শতধারায় বয়ে যায় (Shotodharay Boye Jai) : 14
৬৬.
সময় কেটে চলেছে তার নিজস্ব নিয়মে। কলকাতায় আসার পর কত কিছুই তো ঘটে গেল। ঝিনুক নিখোঁজ। অবনীমোহন সংসারের মোহজাল ছিঁড়ে গুরুর আশ্রমে। রামরতন গাঙ্গুলির মতো একজন আদর্শবাদী মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে বেশ্যাপাড়ায় নাম লিখিয়েছে। হেমনাথদের ইহজীবনে পাকিস্তান ছেড়ে আসা হবে না। এইসব ঘটনায় মহাবিশ্বের আহ্নিক গতিতে কোথায় এতটুকু ছেদ পড়েনি। কী কারণে কে কতখানি কষ্ট পাচ্ছে, অনুশোচনায় গ্লানিবোধে কার বুক পুড়ে যাচ্ছে, কারও ব্যক্তিগত তুচ্ছ বেদনার খবর মহাকাল রাখে না।
সেই যে হেমনাথের চিঠি এসেছিল তারপর সপ্তাহ তিনেক পার হয়ে গেছে। পুরানো রুটিনেই সবকিছু চলছে বিনয়ের। অবশ্য আসাম থেকে দ্বিতীয়বার উৎখাত হওয়া শরণার্থীদের স্রোতটা তেমন আর নেই। বিধানচন্দ্র রায় আসাম গভর্নমেন্টের কাছে সেই যে আবেদন জানিয়েছিলেন তাতে অনেকটা কাজ হয়েছে। কিছু কিছু যে আসছে না তা নয়। তারা অন্যদিক দিয়ে ঘুরপথে চলে যাচ্ছে উত্তর বাংলায়। নর্থ বেঙ্গলে নতুন ভারত-এর যে নিজস্ব সংবাদদাতারা রয়েছে তারা নিয়মিত ওদের সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে।
আসাম থেকে না এলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের আসাটা হঠাৎ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ফরিদপুর, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ এমনকি কয়েকটি জেলায় রাজাকার আর মুসলিম লিগ নতুন করে হাঙ্গামা শুরু করেছে। চলছে অবাধে লুঠপাট, খুন, আগুন। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যুবতী মেয়েদের।
ব্যাপক বর্বরতা। এর ফলে আরও বেশি করে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের ঢল নেমেছে পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার দিকে। ইদানীং কদিন হল, একটার বদলে দুটো করে রিফিউজি স্পেশাল আসছে শিয়ালদায়।
দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বিরাট আকারের দাঙ্গা অনেকবার হয়ে গেছে। সে-সবের ধাক্কা এসে লেগেছে সীমান্তের এপারেও। অতি সাধারণ অতি নিরীহ মুসলমান যারা দিন আনে আনে দিন খায়, পাকিস্তান-হিন্দুস্থানের জটিল রাজনৈতিক টাপাপোড়নের বিন্দুবিসর্গও তারা বোঝে না, বিবি-বাচ্চাদের পেটের ভাত জোটাতে খেটে খেটে যাদের দিন কাবার হয়ে যায়, এবারকার ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ইত্যাদি এলাকার হাঙ্গামার খবর আসতেই তাদের কয়েকটা গ্রামে হামলা হয়ে গেছে। ভয়ার্ত বেশ কিছু মুসলমান পাকিস্তানে চলে গেছে। আরও অনেকেই যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে।
কাল রাতে অফিসে প্রসাদ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি তো কলকাতার চারপাশ চষে ফেলছ। হাজিগঞ্জ বলে কোনও গ্রামের নাম শুনেছ?
বিনয় বেশ অবাক হয়ে বলেছে, না। কোথায় সেটা?
শিয়ালদা সাউথ লাইনে মল্লিকপুর বলে একটা স্টেশন আছে। সেখানে নেমে যেতে হয়। ওটা গরিব মুসলমানদের গ্রাম। কাল সকালে রিফিউজি কলোনি কি রিলিফ ক্যাম্পে যেতে হবে না। তুমি সোজা হাজিগঞ্জে চলে যাবে।
সবিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত বিনয় তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ওখানে যাব কেন?
শুনেছি হাজিগঞ্জের মুসলিমরা ইস্ট পাকিস্তানে চলে যাবে। কেন ওরা যাচ্ছে, ওদের কী অসুবিধা হচ্ছে, ডিটেলে সমস্ত জেনে তাড়াতাড়ি একটা রিপোর্ট তৈরি করে দেবে।
বিনয়ের হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, আগরপাড়ায় মুসলমানদের একটা পরিত্যক্ত গ্রাম দেখেছিল সে। তাছাড়া শ্যামনগরে অন্য একটা ফাঁকা মুসলিম গ্রাম দখল করে উদ্বাস্তুরা কলোনি বসিয়েছে– নেতাজি সুভাষ পল্লি। এই গ্রামগুলোর কথা বলতে গিয়েও কাল থেমে গেছে বিনয়। বললে নিশ্চয়ই খুশি হতেন না প্রসাদ। আসলে না বলাটা ইচ্ছাকৃত নয়। ক্যাম্প এবং কলোনি নিয়ে সে এতটাই ব্যস্ত যে সেকুলার একটা দেশ ছেড়ে মুসলমানদের চলে যাওয়া যে খুব নাড়া-দেওয়া ঘটনা সেটা তার মনেই হয়নি। এর গুরুত্বই সে বোঝেনি।
প্রসাদের কথামতো আজ সকালে চানটান সেরে চা খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে বিনয়।
শিয়ালদা সাউথ থেকে যে-সব ট্রেন ডায়মণ্ডহারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর কি ক্যানিংয়ের দিকে যায়, তার কোনওটায় আগে চড়েনি বিনয়। এদিকটা তার পুরোপুরি অচেনা। অচেনা হলেও শিয়ালদা নর্থ লাইনের মতোই এই অঞ্চলে ট্রেন লাইনের দুধারে মোটামুটি একই দৃশ্য। আমন ধান কেটে নেবার পর যতদূর চোখ যায় শূন্য মাঠ। মাঝে মাঝে ছন্নছাড়া দু-চারটে কৃষাণ গ্রাম, ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা তাল, সুপুরি বা নারকেল গাছের জটলা। খাল, বিল, পুকুর। মেঘলেশহীন আকাশে ঝাঁকে ঝাকে। পাখি উড়ছে।
একসময় হুস হুস ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন মল্লিকপুর পৌঁছে গেল। নানা কামরা থেকে আট দশটি প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে বিনয়ও নেমে পড়ে।
সুরকি-বিছানো লম্বা প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় লাল রঙের ছোট স্টেশন বিল্ডিং। সেটার গা ঘেঁষে রেলের টি-স্টলে স্থানীয় কিছু লোক গুলতানি করছে। তার পাশে বাইরে বেরুবার গেট। ধুতির ওপর কালো. কোট পরা টিকেট কালেক্টর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা হাত সামনের দিকে বাড়ানো। যে প্যাসেঞ্জাররা ট্রেন থেকে নেমেছিল তাদের দু-তিনজন সেই হাতে টিকেট দিয়ে চলে গেল। বাকি সবাই বিনা টিকিটের যাত্রী। তারাও এদিক সেদিক দিয়ে সুট সাট সরে পড়ল।
রেলের বাবুটি নির্বিকার। কে টিকেট কেটেছে, কে ভাড়া না দিয়ে ট্রেনে চড়েছে তা নিয়ে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। রেল তো তার পৈতৃক সম্পত্তি নয়। ভাবখানা এরকম–কেউ যদি ফাঁকি দিয়েই থাকে, দিক।
বিনয় এগিয়ে এসে টিকেটটি রেল-বাবুর হাতে সঁপে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাজিগঞ্জ গ্রামটা কোথায় বলতে পারেন?
রেল-বাবু বলল, মুসলমানদের গাঁ। স্টেশনের বাইরে বেরুলে রাস্তা পাবেন। সেটা ধরে সিধে, চলে যান।
এখান থেকে কত দূর?
মাইল দেড় দুই হবে।
গেট পেরুতেই খোয়ার রাস্তায় এসে পড়ল বিনয়। সেটার দুধারে টালির চালের কিছু দোকানপাট। সেগুলো গা-জড়াজড়ি করে রয়েছে।
মিনিট তিন চার হাঁটার পর খোয়ার পথ শেষ। তারপর থেকে কাঁচা রাস্তা শুরু হয়েছে। তার দুদিকে খানিকটা পর পর গ্রাম।
চারদিক লক্ষ করতে করতে চলেছে বিনয়। পরিবেশ শান্ত, উত্তেজনাহীন, নিঝুম। এখানে এমন কী ঘটতে যাতে পারে যাতে হাজিগঞ্জের মুসলমানেরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে? দাঙ্গা, আগুন লাগানো, ব্যাপক হত্যা-এ-সব হলে এলাকার আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু তেমন কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না।
টিকেট কালেক্টর বলে দিয়েছিল, স্টেশন থেকে হাজিগঞ্জ দেড় দুমাইল দূরে। এত সব গ্রামের মধ্যে কোনটা হাজিগঞ্জ, কে জানে। তাই উলটো দিক থেকে যারা আসছে–চাষাভুষো ধরনের মানুষজন–তাদের জিজ্ঞেস করে করে এগিয়ে চলেছে বিনয়। যাকেই হাজিগঞ্জের কথা বলে সে-ই বেশ অবাক হয়। তার পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে, বাবু কি হেথায় লোতুন এয়েচেন?
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। হ্যাঁ—
হাজিগঞ্জ মোছলমান কেষাণদের গাঁ। হোথায় গে কী করবেন?
পোশাক-টোশাক দেখে লোকগুলো বুঝে গিয়েছে বিনয় শহুরে, শিক্ষিত এবং হিন্দু। এমন একজন কেন হাজিগঞ্জের খোঁজ করছে, সেজন্য তাদের প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল। সেই সঙ্গে হয়তো কিছুটা ধন্দে পড়ে গেছে।
বিনয় বলে, দরকার আছে।
কিন্তু বাবু ওই গাঁ খেনা (খানা) পেরায় ফাঁকা হয়ে গেছে। দেশ ছেড়ি (ছেড়ে) ওকেনকার লোকজন। চলি গেচে
সবাই চলে গেছে? দু-চারজনও কি নেই?
অনিশ্চিতভাবে লোকগুলো বলে, থাকতি পারে। তারাই গ্রামটার হদিস দেয়। কাঁচা রাস্তা ধরে আরও অনেকটা হাঁটলে একটা কুলুনি পড়বে। তারপরেই হাজিগঞ্জ।
কুলুনি যে কলোনি, সেটা বুঝতে পারে বিনয়। কলকাতার চারপাশে বনবাদাড় ঝোপঝাড় নির্মূল করে, ফাঁকা জমি দখল করে উদ্বাস্তুরা কত যে জবরদখল কলোনি বসিয়েছে তার লেখাজোখা নেই। প্রায় প্রতিদিনই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এইসব কলোনিতে বিনয়কে ছুটতে হয়। কিন্তু শিয়ালদা সাউথ লাইনের বেশ কটা স্টেশনে পেরিয়ে এত দূরে এসে উদ্বাস্তুরা গা বসিয়েছে এমন ধারণা ছিল না তার।
একসময় কলোনির সামনে এসে পড়ল বিনয়। উদ্বাস্তুদের আর দশটা উপনিবেশ যেমন হয়, এটাও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। রাস্তার দিকে খুঁটি পুঁতে তার মাথায় টিন লাগিয়ে আলকাতরা দিয়ে নাম লিখে দেওয়া হয়েছে : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কলোনি। সর্বত্যাগী জননায়কের নামে এই বেটপ জনপদের নাম। মনে হল, খুব বেশিদিন হয়নি এটার পত্তন হয়েছে।
অন্যদিন জবরদখল কলোনি, বা ত্রাণশিবির দেখলেই সে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আজ তাকে আলাদা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। কলোনি ডাইনে ফেলে মিনিট দশেক হেঁটে হাজিগঞ্জে পৌঁছে গেল বিনয়।
রাস্তা থেকেই বোঝা গেল, গ্রামটা বহুকালের পুরানো। পাকা দালান একটাও নেই। সবই টিন বা খড়ের চালের ঘর, মাটির দেওয়াল। কিন্তু কারওকেই দেখা যাচ্ছে না। চারদিক আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জনমানবহীন।
হঠাৎই মামুদপুরের কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। পূর্ব পাকিস্তানের একটা অতি অখ্যাত গ্রাম। ঝিনুককে নিয়ে সীমান্তের এক দঙ্গল ঘাতকের তাড়া খেয়ে পুরো একদিন সেখানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। ওখানকার হিন্দুদের এলাকাটা ছিল এমনই নির্জন। দমবন্ধ-করা। জমাট স্তব্ধতা জায়গাটার ওপর চেপে বসেছিল। মামুদপুরের ওই অঞ্চলটায় একটি জনপ্রাণীও ছিল না। ভিটেমাটি ঘরবাড়ি ফেলে সব হিন্দু চলে এসেছিল ভারতে।
হাজিগঞ্জ যেন আর-এক মামুদপুর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকল বিনয়। এখন দশটার মতো বাজে। এই দিনের বেলাতেও চতুর্দিক থেকে ঝিঁঝির ডাক উঠে আসছে। গ্রামের নানা প্রান্তে বিশাল বিশাল প্রাচীন সব গাছ। সেগুলোর ডালপালার আড়ালে থেকে থেকে তক্ষক ডেকে উঠছে।
বিনয় লক্ষ করল, অনেকগুলো বাড়ির দরজায় তালা লাগানো। কোনও কোনওটার দরজা জানালা হাট করে খোলা। সব খাঁ খাঁ করছে। একজোড়া দাঁড়াস সাপ বুক টেনে টেনে একটা ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে পড়ল।
কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল বিনয়ের। তবু এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে একটু সাহস করে সে ডাকতে লাগল, কেউ আছেন? একটু শুনবেন?
কোনও সাড়াশব্দ নেই।
হাজিগঞ্জ বেশ বড় গ্রাম। ডাকাডাকি করতে করতে অনেকটা ভেতর দিকে চলে এল বিনয়। আচমকা চোখে পড়ল ডানপাশের তিন চারটে বাড়ির জানালা থেকে কয়েক জোড়া শঙ্কাতুর চোখ চট করে সরে গেল।
না, গ্রাম একেবারে জনশূন্য নয়। যে জানালাগুলোয় চোখ দেখা গিয়েছিল সেদিকে এগিয়ে গেল বিনয়। বলল, ভয় নেই। বাইরে আসুন
কেউ বেরুল না।
তবে খানিক দূরে বাঁ পাশের একটা মেটে বাড়ি থেকে একটি আধবুড়ো মুসলমান বেরিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। চুল এলোমেলো। শুকনো, ক্ষয়টে শরীর। পরনে ময়লা লুঙ্গি আর জামার ওপর রং জ্বলে-যাওয়া পুরোনো চাদর। চোখে মুখে কেমন একটা ত্রস্ত ভাব।
বিনয় আঁচ করতে পারছিল, লোকটা ঠিক স্বস্তি বোধ করছে না। বলা নেই কওয়া নেই, একটি যুবক হঠাৎ এসে পড়েছে, ব্যাপারটা তাকে ভেতরে ভেতরে উতলা করে তুলেছে। তার অস্বাচ্ছন্দ্য কাটাবার জন্য নরম গলায় বিনয় জিজ্ঞেস করে, নমস্কার মিঞা সাহেব, আপনার নাম কী?
আগন্তুক যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলছে। লোকটা সসম্ভ্রমে সেলাম জানিয়ে বলল, কাসেম আলি। কিন্তুক বাবু, আপনারে তো চিনতি পারলাম না।
কী করে চিনবেন? আমি তো এই প্রথম আপনাদের এখানে এলাম। আমার নাম বিনয় বসু।
কীসির তরে (জন্য) এয়েচেন? কী চান বাবু?
সে খবরের কাগজে কাজ করে জানিয়ে বিনয় বলল, আপনাদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলতে চাই। কোথাও একটু বসা যাবে?
বিনয়ের কথাবার্তার ধরনে কাসেম মিঞা খুশি হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারছে না। তার মধ্যে উৎকণ্ঠা থেকেই যাচ্ছে। দ্বিধান্বিতভাবে বলল, আসেন
যে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল, বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে সেটার বাইরের দিকের বারান্দায় একটা হাতল-ভাঙা চেয়ারে তাকে বসালো কাসেম আলি। নিজে বসল মাটির ওপর। বলল, কী কইবেন, বলেন বাবু—
শুনলাম, এখানকার সবাই পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। গ্রামে ঢুকে দেখলাম অনেক বাড়ি ফাঁকা। মনে হল, তারা আগেই চলে গেছে।
কাসেম আলি চুপ করে থাকে।
আমি কোনও ক্ষতি করব না। আমাকে আপনাদের নিজের লোক ভাবতে পারেন।
কাসেম আলি কিছুক্ষণ কী ভেবে শেষ পর্যন্ত মনস্থির করে ফেলে। ঢোক গিলে বলে, হ্যাঁ বাবু। বেশির ভাগ লোক পাকিস্থানে চইলে গেচে।শুদু আমাদের হাজিগঞ্জ লয়, ওধারে ধরুন গে, সরাইপুর, তাজহাট-কাঁচাকাচি এমনি আরও কটা গাঁয়ে গেলে একজন লোকও পাবেন না। সব একন বারের ওপারে। আমরা হাজিগঞ্জে যে কঘর আচি, দু-চার দিনির মদ্যি চইলে যাব।
নিজের দেশ ছেড়ে, বাপ-দাদার বাড়ি ফেলে চলে যাচ্ছেন কেন?
কাসেম আলি জবাব দিল না।
এদিকে এধার ওধার থেকে একজন দুজন করে কিছু লোক দাওয়ার সামনে এসে জড়ো হয়। যুবক, বৃদ্ধ, আধবয়সী। এক দঙ্গল বাচ্চাও জুটে গেল। এই গ্রামে পর্দার কড়াকাড়ি নেই। নানা বয়সের কিছু মেয়েমানুষকেও দেখা যাচ্ছে। তারা কাছে আসে নি। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সবার চোখ বিনয়ের দিকে।
আগের কথার সুতো ধরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, খানে কি বড় রকমের দাঙ্গা হয়েছে?
কাসেম আলি বলল, হয়নি
কেউ কি দেশ ছাড়ার জন্যে হুমকি দিচ্ছে?
কাসেম আলি জবাব দেবার আগেই সামনের ভিড়টার ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে, পাকিস্থান ঠেঙে (থেকে) যে রিফুজরা একেনে এয়েছে তারা মদ্যি মদ্যি এইসে শাইসে (শাসিয়ে) যায়। আঙুল বাড়িয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কলোনিটা দেখিয়ে ওরা বলতে থাকে, বলে, তোদের জন্যি পাকিস্থান দেওয়া হয়েছে। হিন্দুস্থানে পইড়ে আছিস কেন? চইলে যা। এই এলেকের কিছু নোকও তাদের সনগে ভিড়ে গেছে।
পাকিস্তান ইসলামিক স্টেট। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সেটার সৃষ্টি। কিন্তু ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে সব জাতি, সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। এদেশের নাগরিক হিসেবে একজন হিন্দুর যতটা মর্যাদা, মুসলমান শিখ বা খ্রিস্টানেরও ঠিক ততটাই। কিন্তু এ-সব ভারী ভারী কথা কাসেম আলিদের মাথায় ঢুকবে না। বিনয় বলল, কে কী বলল তা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনাদের গায়ে কেউ আঙুল ঠেকাতে পারবে না।
কাসেম আলি ইতস্তত করে বলে, শুনতি পাচ্চি, আরও অনেক রিফুজি ইদিগির (এদিকের) ফাঁকা জায়গাগুনোয় কুলুনি বসাবে। পাকিস্থান ঠেঙে মার খেইয়ে মাগছেলাপুলারে নিয়ি হেথায় চইলে। আসতেছে। আসাদের উবরি (ওপর) তাদের খুব রাগ। ককন কী কইরে বসবে! মোট্যে ভস্ (ভরসা) পাই না। তাছাড়া
প্রায় সব দেশেরই, বিশেষ করে সদ্যখণ্ডিত একটি দেশের দুই অংশে, ভারত এবং পাকিস্তানের মাইনোরিটিদের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতার ভয়। কোথাও কম, কোথাও বেশি। সেটা তাদের অস্তিত্বের ভেতর বদ্ধমূল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ তাদের ত্রাস, সারাক্ষণ উৎকণ্ঠা।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, তাছাড়া কী?
আমাদের জেতের অনেক নোক ওপারে চইলে গেচে, আরও যাচ্চে। তাই–বাকিটা শেষ না করে থেমে যায় কাসেম আলি।
অনেকে একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে থাকলে তবু খানিকটা সাহস পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে বড় রকমের ভাঙন ধরেছে, আত্মবিশ্বাস টলে যেতে বাধ্য। হাজিগঞ্জের বাসিন্দাদের মনোভাবকাসেম আলির কথায় ফুটে ওঠে। সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিনয়ের।
কাসেম আলি ফের বলে, আরও কিছু কতা (কথা) আচে বাবু। শুনিচি পাকিস্থানে গেলি আমাগের পচুর সুযুগ সুবিদে মেলবে। একেনে লিজের এক বেঘত জমিনও লেই। পরের খেতিতে চাষ কইরে ছমাস দুবেলা খেতি পাই। বাকি ছমাস হয় উপুস, লইলে আধপেটা। আমরা বড় গরিব। তাই
তার কথা শেষ হতে না হতেই জটলা থেকে একটা আধবুড়ো বলে, হোতায় (সেখানে অনেক চাষের ভূঁই, বাড়িঘর দেচ্চে। পাকিস্থানে গেলি কুনো দুঃখুকষ্ট থাকবেনি।
বিনয় জানে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ছিন্নমূল মানুষেরা এপারে চলে এসেছে তাদের অনেকেরই ধারণা ছিল ভারতবর্ষ এক স্বপ্নের দেশ। এখানে পথেঘাটে সোনাদানা হীরে মুক্তো ছড়ানো, নদীতে দুধের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। একবার সীমান্ত পেরুতে পারলেই হয়। ওদের মতোই হাজিগঞ্জবাসী গরিবগুরবো মানুষগুলোও স্বপ্ন দেখছে পাকিস্তানে পৌঁছুতে পারলে তাদের সমস্ত কষ্টের অবসান হবে। সেখানে তাদের জন্য বেহেস্তের যাবতীয় সুখ অপেক্ষা করে আছে।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, পাকিস্তানে কোথায় যাবেন আপনারা?
কাসেম আলি বলল, আমাদের হাজিগঞ্জ বলেন, ওদিগির (ওদিকের) সরাইপুর তাজহাট কি আর দু-চারটে গাঁ বলেন–সব জায়গার নোকজন খুলনে আর ঢাকার দিকি গেছে। আমরাও ত্যামন কুতাও (কোথাও) যাব।
যারা ওপারে গেছে তারা কেমন আছে, কীভাবে আছে, কিছু খবর পেয়েছেন?
এবার চিন্তিত দেখায় কাসেম আলিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, না, পাইনি বাবু। তবে পাকিস্থানি য্যাকন গেছে, মনে হচ্চে, ভালই আছে।
বিনয় বলল, পাকিস্তান অচেনা জায়গা। সেখানে যাবার আগে ভাল করে ভাবনা চিন্তা করবেন। কথাটা শুধু কাসেম আলিকেই না, জমায়েতের সকলের উদ্দেশেই বলেছে সে।
কিন্তু কেউ উত্তর দিল না।
বিনয় বুঝতে পারে, হাজিগঞ্জ প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। বাকি মানুষগুলোও দেশ ছাড়ার জন্য বদ্ধপরিকর।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উঠে পড়ল বিনয়।
শুধু হাজিগঞ্জ নয়, পরের একটা সপ্তাহ খোঁজ করে করে কলকাতার কাছাকাছি আরও কটা মুসলিম গ্রামে গেল বিনয়। সব জায়গাতেই লোকজনের মনে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা, চোখে পাকিস্তানের সুখস্বপ্ন। তারাও সীমান্তের দিকে পা বাড়িয়ে আছে।
এদিকে কলকাতা রাতারাতি চোখের সামনে দ্রুত পালটে যাচ্ছে। এই তো সেদিন বিনয় ঝিনুককে নিয়ে এই শহরে এল। প্রথম প্রথম কখনও সখনও উদ্বাস্তুদের দু-একটা মিছিল দেখা যেত। সেগুলোতে কটা আর লোক! খুব বেশি হলে চল্লিশ কি পঞ্চাশ। সবচেয়ে বড় যেটা তাতে এক শ জনও হবে। কি না সন্দেহ।
কিন্তু এখন? রোজই কলকাতার উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে গণ্ডা গণ্ডা মিছিল। কোনও কোনও মিছিলে চার হাজার পাঁচ হাজার উদ্বাস্তুও থাকে। যত দিন যাচ্ছে, মিছিলগুলো আরও, আরও লম্বা হচ্ছে।
শুধু রাস্তা জুড়ে গাড়িঘোড়া থামিয়ে দিয়ে মিছিলই নয়, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে, হাজরা পার্কে কি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ডাঃ বিধান রায়ের বাড়ির উলটো দিকেও মিটিং হচ্ছে। অজস্র উদ্বাস্তুর সঙ্গে কলকাতায় এসেছে বিনয়। তাদের তো দেখেছেই। তার আগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা চলে এসেছিল তাদেরও দেখেছে। প্রথম প্রথম এই ছিন্নমূল মানুষগুলি ছিল সন্ত্রস্ত, জড়সড়। কিন্তু খুব অল্পদিনে তারা দ্রুত পালটে গেছে। মিটিংয়ে মিছিলে ইদানীং যাদের দেখা যাচ্ছে তারা ক্রোধে, অসন্তোষে, উত্তেজনায় ফুটতে থাকে। প্ল্যাকার্ড হাতে, আকাশের দিকে মুঠো-পাকানো হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে আগুন উগরে দেবার মতো তারা আকাশ ফাটিয়ে স্লোগান দেয়
আমরা কারা?
বাস্তুহারা।
আমাদের পুনর্বাসন
দিতে হবে, দিতে হবে।
আমাদের চাষের জমি
দিতে হবে, দিতে হবে।
আমাদের ক্যাশ ডোল
বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে। ইত্যাদি।
জবরদখল কলোনি বা ক্যাম্পেই শুধু নয়, কাগজের দরকারে প্রায়ই উদ্বাস্তুদের মিছিলের সঙ্গে তাদের সভাতেও যেতে হয় বিনয়কে। সর্বস্বহারানো মানুষগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে সে। ত্রাণশিবিরে, কলোনিতে কি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পশুর মতো জীবন :পন করতে করতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, সামনে অনন্ত অন্ধকার–এই পরিস্থিতিতে চরম বিস্ফোরণ। ঘটাবার জন্য তারা প্রস্তুত।
এদের দেখতে দেখতে প্রায়ই সময়ের উজান টানে কবছর পেছন দিকে ফিরে যায় বিনয়।
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। তবে ইংরেজরা ঘোষণা করেছে পূর্ব গোলার্ধের এই ভারতীয় উপনিবেশ ছেড়ে তারা চলে যাবে। দু শ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটবে কিন্তু এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়, তার জন্য কিছু চড়া দামও দিতে হবে। ভারত আর আগের অখণ্ড ভারত থাকবে না। দুভাগ হয়ে এক অংশের পুরোনো ভারত নামটাই বজায় থাকবে, অন্য অংশটি হবে পাকিস্তান। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি দেশ। অর্থাৎ স্বাধীনতা এবং দেশভাগ একই দিনে একই লগ্নে ঘটবে।
পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘুরা যখন জানলো তাদের অংশটি পাকিস্তানে পড়েছে, সেটা হয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি মুসলিম জাহান, শঙ্কায় আতঙ্কে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। দাঙ্গার অভিজ্ঞতা তাদের স্মৃতিতে তখনও টাটকা। তারা বুঝতে পারছিল একবার পাকিস্তান হয়ে গেলে তাদের পক্ষে সেখানে থাকা আদৌ সম্ভব নয়।
মহাত্মা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব বাংলার এই বিশাল মানবগোষ্ঠীর মনোবল একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নয়া দিল্লির এক প্রার্থনা সভার পর তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা মোটামুটি এইরকম : পূর্ব বাংলার হিন্দুদের একটা বড় সমস্যা হল, সত্যিকার বা কাল্পনিক ভয়ে তারা পাকিস্তানে তাদের বাড়িঘর ছাড়বে। যদি দৈনন্দিন কাজকর্মে বা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় তাদের বাধা দেওয়া হয় কিংবা তাদের যদি নিজের দেশে বিদেশি মনে করা হয়, যদি সেখানে এই মানুষগুলির পক্ষে থাকা সম্ভব না হয়, তেমনটা হলে সীমান্তের এপারে তাদের দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানানো, এবং সবরকম বৈধ সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত। এখানে এসে তারা যেন কখনই মনে না করে, অন্য দেশ থেকে এসেছে। তারা বিদেশি।
গান্ধীজি বোঝাতে চেয়েছেন, ভারত পূর্ব-পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষদের কাছে স্বদেশ।
জওহরলাল নেহরুও স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের কাছে কত না প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বার বার তিনি তখন বলেছেন, পূর্ব বাংলায় যারা বিপন্ন হয়ে পড়বে তাদের দেশেই ওই মানুষগুলির সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা, আর যদি প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে তা সম্ভব না হয় ভারতে তাদের আশ্রয় দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
কিন্তু দেশভাগের পর এইসব আশ্বাসের কথা খুব সম্ভব মনে ছিল না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লোকসভায় বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা যে দলে দলে ভারতে চলে আসছে তা কোনওভাবেই কাম্য নয় এবং তাদের দেশত্যাগে উৎসাহ দেওয়া অনুচিত। তিনি নানাভাবে বুঝিয়ে দিতেন, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা এদেশে বহিরাগত। তারা বিদেশি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের এক চিঠির জবাবে তিনি লিখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে জনস্রোত এপারে চলে আসছে তা সর্বতোভাবে ঠেকাবার চেষ্টা করা উচিত। নইলে এই বিরাট সমস্যার সমাধান করা মুশকিল।
নেহরুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইন্টার ডোমিনিয়ন কনফারেন্স অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তানের সর্বোচ্চ স্তরে আলোচনার মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের নিয়ে সংকটের সুরাহা সম্ভব। কনফারেন্স হয়েও ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে এরপর যে চুক্তি হয় তাতে কিঞ্চিৎ সুফলও মেলে। সাময়িকভাবে হিন্দুদের আসাটা কমে যায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবার ঝাঁকে ঝাকে উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করে।
পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্র যা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিতের ওপর সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রবল সেখানে কাগজের ওপর কালির হরফে লেখা ঠুনকো এগ্রিমেন্ট দিয়ে তাদের কতদিন আর ঠেকিয়ে রাখা যায়! ফের শুরু হল সন্ত্রাস-হুমকি, হত্যা, আগুন, ধর্ষণ, ইত্যাদি।
আসলে পাকিস্তান সম্পর্কে একটা তলতলে নরম মনোভাব নিয়ে চলেছেন নেহরু! তার ধারণা, টেবলের দুধারে বসে কথাবার্তা বললেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কঠোর পদক্ষেপ নিতে তিনি ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। আঙুল তুলে কড়া গলায় যদি বলতেন, উৎপাত বন্ধ করার ব্যবস্থা নাও, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের দুর্গতি এতটা হতো না।
এ-সব সত্ত্বেও উদ্বাস্তুরা এদেশে এসে প্রথম প্রথম কংগ্রেসের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কংগ্রেস সর্বভারতীয় বিশাল রাজনৈতিক শক্তি। তারাই নিরঙ্কুশভাবে দেশ শাসন করে। উদ্বাস্তুদের বিশ্বাস ছিল কংগ্রেস তাদের নিরাপত্তা, পুনর্বাসন এবং বেঁচে থাকার সবরকম ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেভাবে তাদের আশা পূরণ হয়নি। যা প্রত্যাশা ছিল, প্রাপ্তি তার অনেক কম। ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসের একটা বড় অংশ মনে করত, পাকিস্তানে তাড়া খেয়ে যারা এই বাংলায় এসেছে তারা পুরোপুরি সেকুলার নয়, নির্যাতন ভোগ করার ফলে সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে।
নানা কারণে ছিন্নমূল মানুষেরা ধীরে ধীরে কংগ্রেসের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। আর সেই ফাঁকে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি উদ্বাস্তুদের কাছাকাছি চলে আসে। তাদের নিয়ে মিটিং মিছিল আন্দোলন চালাচ্ছে ব্যাপক আকারে।
মাঝে মাঝেই দেশের নানা সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়ে বিনয়দের রিপোর্টিং সেকশনে তুমুল তর্কাতর্কি লেগে যায়। সবচেয়ে বেশি হইচই হয় উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গ উঠলে।
চিফ রিপোর্টার ছাড়া অন্য রিপোর্টাররা এবং সাব-এডিটররা তো থাকেই, আজকাল নিউজ এডিটর। তারাপদ ভৌমিক, দুজন অ্যাসিস্টান্ট এডিটর অরুণেশ চৌধুরি আর মণিশঙ্কর মিত্রও চলে আসেন।
সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ঘোরাঘুরির পর এই সেদিন অফিসে এসে বিনয় দেখে চিফ রিপোর্টারের টেবলে জমজমাট ভিড়। তারাপদ ভৌমিক থেকে শুরু করে নিউজ ডিপার্টমেন্টের অনেকেই হাজির। উদ্বাস্তুদের নিয়ে তখন তুমুল শোরগোল চলছে।
উদ্বাস্তুদের টপিকটা সুধেন্দুর খুবই পছন্দ। এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সে-ই সবচেয়ে উঁচুতে গলা চড়ায়।
সেদিন সে বলছিল, কমিউনিস্ট পার্টি এতদিন কৃষক আর লেবারের ওপর বেশি জোর দিয়ে এসেছে। এবার আর-একটা বিরাট এরিয়া পেয়ে গেছে। রিফিউজি। তাদের নিয়ে প্রায় রোজই কোথাও না কোথাও মিছিল করছে। মিটিং করছে।
তারাপদ বলেছেন, হা। রিফিউজি বেল্টে ওদের ইনফ্লুয়েন্স বেড়ে যাবে, মনে হচ্ছে।
সুধেন্দু বলল, আপনি দেখে নেবেন তারাপদদা, ইন ফিউচার এই অসংখ্য মানুষ ওদের বিরাট স্ট্রেস্থ হয়ে উঠবে।
ঠিকই বলেছ।
অ্যাসিস্টান্ট এডিটর মণিশঙ্কর মিত্র বলেছেন, রিফিউজিদের এরিয়ায় যদি ওরা ভালরকম বেস তৈরি করতে পারে, ওদের পার্টি হিউজ গেইন করবে।
বিনয় কোনও মন্তব্য করেনি। সে জুনিয়র রিপোর্টার। চিফ রিপোর্টার, নিউজ এডিটর, অ্যাসিস্টান্ট এডিটরদের মতো বাঘা বাঘা সিনিয়র সাংবাদিকদের সামনে মতামত জানানো তার পক্ষে ধৃষ্টতা। সারা শহর এবং শহরতলির নানা এলাকায় চরকির মতো পাক খেতে খেতে, প্রতিদিন মিছিল আর সভাটভায় হাজিরা দিতে দিতে বিনয়ের মনে হয়, তারাপদরা যা বলেছেন, তার পুরোটাই ঠিক।
৬৭.
ফাল্গুন মাস পড়ে গেছে কদিন আগেই। আকাশ এখন ঝকঝকে পরিষ্কার। দক্ষিণ দিক থেকে আরামদায়ক, ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে শহরের ওপর দিয়ে। দিনের তাপাঙ্ক উঠতে শুরু করেছে। রোদের সেই ম্যাড়মেড়ে ভাব আর নেই। দিনের আলো দ্রুত ঝলমলে, সতেজ হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন হল শান্তিনিবাস-এ এসেছে বিনয়। এমনিতে ক্যাম্পে, কলোনিতে, উদ্বাস্তুদের সভায়টভায় অবিরল ছোটাছুটি চলছেই। তুমুল ব্যস্ততার পর মেসে যখন ফেরে, বোর্ডাররা ততক্ষণে রাতের খাওয়া চুকিয়ে শুয়ে পড়েছে। কেননা পরদিন সকালে উঠেই অফিসে টফিসে যাবার তোড়জোড় করতে হয় তাদের। জমিয়ে আড্ডা দেবার সময় কোথায়? সন্ধেবেলায় কাজ থেকে ফেরার পর যখন ওদের হাতে অনেকখানি ফুরসত থাকে তখন বিনয় নতুন ভারত-এর অফিসে ঘাড় গুঁজে কোনও কলোনি টলোনি নিয়ে লিখছে।
রবিবার বিনয়ের ছুটি। কিন্তু শনিবার অফিসে হাফ-ডে করে মেসের প্রায় সব বাসিন্দা যে যার বাড়ি চলে যায়, ফেরে সোমবার অফিস করে সেই সন্ধেবেলায়। সপ্তাহের বাকি কাজের দিনগুলোতে মেসে আসা-যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু হাসি, যৎসামান্য দু-একটা কথার আদান-প্রদান, বোর্ডারদের সঙ্গে সম্পর্কটা এর বেশি আর এগোয় না।
কিন্তু হারু আর দুলালের কথা আলাদা। কলেজে নাইট ক্লাস সেরে বাড়ি থেকে রাত্তিরের খাবার খেয়ে ওরা চলে আসে বিনয়ের ঘরে। ঘণ্টা দেড় দুই কাটিয়ে ঘুমোতে চলে যায়। রবিবারটা তো প্রায় সারাদিনই বিনয়ের ঘরে থাকে। এটাই রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে।
ছেলে দুটো ভারী সরল, সাদাসিধে। ওদের খুবই পছন্দ করে বিনয়। ফেরিওয়ালারা মহেশ হালদার লেনে নানা খাবার বিক্রি করতে আসে। অন্যদিন সম্ভব নয়, কিন্তু রবিবার ওদের এটা সেটা কিনে খাওয়ায়। কোনও কোনও রবিবার দুপুরে আর রাত্তিরে না খাইয়ে ছাড়ে না। মেসেই ওদের মিল-এর ব্যবস্থা করে। মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন সে মেসের চার্জ মেটায় তখন হারুদের খাবারের দামটাও চুকিয়ে দেয়।
কোনও কোনও রবিবার লাজুক সুরে হারু বা দুলাল বলে, একখান কথা কমু বিনয়দা?
কী কথা? বিনয় উৎসুক চোখে তাকায়।
অনেক কাল সিনেমা দেখি না। পয়সার জবর অভাব। নূতন একটা পিকচার পূর্ণ সিনেমায়। রিলিজ করছে। দেখাইবেন?
নিশ্চয়ই। এত সংকোচ করছ কেন?
প্রায় ফি রবিবারই ম্যাটিনি কি ইভনিং শোয়ে উজ্জ্বলা, ইন্দিরা বা বিজলীতে হারুদের সিনেমা দেখিয়ে আনে বিনয়। এই দুটো ছেলের প্রতি বিনয়ের গভীর সহানুভূতি। কত আর বয়স হারুদের? বড় জোর আঠারো উনিশ। এই বয়সে মানুষের কত শখ টখ থাকে। কিন্তু কিছুই মেটাবার উপায় নেই। ওদের সংসারের কী হাল বিনয় তার কিছুটা শুনেছে প্রসাদ লাহিড়ির কাছে। বাকিটা হারুরাই বলেছে। দু-চারটে টাকা খরচ করলে ওদের মুখে যদি একটু হাসি ফোটে তাতে খুশিই হয় সে।
শান্তিনিবাস-এ আসার পর রবিবারটা বাদ দিলে সময় যেন বিনয়কে পিঠে চাপিয়ে দুই ডানা মেলে দুরন্ত গতিতে সামনের দিকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে তার মধ্যে নিজের অজান্তেই বুঝি বা অনেক পরিবর্তনও ঘটে যাচ্ছে। তার যে ধরনের কাজ তাতে পেছন দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ খুব একটা পায় না। ফেলে-আসা জীবন ক্রমশ দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। যে ঝিনুক তার শ্বাস প্রশ্বাসে জড়িয়ে ছিল, যাকে বুকের ভেতর আগলে আগলে পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে এপারে নিয়ে এসেছে, সারাদিন ঊধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে তার কথা আজকাল তেমন যেন খেয়াল থাকে না। তবে মেসে ফিরে ক্লান্ত শরীর বিছানায় ঢেলে দেবার পর বিজন রাতে লাঞ্ছিত মেয়েটার মুখ কি তার সামনে ফুটে ওঠে না? নিশ্চয়ই ওঠে। কিন্তু কতক্ষণ আর। বিনয়ের চোখ ঘুমে জুড়ে আসে, সেই মুখটাও ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যায়।
ঝিনুকের জন্য কি বিনয়ের কষ্ট হয় না? হয়। উদ্ভ্রান্তের মতো রিফিউজিদের ক্যাম্প, কলোনি আর শিয়ালদা স্টেশনে তাকে কম খোঁজেনি সে। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করেও ঝিনুককে খাওয়া যায়নি। এই ধারণাটা বিনয়ের মধ্যে ক্রমশ বদ্ধমূল হচ্ছে, ওকে আর পাওয়া যাবে না। নৈরাশ্য জমতে জমতে ঝিনুককে ঘিরে তার ব্যাকুলতা এবং ক্লেশের তীব্রতা আর আগের মতো নেই। শোক, দুঃখ, যাতনার অনুভূতি খুব সম্ভব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটাই জাগতিক নিয়ম।
ছায়াকেও পাওয়া যায়নি। নরকের খাসতালুক থেকে বিনয় তাকে উদ্ধার করে আনবে, সেই প্রতিজ্ঞা পালনও করা হয়নি। সেই যে সেদিন মানিকতলার বেশ্যাপাড়ার মেয়েগুলো চোখের তারা নাচিয়ে, ঠোঁট কুঁচকে তার দিকে অশ্লীল, নোংরা নোংরা টিপ্পনী ছুঁড়ে দিচ্ছিল তাতে এক মুহূর্তও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি বিনয়। মনে হচ্ছিল, সারা গায়ে ক্লেদ আর দুর্গন্ধ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। দমবন্ধ করে পালিয়ে এসেছিল সে। ঠিকই করেছিল। আর কখনও ওখানে যাবে না। তবে হরিচরণদের প্রচণ্ড জেদ। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েদের বেশ্যাপল্লির ফাঁদ থেকে বার করে আনার জন্য অবিরাম ছোটাছুটি করছেন। তাকে ছায়ার কথা বলেছে বিনয়। কিন্তু রামরতন গাঙ্গুলির মেয়ের হদিস তিনিও পাননি। মেয়েপাড়ার মালকিন তাকে কোথায় সরিয়ে দিয়েছে, কে জানে।
আজ রবিবার। সকালে ঘুম ভাঙার পর মুখটুখ ধুয়ে প্রসাদের ঘরে গিয়েছিল বিনয়। শান্তিনিবাস-এ তার নিত্যকর্ম শুরু হয় প্রসাদের সঙ্গে চা-বিস্কুট খেতে খেতে, রোগা রোগা, অপুষ্টিতে ভোগা উদ্বাস্তুদের এক পাল বাচ্চার জন্য পাউরুটি কেটে সেগুলোতে মাখন লাগানো, তার পর সুবলের আনা লুচি কি কচুরি খাওয়া ইত্যাদি দিয়ে। আজ সে-পর্ব চুকিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে বিনয়।
বেলা একটু চড়লে হঠাৎ হিরণ এসে হাজির। আজ সে আসবে, আগে তা জানায়নি। কয়েক পলক সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়। তারপর ব্যস্তভাবে উঠে গিয়ে একটা চেয়ার এনে বলল, বসুন হিরণদা–
হিরোন বসে পড়লে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কতদিন পর শান্তিনিবাস-এ এলেন। সেই আমাকে ছোটদি আর আপনি এখানে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। তারপর দু-একবার মোটে এসেছিলেন। তাও কতদিন হয়ে গেছে।
বিনয়ের বলার ভঙ্গিতে অনুযোগ দিল। হিরণ বলে, সেটা তো আমিও বলতে পারি। মেসে আসার পর টালিগঞ্জে কবার গেছ?
আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি গেছি। বলে একটু থামে। তারপর ফের শুরু করে, অফিসের ভীষণ চাপ। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। রবিবারটা ছুটি। মাঝে মাঝে সেদিনও বেরুতে হয়। সবই আপনি জানেন।
আমাকে অফিস দেখিও না। চাকরি আমিও করি। তাছাড়া আমি একজন ফ্যামিলি-ম্যান। বুড়ো ঠাকুরদা, অসুস্থ জেঠিমা রয়েছে। কতদিক যে সামলাতে হয়। তোমার ঘাড়ের ওপর এত প্রেসার আছে? তুমি তো ঝাড়া হাত-পা ইয়ং ম্যান।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন থেকে আরও বেশি করে টালিগঞ্জে যেতে চেষ্টা করব।
দেখা যাক। হিরণ বলল, শোন, একটা বিশেষ দরকারে তোমার কাছে এসেছি
বিনয় বলে, দরকারের কথা পরে হবে। আগে চাটা আনাই
কিছুতেই আনাতে দিল না হিরণ। জানালো, আধ ঘন্টা আগে বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরিয়েছে। তারপর বলল, জেঠিমা এখন সুস্থ। তাকে নিয়ে আপাতত দুর্ভাবনার কোনও কারণ নেই। বাড়ির রং, রিপেয়ার হয়ে গেছে। গৃহপ্রবেশটা আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। আসছে রবিবার দিনও স্থির হয়ে গেছে। তুমি অবশ্যই ওই দিন আমাদের নতুন বাড়িতে চলে যাবে। খুব সকাল সকাল যেয়ো। দেরি কোরো না।
বিনয় মাথা হেলিয়ে দেয়–যাবে।
এবার চল, প্রসাদদাকে নেমন্তন্নটা করে আসি। তোমাকে যেদিন মেসে দিয়ে গেলাম, সেদিন ওঁকে বলেছিলাম, গৃহপ্রবেশের দিন ওঁর যাওয়া চাই-ই চাই। উনি রাজি হয়েছিলেন।
রবিবার প্রসাদেরও ছুটির দিন। তিনি তার ঘরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হিরণ নেমন্তন্ন করলে বিব্রত বোধ করেন। জানালেন, পরের রবিবার নতুন ভারত-এর মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতা তাঁর বাড়িতে কাগজের কজন সিনিয়র সাংবাদিককে নিয়ে মিটিং করবেন। সেখানে প্রসাদকেও হাজির থাকতে হবে, তাই হিরণদের গৃহপ্রবেশের দিন যাওয়া সম্ভব হবে না। পরে নিশ্চয়ই একদিন যাবেন। হিরণরা যেন কিছু মনে না করে।
হিরণ বলল, আপনি গেলে খুব আনন্দ হতো।
আমার আনন্দও কি কম হতো? কিন্তু কী করব ভাই, মালিক ডেকেছেন। না গিয়ে কি উপায় আছে?
হিরণ বলল, যেদিন যাবেন, একটু আগে যেন খবর পাই। আমি এসে নিয়ে যাব।
প্রসাদ বললেন, নিয়ে যেতে হবে না। আমি বিনয়কে নিয়ে চলে যাব।
৬৮.
পরের রবিবার খুব সকালে উঠে অন্যদিনের মতো চান টান সেরে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল । বিনয়।
ফাল্গুনের আধাআধি পার হয়েছে ঠিকই তবু দিনের শুরুতে এখনও কিছুটা সময় বাতাসে ঠাণ্ডা একটা আমেজ থাকে। সন্ধের পরও শীত শীত লাগে। বিনয়ের ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই শার্টের ওপর একটা হাফ-হাতা পাতলা সোয়েটার পরে নিয়েছে। বেলা চড়লে রোদের তেজ যখন বাড়বে, সোয়েটারটা খুলে ফেলবে।
ট্রামে টালিগঞ্জে এসে সুধাদের জাফর শা রোডের বাড়িতে গেল না বিনয়। একটা রিকশা ধরে সোজা আমিনুল হক স্ট্রিটে খান মঞ্জিল-এর সামনে এসে নামল। তারপর অপার বিস্ময়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বাড়িটাকে এখন আর চেনা যায় না। পুরানো রেন ওয়াটার পাইপ, গেট–সব পালটে নতুন লাগানো হয়েছে। ভাঙা দেওয়াল, ছাদের কার্নিস, বাউণ্ডারি ওয়াল মেরামত করে আগাগোড়া রং করা হয়েছে। বাতাসে টাটকা পেন্টের ঝাঝালো গন্ধ। গেটের দুপাশে চিত্র-করা বড় ঘটে শিষ-ওলা আমের পল্লব, কলাগাছ। গেটের মাথা ফুল পাতা দিয়ে সাজানো।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতর যেতে গিয়ে চোখে পড়ল গেটের পাশে বাউণ্ডারি ওয়ালের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা আছে? রাজদিয়া হাউস। বাড়ির নাম কী হবে, এই নিয়ে হিরণ, দ্বারিক দত্ত, সুধা এবং সে কম মাথা ঘামায়নি। শেষ অবধি দ্বারিক দত্তর দেওয়া এই নামটাই সবাই মেনে নেয়। রাজদিয়ায় কোনওদিনই আর ফেরা হবে না। কিন্তু এই বাড়ি যতদিন আছে পূর্ববঙ্গের সেই ভূখণ্ডের স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। নামটা দেখতে দেখতে পুরানো কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের।
তার আরও মনে পড়ে, প্রথম যেদিন হিরণের সঙ্গে এই বাড়ি দেখতে আসে, যেখানে রাজদিয়া হাউস লেখাটা রয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় একটা বিবর্ণ পাথরের পাটায় লেখা ছিল : খান মঞ্জিল। প্রতিষ্ঠা ১৮৮০ সাল। তার নিচে রহমত আলি খান এম এ, বি এল। গত শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি এই ইমারতের গা থেকে তার আদি নাম তো বটেই, তার প্রতিষ্ঠাতার নামও চিরকালের মতো বিলীন হয়ে গেল।
গেট পেরিয়ে বাড়ির কমপাউন্ডে ঢুকল বিনয়। ভেতরে কোথাও ধুলো ময়লা আবর্জনার লেশমাত্র নেই। সব ঝকঝক তকতক করছে। অল্পবয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হইচই বাধিয়ে চারদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
হিরণ সেদিন বলেছিল, গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে অনেককে নেমন্তন্ন করেছে। ছেলেমেয়ে স্ত্রী সুদ্ধ তার অফিসের সহকর্মীদের, জাফর শা রোডে তাদের প্রতিবেশীদের, এমনকি এই পাড়ার পরিচিত লোকজনদেরও। তাছাড়া, কলকাতায় যে-সব আত্মীয়পরিজন রয়েছে–তাদেরও। বাচ্চাগুলো ওদেরই হবে।
কচি কচি গলার কলর কলর ছাপিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে মন্ত্রপাঠের গম্ভীর, সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই পুজো টুজো শুরু হয়ে গেছে।
বিনয়ের চোখে পড়ল, মূল বিল্ডিংয়ের সামনের দিকের ফাঁকা জায়গায় ডান পাশের বাউণ্ডারি। ওয়াল ঘেঁষে দুটো মোটর দাঁড়িয়ে আছে। একটা বিরাট আকারের ফোর্ড, অন্যটা পন্টিয়াক।
পন্টিয়াকটা কাদের গাড়ি, বিনয় জানে না। তবে ফোর্ডটা আনন্দদের। আনন্দ আর তার ভাই দীপক এমনিতে এটায় চড়ে না। অফিসের গাড়িতে তাদের অফিসে যায়। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে–যেমন বিয়ে, পৈতে, শ্রাদ্ধ-নেমতন্ন থাকলে ফোর্ডটা বার করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, আনন্দরা আগেই এখানে এসে গেছে। ওরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সপরিবার নিমন্ত্রিত হওয়াই স্বাভাবিক।
আচমকা বিনয়ের খেয়াল হল, আনন্দর মা হেমনলিনীও কি এসেছেন? ঝিনুক নিখোঁজ হয়েছে। এতদিনে বিনয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে তাকে আর পাওয়া যাবে না। মেয়েটার জন্য পুরানো আবেগ আর তত তীব্র নেই। তবু হেমনলিনীর কথা ভেবে কেমন যেন গুটিয়ে গেল সে।
ওই মহিলাটি সম্পর্কে বিনয়ের মনে যা জমে আছে তা হল বিরক্তি। বিতৃষ্ণা। মহিলাটির মস্তিষ্কে ঠাসা রয়েছে হাজার বছরের পচা গলা সংস্কার। হেমননিলনীকে সে যে পছন্দ করে না তা নিশ্চয়ই মহিলা জেনে গেছেন। তার সঙ্গে দেখা হোক, এটা সে চায় না।
প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিনয়। একবার ভাবে, ফিরে যাবে, কিন্তু গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে থাকলে হিরণরা ভীষণ দুঃখ পাবে। সুধা কেঁদেকেটে চারদিক ভাসিয়ে ফেলবে। এমনও তো হতে পারে, আনন্দদের বাড়ির সবাই এসেছে, শুধু হেমনলিনী বাদ।
নানা এলোমেলো চিন্তার টানাপোড়েনে শেষ পর্যন্ত কখন যে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল খেয়াল নেই।
একতলায় বেশ বড় একটা হল-ঘর। সেখানে ঢালা ফরাস পাতা, রয়েছে প্রচুর চেয়ারও। বেশ কিছু লোকজন সেখানে বসে আছে। এরা নিশ্চয়ই আমন্ত্রিত অতিথি। বংশী সিং এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া আর কারওকেই চেনা গেল না। আগেই লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বংশী তার মিস্ত্রিদের নিয়ে হিরণদের এই বাড়িটা সারিয়ে সুরিয়ে ভোল পালটে দিয়েছে।
বিনয়কে দেখে উঠে এল বংশী। প্রথম আলাপের দিনই বোঝা গিয়েছিল লোকটা বেশ বিনয়ী। হাতজোড় করে বলল, নমস্তে বাবুজি। বিল্ডিংটা কেমন দেখলেন?
বিনয় তারিফের সুরে বলল, বাইরে থেকে তো খুব ভাল লাগছে।
অন্দরে গিয়ে পুরাটা দেখলে আরও আচ্ছা লাগবে।
বিনয় একটু হাসল।
বংশী বলল, যো দেখলেন, আমার কাম পসন্দ হইয়েসে তো?
বিনয় বলে, হা হা, হয়েছে।
হাত কচলাতে কচলাতে বংশী বলল, আপনার জানাশোনা কেউ বিল্ডিং বানালে কি পুরানা কোঠি মেরামত করতে চাইলে আমার কথা বলবেন।
তার পছন্দ-অপছন্দের ওপর কেন লোকটা এত জোর দিচ্ছে, এতক্ষণে বোঝা গেল। হিরণ এবং আনন্দর শালা সে। তাই লোকটা ঠাউরে নিয়েছে বুঝি বা বিশাল কেউ হবে। জানে তো না, তার চালচুলো নেই, সস্তার মেসে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকে। হাজার হাজার টাকা খরচ করে যারা নতুন বাড়ি টাড়ি করায় এমন কারও সঙ্গে তার চেনাজানা নেই। কিন্তু বংশীকে নিরাশ করতে ইচ্ছা হল না। বলল, নিশ্চয়ই বলব।
বিনয় আর দাঁড়াল না, সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগল। লক্ষ করল, প্রতিটি ধাপে চমৎকার সব আলপনা। লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, ফুল, পাখি ইত্যাদি। নিশ্চয়ই সুধা এঁকেছে। ওর আঁকার হাত বেশ ভাল। এইসব আলপনার পেছনে কত যে যত্ন, কত পরিশ্রম আর স্বপ্ন যে জড়ানো।
একতলার মতো দোতলাতেও মস্ত হল-ঘর। দরজার দুধারে মঙ্গলঘট। এখানেই বিরাট করে পুজোর আয়োজন করা হয়েছে।
পুরো হলটা, গোলাপ রজনীগন্ধা আর জুই দিয়ে সাজানো।
এখানে চার ভাগের তিন ভাগ জুড়ে মেঝেতে ধবধবে ফরাস। সেখানে অনেক পুরুষ এবং মহিলা বসে আছেন। সবাই নিমন্ত্রিত অতিথি। আর-এক অংশে পশমের আসনে বসেছেন পুরোহিত। তার সামনে চকচকে তামার টাটে নারায়ণ শিলা। ছোট পেতলের ঘটে ডাব, পঞ্চপল্লব। কোষাকুষি। ফুল বেলপাতা দূর্বা ঘি মধু, এমনি অজস্র উপকরণ। রয়েছে দেবতার ভোগের জন্য নানা উপচার। প্রচুর আতপ চাল, সন্দেশ এবং রকমারি ফল। জ্বলছে পঞ্চপ্রদীপ। অগুনতি সুগন্ধি ধূপ পুড়ছে। ফুল এবং ধূপের গন্ধে বাতাস ম ম করছে।
পুরোহিতের পাশে অন্য একটি আসনে বসেছে সুধা। জেঠ শাশুড়ি যদিও মাথার ওপর আছেন, আসল গৃহকর্তী সে-ই। তাকে আজ আর চেনাই যায় না। পরনে চওড়া লালপাড় গরদের শাড়ি, গলায় আঁচল জড়ানো। কপালে মস্ত সিঁদুরের ফোঁটা। সিঁথিতে চওড়া করে সিদুরের টান। পুজোর জন্য যা যা দরকার, পুরোহিতের হাতের কাছে এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে।
অনন্ত বিস্ময়ে সুধাকে দেখছিল বিনয়। তার যে ছোটদিটি চুলবুলে, চঞ্চল, সারাক্ষণ তার সঙ্গে খুনসুটি করে কাটিয়ে দিত সে যেন অন্য কেউ। এই সুধা বুঝি বা সংসারের এক পরম অভিজ্ঞ, পাকা গৃহিণী। মানুষ কত যে বদলে যায়!
পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন। একটানা। ছেদহীন।
এতে গন্ধে পুষ্পে সূর্যগ্রহায় নমঃ
এতে গন্ধে পুষ্পে সোমগ্রহায় নমঃ
এতে গন্ধে পুষ্পে মঙ্গলগ্রহায় নমঃ
এতে গন্ধে পুষ্পে বুধগ্রহায় নমঃ
পুরোহিত এবং সুধার দিক থেকে বিনয়ের চোখ অতিথিদের দিকে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চকিত হয়ে ওঠে সে। যে ভয়টা করেছিল তা-ই ঘটেছে। ফরাসের ডান পাশের শেষ মাথায় বসেছে ঝুমাদের বাড়ির সবাই। ঝুমা, তার দাদু রামকেশব, শিশির এবং স্মৃতিরেখা। তাদের পাশে আনন্দরা। আনন্দ, সুনীতি দীপক মাধুরী এবং সবার মাঝখানে মধ্যমণি সেই মহিলাটি। ব্যক্তিসম্পন্ন, অভিজাত কিন্তু কুসংস্কারের আড়ত-হেমনলিনী।
ভেতরে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য ছিলই। সেটা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
হঠাৎ হিরণের গলা কানে এল, আরে বিনু, ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসএস–
হিরণ বসেছে ফরাসের বাঁ দিকে। তার পাশে অনেক অচেনা মুখ। শুধু একজনই পরিচিত। তিনি মধুসূদন ভট্টাচার্য। হিরণদের এই বাড়ি থেকে কটা বাড়ির পর তার বাড়ি। প্রতিবেশী হিসেবে তিনিও নিমন্ত্রিত।
বিনয় ভিড়ের ভেতর পথ করে করে হিরণের পাশে গিয়ে বসে।
হিরণ বলে, এত দেরি করলে যে! তোমাকে বলে এসেছিলাম, গৃহপ্রবেশের লগ্ন খুব সকালে। শুরুটাই তো দেখতে পেলে না।
বিনয় বলল, কী করব, চানটান করে ভবানীপুর থেকে এতটা পথ আসতে সময় লাগে না?
হিরণ মেনে নিল, তা অবশ্য লাগে। তবে খানিকক্ষণ আগে এলে তোমার ছোটদির একটা নতুন চেহারা দেখতে পেতে।
উৎসুক চোখে হিরণের দিকে তাকায় বিনয়।
হিরণ বলে, পুজো শুরু হবার আগে সুধা বরণ-কুলো মাথায় নিয়ে পুরোহিতের পেছন পেছন প্রত্যেকটা ঘরে ঘুরেছে। আমাদের দেশে গৃহপ্রবেশের ওটা একটা নিয়ম। তখন বা এলিগ্যান্ট যে লাগছিল তোমার ছোটদিকে! আমি ক্যামেরায় ছবি তুলে রেখেছি। ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট পারফেক্ট গৃহলক্ষ্মী। পরে ডেভলাপ করিয়ে তোমাকে দেখাব। একটু থেমে ফের বলে, নিজেদের নতুন বাড়ি হওয়ায় কী খুশি যে হয়েছে সুধা! শুধু একটা আক্ষেপ
কীসের আক্ষেপ?
বুঝতে পারছ না? এত বড় বাড়ি। কত ঘর। অথচ তুমি আমাদের কাছে থাকবে না।
বিনয় উত্তর দিল না।
হিরণ বলতে লাগল, কেন কষ্ট করে মেসে গিয়ে পড়ে আছ, ভেবে পাই না।
এই নিয়ে আগেও অনেক কথা হয়েছে। বিনয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল, কেন বোনের শ্বশুরবাড়িতে তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ফলে সুধার কত যে অভিমান, কান্নাকাটি। দ্বারিক দত্ত, সরস্বতী এবং হিরণও কম কষ্ট পায়নি। কিন্তু সে-সব চুকে বুকে গেছে। তবু দেখা যাচ্ছে দুঃখটা ভুলতে পারেনি হিরণরা। আজ গৃহপ্রবেশের দিনে সেই প্রসঙ্গটা ফের খুঁড়ে বার করে আনল সে।
একই জবাব বার বার দিতে ইচ্ছা হয় না বিনয়ের। সে চুপ করে থাকে। তার মনোভাব আঁচ করে নিয়ে হিরণ এ-ব্যাপারে ছেদ টেনে দেয়। মধুসূদন ছাড়া কাছাকাছি যারা বসে আছে, তাদের সবার সঙ্গে বিনয়ের আলাপ করিয়ে দিল সে। এরা সকলেই এই এলাকার লোকজন। বেশির ভাগই অনেক কালের পুরানো বাসিন্দা। দু-তিন পুরুষ ধরে আছে। বাকিরা পাকিস্তানের ঘর বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে কিছুদিন হল এসেছে।
পরিচয়পর্ব যখন চলছে, সেই সময় হল-ঘরের দরজার সামনে কয়েকজনকে দেখা গেল।
হিরণ ব্যস্তভাবে উঠে পড়ে। বিনয়কে বলে, আমার অফিসের কলিগরা এসেছে। ওদের এনে বসাই। তোমরা কথা বলো
হিরণ চলে গেল। অতিথিরা আসছে। তাদের দেখাশোনা, আপ্যায়ন-হিরণের কি বসে বসে গল্প করলে চলে!
সদ্য যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তারা মামুলি দু-একটা প্রশ্ন করছে। বিনয় হ্যাঁ না করে যাচ্ছে। অতি সাধারণ, সৌজন্যমূলক কথাবার্তা।
কাছেই রয়েছেন মধুসূদন। একসময় তার দিকে ঘুরে বসে বিনয়। ভদ্রলোকের করুণ, বিষাদময় মুখ। এর আগেও যতবার দেখা হয়েছে, অবিকল একই মুখচ্ছবি। সারাক্ষণ মধুসূদন গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ এসেছেন?
মধুসূদন বললেন, মিনিট পনেরো কুড়ি আগে।
ভাল আছেন তো?
আমাদের আর ভাল থাকাথাকি! দিন কোনওরকমে কেটে যায়। তুমি তো সবই জানো।
মধুসূদন কি তাকে আপনি করে বলতেন, না তুমি? মনে পড়ল না। যাইহোক ওঁদের কথা কিছুই অজানা নেই বিনয়ের। কুমিল্লায় যে শহরে মধুসূদনরা থাকতেন সেখানকার মুসলিম লিগের পান্ডা নিয়ামত আলির ছেলে শোভান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ তার মেয়ে দীপালিকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে একটা চরে আটকে রেখেছিল। দিনের পর দিন মেয়েটার ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। পরে ওই শহরের এস ডি ও রফিকুল ইসলাম তাকে উদ্ধার করে আনেন। স্বেচ্ছায় দীপালি তাকে বিয়ে করেছে, কেননা সে জানে, মা-বাবা লোকলজ্জার ভয়ে তাকে কোনওদিনই ফিরিয়ে নেবেন না।
দীপালিকে গায়ের জোরে শোভনরা কেড়ে নিয়ে যাবার পর মনঃকষ্টে একেবারে ভেঙেচুরে গিয়েছিলেন মধুসূদনের স্ত্রী কমলা। তবু দূর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে সেই যন্ত্রণা কমে আসত। সময়ের হাতে এমন এক জাদুকাঠি আছে যা শোক দুঃখ যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়।
সন্তানকে খোয়াবার বেদনার চেয়ে কমলা সহস্র গুণ কষ্ট পেয়েছিলেন যেদিন শুনলেন রফিকুলের সঙ্গে দীপালির বিয়ে হয়েছে। পবিত্র ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে মুসলমানের ঘর করছে, শোনামাত্র মনে হয়েছিল আকাশ থেকে সমস্ত ব এসে পড়েছে মাথার ওপর। এত বড় গ্লানি সহ্য করতে পারেন। নি কমলা। কদিন আগে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।
বিনয় খুব নিচু গলায় দ্বিধার সুরে জিজ্ঞেস করে, মন্টুর মা এখন কেমন আছেন?
মলিন হাসি ফুটে ওঠে মধুসূদনের মুখে।সেই সেদিন যা শুনে গিয়েছিলে, অবস্থা তার চেয়ে। অনেক খারাপ।
কী বলা উচিত, ভেবে পাচ্ছিল না বিনয়। দুচোখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে।
বুঝলে বিনয়, কোনও আশা-ভরসা নেই। হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর সমানে চিকিৎসা চলছে কিন্তু ফল হবে বলে মনে হয় না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর মধুসূদন ফের বলেন, মন্টুর মা গলায় যে ফাঁসটা দিয়েছিল তাতে ভেতরকার শিরাটিরা ছিঁড়ে গেছে। গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরুচ্ছে না। কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিনয় বলে, সে কী!
ডাক্তাররা অবশ্য কখনও হাল ছাড়েন না। বলছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ওটা নেহাতই সান্ত্বনা।
এখন হয়তো কথা বলতে পারছেন না। দু-এক মাস পর নিশ্চয়ই পারবেন।
মধুসূদন বিনয়ের কথার উত্তর দেন না। অসীম নৈরাশ্যে তলিয়ে যেতে যেতে বলেন, মেয়েটাকে হরিয়েছি। বাকি জীবন যোবা স্ত্রীকে নিয়ে কাটাতে হবে।
পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ চলছিল অবিরল। চারপাশে অন্য অতিথিরা কথা বলছিল অনর্গল। তার একটি বর্ণও বুঝতে পারছিল না বিনয়। সব দুর্বোধ্য। মাছির ভনভনানির মনে হচ্ছিল।
একসময় হঠাৎ উঠে পড়লেন মধুসূদন। বললেন, এখন চলি বিনয়
বেশ অবাক হয়ে বিনয় বলে, পুজো শেষ হল না। এর মধ্যেই চলে যাবেন?
বোঝেনই তো, আমার পক্ষে বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকা সম্ভব নয়। মধুসূদন বলতে লাগলেন, হিরণবাবু সেদিন গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ করে এলেন। তোমাদের সঙ্গে যা সম্পর্ক, না এসে পারা যায় না। আমার ছেলে মন্টুকে তো দেখেছ-
চোদ্দ পনেরো বছরের একটি ফুটফুটে কিশোরের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে বিনয়ের। সে বলে, দেখব না কেন? যখনই আপনাদের বাড়ি গেছি, ওর সঙ্গে কত কথা হয়েছে। চমৎকার ছেলে
মন্টুর ওপর ওর মাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে এসেছি। যখন আসি নির্জীবের মতো চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে ছিল কমলা। হঠাৎ যদি ওর কষ্টটা বাড়ে, ওইটুকু ছেলের পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে না। তোমরা তো এখন থেকে এ-বাড়িতে থাকচ্ছ। মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে যেয়ো।
বিনয় কিছু বলল না। কী করে জানায়, সে রাজদিয়া হাউসএ থাকবে না।
মধুসূদন চলে যাবার পর নীরবে বসে থাকে বিনয়।
পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ এবার কানে আসে।
সর্বে বাস্তুময়ং জগৎ
সর্বে বাস্তুময়ং ভবঃ
নমঃ বাস্তুদেব নমহস্তুতে
মধুসূদনের চিন্তাটা বিনয়ের মস্তিষ্ক তোলপাড় করে দিচ্ছিল। একটি ব্রাহ্মণ পরিবার হাজার বছর ধরে তাদের সংস্কার, তাদের বংশগৌরব, মনুষ্যকুলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব, তাদের অহমিকা এবং পবিত্রতা যক্ষের মতো আগলে রেখেছিল। এই বংশের মেয়ে মরে যাবার বদলে একটি মুসলমানকে বিয়ে। করেছে, এত বড় ধাক্কাটা তারা কীভাবে সামলাবে, ভেবে পাচ্ছে না বিনয়। চিন্তার এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিজের অজান্তে হঠাৎ তার চোখ যেখানে পুজো হচ্ছে তার ওধারে চলে যায়। হল-ঘরে ঢোকার সময়ই সে দেখেছে, হেমনলিনীরা ওখানে বসে আছেন। এবার চোখে পড়ল, ওঁরা সবাই তার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন বলাবলি করছেন।
মধুসূদনকে দেখার পর হেমনলিনী বিনয়ের ভাবনা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন পুরানো সেই অস্বাচ্ছন্দ্য এবং বিতৃষ্ণা আবার ফিরে এল।
কিছুক্ষণ উসখুস করে উঠে পড়ে বিনয়। সোজা হল-ঘরের বাইরে চলে আসে। হিরণকে কোথাও দেখা গেল না। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও ব্যস্ত আছে।
অন্যমনস্কর মতো বিনয় সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। দুধারের ঘরগুলোর সব দরজা জানালা খোলা। দেখা গেল, জাফর শা রোডের পরিচিত খাট আলমারি টালমারি এনে প্রতিটি ঘরে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া নতুন কিছু আসবাবও চোখে পড়ল।
ছাদে চলে এল বিনয়। মস্ত ছাদটা একেবারে ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। ওপরে তেরপল খাটানো। এক ধারে কলাপাতা আর নতুন মাটির গেলাসের পাহাড়। রয়েছে বড় বড় জালা ভর্তি খাবার জল। স্তূপাকার চটের আসন।
সেদিন হিরণ বলে এসেছিল, গৃহপ্রবেশের দিন দুপুরে অতিথিদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, ছাদেই খাওয়ানো হবে।
লক্ষ্যহীনের মতো হাঁটতে হাঁটতে ছাদের বাঁ ধারে চলে আসে বিনয়। নিচে, বাড়ির পেছন দিকটায় মোটা কাপড়ের ছাউনি দিয়ে তার তলায় রান্নাবান্নার এলাহি তোড়জোড় চলছে। বড় বড় ঝুড়িতে মাছ, মাংস কেটে ধুয়ে রাখা হয়েছে। কাটা হচ্ছে আনাজ। বাটা হচ্ছে নানারকম মশলা। তিনটে বিরাট বিরাট উনুনে চড়ানো হয়েছে মস্ত মস্ত কড়াই। দুজন মাঝবয়সী রাঁধুনী বামুন এবং তিনটে জোগাড়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।
খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার পর উলটোদিকে চলে আসে বিনয়। এপাশ দিয়ে বাড়ির সামনের চওড়া রাস্তাটা দুধারে অনেক দূর অবধি চলে গেছে। চেনা জায়গা। হিরণের সঙ্গে কতবার এখানে এসেছে। ছাদের নিচু রেলিংয়ে কনুই রেখে তাকিয়ে থাকে বিনয়। চারদিকে প্রচুর দালান কোঠা, বস্তি, মাজার। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। যানবাহন বলতে সাইকেল রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, মাঝে মাঝে দু-চারটে প্রাইভেট কার।
সুধাদের এই সুখের দিনে আনন্দ করতেই এসেছিল সে। কিন্তু প্রথমে হেমনলিনী, তারপর মধুসূদন। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। কিছুই ভাল লাগছে না।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল বিনয়, খেয়াল নেই। হঠাৎ ডাকটা কানে এল, বিনুদা-বিনুদা—
চমকে ঘুরে তাকাতেই বিনয় দেখতে পায়, ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। তার পাশে হেমনলিনী।
হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। ঝুমারাও তাকে লক্ষ করছিল। ওরা যে ছাদে চলে আসবে, ভাবা যায়নি। বিশেষ করে হেমনলিনী আসতে পারেন, এটা তো অকল্পনীয়। কী বলবে, কী করবে, ঠিক করে উঠতে পারছিল না সে। এদিকে ঝুমারা কাছাকাছি চলে এসেছে।
হেমনলিনী বললেন, তুমি একা একা এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছ! ওদিকে সারা বাড়ি আমরা তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তার কণ্ঠস্বর ভারী কোমল, স্নেহা।
হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারে না বিনয়। এই মহিলা কী উদ্দেশ্যে তাকে খোঁজাখুজি করছেন, মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে
সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়। হেমনলিনীর কী এমন কথা থাকতে পারে যাতে আত্মীয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানে এসে পুজোর মাঝখানে আচমকা উঠে এসে তাকে বাড়িময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন! বলে, কী কথা?
ঝুমা নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বলল, ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি? কোথাও গিয়ে বসা যাক
ঝুমার দিকে তাকায় বিনয়। কোথায় যাব?
সবাই দোতলায় পুজোর জায়গায় কি একতলায় রয়েছে। তেতলাটা একদম খালি। চল, ওখানে যাই–
একদিকে অনিচ্ছা, আর-এক দিকে কৌতূহল। খানিক দোনামনা করে ঝুমাদের সঙ্গে তেতলার একটা ঘরে চলে আসে বিনয়।
খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল ইত্যাদি নানা আসবাবে ঘরটা পরিপাটি সাজানো। বিনয়ের হাত ধরে খাটের এক ধারে তার পাশে বসালেন হেমনলিনী। একটু দূরে একটা বেতের মোড়া টেনে এনে তার ওপর বসল ঝুমা।
হেমনলিনী বললেন, জানো বিনু, সপ্তাহ দেড়েক আগে হিরণ আর সুধা আমাদের নেমন্তন্ন করে এসেছিল। কিছুদিন ধরে আমার শরীর ভাল যাচ্ছে না। বাতের ব্যথা, হার্টের রোগ, দাঁতের যন্ত্রণা–এটা সেটা লেগেই আছে।
মহিলা সাতকাহন ফেঁদে বসেছেন। এ-সব যে ভণিতা, বুঝতে পারছে বিনয়। কখন আসল বক্তব্যটা শুরু হবে, সেজন্য চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।
হেমনলিনী থামেননি, ভেবেছিলাম, শরীরের যা হাল, আসতে পারব না। কিন্তু তখনই মনে পড়ল, দিদির গৃহপ্রবেশে তুমি নিশ্চয়ই আসবে। তাই তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কষ্ট করে। চলে এলাম।
বয়স্ক মহিলাটির কথাগুলো মাথার দশ হাত ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায় বিনয়ের। বিমূঢ়ের মতো সে বলে, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর হেমনলিনী ফের বলেন, যদি এখানে দেখা না পেতাম, দু-চারদিনের মধ্যে তোমার ভবানীপুরের মেসে আমাকে ছুটতে হতো। কেন জানো?
নিজের অজান্তেই যেন বিনয় বলে ওঠে, কেন মাসিমা?
তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার জন্যে।
সারা শরীরে, মাথা থেকে পা অবধি, চমক খেলে যায় বিনয়ের। কী বলছেন হেমনলিনী! পরিষ্কার বাংলাই। তবু ভীষণ দুর্বোধ্য। এবং অবিশ্বাস্যও। মনে হয়, বহু দূরের অচেনা কোনও গ্রহের বাসিন্দাদের ভাষা। বিহ্বল বিনয় তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে।
হেমনলিনী বিনয়ের একটা হাত তুলে নিয়ে আঁকড়ে ধরেন। ব্যাকুলভাবে বলেন, তোমাদের, বিশেষ করে ঝিনুকের ওপর আমি খুব অন্যায় করেছি। কত কষ্ট করে, কত বিপদের মধ্যে পাকিস্তান থেকে আমাদের বাড়িতে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলে। কোথায় বুকে টেনে নেব, তা না করে দূর দূর করে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছিলাম। তোমরা কোথায় যাবে, কে তোমাদের আশ্রয় দেবে, একবারও সে-সব ভেবে দেখিনি।
পলকের জন্যও চোখ সরাতে পারছে না বিনয়। এ কোন হেমনলিনীকে দেখছে সে?
হেমনলিনী বলেই যাচ্ছেন, সেকালের মানুষ তো। আমাদের অনেক রকম সংস্কার থাকে। একটা যুবতী মেয়েকে দাঙ্গাবাজরা জোর করে কয়েকদিন আটকে রাখল। তার কোনও দোষ নেই। জানি ঝিনুক নিপাপ। কিন্তু ওকে যখন নিয়ে এলে, আমার মাথার ঠিক ছিল না। মনে হচ্ছিল বাড়ি অপবিত্র হয়ে গেল। আসলে আমাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা জানাশোনা কারও জীবনে তো এরকম ঘটনা ঘটেনি। একটু থেমে ফের শুরু করেন, মেয়েটা বড় দুঃখী। ওর জন্যে আমার মায়া দয়া থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কী দুর্মতি যে হল! ঝিনুককে আমি মেনে নিতে পারিনি।
কী বলবে, ভেবে পায় না বিনয়। এই কি সেই হেমনলিনী যিনি প্রচণ্ড দাম্ভিক, অসীম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যিনি বিপুল কর্তৃত্বে নিজের সংসারের বক্সা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে রাখেন। ছেলেরা, তাদের বউরা, কাজের লোকেরা, এমনকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিজনেরা, সবাই তার সামনে তটস্থ। কারও সাধ্য নেই। তার মুখের ওপর টা ফো করে। সেই হেমনলিনীকে এখন আর চেনাই যায় না। তার হাত ধরে যে বৃদ্ধাটি বসে আছেন তার মধ্যে অহমিকার, ব্যাক্তিত্বের লেশমাত্র নেই। তাঁর দিকে তাকিয়ে একটি করুণ, কাতর, অনুতপ্ত মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে বিনয়।
হেমনলিনী এবার বলেন, তোমাদের সঙ্গে ওইরকম ব্যবহার করার জন্যে ঝুমা পরে আমাকে ভীষণ বকাবকি করেছে। মেয়ের সে কী রাগ আমার ওপর।
পলকের জন্য বিনয়ের চোখ ঝুমার দি! ঘুরে আবার হেমনলিনীর মুখে ফিরে যায়।
হেমনলিনী কখন থামবেন, কে জানে। অনর্গল বলে চলেছেন, মাঝে মাঝে ভেবেছি, সুধাদের বাড়ি থেকে আমার কাছে তোমাদের নিয়ে আসব। কিন্তু তার মধ্যে তোমার বাবা হঠাৎ গুরুর আশ্রম থেকে দিন কয়েকের জন্যে ফিরে এলেন। ঝিনুক নিখোঁজ হল। তারপর অবনীমোহন বাবু এখানকার পাট চুকিয়ে চলে গেলেন। এত সব ঘটনার মধ্যে তোমার কাছে যাওয়া হয়নি। কিন্তু মনটা ছটফট করত। যতক্ষণ না ক্ষমা করছ, শান্তি পাচ্ছি না।
মাত্র কটা মাসের মধ্যে একজন মানুষের এতখানি পরিবর্তন ঘটতে পারে, এ যেন কল্পনাই করা যায় না। বিনয় অদ্ভুত এক ঘোরের ভেতর হেমনলিনীকে দেখছিল। এই মহিলা সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণার সীমা-পরিসীমা নেই। মস্তিষ্কের অগুনতি কুঠুরিতে গনগনে ক্রোধ জমা হয়ে ছিল। সেটা এখন আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। বিরূপতা, অসন্তোষ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল, মহিলার মুখদর্শন করবে না। এই মুহূর্তে তা আর মনে নেই। সময় এক পরামাশ্চর্য জাদুকর। নিমেষে কত কঠিন প্রতিজ্ঞা, কত দৃঢ়তা যে তছনছ করে দেয়।
বিনয় তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছিল। বিব্রত মুখে বলে, ক্ষমার কথা কী বলছেন মাসিমা! আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না।
হেমনলিনী বললেন, ঠিক আছে, তোমার যখন সংকোচ হচ্ছে, বলব না। তবে আমার একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে।
বলুন
আমাদের বাড়ি তোমাকে আসতে হবে। কবে আসবে বলল
বিনয় বলে, অফিস থেকে আমার ওপর এত কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যে সকাল থেকে। রাত নটা-দশটা পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। কখন আপনাদের বাড়ি যাই?
হেমনলিনী সস্নেহে হাসলেন, অফিসে তো হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। তারা কি আপনজনদের বাড়ি যায় না?
বিনয় থতমত খেয়ে যায়। একটু সামলে নিয়ে বলে, খবরের কাগজের কাজটা অন্যরকম। দশটা। পাঁচটা করলে চলে না। তাছাড়া আমার ওপর চাপটা একটু বেশি দেওয়া হয়েছে। আনন্দদা সমস্ত জানে।
হেমনলিনী বললেন, তোমার আনন্দদা আমাকে একটা খবর দিয়েছে।
কী খবর?
একটু মজার গলায় হেমনলিনী বললেন, কাগজে যারা কাজ করে তাদের বোজ অফিসে যেতে হয় না। সপ্তাহে তাদেরও একটা দিন ছুটি থাকে। শুনেছি রবিবার তোমার ছুটি।
বিনয় বেশ হকচকিয়ে গেল। দেখা যাচ্ছে মহিলাটি তার নাড়িনক্ষত্রের সমস্ত কিছু জেনে বসে আছেন। সে বলে, হ্যাঁ। কিন্তু প্রায় প্রতি রবিবার আমার কিছু কিছু কাজ থাকে–।
হেমনলিনী হালকা ধমকের সুরে বললেন, এই ছেলে, আমাকে কাজ দেখিও না। তোমাকে ছাড়া অফিস একেবারে অচল হয়ে যাবে, তাই না? কোনও ওজর আমি শুনব না।
বৃদ্ধার ধমকটা যে সত্যিকারের ধমক নয়, বরং তাতে স্নেহের এবং আন্তরিকতার ছোঁয়া মেশানো, সেটা বেশ অনুভব করা যায়। তো তো করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিনয়, কিন্তু তার আগেই হেমনলিনী বলে ওঠেন, আসছে রবিবার তুমি আমাদের বাড়ি নিশ্চয়ই আসছ। নইলে বুঝব আমার ওপর থেকে তোমার রাগটা যায়নি।
হেমনলিনীর আজকের কথাবার্তা এবং আচরণের এমন একটা আপন-করা ব্যাপার আছে যে না বলা যায় না। একটু ভেবে বিনয় বলল, আচ্ছা, যাব
হেমনলিনী কোমল গলায় বললেন, সকাল সকাল চলে যাবে। সারাদিন থাকবে। দুপুরে তো খাবেই, রাতেও খেয়ে আসবে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে বললেন, না না, অত রাতে মেসে ফিরতে হবে না। তোমার অফিস তো আমাদের বাড়ির খুব কাছে। পরদিন আমাদের ওখান থেকে সোজা অফিসে যেয়ো
বিনয় মাথা নাড়ে, খাওয়া টাওয়া থাক। এত করে বলছেন, আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করে, খানিকক্ষণ থেকে চলে আসব। বলতে বলতে হঠাৎ নিজের অজান্তে তার চোখ ঝুমার দিকে চলে যায়। পলকহীন ঝুমা তাকে দেখছে। কতক্ষণ মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে, কে জানে। তার চোখে মুখে আলোর ঝলক খেলে যাচ্ছে।
চকিতে বিনয়ের মনে হয়, শুধু বিবেকের খোঁচায় হেমনলিনী তার কাছে ক্ষমা চাইতে আসেননি। এটা ঠিক, তার অনুশোচনা নিছক লোক-দেখানো নয়। কিন্তু নাতনিকে সঙ্গে করে তাকে খুঁজে বার করা, নিজেদের বাড়িতে তাকে যাবার জন্য, এত অনুরোধ, এ-সরের ভেতর অন্য কোনও সংকেত রয়েছে। কী সেটা? স্পষ্ট করে বোঝার আগেই হেমনলিনী জেদী বালিকার মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন।তোমার কোনও কথা শুনব না। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তান থেকে আমাদের বাড়ি এসেছিলে। কোনওরকম আদরযত্ন করতে পারিনি। কী খারাপ যে আমার লেগেছে, বলে বোঝাতে পারব না। তোমাকে নিয়ে একটা দিন আমরা সবাই আনন্দ করতে চাই। একদম না বলবে না।
পুরো একদিন এবং একটা রাত কাটাতে রাজি নয় বিনয়। হেমনলিনীও ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, রবিবার বিকেল অবধি থেকে চা খেয়ে চলে আসবে।
একটু নীরবতা।
তারপর হেমনলিনী আচমকা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ঘন্টাখানেক হল এসেছি। এতক্ষণে পুজো বোধহয় শেষ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই আমাকে সবাই খোঁজাখুঁজি করছে। যাই তিনি বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। যুবা বয়সের একটি ছেলে এবং একটি তরুণী যে ঘরে পড়ে রইল, সেদিকে তার দৃকপাত নেই।
হেমনলিনীর এমন তড়িঘড়ি চলে যাওয়াটা বিনয়কে রীতিমতো অবাক করে দেয়। খোলা দরজার বাইরে কপা গেলেই সিঁড়ি। বৃদ্ধা ত্বরিত পায়ে ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন। যতক্ষণ তাকে দেখা গেল, তাকিয়ে থাকে বিনয়। তারপর দুই চোখ ঘরের ভেতর ফিরিয়ে আনতেই কুমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। ঠায় বসে ঠিক একইভাবে তাকে লক্ষ করছে।
মস্তিষ্কে বিদ্যুতের ঝলক খেলে যায়। হেমনলিনী সেকেলে মানুষ। রক্ষণশীলতার ডালপালা ছড়িয়ে আছে তার হাড়ে-মজ্জায়। পুরানো সব ধ্যানধারণা, আদ্যিকালের যত সংস্কার যখের মতো আগলে রয়েছেন। একটি যুবক এবং একটি যবুতাঁকে ফাঁকা ঘরে রেখে তিনি যে চলে গেলেন সেটা কি ইচ্ছাকৃত?
আজই কি প্রথম? রাজদিয়ায় ঝুমার সঙ্গে ফাঁকা ঘরে কত নির্জন দুপুর কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। তখন ঝুমা সদ্য কিশোরী, আর সে কৈশোর পেরুতে চলেছে। সে ছিল সরল, লাজুক। কিছুটা মুখচোরা। বাংলা টেক্সট বইতে অপাপবিদ্ধ বলে একটা নতুন শব্দ শিখেছিল। তার নিজের সম্বন্ধে সেটা চমৎকার খেটে যেত। নারীর শরীরে কতটা বিস্ময়, কতখানি বিস্ফোরক জমা হয়ে থাকে সে-সব ব্যাপারে তার তিলমাত্র ধারণা ছিল না। কিন্তু ঝুমা? সেই বয়সেই পেকে টুসটুসে। তার চোখের তারায়, ভেজা ভেজা ঠোঁটে, মসৃণ নিটোল গ্রীবায় এবং কোমরের ক্ষিপ্র মোচড়ে কত যে কুহক মাখানো থাকত! এই মেয়েটাই তার হাত ধরে একটার পর একটা দরজা খুলে জীবনের অজানা এক রহস্যের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল। নারী-শরীর কী বস্তু সেই প্রথম জেনেছে বিনয়। ঝুমাকে দেখলে তার শিরায় শিরায় তড়িৎপ্রবাহ খেলে যেত। গাঢ় হয়ে উঠত শ্বাসপ্রশ্বাস। বুকের ভেতর কত যে শিহরন! কলকাতায় আসার পর তার সঙ্গে প্রথম দিকে যতবার দেখা হয়েছে ঠিক এমনটাই হয়েছে। কিন্তু কিছু দিন আগে সেই যে ঝুমা তাকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা রেস্তেরায় নিয়ে গিয়েছিল তখন সে যেন অন্য মেয়ে। পর্দা ঢাকা কেবিনে তারা ঘণ্টীদেড়েক কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু চুমু তো দূরের কথা, একবারও তাকে ছোঁয়নি পর্যন্ত।
সুধাদের নতুন বাড়ির তেতলায় নির্জন ঘরটিতে এই মুহূর্তে যে তরুণীটি বিনয়ের কাছাকাছি বসে আছে, তাকেও যেন চেনা যায় না। ঝুমা সারাক্ষণ কথা বলে। সারাক্ষণ তার ছটফটানি। সারাক্ষণ তার চোখের তারা নাচতে থাকে। কিন্তু এই ঝুমা বড় বেশি শান্ত, ধীর, নম্র।
ঝুমা বলল, তুমি কিন্তু কথা রাখোনি বিনুদা—
বিনয় হকচকিয়ে যায়। কী কথা বল তো?
সেদিন রেস্তোরাঁয় বলেছিলে, আমাদের কলেজে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
তাই বলেছিলাম?
সোজাসুজি তার প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে ঝুমা বলে, আমার কথা তোমার কখনও মনে থাকে না। আমিই যেচে যেচে তোমার কাছে যাই
বিনয় লজ্জা পেয়ে যায়। কুণ্ঠিতভাবে বলল, আমার কাজের দুর্দান্ত প্রেসার। রিফিউজিদের ব্যাপারে সমস্ত দিন এত ঘোরাঘুরি করতে হয় যে কাকে কী বলি, অনেক সময় মনে থাকে না। একটু থেমে ফের বলে, আমি কী অবস্থায় আছি, আনন্দদা খুব ভাল করেই জানে। তাকে জিজ্ঞেস কোরো।
অন্য সবার সঙ্গে আমাকে এক করে ফেললে বিনুদা! আমার কথা একটু আলাদা করে মনে রাখতে পার না? ঝুমার গলার স্বর গম্ভীর হয়ে ওঠে। হয়তো চাপা দুঃখে, হয়ত অভিমানে।
বিনয় অপ্রস্তুত। ঝুমা নিজেকে যে উপেক্ষিত ভাবছে, সেটা ঠিক নয়। চুম্বকের মতো সে তাকে প্রবলভাবেই আকর্ষণ করে। কিন্তু নিজের মনের যে অন্তর্মহল সেখানে জমে আছে ঘন কুয়াশা। একদিন তার বিশ্বাস ছিল, নিরুদ্দেশ ঝিনুককে সৌরলোকের যে কোনও প্রান্ত থেকে খুঁজে বার করে আনতে পারবে। কিন্তু সেই মনের জোর, সেই প্রত্যয় আর তেমনটা নেই। সব আলগা আলগা হয়ে টলে গেছে। কিছুদিন আগেও কোনও কোনও বিজন মুহূর্তে, ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বা রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঝিনুকের কথা ভেবে সে হতাশ হয়ে পড়ত। কষ্টে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যেত। একসময় মনে হতে লাগল, ঝিনুক আর কোনওদিনই ফিরে আসবে না। ক্রমশ মেয়েটা দূরে সরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু স্মৃতি থেকে তখনও বিলীন হয়ে যায়নি। ঝিনুকের এই স্মৃতিটাই তাকে ঝুমার দিকে পা বাড়াতে দেয়নি। কাজের চাপ আছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে একটু সময় বার করে ঝুমার সঙ্গে দেখা করা কি সত্যিই যেত না?
বিব্রত বিনয় বলে, মানে-মানে- হঠাৎ থেমে যায় সে। তার মধ্যে ঝুমা বা ঝিনুককে নিয়ে যে টানাপোড়েনটা রয়েছে সেটা তো আর বলা যায় না।
ঝুমা বলতে লাগল, জানো বিনুদা, তোমার জন্যে রোজ অপেক্ষা করি। কতদিন যে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি, কিন্তু তুমি আসোনি। একটু চুপ করে থেকে বলে, আমার কষ্ট হয়, তুমি বোঝে না বিনুদা? তার গলা বুজে আসে।
ঝুমার বলার মধ্যে এমন এক ব্যাকুলতা ছিল যা বিনয়কে আমূল নাড়া দিয়ে যায়। যে তরুণী পুরুষের স্নায়ুমণ্ডলীতে ঝড় তুলতে পারে, বিপুল শক্তিতে ছিনিয়ে নিতে পারে জগতের সব চেয়ে কাম্য পুরুষটিকে, তার এমন আর্তি যেন কল্পনা করা যায় না। কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না বিনয়। আবছাভাবে হলেও চকিতে ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, ঝুমার সঙ্গে দেখা হলেই ঝিনুক যেন কোনও গোপন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসে। যখনই ঝুমা, তখনই ঝিনুক। দুই নারী কী এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছে।
বিনয় কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, সুনীতির গলা শোনা গেল, বিনু, ঝুমা ডাকতে ডাকতে সে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়।মা (হেমনলিনী) বললেন, তোরা এখানে বসে গল্প করছিস। চল, পুজো শেষ হতে চলল।
বিনয় এবং ঝুমা ধীরে ধীরে উঠে পড়ে। সুনীতির পেছন পেছন দোতলায় নামতে নামতে ঝুমা খুব নিচু গলায় বিনয়কে বলে, আমি কিন্তু তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।
এই কথাটা আগেও কয়েকবার বলেছে ঝুমা। কীসের অপেক্ষা তাও অজানা নেই। কিন্তু সে কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে, নিজের কাছে এখনও তা স্পষ্ট নয়।
গৃহপ্রবেশের পুজো হোম যজ্ঞ, সব শেষ হয়েছে। এখন ছাদে হই হই করে খাওয়া দাওয়া চলছে। ছাদের নিচু দেওয়ালের ধার ঘেঁষে সারি সারি আসন পেতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল নিমন্ত্রিতদের। মাঝখানে আরও দুটো রো। পরিবেশন করছে সুধা সুনীতি উমা হিরণ এবং হিরণের অফিসের কয়েকজন সহকর্মী।
হেমনলিনী বিধবা মানুষ। তাঁর সাত্ত্বিক আহার। পরে খাবেন। তিনি বসে আছেন, একধারে একটি চেয়ারে। পরিবেশনটা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় সেদিকে লক্ষ রাখছেন। মাঝে মাঝে বলে উঠছেন, এর পাত খালি, ভাত দাও। ওকে আর দুখানা মাছ, তাকে মুড়িঘন্ট, ইত্যাদি। এটা যেন তার নিজের বাড়িরই কাজ, এমনই একটা ভাব।
দ্বারিক দও আসল গৃহকর্তা। ডাক্তারের কড়া ফতোয়া, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে খাওয়া দাওয়া সারতে হবে, নইলে অনিবার্য শরীর খারাপ। তাই তিনিও সবার সঙ্গে বসে পড়েছেন। তার কর্তব্যটা পালন করছেন হেমনলিনী।
একটা রো’তে পাশাপাশি বসেছে আনন্দ, শিশির, দ্বারিক দত্ত, বিনয় এবং বেশ কিছু অতিথি। উলটো দিকের সারিতে, মুখোমুখি স্মৃতিরেখা ঝুমা এবং নানা বয়সের আরও কয়েকজন মহিলা।
খেতে খেতে নানারকম গল্প হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মজার কথায় হাসি ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। তারই ভেতর হঠাৎ শিশির বিনয়কে জিজ্ঞেস করেন, তোমার কাজ কীরকম চলছে?
বিনয় বলল, ভালই তো
নতুন ভারত-এ তোমার লেখা রেগুলার পড়ছি। রিফিউজি প্রবলেমগুলো ঠিকভাবে তুলে ধরছ। কিন্তু
কী?
আনন্দ সেদিন বলছিল, তোমাকে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয়।
বিনয় একটু হাসল, উদ্বাস্তুদের বিরাট সমস্যা। এক জায়গাতেও তারা থাকে না। নানা জায়গায় ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাই আমাকে সে-সব এলাকায় ছুটতে হয়। পরিশ্রম তো হবেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর শিশির বললেন, তোমাকে যে চাকরিটার কথা বলেছিলাম সেটা এখনও আছে। বিদেশি ফার্ম, খাটুনি কম। অফিসে আরামে বসে কাজ করতে পারবে। ব্রাইট ফিউচার। ভেবে দেখতে পার।
এর আগেও সুধাদের জাফর শা রোডের বাড়িতে গিয়ে এই চাকরিটার কথা জানিয়ে এসেছিলেন শিশির। মুখের ওপর সোজাসুজি কিছু না বললেও, মনে মনে খুঁসেছিল বিনয়। পরে সুধার কাছে রোষ উগরে দিয়েছিল। শিশির কোন উদ্দেশ্যে তার নাকের সামনে আরামদায়ক, লোভনীয় একটা চাকরির টোপ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তা কি আর সে বোঝেনি?
দেখা যাচ্ছে, শিশির হাল ছাড়েননি। কিন্তু সেদিনের মতো ভেতরে ভেতরে বিনয় কিন্তু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে না। সে শুধু বলে, আপনার কথা মনে থাকবে। বলেই খেয়াল হয়, সে এর মধ্যে যেন বদলে যেতে শুরু করেছে।
ওদিক থেকে স্মৃতিরেখা বললেন, বিনু, সেই যে একদিন আমাদের বাড়ি গেলে তারপর আর দেখা নেই। আসো না কেন?
বিনয় একই অজুহাত পেশ করে। তার বিশাল কাজের চাপ।
হেমনলিনীর মতো স্মৃতিরেখাও জোর দিয়ে বলেন, কোনও কথা শুনব না। আমাদের বাড়ি আসতেই হবে।
গৃহপ্রবেশের এই অনুষ্ঠানে আত্মীয় পরিজন, বিশেষ করে হেমনলিনী এবং শিশিরদের যাবতীয় আগ্রহ বিনয়ের ওপর। গৃহপ্রবেশটা উপলক্ষ মাত্র। এঁরা যেন তারই জন্য এখানে জড়ো হয়েছেন। স্মৃতিরেখার কথার জবাবে কিছু একটা বলে সে, কিন্তু তার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।
ঝুমা, শিশির এবং স্মৃতিরেখা কী চান, বিনয় তা জানে। অনুতপ্ত হেমনলিনী তাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য কেন জেদ ধরেছেন, মোটামুটি তাও আঁচ করতে পারে। কিন্তু কী করবে সে? বৃদ্ধা মহিলাটিকে কথা দেবার পরও হঠাৎ মনে হয় মনের অতল স্তরে কোথায় যেন একটু দ্বিধা থেকে গেছে।
৬৯.
সুধাদের গৃহপ্রবেশের পর ছটা দিন পার হয়ে গেল। ফের একটা রবিবার এসে হাজির। সপ্তাহের অন্য সব দিনের মতো ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল বিনয়ের। এটাই তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
হিমঋতুর আয়ুষ্কাল এ-বছরের মতো ফুরিয়ে যাবার পর থেকে দিনের তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাতাসে শীতের সেই কামড়টা আর নেই। কদিন আগে সকালের দিকে কিছুক্ষণ আর সন্ধের পর থেকে বাকি রাতটা ঠণ্ডার হালকা আমেজ থাকত। এখন সেটাও নেই।
লেপ কম্বল আগেই ভাঁজ করে একটা বড় টিনের ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিনয়। আজকাল চাদর। গায়ে দিলেই কাজ চলে যায়।
কিছুদিন আগেও শীতের দাপটে ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে শুতে হতো। এখন রাস্তার দিকের জানালা খুলে রাখে বিনয়।
শুয়ে শুয়েই জানালার বাইরে তাকালো সে। এই মুহূর্তে আকাশে দিনের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করেছে। নিচে থেকে নানারকম আওয়াজ ভেসে আসছে।
এ-পাড়ায় দিনের আরম্ভ তুমুল ঝগড়াঝাটি দিয়ে। বিনয়দের শান্তিনিবাস মেস থেকে ডানপাশে খানিকটা গেলে যে মোড়টা পড়ে সেখানে রয়েছে কর্পোরেশনের একটা জলের কল। ভোরের আলো দেখা দিতে না দিতেই চারপাশের বস্তিগুলো থেকে বালতি কলসি ডেকচি নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এসে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কে আগে জল নেবে তাই নিয়ে চলে হুড়োহুড়ি, ধস্তাধস্তি, খিস্তিখেউড়। আজও মহাযুদ্ধ চলছে। তা ছাড়া রিকশা, সাইকেল, দু-একটা ট্যাক্সি বা ঘোড়ার গাড়ি চলে যাবার। রকমারি শব্দ। রাস্তার উলটো দিকের বস্তির ঘরে ঘরে বা এধারে ওধারে চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকানগুলোর উনুনে আঁচ পড়েছে। কয়লার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে মহাশূন্যে।
সুধাদের গৃহপ্রবেশের পর মাঝখানের ছটা দিন চাপা অস্থিরতা তাকে যেন তাড়া করে বেড়িয়েছে। সারাদিন উদ্বাস্তু কলোনি টলোনিতে ছোটাছুটি এবং নানা ব্যস্ততার মধ্যে তবু একরকম কেটে যেত। কিন্তু রাত্তিরে মেসে ফিরে এলে আজব এক দর্পণ কেউ যেন তার সামনে টাঙিয়ে দিয়েছে। প্রতিবিম্বের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সে বার বার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, হেমনলিনীদের বাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে? উত্তরও পাওয়া গেছে। যাঁর বিরুদ্ধে ঝিনুকের ওপর মানসিক পীড়নের অভিযোগ, তিনি তো অনুতপ্ত, ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন। এখন যাওয়া যেতেই পারে। তাছাড়া, অনেকেই যা বলে, আয়নার প্রতিচ্ছবিও তা-ই জানিয়েছে। যে মেয়ে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছে, কোনওদিনই সে আর ফিরবে না। বেঁচে আছে কি না, কে জানে। যদি বেঁচে থাকেও, বিনয়ের কথা একবারও কি তার মনে পড়ে? নাকি তাকে পুরোপুরিই ভুলে গেছে? ক্ষোভে দুঃখে আত্মগ্লানিতে চলেই না হয় গিয়েছিল, বিনয়ের কথা ভেবে ফিরেও তো আসতে পারত। সুধাদের বাড়ির ঠিকানা তো তার অজানা ছিল না।
না, ঝিনুক আর আসবে না। সম্পর্কের সুতোগুলো নিজের হাতে ছিঁড়ে দিয়ে চিরকালের মতো বিলীন হয়ে গেছে।
ঝিনুক চলে যাবার পর প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। উভ্রান্তের মতো সকাল থেকে রাত অবধি, যতক্ষণ ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে না আসে, তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। তার মতো কারওকে দেখা গেছে, এমন খবর কানে আসামাত্র কোথায় না কোথায় ছুটেছে! কিন্তু প্রথম দিকের সেই আকুলতা ক্রমশ ক্ষয়ে এসেছে। সুধাদের বাড়িতে হেমনলিনীর সঙ্গে দেখা হবার পর স্মৃতিতে ঝিনুক আরও ঝাপসা হয়ে গেছে। হেমনলিনী তো উপলক্ষ মাত্র। এর পেছনে যে রয়েছে, সে ঝুমা।
আসলে ঝুমা রক্তমাংসের উষ্ণ এক তরুণী সারাক্ষণ যে টগবগ করে ফুটছে। সে সামনে এসে দাঁড়ালে স্নায়ুমণ্ডলীতে ঝড় বয়ে যায়। আর ঝিনুকের অস্তিত্ব স্মৃতি ছাড়া আজ আর কোথাও নেই। একদিন বিনয়কে নিয়ে দুই তরুণীর মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কিন্তু স্মৃতির এক মানবী কি চিরদিন পারে ঝুমার মতো একটি মেয়েকে ঠেকিয়ে রাখতে?
ছটা দিন নিজেকে তোলপাড় করে শেষ পর্যন্ত বিনয় স্থির করে ফেলেছে হেমননিলনীদের বাড়ি যাবে। আনন্দকে জানিয়েও দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ হল রোদ উঠে গেছে। ঘরভর্তি ঝলমলে আলো। গা থেকে চাদর সরিয়ে, গামছা, মাজনের কৌটো, সাবান, দাড়ি কামাবার ব্লেড, তেলের শিশি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল বিনয়। চান সেরে, জামাকাপড় পালটে একেবারে বাইরে বেরুবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। তারপর চলে এল প্রসাদের ঘরে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রসাদের দৈনন্দিন রুটিনের প্রথম কাজটি এখন চলছে। ক্ষিপ্র হাতে পাউরুটি কেটে কেটে স্তূপাকার করে রাখছেন। শীত বিদায় নেবার পর আজকাল আর স্টোভ ধরিয়ে ঠাণ্ডা জমাট মাখন গরম করতে হয় না। এমনিতেই তা নরম হয়ে থাকে।
অন্যদিনের মতো আজও প্রসাদ বললেন, নাও, হাত লাগাও
শান্তিনিবাস-এ আসার পর থেকে বিনয়েরও দিনের প্রথম কাজটি হল, রুটিতে মাখন লাগানো। আজ বাইরে বেরুবার তাড়াহুড়ো নেই। ধীরে সুস্থে হেমনলিনীদের বাড়িতে গেলেই হবে। বিনয় একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ে। কৌটো থেকে ছুরি দিয়ে মাখন তুলে নেয়।
দুজনেরই হাত চলছে। ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা। অফিসের কথা, উদ্বাস্তুদের অজস্র সমস্যার কথা, কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসন হবে তাই নিয়ে আলোচনা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর মধ্যেই সুবল মেসের বরাদ্দ চা-বিকুট দিয়ে যায়। তারপর দোকান থেকে কিনে আনে সকালের জলখাবার। খাওয়াদাওয়া চুকতে না চুকতেই এ-পাড়ার উদ্বাস্তুদের বাচ্চাগুলো তাদের মাখন-রুটি নিয়ে যায়।
বেলা আর একটু বাড়লে বিনয় উঠে পড়ে। বলে, প্রসাদদা, দুপুরে আমার একটা নেমন্তন্ন আছে। যাচ্ছি।
প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কখন ফিরছ?
সন্ধের আগেই।
ছুটির দিনে রাস্তায় লোকজন, গাড়িঘোড়া বেশ কম। চারপাশে কেমন একটা ঢিলেঢালা ভাব। দুপুরের অনেক আগেই হেমনলিনীদের বাড়ি পৌঁছে গেল বিনয়।
গেট খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকতেই সুনীতিদের কাজের লোক যতীন কোত্থেকে যেন দৌড়ে চলে এল। সসম্ভমে বলল, আসেন দাদাবাবু, আসেন।
গেট থেকে মূল বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। দুধারে ফুলের বাগান, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। আগে আগে চলেছে যতীন, পেছনে বিনয়।
চলতে চলতে যতীন বলতে লাগল, কখন আসবেন সেই জন্যি সকাল থিকে রাস্তার দিকে নজর রাকছিলুম
বিনয় অবাক।-নজর রাখছিলে!
হ্যাঁ। মা রাকতে বলেছেন। কতবার যে গেটের কাছে এসে দেখে গেচি!
মা, অর্থাৎ হেমনলিনী। এ-বাড়ি বিনয়ের কি অচেনা? সুনীতির বউ-ভাতে হেমনাথের সঙ্গে এসে বেশ কদিন থেকে গেছে। এই সেদিনও পাকিস্তান থেকে ঝিনুককে নিয়ে এখানেই এসেছিল। হেমনলিনীর কি ধারণা, সে বাড়িটা ভুলে গেছে, এরাস্তায় এসে খোঁজাখুঁজি করে বেড়াবে? পরক্ষণে খেয়াল হয়, লক্ষ রাখার জন্য একটা লোককে যে হামেহাল মজুত রাখা হয়েছে, হয়তো সেটা তার আসাটাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবার জন্য।
সদর দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতীন গলা চড়িয়ে হাঁক দেয়, মা, বিনু দাদাবাবু এসে গেচে
আসছি আমরা।
দোতলা থেকে হেমনলিনীর গলা ভেসে আসে। একটু পরেই দেখা যায়, প্যাসেজের ও মাথার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে কল কল করতে করতে নেমে আসছে মেয়েদের একটা দঙ্গল। হেমনলিনী তো
আছেনই, তার সঙ্গে রয়েছে সুনীতি, দীপকের বউ মাধুরী, ঝুমা এবং আরও একটি তরুণী। মেয়েটি সুধার বয়সী। বিবাহিতা। সুন্দরী। শরীরের গড়ন ভারী ধরনের। মুখটা চেনা চেনা। আগে কোথায় যেন দেখেছে, ঠিক মনে করে উঠতে পারল না বিনয়।
কাছে এসে সুনীতি বলল, কি রে, এত দেরি করলি যে?
হেমনলিনী ব্যগ্র স্বরে বললেন, সেই সকাল থেকে তোমার জন্যে আমরা অপেক্ষা করে আছি। এস–এস–
নিজের অজান্তে বিনয়ের চোখ ঝুমার দিকে ঘুরে যায়। ঝুমা কিছু বলল না। তার চোখের মণিতে আলোর ঝলক খেলে যেতে লাগল। মুখে ফুটে উঠল পরমাশ্চর্য এক হাসি। তাতে কত কী-ই যে রয়েছে। সুখ, আনন্দ, মধুর স্বপ্নের বিচ্ছুরণ।
একতলার বসার ঘরে নয়, হেমনলিনী সোজা সবাইকে নিয়ে ফের দোতলার সিঁড়ির দিকে চললেন। প্যাসেজ দিয়ে খানিকটা এগুলেই বাঁ ধারে রান্নাঘর। সেখানে এখন প্রচণ্ড ব্যস্ততা। এ-বাড়ির রাঁধুনী বামুন অনাথ তার জোগাড়েদের নিয়ে গলঘর্ম। কেউ বাটনা বাটছে, কেউ আনাজ কাটছে, কেউ মাছে নুন-হলুদ মাখাচ্ছে। চলছে রান্নাবান্নার বিপুল আয়োজন।
চকিতে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ঝিনুককে নিয়ে এ-বাড়ি থেকে চলে যাবার দৃশ্যটি মনে পড়ে গেল বিনয়ের। সেই বিদায়টি কেমন ছিল? নিরানন্দ। গ্লানিময়। চরম অসম্মানজনক। আর আজকের এই উষ্ণ, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটিতে এমন এক জাঁকালো অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছিল, কে ভাবতে পেরেছে?
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে সেই আধো-চেনা তরুণীটি জিজ্ঞেস করে, আমার সঙ্গে কথা বলছ না যে বিনু? নিশ্চয়ই চিনতে পার নি?
বিনয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। চমকে উঠে তোতলাতে থাকে, মানে–মানে
তার কাঁধে একটা হাত রেখে স্নিগ্ধ গলায় তরুণী বলে, আমি রুমাদি- ঝুমার দিদি। আমাকে ভুলে গেছ!
অপ্রস্তুতের একশ্যে। বিব্রত মুখে বিনয় বলে, অনেকদিন পর দেখা তো। তাই–বলতে বলতে মাথার ভেতরে স্মৃতির ঝাপি খুলে যায়। বেরিয়ে আসতে থাকে ছবির পর ছবি। সেই যুদ্ধের আমলে জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা ফাঁকা করে যে যেদিকে পারে উধাও হয়েছিল। রুমারা গিয়েছিল রাজদিয়ায়। তাদের সঙ্গে আনন্দও। তখন নৌকোয় করে কত ঘোরাঘুরি, পুজোর সময় একসঙ্গে প্রতিমা দেখতে যাওয়া, নদীর চরে বনভোজন, পাখি শিকার, আনন্দর পেছনে লাগা, এমনি কত কী। যুদ্ধের শেষাশেষি ঝুমারা কলকাতায় চলে এল। তার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় রুমার। খবরটা রাজদিয়ায় থাকতে থাকতেই পেয়েছিল বিনয়। তাদের সবাইকে নেমতন্নও করেছিলেন রুমার ঠাকুরদা রামকেশব মজুমদার। কিন্তু স্নেহলতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতায় আসা হয়নি। বিনয় শুনেছে, রুমার স্বামী অমিতেশ পাটনায় চাকরি করে, বিয়ের পর সেখানে চলে গিয়েছিল সে। দেশে থাকতে সেই যে দেখা হয়েছিল, তারপর এতদিন বাদে তাকে দেখল বিনয়।
রুমা বলল, তোমাকে কত ছোট দেখেছিলাম। এখন একেবারে ইয়ং ম্যান। চেহারা, গলার স্বর পালটে গেছে। তবু দেখেই চিনতে পেরেছি।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, শুনেছি তোমরা পাটনায় থাকো। এখনও কি সেখানেই আছ?
হ্যাঁ। আরও দুবছর ওখানে থাকতে হবে। তারপর তোমার জামাইবাবু কলকাতায় বদলি হবে। আমরাও পাকাপাকি এখানে চলে আসব।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, তার তত দেরি আছে। তুমি হঠাৎ কলকাতায়?
অনেকদিন মা-বাবা-ঝুমাকে দেখি না। মন খারাপ লাগছিল, তাই চলে এলাম। মাসখানেক কাটিয়ে তবে পাটনায় ফিরব।
তোমার বিয়েতে আসতে পারিনি। জামাইবাবুকে দেখিনি। এবার দেখাও হবে, আলাপও হবে।
উহু– আস্তে মাথা নাড়ে রুমা।
বিনয় বলে, উঁহু মানে?
তোমার জামাইবাবু আমাকে কলকাতায় রেখেই ফিরে গেছে। মাসখানেক বাদে যখন নিতে আসবে তখন আলাপ কোরো।
একটু চুপচাপ।
তারপর রুমা ফের বলে, জানো বিনু, শুধু মা-বাবাদের জন্যেই না, তোমার জন্যেও এবার কলকাতায় এসেছি। কতকাল পর তোমাকে দেখলাম। কী ভাল যে লাগছে!
উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যায় বিনয়। তারপর বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, আমার কথা তুমি জানলে কী করে?
গেল সপ্তাহে মা চিঠিতে তোমার কথা খুব করে লিখেছে। তোমার জামাইবাবুর অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। এক্ষুনি আসতে চাইছিল না। জোর করে ওকে নিয়ে আমি চলে এলাম।
বিনয় ধন্দে পড়ে যায়। রুমার মা স্মৃতিরেখা তার মেয়েকে চিঠি লিখতেই পারেন। কিন্তু তার সম্বন্ধে সাতকাহন কী লিখেছেন? তার জন্যেই বা কেন তাড়াহুড়ো করে রুমা চলে এসেছে? এ-সব জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল সে।
দোতলায় আনন্দ আর সুনীতির শোওয়ার ঘরে হেমনলিনী বিনয়দের নিয়ে চলে এলেন। ঘরটা বিশাল। একধারে কারুকাজ-করা সেকেলে খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল ইত্যাদি। আর-এক পাশে মেঝেতে কার্পেট পাতা। তার ওপর তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে শিশির, আনন্দ, দীপক আর স্মৃতিরেখা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। বিনয়কে দেখে তারা হইচই বাধিয়ে দেন।
হেমনলিনী হেসে হেসে বললেন, বিনয়কে দিয়ে গেলাম। তোমরা গল্প-টল্প কর। আমি গিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করছি। সুনীতিরা তাঁর সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। হেমনলিনী রাজি হলেন না। তোমরা বিনুকে নিয়ে এখানেই আনন্দ কর। বলে তিনি চলে গেলেন।
বিনয়কে মাঝখানে বসিয়ে মজলিশ আরও জমজমাট হয়ে উঠল। ফুরফুরে মেজাজে, লঘু চালে অবিরল আড্ডা। কতরকম বিষয়! সিনেমা, থিয়েটার, ফুটবল, ক্রিকেট। মজার মজার কথায় আতশবাজির মতো হাসি যেন ফেটে পড়তে থাকে। মেয়েরা হা হা, হি হি করতে করতে ঢলে পড়ে।
এখানে বয়সে সবার বড় শিশির। গুরুজন। মস্ত চাকরি করেন। এমনিতেই রাশভারী। কিন্তু আজ বয়সের, সামাজিক মর্যাদার সীমারেখা ভেঙে সবার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন।
মাঝে মাঝে যতীনের হাতে প্রকাণ্ড ট্রেতে প্রচুর মাছভাজা, প্রচুর কুমড়ো ফুল কি বকফুলের বড়া, বেগুনি, মিষ্টি দিয়ে যাচ্ছেন হেমনলিনী। প্রতিবারই অঢেল চা।
শিশিররা হাঁ হাঁ করে উঠলে তিনি বলেন, রান্না শেষ হতে অনেক দেরি। খাও সবাই। আমাকে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসতে হবে। দেখিয়ে না দিলে অনাথ যে কী পিণ্ডি পাকিয়ে বসবে! বলে আর দাঁড়ান না। আজ শতভুজা হয়ে সমস্ত কিছু একাই সামাল দিচ্ছেন।
বিনয়ের মনে হয়, এ-বাড়িতে আজ এত যে আয়োজন, এত সমারোহ, এত হইচই, উৎসব উৎসব ভাব–সব তারই জন্য।
খাওয়ার যখন ডাক পড়ল, আড়াইটা বেজে গেছে। খেতে খেতে সুনীতিরা, স্মৃতিরেখারা ঠিক করে ফেললেন, আজকের এই আনন্দটা একটা রবিবারের মধ্যেই ফুরিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। পরের ছুটির দিনগুলোতেও তার জের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। কোনও রবিবার সিনেমা, কোনও রবিবার পিকনিক, কোনও রবিবার ম্যাজিক বা থিয়েটার কিংবা কাছাকাছি কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা।
বিনয় ভেবে রেখেছিল, খাওয়াদাওয়ার পর বেলা পড়ে এলে মেসে ফিরে যাবে। কিন্তু সেটি সম্ভব হল না। বিকেলে চাটা খাওয়ার পর আর-এক প্রস্থ আসর বসানো হল।
শিশির তাসের ম্যাজিক দেখালেন। দীপক রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো। ঝুমা, রুমা আর মাধুরীর গানের গলা বেশ ভাল। তারা অনেকগুলো গান শোনায়। বন্দর ছাড়ো, বন্দর ছাড়ো, যাত্রীরা সবে, জোয়ার এসেছে আজ-, ওই মালতীলতা দোলে, পিয়ালতরুর কোলে, আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, ওই পাহাড়ের ঝরনা আমি নাচি তা থই, থই, কোন লগনে জনম আমার, আকাশে চাঁদ ছিল রে ইত্যাদি।
সন্ধের পর রুমা আর হেমনলিনী বিনয়কে নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে চলে এলেন। তাকে বসিয়ে ওঁরাও মুখোমুখি বসলেন।
রুমা বলল, বিনু, আমি যে এত তাড়াহুড়ো করে চলে এলাম সেটা তোমার আর ঝুমার জন্যে। কী বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। সুনীতি মামির তুমি ভাই। সেদিক থেকে আত্মীয়তা তো আছেই। আমরা তোমাকে আরও আপন করে পেতে চাই। ঝুমা
রুমাকে শেষ করতে দিলেন না হেমনলিনী। বলে উঠলেন, মেয়েটা সেই কবে থেকে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এত ভালবাসা তুচ্ছ করার জিনিস নয় বিনু
রাতে না খাইয়ে হেমনলিনীরা ছাড়লেন না। মেসে ফিরে যেতে যেতে বিনয়ের মনে হয়, তার ভেতরকার দ্বিধাটা বুঝি বা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। ঝিনুক জীবনের যে-দিকটা ফাঁকা করে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে, অন্য এক তরুণী সেই শূন্যস্থান ক্রমশ পূর্ণ করে দিচ্ছে। জীবনের সবে তো শুরু। সামনে বিপুল ভবিষ্যৎ। একটি ধর্ষিতা মেয়ের স্মৃতি নিয়ে একা একা বছরের পর বছর কাটানো কি সম্ভব?
৭০.
হারু আর দুলালকে অল্পদিনেই খুব ভাল লেগে গেছে বিনয়ের। সদ্যযুবক এই ছেলে দুটোর মধ্যে রয়েছে নির্মল সারল্য। তারা আগাগোড়া সৎ। বেশ কিছুদিন হল পূর্ব পাকিস্তানে সর্বস্ব খুইয়ে কলকাতায় এসেছে। কিন্তু মহানগরের নোংরামির বিষ তাদের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে পড়েনি। ধূর্তামি, চাতুরালি, ফেরেববাজি, কৌশলে কিছু বাগিয়ে নেওয়া–এ-সব তারা জানে না। এখনও পূর্ব বাংলার দুই সোজাসাপটা বালকই থেকে গেছে।
প্রসাদও ওদের যথেষ্ট ভালবাসেন। নিয়মিত দুজনের কলেজের মাইনে দিয়ে যাচ্ছেন। বইপত্র কিনে দেন। ওদের সংসারের অনটন যখন চরমে পৌঁছয়, সাহায্যও করেন। কিন্তু দুলালদের সঙ্গে তার বয়সের তফাৎ অনেকটাই। তাছাড়া প্রসাদ রাশভারী। তাই বড় রকমের দূরত্ব থেকেই যায়। সেটা পেরিয়ে ওঁর কাছাকাছি পৌঁছনো হারুদের সাধ্যের বাইরে।
তুলনায় বিনয়ের সঙ্গে ওদের বয়সের পার্থক্য তেমন কিছু নয়। খুব বেশি হলে চার পাঁচ বছর। ঝিনুকের ধর্ষিত হওয়া, তাকে প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে পাকিস্তানের সীমান্ত পার করে কলকাতায় নিয়ে আসা, এখানে তার অসম্মান লাঞ্ছনা এবং পরে নিরুদ্দেশ হওয়া–এই সব ঘটনা বিনয়কে কিছুকাল অস্থির, উদ্ভ্রান্ত করে রেখেছিল। নইলে এমনিতে সে হাসিখুশি, আমুদে। তার স্বভাব এমনই নরম, এমনই মায়াময় যা সবাইকে কাছে টানে। হারুরা তার ঘরে এলে সহজে নড়তে চায় না; গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে। বিনয়ের কাছে ওদের বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। প্রাণ খুলে তাকে নিজেদের দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, সংকটের কথা বলে যায়। বিনয়ের কাছে তাদের যত আবদার।
কোনও দিন বিনয় অফিস থেকে ফিরে এলে ওরা এসে ধরে, বিনয়দা, ইন্দিরা সিনেমায় সমাপিকা পিকচারখান চলতে আছে। শুনছি খুব ভাল। আইজ নাইট শোয়ে দেখাইতে অইব। কোনও দিন বলে কুলপি কি মাংসের ঘুগনি খাওয়ান। তবে রোজই একবার করে জানায়, চাকরি বাকরি না পেলে ম-বাবা-ভাইবোনদের নিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন নিচু গলায় দুলাল বলেছে, আমরা গুপনে (গোপনে) নানান অফিসে দরখাস্ত পাঠাইতে আছি। আপনেরেই হুধা কইলাম। দেইখেন প্রসাদকাকায় য্যান ট্যার (যেন টের) না পায়। হুনলে তেনি খেইপা যাইবেন।
হারুদের চাকরি করার পেছনে যে জোরালো যুক্তিটা রয়েছে তা অনেক আগেই মেনে নিয়েছে বিনয়। রোজগার না করলে ওদের সংসার সত্যিই ভেসে যাবে। কিন্তু এ-সব শুনতেই চান না প্রসাদ। তার মতে হারু দুলালদের যা বয়স পড়াশোনা ছাড়া কোনও দিকে ওদের তাকানোর প্রয়োজন নেই। লেখাপড়াই ওদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রসাদের সঙ্গে বিনয়ের যা সম্পর্ক তাতে এ নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক করা যায় না। নীরব থাকাই শ্রেয়। সে হারুদের বলে, তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো, আমি প্রসাদদাকে কিছু বলব না।
ফাল্গুন মাসটা কখন এল, কখন বিদায় নিল, প্রায় টেরই পাওয়া যায়নি। চৈত্র এসে জানান দিয়ে গেছে, গরমকাল আসতে আর দেরি নেই।
দেখতে দেখতে গনগনে হলকা ছুটিয়ে একদিন বৈশাখ এসে হাজির। তাপমাত্রা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। বেলা চড়ার পর থেকে সন্ধের আগে পর্যন্ত রোদ অবিরল আগুন ঢালতে থাকে। তপ্ত বাতাস রাগে গরগর করতে করতে দিগ্বিদিকে ছুটে যায়।
কলকাতার অন্য রাস্তার মতো মহেশ হালদার লেনেও গ্রীষ্মের দুটো মাস সকালের দিকে দশটা সাড়ে-দশটা অবধি ভালই ভিড় থাকে। যতই গরম পড়ুক, মানুষকে বাজারে যেতে হয়, অফিসে বা অন্য কাজকর্মে না বেরুলে চলে না।
কিন্তু দুপুরে, সূর্য যখন সোজাসুজি মাথার ওপর উঠে আসে, এই গলি তখন সুনসান। লোকজন একরকম দেখাই যায় না। কাক চিল চড়াই-সব উধাও। ফেরিওলার হাঁক কানে আসে না। এমনকি যে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো তিন শিফটে কামড়াকামড়ি করে রাস্তার দখল বজায় রাখে তারাও বেপাত্তা হয়ে যায়। কোনও গাড়ি-বারান্দার তলায় কিংবা দেওয়ালের আড়ালে একটু ছায়া পেলে কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। হয়তো তার পাশেই শুয়ে আছে শত্রুপক্ষের কেউ। কিন্তু লড়াই যে বাধাবে। সেই ইচ্ছা বা প্রতাপ তার থাকে না। গ্রীষ্ম তার সব এনার্জি শুষে নিয়ে তাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। সন্ধের পর থেকে মহেশ হালদার লেন পুরোপুরি বদলে যায়। ততক্ষণে দিনের তাপাঙ্ক ঝপ করে অনেকখানি নেমে গেছে। কর্পোরেশনের গ্যাসবাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠে। এ-পাড়ার বাসিন্দারা অফিস এবং অন্য সব কাজের জায়গা থেকে ফিরে, সারাদিনের লাট-হওয়া জামাকাপড় পালটে, পাড়ার বোয়াকগুলো আলো করে বসে আড্ডা জমায়। রাস্তার এবং ছোট ছোট মলিন চায়ের দোকানগুলোতেও তখন থোকায় থোকায় ভিড়। স্কুলের ছেলেদের অবশ্য এই সব মজলিশে ঘেঁষতে। দেওয়া হয় না। তবে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে যারা পড়ে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই; কেননা তারা দস্তুরমতো সাবালক। এই যুবকরা কোনও না কোনও জটলায় জুটে যায়। নাইট ক্লাস সেরে এসে হারু আর দুলালও একটা না একটা দঙ্গলে ভিড়ে পড়ে।
বিনয় লক্ষ করেছে, গোড়ার দিকে নৈশ আড্ডাগুলো থেকে মাছির ভনভনানির মতো আওয়াজ তার ঘরে উঠে আসত। কিন্তু পরে আওয়াজটা তুমুল হইচইয়ের চেহারা নিতে শুরু করেছে। যত দিন যাচ্ছে বচসা, উত্তেজনা, চেঁচামেচি বেড়েই চলেছে।
এর কারণটা কী? ধন্দে পড়ে গিয়েছিল বিনয়। পরে অবশ্য দুলালদের কাছে জানা গেছে, এ-সবের হেতু হল কলকাতার ফুটবল লিগ এবং ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান।
বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে লিগের খেলা শুরু হয়েছে। বাঘা বাঘা কত টিমই তো খেলছে। মহামেডান স্পোর্টিং, রাজস্থান, ভবানীপুর, ইস্টার্ন রেলওয়ে, বি এন আর, ওয়াড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের ব্যাপারই আলাদা, তারা সবার ওপরে। এই দুই দলের মধ্যে চিরকালের আকচাআকচি। দাঁতে দাঁত চেপে তাদের পাঞ্জা কষা চলছে আজন্ম। বাঙালি জাতি আড়াআড়ি দুভাগ হয়ে একটা ভাগ ইস্টবেঙ্গলের, অন্যটা মোহনবাগানের। পদ্মার ওপারের বাঙালিদের হৃৎস্পন্দন হল ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এপারের বাঙালিদের প্রাণভোমরা। দুই টিমের হারজিতের ওপর আপামর বাঙালির মান-সম্ভ্রম, অহমিকা আর মরণবাঁচন যেন জড়িয়ে আছে। এই দল দুটো না থাকলে বাঙালির জীবনে বারো আনা মজাই থাকত না। সমস্ত কিছু আলুনি হয়ে যেত।
রাজদিয়ায় থাকতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের কথা শুনেছে বিনয় কিন্তু টিম দুটো যে এমন ব্যাপকভাবে বাঙালির জীবনে ঢুকে পড়েছে, জানা ছিল না।
দেশভাগের আগে মহেশ হালদার লেনে পদ্মাপারের বাঙালিরা ছিল না বললেই হয়। থাকলেও হাতে গোনা দু-একটা ফ্যামিলি। তারা যে রয়েছে, টেরই পাওয়া যেত না। তাই এলাকায় মোহনবাগানীদের ছিল একচ্ছত্র প্রতাপ।
কিন্তু সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের পর আবহাওয়া পালটে যায়। ছিন্নমূল মানুষের ঢল নামে কলকাতায়। তাদের একটা ঝক চলে ভবানীপুরের এই গলিতে। মহেশ হালদার লেনের বস্তিগুলো উদ্বাস্তুতে ভরে গেল। দেশ থেকে যারা কিছু পয়সাকড়ি আনতে পেরেছিল, তারা পাকা দালানকোঠায় ঘর ভাড়া নিয়ে ঢুকে পড়ল। ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ পতাকা তোলার এবং তাদের পক্ষে জয়ধ্বনি দেবার লোক এখন প্রচুর। সমানে সমানে মোহনবাগানীদের সঙ্গে তারা টক্কর দিচ্ছে।
রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে তার ঘরের রাস্তার দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে বিনয়ের চোখে পড়ে নিচে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি চলছে।
কোনও মোহনবাগানী মুখ বাঁকিয়ে, চোখ কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলছে; আরে যা যা। এই তো সবে তোদের টিম জন্মালো। এখনও গা থেকে আঁতুড়ের গন্ধ যায়নি। সেদিনের যোগী, ভাতকে বলে অন্ন! লোকটা তোড়ে বলে যায়, আমরা ধবধবে সাদা চামড়াদের, ইয়েস স্পটলেস হোয়াইট হারিয়ে শিল্ড জিতেছি। সেটা রেড-লেটার ডে। ইন্ডিয়ার ন্যাশনাল হিস্ট্রিতে লাল কালিতে ঘটনাটা লেকা আচে। তোদের আচে আমাদের মতো অ্যারিস্টোক্র্যাসি! রিফিউজিদের টিম! বাতাবি নেবু নিয়ে পঞ্চাশ বছর রগড়া, তারপর ফুটবলে পা ঠেকাবি।–হু! নাক দিয়ে অবজ্ঞাসূচক শব্দ বার করে ভিড়ের ভেতর একটা সিঁড়িঙ্গে ছোকরাকে বলে, অ্যাই বটা, মুকুন্দ কেবিন-এ বলে আয়, এক কাপ ডাবল হাফ যেন এক্ষুনি পাঠায়। গরম গরম। আমার নামে দামটা খাতায় লিকে রাখতে বলবি। চায়ের নামে ঘোড়ার পেচ্ছাপ যেন না দেয়।
এদিকে পদ্মাপারের ইস্টবেঙ্গলীদের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। তাদের একজন চিড়বিড়িয়ে ওঠে, অ্যারিস্টোক্র্যাসি! রেড ল্যাটার ডে! কবে খাইছিল ঘি, হাতের তালুতে অহনও ঘইটারা গোন্ধ সোঙ্গে (গন্ধ শোঁকে)। পঞ্চাশ বছর আগে আমাগো টিম থাকলে সায়েবগগা হারাইয়া দশ বার শিল্ড জিততাম। আমাগো টিম লইয়া পুরা একখান ন্যাশনাল হিস্টোরি ল্যাখা হইত। আমাগো তো হেইদিনের টিম, র্যাকর্ড (রেকর্ড) দ্যাখ, কতবার ইস্টব্যাঙ্গলের কাছে হারছস। দ্যাখ কতগুলা গোল তগো দিছি!
ডবল-হাফ চা এসে গিয়েছিল। কাপে চুমুক দিতে দিতে পা নাচাচ্ছিল সেই মোহনবাগানীটি। বলল, শালা বাঙাল, পদ্মার পাড় থেকে ভয়ে ন্যাজ গুটিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এয়েচিস। বেশি ফুটুনি করবি না। আমরা দয়া করে থাকতে দিইচি। হ্যাঁ
ইস্টবেঙ্গলীর রক্তচাপ আচমকা দশগুণ বেড়ে যায়। খেপে ওঠে সে। –হালা ঘইটা (ঘটি), কইলকাতা কি তগো বাপের সোম্পত্তি?
আড্ডাবাজদের মধ্যে যাদের মাথা ঠাণ্ডা তারা হাঁ হাঁ করে ওঠে। –অ্যাই অ্যাই, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়ে কথা হচ্ছে। এর ভেতর বাপ তোলাতুলি নয়।
অন্য একজন বলে, বি ডিস্যান্ট (ডিসেন্ট)। স্পোর্টস-ম্যান স্পিরিট নষ্ট করনটা ঠিক না।
আবহাওয়া তপ্ত হয়ে উঠেছিল, ধীরে ধীরে জুড়িয়ে আসে।
রোজই এই ধরনে উত্তপ্ত তর্কাতর্কি চলে। তারপ সব মিটেও যায়।
আজ শুক্রবার। অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি চুকিয়ে বিনয় ঠিক করে ফেলল, মেসে ফিরে যাবে।
ট্রামে বাসে এবং খানিকটা পায়ে হেঁটে সে যখন মহেশ হালদার লেনের মুখে এসে পৌঁছল, তখনও ভাল করে সন্ধে নামেনি। সূর্য ডুবে গেছে ঠিকই, তবে হঠাৎ লজ্জা-পাওয়া মেয়ের মুখের মতো লালচে একটু আভা তখনও আকাশের গায়ে লেগে আছে।
তাদের গলিতে পা দিয়ে তাজ্জব বনে যায় বিনয়। মোড়ের এধারে ওধারে মুখোমুখি দুই বাড়ির কার্নিসে দড়ি আটকে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বড় বড় পচা চিংড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যত সে এগুচ্ছে মাথার ওপর আরও তিনটে ঘটি দেখা গেল। এখন পাঁচ নম্বরটা টাঙানোর তোড়জোড় চলছে।
বিনয়ের চোখে পড়ল, ডানদিকের একটা দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে ছাদের দেওয়ালে দড়ি বাঁধছে দুলাল। উলটো দিকের বাড়িটাও দোতলা। সেটার মাথায় চড়েছে শিবু। সেও কাঠ বাঙাল এবং ইস্টবেঙ্গল বলতে উন্মাদ। শিবুর হাতে রয়েছে দড়ির অন্য দিকটা; সেও টান টান করে তার ছাদে সেটা বাঁধছে। মধ্যিখানে চিংড়ির সারি।
নিচে এক দঙ্গল ছোকরা। তারা হই হই করে দুলাল আর শিবুকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের ভেতর হারুকেও দেখা গেল।
আরও একটু এগুতেই চোখে পড়ল, পর পর কটা পচা ইলিশ একই প্রক্রিয়ায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং আরও কয়েকটা ঝোলানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানেও আর এক দঙ্গল ছোকরা হই হই করছে।
পচা ইলিশ আর চিংড়ির রহস্যটা বিনয়ের কাছে স্পষ্ট হল না। সে মেসে ফিরে, চান টান করে নিল। এই গরমে দুবেলা চান না করলে চলে না। গায়ের চামড়া যেন জ্বলে যায়। চানের পর বাইরের ধুতি শার্ট বদলে পাজামা টাজামা পরে সুবলকে দিয়ে চা আর লুচি, ছোলার ডাল আনিয়ে নিল। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছিল। কিছুক্ষণ শোওয়া দরকার। দ্রুত খাওয়া চুকিয়ে সে বিছানায় উঠতে যাবে, হারু আর দুলাল এসে হাজির।
শোওয়া আর হয় না। হারু এবং দুলালকে বসিয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবে? আনিয়ে দেব?
না। কিছুক্ষণ আগে টিফিন করছি। দুজনেই মাথা নাড়ে। দুলাল বলল, আপনে তরাতরি অফিস থিকা ফিরা আইছেন, ভালই অইছে।
উৎসুক সুরে বিনয় বলে, কেন বল তো, কিছু দরকার আছে?
হ। কাইল ইস্টব্যাঙ্গল মোহনবাগান লিগের ফাস্ট ম্যাচটা খেলব। হারু, আমি আর এই পাড়ার কয়েকজন ইস্টব্যাঙ্গল সাপোর্টার ম্যাচখান দেখতে যামু। আমাগো ইচ্ছা, আপনেও আমাগো লগে যাবেন।
বিনয় অবাক হয়ে কয়েক লহমা তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, আমি যাব! কিন্তু অফিস আছে যে
দুলাল বলল, একটা তত দিন। ছুটি ন্যান (নিন)। ভোর ভোর বাইর অইয়া ফাস্ট ট্রাম ধইরা যামু।
বিনয়ের খেয়াল হল, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা কখনও দেখা হয়নি। অথচ এই খেলা নিয়ে বাঙালি জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। সে যে কী তীব্র উন্মাদনাতার কিছু কিছু আঁচ সে এর মধ্যেই টের পেয়েছে। ভাবল, মাঠে গিয়ে খেলাটা দেখলে হয়। জিজ্ঞেস করল, ফাস্ট ট্রাম ধরতে হবে কেন?
নাইলে টিকিট পাইবেন না। অত ভুরে (ভোরে) গিয়াও দেখবেন, দ্যাড় মাইল লম্বা লাইন পইড়া গ্যাছে।
চকিতে বিনয় ভেবে নিল, ভোরবেলায় বেরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে খেলা দেখে মেসে ফিরতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে যাবে। মাঠে নিশ্চয়ই ভাত টাত পাওয়া যাবে না। কী মিলবে, তার জানা নেই। একরকম না খেয়েই সারাটা দিন কেটে যাবে। এত কষ্ট করার মানে হয় না। পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে রাত্তিরে নতুন ভারত-এর স্পোর্টস সেকশনের রিপোর্টারদের ফোন করলে একখানা কমপ্লিমেন্টারি টিকেটের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দেবে। হারুরা যে প্রক্রিয়ার কথা বলল, এর ফলে এত হাঙ্গামা পোয়াতে হবে না। ধীরে সুস্থে বিকেলের আগে আগে মাঠে গিয়ে আরামে খেলা দেখা যাবে। এ-সব বলায় দুলালরা লাফিয়ে উঠল, না না, হে (সে) হইব না। আমাগো লগেই যাইবেন। ইস্টবেঙ্গলের রিয়াল সাপোর্টার গো মইদ্যে বইয়া ম্যাচ দ্যাখনের এক্সপিরিয়েন্সই ভেন্ন।
ব্যাপারটা মন্দ নয়। বিনয় শুনেছে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড নিয়ে মাঠে গেলে আলাদা বসার ব্যবস্থা আছে। আমজনতার সঙ্গে ঠাসাঠাসি পুঁতোগুতি করতে হয় না। সেখানে প্রচুর স্বাচ্ছন্দ্য কিন্তু অসংখ্য সাধারণ সাপোর্টার কীভাবে খেলা দেখে তা জানতে আগ্রহ হচ্ছে। কষ্ট হবে ঠিকই, তবে নতুন ধরনের একটা অভিজ্ঞতাও তো হবে।
বিনয় বলল, ঠিক আছে, তোমাদের সঙ্গেই যাব।
চিংড়ি এবং ইলিশের রহস্যটাও হারুদের কাছে জেনে নিল সে। ইলিশ হচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের সিম্বল, চিংড়ি মোহনবাগানের।
রাত্তিরে প্রসাদ মেসে ফিরলে তার কাছ থেকে ছুটি চেয়ে নিল।
ভোরে, এখনও হালকা অন্ধকারে চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে, সেই সময় হারুরা এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। দেখা গেল, শুধু ওরা দুজনই নয়, আরও সাত-আটটি ছেলে শান্তিনিবাস-এর সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই মুখ চেনা, নামও জানে বিনয়। ওরাও উদ্বাস্তু এবং ইস্টবেঙ্গলের ঘোর সাপোর্টার।
বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই দিনের প্রথম ট্রামটি এসে গেল। সেটার বুকের কাছে জোরালোলা আলো জ্বলছে।
বিনয়রা উঠে পড়ে। ট্যাং ট্যাং আওয়াজ তুলে পাতলা অন্ধকার ভেদ করে ট্রাম দেড়ি শুরু করে।
এত ভোরেও প্রচুর প্যাসেঞ্জার রয়েছে। কিছু ময়দানের প্রাতঃভ্রমণকারী, কিছু চলেছে গঙ্গাস্নান করতে। বাকিদের একটানা কলর কলর শুনে বোঝা যায়, ওরা যাচ্ছে আজকের ম্যাচের টিকেটের জন্য লাইন দিতে।
পার্ক স্ট্রিটের মুখে এসে বিনয়কে নিয়ে নেমে পড়ল হারুরা। তারপর বাঁ দিকের ময়দানে নেমে কালীঘাট ক্লাব, রাজস্থান ক্লাব, রেঞ্জার্স ক্লাব, ডালহৌসি ক্লাব, রেড রোড পেরিয়ে সবাই যেখানে এসে পড়ল সেখানে অনেকখানি জায়গা প্রায় পনেরো ফিট উঁচু, মজবুত তক্তা পুঁতে ঘিরে রাখা আছে। তক্তার বেষ্টনীর মাথায় রবাবর দুলাইনের তার কাঁটা আটকানো। বোঝাই যায়, কেউ যাতে বে-আইনিভাবে টপকে ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্য ওই এলাকাটা দুর্ভেদ্য করে রাখা হয়েছে।
এদিকটায় কখনও আসা হয় নি বিনয়ের। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দুলাল তক্তার লম্বা পাঁচিলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, এই অইল ক্যালকাটা ক্লাবের ফুটবল গ্রাউন্ড। এইহানেই আইজ ইস্টব্যাঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ।
পাঁচিলের বাইরে ছটা টিকেট কাউন্টার। সেগুলো এখন বন্ধ। দুলালরা বলেছিল, রাত পোহাতে–পোহাতেই দেড় মাইল লম্বা লাইন পড়ে যাবে। অতটা না হলেও প্রতিটি কাউন্টারের সামনে। চার পাঁচ শ জন পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হারু বলল, এইগুলান অইল ছয় আনার টিকটের কাউন্টার। উত্তর দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, দুটো লাইন দেখিয়ে বলে, উইহানে দশ আনা টিকটের কাউন্টার। কুনখানে লাইন দিবেন?
কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল বিনয়, দুলাল বলে ওঠে, ছয় আনার লাইনেই খাড়ামু। শুদাশুদি বিনয়দার বেশি পয়সা খরচা করামু ক্যান? অত নবাবীর দরকার নাই।
সামনের একটা ছআনার লাইনে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে।
রোদ উঠে গিয়েছিল। চৌরঙ্গি, কার্জন পার্ক, ইডেন গার্ডেনের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসতে লাগল। ছআনা, দশ আনা টিকেটের লাইনগুলো প্রতি মিনিটে বিশ হাত পঁচিশ হাত করে লম্বা হচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শোরগোল।
এই সকালবেলাতেই চা-ওলা, মশলামুড়িওলারা এসে হাজির। ভোরে চা খেয়ে আসা হয় নি। একটা চা-ওলাকে ডেকে মাটির ভাঁড়ে চা আর নোনতা বিস্কুট কিনে খেল বিনয়। দুলালদেরও খাওয়াল।
বেলা যত বাড়ে লাইনগুলোর ল্যাজ আরও, আরও দীর্ঘ হয়।
সূর্য আকাশের ঢালু পাড় বেয়ে বেয়ে দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে। রোদের তেজ বেড়েই চলেছে।
চা-ওলা, মশলামুড়িওলারা আগেই এসে গিয়েছিল। এখন ঘুগনিওলা, কাটা ফলওলা, শরবতওলা, ফুচকাওলা আর সস্তা বেকারির পাউরুটি প্যাটিস কেক নিয়ে ফেরিওলারা হানা দিয়েছে।
দুলাল বলল, বিনয়দা, মাঠের ভিতারে ঢুকলে খাওনের (খাবার) কিছু মিলব না। অহনই যা হউক, খাইয়া লওন ভাল।
বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে। ঠিকই বলেছ
পাউরুটি ঘুগনি আর প্যাটিস কেনা হল সবার জন্য। সেই সঙ্গে আরেক দফা চা। সমস্ত খরচই বিনয়ের।
খাওয়াদাওয়া চুকতে না-চুকতেই তুমুল গোলমাল শুরু হয়ে যায়। বাইরে থেকে উটকো কিছু লোক বিনয়দের লাইনের সামনের দিকে ঠেলে পুঁতিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে। শুধু তাদেরই নয়, অন্য লাইনগুলোতেও এভাবে গায়ের জোরে ঢোকার চেষ্টা চলছে। কিন্তু যারা ভোর থেকে দাঁড়িয়ে আছে তারা ছাড়বে কেন? এই নিয়ে হুলস্থুল বেধে যায়। ধস্তাধস্তি, উত্তেজনা, হাতাহাতি, খিস্তিখেউড়। কিন্তু হানাদারদের পুরোপুরি তাড়ানো যায় না। বিনয়রা মোটামুটি তিন শ জনের পেছনে ছিল। এখন অনেকটা পিছিয়ে গেছে। তাদের সামনে আপাতত শ পাঁচেক মানুষ।
এদিকে বাতাস গরম হয়ে উঠেছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল বিনয়ের। বলল, এ-সব কী ব্যাপার, ভদ্রভাবে লাইন না দিয়ে ঢোকার কোনও মানে হয়?
দুলাল বলল, আর কইয়েন না বিনয়দা, ইস্টব্যাঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ থাকলে শয়তানের ছাওরা দেরিতে আইব, উইড়া আইয়া সুখের দিকে জুইড়া বইতে চাইব। যতক্ষণ না মাউন্ট্যাড পুলিশ আইতে আছে, হারামজাদারা এই ঝঞ্ঝাট চালাইয়া যাইব।
সূর্য যখন সোজা মাথার ওপর উঠে এল, সেইসময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘোড়-সওয়ার সার্জেন্টের দল এসে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যারা বে-আইনিভাবে লাইনে ঢুকবার তালে রয়েছে, ঘোড়া দাবড়ে সার্জেন্টরা তাদের ভাগিয়ে দেয়।
সাড়ে বারোটা নাগাদ টিকেট বিক্রি শুরু হল। দুটোর ভেতর মাঠে ঢুকে পড়ল বিনয়রা। তাদের দিকে গ্যালারির সারি সারি কাঠের পাটাতন ওপর থেকে নিচে নেমে গেছে। পাটাতনগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে বা বসে খেলা দেখার ব্যবস্থা। ডাইনে ইডেন গার্ডেনের দিকটায় দশ আনার টিকেটের গ্যালারি। মাঝখানে সবুজ গালিচার মতো খেলার মাঠ। সেটার ওধারে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বারদের বসার বন্দোবস্ত। দক্ষিণে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকটায় তক্তার পাঁচিল, তারকাটা আছে ঠিকই, তবে গ্যালারি নেই। ওটার বাইরে র্যামপার্ট থেকে একটু আধটু খেলা দেখা যায়। যারা, লম্বা লম্বা লাইন দেখে টিকেটের আশা ছেড়ে দিয়েছে, এর মধ্যেই তারা ওখানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। এদের কারও কারও হাতে আয়নাবসানো পেরিস্কাপ। বিনয় এসব কিছুই জানত না, দুলালই বিশদভাবে জানিয়ে দিল।
আড়াইটার ভেতর টিকেট কাউন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মাঠ বোঝাই হয়ে গেছে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদে জামাকাপড় ঘামে ভিজে গেছে। বিনয়ের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, তবে এত মানুষের মধ্যে এসে ভালও লাগছে।
সারা মাঠ জুড়ে হই হই চলছে। আজকের এই খেলা নিয়ে সবাই ভীষণ উত্তেজিত।
বিনয়রা যেখানে বসে আছে তার ঠিক তিন ধাপ নিচে থেকে মাঠজোড়া শোরগোল ছাপিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এল।
কে একজন করাত চালাবার মতো কর্কশ শব্দ করে বলে ওঠে, গত বচ্ছর ঘইটাগো (ঘটিদের) কাছে আমরা দুই গোলে হাইরা গ্যাছিলাম। পুত্রশোকের থিকা বেশি কষ্ট পাইছি। এইবার ওগো ন্যাটে (নেটে) তিনবার বল সান্ধমু (ঢোকাব)।
সঙ্গে সঙ্গে একটু সরু, ক্যানকেনে, ধাতব কণ্ঠস্বর শোনা গেল, পুত্রশোক। তিনবার বল ঢোকাবে। আর আমরা একেনে শুয়ে শুয়ে বুড়ো আঙুল চুষবার জন্যে এয়েচি। তোদের এবার পাঁচ গোল দোবো। শালা বাঙাল
বোঝাই যাচ্ছে, প্রথম গলাটি পদ্মাপারের কোনও আদি বাসিন্দার, দ্বিতীয়টি খাস কলকাত্তাইয়ার। অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চিরকালের সেই মহাসংগ্রাম।
কর্কশ গলা ধমকে ওঠে, চোপ। হালা হালা (শালা শালা) কবি না। হালা ঘটি—
ক্যানকেনে গলা।–তবে কী বলব-ছনুমান?
তরা বান্দর
তোরা শিম্পাঞ্জি।
তরা গাধা
তোরা ছাগল
জীবজন্তুর তালিকা শেষ হবার আগেই মাঠের বাইরে থেকে কাতর চিৎকার শোনা গেল, আমারে তোলেন, আমারে তোলেন
বিনয়রা গ্যালারির ওপর ঝুঁকে পড়ে। একটা লোক বয়স পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ, কালো কুচকুচে, বেজায় মোটা, ওজন দেড় মণের কাছাকাছি, পরনে ময়লা খাটো ধুতির ওপর তালি-মারা হাফ-হাতা পাঞ্জাবি, পায়ে রবারের টায়ার-কাটা স্যান্ডেল-দুহাত তুলে উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে গ্যালারির লোজনদের সমানে বলে যাচ্ছে, দ্যাশ গ্যাছে, ভিটা গ্যাছে, আছে খালি ইস্টব্যাঙ্গল ক্লাবখান। আইজকার (আজকের) খেলা দ্যাখতে না পারলে জীবনই ব্রেথা (বৃথা)। আইছি ধুবুলিয়া কেম্প থিকা। আমারে তোলেন, আমারে তোলেন
বোঝা গেল লোকটা উদ্বাস্তু এবং শুধুমাত্র ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচটি দেখার জন্য ধুবুলিয়ার ত্রাণশিবির থেকে তার ময়দানে আগমন। কিন্তু টিকেট বিক্রি বন্ধ হওয়ায় মাঠের ভেতর ঢোকা তার পক্ষে অসম্ভব।
যতই সে বিলাপের সুরে চেঁচিয়ে যাক, ঘোড়-সওয়ার সার্জেন্টদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে তার দুমণ ওজনের শরীরটাকে কোন প্রক্রিয়ায় মাঠে ঢোকানো যায়, কারও জানা নেই। ভেতরে যারা ঢুকতে পেরেছে, লোকটার প্রতি তাদের বিপুল সহানুভূতি। কিন্তু কারও কিছু করার নেই। করুণ চোখে তারা তাকিয়ে থাকে। করুণার আশায় লোকটা দৌড়েই চলেছে। একদৃষ্টে তাকে লক্ষ করছিল দুলাল। আচমকা সে বলে উঠল, বিনয়দা, এমুন টু হান্ড্রেড পারসেন্ট ইস্টব্যাঙ্গল সাপোর্টাররে মাঠের বাইরে রাখন মহাপাপ। এনার লাখান ফুটবল লাভার খেলা দ্যাখতে না পারলে এই ম্যাচের অর্থ নাই। ওনারে তুইলা আনতেই হইব।
বিনয় অবাক। জিজ্ঞেস করে, কী করে তুলবে?
দ্যাখেন না ক্যামনে তুলি।
দুলাল যে-ছকটা করল তা চমকে দেবার মতো। গ্যালারির একটি লোকের কাছ থেকে তার ছাতা চেয়ে নিয়ে তারকাটার ফাঁক দিয়ে বাঁকানো বেতের হ্যান্ডেলটি নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে অন্য প্রান্তটি দুহাতে ধরে রইল। তার নির্দেশে হারু এবং আরও কয়েকজন পর পর কোমর জাপটে ধরে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ফেলল। এজাতীয় মহৎ কর্মে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী হাত মেলায়। তারাও কোমর ধরে শিল্পটাকে আরও জোরদার করে তোলে। একেবারে শেষে বিপুল শক্তিমান একজন পিলারের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। এই কাজে পদ্মার এপার ওপার একাকার। সেই ক্যানকেনে গলা এবং কর্কশ গলাও জুটে গেছে। বেশ কজন তারকাটা ফাঁক করে ধরে রাখল, যাতে ফোকর গলে ধুবুলিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দাটি ভেতরে চলে আসতে পারে।
ছাতার হ্যান্ডেল নামিয়ে সমানে সেই লোক্টাকে ডাকাডাকি করছিল দুলাল। –তরাতরি ছাতি ধরেন–তরাতরি করেন।
লোকটা এমন আজব কপিকল দেখে প্রথমটা হতভম্ব। তারপর দৌড়ে এসে সেটা ধরে ঝুলে পড়ে। দুলাল সমস্ত শক্তি তার দুহাতে জড়ো করে দাঁতে দাঁত চেপে ছাতাসুদ্ধ নোকটাকে টেনে ওপরে তুলতে থাকে। কিন্তু প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ ঠেকিয়ে ওপরে তোলা কি সহজ ব্যাপার।
বিনয় পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। দুলালের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। গলা আধ হাত লম্বা হয়ে গেছে। হাত যেন ছিঁড়ে পড়বে। যারা পর পর কোমর ধরে রয়েছে তাদের চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে।
মাগনায় এমন একটা সিনেমা দেখার জন্য মাঠের বাইরে এবং গ্যালারির মাথায় বিস্তর দর্শক জমা হয়ে গেছে।
ছাতা টানতে টানতে দুলাল সমানে চেঁচাচ্ছে।
মারি জুয়ান
অন্যরা তার সঙ্গে তাল দিচ্ছে। হাইও।
ড্যানা (হাত) ছিড়া যায়
হাঁইও
কমর (কোমর) ভাইঙ্গা যায়
হাইও
বুক ফাইটা যায়
হাইও—
দুই মণ ওজন
হাইও—
আরও জোরে টান মারো
হাইও
হল্লা-টল্লা শুনে একজন ঘোড়-সওয়ার সার্জেন্টের নজর এসে পড়ে লোকটার ওপর এবং সঙ্গে সঙ্গে সে এদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ঝুলন্ত লোকটা প্রায় পাঁচিলের মাথায় উঠে এসেছে। সে ভয়ে। চিৎকার করে ওঠে, খাইল রে, সার্জেনে আমারে খাইয়া ফালাইল চেঁচাতে চেঁচাতেই সে তারকাটার ফোকরে কোনওক্রমে ডান পা গলিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বাঁ পাটা ঢোকাবার আগেই সার্জেন্ট তার ধুতির কেঁচাটি ধরে ফেলে। লোকটি পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় ভেতরে ঢুকতে পারে ঠিকই, তবে ততক্ষণে বস্ত্রহরণ হয়ে গেছে। এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল কিন্তু তার লেশমাত্র অস্বস্তি নেই। দার্শনিকের মতো মুখ করে ধীরেসুস্থে পাঞ্জাবিটা নিচের দিকে নামিয়ে হাত দুটো কোমরে বেঁধে ফেলে। ওপরে ছেঁড়াখোঁড়া গেঞ্জি, নিচে পাঞ্জাবি।–লোকটা গ্যালারিতে অগুনতি মানুষের মধ্যে নির্বিকার বিরাজ করতে থাকে।
একসময় খেলা শুরু হল।
ফার্স্ট হাফে কোনও দলই গোল করতে পারেনি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। সেকেন্ড হাফের মাঝামাঝি ইস্টবেঙ্গল একটি গোল করল। সঙ্গে সঙ্গে মাঠের আধাআধি একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাকি অর্ধেক উত্তেজনায়, উল্লাসে, পাগলামিতে ফেটে পড়ে। চিৎকার আর থামতেই চায় না। বিনয় লক্ষ করল, তার চারপাশে শয়ে শয়ে পদ্মাপারের মানুষদের ওপর উন্মত্ততা ভর করেছে। কেন এই বেপরোয়া, উদ্দাম খ্যাপামি? এর উত্তরও বিনয়ের জানা আছে। এই সব-খায়ামে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সামনে আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, বেঁচে থাকার নিরুদ্বেগ কোনও পন্থাও তাদের কেউ জানিয়ে দেয় নি। অপার নৈরাশ্যের আঁধারে তলিয়ে যেতে যেতে ইস্টবেঙ্গল নামটা পেয়ে গেছে ওরা। সীমান্তের এপারে পূর্ববঙ্গ-এর একটা টুকরো। এটাকেই আঁকড়ে ধরেছে। প্রাণপণে টিকে থাকতে হলে খুব সম্ভব একটা উন্মাদনা চাই। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছাড়া তাদের আধ-মরা ফুসফুসে তড়িৎপ্রবাহ ঘটানোর মতো আপাতত আর কিছু নেই।