শতধারায় বয়ে যায় (Shotodharay Boye Jai) : 07
৩১.
গরম জলে চান করে, নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়ে বিনয়। সুধার আজ আর ভুল হয়নি। ধুতি শার্ট আর ফুলহাতা সোয়েটার তো বিনয়ের গায়ে রয়েছেই। সঙ্গে একটা গরম শাল এবং মাফলারও দিয়ে দিল। কাল রাতে ফেরার সময় ঠাণ্ডায় রক্ত প্রায় জমে গিয়েছিল বিনয়ের। আজ অন্তত সেই কষ্টটা পেতে হবে না। সুধা বার বার বলে দিয়েছে, অফিস ছুটির পর সে যেন গলা আর মাথা ভাল করে ঢেকে নেয়।
নতুন ভারত-এর অফিসে দুটোর আগেই পৌঁছে গেল বিনয়। কালকের মতো আজও সারা অফিস জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা। একতলার একদিকে ঝড় তুলে রোটারি মেশিনের ট্রায়াল চলছে। আর একদিকে লাইনো মেশিনের খট খট আওয়াজ। দোতলাতেও টান টান ব্যস্ততা। কোথাও এতটুকু ঢিলেমি নেই।
তেতলায় এসে দেখা গেল, নিউজ ডিপার্টমেন্ট কালকের মতোই সরগরম। প্রুফ-রিডার আর সাব-এডিটরদের বসবার জায়গাটার পাশ দিয়ে হল-ঘরের শেষ মাথায় রিপোর্টিং সেকশনে চলে এল বিনয়।
চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি তার টেবিলে বসে কিছু লিখছিলেন। খানিক দূরে অন্য রিপোর্টারদের জন্য সারি সারি চেয়ার টেবলগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। তবে কি সুধেন্দুরা এখনও আসেনি?
লেখালেখির সময় ডাকলে প্রসাদ বিরক্ত হতে পারেন। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, না নিজের টেবিলে গিয়ে বসবে, বিনয় যখন ঠিক করে উঠতে পারছে না, সেই সময় হঠাৎ প্রসাদ মুখ তুললেন, ও, তুমি এসে গেছ। গুড। সকালে আমার মেসে গিয়েছিলে। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে চান-খাওয়া সেরে অফিসে আসতে দেরি হবে। বোস—
প্রসাদের সামনাসামনি একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে পড়ে বিনয়। টেবলের ওপর একটা বাঁধানো লম্বা নতুন খাতা পড়ে ছিল। সেটা দেখিয়ে প্রসাদ বললেন, আজ অ্যাটেনডান্স রেজিস্টার দিয়ে গেছে। সই কর।
ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না বিনয়ের। সে অবাক তাকিয়ে থাকে।
একটু হেসে প্রসাদ বুঝিয়ে দিলেন, তুমি যে অফিসে এসে ডিউটি দিয়েছ তার রেকর্ড তো থাকা চাই। তোমার উইকলি ছুটির দিন হল রবিবার। ওই দিনটা বাদে বোজ এসে হাজিরা খাতায় সই করবে। নইলে অ্যাবসেন্ট হয়ে যাবে। আরও জানালেন, খবরের কাগজে বছরে কদিন ক্যাজুয়াল লিভ, কদিন আর্নড লিভ, কদিন মেডিক্যাল লিভ, ইত্যাদি।
বিনয়ের এই প্রথম চাকরি। অ্যাটেনডান্স রেজিস্টারে সই এবং ছুটিটুটি সম্পর্কে কিছু জানা গেল। নিশ্চয় অফিসের আরও অনেক নিয়মকানুন আছে। কাজ করতে করতে সেগুলো রপ্ত হয়ে যাবে।
প্রসাদ এবার খাতা খুলে একটা সাদা পাতা দেখিয়ে বললেন, কাল আর আজকের তারিখ দিয়ে পর পর সই করে ফেল। অ্যাটেনডান্স রেজিস্টারটা আমার টেবলে থাকবে। রোজ অফিসে এসে প্রথমেই সইটা করবে।
আচ্ছা।
সইটই সারা হলে বিনয় জিজ্ঞেস করল, আমাদের সেকশানের আর কেউ আসেনি?
সবাই এসেছে। সুধেন্দু আর মণিলালকে একটা কাজে বাইরে পাঠিয়েছি। রমেন লাইব্রেরিতে গেছে।
নতুন ভারত বাজারে বেরুতে এখনও কদিন দেরি আছে। বিনয়কে অবশ্য অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে অন্য রিপোর্টারদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। ততদিন তারা লাইব্রেরিতে গিয়ে অন্য স্টেটের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এমন চমকপ্রদ মালমশলা জোগাড় করুক যা দশ পনেরো দিন পরেও বাসি হয়ে যাবে না। সে-সব সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কথাও বলা হয়েছিল। বিনয় যখন অফিসে থাকবে তাকেও এই ধরনের লেখা তৈরি করতে হবে। প্রসাদের ধারণা, দেরিতে ছাপা হলেও সেগুলো পাঠকদের ভাল লাগবে। কিন্তু আজ হঠাৎ মত পালটে তিনি কি সুধেন্দু আর মণিলালকে রিপোর্টিং-এর দায়িত্ব দিয়েছেন? প্রশ্নটা মাথায় এলেও মুখ ফুটে বলতে সাহস হল না বিনয়ের।
প্রসাদ বললেন, এখানে বসে থেকে আর কী করবে? লাইব্রেরিতে যাও। দেখ, কালকের মতো ভাল কিছু পাও কি না–
বিনয় উঠে পড়ল।
দোতলায় লাইব্রেরিতে আসতে চোখে পড়ল, ডানদিকের শেষ প্রান্তে নাড়ুগোপাল মার্কা, শীতকাতুরে লাইব্রেরিয়ান রামগোপাল দত্ত তার নিজস্ব টেবলটির ওধারে যথারীতি বিরাজ করছেন। গরম পাঞ্জাবি, ফুলহাতা সোয়েটার, শাল, উলের টুপি দিয়ে নিজেকে এমনভাবে দুর্ভেদ্য করে রেখেছেন যে ঠাণ্ডা হাওয়া ভেতরে ঢুকে চামড়ায় কামড় বসাবে তার উপায় নেই।
মাঝখানের মস্ত টেবলটায় এখন দুজন মাত্র পড়ুয়া। রমেন বিশ্বাস একটা ইংরেজি কাগজ থেকে কীসব টুকে নিচ্ছিল। পায়ের শব্দে চোখ তুলে একপলক বিনয়কে দেখে তক্ষুনি মাথা নামিয়ে নিল। কাল যা ঘটেছে তারপর আর কথা বলার মতো মুখ নেই তার।
লাইব্রেরির দুনম্বর পড়ুয়াটিকে আগে দেখেনি বিনয়। মাঝবয়সী। ভারী চেহারা। চোখে মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল চশমা। চওড়া কপাল। মাথায় কঁচাপাকা চুল। দেখামাত্র টের পাওয়া যায় মানুষটি গম্ভীর ধরনের। পরনে মোটা খদ্দরের ধুতি, পাঞ্জাবি এবং আলোয়ান। খুব মগ্ন হয়ে কী একটা বই পড়ছেন। মাঝে মাঝে সেটা থেকে কিছু নোট নিচ্ছেন। অন্য কোনও ব্যাপারেই এখন তার নজর নেই। ইনি নতুন ভারত-এর কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন, জানা নেই। তবে বিনয় যখন এই অফিসে একবার ঢুকেছে, নিশ্চয়ই জেনে যাবে।
লাইব্রেরিতে যখন এসেছে, রামগোপাল দত্তর সঙ্গে আগে দেখা করা উচিত। পড়ার টেবলটা পেছনে রেখে বিনয় যখন ডান দিকে কপা এগিয়ে গেছে, দুহাত তুলে, টুপি-পরা মাথা ঝাঁকিয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন রামগোপাল, না না, একেনে নয়। কাগজপত্তর কোতায় থাকে, কাল সবদেকিয়ে দিইচি। সেগুলো নিয়ে বসে পড়। আগে কাজ, পরে গল্প।
বিনয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রামগোপাল দত্ত কাল নিজে থেকে তাদের ডেকে কত মজার মজার কথা বললেন। আড্ডাবাজ লোকটাকে আজ আর চেনাই যায় না।
রামগোপাল বিনয়ের মনোভাবটা আঁচ করে নিয়েছিলেন। বললেন, কাল তোমাদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে ডেকে নিয়েছিলুম। আলাপ হয়ে গেছে। কাজের পর যদি সময় পাওয়া যায় তকন ফের তোমাদের ডাকব।
বিনয় ঘুরে লাইব্রেরির অন্য প্রান্তে চলে যায়। সেখানকার সারি সারি তাকগুলো থেকে বম্বের। তিনটে কাগজের ফাইল নামিয়ে পড়ার টেবলে এসে বসে। এগুলো গত মাসের ফাইল। কাগজগুলো হল বম্বে ট্রিবিউন, ফ্রি প্রেস জার্নাল আর টাইমস অফ ইন্ডিয়া।
ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর একটা চমৎকার রিয়েল লাইফ স্টোরি পাওয়া গেল। পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে যায় বিনয়। এবং অভিভূতও।
কাল পাওয়া গিয়েছিল লাহোরের এক তরুণী নীলমের কাহিনী। আজ যার সম্বন্ধে বিনয় পড়ছে সে করাচির একটি বালক। নাম দীনেশ। লেখার সঙ্গে তার ফোটেও ছাপা হয়েছে। বড় কোমল, বড় স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি।
কাগজের প্যাডে লেখাটার মূল পয়েন্টগুলো টুকে নিতে নিতে বার বার বিনয়ের মনে হচ্ছে, দেশর্ভাগ কতভাবেই না এই উপমহাদেশকে আলোড়িত করে যাচ্ছে।
দীনেশের কাহিনিটা এইরকম।
দীনেশদের আদি বাড়ি ছিল সিন্ধু প্রদেশের নগণ্য শহর খায়েরপুরে। শহরটা বিখ্যাত ভুট্টো পরিবারের জমিদারি লারকানার লাগোয়া।
ভারতবর্ষের আর দশটা মফস্বল শহর যেমন হয়, খায়েরপুর তার থেকে আলাদা কিছু নয়। শান্ত। উত্তেজনাশূন্য। সারাক্ষণ যেন ঘুমিয়েই আছে। জীবন সেখানে ঢিমে চালে রয়ে যেত। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। এতটুকু পরিবর্তন নেই। সময় পরমাশ্চর্য কোনও ম্যাজিকে সেখানে থমকে ছিল।
শহরের গা ঘেঁষে দীনেশদের বেশ কিছু জমিজমা ছিল। চাষবাস এবং ছোটখাটো ব্যবসা, এই নিয়েই তার পূর্বপুরুষেরা সন্তুষ্ট থেকেছে। কেউ লেখাপড়ার ধার ধারত না। কোনও উদ্যোগ নেই, বড় কিছু ভাবার বা করার মতো উদ্যম নেই। খায়েরপুর আর ভুট্টোদের লারকানার বাইরে বংশের কেউ কোনওদিন পা বাড়ায়নি।
কিন্তু দীনেশের ঠাকুরদা ছোটিরাম শিবদাসানি ছিলেন অন্য ধাতের মানুষ। একরোখা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। পৃথিবীর কলরোল থেকে বহুদূরে অতি তুচ্ছ, ঘুমন্ত এক শহরে একঘেয়ে, ম্যাড়মেড়ে জীবন কাটিয়ে দেবার ইচ্ছা তার ছিল না। বাড়ির কেউ চায়নি, তবু সব বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি চলে এসেছিলেন করাচিতে তাঁদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নিজের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করে করাচি পোর্টে চাকরি নিয়েছিলেন।
তখন ইংরেজ আমল। করাচিতে দিনগুলো মসৃণভাবেই কেটে যাচ্ছিল। ছুটিছাটায় মাঝে মাঝে তিনি খায়েরপুরে যেতেন। মা-বাবা সেখানেই থাকতেন। ছোটিরাম তাদের একমাত্র সন্তান। তবে ওঁদের ছিল বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। বিষয় সম্পত্তিরও যৌথ মালিকানা। কাকা-জেঠা, তাদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে মড়িয়ে একই সংসারে ছিল।
চাকরিতে ঢোকার বছর দুই বাদে পোর্টের কোয়ার্টার পেয়েছিলেন ছোটিরাম। তার এক বছর পর বিয়ে। মা-বাবাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলেন। জোর করে দু-একবার নিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু খায়েরপুরের মাটিতে তারা বাহান্ন পাকে এমন জড়িয়ে ছিলেন যে করাচির মতো বড় শহরে লোকজনের ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠতেন। এক সপ্তাহের বেশি তাদের আটকে রাখা যেত না।
স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন ছোটিরামের একটি ছেলে হল। নাম দেওয়া হল অবিনাশ। ছোটিরাম যেমন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অবিনাশও তাই। তার কোনও ভাইবোন নেই। ছোটিরাম খুব যত্ন করে ছেলেকে মানুষ করে তুললেন। অবিনাশ করাচির এক কলেজ থেকে বি এ পাস করে পোর্টে ভাল চাকরি পেল। প্রথমে জুনিয়র অফিসার। তিন বছরের মধ্যে সিনিয়র গ্রেডে প্রমোশন। বড় কোয়ার্টার দেওয়া হল তাকে। মা-বাবাকে নিয়ে সেখানে উঠে গেল সে। নতুন কোয়ার্টারে যাবার পর অবিনাশের বিয়ে দিলেন ছোটিরাম।
তারপর একের পর এক কত ঘটনা। ছোটিরামের রিটায়ারমেন্ট। তার মৃত্যু। কয়েক বছর বাদে তার স্ত্রী, অর্থাৎ অবিনাশের মাও মারা গেলেন।
জাগতিক নিয়মে কোনও কিছুই ফাঁকা পড়ে থাকে না। অবিনশের একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হল। বীণা আর দীনেশ। বীণা বড়, দীনেশ ঘোট। মা-বাবার শূন্য স্থান তারা ধীরে ধীরে পূরণ করে দিতে লাগল।
অবিনাশের চোখের সামনে আকাশপ্রমাণ কোনও স্বপ্ন ছিল না। মধ্যবিত্তদের যেমন হয় তেমনি ছিল ছোট মাপের কিছু আশা। ছোট ছোট কিছু ইচ্ছা। বীণা আর দীনেশ যতদূর পড়তে চায়, পড়াবে। বীণার ভাল বিয়ে দেবে। করাচিতে একটা বাড়ি করে ছবির মতো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। খায়েরপুরে পারিবারিক বিষয় আশয়ের প্রতি তার কোনও মোহ ছিল না। নিজের ভাগেরটা সে খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইদের লিখে দিয়েছিল।
করাচির যে এলাকায় অবিনাশরা থাকত সেটা পাঁচমেশালি। মুসলমানই বেশি। কিছু সিন্ধুপ্রদেশের হিন্দু। কিছু শিখ। কিছু গোয়ান পি এবং ভারতের অন্য সব প্রভিন্সের সামান্য কিছু মানুষ। সবাই বন্দরের কর্মী।
পাঁচ ভাই একসঙ্গে থাকলে ঝগড়াঝাটি বাধে। বাসনকোসন পাশাপাশি রাখলে ঠোকাঠুকি লাগে। মাঝে মাঝে এই ধরনের তুচ্ছ ব্যাপার ঘটলেও অবিনাশদের মহল্লায় বড় রকমের অশান্তি কখনও হয়নি।
অবিনাশ কারও সাতে-পাঁচে থাকত না। শান্ত, নির্বিরোধ, ভালমানুষ। নিজের সংসার, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে তখন মশগুল। তবে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, আর পিদ্রুই হোক, প্রতিবেশী সবার সঙ্গেই ছিল তার সদ্ভাব।
ইচ্ছাপূরণের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। ছেলেমেয়েরা ভালভাবেই মানুষ হচ্ছিল। নামকরা স্কুলে তারা পড়ত। লেখাপড়া শেষ হলে সৎ পাত্রের সঙ্গে বীণার বিয়েও হতো। করাচি পোর্টে কেউ রিটায়ার করলে সেই আমলে তার ছেলে, ছেলে না থাকলে তার পরিবারের কেউ চাকরি পেত। সেদিক থেকে দীনেশের ভবিষ্যৎ ছিল সুরক্ষিত। হাতে কিছু টাকা জমেছিল অবিনাশের। বাড়ির জন্য পছন্দমতো জমির খোঁজ করছিল সে। আপাতত জমিটা কেনা হয়ে থাক, পরে লোন টোন নিয়ে বাড়ি তৈরির কাজে হাত লাগানো হবে, এইরকমই ছিল তার পরিকল্পনা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। অবিনাশের সমস্ত আশা, সব স্বপ্ন চোখের পলকে নির্মূল হয়ে গেল।
উনিশ শ ছেচল্লিশে আকাশ বাতাস টু নেশন থিওরির বিষে ভরে গেছে। জিন্না এবং মুসলিম লিগ তাদের দাবিতে অনড়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান চাই-ই চাই। মুখের কথায় না হলে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লন্ডন থেকে যে ক্যাবিনেট মিশন এসেছিল তারা ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। নিরীহ, হতদরিদ্র, সাধারণ মানুষ যারা রাজনীতির র টুকু বোঝে না তাদের রক্তে ভেসে গেল দেশ।
সমস্ত দেশ যখন জ্বলছে, করাচি কি গা বাঁচিয়ে শান্তির দ্বীপ হয়ে থাকতে পারে? আগুনের আঁচ সেখানে এসেও লাগল। শুধু করাচিতেই না, গোটা সিন্ধু প্রদেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল।
করাচি সশস্ত্র হননকারীদের দখলে চলে যাবার পর তারা মহল্লায় মহল্লায় হানা দিতে লাগল। পোর্ট এলাকাও রেহাই পেল না।
একদিন রাতে বেছে বেছে পোর্টের কোয়ার্টারগুলোতে তুমুল হল্লা করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল দাঙ্গাবাজেরা। ভেতর থেকে টেনে টেনে বাসিন্দাদের বার করে তলোয়ার বল্লম দা ডাণ্ডা দিয়ে খুঁচিয়ে। কুপিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিতে লাগল। গর্ত থেকে ইঁদুর বার করে যেভাবে মারা হয়, অবিকল তেমনি।
কিন্তু সবাইকে জল্লাদের নাগালের ভেতর পায়নি। অনেকেই তাদের চোখ এড়িয়ে কোয়ার্টারের পেছন দিকের দরজা দিয়ে পালাতে পেরেছিল। অবিনাশ শিবদাসানির পরিবারও ধরা পড়তে পড়তে নেহাত আয়ুর জোর ছিল বলেই, বেঁচে গেছে। কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে তারা পাগলের মতো ছুটতে শুরু করেছিল। কোথায় যাচ্ছে, জানে না। প্রাণ বাঁচানো যাবে কি না, জানে না। দঙ্গল দঙ্গল হত্যাকারী মারণাস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। তাদের কারও খপ্পরে পড়ে যাবে কি না, জানে না। শুধু দৌড়, দৌড় আর দৌড়।
শেষ পর্যন্ত ওরা একটা রিলিফ ক্যাম্প অর্থাৎ ত্রাণশিবিরে পৌঁছাতে পেরেছিল। আর তখনই দেখা গেল, সবাই আসতে পেরেছে, শুধু দীনেশ বাদ। দীনেশের বয়স তখন চার। প্রাণভয়ে পালাবার সময় কখন সে কোনদিকে ছিটকে পড়েছিল, টের পাওয়া যায়নি।
অবিনাশ এবং তার স্ত্রী প্রতিভা উন্মাদের মতো ছেলের খোঁজে তখনই বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল কিন্তু ত্রাণশিবিরের সুপারভাইজার এবং রক্ষীরা তাঁদের বেরুতে দেয়নি। বেরুনো মানেই দাঙ্গাবাজদের হাতে পড়ে চোখের পলকে লাশে পরিণত হওয়া।
মাস কয়েকের মতো করাচির সেই ত্রাণশিবিরে কাটাতে হয়েছে অনিনাশদের। এর মধ্যে দেশের হাল আরও খারাপ হয়েছে। পরিবেশ আরও বিষময়। আরও অগ্নিগর্ভ। হত্যা আর সন্ত্রাসের মাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে আরও বেড়ে যাচ্ছিল।
ছেলে-হারানোর বুকফাটা শোকে চান-খাওয়া একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অবিনাশের। প্রতিভার চোখের জল ফুরতো না। দিবারাত্রি কেঁদেই যেত। কেঁদেই যেত। অবিরল কান্না।
ত্রাণশিবিরের কর্মী এবং সুপারভাইজারকে তো বটেই, মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেবার জন্য যে নেতা এবং পুলিশ অফিসাররা আসতেন প্রতিভা এবং অবিনাশ তাদের হাতে-পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করত, দীনেশকে যেন তারা খুঁজে এনে দেন। কিন্তু সেই নিদারুণ সময়ে শয়ে শয়ে শিশু, কিশোর, যুবক যুবতী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের হাজারটা দায়িত্ব–দাঙ্গা থামানো। সাম্প্রদায়িক উসকানি বন্ধ করা, শান্তি ফিরিয়ে আনা। যারা দাঙ্গায় হারিয়ে গেছে তাদের আলাদা আলাদা ভাবে উদ্ধার করে পরিজনদের কাছে ফিরিয়ে দেবার মতো সময় কোথায়?
একদিন জাহাজ বোঝাই করে করাচি এবং চারপাশের ত্রাণশিবিরগুলো থেকে সিন্ধু প্রদেশের হিন্দু আর শিখদের বোম্বাইতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। বোম্বাইয়ে ধোবি তালাও এলাকার এক শরণার্থী শিবিরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। ওখানে থাকতে থাকতেই বোম্বাই পোর্টে যোগাযোগ করে অবিনাশ। সে যে করাচি বন্দরে কাজ করেছে অফিসার গ্রেডে, দাঙ্গার জন্য প্রমাণপত্র নিয়ে আসতে পারেনি, সে সব সবিস্তার জানাবার পর এবং তার কাজকর্মের অভিজ্ঞতা শুনে বোম্বাই পোর্ট তাকে চাকরি দেয়। তবে অফিসার গ্রেডে নয়। মাথা গোঁজার মতো একটা কোয়ার্টারও পেয়ে যায় সে।
বোম্বাইতে আসার পরও দীনেশের ব্যাপারে আশা ছেড়ে দেয়নি অবিনাশরা। ফি সপ্তাহে দু-একবার করে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে কিংবা ভারত সরকারের রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন মিনিস্ট্রির বোম্বাই অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকত। তার একটাই আর্জি, করাচি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে দীনেশকে যেন তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
বছর তিনেক একটানা লেগে থাকার পর দীনেশকে ফিরে পাওয়া গেল। বোম্বাই পুলিশের অনবরত তাগাদায় করাচি পুলিশ এবং সেখানকার রেসকিউ টিম দাঙ্গায় নিখোঁজ মানুষজনের সঙ্গে দীনেশেরও খোঁজখবর করতে থাকে। সেই সঙ্গে উর্দু, ইংরেজি এবং সিন্ধি ভাষার কাগজগুলোতে নিরুদ্দিষ্টদের তালিকা ছেপে আবেদন করা হয়, এদের সন্ধান পাওয়া গেলে তক্ষুনি যেন অনুগ্রহ করে পুলিশ বা উদ্ধারকারী দলের অফিসে যোগাযোগ করা হয়।
খবরের কাগজে দীনেশের নাম দেখে আবু হামিদ নামে এক প্রৌঢ় মুসলমান তাকে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে নিয়ে আসে। জানায়, করাচির দাঙ্গার সময় দীনেশদের পরিবার যখন উদভ্রান্তের মতো পালাচ্ছে, সে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। প্রচণ্ড ভয়ে সমানে কাঁদছিল দীনেশ আর দিশেহারার মতো ছোটাছুটি করছিল। হামিদ শহরে একটা জরুরি কাজে এসেছিল। তাকে দেখতে পেয়ে কোলে তুলে নেয়। পরে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়।
হামিদদের বাড়ি করাচিতে নয়। শহর থেকে মাইল দশেক দূরে শাহিদাবাদ নামে একটা গ্রামে। দীনেশ তখন খুবই ছোট। নিজের নাম আর বাবার নামটা কোনও রকমে বলতে পারলেও তারা করাচির কোন মহল্লায় থাকত, তার বাবা কী করত, বাড়ির আর কে কে আছে, এ-সব কোনও হদিসই দিতে পারেনি।
স্ত্রী এবং তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে হামিদের সংসার। প্রথম প্রথম সেখানে গিয়ে দীনেশ খেত না, ঘুমতো না, অবিরাম কাঁদত। কেঁদেই যেত।
তারপর ধীরে ধীরে একদিন কান্না থামল। আবু হামিদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে গেল সে। দাঙ্গায় বাপ-মা এবং অন্যান্য পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বালকটিকে হামিদ এবং তার স্ত্রী অপার মমতায় মানুষ করে তুলতে লাগল। দীনেশ হয়ে উঠল তাদের চতুর্থ সন্তান।
হামিদ সৎ, ইমানদার মানুষ। নাম শুনেই জানতে পেরেছে দীনেশরা হিন্দু। সে হিন্দুরা যা খায় না কখনও তাকে তা খাওয়ায়নি। তাকে মুসলমান করার চেষ্টা করেনি। সব সময় ছেলেটাকে আগলে আগলে রেখেছে। বড় হবার পর জ্ঞানবুদ্ধি হলে দীনেশ কোন ধর্ম পালন করবে সেটা তার ওপর ছেড়ে দেবার কথা ভেবে রেখেছিল সে।
করাচির দাঙ্গার পর কবছর কেটে গেছে। দীনেশ এখন সাতবছরের বালক। দাঙ্গার কথা, মা বাবা-বোনের মুখ ক্রমশ তার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল।
হয়তো বাকি জীবনটা শাহিদাবাদেই কেটে যেত দীনেশের। কিন্তু হঠাৎ খবরের কাগজে পুলিশের বিজ্ঞপ্তিটা চোখে পড়ে যায় আৰু হামিদের। বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠেছিল তার। যে শিশুটিকে বিপুল স্নেহে বড় করে তুলেছে তাকে কিছুতেই ফিরিয়ে দেবে না। পরক্ষণে খেয়াল হল, দীনেশকে হারিয়ে তার মা-বাবার জীবন নিশ্চয়ই ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ায় গিয়ে কোনও রকমে তারা হয়তো বেঁচে আছে।
আবু হামিদ স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে দীনেশকে ইন্ডিয়ায় পাঠানোই ঠিক করে ফেলল। যদিও বুক ফেটে যাচ্ছিল, তবু মনে হচ্ছিল এটাই নির্ভুল সিদ্ধান্ত। এবং ওপরওলার এমনই ইচ্ছা।
নতুন কুর্তা প্যান্ট জুতো কিনে, দীনেশকে পরিয়ে করাচি পুলিশের হেড কোয়ার্টার্সে নিয়ে এল হামিদ। তারপর অঝোরে চোখের জলে বিদায়।
তিনদিন বাদে দাঙ্গায় নিখোঁজ আরও অনেক মানুষের সঙ্গে বোম্বাই চলে এল দীনেশ। প্রথমে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে। সেখান থেকে তার আসল মা-বাবা অবিনাশ আর প্রতিভার কাছে। যে সন্তানের কোনও আশাই ছিল না তাকে ফিরে পেয়ে একেবারে উন্মাদ হয়ে গেল অবিনাশরা। সারা বাড়িতে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে যেতে লাগল। ছেলেকে কীভাবে আদর করবে, কোথায় বসাবে, ভাল ভাল কী খাবার খাওয়াবে, কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছিল না। এই তার গালে মাথায় বুকে হাত বুলিয়ে আদর করছে। এই কোলে তুলে নিচ্ছে। দোকানে নিয়ে দামি দামি পোশাক কিনে দিচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে। মেরিন ড্রাইভে। জুহু বিচে। এলিফ্যান্টা কেভে। দীনেশের আসার খবর পেয়ে পড়োশিরা ছুটে এসেছিল। এসেছিল আত্মীয়-পরিজনেরা। তারা একমত হয়ে জানিয়ে দিল, তিন বছর যে ছেলে মুসলমানের ঘরে কাটিয়ে এসেছে তার শুদ্ধিকরণ ভীষণ জরুরি। অতএব নিষ্ঠাভরে যাবতীয় দেবদেবীকে তুষ্ট করার জন্য পুজো হোম চলল। চলল দিবারাত্রি গীতা এবং চণ্ডীপাঠ। হোমের ঘূতের গন্ধে, ধূপের সুবাসে সারা বাড়ি যেন তপোবন হয়ে উঠল।
এত যে আদরযত্ন, শোধনের এত যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কিন্তু দীনেশ সারাক্ষণ মনমরা, অন্যমনস্ক। রাতে ঘুমের ঘোরে কিংবা একটু একলা হলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদে, আব্ব, আম্মী–ওই নামেই আবু হামিদের ছেলেমেয়েরা তাকে এবং তার স্ত্রীকে ডাকত। দেখাদেখি দীনেশও ডাকতে শিখেছিল। নিজের মা-বাবার কাছে এসেও বহুদূরের, অন্য ধর্মের আশ্রয়দাতা মা-বাবাকে সে লহমার জন্যও ভুলতে পারেনি। তার মন সর্বক্ষণ করাচি থেকে দশ মাইল দূরের এক গ্রামে পড়ে থাকত।….
কাগজের প্রতিবেদনটা এখানেই শেষ। লাইব্রেরিতে বসেই দীনেশের জীবনের এই বিচিত্র কাহিনী সাজিয়ে গুছিয়ে বিনয় যখন লেখাটা শেষ করল, সন্ধে হয়ে গেছে। রমেন বিশ্বাসকে লাইব্রেরিতে দেখা গেল না, কখন সে তার কাজ সেরে চলে গেছে, টের পাওয়া যায়নি। তবে সেই প্রৌঢ় গম্ভীর মানুষটি মগ্ন হয়ে বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন। দূরের টেবলে লাইব্রেরিয়ান রামগোপাল দত্ত শীতের পোশাকে সারা শরীর ভাল করে মুড়ে বিরাজ করছেন।
বিনয় আর বসল না। লেখার কাগজগুলো গুছিয়ে পিন দিয়ে গেঁথে একবার পড়ে নিল। দু একটা শব্দ পালটে নতুন শব্দ বসিয়ে সোজা তেতলায় নিউজ ডিপার্টমেন্টে তাদের রিপোর্টিং সেকশানে চলে এল।
প্রসাদ লাহিড়ি তার চেয়ারে যথারীতি বসে আছেন। তার মুখোমুখি রমেন বিশ্বাস। দুজনে কথা বলছিলেন। সুধেন্দু আর মণিলালকে দেখা গেল না। খুব সম্ভব তারা এখনও ফেরেনি।
বিনয়কে দেখে তার দিকে তাকালেন প্রসাদ। একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু পাওয়া গেল?
বিনয় বলল,— লেখাটা হাতেই ছিল। সেটা প্রসাদের দিকে বাড়িয়ে দিল।
লেখাটা নিয়ে বোসো– বলে প্রসাদ পড়তে শুরু করলেন।
নিঃশব্দে রমেনের পাশের চেয়ারে বসে একদৃষ্টে প্রসাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল বিনয়।
পড়া শেষ হলে প্রসাদ কপিটা টেবলে নামিয়ে রেখে রীতিমতো উচ্ছ্বাসের সুরে বললেন, ফাইন। এরকম হিউম্যান স্টোরি আরও পাও কি না দেখো।
নিজের অজান্তেই বিনয়ের দুই চোখ রমেনের দিকে চলে যায়। প্রসাদের মুখে তার লেখার প্রশংসা শুনতে শুনতে রমেনের মুখ হিংসেয় পুড়ে যাচ্ছে।
প্রসাদ বললেন, আজ সকালে আমার মেসে গিয়েছিলে। তাই সময় পাওনি। খুব তাড়াতাড়ি রিফিউজি কলোনিগুলোতে যাওয়া শুরু কোবরা। পারলে কাল থেকে।
মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বিনয় বলে, আচ্ছা
এখন অফিসে তোমার কোনও কাজ নেই। ইচ্ছে হলে বাড়ি যেতে পার।
বিনয় আর বসল ন। ধীরে ধীরে উঠে পড়ল।
৩২.
শুক্রবার অফিসে জয়েন করেছিল বিনয়। শনিবার গিয়েছিল প্রসাদদের শান্তিনিবাস-এ। আজ রবিবার। তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
তবু বিনয় ঠিক করে রেখেছিল, প্রসাদ রিফিউজি কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পের যে লিস্টটা দিয়েছেন তার কোনও একটায় আজ সকালে যাবে। কিন্তু কাল রাত্তিরে অফিস থেকে ফেরার সময় ঠাণ্ডা লেগে জ্বর জ্বর লাগছে। তাই সে ভেবেছে, আজ আর বেরুবে না। বেশি ঘোরাঘুরি করলে জ্বর যদি বেড়ে যায়, কাল অফিসে যাওয়া সম্ভব হবে না। কাজে জয়েন করে দুদিন যেতে না যেতেই কামাই করাটা খুব খারাপ দেখাবে। তাই সারাদিন বিশ্রাম তো নেবেই, তেমন দরকার বুঝলে দু একটা ইনফ্লুয়েঞ্জার বড়িও খাবে।
এখন আটটার মতো বাজে।
বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিল হিরণ আর বিনয়। মাঝে মধ্যে এলোমেলো, অসংলগ্ন কিছু কথাও হচ্ছিল। বাঙালিদের প্রতি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের বৈষম্য, কাশ্মিরে পাকিস্তানিদের হানাদারি, জিনিসপত্রের চড়া দর, ইত্যাদি।
কথার ফাঁকে হঠাৎ হিরণ জিজ্ঞেস করল, তোমার তো আজ অফ-ডে। কোথাও বেরুবে টেরুবে না তো?
জ্বরের ব্যাপারটা বাড়ির কাউকে জানায়নি বিনয়। জানালে সবাই বিশেষ করে সুধা অস্থির হয়ে উঠবে। বলল, না। কেন বলুন তো?
কয়েকজন আসবে। তুমি বাড়িতে থাকলে ভাল হয়।
কারা আসবে?
হিরণ হাসল, অচেনা কেউ নয়। একটু ওয়েট কর। নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
মিনিট পনেরো কুড়ি বাদে বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল। কেউ ডাকছে, হিরণ প্রধা দরজা খোল। সেই সঙ্গে কড়া নাড়ার একটানা খটখটানি।
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ হাত থেকে নামিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল হির। ওরা এসে গেছে বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে নেমে গেল সে।
যে ডাকছিল তার কণ্ঠস্বরটি খুবই চেনা। আনন্দ এসেছে। সে যে আজ আসবে, হিরণ কি সুধা আগে জানায়নি। অবাক হয়ে বসে থাকে বিনয়।
খানিক পরে শুধু আনন্দই না, হিরণের সঙ্গে সুনীতি আর শিশিরও দোতলায় উঠে এসেছেন। এই তোপরশুদিন আনন্দ এ-বাড়িতে এসে তাকে সঙ্গে করে নতুন ভারত-এর অফিসে গিয়েছিল। আজই যে সে আবার আসবে, ঘুণাক্ষরে তা জানায় নি। জানাতে যে হবে, এমন কোনও কথা নেই। সুনীতিকে নিয়ে সে যখন ইচ্ছা শালী এবং ভায়রার বাড়ি আসতেই পারে কিন্তু ঝুমার বাবা শিশির যে ওদের সঙ্গে চলে আসবেন তা ভাবা যায় নি। রীতিমতো অবাক হয়ে যায় বিনয়।
হিরণ শিশির আর আনন্দ ঘরে চলে আসে। সুনীতি কিন্তু ঢুকল না। দরজার বাইরে থেকে আনন্দকে বলল, তোমরা এখানে বোসো। আমি ভেতরে সুধার কাছে যাচ্ছি। সে চলে যায়।
শিশিরকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিনয়। তাকে বসতে বলে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন শিশির। হিরণ আর আনন্দও বসল।
সেই যুদ্ধের গোড়ার দিকে এক পুজোর ছুটিতে শিশির, তার স্ত্রী স্মৃতিরেখা, দুই মেয়ে রুনা ঝুমা রাজদিয়ায় গিয়েছিল। তার বছর তিনেক বাদে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জাপানি বোমার আতঙ্কে কলকাতায় যখন ইভাকুয়েশন শুরু হয়ে গেছে, শহর কঁকা করে যে যেদিকে পারে পৈতৃক প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় শিশিররা ফের রাজদিয়ায় গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন। এই দুবারই শিশিরকে যা দেখেছিল বিনয়। পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর একদিন রাস্তা থেকে জোর করে ঝুমা হেদুয়ার কাছে তাদের রমাকান্ত চ্যাটার্জি লেনের বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন শিশির অফিসে। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
রাজদিয়ার পর কলকাতায় এই প্রথম শিশিরকে দেখল বিনয়। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল বেয়াল্লিশ তেতাল্লিশ। চুলে অল্প অল্প সাদা ছোপ ধরতে শুরু করেছে। বয়স সেভাবে কামড় বসাতে পারেনি। বেশ সুপুরুষ ছিলেন। টান টান সতেজ চেহারা। মসৃণ ত্বক। চওড়া কপাল। দৃষ্টিশক্তির জোর ছিল। তখনও চশমার দরকার হয়নি।
তারপর কবছর কেটে গেছে। সেই তেজী ভাবটা আর নেই। চুল আধাআধি পেকে গেছে। শরীর জুড়ে প্রচুর ভাঙচুর। চামড়া আর তেমন চিকন নয়, সরু সরু অগুনতি রেখা ফুটে বেরিয়েছে। সারা মুখে কালচে ছোপ। পিঠটা সামান্য নুয়ে পড়েছে। একটু ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটেন। চোখে এখন বাই ফোকাল চশমা। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, বয়স তাকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে।
বিনয় জানে বিরাট ব্রিটিশ ফর্মে চাকরি করেন শিশির। অফিসে স্যুটে-বুটে পাক্কা সাহেব। কিন্তু বাড়িতে কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে গেলে তার পুরো বাঙালি পোশাক। সুধাদের বাড়িতে ধুতি, সার্জের পাঞ্জাবি আর শাল পরে এসেছেন।
শিশির বিনয়কে বললেন, কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভাল আছ তো?
গা-ব্যথা আর জ্বর জ্বর ভাবের কথাটা জানালো না বিনয়। বলল, হ্যাঁ।
তোমার সব খবরই আনন্দ আর সুনীতির কাছে পাই। পাকিস্তান থেকে পার্মানেন্টলি চলে এসেছ। আসার পথে ভীষণ বিপদে পড়েছিলে। যে-কোনও সময় রাজাকাররা খুন করে ফেলত। ভগবানের অসীম করুণা, শেষ পর্যন্ত সেফলি ইন্ডিয়ায় এসে পৌঁছেছ। ইস্ট বেঙ্গলে ফেরার কথা আর চিন্তাও কোরো না।
না, আর ফেরার প্রশ্নই নেই।
হেমজেঠা গোঁয়ার্তুমি করে দেশে থেকে গেলেন। খুব ভুল করেছেন। আমার বাবা আসার সময় বার বার ইন্ডিয়ায় চলে আসতে বলেছিলেন। শুনলেন না।
শিশিরদের বাড়ি বিনয় যেদিন যায়, তার বাবা অর্থাৎ রামকেশবের মুখে এই কথাই শুনেছিল। সে জানে কারও পরামর্শেই কর্ণপাত করবেন না হেমনাথ। তার এক গোঁ, জন্মভূমি ছেড়ে আসবেন না।
বিনয় কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই শিশির ফের বললেন, হেমজেঠার কোনও খবর পেয়েছ?
বিনয় বলল, বেশ কিছুদিন আগে একখানা চিঠি পেয়েছিলাম। তারপর একদম চুপচাপ। আমরা ভীষণ চিন্তায় আছি। একটু থেমে বলল, রাজদিয়ার নিত্য দাস এপারে চলে এলেও পাকিস্তানের বহু লোকের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে।
জানি।
সে-ই দাদুর প্রথম চিঠিটা আনিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বলে গেছে, যত তাড়াতাড়ি পারে পরের চিঠিটা আনবে।
একটু চিন্তা করে শিশির বললেন, যদি দিনকয়েকের ভেতর হেমজেঠার চিঠিপত্র না পাও, আমাকে জানিও। আমার এক বন্ধু তোফায়েল আমেদ এখন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। তার সঙ্গে কনট্যাক্ট করে হেমজেঠার খবর আনিয়ে দেব।
চকিতে বিনয়ের মনে পড়ে যায়, সেদিন রামকেশব তোফায়েল আমেদের কথা বলেছিলেন। তিনিই রামকেশবের ইন্ডিয়ায় চলে আসার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রামকেশব ঝিনুক সম্পর্কে নিষ্ঠুর মন্তব্য করায় অসহ্য রাগে বিনয়ের মস্তিষ্কে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে আর কখনও শিশিরদের বাড়ি যাবে না। সেদিন ওখান থেকে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে তোফায়েল আমেদের কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
বিনয় বলল, তাহলে খুবই ভাল হয়। দাদুর চিঠি না এলে আনন্দদাকে জানিয়ে দেব, আনন্দদা আপনাকে বলে আসবে।
আনন্দদা কেন? তুমি তো আমাদের বাড়ি চেনো। নিজেই চলে এস।
রামকেশবের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিনয় উত্তর দিল না।
শিশিরের আসার খবর পেয়ে দ্বারিক দত্ত বাইরের ঘরে চলে এলেন। তাকে দেখে শিশির আর আনন্দ উঠে গিয়ে প্রণাম করল।
দ্বারিক দত্ত একটা সোফায় বসে আনন্দদের বসতে বলে অভিযোগের সুরে শুরু করলেন, শিশির, তুই এই বুড়ো মানুষটাকে একেবারে ভুলে গেছিস। আনন্দ তবু মাঝে মাঝে আসে। পাকিস্তান থেকে কবে চলে এসেছি। একবার তো লোকে দেখা করে যায়?
বিব্রত শিশির বললেন, এই, মানে
এরপর কিছুক্ষণ দেশের কথা হল। সাতচল্লিশের ভাগাভাগির পর পূর্ব বাংলা এখন ছারখার। দ্বারিক দত্তর গলায় শুধু আক্ষেপ। লাখ লাখ মানুষ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে শেষ হয়ে গেল। এই স্বাধীনতার কোনও প্রয়োজন ছিল।
ঘরের আবহাওয়া থমথমে হয়ে যায়।
এই সময় কলরোল তুলে সুধা বাইরের ঘরে ঢুকল। তার সঙ্গে সুনীতি। ওদের হাতে কাঠের নকশা-করা ট্রেতে চায়ের কাপ আর চীনামাটির বড় বড় প্লেটে লুচি, বেগুন ভাজা, আলুকপির তরকারি, মিষ্টি। এর মধ্যেই শিশিরদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে ফেলেছে সুধা।
কাপ-প্লেট নিচু সেন্টার টেবলে সাজিয়ে দিতে দিতে সুধা শিশিরকে বলল, কি মশাই, সেই দুবছর আগে একবার এ-বাড়িতে এসেছিলেন। এতদিনে আমাদের কথা মনে পড়ল। তার গলায় অনুযোগ। হয়তো সামান্য অভিমানও।
রাজদিয়ায় যখন সুধা শিশিরকে দেখেছিল তখন তার বয়স অনেক কম। রাশভারী, প্রৌঢ় মানুষটার কাছে বিশেষ ঘেঁষত না। বেশ দূরে দূরেই থাকত। কিন্তু আনন্দর সঙ্গে সুনীতির বিয়ে হবার পর থেকে সম্পর্কটা অন্যরকম হয়ে গেছে। বয়সের তফাত সুধা আর মানেই না।
দেখা হলে দিদির ননদের স্বামীর সঙ্গে সমানে ঠাট্টা ইয়ারকি করে। শিশির কাচুমাচু মুখে বললেন, অফিসে এত কাজের চাপ যে কোথাও যাব, কারও সঙ্গে দেখা করব, তেমন সময় করে উঠতে পারি না।
সুধা বলল, রবিবারেও আপনার অফিস থাকে না কি?
শিশির সুধাকে একটু ভয়ই পান। মেয়েটার কথায় রাখঢাক নেই। কারওকেই সে তিলমাত্র রেয়াত করে না। বললেন, সব কাজ অফিসে শেষ করতে পারি না। অনেক ফাইল বাড়িতে এনে দেখতে। হয়।
জানি জানি, আপনি বিরাট কাজের লোক। সুধা ঝংকার দিয়ে ওঠে, তবু তারই ভেতর আত্মীয়স্বজনদের কাছে যেতে হয়, নইলে সম্পর্ক থাকে না। তাছাড়া
একটার পর একটা তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তটস্থ শিশির জিজ্ঞেস করলেন, তাছাড়া কী?
আমরা পৃথিবীর বাইরে থাকি না। হেদুয়া থেকে আমাদের এই টালিগঞ্জ সাত-আট মাইলের বেশি হবে না। ইচ্ছে থাকলে এটুকু পথ কষ্ট করে আসা যায়।
শিশির ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন, তা অবশ্য যায়। তবে ওই যে বললাম, কাজের প্রেসার।
শিশিরকে কোণঠাসা হতে দেখে ঘরের সবাই খুব মজা পাচ্ছিল। হাসছিলও।
শিশির চকিতে ভেবে নিলেন পালটা আক্রমণ হানতে না পারলে সুধাকে রোখা যাবে না। সুধা ফের অস্ত্র তুলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তিনি বলে উঠলেন, টালিগঞ্জ থেকে আমাদের হেদুয়াও সাত-আট মাইলের বেশি হবে না। আমরাও পৃথিবীর বাইরে থাকি না। তুমি কদিন গেছ আমাদের বাড়িতে?
সুধা একটু থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলে, কাজটা বুঝি শুধু ছেলেদেরই থাকে? মেয়েদের থাকে না? অফিসের ভাত দেওয়া, অসুস্থ জেঠিশাশুড়িকে খাওয়ান, চান করানো, দাদাশ্বশুরের দেখাশোনা–এসব বুঝি কাজ না? কখন–
সুধাকে বাগে পাওয়া গেছে। হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে শিশির বললেন, তোমারও সময় নেই, আমারও সময় নেই। সুতরাং কাটাকুটি।
দ্বারিক দত্ত হাত তুলেছিলেন। হেসে হেসে বললেন, আর যুদ্ধ নয়। এবার শান্তি। সুধা, তুমি প্রথম দিকে ভালই চালাচ্ছিলে। শেষটায় শিশির কিন্তু তোমাকে কজা করে ফেলেছে।
সুধার ভেতর একটি চুলবুলে বালিকা রয়েছে। সে জিভ ভেংচে বলে, ই-হি-হি, তারপর শিশিরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কষ্ট করে যখন এসেই পড়লেন, স্মৃতিরেখাদিকে নিয়ে এলেন না কেন?
খানিক আগে দেশভাগের প্রসঙ্গ ওঠায় ঘরের পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠেছিল। এখন সেটা অনেক হালকা। শিশির বললেন, স্মৃতিরেখার আসার খুব ইচ্ছা ছিল। কাল থেকে কোমরে খিচ ধরেছে। ভীষণ টাটাচ্ছে। তাই এল না। পরে একদিন নিশ্চয়ই আসবে।
ঝুমার নিশ্চয়ই খিচ ধরেনি। সে এল না কেন?
রবিবার একজন প্রফেসরের কাছে পড়তে যায়। আসবে কী করে?
একপাশে চুপচাপ বসে আছে বিনয়। গা ব্যথা তো আছেই, মাথাও টিপটিপ করছিল। ঘরের ভেতর লঘু সুরে মজার মজার কথা হচ্ছে। সেদিকে তার মন নেই। শরীর ভাল না থাকলে যা হয়। আচমকা ঝুমার নামটা কানে আসতে সে যেন একটা ঝাঁকুনি খায়। সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে কোনও অলৌকিক পর্দায় ভেসে ওঠে। ঝুমা আর ঝিনুক, ঝিনুক আর ঝুমা-মেয়ে দুটো যেন কোনও অদৃশ্য সুতোয় জড়িয়ে আছে। রাজদিয়ার মানুষজন, দেশভাগের পর যারা কলকাতায় চলে এসেছে, তাদের যার সঙ্গেই দেখা যোক, ঝিনুকের প্রসঙ্গ টেনে আনবেই। শিশির কিন্তু তার নাম একবারও মুখে আনেননি। কখন ফস করে তার সম্পর্কে তিনি কী জিজ্ঞেস করবেন, কোন ধরনের নিষ্ঠুর মন্তব্য করে বসবেন—ভাবতেই তটস্থ হয়ে ওঠে বিনয়।
সুধা প্লেটের দিকে আঙুল বাড়িয়ে শিশিরদের বলে, লুচি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নিন। আমাদের আর দাঁড়াবার সময় নেই। রান্নাবান্না সব পড়ে আছে।
খাদ্যবস্তুর পরিমাণ আগেই নজরে পড়েছিল শিশিরের। নানা কথায় অন্যমনস্ক থাকায় তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। এবার প্রায় আঁতকে উঠলেন, কী করেছ সুধা! এত কখনও খাওয়া যায়।
যায় যায়। দুপুরে ভাত খেতে অনেক দেরি হবে। নিন, প্লেটে হাত দিন।
সুধা যা মেয়ে, কোনও ওজরই কানে তুলবে না। নিরুপায় শিশির কাঁধ ঝাঁকিয়ে, করুণ মুখে লুচির কোনা ছিঁড়তে লাগলেন।
সুধা ঘরের বাকি সবাইকে খাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে সুনীতিকে সঙ্গে করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
খেতে খেতে শিশির দ্বারিক দত্তকে বললেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা করা তো আছেই, আরও দুটো বিশেষ দরকারে আজ আমাকে আসতে হল।
দ্বারিক দত্ত বললেন, একটা তো জানি। রাজমিস্তিরির ব্যাপারে কী সব ব্যবস্থা করেছিস। সেদিন হিরণ বলছিল, তুই আসবি।
হ্যাঁ। আপনাদের খান মঞ্জিল সারাবার জন্যে হিরণ ভাল মিস্তিরি জোগাড় করে দিতে আনন্দকে ধরেছিল। আনন্দ গিয়ে আমাকে বলল। আমাদের বাড়িতে গত বছর যে বিহারি মিস্তিরিরা কাজ করেছিল তাদের ডাকিয়ে আনলাম। ওরা লোক ভাল। বিশ্বাসী। গলাকাটা মজুরি হাঁকে না। হিরণের পক্ষে তো অফিস ফেলে সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকা সম্ভব নয়। কী কী করতে হবে, বলে দেবে। আমার মিস্তিরিরা একখানা ইট কি এতটুকু সিমেন্টও সরাবে না।
দ্বারিক দত্ত খুবই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন, এরকম লোকই তো দরকার। কবে থেকে ওরা কাজে লাগবে?
আপনারা যেদিন থেকে বলবেন। শিশির বলতে লাগলেন, আনন্দ খান মঞ্জিল-এর ঠিকানা দিয়ে এসেছিল। আজ সাড়ে দশটায় আমি ওদের হেড মিস্তিরি বংশী সিংকে ওই বাড়িটার সামনে দাঁড়াতে বলেছি। ও বাড়িটা দেখুক, কী খরচাটরচা পড়বে তার একটা এস্টিমেট দিক। তারপর শুভদিন দেখে কাজ শুরু করুক।
দ্বারিক দত্ত বললেন, খুব ভাল। এবার তোর দুনম্বর দরকারটার কথা বল।
মাথা সামান্য কাত করে শিশির বিনয়কে এক লহমা দেখে নিলেন। তারপর বললেন, সেটা বিনুর ব্যাপারে–
মুখটা তেতো তেতো লাগছিল বিনয়ের। একেবারেই খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু খুঁটে খুঁটে একটু আধটু মুখে দিচ্ছিল। শিশিরের কথা কানে যেতে চমকে উঠল। খান মঞ্জিল সারানোর ব্যবস্থা করা না হয় ঠিক আছে, কিন্তু তার কাছে এমন কী প্রয়োজন থাকতে পারে যে শিশিরকে জাফর শা রোডে ছুটে আসতে হয়েছে? দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, বিনুর ব্যাপারে কী দরকার রে শিশির?
শিশির বললেন, এখন না। খান মঞ্জিল থেকে ফিরে এসে বলব-হৈঠাৎ সামনের দেওয়ালে ঘরির দিকে চোখ পড়তে চঞ্চল হয়ে উঠলেন, হিরণ বিনু আনন্দ-তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে নাও। দশটা বেজে বাইশ হয়ে গেছে। দ্বারিক দত্তকে বললেন, আপনিও চলুন দ্বারিক জেঠা—-
দ্বারিক দত্ত বললেন, আমি তো সেদিনই দেখে এসেছি। তারা আজ যা। মিস্তিরিরা কাজে লাগলে তখন যাব।
বিনয়ের যাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। শরীর খারাপ লাগলেও শিশিরের মুখের ওপর না বলা গেল না। কোনও রকমে দুটো লুচি খেয়ে সে ভেতরে চলে গেল। বেরুবার আগে ওষুধ টোষুধ কিছু খেয়ে নিতে হবে।
বাইরের ঘরের সামনে সরু প্যাসেজ। সেটার ডান ধারে কিচেন। আর-একটু এগিয়ে গেলে বা পাশে পর পর বেড-রুম।
রান্নাঘরের দরজার মুখে আসতে বিনয়ের চোখে পড়ল, এলাহি কাণ্ড চলছে। উনুন ছাড়াও দু দুটো স্টোভ জ্বলছে। সেগুলোর মাথায় বড় বড় কড়াইতে মাংস, পালং-এর ঘন্ট, মুগের ডাল চাপানো হয়েছে। আরও তিন রকমের মাছ রান্না হবে। সেগুলো কেটে কুটে আলাদা আলাদা কানা-উঁচু বোগি থালায় নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা হয়েছে। দুই বোন সুধা-সুনীতি একেবারে হিমসিম। তারই মধ্যে চলছে নানা মজার কথায় হি হি হাসি। এক কোণে উমা শিলে বাটনা বেটে চলেছে।
বিনয় ডাকে, ছোটদি—
সুধারা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। সুধা জিজ্ঞেস করে কি রে, কিছু চাই?
হ্যাঁ। তোর কাছে গা ব্যথার পিল-টিল আছে?
কেন রে?
শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে।
রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরিস। নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা লেগেছে। দাঁড়া, ওষুধ নিয়ে আসছি।
কিচেন থেকে বেরিয়ে ওধারে তাদের বেডরুম থেকে একটা বাদামি রঙের গোলাকার পিল এক গেলাস জলসুদ্ধ বিনয়কে দিল সুধা।–খেয়ে ফেল। দশ মিনিটের ভেতর ব্যথা কমে যাবে। দেখবি বেশ ঝরঝরে লাগছে।
ওষুধ খেয়ে গেলাসটা কিচেনের এক পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, শিশির দা আমার কাছে কী একটা দরকারে নাকি এসেছেন? তোরা কিছু জানিস?
চকিতে সুধা সুনীতির দিকে তাকায়। দুই বোনের চোখেমুখে চাপা হাসি খেলে যায়। তারপর ভীষণ ভালমানুষের মতো মুখ করে সুধা বলে ওঠে, আমরা কিছু জানি না বাবা। শিশিরদা যখন এসেছেন, তিনিই বলবেন। ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাক।
বিনয়ের মনে হল, সুধা-সুনীতি সব জানে। সে আর কোনও প্রশ্ন করল না। অনেকখানি অস্বস্তি নিয়ে বাইরের ঘরের দিকে চলে গেল।
৩৩.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুখানা রিকশা ডেকে নিয়েছিল হিরণ। অলিগলির ভেতর দিয়ে পাক খেতে খেতে সে দুটো এখন খান মঞ্জিল-এর দিকে এগিয়ে চলেছে।
সামনের রিকশাটায় বসেছে হিরণ আর শিশির। পেছনেরটায় আনন্দ আর বিনয়।
শীতটা এবার কলকাতায় বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। এখন এগারোটার মতো বাজে। রোদে ভেসে যাচ্ছে শহর। তবু শরীরকে তপ্ত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। একটাই বাঁচোয়া, আজ কনকনে উথুরে বাতাসের দাপটা নেই।
রাস্তার দুধারে চেনা সব দৃশ্য। ডোবা, পানাপুকুর, টালি বা খাপরার চালে ছাওয়া বস্তি। ফাঁকা মাঠে ঢ্যাঙা তালগাছ। টালিগঞ্জের এদিকটায় প্রচুর পাখি। চড়াই, চিল, কাক, বুলবুলি, পাখি, বক। নানা ধরনের গাছও রয়েছে অজস্র। গাছগুলোর মাথায় এবং আকাশে ঝাঁকে ঝাকে পাখি উড়ছে।
সুধা যে পিলটা দিয়েছিল সেটা বেশ তেজী। গায়ের ব্যথা অনেক কম লাগছে। মাথার টিপ টিপ আর জ্বর জ্বর ভাবটাও প্রায় নেই বললেই হয়। সারা শরীরে ঘন করে চাদর জড়িয়ে আনন্দর পাশে বসে অন্যমনস্কর মতো দুপাশের বাড়িটাড়ি মাঠঘাট দেখছিল বিনয়। কিন্তু মাথায় সেই চিন্তাটাই পাক খাচ্ছে। রাজদিয়ায় থাকার সময় শিশিরের খুব কাছাকাছি কখনও যায়নি সে। যেটুকু দেখেছে, দূর থেকেই। পাঁচ দুবছর বাদে আবার দেখা হল। কিন্তু তার কাছে শিশিরের কী প্রয়োজন থাকতে পারে, কিছুতেই আঁচ করা যাচ্ছে না। খানিক আগে সুধা আর সুনীতির মুখে চাপা হাসি দেখে একটু অন্তত বোঝা গেছে, ওরা সব জানে। দিদিরা যখন জানে, তাদের স্বামীদের কি আর তা অজানা আছে?
আচমকা বিনয়ের মনে হল, আনন্দকে জিজ্ঞেস করলে ব্যাপারটা হয়তত পরিষ্কার হবে। ঘাড় ফিরিয়ে লক্ষ করল, খুব মন দিয়ে চারদিক দেখছে আনন্দ। নিচু গলায় তাকে ডাকল বিনয়।
আনন্দ মুখ ফেরায় না। যেমন দেখছিল তেমনই দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
তার কাছে শিশিরের কী প্রয়োজন, জানতে চাইল বিনয়।
যথাযথ উত্তর এবারও পাওয়া গেল না। ভাসা-ভাসা ভাবে আনন্দ বলল, তোমার ফিউচার প্ল্যান কী, এই নিয়ে বোধহয় শিশিরদা আলোচনা করবেন।
বিনয় বিরক্ত হল। জেনেশুনেও সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে। সে চুপ করে রইল। পরক্ষণে ভেতরে ভেতরে চঞ্চল হয়ে ওঠে, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শিশিরের এত আগ্রহ কেন? আকাশপাতাল হাতড়েও সঠিক কারণটা খুঁজে না পেয়ে তার মন ঘোলাটে হয়ে থাকে।
রিকশা একসময় সেই গরিব মুসলমানদের বস্তিটার সামনে চলে আসে।
সেটা পেরুবার পর আনন্দ বলল, টালিগঞ্জের এদিকটায় আগে কখনও আসিনি। তবে জানি, ফর্টি-সিক্সের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডেতে এখান থেকে মুসলমানরা মিছিল বার করেছিল। তাদের স্লোগান ছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। খুব গন্ডগোল হয়েছিল এই এরিয়ায়।
শিশিরকে বাদ দিয়ে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছে আনন্দ। বিনয় অন্যমনস্কর মতো বলল, হিরণদাও সেদিন তাই বলছিল।
শুনেছিলাম, পাকিস্তান হবার পর এখানকার মুসলমানেরা ভিটেমাটি ফেলে চলে গেছে। এখন তো দেখছি সবাই যায়নি।
ওপারের সব হিন্দুই কি চলে এসেছে?
কথাটা বুঝতে না পেরে আনন্দ বলল, মানে?
বিনয় বলে, লাখ লাখ হিন্দু যেমন চলে এসেছে তেমন যাদের উপায় নেই তারা পাকিস্তানেই থেকে গেছে। অজানা, নতুন জায়গায় গিয়ে কী খাবে, কী করবে, সেই দুশ্চিন্তা তো রয়েছে। এখানকার মুসলিমদের সম্পর্কেও একই কথা–
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর আনন্দ জিজ্ঞেস করে, হিরণদের খান মঞ্জিল এখান থেকে আর কত দূরে?
বিনয় বলল, আরও মিনিট পাঁচ-সাতেক লাগবে।
রিকশায় পাঁচ-সাত মিনিটের পথ আর কতটুকু? এমন এক জায়গায় হিরণরা বাড়ি এক্সচেঞ্জ করল যার গা ঘেঁষে কিনা মুসলিম বস্তি! আনন্দকে রীতিমতো চিন্তাগ্রস্ত দেখায়। আর কোনও সেফ জায়গায় ওরা বাড়ি পেল না?
আনন্দর দুর্ভাবনার কারণটা স্পষ্ট। সেই অবিশ্বাস। কলকাতার সবচেয়ে নিরাপদ এলাকায় বাস করেও টু নেশন থিয়োরির বিষ তার মধ্যেও ঢুকে গেছে। বিনয় বলল, যতদূর শুনেছি, এরা খুব নিরীহ মানুষ। বারি জামাকাপড়ের চেহারা দেখে বুঝতেই পারছেন ভীষণ গরিব। নিজেরাই ভয়ে ভয়ে থাকে। ওরা অন্যের ক্ষতি করবে, ভাবাই যায় না।
আনন্দ তার কথা যেন শুনতেই পেল না। বলল, যেখানে হিরণরা বাড়ি নিয়েছে তার আশেপাশে কত মুসলিম আছে?
আগে অনেক ছিল। বেশির ভাগই চলে গেছে। যারা এখনও রয়েছে, তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে। প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ বা বিক্রি করতে যেটুকু সময় লাগে তার বেশি একদিনও থাকবে না।
একসময় খান মঞ্জিল-এর সামনে এসে পর পর দুই রিকশা থামল। সবাই নেমে পড়ে। পয়সা বার করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল হিরণ। দেখতে পেয়ে গম্ভীর মুখে ধমকের সুরে শিশির বললেন, তোমার সাহস তো কম নয়। আমি সবার বড়। তুমি কি না ভাড়া দিতে চাইছ! পকেট থেকে হাত বার কর।
রিকশা পিছু ছআনা ভাড়া। দুই রিকশাওলাকে তাদের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে শিশির খান মঞ্জিল– এর দিকে তাকালেন। হিরণকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বাড়ি?
হিরণ আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ
বাইরে থেকে মনে হচ্ছে বেশ শক্তপোক্ত। এক্সচেঞ্জ করে বেশ ভাল বাড়িই তো পেয়েছ।
হিরণ খুশি হল। দেশের সম্পত্তি বদলাবদলি করে সে যা পেয়েছে তাতে অন্তত ঠকতে হয়নি। যারাই দেখেছে, বাড়িটার প্রশংসা করেছে।
একটু হেসে হিরণ বলল, আসুন
খান মঞ্জিল-এর দিকে পা বাড়াতে গিয়ে চোখে পড়ল, বন্ধ গেটের সামনে একটা নিরেট চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর। মাথায় কাঁচাপাকা চুলে কদমছাঁট। পরনে খাটো ধুতি, আর ছিটের ফুল শার্টের ওপর রোয়াওলা চাদর। পায়ে হাঁটু অবধি মোজা আর বেটপ ভারী বুট। বাঁ হাতে গোলাকার ঘড়ি।
কাছাকাছি যেতেই লোকটা হাতজোড় করে পিঠ ঝুঁকিয়ে সসম্ভ্রমে শিশিরের উদ্দেশে বলল, নমস্তে বড়ে সাব
শিশির মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বললেন, ও, তুমি এসে গেছ।
লোকটা বেশ বিনয়ী। বলল, হাঁ সাব। আপনি হুকুম করেছেন। আসব না?
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ?
জ্যাদা টেইম নেহী। হোগা পন্দ্র বিশ মিনট।
কথাবার্তার ধরনে বোঝা গেল, এই লোকটাই রাজমিস্তিরিদের হেড বংশী সিং। সে ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে? এইসময় তারই তো খান মঞ্জিল-এর সামনে অপেক্ষা করার কথা।
বংশীর সঙ্গে হিরণদের আলাপ করিয়ে দিলেন শিশির। পিঠ নুইয়ে সবাইকে নমস্তে জানায় সে।
হিরণ বাড়ির চাবি নিয়ে এসেছিল। গেটের ঢাউস তালা যখন সে খুলছে সেই সময় বিনয়ের। চোখ চলে যায় খানিক দূরে মধুসূদন ভট্টাচার্যের বাড়িটার দিকে। মধুসূদন সেদিনই বলে রেখেছিলেন, খান মঞ্জিল-এ যখনই বিনয়রা আসবে, একবার যেন তার সঙ্গে দেখা করে যায়।
একটু ভাল করে লক্ষ করতেই বিনয়ের মনে হল, মধুসূদনদের বাড়িটা আশ্চর্য রকমের নিঝুম। এ-ধার থেকে যেটুকু চোখে পড়ছে–সব দরজা জানালা বন্ধ।
কী জানি কেন, নিজের কাছে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই বাড়িটা যেন বিনয়ের শিরায়ু ধরে টানতে লাগল। হিরণ গেটের তালা খুলে ফেলেছিল। বিনয় তাদের বলে, আপনারা ভেতরে যান। আমি একটু পরে আসছি।
হিরণ মোটামুটি আঁচ করে নিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, মধুসূদনবাবুর বাড়ি যাবে নাকি?
হ্যাঁ। এদিক যখন আসাই হল, একবার যাই—
ঠিক আছে। বেশি দেরি কোরো না।
না না, দেখা করেই চলে আসব।
ওঁকে বোলো, আমি আজ আর যেতে পারব না। বংশী সিংকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। এরপর যেদিন আসব, নিশ্চয়ই দেখা করব।
আচ্ছা
শিশির এবং আনন্দ, দুজনেই জিজ্ঞেস করল, মধুসূদনবাবু কে?
হিরণ জানিয়ে দেয়, তাদের মতোই বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে পাকিস্তান থেকে এ-পাড়ায় চলে এসেছেন মধুসূদন। খান মঞ্জিল মেরামত হয়ে গেলে তারা যখন পাকাপাকি ভাবে উঠে আসবে, মধুসূদনবাবুরা হবেন তাদের প্রতিবেশী। পাকিস্তানে থাকতে ওঁদের পরিবারে যে চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে, নিচু গলায় তা জানাতে জানাতে হিরণ আনন্দ এবং শিশিরকে সঙ্গে করে খান মঞ্জিল-এর কমপাউন্ডে ঢুকে পড়ে। তাদের পিছু পিছু যায় বংশী সিং।
এদিকে বিনয় সোজা চলে আসে মধুসূদনদের বাড়ির সামনে। গেট খোলা রয়েছে। সেদিন এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধুসূদন। আজ কারওকেই দেখা যাচ্ছে না।
কী ভেবে দুপাশের এবং রাস্তার উলটো দিকের বাড়িগুলোর দিকে তাকায় বিনয়। ওই সব বাড়ির জানালায় কিছু মুখ চোখে পড়ে। নানা বয়সের মহিলাই বেশি। কিছু পুরুষও রয়েছে। সকলেই কেমন যেন বিহূল। কোনও কারণে মানসিক দিক থেকে ভীষণভাবে ঝাঁকুনি খেলে যেমন হয়, অবিকল সেইরকম চেহারা।
বোঝা যাচ্ছে, মধুসূদনদের বাড়িতে কিছু একটা ঘটেছে। মারাত্মক কোনও ঘটনা। কী সেটা? চকিতে বিনয় একবার ভাবল, ফিরেই যায়। পর মুহূর্তে ঠিক করে ফেলে, বাড়ির গেট পর্যন্ত এসে দেখা করে না-যাওয়াটা বিশ্রী ব্যাপার। অনুচিতও। তাছাড়া, কৌতূহলের চেয়ে তীব্রভাবে যেটা তাকে ঠেসে ধরতে শুরু করেছে তা হল উৎকণ্ঠা। ভেতর থেকে অদৃশ্য কেউ জানান দিয়ে যাচ্ছে, মধুসূদনরা নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছেন।
গেটের একটা পাল্লা আধাআধি খোলা ছিল। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বিনয়। কপা এগুলেই বাড়ির সদর দরজা। সেটা অবশ্য বন্ধ। সেখানে এসে সে ডাকতে লাগল, মধুসূদনবাবু মধুসূদনবাবু
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর মধুসূদনই দরজা খুলে দিলেন। ভাঙা ভাঙা, ঝাপসা গলায় বললেন, ও, আপনি!
মধুসূদনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল বিনয়। কয়েকদিন আগেও তাকে দেখে গেছে। তখনও যে খুব একটা সুস্থ, প্রাণবন্ত মনে হয়েছিল তা নয়। বিমর্ষ মুখ। বোঝা যাচ্ছিল, কী এক যন্ত্রণায় সারাক্ষণ কষ্ট পাচ্ছেন। তার কারণও পরে জানা গেছে। কিন্তু সেই মানুষটাকে আজ চেনাই যায় না। ফর্সা রং পুড়ে ছাইবর্ণ। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখের কোলে পুরু কালির ছোপ। গাল বসে গেছে। মুখময় কঁচাপাকা দাড়ি। চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো এত লাল, মনে হয় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পরনে ময়লা ধুতি জামা চাদর।
মাত্র কটা দিনে একটা মানুষ ভেঙেচুরে এতটা তছনছ হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল! হঠাৎ দেখা গেল, মধুসূদনের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে তার ছেলে মন্টু। ফুটফুটে কিশোরটিও ঠিক স্বাভাবিক নেই। ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত। চোখে মুখে নিদারুণ ভয়ের ছাপ।
মধুসূদনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। সে-রকম কোনও ঘনিষ্ঠতাও হয়নি। এর আগে একবারই মাত্র দেখা হয়েছে। তবু তাঁকে এবং মন্টুকে আজ দেখতে দেখতে উদ্বেগে বুকের ভেতরটা ভরে যাচ্ছে বিনয়ের। সে বলল, খান মঞ্জিল-এ এসেছিলাম। ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে আপনাদের।
তক্ষুনি উত্তর দিলেন না মধুসূদন। কিছুক্ষণ পর উদ্ভ্রান্তের মতো বললেন, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। কীভাবে যে বেঁচে আছি, নিজেরাই জানি না। এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল
উৎকণ্ঠা বহুগুণ বেড়ে যায় বিনয়ের। কোনও রকমে সে বলে, কী হয়েছে?
এক মুহূর্ত কী ভেবে মধুসূদন বললেন, ভেতরে এস, সব বলছি।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকে একটু এগুলেই বসবার ঘর। মধুসূদন বিনয়কে সেখানে নিয়ে এলেন। মন্টুও সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। আগের দিনও বিনয়দের এই ঘরেই এনে বসানো হয়েছিল।
বিনয়ের মনে পড়ে গেল, সেদিন এখানে আসার কিছুক্ষণ পর মধুসূদনের স্ত্রীর বুকফাটা বিলাপ কানে এসেছিল। লহমায় তার স্নায়ুমণ্ডলী সজাগ হয়ে যায়। কিন্তু না, বাড়ির ভেতর দিকে অপার নৈঃশব্দ্য।
মধুসূদন বললেন, বোসো- বিনয় বসার পর তিনিও বসে পড়লেন। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে মুহ্যমানের মতো বসেই থাকেন।
তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
একসময় মধুসূদন ভাঙাচোরা গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে বলে ওঠেন, পরশু রাতে আমার স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছিল।
হৃৎপিন্ডে শানানো একটা ফলা আমূল ঢুকে যায় বিনয়ের। গলা চিরে তীব্র, কাতর চিৎকার বেরিয়ে এল তার, কেন?
ভেঙেপড়া, বিধ্বস্ত মধুসূদন ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলতে লাগলেন, তুমি তো আমাদের ফ্যামিলির সব কথাই শুনেছ। প্রাণ নিয়ে আমরা তিনজন ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসতে পেরেছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার মেয়ে দীপালিকে আনতে পারিনি।
এ-সব নতুন কিছু নয়। আগের দিনই শুনে গিয়েছিল বিনয়। তবু মধুসূদন যখন আবার বলছেন, বলুন। সে চুপ করে থাকে।
মধুসূদন থামেননি, তোমাকে সেদিনই বলেছি, আমরা মনে-প্রাণে চেয়েছি, দীপালির মরণ হোক। যে হারিয়ে গেছে, চিরকালের মতো হারিয়ে যাক। কিন্তু পরশু দিন যে-খবর পেলাম তাতে মনে হল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। বুক ফেটে যাচ্ছিল। সে যে কী নরক যন্ত্রণা, বলে বোঝাতে পারব না।
কী খবর এসেছে, এখনও জানাননি মধুসূদন ভট্টাচার্য। তবে সেটা যে নিদারুণ কিছু, আঁচ করা যাচ্ছিল। শোনার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে বিনয়।
মধুসূদন বলতে লাগলেন, পরশু দুপুরে আমাদের কুমিল্লারই একটা লোক, তার নাম নবদ্বীপ সাহা, এক মোক্তারের মুহুরি ছিল সে হঠাৎ এসে হাজির। আমরা দেশ ছেড়ে চলে আসার অনেক পরে ওরা ইন্ডিয়ায় এসেছে। আমরা তবু বাড়ি এক্সচেঞ্জ করতে পেরেছি, হুন্ডি করে কিছু টাকাও এনেছি। নবদ্বীপ একটা সিকি পয়সাও আনতে পারেনি। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে এক কাপড়ে চলে আসতে হয়েছিল। এপারে পৌঁছবার পর ওদের তোলা হয়েছে নিউ আলিপুরের এক রিফিউজি। ক্যাম্পে। কীভাবে আমাদের ঠিকানা জোগাড় করেছে, জিজ্ঞেস করিনি। খবরটা তার কাছেই পাওয়া গেল। কী বলল জানো?
কী?
নবদ্বীপের মুখে যা শুনেছিলেন তাই বলতে লাগলেন মধুসূদন। কুমিল্লায় সেই ভয়ঙ্কর রাতে শোভান এবং তার দলবল তাদের বাড়ি হানা দিয়েছিল এবং দীপালির মুখ বেঁধে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ওরা তাকে দশ মাইল দূরে এক নদীর চরে আটকে রাখে।
এদিকে ইন্ডিয়া এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে, সীমান্তের দুধারেই রেসকিউ কমিটি গড়া হয়েছিল। তাদের কাজ হল পুলিশের সাহায্য নিয়ে নিখোঁজ মেয়েদের খুঁজে বার করে রেড ক্রসের হাতে তুলে দেওয়া। রেড ক্রস চেষ্টা করবে এই লাঞ্ছিত মেয়েদের মা-বাবা বা অন্য অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দিতে।
শুনতে শুনতে লাহোরের নীলমের কথা মনে পড়ে যায় বিনয়ের। সে নীরবে বসে থাকে।
মধুসূদন বলতে লাগলেন, ভারত-পাকিস্তানের অন্য সব জায়গার মতো কুমিল্লায় তাদের সেই শহরেও রেসকিউর কাজ শুরু হয়েছিল। তার দায়িত্বে ছিলেন এস ডি ও রফিকুল ইসলাম। লুটপাট, খুন জখম, হিন্দুদের হুমকি দিয়ে দেশ থেকে তাড়ানোর ঘটনাগুলো তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে নারীহরণ, ধর্ষণ–এ-সব তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছিল। ওই শহরের যে মেয়েরা লুট হয়ে গেছে তাদের কীভাবে উদ্ধার করা যায়, এটাই ছিল তার সর্বক্ষণের চিন্তা। চান নেই, খাওয়া নেই, সশস্ত্র ফোর্স নিয়ে সারা শহরের প্রতিটি বাড়িতে তো বটেই, কাছাকাছি নদীতেও হানা দিয়ে সন্দেহজনক নৌকো দেখলেই তল্লাশি চালিয়েছেন। অনেক ধর্ষিত মেয়েকে উদ্ধারও করেছেন। কিন্তু দীপালিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত নদীর চরে তার সন্ধান মিলল। সেখান থেকে তাকে নিয়ে এসে রফিকুল নিজে সঙ্গে করে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ইচ্ছা, রেড ক্রসের দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া। তারা দীপালিকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে।
মধুসূদন বললেন, রেড ক্রসের অফিসে গিয়ে বেঁকে বসল দীপালি। সে কলকাতায় আমাদের কাছে ফিরতে রাজি নয়।
বিনয় চমকে ওঠে, কেন?
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বিষাদ মধুসূদনের মুখে ঘন হতে থাকে। বিনয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, আসবে না শুনে প্রথমটা আমার বুক ভেঙে গিয়েছিল। পরে ভেবে দেখলাম ঠিকই করেছে। যে-মেয়েকে দিনের পর দিন চরে আটকে রাখা হয়েছিল, যার চরম সর্বনাশ ঘটে গেছে, সে ফিরে এলে আমাদের কী হাল হতো চিন্তা করতে পারবে না। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে চেনাজানা কেউ ঘেন্নায় আমাদের ছায়া মাড়াত না, হঠাৎ দেখা হলে গায়ে থুতু দিত।
অবিকল আর-এক ঝিনুক। বিনয়ের বুকের ভেতরটা অসহ্য ক্লেশে উথালপাতাল হয়ে যেতে থাকে। ঝিনুকের পরিণতি কী হয়েছে, জানা নেই। বেঁচে আছে, না মরে ঝরে গেছে, কে বলবে।
কিছুক্ষণ নিঝুম বসে রইলেন মধুসূদন। তারপর ফের শুরু করেন। শুধু ইন্ডিয়ায় মা-বাবার কাছেই না, ধর্ষিত মেয়েদের জন্য যে উদ্ধারাশ্রম খোলা হয়েছিল সেখানেও দীপালিকে পাঠানো গেল না।
একটি হিন্দু মেয়ের জন্য যথেষ্ট করেছেন রফিকুল ইসলাম। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে জবরদস্ত মুসলিম লিগের নেতার ছেলের মুঠো থেকে তাকে উদ্ধার করে এনেছেন। যে-দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা নিখুঁতভাবে পালন করা হয়েছে। দীপালির ব্যাপারে পুরোপুরি হাত ধুয়ে ফেলতে পারতেন রফিকুল, কিন্তু উভ্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত মেয়েটিকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যেতে পারেননি।
রফিকুলের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। একমাত্র আপা অর্থাৎ দিদি থাকেন ঢাকায়। ভগ্নীপতি একটা বিদেশি কোম্পানিতে বিরাট অফিসার। নিরুপায় রফিকুল দীপালিকে তার দিদির বাড়িতে নিয়ে তুলেছিলেন। রফিকুলের দিদির নাম আফরোজা। ভগ্নীপতি হলেন হাফিজুর রহমান। তারা অসীম মমতায় দীপালিকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই, ধর্ম আলাদা, এমন এক অনাত্মীয় তরুণী তো অনন্ত কাল কারও বাড়িতে থাকতে পারে না। ভদ্র, শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। তাকে দাসী বাঁদি করে রাখা যায় না। সে আবার নিজের মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে রাজি নয়। দীপালিকে নিয়ে বড় ধরনের সংকট না হলেও ক্রমশ আফরোজা আর হাফিজুরের দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিল। একটি লাঞ্ছিত ব্রাহ্মণ তরুণী কী পরিচয়ে তাদের কাছে থাকবে, তার ভবিষ্যৎই বা কী, ভেবে ভেবে তারা কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না। মেয়েটাকে নিয়ে কী করতে চান, আত্মীয়পরিজন বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনতে হচ্ছিল অনবরত। এদিকে রফিকুল তো বোন-ভগ্নীপতির হাতে দীপালিকে সঁপে দিয়ে কুমিল্লার সেই শহরে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটাকে মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি। ফি শনিবার তিনি দিদির বাড়িতে তার খোঁজখবর নিতে আসতেন। প্রথম দিকে ছিল শুধুই করুণা। শুধুই সহানুভূতি। তারপর কবে অসহায় মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন, নিজেও টের পাননি। ধর্ষণের গ্লানি নিয়ে এই পৃথিবীতে দীপালি বাকি জীবন কাটিয়ে দিক, এটা ভাবতেও তার ভীষণ কষ্ট হতো। একদিন সরাসরি বলেছিলেন, দীপালি ব্রাহ্মণ কন্যা আর তিনি মুসলমান। যদি সংস্কার কাটিয়ে সে তাকে বিয়ে করতে চায়, রফিকুলের কাছে সেটা হবে বিরাট একটা পাওয়া। আসলে দীপালি সম্মানজনকভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকুক, সেটাই ছিল একান্তভাবে রফিকুলের কাম্য।
প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল দীপালি। রফিকুল তার কাছে পরমাশ্চর্য এক দেবদূত। তার ত্রাণকর্তা। চর থেকে উদ্ধার করে না নিয়ে এলে অন্ধকার এক নরকে তাকে পচে গলে মরে যেতে হতো। তবু নিজের মধ্যে কোথাও একটা বাধা ছিল। যার রক্তে আবহমান কালের বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের রক্ত বয়ে চলেছে তার পক্ষে একটি মুসলমানকে বিয়ে করায় মন সায় দেয়নি। পরক্ষণেই দীপালি ভেবেছে, সে তো একেবারে খাদের প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। বাবা-মা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। পৃথিবীর একদিকের সব দরজা চিরকালের মতো তার কাছে বন্ধ হয়ে গেছে। একটা পথই তখন তার সামনে খোলা। রফিকুলের সঙ্গে বিয়ে। তবু আরও একটা দ্বিধা ভেতর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তার দেহ নিপাপ নেই। সারা শরীরে জগতের সবটুকু কালি আর দুর্গন্ধ মাখানো রয়েছে।
দুহাতে মুখ ঢেকে দীপালি বলেছিল, আমি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছি। এই অবস্থায়
রফিকুল সদয় সুরে বলেছিলেন, ওটা এক দুর্ঘটনা। ভুলে যেতে চেষ্টা কর।
এরপর বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। রফিকুলের দিদি এবং ভগ্নীপতি পরম উদারতায় দীপালিকে গ্রহণ করেছিলেন।
বিয়ের পর কুমিল্লার সেই শহরে দীপালিকে নিয়ে যাননি রফিকুল। তখনও সেখানে অনেক হিন্দু ছিল। তারা দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যায়নি। সকলেই দীপালির চেনাজানা। ওদের সঙ্গে দেখা হলে সে স্বস্তি বোধ করত না।
কিন্তু রফিকুল স্ত্রীকে ছেড়ে কুমিল্লায় থাকতে চাইছিলেন না। ঢাকায় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উঁচু মহলে ধরাধরি করে ময়মনসিংয়ে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। ……..
নবদ্বীপ সাহার মুখে যা শুনেছিলেন, সবিস্তার সব জানিয়ে নতমুখে বসে রইলেন মধুসূদন। মাথাটা। ভেঙে বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। তারই মধ্যে গোঙানির মতো আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী কমলা অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে, তক্ষুনি আবার মূৰ্ছ। যেটুকু সময় হুশ থাকে শুধু কান্না আর কান্না। আমাদের সংসারে যেন বজ্রপাত ঘটে গেল। পরশু থেকে কীভাবে সময় কাটছে, আমরাই শুধু জানি। কাল রাত্তিরে কখন যে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে কমলা বাথরুমে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়েছিল, আমি টের পাইনি। মন্টু কিছু একটা শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে সিলিংয়ের বরগা থেকে ঝুলতে দেখে চিৎকার করে ওঠে। আমিও ছুটে যাই। ধরাধরি করে ওর মাকে নামাই। পাড়ার লোকজনকে ডেকে লেকের ধারের হাসপাতালে নিয়ে যাই।
মধুসূদনের স্ত্রী এখনও যে বেঁচে আছেন সেটা মন্টুকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। মারা গেলে ওর পরনে থাকত গুরুদশার সাজ। নতুন কোরা ধুতি-চাদর। গলায় ঝুলত লোহার কাঠি। জোরে শ্বাস টেনে বিনয় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, উনি এখন কেমন আছেন?
মধুসূদন গভীর হতাশায় জোরে জোরে মাথা নাড়েন, জ্ঞান ফেরেনি। যেভাবে গলায় ফাঁস আটকেছিল তাতে ডাক্তার খুব একটা ভরসা দিচ্ছেন না। তারপর মুখ তুলে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলেন, সবই অদৃষ্ট।
বিনয় কী বলবে, ভেবে পেল না।
মধুসূদন এবার বলেন, মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, তার কোনও খোঁজ পাচ্ছিলাম না– ধীরে ধীরে তা একরকম সয়ে যেত। ভাবতাম মরে গেছে। কিন্তু নবদ্বীপ এসে সমস্ত ওলটপালট করে দিল। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, আমরা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। মেয়েটা যা করেছে, আমাদের চোদ্দ পুরুষের সব পুণ্য নষ্ট হয়ে গেল। মরার পর নরকেও আমাদের জায়গা হবে না। যন্ত্রণায়, পাপবোধে, কষ্টে তার কণ্ঠস্বর বুজে আসে।
দীপালিকে জোর করে শোভানরা ধরে নিয়ে নদীর চরে আটকে রেখেছিল। সে ধর্ষিত। তার চরম সর্বনাশ ঘটে গেছে। এজন্য মধুসূদনের কষ্টের অবধি ছিল না। মেয়ের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, চিরকালের মতো তাকে হারানোর শোক সহ্য করতে পারেননি কমলা। তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।
সংসারের ভিত ধসে পড়েছে। তবু তারই মধ্যে ইন্ডিয়ায় এসে মধুসূদন খানিকটা সামলে উঠে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরশু নবদ্বীপ সাহার মুখে দীপালির খবরটা শোনার পর ফের সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে গেছে।
তাদের ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে মুসলমানকে বিয়ে করেছে। এমন মহাপাতক সৌরলোকে আর কখনও বুঝি হয়নি। বিশুদ্ধ ভট্টাচার্য বংশের মর্যাদা, গৌরব, পবিত্রতা–সব কিছু ধূলিসাৎ। এর চেয়ে বড় শোক, বড় আঘাত, বড় মনস্তাপের ঘটনা তাদের বংশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি।
মধুসূদনের বিলাপ চলতেই থাকে। হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, অনেকক্ষণ এ-বাড়িতে এসেছে সে। ওদিকে নিশ্চয়ই বংশী সিংকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খান মঞ্জিল দেখানো শেষ করে হিরণরা তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বিনয় বিষাদ-মাখানো সুরে বলল, আমাকে এবার উঠতে হবে। জরুরি একটা কাজ আছে। আজ। যাই– হিরণরা যে খান মঞ্জিল-এ এসেছে, সেটা আর জানালো না।
আস্তে মাথা হেলিয়ে দেন মধুসূদন, আচ্ছা—
পরে এসে মন্টুর মায়ের খবর নিয়ে যাব।
মধুসূদন উত্তর দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেনও না। যেমন বসে ছিলেন তেমনি বসে রইলেন। মুহ্যমান। শোকে, গ্লানিতে জর্জরিত।
৩৪.
বাড়ির বাইরে এসে আচ্ছন্নের মতো হাঁটছিল বিনয়। পরশু গলায় ফাঁস লাগাবার পর এখনও জ্ঞান ফেরেনি কমলার। ফিরবে কি না, ডাক্তার তেমন কোনও ভরসা দেননি। শেষ পর্যন্ত যদি বেঁচেও যান, ফের যে আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন না, কে বলতে পারে? মেয়ের জন্য পিতৃকুল এবং শশুরকুলের যাবতীয় সুকৃতি আর পুণ্য ধ্বংস হয়ে গেছে, এটা কি তিনি কোনও দিন ভুলতে পারবেন? মধুসূদনের কথা যত ভাবে, প্রবল পাষাণভার যেন বিনয়ের মাথায় চেপে বসতে থাকে।
খান মঞ্জিল-এ এসে একতলা দোতলা বা তেতলায় কোথাও হিরণদের দেখা পাওয়া গেল না। তবে ছাদ থেকে ওদের গলা ভেসে আসছিল। বিনয় সোজা সেখানে চলে এল।
হিরণরা বংশী সিংকে ভাঙা কার্নিস আর ছাদের ফাটল-ধরা, ছালচামড়া-ওঠা জায়গাগুলো দেখাচ্ছে। বহুকাল মেরামত না করায় কোথাও কোথাও বট-অশ্বখের চারা গজিয়েছে।
শিশির বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সারা বাড়িটা দেখেছ। ছাদের হালও দেখলে। গাছগুলো শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে সারাই করবে।
বংশীর হাতে একটা মাঝারি নোটবই আর পেন্সিল রয়েছে। কী সব লিখতে লিখতে সে বলল, ও তো করতেই হবে।
রেন-ওয়াটার পাইপগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সেগুলো পালটাতে হবে।
হ্যাঁ।
হঠাৎ হিরণের যেন মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে বলল, একতলার রান্নাঘরটা ভেঙে নতুন করে করতে হবে কিন্তু
বংশী ঘাড় কাত করে, ঠিক হ্যায়।
ছাদে একটা বড় ঠাকুর-ঘর হবে।
হয়ে যাবে।
এবার শিশির বললেন, কী কী করতে হবে, মোটামুটি জেনে নিলে। কত ইট সিমেন্ট বালি টালি লাগবে, তোমাদের মজুরি কীরকম পড়বে, তার একটা এস্টিমেট করে দিও।
বংশী ঝড়ের গতিতে লিখে যাচ্ছিল। বলল, ঠিক হ্যায় বড়ে সাব
তা হলে এখন ফেরা যাক।
বিনয় ছাদে ওঠার পর সবার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়ি মেরামতের খুঁটিনাটি নিয়ে হিরণরা এমনই মগ্ন ছিল যে তার আসাটা কেউ লক্ষ করেনি। ছাদ থেকে নামার জন্য ঘুরে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে, তখনই ওরা বিনয়কে দেখতে পেল।
আনন্দ বলল, কী আশ্চর্য, বলে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। এই তোমার তাড়াতাড়ি! হাতের ঘড়িটা দেখে বলতে লাগল, পাক্কা একটি ঘন্টা পার করে এলে।
বিনয় বিব্রত বোধ করে, যেখানে গিয়েছিলাম, কথায় কথায় দেরি হয় গেল।
শিশির বললেন, তোমার জন্যে ওয়েট করে করে শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজনে বংশীকে বাড়িটা দেখিয়ে কী করতে হবে, বুঝিয়ে দিলাম। তুমি হয়তো সবটা শোননি। পরে শুনে নিও। তখন যদি মনে হয়, আরও কিছু অ্যাডিশান বা চেঞ্জটেঞ্জ করতে হবে, বোলো। বংশী করে দেবে।
হিরণের হঠাৎ খেয়াল হল, তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না। এত বড় একটা মেরামতি, তার সঙ্গে দুএকটা নতুন ঘর বানানো, সব মিলিয়ে প্রচুর খরচের ব্যাপার। যা করার একবারেই করতে হবে। পছন্দ হল না বলে ভেঙে নতুন করে কর, এত টাকা কোথায় পাবে সে? বলল, এক কাজ করা যাক, নেক্সট ছুটির দিনে বংশী সিংকে আমাদের বাসায় ডেকে বিনু আর আমি ওর সঙ্গে বসব। দাদু আর সুধাও থাকবে। যা যা করার কথা এখন ওকে বলা হল, তার সঙ্গে আরও যদি কিছু করতে হয়, বাড়ির সবাই মিলে ভেবে চিন্তে সেদিন জানিয়ে দেব।
শিশিরও সায় দিলেন, সেটাই ভাল। দ্বারিক জেঠু আর সুধা তো আজ আসতেই পারল না। বিনুও কোথায় গিয়ে আটকে রইল। সকলে একসঙ্গে থাকলে আজই সব ঠিক হয়ে যেত। বংশীকে বললেন, এর মধ্যে তাহলে আর এস্টিমেটটা কোরো না। হিরণদের সঙ্গে বসে ভাল করে সমস্তটা বুঝে নিও। কাজে হাত দিতে না হয় কদিন দেরি হবে।
বংশী বলল, ঠিক হ্যায় বড়েসাব।
এদিকে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে বিনয়। দেশের বিষয় আশয়ের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে হিরণরা খান মঞ্জিল-এর মতো বিরাট একখানা বাড়ি পেয়েছে। এ-বাড়ির পুরোটার মালিক ওরাই। বিনয়ের তাতে ছিটেফোঁটা অংশও নেই। তবু মেরামতের সময় কতটা অদলবদল করা হবে, নতুন কখানা ঘর তোলা দরকার, এ নিয়ে শিশির এবং হিরণ কেন যে তার মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে, কিছুতেই তা মাথায় ঢুকছে না বিনয়ের। সে শুধু ওদের কথা শুনেই গেল, কোনও উত্তর দিল না।
ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে সবাই নামতে শুরু করেছিল। দোতলায় এসে আচমকা কী ভেবে হিরণ বিনয়কে বলল, একটু দাঁড়াও। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। অন্যদের বলল, আপনারা নিচে চলে যান। আমরা এক্ষুনি আসছি।
আনন্দ, শিশির আর বংশী নামতে লাগল। হিরণ বাঁ পাশের রেলিং-লাগানো চওড়া বারান্দা দিয়ে বিনয়কে সঙ্গে করে এগিয়ে গেল।
খান মঞ্জিল-এ আগেও দুবার এসেছে বিনয়। এ-বাড়ির প্রতিটি ঘর, প্রতিটি বারান্দা, প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ তার চেনা। তবু কী দেখাতে চায় হিরণ? বিস্ময় বাড়ছিল বিনয়ের। সে জিজ্ঞেস করে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
হিরণ বলল, আরে চলই না। নিজের চোখে সব দেখতে পাবে।
বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করে না। একটু পরে কোণের দিকের একটা ঘরে চলে আসে তারা। চৌকো ধরনের প্রশস্ত ঘর। কম করে পঁচিশ ফিট বাই কুড়ি ফিট। দুধারের দেওয়ালে দুজোড়া করে বড় বড় জানালা। গরাদের বাইরে খড়খড়ি, ভেতরে রঙিন কাঁচের পান্না। জানালাগুলো বন্ধ ছিল। ক্ষিপ্র হাতে খুলে দিল হিরণ। লহমায় সারা ঘর রোদে ভরে গেল।
সোজাসুজি যে জোড়া জানালাটা রয়েছে হিরণ বিনয়কে সেখানে নিয়ে এল। সামনের দিকে মেন রাস্তা। বেশ লোজন দেখা যাচ্ছে। ঢিমে চালে কটা সাইকেল রিকশা চলেছে। একটা ঘোড়ার গাড়ি খট খট আওয়াজে শীতের অলস দুপুরটাকে ঝাঁকুনি দিতে দিতে দূরে ট্রাম রাস্তার দিকে ছুটে গেল।
বাড়ির সামনের অংশ আর বাঁ পাশটা দেখাতে দেখাতে হিরণ বুঝিয়ে দিল কোন দিকটা পুব আর কোনটা দক্ষিণ। বলল, ইস্ট আর সাউথ খোলা থাকায় এই ঘরে কোনওদিন আলো-হাওয়ার অভাব হবে না। তোমার ছোটদির ইচ্ছে, এই ঘরটায় তুমি থাকবে। তেতলায় ঠিক ওপরের ঘরটা আমার আর সুধার। এ-বাড়িতে এই ঘর দুটোই বেস্ট।
এখানে টেনে আনার উদ্দেশ্যটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে যায়। কী ভেবেছে হিরণরা, বাকি জীবন বিনয় তাদের কাছে কাটিয়ে দেবে? বোঝাই যাচ্ছে, সুধারা তাকে সহস্র পাকে জড়িয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু বিনয়ের মধ্যে একটি স্বাধীন মানুষ রয়েছে, যার আত্মসম্মানবোধ প্রখর। সে ঠিকই করে রেখেছে, অফিসে প্রথম মাসের মাইনেটা পেলেই সুধাদের বাড়ি থেকে চলে যাবে। বোনের শ্বশুরবাড়িতে চিরকাল পড়ে থাকার আদৌ তার কোনও ইচ্ছা নেই। এ-সব বলতে গিয়েও থেমে গেল।
হিরণ বলল, যদি মনে হয়, এই ঘরের দেওয়াল কেটে কটা তাক বসাবে, বংশীকে বলে দিও
যে-ঘরে কোনও কালেই সে বাস করবে না তার দেওয়ালে তাক বসানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজনই সে বোধ করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তা জানালে হিরণ তুমুল হইচই বাধিয়ে দেবে। বিনয় শুধু বলল, পরে দেখা যাবে।
আচ্ছা
হিরণ চটপট জানালাগুলো বন্ধ করে বলল, চল–
শিশিররা আগেই নেমে এসে বিনয়দের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হিরণ সদর দরজায় তালা লাগিয়ে সবাইকে নিয়ে রাস্তায় এসে দুটো রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। বংশী ট্রাম রাস্তার দিকে হাঁটতে। লাগল।
খান মঞ্জিল-এ আসার সময় বিনয় আর আনন্দ এক রিকশায় উঠেছিল। অন্যটায় শিশির আর হিরণ। ফেরার সময় সঙ্গী বদল হয়েছে। এখন বিনয়ের পাশে হিরণ।
অলিগলি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দুই রিকশা। সূর্য এখন সোজাসুজি মাথার ওপর। দুপুরের তপ্ত রোদ উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়। বেশ আরাম লাগছিল বিনয়ের। অন্যমনস্কর মতো রাস্তার ধারের বাড়িঘর ডোবা গাছগাছালি দেখছিল সে। তবে নির্দিষ্টভাবে কিছু ভাবছিল না। টুকরো টুকরো নানা চিন্তা তার মাথায় আনাগোনা করছে। সবই এলোমেলো। অসংলগ্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক নেই। খান মঞ্জিল,মধুসূদনদের বাড়ির শোচনীয় ঘটনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য সমস্ত ছাপিয়ে অফিসের অ্যাসাইনমেন্টটা ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে। আজ থেকে কলকাতার আশেপাশের রিফিউজি ক্যাম্প আর কলোনিগুলোতে তার যাবার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ জ্বর বাধিয়ে বসায় যাওয়া হয়নি। তবে একটাই আশার কথা, সুধার ওষুধে বেশ কাজ হয়েছে। জ্বরটা কিছুক্ষণ আগে ছেড়ে গিয়েছিল। শরীর এখন অনেক চনমনে লাগছে। কাল কাছাকাছি কোনও একটা ক্যাম্প বা কলোনিতে তাকে যেতেই হবে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ চলার পর হঠাৎ হিরণ ডাকল, বিনু
বিনয় মুখ ফিরিয়ে তাকায়, কিছু বলবেন?
মধুসূদনবাবুদের বাড়িতে এত দেরি হল কেন তোমার? কোনও খবর আছে?
বিনয় রীতিমতো অবাকই হল। এ-পাড়ায় মধুসূদনরা ছাড়া তার চেনাজানা অন্য কেউ যে নেই আর সেখানেই যে সে গিয়েছিল, হিরণ তা ঠিকই আঁচ করে নিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মধুসূদনদের কথা হিরণ জানতে চাইবে, ভাবা যায়নি। বিনয়ের মনে হয়েছিল, খান মঞ্জিল-এর ব্যাপারে হিরণের আরও ব্যাপক কোনও পরিকল্পনা আছে। এক্সচেঞ্জ করে পাওয়া এই বাড়িটা তার স্বপ্নের বাড়ি। ভেবেছিল, এটা নিয়েই সে কিছু বলবে কিন্তু একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছে।
বিনয় বলল, হ্যাঁ, খুব খারাপ খবর।
মধুসূদনের দেশ ছেড়ে চলে আসার কারণ সেদিনই জেনে এসেছিল হিরণ। স্ত্রীকে নিয়ে মানুষটা যে মারাত্মক সংকটে রয়েছেন সেটাও নিজের চোখে দেখেছে। চকিতে কিছু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওঁর স্ত্রীকে নিয়ে কি কোনও প্রবলেম হয়েছে?
হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা পরশু গলায় দড়ি দিয়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনও জ্ঞান। ফেরেনি।
আত্মহত্যার পেছনে নিদারুণ হেতুটা কী, জানিয়ে দিল বিনয়।
শোনার পর অনেকটা সময় নিঃশব্দে বসে থাকে হিরণ। তারপর জোরে শ্বাস ফেলে বলে, পার্টিশান ফ্যামিলিটাকে একেবারে শেষ করে দিল।
বিনয় উত্তর দেয় না।
৩৫.
সুধাদের রান্নাটান্না হয়ে গিয়েছিল। হিরণরা বাড়ি ফিরতেই দুই বোন তাড়া লাগায়, অনেক বেলা হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও।
রান্নাঘরটা বেশ প্রশস্ত। এক পাশে রান্নার সরঞ্জাম। জোড়া উনুন, স্টোভ। এ ছাড়া জাল-লাগানো মিট সেফ। সারি সারি তাকে কাঁসার থালা, বাটি, গেলাস, কাসি, ঘটি এমনি সব বাসনকোসন। আর আছে নানা মাপের অগুনতি কৌটো, কাঁচের বয়ম। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও ঘরের অর্ধেকটা ফাঁকা পড়ে থাকে। হিরণরা সেখানে বসেই খায়। বাড়ির লোকেদের ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু মান্য আত্মীয়-পরিজনেরা এলে তাদের তো আর রান্নাঘরে হাঁড়ি কড়া উনুন টুনুনের পাশে খেতে বসিয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে শিশির সেই কত কাল আগে এ-বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর এই। তাকে খাতিরযত্ন না করলে চলে?
বাইরের ঘরের সোফা চেয়ার টেয়ার আগেই সরিয়ে রেখেছিল সুধা। সবার মুখটুখ ধোওয়া হয়ে গেলে সেখানে ফুলকাটা আসন বিছিয়ে হিরণ আনন্দ শিশির বিনয় এবং দ্বারিক দত্তকে খেতে বসিয়ে দেওয়া হল।
সুধা আর সুনীতি পরিপাটি করে থালায় মিহি চালের ভাত এবং থালাগুলোর চারপাশে বাটিতে বাটিতে তিন চার রকমের মাছ, মাংস, ডাল, নিরামিষ তরকারি, চাটনি ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়েছে। উমা দরজার কাছে এক পায়ে খাড়া। সুধা ইশারা করলেই রান্নাঘর থেকে আরও মাছ, আরও ভাত, আরও মাংস নিয়ে আসবে।
উৎকৃষ্ট খাদ্যবস্তুগুলোর সুগন্ধে ঘরের বাতাস ম ম করছে। মুখোমুখি খেতে বসেছে হিরণরা। একদিকে দ্বারিক দত্ত আর শিশির। আর-এক দিকে হিরণ, আনন্দ এবং বিনয়।
বিপুল পরিমাণ সুখাদ্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন শিশির। তার চোখ যেন আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। করুণ সুরে বলেন, কী ব্যাপার বল তো সুধা?
সুধা মোটামুটি কিছু একটা আঁচ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কীসের ব্যাপার?
আমাকে তুমি কি গদু চক্কোত্তির ভায়রাভাই ঠাউরে নিয়েছ?
বিনয় কোনাকুনি তার পাতের সামনে নীরবে বসে ছিল। অনেক দিন পর গদু চক্কোত্তির নামটা শুনল সে। মাঝখানে কটা বছর তার ওপর দিয়ে এত ঝড়ঝাঁপটা গেছে, যে গদুর কথা তার স্মৃতি থেকে একেবারেই মুছে গিয়েছিল। বহুকাল পর ফের তাকে মনে পড়ে গেল।
গদু ছিল বিক্রমপুরের সব চাইতে নামকরা খাইয়ে তোক। এমন ভোজনপটু মানুষ জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেনি বিনয়। এমনিতে রোগা পাতলা মাঝারি ধাঁচের চেহারা ছিল তার। কিন্তু গদুর খাওয়ার বহর দেখলে চোখ কপালে উঠে যেত।
জীবনে খাওয়াই ছিল তার একমাত্র কাজ। রাজদিয়াকে ঘিরে যে চল্লিশ পঞ্চাশটা গ্রাম রয়েছে, শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস সে-সব জায়গায় সে চষে বেড়াত। গরমের সময় তার পরনে থাকত খাটো ধুতি, শরীরের ওপর দিকটা খালি, কাঁধে চাপানো থাকত একখানা দলা-মোচড়া ফতুয়া। শীতকালে ফতুয়াটি পরে তার ওপর জড়িয়ে নিত পুরানো এন্ডির চাদর। বর্ষাকালে অবশ্য মাথার ওপর থাকত মান্ধাতার বাপের আমলের তালি-মারা ছাতা।
পূর্ব বাংলা ছিল এক স্বপ্নের পৃথিবী। সেখানে তখন অঢেল মাছ, অঢেল দুধ, মাঠের পর মাঠ জুড়ে সোনালি শস্য। লক্ষ্মীপুজো, দুর্গাপুজো, হাজারটা পার্বণ, মেয়ের বিয়ে, কুমারী মেয়েদের ব্রতসাঙ্গ, শ্রাদ্ধ–ছড়ানো ছিটানো চল্লিশ পঞ্চাশখানা গ্রামের কোনও না কোনও বাড়িতে অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। নেমন্তন্নর দরকার হতো না গদুর। সব বাড়ির দরজাই তার কাছে ভোলা। গেরস্তরা তাকে দেখলে খুশিতে হইচই বাধিয়ে দিত। তক্ষুনি তার হাত-মুখ ধোওয়ার ব্যবস্থা করে খেতে বসানো হতো। কাঁচা ফলারের ব্যবস্থা থাকলে সের দুই চিড়ে, ডজন দুই মোহন বাঁশি কলা, সের খানেক পাতক্ষীর, গোটা পঞ্চাশেক ক্ষীরমোহন, আর পাকা ফলার হলে দিস্তা দিস্তা লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ষাট সত্তর টুকরো পাকা রুই, চিতলের পেটি এবং সেই সঙ্গে এক গামলা রসগোল্লা আর এক থালা সন্দেশ উড়িয়ে দিত। এইভাবে সারা বিক্রমপুর জুড়ে দিগ্বিজয় করে বেড়াত সে।
রাজদিয়ায় থাকার সময় সুধাও গদুকে দেখেছে। সে বলল, গদু চক্কোত্তি এখন এ বাড়িতে থাকলে সবার জন্যে যা রান্না করেছি, একাই সে সাবাড় করে দিত। উঃ, কী খেতে যে পারত নোকটা! ওইরকম রোগাপটকা চেহারা, কোথায় যে এত খাবার ঢোকাত, কে জানে। বলে হি হি হাসতে লাগল। মনমেজাজ ভাল থাকলে কথায় কথায় তার মসি।
দ্বারিক দত্ত হেসে হেসে বললেন, গদুর চার-পাঁচটা এক্সট্রা পাকস্থলী ছিল।
শিশির সুধাকে বললেন, না না সুধা, এত আমি খেতেই পারব না। ভাত মাছ কপির ডালনা সব অর্ধেক অর্ধেক তুলে নাও। তখন ঠেসে ঠেসে অত লুচি তরকারি খাওয়ালে। এখনও সেগুলো হজম হয়নি। পেটে গিজ গিজ করছে।
সুধা নাছোড়বান্দা। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কিচ্ছু তুলব না। যা দিয়েছি লক্ষ্মী ছেলের মতো খেয়ে নিন।
শিশির বললেন, আমার কত বয়েস হয়েছে জানো? পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি। এই বয়েসে এত খাওয়া যায়?
দ্বারিক দত্ত পাশ থেকে বললেন, না না করিস না শিশির। তোর পঞ্চাশ আর আমি সত্তর পেরিয়েছি। তুই আমার কাছে ছেলেমানুষ। সুধা-সুনীতি যা দিয়েছে সমস্ত তো খাবই, আরও দুচারখানা মাছও নেব। হাত গুটিয়ে বসে থাকিস না। গদু চক্কোত্তির মতো না হলেও এখনও যথেষ্ট পরিমাণে তিনি খান। পরিপাক যন্ত্রটি যে-কোনও যুবকের মতোই তাঁর পুরোমাত্রায় সক্রিয়। পেট ভুটভাট, অগ্নিমান্দ্য–এ-সব তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি।
একই দেশে বাড়ি। বাবার চেয়ে দ্বারিক দত্ত বয়সে বড়। সেই সুবাদে জেঠামশাই। এবং গুরুজন। ব্রিটিশ কোম্পানিতে মস্ত অফিসার হলেও আপত্তি করতে সাহস হল না শিশিরের। ফাঁসির আসামীর মতো মুখ করে খাওয়া শুরু করলেন তিনি।
সুধার মধ্যে ঝলমলে, সতেজ, ঝোড়ো একটা ব্যাপার আছে। সে যেখানে থাকে তার চারপাশ যেন স্নিগ্ধ আলোয় ভরে যায়। মানুষকে মাতিয়ে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা মেয়েটার।
হালকা হাসি এবং মজার মজার কথায় ভোজের আসরটাকে পলকে জমিয়ে তুলল সুধা। দ্বারিক দত্তও কম যান না। নাত-বউয়ের সঙ্গে তিনিও সমানে পাল্লা দিতে লাগলেন। সবই খাওয়া দাওয়ার গল্প। রাজদিয়ায় থাকতে যুবা বয়সে তিনি, হেমনাথ এবং লালমোহন অর্থাৎ ফাদার লারমোর বাজি ধরে কোথায় কোন কোন বিয়ে বাড়িতে কী কী খেয়েছেন তার লম্বা ফিরিস্তি পেশ করতে থাকেন। তবে নতমস্তকে স্বীকার করলেন, গদু চক্কোত্তির ধারে কাছে তারা কেউ নেই। সেই সঙ্গে ছোটখাটো কিছু হা-হুতাশ। আজকালকার ছেলেমেয়েরা খেতে পারে না। তাদের পেটের খোল ছোট। হাবিজাবি খেয়ে হজমশক্তি তাদের নষ্ট হয়ে গেছে। দ্বারিক দত্তর আরও আক্ষেপ, কলকাতায় ওপার বাংলার মতো ভাল মাছ মেলে না, তরতাজা আনাজ দুর্লভ। দুধ, ঘি, তেলসমস্ত কিছুতে ভেজাল। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারই মধ্যে খান মঞ্জিল মেরামতের ব্যাপারে কী ঠিক হয়েছে, তা নিয়েও কথা হল।
বিনয় চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। মধুসূদন ভট্টাচার্যের স্ত্রীর গলায় দড়ি দেবার কথা শোনার পর থেকে গাঢ় বিষাদে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিল তার। সুধাদের লঘু চালের নানা গল্প, মুহুর্মুহু হা হা, হি হি– সব মিলিয়ে ভারাক্রান্ত ভাব অনেকটা কেটে গেছে। হঠাৎ শিশিরের ডাক কানে এল, বিনু
বিনয় চমকে পাত থেকে মুখ তোলে। আর তখনই মনে পড়ে যায়, শিশির শুধু খান মঞ্জিল সারাইয়ের ব্যবস্থা করতেই আসেননি, তার সঙ্গেও নাকি ওঁর জরুরি কিছু কথা আছে। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে।
শিশির বললেন, আমাদের বাড়ি যাবার জন্যে আনন্দকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম। তোমাকে বলেনি?
বিনয় মাথাটা সামান্য কাত করে, বলেছে।
রোজ ভাবি আসবে। কিন্তু এলে না তো?
রামকেশবের জন্য যে যাওয়া যায় নি একথা শিশিরের মুখের ওপর বলা যায় না। সে চুপ করে থাকে।
শিশির একটু ভেবে বললেন, শুনলাম তুমি একটা নতুন খবরের কাগজে জয়েন করেছ।
বিনয় বলল, হ্যাঁ। আনন্দদাই কাজটা পাইয়ে দিয়েছেন।
দেখ বিনু, এই ধরনের চাকরির কোনও ফিউচার আছে বলে আমি মনে করি না।
এমন মতামত আগেও কেউ কেউ জানিয়েছে। বিনয় জবাব দিল না।
শিশির বলতে লাগলেন, হিরণের কাছে শুনেছি, তোমার জন্যে সে স্টেট গভর্নমেন্টের দু-একটা ডিপার্টমেন্টে চাকরির চেষ্টা করছে।
বয়স্ক কেউ যদি পাশে বসে অনবরত কথা বলে যায়, মুখ বুজে বসে থাকাটা অভদ্রতা। বিনয় বলল, হ্যাঁ।
শিশির বললেন, গভর্নমেন্ট সার্ভিসে সিকিউরিটি আছে ঠিকই, কিন্তু স্যালারি ভীষণ কম। প্রোমোশন পেতে অনেক বছর লেগে যায়।
বিনয় বলে, আমি এ-সব ঠিক জানি না।
একটু চিন্তা করে শিশির এবার বললেন, আনন্দও সেদিন বলছিল, তোমার জন্যে ওদের অফিসে বলে রেখেছে। ওটা নামকরা ফার্ম। ওখানে হলে তো ভালই হয়। কিন্তু কবে হবে তার ঠিক নেই।
এ-সব কথার উত্তর হয় না। বিনয় নিঃশব্দে খেতে থাকে।
শিশির থামেননি, তোমার সম্বন্ধে আমি অনেক ভেবেছি। খবরের কাগজে পড়ে থাকার মানে হয় না। জেসপ কোম্পানির নাম শুনেছ?
বিনয় মাথা নাড়ে, শোনেনি।
বিরাট ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম। খাস সাহেবদের কোম্পানি। বড় বড় রোড-রোলার ছাড়া আরও অনেক কিছু বানায়। ওদের অফিসে আর ফ্যাক্টরিতে বহু লোক চাকরি করে। মাস দেড়েকের ভেতর ওখানে একটা ভ্যাকান্সি হবে। খুব ভাল লোস্ট। শুরুতেই মাইনে সাতা শ টাকার মতো। তা ছাড়া অন্য সব সুযোগ সুবিধা। নানারকম বেনিফিট। আমার এক বন্ধু এদের হেড অফিসে একটা ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার। ওই পোেস্টটার জন্যে তাকে তোমার কথা বলে রেখেছি। সে কথা দিয়েছে, চাকরিটা হয়ে যাবে। শিশির বলতে লাগলেন, তুমি দু-একদিনের ভেতর আমাদের বাড়িতে চলে এস। একটা অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে। কী লিখবে, আমি বলে দেব।
শিশিরদের বাড়িতে যাবার কোনও প্রশ্নই নেই। পৃথিবী উলটে গেলেও সে ও-বাড়ির ছায়া মাড়াবে না। কিন্তু শিশির তার একটা ভাল চাকরির জন্য কেন এমন উতলা হয়ে উঠেছেন, যত ভাবছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে সে। মাথামুণ্ডু কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। বলল, কিন্তু
কিন্তু কী?
সবে কাগজের চাকরিটা পেয়েছি। আমাকে বিরাট অ্যাসাইনমেন্টও দেওয়া হয়েছে। চট করে কাজটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তাতে
হাত তুলে বিনয়কে থামিয়ে দিয়ে শিশির বলেন, দেখ, বড় সুযোগ বার বার আসে না। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। দ্বারিক দত্তর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী বলেন দ্বারিক জেঠা? সুযোগটা নেওয়া উচিত নয়?
দ্বারিক দত্ত তক্ষুনি সায় দিলেন, উচিত তো বটেই। শুরুতে এত টাকা মাইনে, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই অনেক উন্নতি হবে।
বিপুল উৎসাহে শিশির বললেন, তা তো হবেই। বেসরকারি ফার্ম। একটু কাজ দেখাতে পারলে তরতর করে ওপরে উঠে যাবে। বলতে বলতে আবার বিনয়ের দিকে তাকান, হিরণ সুধা সুনীতি আনন্দ, সবার ইচ্ছে তুমি এই কাজটা নাও। আমি তো বটেই, আমাদের বাড়ির ওরা, মানে কুমার মা, ঝুমা প্রত্যেকে তাই চাইছে।
ঝুমার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে চমক খেলে যায় বিনয়ের। শিশিরের এ-বাড়িতে ছুটে আসা, সাহেব কোম্পানিতে দামি চাকরি জোগাড় করে দিয়ে তার নিরাপদ, ঝলমলে ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে দেওয়া, এসবের মধ্যে কীসের একটা সংকেত যেন দ্রুত ফুটে উঠছে।
শিশির যে চাকরিটার কথা বলেছেন, মুরুব্বির জোর ছাড়া তা পাওয়া অসম্ভব। ওটা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ মুঠোয় পুরে ফেলা। অন্য কেউ হলে আহ্বাদে গলে পড়ত। কিন্তু বিনয় টের পাচ্ছে, চাপা একটা রাগ আর অস্বাচ্ছন্দ্য তার ভেতরে কোনও একটা বিন্দু থেকে উঠে এসে তপ্ত বাষ্পের মতো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকে সে।
শিশির বিনয়ের মুখচোখের দিকে লক্ষ করেননি। বলতে লাগলেন, তোমার কাগজের অফিস সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে। আমাদের বাড়ি থেকে খুবই কাছে। আমি অফিস থেকে ছটা সাড়ে ছটার ভেতর চলে আসি। কাল কি পরশু একটু সময় করে সন্ধেবেলায় আমাদের বাড়ি একবার এস। যদি তাড়া থাকে অ্যাপ্লিকেশনটা লিখে দিয়েই চলে যেও। মনে থাকবে তো?
থালায় ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে অস্পষ্ট জড়ানো গলায় বিনয় কী উত্তর দিল, নিজের কাছেই তা পরিষ্কার নয়। তবে সে ঠিকই করে ফেলেছে, জেসপ কোম্পানির চাকরিটা কোনওভাবেই নেবে না। নতুন ভারত ছাড়বার কথা এই মুহূর্তে সে ভাবতেই পারছে না।
শিশির বললেন, তোমার জন্য ওয়েট করব। অবশ্যই এস কিন্তু
বিনয় আগের মতোই আবছা গলায় কিছু বলল।
বিনয়দের খাওয়াদাওয়া চুকলে সুধা-সুনীতিরাও খেয়ে নিল। তারপর বাইরের ঘরে খানিকক্ষণ হালকা মেজাজে সবাই মিলে গল্পগুজব। বিনয় অবশ্য একধারে চুপচাপ বসে আছে। এই আড্ডা তার ভাল লাগছিল না। কেউ তাকে কিছু বললে, শুধু হাঁ করে যাচ্ছিল। হিমঋতুর দিনটা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। শীতের বেলা এই আছে এই নেই। আনন্দরা আর দেরি করল না। সেই উত্তর কলকাতায় যেতে হবে। বিকেলের চা খেয়ে একসময় তারা উঠে পড়ল। হিরণ বিনয় এবং সুধা বড় রাস্তা অবধি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাদের ট্যাক্সিতে তুলে দিল। গাড়িটা চলতে শুরু করলে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিনয়কে আরও একবার তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিলেন শিশির।