Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শরৎকাল || Rabindranath Tagore

শরৎকাল || Rabindranath Tagore

আবার শরৎকাল আসিয়াছে । এই শরৎকালের মধ্যে আমি একটি নিবিড় গভীরতা, একটি নির্মন নিরতিশয় আনন্দ অনুভব করি। এই প্রথম বর্ষা অপগমে প্রভাতের প্রকৃতি কী অনুপম প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করে। রৌদ্র দেখিলে মনে হয় যেন প্রকৃতি কী এক নূতন উত্তাপের দ্বারা সোনাকে গলাইয়া বাষ্প করিয়া এত সূক্ষ্ন করিয়া দিয়াছেন যে, সোনা আর নাই কেবল তাহার লাবণ্যের দ্বারা চারি দিক আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। বায়ু-হিল্লোলের মধ্যে একটি চিরপরিচিত স্পর্শ প্রবাহিত হইতে থাকে, কাজকর্ম ভুলিয়া যাইতে হয়; বেলা চলিয়া যাইতেছে, না মন্ত্রমুগ্ধ আলস্যে অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছে, বুঝা যায় না। শরতের প্রভাতে যেন আমার বহুকালের স্মৃতি একত্রে মিশিয়া রূপান্তরিত হইয়া রক্ত আকারে আমার হৃদয়ের শিরার মধ্যে সঞ্চারম করিতে থাকে। কবিতার মধ্যে অনেক সময়ে এইরূপ স্মৃতিজাগরেণর কথা লেখা হয়, সে কথা সকল সময়ে ঠিক বোঝা যায় না – মনে হয় ও কেটা কবিতার অলংকার মাত্র। হৃদয়ের ঠিক ভাবটি ভাষায় প্রকাশ করা এম্‌নি কঠিন কাজ! বাঁশির শব্দে, পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়, কবিরা বলেন, হৃদয়ের মধ্যে স্মৃতি জাগিয়া উঠে। তাহাকে স্মৃতির অপেক্ষা বিস্মৃতি বলিলেই ঠিক হয়। কিন্তু যে বিস্মৃতি বলিলে একটি অভাবাত্মক অবস্থা বোজায় এ তাহা নয়, এ কেপ্রকার ভাবাত্মক বিস্মৃতি। নহিলে “বিস্মৃতি জাগিয়া উঠা’ কথাটা ব্যবহার হইতেই পারে না। এরূপ অবস্থায় স্পষ্ট যে কিছু মনে পড়ে তাহা নয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পুরাতন কথা মনে পড়িলে যেমনতর মনের ভাবটি হয়, অনেকটা সেইরূপ ভাবমাত্র অনুভব করা যায়। যে-সকল স্মৃতি স্বাতন্ত্র্য পরিহার করিয়া একারার হইয়াছে, যাহাদিগকে পৃথক করিয়া চিনিবার জো নাই, আমাদের হৃদয়ের চেতনরাজ্যের বহির্ভাগে যাহারা বিস্মৃতি-মহাসাগররূপে স্তব্ধ হইয়া শয়ন আছে, তাহারা যেন এক-এক সময়ে চঞ্চল ও তরঙ্গিত হইয়া উঠে; তখন আমাদের চেতনহৃদয় সেই বিস্মৃতি-তরঙ্গের আঘাত অনুভর করিতে থাকে, তাহাদের রহস্যময় অগাধ প্রবল অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়, সেই মহা বিস্মৃতি, অতি বিপুলতার ক্রন্দনধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়।

শরৎকালের সূর্যালোকে আমার এইরূপ অবস্থা হয়। দুই-একটা জীবনের ঘটনা, দুই-একটা অতীতকালের মধুর শরৎ মনে পড়ে, কিন্তু সেইসঙ্গে যে-সকল শরৎকাল মনে পড়ে না, যে-সকল ঘটনা ভুলিয়া গিয়াছি, সেইগুলিই যেন অধিক মনে পড়ে। বছর তিন-চারের পূর্বে একটি শরৎকাল আমি অন্তরের সহিত উপভোগ করিয়াছিলাম। বড়ির প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘরে একটি ছোট্ট ডেস্কের সম্মুখে বাস করিতাম। আরও দুটি-একটি ছোট্ট আনন্দ আমার আশেপাশে আনাগোনা করিত। সে বৎসর যেন আমার সমস্ত জীবন ছুটি লইয়াছিল। আমি সেই ঘরটুকুর মধ্যে থাকিয়াই জগতে ভ্রমণ করিতাম, এবং বহির্জগতের মধ্যে থাকিয়াও ঘরের ভিতরটুকুর মধ্যে যে স্নেহপ্রেমের বিন্দুটুকু ছিল তাহা একান্ত আগ্রহের সহিত উপভোগ করিতাম। আমি যেন একপ্রকার আত্মবিস্মৃতি হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে; তাহার প্রত্যেক সুকুমার বঙ্কিমার লেশটুকুর মধ্যে অপরিসীম প্রেমের ইতিহাস যেন লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তাহার সর্বাঙ্গের সুকোমল সুগোলতার মধ্যে, বিশেষত তাহার বুকের মাঝখানটিতে যেখানে চারি দিকের রঙের ঘোর অতি ধীরে ধীরে নরম হইয়া একেবারে মোলায়েম সাদা হইয়া আসিয়াছে- যেন অনন্তকালের সযত্ন সোহাগের চুম্বন লাগিয়া আছে। অতিশয় আশ্চর্য! একটি গোপন জহরী চাঁপা একটি গোপন সম্পদ তাহার আর সন্দেহ নাই। ইহা ছেলেমানুষের অপরিমন হৃদয়ের মোহমাত্র নহে। এখন সে বিস্ময়ের আনন্দ চলিয়া গেছে। এখন একটা অনাদৃত বুনোলতার বেগুনি ফুলকে নিতান্ত যৎকিঞ্চিৎ মনে হয়। ফুল তো ফুটিবারই কথা। ফুট সুন্দর বটে এবং অনেক ফুল দুর্লভও বটে, কিন্তু তাহার মধ্যে সেই নিবিড় বিস্ময়ের স্থান নাই। ভিক্ষুকের যখন ভিক্ষা বরাদ্দ হইয়া যায়, তখন তাহার আর কৃতজ্ঞতা জন্মে না। শিশুকালে আমরা ভালো করিয়া জানিতাম না চারি দিকের এ অসীম সৌন্দর্য আমাতের নিত্যয়িমিত বরাদ্দ। জননী যেমন প্রতি ক্ষুদ্র কাজে অজস্র স্নেহের দ্বারা আমাদিগকে অনুক্ষণ আছন্ন করিয়া রাখেন, তাহার মধ্যে অনেকটাই আমাদের আবশ্যকের অতিরিক্ত, তাহার অনেকটা আমাদের নজরে পড়ে না, তাহার অনেকটা আমার অবহেলে গ্রহণ করি, কিন্তু উদার মাতৃস্নেহের তাহাতে কিছুই আসে যায় না– ইহাও সেইরূপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress