শতধারায় বয়ে যায় (Shotodharay Boye Jai) : 13
৬১.
মেসের ম্যানেজারকে আগেই বলে রাখা হয়েছে, যতদিন ঠাণ্ডা থাকবে বিনয়ের স্নানের জন্য রোজ সকালে যেন গরম জল দেওয়া হয়। অন্য দিনের মতো আজও এক বালতি ফুটন্ত জল তেতলার বাথরুমে রেখে বিনয়ের ঘুম ভাঙিয়ে দিল সুবল।
বিনয় যখন স্নান করতে যায়, প্রসাদের ঘর ছিল বন্ধ। অনেক রাত করে ফেরেন বলে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায় তার।
বাথরুম থেকে ফেরার সময় চোখে পড়ল, এর মধ্যে জেগে গেছেন প্রসাদ। তার ঘরের দরজা খোলা। দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী বস্তির বাচ্চাদের জন্য খুব যত্ন করে পাউরুটি কাটছেন। বিনয়ের। মনে পড়ে যায়, ত্রাণশিবির এবং জবরদখল কলোনিগুলোতে যাওয়া ছাড়াও আসামের উদ্বাস্তুদের দায়িত্বও তাকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে নিত্য দাস এসে পড়বে। তার সঙ্গে বেকবাগানে যাবার কথা আছে। সেখানে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে। আজ হয়তো শিয়ালদায় ছোটা সম্ভব হবে না। সেটা প্রসাদকে জানানো দরকার।
নিজের ঘরে এসে জামাকাপড় পালটে, গায়ে চাদর জড়িয়ে তৈরি হয়ে নিল বিনয়। কাঠের আলমারিতে হেমনাথের চিঠিটা ছিল। সেটা পকেটে পুরে প্রসাদের ঘরে চলে আসে সে।
অন্য দিনের মতো আজও প্রসাদ বলেন, এসে গেছ? গুড। আমাকে একটু হেল্প কর। তারপর গলা উঁচুতে তুলে সুবলকে চা দিয়ে যেতে বললেন।
প্রসাদের সামনের নিচু টেবলটায় কটা আস্ত পাউরুটি পড়ে আছে। একটা টেনে নিয়ে কাটতে থাকে বিনয়। এটা তারও প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে পড়ে গেছে।
রুটি কাটার ফাঁকে বিনয় ভয়ে ভয়ে বলে, প্রসাদদা, আজকের দিনটা আমাকে ছুটি দিতে হবে।
প্রসাদের হাতের ছুরি থেমে যায়। মুখ তুলে বলেন, ছুটি? হঠাৎ?
বিনয় বলল, একটা দরকারি কাজ আছে। তাই
প্রসাদ রীতিমতো বিরক্ত। কপালে কুঞ্চন দেখা দিয়েছে। বেশ ঝাঝালো গলায় বললেন, কত কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্প কভার করা হয়নি। তার ওপর আসামের উদ্বাস্তুরা আছে। এর মধ্যে তুমি কি না ছুটি চাইছ! স্ট্রেঞ্জ
প্রসাদের একটা চেহারাই এতদিন দেখে এসেছে বিনয়। শান্ত, উত্তেজনাশূন্য, স্নেহপ্রবণ। কিন্তু এই প্রথম টের পাওয়া গেল, কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। সেখানে লেশমাত্র শিথিলতা প্রশ্রয় দেন না। মুখ চুন করে বসে থাকে বিনয়।
কী ভেবে এবার একটু নরম হলেন প্রসাদ। খেয়াল হল, বিনয় কঁকিবাজ নয়। অফিসে জয়েন করার পর থেকে একটা দিনও কামাই করেনি। খেটে চলেছে অবিশ্রাম। যে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে, নীরবে এবং নিপুণভাবে তা করে যাচ্ছে। তার প্রতিবেদনগুলোর জন্য নতুন ভারত-এর সুনাম হয়েছে যথেষ্ট। কাজের ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহ ছেলেটার। গলার স্বর নামিয়ে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে ছুটি চাইছ?
পকেট থেকে হেমনাথের চিঠিটা বার করে প্রসাদকে দিতে দিতে বিনয় বলল, পড়ে দেখুন
একটু অবাক হলেন প্রসা। তারপর দ্রুত চিঠির ভাঁজ খুলে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে বিনয়ের দিকে তাকালেন। তার মুখচোখের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। খুবই চিন্তাগ্রস্ত, ভীষণ উদ্বিগ্ন। বললেন, এ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার
বিনয় বলল, আমি এখন শাজাহান সাহেবের কাছে যেতে চাই। সেই জন্যেই
তার কথার মধ্যেই প্রসাদ বলে ওঠেন, নিশ্চয়ই যাবে। যেভাবে হোক, এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে ফেল–
সুবল চা নিয়ে এল। সেটা শেষ হতে না-হতেই নিত্য দাস এসে যায়। তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বিনয়।
রসা রোডে এসে বাস ধরে সার্কুলার রোডের মোড়। সেখান থেকে অন্য একটা বাসে বেকবাগান।
আগে কখনও কলকাতার এই দিকটায় আসেনি বিনয়। শান্ত, নিরিবিলি এলাকা। বিরাট বিরাট কমপাউন্ডের ভেতর সেকেলে ধাঁচের দোতলা, তেতলা বাড়ি। একটা বড় সবুজ রঙের তেতলা বাড়ির সামনে বিনয়কে নিয়ে এল নিত্য দাস। সেটার কার্নিসে, দেওয়ালে নানা ধরনের কারুকাজ।
বিনয় লক্ষ করে, বাড়িটার একতলা থেকে তেতলা পর্যন্ত সবগুলো ঘরের জানালা ছোট ছোট। প্রতিটিতে দুটো করে পাল্লা। একটা কাঠেব, অন্যটা রঙিন কাঁচের। বাইরের দিকের বগুলো দরজা জানালাতেই মোটা পর্দা ঝুলছে। লহমায় টের পাওয়া যায়, পুরনোপন্থী বনেদি মুসলমানদের বাড়ি। পড়ার অন্য বাড়িগুলোও এক ধাঁচের।
রাস্তার ঠিক ওপরেই লোহার নিচু গেট। দারোয়ানটি মাঝবয়সী মুসলমান। নিত্য দাসকে দেখে এক মুখ হেসে বলল, আদাব দাসবাবু, অনেক রোজ বাদে এলেন
হ্যাঁ। নমস্কার জানিয়ে নিত্য দাস বলে, নানা কামে আটকাইয়া গ্যাছিলাম। তা শাজাহান সাহেব কি এইহানে আছেন, না তেনার হাওড়ার বাড়িত?
এখানেই আছেন। পরশু বিকেলে এসেছেন—
যাউক, নিশ্চিন্ত হইলাম। নাইলে হেই আন্দুলে দৌড়াতেই হইত। তা সাহেবরে এটু খবর দ্যান, তেনার লগে দেখা করুম
বিনয় বুঝতে পারছিল, এ-বাড়িতে যাতায়াতের কারণে নিত্য দাসের সঙ্গে দারোয়ানটার ভালই আলাপ-পরিচয় আছে।
দারোয়ান বলল, আসুন
ভেতরে একটা মস্ত বাঁধানো চাতাল ঘিরে চারদিকে সারি সারি ঘর। একতলা, দোতলা এবং তেতলার নকশা একই রকম। ঘরের গায়ে ঘর। এখানে পর্দার ভীষণ কড়াকড়ি। লোকজন কারওকেই দেখা যাচ্ছে না। তবে পুরুষ এবং মেয়েদের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
দারোয়ান একতলারই একটা মস্ত ঘরে নিয়ে এল বিনয়দের। ঘরটার দেওয়ালে এবং সিলিংয়ে কত রকমের যে নকশা। মেঝেতে কার্পেটের ওপর ভারী ভারী সোফা।
আপনারা বসুন। আমি সাহেবকে জানাচ্ছি– বলে দারোয়ান চলে গেল।
মিনিট দশেক পর যিনি ঘরে এসে ঢুকলেন তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। লম্বা চওড়া, সম্ভ্রান্ত চেহারা। ফর্সা রং। মাথায় প্রচুর কাঁচাপাকা চুল। নিখুঁত কামানো মুখ! পরনে দামি লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবির ওপর পাতলা শাল।
নমস্কার শাজাহান সাহেব বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় নিত্য দাস। দেখাদেখি বিনয়ও।
হাত তুলে আদাব জানান শাহান সাহেব। বলেন, বসুন বসুন সবাই বসলে নিত্য দাসকে বললেন, সেই বলে গেলেন, দিন সাতেকের ভেতর আসছেন। এলেন তিন সপ্তাহ পর।
সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নিত্য দাস জানায়, যার বিষয় আশয় সেই হেমনাথ থাকেন পাকিস্তানে। বর্ডারের ওপারের চিঠি কবে আসবে তার কোনও ঠিক নেই। তিন দিনে যেটা আসার কথা সেটা এল হয়তো পনেরো দিন বাদে। আশায় আশায় থাকার পর কালই হেমনাথের জবাব এসেছে। সেটা পেয়েই আজ ছুটে এসেছে সে। হেমনাথ যে এতকাল দেশ ছেড়ে না আসার জন্য জেদ ধরে। বসেছিলেন, সেটা আর জানায় না।
নিত্য দাস প্রবল উৎসাহের সুরে বলতে লাগল, আমাগো ইচ্ছা, দিন দশ-পনরোর ভিতরে শুভ কামটা সাইরা ফালাই,
একটু চুপ করে থাকেন শাজাহান সাহেব। তারপর বলেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। নিমেষে শ্বাসক্রিয়া যেন বন্ধ হয়ে যায় বিনয়ের। নিত্য দাসের পাশ থেকে সে রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?
এতক্ষণে যেন ভাল করে বিনয়কে লক্ষ করেন শাজাহান সাহেব। গোড়ার দিকে হয়তো ভেবেছিলেন, নিত্য দাসের সঙ্গী মাত্র। বললেন, এঁকে তো চিনতে পারলাম না।
উত্তরটা দিল নিত্য দাস, এনাগোই তো সোম্পত্তি। এনি হ্যামকত্তার নাতি। বিনয়ের নামটামও জানিয়ে দেয় সে।
শাজাহান সাহেব বিনয়কে বললেন, আপনারা বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। দাসবাবুর অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত গেল শুক্রবার অন্য একজনের সঙ্গে এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
বিনয়ের মনে হয়, এই সাজানো গোছানো বসার ঘরটা দুলতে শুরু করেছে। আর চোখের সামনের সমস্ত কিছু দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
শাজাহান সাহেব বিশদভাবে জানালেন, সম্পত্তি বিনিময়ের ব্যাপারে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। নিত্য দাসের ওপর পুরোপুরি ভরসা ছিল তাঁর। হেমনাথের যে বিষয় আশয়ের বিবরণ। তার কাছে শুনেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক তেমনটিই তিনি চান। কিন্তু হঠাৎ নিত্য যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়ায় তার দুশ্চিন্তা ভীষণ বেড়ে যায়। ছোট সম্পত্তির বিনিময় চট করে হতে পারে কিন্তু বড় বড় প্রপার্টির খদ্দের পাওয়া মুশকিল। তার দেড় শ বিঘে তেফসলা জমি, হাওড়ায় দু-মহল পাকা দালান, মোটরগাড়ি, এ-সবের বদলে তো পাঁচ-দশ বিঘের জমি-টমি নেওয়া যায় না।
নিত্য হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন শাজাহান সাহেব। কী করতেন, কে জানে। হয়তো যেমন তেমন একটা প্রপার্টির সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে সীমান্তের ওপারে চলে যেতেন। কিন্তু আকস্মিকভাবেই সমস্যাটার সুরাহা হয়ে গেল।
নিত্য দাসের মতো কত যে টাউট এক্সচেঞ্জের কারবারে নেমে পড়েছে তার লেখাজোখা নেই। তাদেরই একজন হল অধীর শীল। সপ্তাহখানেক আগে একটা সুখবর নিয়ে শাজাহান সাহেবের কাছে সে এসে হাজির। জানালেন, গোপাল মজুমদার নামে এক ভদ্রলোক ইন্ডিয়ায় চলে আসার জন্য পা বাড়িয়ে আছেন। মুন্সিগঞ্জ টাউনে তাদের বাড়ি। টাউনের কাছাকাছি গ্রামের দিকে আশি বিঘের মতো জমি আছে। তবে মোটর নেই। অবশ্য নৌকো রয়েছে অজস্র-শখানেকের মতো। শাজাহান সাহেবের দেড় শ বিঘের বদলে গোপাল মজুমদারের আশি বিঘে জমিটা অবশ্য কম হয়ে গেল। মোটরের বদলে নৌকো। কিন্তু কী আর করা যায়? এটা হাতছাড়া হয়ে গেলে পস্তাতে হবে। এখন আশি বিঘে পাওয়া যাচ্ছে। আরও দেরি হলে বিশ পঞ্চাশও জুটবে কি না সন্দেহ। অগত্যা শাজাহান সাহেবকে দালাল অধীর শীলের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছে।
নীরবে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। আস্তে আস্তে শ্বাস টেনে বলল, আপনাদের এক্সচেঞ্জটা কি হয়ে গেছে?
শাজাহান সাহেব জানালেন, বিনিময় এখনও হয়নি। দলিলপত্র নিয়ে বর্ডার দিয়ে আসার প্রচণ্ড অসুবিধা। তাই তিনি নিজের একজন বিশ্বাসী লোককে মুন্সিগঞ্জে পাঠাবেন। গোপাল মজুমদার স্ট্যাম্প কাগজে তার নামে দানপত্র লিখে লোকটির হাতে দেবে। গোপালের বিশ্বাসী লোকও শাজাহান সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করে একই ভাবে দানপত্র লিখিয়ে নেবে। সমস্ত প্রক্রিয়াটি এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে।
বিনয় কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিত্য দাস বলে ওঠে, আমার একহান কথা রাখবেন?
বলুন-শাজাহান সাহেব উৎসুক চোখে নিত্যর দিকে তাকান।
সুযুগ যহন আছে তহন হুদাহুদি (শুধু শুধু) বিশ বিঘা জমিন কম নিবেন ক্যান? অতখানি জাগা (জায়গা) কি মুখের কথা। গোপাল মজুমদাররে না কইরা দ্যান। হামকত্তার লগেই এঞ্জেটা করেন।
এখন আর তা হয় না।
ক্যান?
আমি সব জেনেশুনেই কম জমিতে রাজি হয়েছি। কথাও দেওয়া হয়ে গেছে। ভদ্রলোক কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এখন তাঁকে নেওভাবেই না বলা যায় না। অসম্ভব।
বিনয় বুঝতে পারছিল, শাজাহান সাহেব এক কথার মানুষ। তার জবানের এদিক সেদিক হবে না। তিনি যে অনড় হয়ে আছেন, এতে তাঁদের ক্ষতি হল কিন্তু মানুষটির প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
নিত্য দাস হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। বলল, আমি পরের হপ্তায় একবার আপনার লগে দ্যাখা করুম। যদিন মজুমদার মশয়ের লগে কামটা কুনো কারণে না হয়
তাকে থামিয়ে দিয়ে শাজাহান সাহেব বললেন, ঠিক আছে আসবেন। একান্তই যদি না হয়, তখন আপনাদের কথা ভেবে দেখা যাবে।
এরপর আর বসে থাকার মানে হয় না। শাজাহান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিনয়রা।
৬২.
রাস্তায় এসে নীরবে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকে দুজনে।
একসময় নিত্য দাস বলে, বড় আশা নিয়া আইছিলাম ছুটোবাবু। এক্কেরে নৈরাশ অইতে অইল-
মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছিল বিনয়ের। হেমনাথের বিষয় সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে কীভাবে তাদের কলকাতায় নিয়ে আসা যায়, সেই চিন্তাটাই তাকে প্রচণ্ড উতলা করে তুলেছে। সে বলল, এখন উপায়?
তক্ষুনি উত্তর দিল না নিত্য দাস। বি: প্রশ্নটা খুব সম্ভব তাকেও যথেষ্ট বিচলিত করে তুলেছে।
বিনয় এবার জিজ্ঞেস করে, আপনি তো বলেন, ইণ্ডিয়া থেকে অনেক মুসলিম পাকিস্তানে চলে যেতে চাইছে। বড় প্রপার্টি আছে, শাজাহান সাহেব ছাড়া আপনার হাতে এমন আর কোনও খদ্দের নেই?
এটাই ভাবছিল নিত্য দাস।না বলতে গিয়ে হঠাৎ সে যেন একটা আলোর রেখা দেখতে পায়। উত্তেজনায় কপালে চাপড় মেরে বলে ওঠে, মাথাটা আমার এক্কেরে গ্যাছে। বস (বয়স) হইছে তো, ছোত কইরা (দ্রুত) হগল মনে পড়ে না। গ্যাল (গত) মাসে মনসুর হোসেন বইলা একজন আমারে কইছিল এচ্চেঞ্জ কইরা পাকিস্থানে যাইতে চায়। বজবজে তেনাগো ম্যালা জমিন আর বড় দালান কোঠা আছে। তেনার কথা পুরা ভুইলাই গ্যাছিলাম।
বজবজ নামটা বিনয়ের জানা। জায়গাটা কোন অঞ্চলে সে সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণাও আছে। শাজাহান সাহেবের হুগলির প্রপার্টির চেয়ে এটা কলকাতার অনেক কাছাকাছি। সব আশা যখন ধসে পড়েছে সেই সময় মনসুর হোসেনের খবরটা বিনয়কে ফের চাঙ্গা করে তোলে। প্রবল উৎসাহের সুরে সে বলে, হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করা দরকার।
নিত্য দাস বলল, হে তো করতেই অইব। কাইল কি পরশু বিহানে (সকালে) উইঠা তেনার বাড়ি চইলা যামু।
বিনয়ের তর সইছিল না। সে বলতে লাগল, না না, কাল-পরশু নয়। এখনই চলুন। দেরি করলে তিনি আবার অন্য কারও সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে ফেলতে পারেন।
নিত্য দাস বেশ অবাক হল, আপনেও বজবজ যাইতে চান নিকি?
নিশ্চয়ই। শুনেছি শিয়ালদা থেকে ট্রেনে বজবজে যাওয়া যায়
হ।
চলুন, রাস্তার ওধারে গিয়ে শিয়ালদার বাস ধরি।
বিনয়ের কেন এত তাড়া, তা না বোঝার কারণ নেই। নিত্য দাস একটু চিন্তা করে বলে, ছুটোবাবু, মনসুর হুসেন যে এচ্চেঞ্জের কথা কইছিল হের পর মাসখানেক পার হইয়া গ্যাছে। এইর ভিতরে তেনার সোম্পত্তি আছে, না কারোর লগে এচ্চেঞ্জ কইরা ফেলাইছে, জানি না। এক কাম করা যাউক-
কী?
আমি একা বরম (বরং) বজবজ গিয়া খবর লইয়া আহি। যদিন দেখি বাড়ি-জমিন অহনও আছে, দুই-এক দিনের ভিতরে আপনেরে হেইহানে নিয়া যামু, কি মনসুর হুসেনরে কইলকাতায় আইনা আপনের লগে দেখা করাইয়া দিমু।
নিত্য দাসের কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ মনে হল। খোঁজখবর নেবার পর মনসুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা ভাল। পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে নিত্যকে দিয়ে হাত-ঘড়িটা দেখে বলল, এখন দশটা বেজে সতেরো। বজবজ থেকে কখন ফিরতে পারবেন?
মনে মনে সময়ের হিসেব করে নিত্য দাস বলে, যাওনে-আহনে (যাওয়া-আসায়) ঘণ্টা দুই-আড়াই। বজবজ টাউনের গায়েই ইস্টিশান। টেরেন থিকা নাইমা মিনিট পাঁচেক হাটলেই গুলাম হুসেনের দালান। তেনার লগে কথা কইতে কতক্ষণ আর লাগব? খুব বেশি অইলে আধা ঘন্টা। দুফার দ্যাড়টা-দুইটার ভিতরে ফিরা আইতে পারুম। তয় (তবে) একহান কথা–
কী?
বজবজে গিয়া যদিন তেনার লগে দ্যাখা হয়, ঠিক আছে। নাইলে দেরি অইব।
বিনয় জোর দিয়ে বলল, যত দেরিই হোক, মনসুর হোসেনের সঙ্গে দেখা না করে ফিরবেন না।
নিত্য দাস ঘাড় কাত করে আইচ্ছা—
ফিরে এসেই আমার স দেখা করবেন।
কই দ্যাখ্যা করুম? আপনর ম্যাসে (মেসে)?
জবাব দিতে গিয়ে থমকে যায় বিনয়। কাল রাতে হেমনাথের চিঠিটা পড়ার পর থেকে তার সব কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তখন তার একমাত্র চিন্তা, শাজাহান সাহেবের সঙ্গে দেখা করে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জের বন্দোবস্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেমনাথকে পাকিস্তান থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা। সেটাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য, অথচ এ নিয়ে সুধা সুনীতি আনন্দ এবং হিরণের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। কিন্তু কাল রাতে এতটাই ক্লান্ত ছিল যে যাওয়া হয় নি। আজ তাকে যেতেই হবে।
এই যে বিনয় নিত্য দাসকে বজবজে পাঠাচ্ছে, সে কী খবর নিয়ে আসবে, জানা নেই। যদি শোনা যায়, মনসুর হোসেনের সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে তখন কী করবে সে?
বিনয় ভাবল, সুধাদের সঙ্গে কথা বলে হেমনাথ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার একা কিছু করা সঙ্গত নয়।
আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছে বিনয়। অফিসে যেতে হবে না। সে স্থির করে ফেলল, এখন মেসে না গিয়ে সুধাদের বাড়ি চলে যাবে। পরমুহূর্তে খেয়াল হল, সেখানে গেলে হিরণের সঙ্গে দেখা হবে না। এতক্ষণে সে অফিসে চলে গেছে। তাছাড়া, শুধু সুধাদের সঙ্গে কথা বললেই চলবে না, আনন্দ এবং সুনীতিকেও চাই। অল্প সময়ের মধ্যে এতজনকে জড়ো করা মুশকিল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিনয় ঠিক করল, আপাতত সে হিরণের অফিসে যাবে। তাকে সব জানালে, নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা সে করে ফেলবে। হেমমলিনী যতদিন বেঁচে আছেন, বিনয় আনন্দদের বাড়ি যাবে না। তার ইচ্ছা, সুধাদের বাড়িতে কথাবার্তা হোক। কিন্তু অন্য একটা সমস্যা আছে। ধরা যাক, হিরণ আনন্দকে তার অফিসে ফোন করল। আনন্দ তাদের বাড়ি গিয়ে কখন সুনীতিকে নিয়ে জাফর শা রোডে আসতে পারবে, কে জানে। তাই খানিকটা সময় হাতে রেখে বিনয় নিত্য দাসকে বলল, আপনি বিকেলে চারটে-পাঁচটা নাগাদ টালিগঞ্জে ছোটদির বাড়ি চলে আসবেন। আমি ওখানে থাকব।
আইচ্ছা–
নিত্য দাস রাস্তা পেরিয়ে ওধারে চলে গেল। ওখানে পাঁচ-সাত মিনিট পর পরই শিয়ালদার বাস আসে। বিনয় এপাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে চৌরঙ্গির বাস ধরবে। চৌরঙ্গিতে নেমে ধর্মতলা রুটের ট্রাম বা বাসে লিণ্ডসে স্ট্রিটের মোড়। সেখান থেকে খানিকটা হাঁটলেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে হিরণের অফিস।
হিরণদের অফিসে আগে আর কখনও আসেনি বিনয়। তবে জায়গাটা যে হগ সাহেবের বাজারের পেছন দিকে সে-সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল।
ব্রিটিশ আমলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই এলাকায় লম্বা লম্বা বিরাট আকারের শেড বানানো হয়েছিল। সেগুলো অবিকল তেমনই রয়েছে। তাছাড়া একতলা দোতলা কটা বাড়িও তৈরি হয়েছে। এখানেই ফুড ডিপার্টমেন্টের অফিস।
সোয়া এগারোটা নাগাদ সেখানে পৌঁছে যায় বিনয়। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে হিরণকে পেয়েও গেল। একটা একতলা বিল্ডিংয়ের একখানা মাঝারি মাপের ঘরে বসে হিরণ। ঘরটা পুরানোনা ধাঁচের চেয়ার টেবল আর মস্ত মস্ত দুটো কাঠের আলমারি দিয়ে মোটামুটি সাজানো।
বিনয় এসময় তার অফিসে, আসবে ভাবতে পারেনি হিরণ। সেই যে সুধা আর সে শান্তিনিবাস-এ বিনয়কে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল তারপর এই দেখা হল।
কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থাকে হিরণ। তারপর ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বোসো, বোসো। রোজই সুধা আর আমি ভাবি তোমার মেসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসব। কিন্তু খান মঞ্জিল মেরামতির তদারক করা আর অফিসের কাজের প্রেসারে একদম সময় করে উঠতে পারিনি। ভেবেছিলাম আসছে রবিবার বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় সে। টেবলের ওপর দিয়ে অনেকখানি ঝুঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয়কে লক্ষ করে। একসময় চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? এনি প্রবলেম?
সামনে আয়না টাঙানো নেই যে নিজেকে দেখা যাবে। তবে হিরণের প্রশ্ন শুনে বিনয় আন্দাজ করে নিল, নিশ্চয়ই তার চোখেমুখে তীব্র উৎকণ্ঠা ফুটে বেরিয়েছে। হেমনাথের চিঠিটা সঙ্গেই রয়েছে। নিঃশব্দে পকেট থেকে সেটা বার করে হিরণকে দিল।
চিঠিটা পড়ার পর রুদ্ধশ্বাসে হিরণ বলে, সর্বনাশ। হেমদাদুর তো মহা বিপদ। তুমি কি শাজাহান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছ?
বিনয় বলল, নিত্য দাস সকালে আমাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই সোজা আপনার অফিসে আসছি।
শাজাহান সাহেব কী বললেন?
শাজাহানের সঙ্গে যা-যা কথা হয়েছে, সব বলে গেল বিনয়। এমনকি এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে নিত্য দাসকে যে বজবজে পাঠিয়েছে এবং সে বিকেলে খবর টবর নিয়ে টালিগঞ্জে হিরণদের বাড়ি আসবে, তাও জানিয়ে দিল।
হিরণ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না।
কোন উদ্দেশ্যে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ছুটে এসেছে, এবার তা জানায় বিনয়। তারপর বলে, আপনি আনন্দদাকে একটা ফোন করে বলুন, বড়দিকে নিয়ে বিকেলে যেন আপনাদের বাড়ি চলে আসে। নিত্য দাস যদি ভাল খবর না আনে, সবাই মিলে কিছু একটা ঠিক করব। দাদুর মতো মানুষ যখন ভয় পেয়েছেন, তাঁকে আর রাজদিয়ায় ফেলে রাখা যাবে না।
হিরণ টেবল থেকে ফোন তুলে এক্সচেঞ্জকে আনন্দর অফিসে লাইন দিতে বলল। একটু পর তাকে পেয়েও গেল।
টেলিফোনটা বেশ জোরালো। টেবলের এধারে বসে দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছে বিনয়।
আনন্দ বলল, কী হল, হঠাৎ ফোন করলে?
হিরণ বলল, রাজদিয়া থেকে হেমদাদুর চিঠি এসেছে। আগে সেটা শুনুন- হেমনাথের চিঠিটা পুরো পড়ে গেল সে।
সব শোনার পর আতঙ্কগ্রস্তের মতো আনন্দ বলে ওঠে, এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
হ্যাঁ। আপনি দিদিকে নিয়ে বিকেলে আমাদের বাড়ি চলে আসবেন। কী কারণে আসা দরকার তা বুঝিয়ে দিল হিরণ।
হা হা, নিশ্চয়ই যাব।
ফোন নামিয়ে রাখার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর হঠাৎ যেন খেয়াল হয়েছে, এমনভাবে হিরণ বলে, সকালবেলা বেরিয়েছ। নিশ্চয়ই খাওয়া টাওয়া হয়নি। চল, কাছেই একটা ভাল হোটেল আছে। তোমাকে খাইয়ে আনি
বিনয় বলল, না না, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
হিরণ আপত্তিটা কানে তুলল না। একরকম জোর করে বিনয়কে টেনে নিয়ে খাইয়ে আনল।
বিকেলে টালিগঞ্জে এসে বিনয়রা দেখল, এর মধ্যে আনন্দ এবং সুনীতি পৌঁছে গেছে। দোতলার বসার ঘরে তাদের মুখোমুখি বসে আছে সুধা আর দ্বারিক দত্ত। বিনয়রাও সেখানেই বসে পড়ল।
বিনয় যে তাদের বাড়ি যায় না, সে জন্য ভীষণ দুঃখ সুনীতির, প্রচুর অভিমান। কিন্তু এ-সব নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না সে। মেসে কীভাবে বিনয়ের দিন কাটছে, সে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে কি না, শরীরের ওপর কতটা যত্ন নিচ্ছে এ-সব নিয়ে কিছুই জানতে চাইল না সুধা।
আজ আলোচনার বিষয় একজনই। সকলের দুশ্চিন্তা এবং উৎকণ্ঠার কেন্দ্রে একমাত্র হেমনাথ।
সন্ধে যখন নামতে শুরু করেছে, কুয়াশায় এবং আঁধারে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মহানগর, সেইসময় বাইরে থেকে নিত্য দাসের ডাক শোনা গেল, ছুটোবাবু-ছুটোবাবু
এ-বাড়িতে এসে কেউ নিচে থেকে ডাকাডাকি করলে উমা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু আজ সে যাবার আগেই বসার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বিনয়। নিত্য দাসের জন্য তারা সেই বিকেল থেকে প্রায় রুদ্ধশাসে অপেক্ষা করছে। সবাই জানে লোকটা ভীষণ ধূর্ত, ধড়িবাজ। কিন্তু হেমনাথের ভবিষ্যৎ রয়েছে তার মুঠোয়। যতই তাকে অপছন্দ করুক, নিত্যই এই মুহূর্তে ত্রাণকর্তা।
একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে একতলায় এসে দরজা খুলে দেয় বিনয়। তার মধ্যে এখন কত রকমের যে অনুভূতি চলছে! আশা, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা, কাঁপুনি। একটার সঙ্গে আর-একটা লেপটে আছে। ব্যগ্র গলায় সে জিজ্ঞেস করে, কাজ হল?
নিত্য দাস বলে, আগে ভিতরে চলেন। হগল কমু
বিনয় লজ্জা পায়। নিজের চিন্তাতেই সে ডুবে আছে। একটা লোক তাদের জন্য যে সেই সকাল থেকে ছোটাছুটি করছে তার কষ্টের কথা খেয়ালই নেই। সৌজন্য বোধটাই তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বিব্রতভাবে বলল, আসুন, আসুন–
নিত্য দাসকে নিয়ে দোতলায় উঠে আসে বিনয়। তাকে একটা লোক চেয়ারে বসতে বলে নিজেও বসে পড়ে। লক্ষ করে, ঘরের বাকি সবার চোখ নিত্যর ওপর স্থির হয়ে আছে। প্রত্যেকেই ভীষণ উদগ্রীব।
নিত্য আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।–না, অইল না। অ্যাতখানি পথ যাওন-আহনই সার। তার, চোখমুখে, গলার স্বরে নৈরাশ্য ফুটে বেরোয়।
কেউ কোনও প্রশ্ন করে না। বজবজ থেকে নিত্য দাস যে খালি হাতে ফিরে এসেছে তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর নিত্য সবিস্তার তার অভিযানের বিবরণ দিয়ে গেল। বেকবাগান থেকে শিয়ালদায় যেতেই বজবজের ট্রেন পেয়ে গিয়েছিল। মনসুর হোসেনের বাড়িতে সাড়ে এগারোটায় পৌঁছেও যায়, কিন্তু তিনি ছিলেন না। শোনা গেল, পারিবারিক কাজে সকালে বেরিয়ে গেছেন। অগত্যা তার জন্য বসে থাকা ছাড়া গতি ছিল না।
মনসুর হোসেন ফিরলেন দেড়টা নাগাদ। নিত্য দাসের আশঙ্কা ছিল, পুরো একটি মাস যোগাযোগ নেই। এর মধ্যে জমিজমা এচ্চেঞ্জ হয়ে গেছে কি না। কিন্তু মনসুর হোসেন একেবারে ভিন্ন সুর। ধরলেন। তিনি ইন্ডিয়াতেই থেকে যাবেন।
নিত্য দাস হতবাক। মাসখানেক আগে যখন মনসুর হোসেনের সঙ্গে তার কথা হয় তখন তিনি ভীষণ এস্ত। আতঙ্কে কাঁপছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্ডিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে চান। নিত্য যেন রাতারাতি খদ্দের জোগাড় করে তার সম্পত্তির বিনিময় বা বিক্রির বন্দোবস্ত করে দেয়।
সেই বিপন্ন, ভয়ার্ত মানুষটি আজ আদ্যোপান্ত অন্যরকম। পরম নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছিল তাকে। চিন্তাভাবনা বা আতঙ্কের লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই।
সিদ্ধান্ত বদল করে হঠাৎ কেন মনসুর হোসেন ইন্ডিয়াতেই থেকে যেতে চাইছেন, কথায় কথায় তাও জানালেন। পাকিস্তানে যে ধরনের মারাত্মক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, বিষবাষ্পে ছেয়ে গেছে আবহাওয়া, এখানে বিশেষ করে বজবজ অঞ্চলে তার শত ভাগের এক ভাগও তেমনটা হয়নি। চাপা উত্তেজনা কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সশস্ত্র হানগরেরা দল বেঁধে তাঁদের ওপর হামলা চালায়নি। ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে যাবার জন্য কেউ হুমকিও দেয়নি।
তা ছাড়া বজবজ এবং আশেপাশের গ্রামগুলোতে রয়েছে অনেক মুসলমান। রয়েছে মনসুর হোসেনের প্রচুর আত্মীয় পরিজন। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগই থেকে গেছে পিতৃভূমিতেই। তারা বদ্ধপরিকর নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। এরা তো বটেই, অনেক হিন্দু যারা পুরুষানুক্রমে পাশাপাশি বাস করে আসছে তারাও বুঝিয়েছে। মনসুর হোসেনরা যেন চলে না যান। পাকিস্তানে যখন যাওয়াই হচ্ছে না, সম্পত্তি বিনিময়ের প্রশ্নই নেই।
নিত্য দাস বলতে লাগল, জবর আশা লইয়া বজবজ লৌড়াইছিলাম (দৌড়েছিলাম)। কামের কাম কিছুই অইল না।
শাজাহান সাহেবের বিষয় আশয় হাতছাড়া হল। আর মনসুর হোসেন ইন্ডিয়াতেই থেকে যাবেন। পর পর দুদুটো ব্যর্থতা। কিন্তু হতাশায় ডুবে থাকলে তো চলবে না। হেমনাথকে কলকাতায় নিয়ে আসার একটা উপায় বার করতেই হবে। এবং সেটা আজই। বিনয় নিত্য দাসকে দেখিয়ে সুধাদের বলে, এর হাতে এই মুহূর্তে আর কোনও বড় খদ্দের নেই। তা হলে কী করা যায়?
নিত্য দাস বলে ওঠে, আমারে দিন পনরো সোময় দ্যান। ম্যালা সোম্পত্তি আছে, এমুন কেও পাকিস্থানে চইলা যাইতে চায় কি না, খোঁজখবর কইরা দেখি–
বিনয় বলল, দাদু কী লিখেছেন, আপনি তো জানেন। অত সময় কোনওভাবেই দেওয়া যাবে না।
আনন্দ এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। এবার বলল, আমি একটা কথা বলছি। তোমরা ভেবে দেখ, সেটা সম্ভব কি না–
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবাই আনন্দর দিকে তাকায়।
আনন্দ বলতে থাকে, কবে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ হবে, সেই আশায় রাজদিয়ায় বসে না থেকে দাদু। দুই দিদাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসুন
দ্বারিক দত্ত সায় দিয়ে বললেন, এটা তুমি ঠিক বলেছ। মাথার ওপর এত বড় বিপদ। ওদের আর দেশের বাড়িতে পড়ে থাকা উচিত নয়। সম্পত্তির চেয়ে প্রাণের দাম অনেক বেশি।
বিনয় বলল, কিন্তু
কী?
দাদু চলে না হয় এলেন। কিন্তু রাজদিয়ার বাড়ি আর জমিজমার কী ব্যবস্থা হবে?
হেমদাদা তো লিখেছে, করিম তাদের বাড়িতে থেকে পাহারা দিচ্ছে। মোতাহার আর সৈয়দ বাড়ি মৃধাবাড়ির ছেলেরা রোজ এসে দেখাশোনা করে যায়। ওদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে আসবে। দ্বারিক দত্ত বলতে লাগলেন, জগতে করিম কি মোতাহারদের মতো সৎ মানুষ হয় না। প্রাণ দিয়ে ওরা হেমদাদার প্রপার্টি রক্ষা করবে।
বিনয় জানিয়ে দিল, এই ব্যাপারে দ্বারিক দত্তর সঙ্গে সে সম্পূর্ণ একমত। করিমদের মোতাহারদের সেই কবে থেকে দেখে আসছে। বিশ্বাসভঙ্গ তারা কখনও করবে না।
দ্বারিক দত্ত বললেন, পরে পাকিস্তানের পরিস্থিতি বদলে গেলে রাজদিয়ায় ফিরে হোমদাদা বিষয় আশয়ের ব্যবস্থা করবে।
পাকিস্তানের পরিস্থিতির আদৌ পরিবর্তন হবে কি না, হলে কবে হবে, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে বিনয়ের। কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে, হিন্দুদের ছেড়ে আসা যাবতীয় জমিজমা বাড়িঘর পাকিস্তান সরকার শত্রু-সম্পত্তি বলে ঘোষণা করবে। তা হলে তো সবই গেল। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য না করে সে বলে, ঠিক আছে, করিমদের হাতেই না হয় প্রপার্টি দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব দিয়ে এলেন, কিন্তু কলকাতায় এসে উঠবেন কোথায়?
সুধা গলার স্বর চড়িয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দেয়, কোথায় উঠবে মানে? আমরা কি মরে গেছি? লোকের আত্মীয়স্বজন থাকে কী করতে? একদমে সে বলে যায়, এক্সচেঞ্জ করে আমরা অত বড় তিনতলা বাড়ি পেয়েছি। সেখানে কতগুলো ঘর। দাদুরা ওখানেই উঠবেন।
সুনীতি নরম ধাতের ঠাণ্ডা মানুষ। সবসময় নিচু গলায় কথা বলে। সেও হইচই বাধিয়ে দিল। তাদেরও বিরাট বাড়ি। অনেক ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। হেমনাথরা স্বচ্ছন্দে তাদের কাছে গিয়েও থাকতে পারবেন।
দুই বোনের স্বামীরা অর্থাৎ হিরণ এবং আনন্দ তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে গলা মেলায়। দুজনেই বলে, হেমনাথরা তাদের বাড়িতে উঠলে পরম সমাদরে, সসম্মানে থাকবেন।
দ্বারিক দও হাত তুলে সুধাদের থামান। বলেন, জানি, হেমদাদারা এলে তোমরা মাথায় করে রাখবে। বলি কি, কোনও এক জায়গায় ওদের থাকার দরকার নেই। একজনের কাছে থাকলে আর-একজনের মন খারাপ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভাগাভাগি করে থাকাই ভাল। কিছুদিন সুধার কাছে, কিছুদিন সুনীতির কাছে।
দ্বারিক দত্ত যেভাবে সমস্যাটার সুরাহা করে দিলেন সেটা সবার মনঃপূত হল। সুধারা তক্ষুনি তা মেনে নেয়।
বিনয় কিন্তু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, উঁহু
ঘরের সকলে তার দিক চোখ ফেরায়। সুধা একটু অসহিষ্ণু ভাবে জিজ্ঞেস করে, উঁহু মানে?
বিনয় বলে, দাদুকে তো আমি জানি। প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধ। উনি শেষ জীবনে কারও আশ্রয়ে এসে থাকতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। একটু ভেবে ফের বলল, প্রপার্টি এক্সচেঞ্জের জন্যে তিনি যে অস্থির হয়ে উঠেছেন তার কারণ একটাই। ইণ্ডিয়ায় এলে কারও গলগ্রহ হতে হবে না। নিজের নতুন বাড়িতেই থাকতে পারবেন।
সুধা ঝাঁঝালো স্বরে বলে, এটা কি একটা কাজের কথা হল! কবে জমিজমা এক্সচেঞ্জ করে ইণ্ডিয়ায় নিজের বাড়িঘর হবে সেই আশায় রাজদিয়ায় পড়ে থাকলে চলে?
বিনয়ের মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো নতুন একটা চিন্তা খেলে যায়। কী আশ্চর্য, কেন যে এই কথাটা আগে সে ভাবেনি! বলল, মুকুন্দপুর কলোনিতে, মানে যুগলদের ওখানে প্রচুর জমি আছে। দাদু সেখানে গেলে যুগলরা কী খুশিই যে হবে! যত জমি চান পেয়ে যাবেন। মুকুন্দপুর আর-একটা রাজদিয়া হয়ে উঠছে। সেখানকার বাসিন্দারা সবাই চেনাজানা, দেশের মানুষ। খুব ভাল লাগবে দাদুর। মনে হবে, অচেনা অন্য দেশে নয়, নতুন এক রাজদিয়াতেই চলে এসেছেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর দ্বারিক দত্ত বললেন, কোথায় থাকলে হেমদাদার আত্মসম্মানে বাধবে না, সে-সব পরে চিন্তা করা যাবে। এখন যা সবচেয়ে জরুরি তা হল হেমদাদা, বউ ঠাকরুন আর শিবানীকে এখানে। নিয়ে আসা।
দ্বারিক যা বলেছেন তার ষোল আনা ঠিক। যাঁরা এখানে এসে পৌঁছায়নি তাদের থাকার জন্য সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ হেমনাথদের আসাটা যে সবার আগে প্রয়োজন, কথায় কথায় সেই প্রসঙ্গটা থেকে সবাই দূরে সরে গেছে। আবার তারা মূল জায়গায় ফিরে আসে।
হিরণ জিজ্ঞেস করল, এক্সচেঞ্জের ব্যাপারটা আপাতত ভেস্তে গেছে। এই অবস্থায় ওঁদের কীভাবে আনা যায়, আপনি কিছু বলতে পারেন?
পারি।
অপার আগ্রহে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়রা।
দ্বারিক দত্ত বললেন, তোমরা তিন নাতি-নাতনি আর দুই নাতিন জামাই, পাঁচজনে মিলে একখানা পত্র লেখ। চিঠির বয়ান কী হবে সেটা আমি বলে দিচ্ছি। সুধা কাগজ কলম খাম এনে বিনুকে দাও। ও লিখুক–
কাগজ কলম এলে মুখে মুখে দ্বারিক দত্ত বলতে লাগলেন। বিনু লেখা শুরু করলঃ
পরম পূজনীয়েষু,
দাদু, আপনার চিঠি পাইয়া আমরা ভীষণ চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছি। রাজদিয়ার ওই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে আপনাদের পক্ষে এক মুহূর্তও থাকা ঠিক হইবে না। মোতাহার সাহেব আর করিমদের উপর বাড়িঘরের ভার দিয়া দলিলপত্র লইয়া ঢাকা হইয়া প্লেনে কলিকাতায় চলিয়া আসুন। ইহা ছাড়া বাঁচিবার অন্য কোনও পথ নাই।
আমরা জানি, মোতাহার সাহেব, করিম এবং অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষী যাঁহারা আছেন, আপনারা চলিয়া আসিলে সকলেই ভীষণ কষ্ট পাইবেন। যাহাতে না আসেন, সেজন্য বাধাও দিবেন। কিন্তু তাহারা অবুঝ নন, ভাল করিয়া বুঝাইলে অবশ্যই বুঝিবেন।
শাজাহান সাহেবের সহিত কাজটি হয় নাই। সাক্ষাতে কারণ জানাইব। যাহা হউক, বড় মাপের সম্পত্তি একচেঞ্জ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনি দলিলপত্র লইয়া আসিলে এখানে থাকিয়া, দেখিয়া শুনিয়া প্রপার্টি বিনিময় করিতে পারিবেন।
আমরা যেখানে আছি সেখানে আপনারা দয়া করিয়া থাকিলে ধন্য হইব। আপনাদের মর্যাদা কোনও ভাবেই ক্ষুণ্ণ হইবে না। আপনাদের শেষের দিনগুলি যাহাতে আনন্দে এবং মাধুর্যে পূর্ণ হয় সেদিকে সর্বদা আমাদের লক্ষ থাকিবে।
আপনি ঝিনুক সম্পর্কে জানিতে চাহিয়াছেন। সে ভাল আছে। পুরাতন দুঃখের…
বিনয় চমকে ওঠে। লেখা থামিয়ে দ্বারিক দত্তকে বলে, এ-সব লিখতে বলছেন কেন? ঝিনুকের কী হয়েছে, আপনি তো সবই জানেন। বুড়ো মানুষগুলোকে ডাহা মিথ্যে–
তার কথার মাঝখানেই দ্বারিক বলে ওঠেন, হেমদাদারা প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তার ওপর ঝিনুকের আসল খবরটা পেলে তাদের মানসিক অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, ভাবতে পার? এমন অনেক মিথ্যে আছে যা সত্যের থেকেও অনেক বেশি জরুরি। সত্যের সঙ্গে মিথ্যে মিশিয়েই সংসারে চলতে হয়।
বিনয়ের মন এতে পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না। অদৃশ্য কাটার মতো অস্বস্তি তাকে খোঁচা দিয়ে চলেছে। সে বলে, কিন্তু দাদুরা কলকাতায় এসে যখন সব জানতে পারবেন?
আগে হেমদাদাদের বিপদটা তো কাটুক। কলকাতায় এলে ওঁদের সব বুঝিয়ে বলা যাবে।
ভীষণ শক পাবেন।
যাকে সেই ছেলেবেলা থেকে বুকে, করে বড় করে তুলেছেন সে নিখোঁজ হয়ে গেছে। শক পাবে না? কিন্তু যা ঘটেছে তাতে তোমার বা আমার কারও হাত নেই। সবই ভবিতব্য।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। বয়স তার তেমন কিছু বেশি হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে কত কিছুই না। চোখের সামনে ঘটতে দেখল! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, আগুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, স্বাধীনতা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ মানুষের সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের এপারে চলে আসা। রাতারাতি কত মানুষ আগাগোড়া বদলে গেল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে পর পর এত সব ঘটে গেছে যার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।
দ্বারিক দত্ত বললেন, নাও, বাকিটা শেষ করে ফেল—
বিনয় নতুন করে লিখতে শুরু করে,
…পুরাতত দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ভুলিয়া অনেকটাই স্বাভাবিক হইয়া উঠিয়াছে।
নিত্য দাসের যে লোক এই পত্র লইয়া যাইতেছে, তাহাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তৎক্ষণাৎ উত্তর দিবেন। কবে আসিতেছেন, বিস্তারিত জানাইবেন। আমরা দমদম এয়ারপোর্টে গিয়া অপেক্ষা করিব।
আপনারা আমাদের প্রণাম লইবেন। ইতি–
ইতির নিচে বিনয়রা একে একে পাঁচজন সই করল। তারপর চিঠিটা ভাজ করে খামের ভেতর পুরে আঠা দিয়ে মুখ আটকে দিল।
দ্বারিক দত্ত এবার নিত্য দাসের দিকে তাকান। –এই চিঠিটা কত তাড়াতাড়ি হেমদাদার কাছে পৌঁছে দিতে পারবি?
মনে মনে হিসেব করে নিত্য দাস বলল, আপনেগো একহান চিঠি তো না, আরও ম্যালা চিঠি জুটাইয়া পাকিস্থানে পাঠামু। তা ধরেন, রাইজদায় পৌঁছাইতে দিন আষ্টেক তো লাগব।
দ্বারিক দত্ত বললেন, চিঠি পৌঁছতে আট দিন, জবাব আসতে আট দিন। আটে আটে ষোল দিন। না না, অত দেরি করা যাবে না।
বিনয় বলল, অন্য চিঠি থাক। আমাদের চিঠিটা নিয়ে আপনার লোক সোজা দাদুর কাছে যেন চলে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে দাদুর উত্তর চাই। অন্য চিঠি না নেবার জন্যে আপনার যা ক্ষতি হবে, আমরা তা পুষিয়ে দেব।
নিত্য দাস বলল, ঠিক আছে, এক হপ্তার মইদ্যেই হ্যামকত্তার পত্র আইনা দিমু–
কত দিতে হবে বলুন
হেই হগল হিসাব-কিতাব পরে অইব। আগে তো পত্র আনি। ম্যালা রাইত অইছে। আপনেগো পত্রখান দ্যান
চিঠি নিয়ে নিত্য দাস চলে গেল।
রাজদিয়া থেকে কী উত্তর আসে তার জন্য বিনয়রা এখন দিন গুনতে থাকবে।
নিত্য দাস চলে যাবার পর বিনয় মেসে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সুধারা তাকে এবং সুনীতিদের রাতের খাওয়া না খাইয়ে ছাড়েনি। খাওয়া দাওয়া চুকলে বড় রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সিতে আনন্দরা তাদের সঙ্গে বিনয়কে তুলে নিয়ে ভবানীপুরে শান্তিনিবাস-এর সামনে নামিয়ে দিয়ে বিডন স্ট্রিটে চলে যায়।
পরদিন থেকে ফের তার দৈনন্দিন রুটিনে ফিরে গেল বিনয়।
ত্রাণশিবির আর জবরদখল কলোনিগুলো নিয়ে যে-সব লেখা অফিসে জমা দেওয়া ছিল, তার বেশির ভাগটাই ছাপা হয়ে গেছে। বিনয়ের এই দুটো কলাম দেশভাগ! নানা ঘটনা, নানা মানুষ আর শরণার্থীদের ত্রাণশিবিরে এবং জবরদখল কলোনিতে এমনই জনপ্রিয় যে একদিনের জন্যও বন্ধ করা যাবে না। হাজার হাজার পাঠক, বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা, এর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। তাছাড়া, সরকারেরও এই কলাম দুটো সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ। রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট এগুলো থেকে প্রচুর তথ্য পায়। তাই প্রসাদ তাড়া দিয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও কটা লেখা তৈরি করে বিনয় যেন তাকে দেয়।
এখন আর নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। সকালে উঠে চটপট স্নান সেরে, চা খেয়ে যাদবপুর, বাঁশদ্রোণী কিংবা বেহালার কোনও কলোনি কি রিলিফ ক্যাম্প ঘুরে সে ছোটে শিয়ালদায়। কোনও দিন দুপুরে, কোনওদিন বা বিকেলের ট্রেনে আসাম থেকে তাড়া খাওয়া নতুন ইহুদিরা আসে। এর ওপর পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি স্পেশাল বোঝাই হয়ে উদ্বাস্তু আসা তো আছেই। সন্ধের পর পর তাদের ট্রেন আসে। নানা তথ্য জোগাড় করে অফিসে ফিরে চটপট তিনটে লেখা তৈরি করে প্রসাদের হাতে দিয়ে মেসে ফিরতে ফিরতে দশটা সাড়ে-দশটা হয়ে যায়। দুপুরে বেশির ভাগ দিনই পেটে ভাত পড়ে না। হোটেলে যে খাবে সময় কোথায়? মুড়ি কি পাউরুটি চিবিয়ে কোনও রকমে খিদে মেটাতে হয়।
এদিকে খবর পাওয়া গেছে, ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় আসাম গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানিয়েছেন, আসাম থেকে উদ্বাস্তুদের ঢল যেন পশ্চিমবঙ্গের দিকে আর না আসে। অবিলম্বে এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গ এমনিতেই উদ্বাস্তু সমস্যায় ডুবে আছে। প্রতিদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী এই রাজ্যে ঢুকছে, তার ওপর ইদানীং আসাম থেকেও ক্রমাগত আসতে থাকায় সমস্যাটা এমন বিপুল আকার নিয়েছে যে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। এখানকার সামাজিক আর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। নতুন করে জনসংখ্যার চাপ নেবার ক্ষমতা আর নেই।
বিধান রায়ের অনুরোধে কতটা কাজ হবে, বোঝা যাচ্ছে না। আসামের উদ্বাস্তুদের আসা। যতদিন না বন্ধ হচ্ছে, বিনয়কে সেই দুপুর থেকে শিয়ালদায় হাজিরা দিয়ে যেতে হবে।
সকালে চোখ মেলার পর থেকে ব্যস্ততা, এত অজস্র কাজে জড়িয়ে থাকা, তবু তারই মধ্যে পাষাণভারের মতো একটি চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় চেপে থাকে-হেমনাথ। সবাই জানে নিত্য দাস লোকটা সুবিধার নয়। চতুর, স্বার্থপর, ফিকিরবাজ। কিন্তু তার একটা বড় গুণ, কথা দিলে কথা রাখে। সে বলেছিল, সাত দিনের ভেতর পাকিস্তান থেকে হেমনাথের চিঠি এনে দেবে। সেই ভরসাতেই রয়েছে বিনয়।
প্রসাদ প্রথম দিকে বিনয়কে বলেছিলেন, সে যেন কলকাতায় দক্ষিণ শহরতলি বা ওদিকেই শহরতলি ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে যে-সব জবরদখল কলোনি বসানো হয়েছে সেগুলো নিয়েই লেখে। পরে জানিয়েছেন বিনয় তার ইচ্ছামতো উত্তর এবং পুবদিকের কলোনিগুলো নিয়েও লিখতে পারে।
আজ সকালে শিয়ালদা থেকে শ্যামনগরে নেমে মাইল দেড়েক হেঁটে যে কলোনিটায় সে পৌঁছল তার নাম নেতাজি পল্লি। সারা ভারতে নেতাজি বলতে একজনই, সুভাষচন্দ্র বসু। তার নামেই কলোনির নাম।
নতুন ভারত-এ চাকরি নেবার পর বহু কলোনিতেই গেছে বিনয়। কিন্তু এটা আলাদা ধরনের। বোঝা যায় এখানে পরিত্যক্ত একটা গ্রাম ছিল। গ্রামটার আশি ভাগ দখল করে বাড়িঘর একটু সরিয়ে সুরিয়ে উদ্বাস্তুরা বসে পড়েছে। বাকি ঘরগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। সেগুলোতে তালা লাগানো।
এটা কাদের গ্রাম ছিল, বোঝা যাচ্ছে না। এমন কলোনি আগে কখনও দেখেনি বিনয়। উদ্বাস্তুরা এমনিতে ফাঁকা জায়গায় ঝোপঝাড় নির্মূল করে, জলাটলা বুজিয়ে বসতি বানায়। কিন্তু আগেকার কোনও গ্রামের লোকজন তাড়িয়ে চেপে বসেছে, এমনটা তার জানা নেই। এ নিয়ে তার রীতিমতো কৌতূহল হচ্ছিল।
নেতাজি পল্লির মাতব্বর বা নেতা গোছের লোকটির নাম অশ্বিনী মালাকার। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। রোগা, পাকানো চেহারা। বেশ বিনয়ী। বিনয় খবরের কাগজ থেকে আসছে শুনে খুব যত্ন করে কলোনিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল।
কীভাবে তারা এখানে বসতি গড়ে তুলেছে সেই ইতিহাসটাও জানিয়ে দিল। তারা আগে ছিল দমদমের এক ত্রাণশিবিরে। দুবেলা খেতে পাওয়া যেত ঠিকই। কিন্তু খাওয়াই তো শেষ কথা নয়। আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই–এভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তারা খবর পাচ্ছিল, কলকাতার চারপাশে তো বটেই, পশ্চিম বাংলার জেলায় জেলায় উদ্বাস্তুরা সরকারের ভরসায় না থেকে নতুন নতুন কলোনি বসিয়ে নিজেদের মতো বাঁচার চেষ্টা করছে। তারাও ফাঁকা জায়গার সন্ধানে ছিল। এখানে একটা পোড়ো গ্রামের খোঁজ পেয়ে রাতারাতি এসে পড়েছে।
বিনয়ের সঙ্গে অশ্বিনীকে কথা বলতে দেখে নেতাজি পল্লির প্রচুর মেয়েপুরুষ, বাচ্চাকাচ্চা কিশোর-কিশোরী তাদের চারপাশে জড়ো হয়েছিল। যেমনটা অন্য কলোনিতে দেখা গেছে, এখানেও তার হেরফের হয়নি। নেতাজি পল্লির অন্য বাসিন্দারা গভীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এখানে যারা বাস করছে অশ্বিনী মালাকার তাদের সম্বন্ধেও নানা তথ্য জানিয়ে দিল। সব মিলিয়ে প্রায় সাত শ জন।
কুমোর কামার তাঁতি বারুই-এমনি নানা জাতের মানুষ। দেশে থাকতে যে যার কৌলিক কাজকর্ম করত। জন্মভূমির থেকে উৎখাত হয়ে আসার পর এখানে কেউ দিনমজুর। কেউ হকার। কেউ মুটেগিরি করে পেট চালায়।
নতুন কিছু নয়। অন্য কলোনিগুলোর বাসিন্দারাও এইভাবেই টিকে আছে।
সেই কৌতূহলটা সমানে খোঁচা মারছিল। বিনয় একসময় বলেই ফেলে, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় আপনারা আসার আগে এখানে একটা গ্রাম ছিল। সেটা
বিনয়ের কথার মাঝখানেই অশ্বিনী বলে ওঠে, হ, আছিল তো। মুসলমানগো গেরাম
তারা গেল কোথায়?
ঘরে তালা লাগাইয়া বেবাকটি পাকিস্থানে গ্যাছে গিয়া। জনমনিষ্যি নাই, গেরাম ফাঁকা পাইয়া আমরা ঢুইকা পড়লাম। নূতন কইরা ঘর বানানের খাটনিটা বাচছে।
কতদিন আগে এরা চলে গেছে?
ঠিক কইতে পারুম না। আমরা আইয়া তাগো দেখি নাই। শুনাশুন কানে আইছে মাস আষ্টেক আগে হেরা গ্যাছে গিয়া।
একটু ভেবে বিনয় বলে, অন্যের বাড়িঘর দখল করলেন। তারা যদি ফিরে আসে?
অশ্বিনী মালাকারের কপাল কুঁচকে যায়। আর আইছে! যারা ডরে পলাইছে হেরা কি ফিরে? এই যে আমরা ভিটামাটি ফালাইয়া চইলা আইছি, আর কি ফিরা যামু? কিছুক্ষণ থেমে ফের বলে, আর যদিন ফিরে তো ফিরব।
তখন তো এই বাড়িটাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অশ্বিনীর। চোখের দৃষ্টি তীব্র, জ্বলজ্বলে। যে বিনয়ী মানুষটা এতক্ষণ নরম গলায় কথা বলছিল তাকে যেন আর চেনাই যায় না। অশ্বিনী রুক্ষ গলায় বলে, এইহান থিকা যামু কই? যদি হেরা আহে তহন দেখা যাইব। সিধা কথা কই, দুইবার রিফুজ অইতে পারুম না।
বোঝা গেল, দখল ছাড়ার আদৌ ইচ্ছা নেই অশ্বিনীদের। সহজে এখান থেকে তারা নড়বে না। খানিক চিন্তা করে বিনয় জিজ্ঞেস করে, এই গ্রামটার আগের নাম কী ছিল?
সুনাডাঙ্গা (সোনাডাঙা)।
ইদানীং যে কলোনি বা ক্যাম্পেই যায়, ঝিনুকের খোঁজ করে বিনয়। এখানেও করল। অশ্বিনী মালাকার জানালো, ওই নামে নেতাজি পল্লিতে কেউ নেই।
আগে আগে ঝিনুক নেই শুনলে হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ত বিনয়। আজকাল ধরেই নিয়েছে ঝিনুককে আর পাওয়া যাবে না। আগের মতো ততটা সে ভেঙে খান খান হয়ে যায় না। কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ে শুধু।
খোঁজখবর সে কম করেনি। ঝিনুকের সন্ধানে সৌরলোক তোলপাড় করে ফেলেছে কিন্তু তাকে না পাওয়া গেলে সে আর কী করতে পারে?
বিনয় আর দাঁড়ায় না। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করে। একটা প্রশ্ন আচমকা তার মাথায় ঢুকে যায়। পাকিস্তান তো হিন্দুশূন্য হতে চলেছে। সোনাডাঙ্গা এবং এরকম আরও কয়েকটি জায়গায় গিয়ে তার মনে হয়েছে শেষ অবধি ইন্ডিয়া থেকেও কি সব মুসলমান চলে যাবে?
শ্যামনগর স্টেশনে এসে বিনয় সবে টিকিট কেটেছে, হুড়মুড় করে কলকাতার ট্রেন এসে গেল। সামনের একটা কামরায় সে উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সিটি বাজিয়ে কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।
অন্যমনস্কর মতো জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনয়। যতদূর চোখ যায় ছবির মতো অসংখ্য দৃশ্য। ছোট ছোট কোনও গ্রাম, খাপছাড়া কোনও শহর। কোথাও ফসলহীন ফাঁকা মাঠ, মজা খাল, বাঁশের সাঁকো, ইত্যাদি ইত্যাদি। ট্রেন ঋই ঋই আওয়াজ তুলে, চরাচর কাঁপিয়ে যত সামনের দিকে এগুচ্ছে, দৃশ্যগুলো ততই পিছু ছুটতে ছুটতে সামনে থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে।
শ্যামনগর থেকে কটা স্টেশন পেরিয়ে এসেছিল খেয়াল নেই বিনয়ের। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ট্রেন আগরপাড়ায় এসে থেমেছে।
সকালে এই লাইনেই শ্যামনগর গিয়েছিল সে, কিন্তু তখন আগরপাড়া তার মাথায় ছিল না। এই মুহূর্তে মনে হল, মুকুন্দপুর কলোনিতে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। এদিকে যখন এসেই পড়েছে, আজই কাজটা সেরে নেওয়া ভাল। নইলে দু-এক দিনের ভেতর আসতেই হবে।
দ্রুত উঠে পড়ে বিনয়। প্ল্যাটফর্মে নেমে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে।
মুকুন্দপুরে যখন সে পৌঁছয় সূর্য সোজা মাথার ওপর উঠে এসেছে। এই সময়টা কলোনির বেশির ভাগ পুরুষ মানুষই থাকে বাইরে।
যুগল বিলের মাছ ধরে বেচে। বিক্রিবাটা সেরে এতক্ষণে তার চলে আসার কথা। বিনয়ের আসল কাজটা তার সঙ্গেই। আশা করা যায়, যুগলকে এখন পাওয়া যাবে।
ভর দুপুরে কলোনির মাঝখানের চত্বরে একেবারে মেলা বসে যায়। রান্নাবান্না এবং গেরস্থালির নানা কাজকর্ম সেরে এখানকার বউ-ঝিরা থোকায় থোকায় বসে গল্প টল্প করে সেই বিকেল পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়। সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে এটুকুই তাদের ফুরসত। আজও তাদের দেখা গেল। সেই সঙ্গে কচি-কাঁচা বাচ্চা এবং বুড়োবুড়িদেরও।
যে ছেলেমেয়েগুলোর বয়স পাঁচ থেকে দশ বারোর ভেতর তাদের দেখা যাচ্ছে না। দূরে বনজঙ্গল কেটে যে টিনের চালের স্কুল বসানো হয়েছে সেখান থেকে তাদের কলকলানি ভেসে আসছে। খুব সম্ভব: সুর করে কিছু পড়ছে। নামতা কিংবা পাঠ্য বইয়ের কোনও পদ্য। শব্দটা গুঞ্জনের মতো শোনাচ্ছে। আশু দত্তর ছাত্র ওরা।
খুব ভাল লাগল বিনয়ের। সৃষ্টিছাড়া এক জবরদখল কলোনিতে টিনের চালের অকিঞ্চিৎকর এক স্কুল নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন আশু দত্ত। জীবনের শেষ পর্বে নতুন করে মানুষ গড়ার কাজে তিনি হাত লাগিয়েছেন।
বিনয় চত্বরের মাঝামাঝি চলে এসেছিল। যুগলই তাকে প্রথম দেখতে পেল। খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে একধারে একটা পুরানো তেলচিটে পাটিতে শরীর এলিয়ে দিয়ে সে শুয়ে ছিল। সেই ভোরে বিলের। মাছ ধরে দমদমের বাজারে সেই মাছ বেচে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চান করার পর পেটে ভাত পড়তেই দুচোখ জুড়ে আসছিল তার।
বিনয়কে দেখে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে যুগল। দৌড়ে কাছে চলে আসে। সবিস্ময়ে বলে, আপনে, ছুটোবাবু! হেইদিনও আত (হঠাৎ) আইছিলেন, আইজও আইলেন। আগাম জানান নাই তো?
বিনয় বলল, হঠাৎ একটা বিশেষ দরকারে আসতে হয়েছে। আগে জানাবার মতো সময় পাই নি।
ততক্ষণে নানা বয়সের মেয়েরা, কিশোরী যুবতী থেকে আধবয়সী গিন্নিবান্নি-উঠে পড়েছে। বিনয় আসায় সবাই খুব খুশি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে।ছুটোবাবু আইছে, ছুটোবাবু আইছে
মেয়েদের মধ্যে পাখিও রয়েছে। যুগল তাকে হইহই করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত তুলে থামিয়ে দেয় বিনয়। সে জানে যুগল কী কী করবে। তার জন্য এখনই পাখিকে রান্না চড়াতে বলবে, নিজে জাল নিয়ে বিলে চলে যাবে। তার ছুটোবাবুকে সেরা তেলালো রুই কি কাতলা ছাড়া কি খাওয়ানো যায়?
বিনয় বলল, পাখিকে একদম উদ্বস্ত করবে না। আমি খেয়ে এসেছি।
তার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যাতে থমকে যায় যুগল। কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করে বলে, সইত্য (সত্য) নি কন ছুটোবাবু?
আগে আগে মিথ্যে বলতে গেলে দশবার ঢোক গিলতে হতো। কিন্তু ইদানীং ঝাট এড়াবার জন্য মিথ্যেটা মসৃণভাবেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এখন পাখি রান্না চাপালে খাওয়া দাওয়া সারতে বিকেল হয়ে যাবে। আসাম থেকে নতুন রিফিউজি নিয়ে ট্রেন আসবে দুটো আড়াইটায়। তার আগেই বিনয়কে শিয়ালদায় পৌঁছতে হবে। সে বলল, মিথ্যে বলে আমার লাভ? পেটে খিদে থাকলে নিজেরই তো কষ্ট।
কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না যুগল।
বিনয় এবার বলে, আশু স্যারের সঙ্গে আগে দেখা করব। তারপর তোমার সঙ্গে দরকারি কাজট সেরে কলকাতায় ফিরব। এখন চল—
কথা বলতে বলতে স্কুলে চলে এল বিনয়রা। লম্বা ক্লাস ঘরের একধারে খেলো কাঠের চেয়ারে বসে ছিলেন আশু দত্ত। তাঁর সামনে টেবল। একপাশে ব্ল্যাকবোর্ড। নিচে চটের আসন পেতে বসেছে পড়ুয়ারা। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাটটি ছেলেমেয়ে।
বিনয়কে দেখে উঠে দাঁড়ান আশু দত্ত। অসীম বিস্ময়ে বলে ওঠেন, তুই মুকুন্দপুরে! সূর্য আত। কোনদিকে উঠেছে রে!
কাচুমাচু মুখ করে কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল বিনয়! আশু দত্ত তার আগেই আবার বনে ওঠেন, সেই যে বলে গেলি শিগগিরই আসবি, তারপর তোর আর কোনও খবরই নেই।
এ জাতীয় অনুযোগ উঠলে সবাইকে যে কৈফিয়ৎ দেয়, সেটাই পেশ করে বিনয়। অর্থাৎ অফিসে কাজের চাপে ইচ্ছা থাকলেও সময় হয় না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
খুব কাজের মানুষ হয়ে গেছিস। বলতে বলতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় আশু দত্তর। কদি আগে এসেছিলি। কই, আমার সঙ্গে তো দেখা করে যাস নি!
ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বিনয় বলে, স্যার, অন্যায় হয়ে গেছে। এমন তাড়া ছিল যে আপনাঃ কাছে আসতে পারি নি। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, এখানে কেমন আছেন স্যার?
চমৎকার। মুকুন্দপুরে এসে বেঁচে গেছি। ছাত্রদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে আশু দত্ত বলতে লাগলেন এই বাচ্চাগুলো আর কলোনিতে রাজদিয়া অঞ্চলের লোকজনকে পেয়ে সব কষ্ট ঘুচে গেছে। ওর যে কী ভাল! বিশেষ করে এই যুগলটা আবেগে তার গলার স্বর কেঁপে যায়।
এখানে কোথায় থাকেন এখন?
নিশিকান্ত আচার্য আমাকে একখানা ঘর ছেড়ে দিয়েছে। সেখানেই আছি।
বিনয় বলে, ঠাকুমাকে কি নিয়ে এসেছেন? ঠাকুমা বলতে আশু দত্তের মা।
আশু দত্ত জানালেন, যুগলরা তাদের জন্য নতুন ঘর তোলার তোড়জোড় করছে। সেটা তৈরি হয়ে গেলেই ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে সন্তোষ নাগদের বাড়ি থেকে মাকে নিয়ে আসবেন। তারপর বললে তোকে একটা খবর দিচ্ছি।
কী খবর স্যার?
আমার যে ছাত্র এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে বড় অফিসার তার সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে দে করেছিলাম–তোর মনে আছে?
এই তো সেদিনের কথা। মনে থাকবে না?
সেই ছাত্র মানে শিবনাথ সেনগুপ্ত কদিন আগে এখানে এসেছিল। কথা দিয়ে গেছে স্কুলে। জন্যে গ্রান্টের ব্যবস্থা করবে।
খুব সুখবর।
আমি যদি বেঁচে থাকি, এই ছোট্ট স্কুলটাকে হাই স্কুল করব।
আপনি এক শ বছর বাঁচবেন।
আশু দত্ত হেসে হেসে বললেন, শতায়ু হতে আপত্তি নেই, যদি শরীর সুস্থ থাকে।
বিনয় আশু দত্তর মুখের দিকে পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে যেদিন রাত্তিরে এই মানুষটিকে কালীঘাটে পৌঁছে দিয়েছিল সেদিনটার কথা চকিতে মনে পড়ে যায়। তখন তিনি উদ্ভ্রান্ত, শঙ্কাতুর। কিন্তু এখন? এমন পরিতৃপ্ত, উজ্জ্বল, সুখী মানুষ পৃথিবীতে কজন আছে? উৎসাহে যেন টগবগ করে ফুটছেন।
বিনয় বলল, যে জন্যে আজ এসেছি, এবার সেটা বলি। আমিও একটা খবর এনেছি। সেটা ভাল কি খারাপ বুঝতে পারছি না।
উৎসুক সুরে আশু দত্ত জিজ্ঞেস করেন, কী খবর রে?
বিনয় বলে, দাদু পাকিস্তান থেকে চলে আসছেন। কী কারণে হেমনাথকে আসতে হচ্ছে তাও সবিস্তার জানিয়ে দিল।
স্কুল-ঘরে হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে আসে। কলোনির মেয়েরা বিনয়দের পিছু পিছু চলে এসেছিল। ক্লাসের তারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, নীরবে।
একসময় আশু দত্ত বললেন, হেমদাদাকে আমি অনেক আগেই বলেছিলাম, পাকিস্তানে থাকতে পারবেন না। কী যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার ঘাড়ে চেপেছিল! যাক, শেষ পর্যন্ত যে সুবুদ্ধি হয়েছে, এটা সুসংবাদ–খুবই সুসংবাদ।
বিনয় এবার যুগলের দিকে তাকায়।-এখন সমস্ত নির্ভর করছে তোমার ওপর।
বিহ্বলের মতো যুগল নিজের বুকে হাত রেখে বলে, আমার উপুর?
হ্যাঁ। দাদু দেশের সম্পত্তির কোনও ব্যবস্থাই করতে পারেননি। একেবারে খালি হাতে আসছেন। আমার ইচ্ছা মুকুন্দপুর কলোনিতে তোমরা তাকে খানিকটা জমি দাও—
বিনয়ের কথাগুলো প্রথমটা মাথায় ঢোকে না যুগলের। যা শুনল তা কি ঠিক শুনেছে? পরক্ষণে গলার শির ছিঁড়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে, হ্যামকত্তায় আমাগো এইহানে আইয়া থাকব, হ্যামকায় আমাগো কাছে থাকব উত্তেজনা, আনন্দ, তীব্র উচ্ছ্বাস, সব একাকার হয়ে ঢলের মতো বেরিয়ে আসছে তার গলা দিয়ে।
চেঁচাতে চেঁচাতে স্কুল-ঘর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে জনতাকে লক্ষ করে যুগল বলতে থাকে, হোনছ তুমরা, হোনছ ক্যাঠা আইতে আছে। আমাগো রাইজদার হ্যামকত্ত। তেনারে আমরা মাথায় কইরা রাখুম-বলতে বলতে ফের ভেতরে ঢুকে বিনয়ের হাত ধরে টানতে টানতে স্কুল-ঘরের পেছনে নিয়ে যায়। এ ধারে, এখনও বহুদূর অবধি ঘন বনভূমি। জঙ্গলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে, এগুলান সাফ করলে দুই-আড়াই শকানি জমিন বারাইব (বেরুবে)। এই পুরা জমিনটা হ্যামকত্তার। এইহান থিকা এক আঙ্গুল মাটিও অন্য কেওরে (কাউকে) দিমু না
আরও কিছুক্ষণ মুকুন্দপুরে কাটিয়ে আগরপাড়া স্টেশনে চলে এল বিনয়। যুগল সঙ্গে এসেছে সে তাকে ট্রেনে তুলে দিল।
কলকাতার দিকে ফিরতে ফিরতে যুগলের কথা বার বার মনে পড়ছে। সে হেমনাথের হাতে সমস্ত সৌরলোক তুলে দেবার জন্য প্রস্তুত। মুকুন্দপুরে তার কথাই শেষ কথা।
সুধা বা সুনীতিরা যতই আদরযত্নে রাখার কথা বলুক, তবু সেগুলো পরের বাড়ি। কিন্তু মুকুন্দপুরের জমি হবে হেমনাথের নিজস্ব। এখানে থাকলে তার সংকোচ বোধ করার কারণ নেই।
জমি তো ঠিক হল, কিন্তু হেমনাথ কবে আসবেন, কে জানে। চকিতে রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী এবং তার মেয়েদের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আগে একদিন এসে ওঁদের জন্যও জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল বিনয়। কিন্তু বৃদ্ধা তার তিন মেয়েকে নিয়ে নিরুদ্দেশ। তাদের এখানে আনা যাবে কি না, জানা নেই।
৬৩.
আজ রবিবার। এটা বিনয়ের ছবির দিন। রোদ উঠতে না উঠতেই বাইরে বেরুবার তাড়া নেই। সপ্তাহের প্রথম ছটা দিন সকাল থেকে রাত নটা-দশটা অবধি বিস্তর খাটাখাটুনির পর শরীরে অসীম ক্লান্তি জমে আছে। বিনয় ঠিকই করে রেখেছিল, আজ শুয়ে বসে আয়েশ করে কাটিয়ে দেবে। বিকেলের দিকে শরীর ঝরঝরে লাগলে একটু বেড়িয়ে আসবে।
নিত্য দাস সেদিন বলে গিয়েছিল, সাতদিনের ভেতর হেমনাথের চিঠি এনে দেবে। সাতদিন এখনও পূর্ণ হয়নি। দাদুর জন্য দুশ্চিন্তাটা সারাক্ষণ তার মাথায় চেপে থাকে। বিকেলে ঘুরে টুরে এলে অন্তত খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা যাবে।
খবরের কাগজে ঢোকার পর সকালে উঠে চান করাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বিনয়ের। ছুটির দিনেও তার ব্যতিক্রম হয় না।
আজও চান টান সেরে প্রসাদের ঘরে চলে এসেছিল বিনয়। এখানে বসেই একসঙ্গে তারা চা। এবং জলখাবার খায়। খাবারের দামটা প্রসাদই দেন। আপত্তি করলে ভীষণ রেগে যান। আজকাল তাই আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না বিনয়।
প্রসাদের পাওনাদাররা অর্থাৎ উদ্বাস্তুদের রোগা রোগা ছেলেমেয়েরা তাদের বরাদ্দ রুটি-মাখন নিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল। এখন তারা দুজনে সকালের জলখাবার খাচ্ছে।
রবিবার প্রসাদেরও সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অফিস যেতে হবে না। ঢিলেঢালা, লঘু মেজাজে গল্প করতে করতে তারা সময় কাটাচ্ছিলেন।
গল্প আর কী। সব কথাবার্তাই অফিসকে ঘিরে। নতুন ভারত আনকোরা কাগজ হলেও এর মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। সার্কুলেশন হু হু করে বাড়ছে। কাগজের মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতা খুব খুশি। ইত্যাদি ইত্যাদি
হঠাৎ ভেতর দিকের বারান্দা থেকে একটা গলা ভেসে এল, জোহর (হাতজোড় করে নমস্কার) আইজ্ঞা—
বিনয়রা মুখ ফিরিয়ে রাঁধুনী বামুন বলরামকে দেখতে পায়। প্রসাদ বলেন, আরে ঠাকুর যে। এস এস বলরাম ভেতরে এলে জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ কী মনে করে? কিছু দরকার আছে?
হ্যাঁ। সেই থিপাই (জন্য) তো আসিচি
বল
বলরাম জানায়, বিনয়ের জন্য তাকে আসতে হয়েছে। প্রসাদ একটু অবাক হলেন। –বিনয়ের জন্যে কেন?
বলরাম বলল, আপন কহিথিলে বিনয়বাবু যত্ন করিবা পাই
তা তো বলেছিলাম
প্রসাদকে শেষ করতে না দিয়ে বলরাম বলে, হেলে (কিন্তু) করিবি কেমিতি? সে তো সকারে বাহারি যাউছি। মাঝরাত্রিরে ফিরি আসুছন্তি। তার খাইবা পিবার কন ভাল ব্যবস্থা করিবি?
বলরামের স্বভাবে, কথাবার্তায় একটা আপন-করা ব্যাপার আছে। বিনয় অনুভব করে, তাকে আদরযত্ন করে খাওয়াতে পারছে না, সেজন্য তার মনে যথেষ্ট দুঃখ। স্নেহপ্রবণ মানুষটিকেই আগেই ভাল লেগেছিল। এখন আরও ভাল লাগল।
প্রসাদ বললেন, আজ ছুটির দিন। বাবু বেরুবে না।
বলরামের চোখমুখ খুশির ছটায় ভরে যায়। সে বলে, সে তত ভারি ভাল কথা—
আজ বাবুকে আশ মিটিয়ে খাওয়াও। কী রান্নাবান্না হচ্ছে?
আজি রবিবার। সবু হব। ডালি, তরকারি, মাছ, মাংস।
বিনয় জানে, অন্যদিন ভীষণ তাড়াহুড়ো থাকে। বোর্ডাররা কোনওরকমে নাকেমুখে ওঁজে নটা, সাড়ে-নটার ভেতর যে যার কাজে বেরিয়ে যায়। তখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা, তরিবত করে সাতপদ দিয়ে খাওয়ার সময় কোথায়? রবিবার বেশির ভাগ বোর্ডার তাদের দেশের বাড়িতে চলে যায়। তবে এই রবিবার সবাই মেসে থাকবে। সকলের ইচ্ছা আজ রীতিমতো ভোজের বন্দোবস্ত করা হোক।
প্রসাদ বললেন, চমৎকার—
বিনয়কে দেখিয়ে বলরাম বলল, বাবু পাঁই গোটে বড় মাছমুণ্ড (মাছের মুড়ো) রখি দেবি
খুব ভাল।
রাত্তিরে কী হবে?
পুরী আউ মাংস।
ফার্স্ট ক্লাস।
এবে যাউচি। রসুই ব্যবস্থা করিবা পাই।
বলরাম চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চারটি লোক ঘরে ঢুকল। বয়স তিরিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর। সবাই শান্তিনিবাস-এর বোর্ডার। নাম না জানলেও মুখগুলো বিনয়ের চেনা।
সকলে মোড়াটোড়া টেনে বসে পড়ে। একজন প্রসাদকে বলল, মেসে নতুন বোর্ডার এসেছেন। অথচ পরিচয়ই হয়নি। সেই কোন সকালে বেরিয়ে যান। ফেরেন মাঝরাত্তিরে। আজ ওঁকে পাওয়া গেছে। আলাপ করতে এলাম।
বিনয় বুঝতে পারল, লোকটা তার সম্বন্ধেই বলছে।
প্রসাদ উৎসাহের সুরে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এক জায়গায় থাকতে হবে, আলাপ-পরিচয় না হলে কি চলে? তিনি বিনয়ের সঙ্গে চারজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এঁদের মধ্যে তিনজন মাঝবয়সী, একজন যুবক। টাক-মাথা গোলগাল লোকটির নাম মন্মথ সামন্ত। বার্ড কোম্পানির বড়বাবু। দেশ বর্ধমানের এক গ্রামে। মন্মথর পাশের ঢ্যাঙা, রোগা প্রৌঢ়টি হলেন নরহরি দত্ত। তার বাড়ি হুগলি জেলায়। তিনি বার্মা শেল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। নরহরির পাশের লোকটিও আধ্যবয়সী। বেশ লম্বা চওড়া। চৌকো ধরনের মুখ। নাম দ্বিজদাস মিত্র। মেটাল বক্স কোম্পানির হেড অফিসের মেজোবাবু। বাড়ি বনগাঁয়ে। চতুর্থ জন অর্থাৎ সবচেয়ে কমবয়সী যে, তার নাম নিখিল হাজরা। সানলাইফ ইন্সিওরেন্সের চাকুরে। মাথায় বাবরি চুল, ডানদিকে সিঁথি। পরনে এই সকালবেলাতেই ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর দামি জহর কোট। যুবকটি বেশ শৌখিন। নিখিলদের বাড়ি ডায়মণ্ডহারবারে।
এই চার বোর্ডারেরই বিনয় সম্পর্কে প্রচুর কৌতূহল। যখন জানতে পারল, মাত্র কিছুদিন আগে সে পাকিস্তান থেকে এসেছে তখন প্রায় হামলে পড়ল। তাদের প্রশ্নের শেষ নেই। পাকিস্তানের অবস্থা কতটা ভীতিকর? সেখানে কী ধরনের অত্যাচার চলছে? ইত্যাদি। প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে নতুন ভারত-এ বিনয়ের লেখার তারিফও চলতে লাগল।
বেড়ে লিখেছেন ভাই
রিফিউজিদের প্রবলেমগুলো খুব ভাল ফুটে উঠছে।
আলাপ যখন জমে উঠেছে সেই সময় হিমাংশু এলেন। স্বাধীনতা-সংগ্রামী হরিচরণ বসুর ভাইপো। হিমাংশুকে দেখে ঘরের সবাই, বিশেষ করে প্রসাদ ব্যস্ত হয়ে পড়েন।–আসুন, আসুন–হিমাংশু ঘরে এসে বসলে জিজ্ঞেস করেন, এই সকালবেলায়? কোনও দরকার আছে?
হিমাংশু বিনয়কে দেখিয়ে বললেন, এঁর জন্য আসতে হল। কাকা এখনই ওঁকে নিয়ে যে বলেছেন।
একটু অবাক হলেন প্রসাদ। –কেন বলুন তো?
কাকা ওঁদের হোম-এ যাচ্ছেন। বিনয়বাবুকে সেখানে নিয়ে যেতে চান। কদিন আগে এই নি। ওঁর সঙ্গে কাকার কথাও হয়েছিল।
প্রসাদ হিমাংশুকে বললেন, বিনয় নিশ্চয়ই যাবে। কখন ও ফিরতে পারবে, জানেন?
হিমাংশু বললেন, হোম থেকে কাকা ওঁকে আরও কোথায় যেন নিয়ে যাবেন। সন্ধের আর ফেরা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
প্রসাদ বিনয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে লঘু সুরে বললেন তোমার জন্যে বলরাম ঠাকু মাছের মুড়ো-টুড়ো বেঁধে রাখবে। এ-বেলা আর খাওয়া হল না। বেচারার মন খারাপ হয়ে যাতে ঠাকুরকে বলব, সব যেন রেখে দেয়। রাত্তিরে খেও
হিমাংশু বিনয়কে বললেন, আমি বসছি। আপনি রেডি হয়ে নিন—
বিনয় বলল, চান হয়ে গেছে। আমি জামা কাপড়টা পালটে আসি। সে উঠে পড়ে।
মেসের চার বোর্ডার একটু হতাশই হল। মন্মথ বললেন, আজ আর আলাপটা তেমন জমল না–
প্রসাদ বললেন, একই মেসে তো থাকছেন। পরে আবার বিনয়কে নিয়ে বসবেন। আ হরিচরণবাবুর কাছে ওর না গেলেই নয়। বিনয়কে বললেন, হোমের কাজকর্ম ভাল করে ল করবে। ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে যতটা সম্ভব ওদের দুঃখের হিস্ট্রি জানতে চেষ্টা কোরে তোমার কাছে এই নিয়ে একটা বড় লেখা চাই। নেক্সট উইকে দিও। আগেও প্রসাদ এ-সব বলেছে আবার মনে করিয়ে দিলেন।
শান্তিনিবাস-এর পর কটা ছিরিছাঁদহীন সেকেলে তেতলা। তারপর বত্রিশ নম্বর মহেশ হালদা লেন। এটাই হিমাংশুদের বাড়ি। চিরকুমার হরিচরণ এখানেই ভাইপোর ফ্যামিলির সঙ্গে থাকেন
বাড়িটা দোতলা। যথেষ্ট পুরানো হলেও খুব সম্প্রতি সারিয়ে টারিয়ে রং করা হয়েছে। রাস্তা ওপরেই সদর দরজা। সেটা ভোলা ছিল। হিমাংশুর সঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই মৃস্ত চাতাল। সেটা ঘি সারি সারি ঘর। ঘরগুলোর সামনে দিয়ে চওড়া বারান্দা চলে গেছে। বারান্দার একধারে দোতলা ওঠার সিঁড়ি। কলকাতার আদ্যিকালের বাড়িগুলোর মতো এটারও অবিকল একই ধরনের নকশ
একতলার ডানধারে বিশাল একখানা ঘরে বিনয়কে নিয়ে গেলেন হিমাংশু। ঘরটার তিন দিকে দেওয়ালে বেশ কটা কাঁচের পাল্লা দেওয়া আলমারি আর কাঠের র্যাক। অজস্র বই আর পুরাতে খবরের কাগজে সেগুলো ঠাসা।
মাঝখানে প্রকাণ্ড ভারী খাটে পুরু তোষকের ওপর ধবধবে বিছানায় বসে ছিলেন হরিচরণ দেখামাত্রই টের পাওয়া যায়, তার চান হয়ে গেছে। পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তিনি বেরুবার জ প্রস্তুত। তাঁর শিয়রের দিকে একটা নিচু টেবলে টেবলক্লক, ওষুধপত্তরের কটা শিশি, একটা মো ডায়েরি, কাগজ, কলম, পেনসিল ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস ছাড়াও আজকের দুটো বাংলা আর একৗ ইংরেজি কাগজ। যারা দেখা করতে আসে তাদের বসার জন্য খানকতক চেয়ার।
হরিচরণ বললেন, বোসো বিনয়, বোসো– বিনয় বসলে হিমাংশুকে বললেন, বউমাকে বল বিনয়কে চা-জলখাবার দিয়ে যাক।
বউমা নিশ্চয়ই হিমাংশুর স্ত্রী। বিনয় ব্যস্তভাবে বলে ওঠে, আমি খেয়ে এসেছি। এখন কি দিতে হবে না।
সারাদিন আমার সঙ্গে কাটাতে হবে। সেই দুপুরের আগে খাওয়াদাওয়া নেই। লজ্জা করে না। খেলে নিজেই কষ্ট পাবে।
লজ্জা কেন করব? বিনয় একটু হাসল।
ঠিক আছে। তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক। খাট থেকে নেমে লাল ক্যাম্বিসের ফিতে বাঁধা হতে পরে হরিচরণ বললেন, চল
বিনয় জিজ্ঞেস করল, আপনাদের হোমটা কোথায়?
কসবায়। বালিগঞ্জ স্টেশনের ওধারে। রসা রোডে গিয়ে বালিগঞ্জের ট্রাম ধরব। বালিগঞ্জ থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
রসা রোডে এসে ট্রামে হরিচরণের পাশাপাশি বসে যেতে যেতে ঝিনুকের কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। হরিচরণ সেদিন জানিয়েছিলেন, নানা জায়গা থেকে ধর্ষিত মেয়েদের উদ্ধার করে এনে তাদের হোমে আশ্রয় দিয়েছেন। এমনও হতে পারে, ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর তিনি হয়তো কোথাও তাকে পেয়ে নিয়ে এসেছেন। জিজ্ঞেসও করেছিল বিনয় কিন্তু হোমের শখানেক মেয়ের ভেতর ঝিনুক নামে কেউ আছে কি না হরিচরণ বলতে পারেননি। অতজনের নাম মনে রাখা সম্ভব নয়।
হোমে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হবে কি হবে না, কে জানে। যদি হয়ে যায়? বুকের ভেতর ঝড় হয়ে গেল বিনয়ের।
বালিগঞ্জ রুটের ট্রামের দৌড় বালিগঞ্জ রেল স্টেশন অবধি। গড়িমসি চালে চলতে চলতে, এক সময় সেটা সেখানে পৌঁছে গেল।
ট্রাম থেকে নেমে কপা গেলেই রেল লাইন। লাইন পেরিয়ে হরিচরণের সঙ্গে ওধারে চলে গেল বিনয়। কসবার নাম আগেই শুনেছিল সে। এদিকেই কোথাও নিত্য দাস বাড়ি কিনেছে। অনেক বার যেতেও বলেছিল কিন্তু নানা ব্যস্ততার মধ্যে যাওয়া হয়ে ওঠে নি।
রেল লাইনের ওপার থেকে সরু পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে সামনের দিকে চলে গেছে। সেখানে এসে হরিচরণ বললেন, এই এরিয়ায় বাস টাস খুব কম চলে। বেশি দূরে তো নয়। চল হেঁটেই যাওয়া যাক। বলে জোরে জোরে পা চালিয়ে দিলেন।
কলকাতার এই দিকটায় শহর সেভাবে দানা বাঁধেনি। দুধারে প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। রয়েছে ডোবা, পানাপুকুর, সুরু খাল, ঝোপঝাড়, অজস্র গাছগাছালি। এ-সবের ফাঁকে ফাঁকে ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর। বেশির ভাগই টিন বা টালির চালের। শ্যাওলা-ধরা সেকেলে দালানকোঠাও কিছু আছে। নতুন নতুন বাড়িও চোখে পড়ছে।
নিত্য দাস বলেছিল, পাকিস্তান থেকে যারা লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু টাকাপয়সা আনতে পেরেছে তারা অনেকেই কসবায় সস্তায় জমিটমি কিনে বাড়ি করছে। বোঝা যায়, কলকাতা এই অঞ্চলে হাত-পা ছড়াতে শুরু করেছে। ঝোপজঙ্গল খালবিলে ভরা বা তার আদ্যিকালের গেঁয়ো চেহারা নিয়ে পড়ে থাকবে না, কলকাতার অন্য সব অঞ্চলের মতো দু-চার বছরের ভেতর জমজমাট হয়ে উঠবে।
রাস্তায় নোকজন কম। তবে সারা আকাশ জুড়ে পাখি উড়ছে ঝুঁকে ঝাকে। বেলা বেড়েছে বেশ খানিকটা।
মহেশ হালদার লেন থেকে বেরুবার পর তেমন কথা টথা বলেননি হরিচরণ। প্রায় চুপচাপ। কসবার রাস্তা ধরে খানিকটা চলার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে? বিনয় বলল, না না–বলেই তার সঙ্গে আর-একটু জুড়ে দিল, দেশে থাকতে রাস্তায় বেরুলেই তো আর ট্রাম বাস পাওয়া যেত না। বর্ষার দিনে নৌকো, নইলে বছরের বাকি সময়টা মাইলের পর মাইল হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না।
বিনয়ের কথাগুলো হরিচরণ মন দিয়ে শুনলেন বলে মনে হল না। নীরবে হাঁটতে লাগলেন। বিনয় লক্ষ করেছে, সারাটা পথ কী ভাবতে ভাবতে চলেছেন হরিচরণ। কোনও কারণে কি উদ্বিগ্ন?
হরিচরণ যদিও বলেছিলেন বেশি দূরে নয়, কিন্তু প্রায় মাইল দেড়েক হাঁটার পর যেখানে এসে তিনি থামলেন সেটা বেশ বড় একটা তেতলা বাড়ি। বয়স কম করে পঞ্চাশ ষাট বছর তো হবেই। বাড়িটা ঘিরে উঁচু দেওয়াল। দেওয়ালের মাথায় ঘন করে তারকাঁটা লাগানো। রাস্তার দিকে মজবুত লোহার গেটের মাথায় টিনের ফলকে লেখা; রেণুবালা নারী মঙ্গল কেন্দ্র।
কসবার এই অংশটা বড় বেশি নির্জন। অনেক দূরে দূরে দু-চারটে বাড়ি চোখে পড়ে।
তেতলাটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে হরিচরণ বললেন, এই আমাদের হোম
সেটা আন্দাজ করে নিয়েছিল বিনয়। হোমের মেয়েদের নিরাপত্তার কারণেই যে কমপাউণ্ড ওয়াল, তারকাটা ইত্যাদি দিয়ে বাড়িটাকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে।
হরিচরণ এবার বললেন, বেলেঘাটার এক বড় বিজনেসম্যান, তারানাথ বিশ্বাস, হোমের জন্যে এই বাড়িটা আমাদের দান করেছেন। তারানাথের ইচ্ছে তার মা রেণুবালার নামে হোমের নামকরণ করা হোক। তাই করা হয়েছে। একটু হেসে বলেন, এত বড় একটা বাড়ি কে আর আমাদের দিত? ওঁর মায়ের নামটা থাকলে অসুবিধার কী আছে বল? উদ্দেশ্যটা তো মহৎ।
গেটের একটা পাল্লা খোলা। সেখানে টুলে বসে ছিল মস্ত চেহারার পালোয়ানমার্কা অবাঙালি দারোয়ান। খুব সম্ভব ভোজপুরি। হরিচরণকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ায়। নমস্তে
হাত তুলে প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বিনয়কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন হরিচরণ।
গেটের পর খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কিছু ফুলের গাছ। তারপর মূল বিল্ডিং।
একতলার ডানপাশে একখানা বিরাট ঘর। দরজার মাথায় লেখা অফিস। ঘরের মাঝখানে একটা ড্রয়ারওলা সাবেকি মস্ত টেবল ঘিরে অনেকগুলো চেয়ার। একপাশের দেওয়াল ঘেঁষে সারি সারি পেল্লায় আলমারি। অন্য তিন দেওয়ালে মনীষীদের ছবি। রামমোহন। রামকৃষ্ণদেব। বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথ। মহাত্মা গান্ধি। নেতাজি সুভাষ।
টেবলের চারধারে কয়েকজন বসে আছেন।
ওঁরা হরিচরণের সমবয়সীই হবেন। হয়তো দু-এক বছরের ছোট বা বড়। পরনে প্রায় একই ধরনের পোশাক। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবির ওপর চাদর।
হরিচরণ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সকলে একসঙ্গে বলে ওঠেন, এসএস- বিনয়কে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটি বুঝি তোমার সেই রিপোর্টার?
হ্যাঁ। ওর নাম বিনয় টেবলের কাছে এসে হরিচরণ বয়স্ক মানুষগুলোর সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। গড়পড়তা বয়স্ক বাঙালিরা যেমন হয়, ঠিক তেমনটি। ওঁরা মোট চারজন। ওঁদের মাঝারি হাইট। শ্যামবর্ণ। আলাদা করে চোখে লাগার মতো কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। এরই মধ্যে একজনই শুধু একটু বেশি লম্বা। শীর্ণ, ফ্যাকাসে মুখ। নাম পশুপতি চট্টরাজ। চোখে যাঁর সবচেয়ে পুরু লেন্সের চশমা তিনি মেঘনাদ সিংহ। যাঁর চুল ধবধবে সাদা তার নাম লোকনাথ সাহা। অন্য দুজন পীতাম্বর মল্লিক এবং মহাদেব পালিত। এঁরা প্রত্যেকেই স্বাধীনতা-সংগ্রামী। বাইরে থেকে যতই নিরীহ, সাদামাঠা দেখতে হোক না, ভেতরে রয়েছে গনগনে আগুন। দেশপ্রেমের অনির্বাণ অগ্নিশিখা। হরিচরণ আরও জানালেন, তার মতোই এরাও চিরকুমার। সেই প্রথম যৌবনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না দেশ স্বাধীন হচ্ছে সংসারিক বন্ধনে নিজেদের জড়াবেন না। ইংরেজদের জেলে জীবনের সেরা সময়টাই তাদের ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর যখন জেল থেকে বেরুলেন শরীর ভেঙে চুরে গেলেও মনোবল কিন্তু অটুটই রয়েছে। ভেতরের আগুন নেভেনি।
মুক্তিসংগ্রামের সময় তাদের যে অসংখ্য সহযোদ্ধারা ছিলেন, সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের পর তাঁরা অনেকেই রাতারাতি বদলে গেছেন। পুরোনো লক্ষ্য, পুরোনো আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে তারা ছুটছেন অন্যদিকে। তাদের ক্ষমতা চাই, অর্থ চাই, আরাম চাই। হাতে সময় আর নেই। আয়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। যে কদিন বেঁচে থাকা, যতটা পার ভোগ করে নাও। দেশের জন্য অনেক কষ্ট সয়েছ। তার সামান্য দাম নেবে না?
কিন্তু হরিচরণ এবং অফিস ঘরে যে মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছেন তারা কিন্তু অবিচলিত। কোনও প্রলোভনই তাদের বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। পরাধীন ভারতে তাঁদের যুদ্ধটা ছিল একরকম। স্বাধীন ভারতেও তাদের লড়াই শেষ হয়নি। হাজার হাজার ধর্ষিত মেয়েকে নিজেদের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য তারা জীবন পণ করেছেন।
হরিচরণ একটা চেয়ারে বসে পড়েছিলেন। বলতে লাগলেন, তুমি জানো, আমি হিমাংশুদের কাছে থাকি। সকালে হোমে এসে রাত্তিরে ফিরে যাই। কিন্তু আমার এই বন্ধুরা আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এই হোমেই মেয়েদের আগলে সারাক্ষণ পড়ে আছে।
বিনয় একদৃষ্টে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার এগিয়ে গেল। ঝুঁকে প্রণাম করতে যাবে, লোকনাথ সাহা হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিতে দিতে বললেন, থাক থাক। এতজনকে নিচু হয়ে প্রণাম করতে হলে কোমর ব্যথা হয়ে যাবে। বোসো
বিনয় কুণ্ঠিতভাবে হাসল।
হরিচরণ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগলেন, দুর্গা–দুর্গা
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরুষালী চেহারার শক্তসমর্থ মেয়েমানুষ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। হরিচরণ তাকে বললেন, আমাদের জন্যে চা করে আন। বিনয়কে দেখিয়ে বলেন, দুপুরে ও এখানে খাবে। ওর জন্যে চাল নিস
দুর্গা মাথা হেলিয়ে দেয়, আচ্ছা—
মেয়েরা কাজ শুরু করেছে?
হ্যাঁ—
ওদের বলিস আমরা একটু পরেই যাচ্ছি।
বলব।
দুর্গা চলে গেল।
বিনয় মোটামুটি আঁচ করে নিল, এই মেয়েমানুষটিকে হোমের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
হরিচরণ এবার বিনয়কে বললেন, তুমি তো এই হোম নিয়ে লিখবে। রেণুবালা নারী মঙ্গল কেন্দ্র কীভাবে চলছে, সেটা তোমার জানা দরকার। মেঘনাদের কাছে শুনে নাও। বল হে মেঘনাদ
পকেটে নোট বই আর পেন ছিল। সেগুলো বার করে প্রস্তুত হয়ে নিল বিনয়।
বোতলের নিচের দিকের কাঁচের মতো পুরু যার চশমা, খুবই কৃশ চেহারা, সেই মেঘনাদ সিংহ বলতে শুরু করলেন। একটা বোর্ড বা পরিচালন কমিটি রয়েছে হোমের। বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হরিচরণ বসু। সেক্রেটারি লোকনাথ, সাহা। এঁদের সাহায্য করার জন্য আছেন তিনজন মেম্বার। পীতাম্বর মল্লিক, পশুপতি চট্টরাজ এবং মেঘনাদ। স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা ছাড়াও রয়েছেন বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী। তারা হোমে থাকেন না। দরকার মতো ডাকলে নানা ধরনের কাজ করে দিয়ে যান। বহু গণ্যমান্য মানুষ বোর্ডের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যুক্ত। যেমন কোনও কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, নামকরা ডাক্তার, লইয়ার, বিজনেসম্যান, ইত্যাদি। কিন্তু হোম চালানো তো মুখের কথা নয়। তার জন্য প্রচুর টাকা দরকার। মূল সমস্যাটা সেখানেই। অনেক আবেদন নিবেদন করার পরও সরকারি অনুদান এখনও পাওয়া যায়নি। সবটাই চলছে করুণার ওপর। কলকাতার কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং পয়সাওলা বড়লোক অনুগ্রহ করে টাকা পাঠান। আপাতত সেটাই ভরসা। তবে এই সাহায্য যে সময়মতো নিয়মিত আসে তা কিন্তু নয়। যারা টাকা পাঠাতে ভুলে যান, দৌড়ঝাঁপ করে তাঁদের কাছে গিয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়। মোট কথা, হোমের প্রায় এক শটি মেয়ের জীবন সরু সুতোর ওপর ঝুলছে।
টাকার কথায় হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় হরিচরণের। এবার বলে ওঠেন, কাল সন্ধেবেলা আমি যখন এখান থেকে যাই তখনও অ্যাডভোকেট সত্যজিৎ মিত্র আর রামকৃষ্ণ ট্রেডিং কোম্পানির ডোনেশেনের টাকাটা আসে নি। পরে কি এসেছে?
মেঘনাদ বললেন, হ্যাঁ। কাল তুমি যাবার অনেক পরে সেই রাত দশটায় লোক দিয়ে ওঁরা পাঠিয়েছেন।
কত পাওয়া গেল?
সাড়ে আট হাজার।
হরিচরণ বললেন, যাক, এখন মাসখানেকের জন্যে নিশ্চিন্ত। বিনয়কে নিয়ে আসার সময় কী দুর্ভাবনা যে হচ্ছিল। টাকাটা না এলে খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম।
সারাটা পথ কেন হরিচরণকে অন্যমনস্ক আর চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল, এতক্ষণে বুঝতে পারল বিনয়।
পীতাম্বর মল্লিক বললেন, টাকা আসবে কি আসবে না, এলে কখন আসবে, এই নিয়ে দিনের পর দিন দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়। বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করে ইমিডিয়েটলি গ্রান্টের ব্যবস্থা না করলেই নয়।
হরিচরণ পীতাম্বরকে বললেন, হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়িই রাইটার্সে গিয়ে বিধানবাবুর পি এর কাছ থেকে আপয়েন্টমেন্টের ডেট নিয়ে নেব। দেখা করতেই হবে।
দুর্গা চা দিয়ে গিয়েছিল। কয়েক চুমুকে শেষ করে উঠে পড়লেন হরিচরণ।–চল বিনয়– অন্যদের বললেন, তোমরাও এস
পীতাম্বর জানালেন, হোমের হিসেবপত্তর নিয়ে তাদের বসতে হবে। নতুন নতুন অনেককে ডোনেশনের জন্য চিঠি লিখতে হবে। হরিচরণই বরং বিনয়কে নিয়ে যাক।
অফিস-ঘরের পাশ দিয়ে যে প্যাসেজটা সোজা ভেতর দিকে চলে গেছে সেটা ধরে বেশ খানিকটা যাবার পর একটা টানা বারান্দা। তারপর বাউণ্ডারিওয়াল অবধি অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পর পর তিনটে লম্বা ব্যারাকের মতো শেড তোলা হয়েছে। মেঝে পাকা, মাথায় অ্যাসেবেস্টসের ছাউনি। ডান ধারের শেডে অনেকগুলো মেয়ে উঁচু কিছুর ওপর বসে একটানা ঘটর ঘটর শব্দ করে কী সব করে চলেছে। মেঝেতে বসে আছে কয়েকজন। তারাও কিছু করছে। বাঁ দিকের শেডেও অনেকগুলো মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। তারাও ঘাড় গুঁজে কিছু করছে। মাঝখানের শেডটায় কেউ নেই। সেটার একপাশে বড় বড় টিনের বাক্স ডাঁই-করা। বাকি অংশটা ফাঁকা।
হরিচরণ নিচু গলায় বললেন, মেয়েগুলোর আতঙ্কের স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে আমরা ওদের স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টা করছি। এমন কিছু জিজ্ঞেস কোরো না যাতে পুরনো কথা মনে পড়ে যায়।
আস্তে মাথা নেড়ে বিনয় জানায়, জিজ্ঞেস করবে না।
মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে জামাটামা তৈরির কাজ, চামড়ার কাজ শেখানো হয়েছে। ওদের বানানো জিনিস দোকানে দোকানে দিয়ে আসা হয়। মোটামুটি বিক্রিও হচ্ছে।
বিনয়কে নিয়ে প্রথমে ডানপাশের শেডে এলেন হরিচরণ। দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়নি, এবার দেখা গেল, মেয়েদের কেউ টুলে বসে মেশিনে ফ্রক সেলাই করছে, কেউ সায়া, কেউ ব্লাউজ। মেঝেতে যারা বসে আছে তারা পেন্সিলের দাগ দিয়ে জামাটামার জন্য নানা রঙের ছিট কাপড় কেটে চলেছে। পরে সেগুলো সেলাই করা হবে।
হরিচরণ বিনয়ের সঙ্গে মেয়েদের অলাপ করিয়ে দিলেন। এ তোদের একজন দাদা। নাম বিনয়। খুব ভাল ছেলে। তোদের কাজকর্ম দেখতে এসেছে।
বিনয়কে দেখে সেলাই কলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেঝেতে বসা মেয়েদের কচিও থেমে গেছে। সবার চোখেমুখে প্রবল অস্বস্তি। নিমেষে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।
বিনয় মেয়েগুলোর মনোভাব আন্দাজ করে নিয়েছিল। ওরা ধরেই নিয়েছে ওদের লাঞ্ছনার খবর পৃথিবীর কারও জানতে বাকি নেই। বিনয়ও কি জানে না? নিশ্চয়ই জানে। হয়তো সেই কারণেই এমন কুঁকড়ে যাওয়া।
ঝিনুকের কথা মনে পড়ে বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ফের তুমুল তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। দ্রুত চারপাশের মেয়েদের দেখে নেয় সে। না, এই শেডে ঝিনুক নেই। কিন্তু প্রতিটি মেয়ের মুখই যেন ঝিনুকের মুখ।
প্রাণপণে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে মুখে ক্ষীণ হাসি টেনে বিনয় সামনের একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, আপনার কী নাম?
মুখ নামিয়ে কাঁপা গলায় মেয়েটি বলে, মালা—
মা, বাবা, ভাই, বোন?
উত্তর নেই।
দেশ ছিল কোথায়?
উত্তর নেই।
পরপর বাকি সবাইকে একই প্রশ্ন করে নামগুলোই শুধু জানা গেল। লতা, বাণী, জবা, লক্ষ্মী ইত্যাদি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোথায় ছিল তাদের জন্মস্থান, তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি, সে-সম্বন্ধে কেউ টু শব্দটিও করল না।
বাঁ ধারের শেডটায় চামড়ার ব্যাগ তৈরি হচ্ছিল। কয়েকজন মেশিন চালাচ্ছিল, বাকি সবাই চামড়া কেটে কেটে একধারে সাজিয়ে রাখছে।
এখানেও বিনয়কে দেখামাত্র কাজ বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েগুলোর প্রতিক্রিয়া একই রকম। অচেনা একটা মানুষ আচমকা এসে পড়ায় অস্বস্তি, উদ্বেগ। কিছুটা বা ভয়। হরিচরণ অনেক করে বোঝালেও নাম ছাড়া মেয়েগুলোর মুখ থেকে আর কিছুই বার করা গেল না।
বিনয় লক্ষ করেছে এখানেও ঝিনুক নেই। ওরা যখন শেডটা থেকে বেরিয়ে আসছে, হঠাৎ শেডের অন্য প্রান্ত থেকে একটি মেয়ে দৌড়তে দৌড়তে চলে এল। খানিক আগেই তার সঙ্গে বিনয়ের কথা হয়েছে। নামটাও মনে আছে। আভা।
আভা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দাদা, আপনে আমাগো দ্যাশের কথা, মা-বাপের কথা জিগাইতে আছিলেন না? পিরথিমীতে আমাগো কেও নাই, কিছু নাই। এই আশ্রমই আমাগো দ্যাশ। হরিচরণকে দেখিয়ে বলে, এনারাই আমাগো মা-বাপ
এই মেয়েরা নিজেদের পিতৃ পরিচয়, বংশ পরিচয়, জন্মস্থান, অর্থাৎ সমস্ত অতীতকে ভুলে যেতে চাইছে। হতচকিত বিনয় জিজ্ঞেস করে, কিন্তু এখানে আসার আগে কোথাও তো ছিলেন?
আছিলাম। যমের পুরীতে। যমের পুরী? হ। ফের হরিচরণকে দেখিয়ে দেয় আভা, এনারা আমাগো হেইহান থিকা উদ্ধার কইরা নিয়া আইছেন। বলেই যেভাবে এসেছিল তেমনি ছুটতে ছুটতে ফিরে গেল।
বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে বিনয়। তার কাঁধে একখানা হাত রেখে হরিচরণ বললেন, যমপুরীটা কী, তোমাকে পরে বুঝিয়ে দেব। আজও পীতাম্বর আর আমি সেখানে যাচ্ছি। দুপুরের খাওয়া চুকিয়েই বেরিয়ে পড়ব। তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। এখন চল, অফিসে ফেরা যাক
গাঢ় বিষাদে মন ভরে গিয়েছিল বিনয়ের। নীরবে কয়েক পা হাঁটার পর সে বলে, এত করে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু মেয়েগুলো স্রেফ জানিয়ে দিল তাদের মা-বাবা নেই। পাকিস্তানে কোথায় কোথায় তাদের বাড়ি ছিল তাও জানালো না। কেন বলুন তো?
বিমর্ষ মুখে হরিচরণ বললেন, ওদের বড় কষ্ট, বড় রাগ আর অভিমান
এই মেয়েদের দুঃখের যে সীমা-পরিসীমা নেই, তার কারণ আগেই জানা হয়ে গেছে। কিন্তু মা-বাবার ওপর ক্রোধ এবং অভিমানের হেতুটা কী? সাতপুরুষের ভিটেমাটি পাকিস্তানের কোন জেলায় বা গ্রামে ছিল তার নাম মুখে আনতেই বা অসুবিধাটা কোথায়?
হরিচরণ হয়তো বিনয়ের ধন্দটা আঁচ করতে পারলেন। একটু ভেবে বিশদভাবে এবার জানালেন, হোমের মেয়েদের উদ্ধার করে আনার পর বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে রিফিউজি কলোনি কি ত্রাণশিবিরে ওদের মা-বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিজেদের ধর্ষিতসন্তানদের দেখে আকুল কান্নায় তারা ভেঙে পড়েছে। বুক চাপড়ে কত যে বিলাপ! কত যে হাহাকার! ওই পর্যন্তই। কিন্তু একজনও তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে নেয়নি। কারণ-লোকলজ্জা। কারণকে কী বলবে সেই ভয়। ওদের যুক্তিগুলো এইরকম। এমন মেয়েকে ঘরে তুললে আত্মীয় পরিজনেরা সম্পর্ক রাখবে না। পরিচিত লোকজন গায়ে থুতু দেবে। কেউ তো নিজের সংসারটুকু নিয়ে দ্বীপের মতো আলাদাভাবে টিকে থাকতে পারে না। সমাজে হাজারও মানুষের সঙ্গে বাস করতে হয়। তাছাড়া ওই একটা মাত্র মেয়েই তো নয়, হয়তো তাদের আরও দু-চারটে সন্তান আছে। অমন মেয়েকে ফেরত নিলে অন্যগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? ঘেন্নায় কেউ তাদের ছোঁয়া খাবে না, তাদের ছায়া মাড়াবে না। আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
হরিচরণরা অবিরল বুঝিয়েছেন, মেয়েগুলোর জীবনে যা ঘটে গেছে সে জন্য তারা নিজেরা এতটুকু দায়ী নয়। তাদের ফিরিয়ে নিলে দু-চারদিন লোকে হয়তো ফিসফাস করবে, ওদের দিকে আঙুল তুলে দেখাবে। তারপর চুপ হয়ে যাবে।
কিন্তু মেয়েগুলোর মা-বাপেরা কোনও কথাই কানে তোলেনি। সমানে কেঁদেছে আর না না করে গেছে। যুবতী মেয়ের শরীর যদি একবার নষ্ট হয়ে যায়–তার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়-তাকে আর। সংসারে ফেরানো যায় না। দুঃখে বুক ফেটে গেলেও তাকে বিসর্জন দিতেই হয়। দেশভাগের পর। এত যে ওলটপালট ঘটে গেছে জীবনে, যথাসর্বস্ব হারিয়েছে তারা, কিন্তু রক্তের মধ্যে পুরানো। সংস্কারগুলোকে ঠিক ধরে নিয়ে এসেছে। তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, ধর্ষিত মেয়েকে ঘরে ঢোকালে সংসারের পবিত্রতা ধ্বংস হয়ে যাবে। অগত্যা হরিচরণরা মেয়েগুলোকে হোমে আশ্রয় দিয়েছেন।
অবিকল নীলমের কাহিনি। শুধু এদের পাশে কোনও সুরেশ নেই।
শুনতে শুনতে শিউরে উঠছিল বিনয়। চোখের সামনে বার বার ঝিনুকের মুখ ফুটে উঠছে। হোমের এই মেয়েগুলো অনেক কিছু হারালেও ভেসে যাবে না। তাদের পাশে আছেন হরিচরণরা। এই হৃদয়বান, আদর্শবাদী মানুষগুলো রসাতলের প্রান্ত থেকে ওদের তুলে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ঝিনুক? সে কোথায় আছে, একেবারে শেষ হয়ে গেছে কি না, কে জানে।
হরিচরণ এবার বললেন, মা-বাপেরা নেয়নি, দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সেজন্যে মেয়েগুলোর ভীষণ ক্ষোভ, ভীষণ দুঃখ। তাই বলে, ওদের কেউ নেই। পুরো অতীতটাকেই ওরা খারিজ করে দিয়েছে।
ঝিনুকের চিন্তাটা প্রবলভাবে বিনয়কে ঝাঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। সেটা সামনে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, ক্ষোভ হবার তো কথাই।
অফিস-ঘরে এসে রেণুবালা নারী মঙ্গকেন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে লিখে নিল বিনয়। বিশেষ করে যাঁদের ডোনেশনে হোমটা চলে সেই সহৃদয় দাতাদের নাম এবং ঠিকানা। হোম
নিয়ে যে প্রতিবেদনটা তৈরি করবে তাতে এই মানুষগুলোর কথা বড় করে লিখবে। একটা মহান কাজে যাঁরা আড়ালে থেকে নিঃস্বার্থ সাহায্য করছেন তাদের সম্বন্ধে মানুষের জানা দরকার।
দুপুরবেলায়, সূর্য যখন সোজাসুজি মাথার ওপর উঠে এসেছে সেই সময় দুর্গা এসে হাজির। রান্না হয়ে গেছে। খেতে চলুন– বলেই চলে গেল।
চল হে হরিচরণ বিনয় এবং অন্য স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের নিয়ে হোমের পেছন দিকে চলে এলেন। এখানে পর পর যে তিনটে বিরাট লম্বা শেড রয়েছে তার মাঝখানেরটার বেশির ভাগ অংশই খালি পড়ে আছে। খানিক আগে শেডগুলোতে ঘুরে গেছে বিনয়। এখন দেখা গেল, মধ্যের শেডটার ফাঁকা জায়গায় মুখোমুখি দুলাইনে সারি সারি চটের আসন পাতা। প্রায় শখানেকের মতো। প্রতিটি আসনের সামনে কাঁসার থালা এবং জল ভর্তি গেলাস। থালার কোনায় নুন, কাঁচালঙ্কা এবং এক টুকরো করে লেবু।
বিনয় লক্ষ করল, দুধারের অন্য শেড দুটোয় কেউ নেই। বোঝা যাচ্ছে, দুপুরের খাওয়ার জন্য এই সময়টা কাজকর্ম বন্ধ থাকে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পেতলের বালতি বোঝাই করে দুর্গা এবং আরও চার-পাঁচটি মাঝবয়সী মেয়েমানুষ ভাত ডাল তরকারি নিয়ে এসে পাতে পাতে দিতে লাগল।
দুর্গা প্রায় দশভুজা। দুহাতে নয়, যেন দশ হাতে পরিবেশন করে চলেছে। যন্ত্রের মত। সেই সঙ্গে মুখও চলছে বিরামহীন। তার সঙ্গিনীদের সমানে বলে চলেছে–কার পাতে ডাল পড়েনি, কাকে ভাত দিতে হবে, ইত্যাদি। দুর্গা যে একজন তুখোড় দলনেত্রী, সেটা তার তৎপরতা দেখে টের পাওয়া যায়।
হরিচরণের ঠিক বাঁ পাশে বসে খাচ্ছিল বিনয়। আয়োজন খুবই সাদামাঠা। মোটা চালের ভাত, মুসুর ডাল, আলু ভাজা আর নানারকম আনাজ দিয়ে একটা তরকারি।
হরিচরণ বললেন, তোমার খুব কষ্ট হল বিনয়
বিনয় খেতে খেতে হোমের মেয়েগুলোকে দেখছিল। সারি দিয়ে বসে তারাও খাচ্ছে। নীরবে, নতমুখে। কেমন যেন আড়ষ্ট। ওদের দিকে চোখ রেখেই সে জিজ্ঞেস করে, কীসের কষ্ট?
মাছ নেই, মাংস নেই, গাবের দানার মতো রেশনের চালের ভাত, ট্যালটেলে ডাল
হরিণচরণের কথার মধ্যেই মেয়েদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিনয় বলে, আমার একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। আপনারা খেতে পারছেন, আর আমি পারব না?
হোমে বিনয়ের আপ্যায়নটা যে ঠিকমতো হচ্ছে না, সেজন্য হরিচরণ হয়তো সংকোচ বোধ করছেন। খানিকটা কৈফিয়ৎ দেবার সুরে বললেন, আসলে ডোনেশন বাবদ যা পাওয়া যায় তা দিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব না। কোনওরকমে মেয়েগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা আর কি।
বিনয় বলল, আমি কি তা বুঝি না? এ নিয়ে আর কিছু বললে কিন্তু খুব লজ্জা পাব।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি খাও।
বিনয়ের চোখ আবার মেয়েদের দিকে ফিরে যায়। ফের কী বলতে গিয়ে সেটা লক্ষ করেন হরিচরণ। নিচু গলায় বলেন, বুঝলে বিনয়, এই মেয়েরা গোড়ার দিকে আমাদের সঙ্গে খেতে বসতে চাইত না। আমরাই জোর করে বসাই। ওদের সঙ্গে এমনভাবে মিশি, গল্প করি, একসঙ্গে বসে খাই, যাতে মেয়েগুলো সমস্ত গ্লানি ভুলে গিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু—
প্রথম আলাপের দিন থেকেই এই স্বাধীনতা-সংগ্রামীটির প্রতি বিনয়ের অনন্ত শ্রদ্ধা। হোমে এসে সেটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। শুধু তিনিই নন, তার পুরানো সহযোদ্ধারা–পশুপতি চট্টরাজ, মেঘনাদ সিংহ, পীতাম্বর মল্লিক, লোকনাথ সাহাদের যত দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অফুরান বিস্ময়ে পূর্ণ হচ্ছে মন। হেমনাথ আর ফাদার লারমার ছাড়া এমন উদারতা, এত মহানুভবতা কি। আগে আর কারও মধ্যে দেখেছে বিনয়? মনে তো পড়ে না। হরিচরণের কথার খেই ধরে সে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কী?
এখনও ওরা পুরোপুরি সহজ হতে পারেনি। আমাদের সামনে তবু খানিকটা নর্মাল থাকে। কথা বলে, গল্প করে, মজার কথায় হাসে। কিন্তু নতুন কারওকে দেখলে গুটিয়ে যায়। এই যে তুমি এসেছ, ওরা একদম চুপ হয়ে গেছে। হয়তো ভাবছে, মনে মনে ওদের তুমি ঘেন্না করছ। এই ধরনের দুঃখী মেয়েদের মারাত্মক কমপ্লেক্স থাকে।
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, খাওয়া দাওয়া চুকে গেলে এক মুহূর্তও দেরি করা হবে না। সেই মতো পীতাম্বর মল্লিক এবং বিনয়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হরিচরণ। মিনিট চল্লিশের ভেতর বালিগঞ্জ স্টেশন পেরিয়ে রাসবিহারীতে এসে বাসে উঠলেন ওঁরা।
৬৪.
মানিকতলায় নেমে যে রাস্তাটা সোজা ডান দিকে গেছে সেটা ধরে অনেকটা এগুবার পর বাঁ ধারের একটা গলিতে ঢুকলেন হরিচরণ। কয়েক পা যেতেই বিরাট এলাকা জুড়ে একটা চাপ-বাঁধা। বস্তি। মাথায় টালির চাল। গলির দিকে মস্ত সদর দরজাটা হাট করে খোলা। তাই ভেতরের অনেকটা অংশ চোখে পড়ছে। প্রকাণ্ড একটা বাঁধানো চাতাল ঘিরে সারি সারি কত যে ছোট ছোট কুঠুরি তার লেখাজোখা নেই।
চাতালে আসন বা কাঠের জলচৌকিতে বসে অগুনতি যুবতী–ষোল থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ অবধি। বয়স–এখন, এই পড়ন্ত বেলায় সাজগোজ শুরু করেছে। কেউ চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে খোঁপা বাঁধছে, কেউ চোখে সরু করে কাজল টানছে, কেউ বা মুখের সামনে হাত-আয়না ধরে গালে আর ঠোঁটে গোলাপি রং মাখছে। নিজেদের কতভাবে মোহিনী করে তোলা যায়, চলছে তারই ব্যাপক প্রস্তুতি।
যমের পুরীটা যে কী, এতক্ষণে তা বুঝতে পারে বিনয়। সিনেমায় পতিতাপল্লির ছবি দেখেছে সে। গল্প-উপন্যাসে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনাও পড়েছে। কিন্তু এমন একটা নিষিদ্ধ এলাকায় কখনও আসতে হবে, কোনওদিন কি তা সে ভাবতে পেরেছে।
বিনয়ের বুকের ভেতরটা চিরতে চিরতে ধারালো করাত যেন ওঠানামা করছে। হৃৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পরক্ষণে মনে হল, সেটা এত জোরে লাফাচ্ছে যেন হাড়-মাংস ভেদ করে বেরিয়ে আসবে। মাথা ঝিম ঝিম।
যখন সে খানিকটা সামলে নিয়েছে, হরিচরণের গলা কানে এল, কই গো মা জননীরা, নিশিবালা কোথায়? বস্তির ভেতরে ঢোকেননি, সদর দরজার বাইরে থেকেই তিনি কথাগুলো বলেছেন।
মেয়েরা প্রসাধনে এমনই মজে ছিল, হরিচরণদের লক্ষ করেনি। সাজসজ্জা স্থগিত রেখে কজন চকিতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর শুরু হয়ে যায় তুমুল হইচই।
মাসি-মাসি
তরাতরি আসো। দেখ মাসি, হেরা আবার আইছে–
মেয়েদের মধ্যে অনেকেই যে পূর্ব পাকিস্তানের, এবং খুব বেশিদিন যে তারা এখানে আসেনি, কথা শুনে টের পেল বিনয়। এটাও বোঝা গেল, এখানে হরিচরণরা অপরিচিত নন। আগেও তারা এই পাড়ায় এসেছেন।
মেয়েদের ডাকাডাকি শেষ হতে না-হতেই ডানধারের শেষ কুঠুরি থেকে যে মাঝবয়সী মেয়েমানুষটি ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল তার রং চকচকে কালো, যেন সারা গায়ে ঘাম তেল মাখানো। মুখ গোলাকার। ঘাড়ে-গর্দানে ঠাসা। বড় বড় লালচে চোখ। পা থেকে গলা পর্যন্ত থাক থাক চর্বি। সাজের বাহারও যথেষ্ট। হাতে, গোছ গোছ সোনার চুড়ি, বাউটি। নাকে ফাঁদি নথ। গলায় সাত নহর হার। পরনে ক্যাটকেটে সবুজ শাড়ি। এলো চুল উড়ছে।
সদরের কাছে এসে হরিচরণদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েমানুষটি। বিনয় আন্দাজ করে নেয় সে-ই নিশিবালা। এই পাড়ার মাসি।
নিশিবালা যতই রণচণ্ডীমার্কা হোক, তার কথাবার্তা এবং আচরণ কিন্তু পুরোপুরি উলটো। চেহারার সঙ্গে সে-সরের আদৌ মিল নেই। বিপুল শরীর নিয়ে অতি কষ্টে, প্রচুর কসরত করে, চাতালে মাথা ঠেকিয়ে হরিচরণ আর পীতাম্বরের উদ্দেশে প্রণাম সেরে জোড়হাতে উঠে দাঁড়ায় সে গলায় অঢেল বিনয় মিশিয়ে বলে, বাবারা, এই নিয়ে তিনদিন একেনে এলেন। আপনাদের মতো মানী নোকেঁদের কি এই পচা আঁস্তাকুড়ে আসাটা মানায়?
বিনয় হরিচরণদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। বস্তির অন্য মেয়েগুলোর কথায় জানা গেছে হরিচরণরা আগেও এ-পাড়ায় এসেছেন। নিশিবালা সেটা আরও স্পষ্ট করে দিল।
বিনয় লক্ষ করেছে, দুই স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে নিশিবালা ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূর থেকে প্রণাম করল। হয়তো তার ধারণা, তার স্পর্শে হরিচরণরা রুষ্ট হবেন, কিংবা তাদের পবিত্র শরীর অশুদ্ধ হয়ে যাবে।
হরিচরণ বললেন, রাস্তায় দাঁড়িয়েই কি কথা বলব?
কী ভেবে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিশিবালা বলল, আচ্ছা আসুন। কিন্তুন
ভেতরে যেতে যেতে হরিচরণ জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কী?
নিশিবালা হরিচরণদের কোনও ঘরে নিয়ে গেল না। তিনখানা কাঠের চেয়ার আনিয়ে চাতালেই ওঁদের বসালো। কাঠে হয়তো স্পর্শদোষ নেই, তাই চেয়ারের ব্যবস্থা। নইলে বিনয়দের দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।
নিশিবালা এবার হরিচরণের প্রশ্নটার উত্তর দিল, বাবারা বার বার এই নদ্দমায় এলে আপনাদের দুন্নাম হয়ে যাবে।
পীতাম্বর বললেন, তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছি। দুর্নামের ভয় করি না। দেশের মানুষ আমাদের চেনে। এই বয়েসে আমরা গোল্লায় গেছি, একজনও তা বিশ্বাস করবে না। তাদের চরিত্রের ভিতটি যে কোনও কারণেই ধসে পড়ার নয়, মুখে চুনকালি লাগারও যে একটুকু সম্ভাবনা নেই, সেটা দৃঢ়ভাবে বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
বিনয় ওঁদের কথা শুনছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের অজান্তেই বুঝিবা অবিরল তার চোখ অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। খানিক দূরে চাতালের একধারে যুবতী মেয়েগুলো গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। চাপা গলায় ফিস ফিস করে কথা বলছে। সেখান থেকে অস্পষ্ট গুঞ্জনের মতো আওয়াজ আসছে।
নিশিবালা আচমকা বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে ওঠে, আপনারা আসেন আসেন, তা এই উঁচুকা বয়েসের (যুবক) ছেলেটাকে লিয়ে এয়েচেন কেন গো বাবারা? এনার মতি ভেরম (এম) হতে কতক্ষণ?
ইঙ্গিতটার মধ্যে এতটুকু ধোঁয়াটে ব্যাপার নেই। জলের মতো তা স্বচ্ছ। পীতাম্বর বা হরিচরণ চিরকুমার। দেশের জন্য আজন্ম ব্রহ্মচর্য পালন করে এসেছেন। পরকালের দোরগোড়ায় পৌঁছে তাদের আর পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু উঠতি বয়সের একটা ছেলের পক্ষে নিজেকে সামলে রাখা মুশকিল। সোজাসাপটা যাকে বলে বেশ্যাপট্টি এটা হল তাই। এখানে শরীরের পসরা সাজিয়ে গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে শিকার ধরার জন্য ওত পেতে আছে। যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও যুবক ঘাড় গুঁজে লাট খেয়ে পড়বে।
নিশিবালা বলতে লাগল, আপনাদের মতো বড় মানুষদের সঙ্গে এয়েছে বলে এত কথা বললাম। নইলে আমাদেরই তো ভাল-খদ্দের যত বাড়ে।
হরিচরণ গম্ভীর স্বরে বললেন, ওর স্বভাব অত ঠুনকো নয়। ওকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আগের তিন তিন বার এসে তোমাকে কী বলে গিয়েছিলাম, মনে আছে?
নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে দেয় নিশিবালা–আছে।
এখানকার মেয়েদের আমার কথাগুলো জানিয়েছ?
নিশিবালা উত্তর দিল না। হরিচরণ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে বলনি।
না, বলিনি- আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে নিশিবালা।
ঠিক আছে, তুমি যখন বলবেই না, আমাকেই তাহলে বলতে হবে—
না না– আচমকা যেন ঝাঁকুনি খেয়ে চকিত হয়ে ওঠে নিশিবালা। এতক্ষণ পা থেকে মাথা অবধি বিনয় এবং নম্রতার যে খোলসটা আঁটা ছিল, ঝাড়া দিয়ে সেটা খসিয়ে ফেলে তার ভেতর থেকে উগ্র একটা মেয়েমানুষ বেরিয়ে আসে। খানিক দূরে অল্পবয়সী মেয়েদের জটলাটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে কর্কশ গলায় ধমকে ওঠে, অ্যাই, তোরা এখেনে পেঁড়িয়ে সং দেকচিস। যা, ভাগ। যে যার ঘরে গে সাজগোজ কর ।
সিনেমায় আর গল্প-উপন্যাসে যে মাসি বা বাড়িউলিরা বিপুল দাপটে বেশ্যাপাড়া চালায়, তাদের একটি জীবন্ত নমুনা এই প্রথম স্বচক্ষে দেখতে পেল বিনয়। লক্ষ করল, মেয়েগুলো নিশিবালার মুখের ওপর একটি কথাও বলল না। তড়বড় করে দৌড়তে দৌড়তে ইঁদুরের গর্তের মতো সারিবদ্ধ খুপরিগুলোতে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
নিশিবালা ফের বিনয়দের দিকে তাকায়। হরিচরণ বলেন, দেখ মা, পাকিস্তানের অনেক মেয়ে নিরুপায় হয়ে, নেহাত পেটের দায়ে তোমাদের এখানে এসে উঠেছে। বড় দুঃখী এরা। তিনি বিশদভাবে বলতে লাগলেন, দেশভাগ না হলে এমন দুর্ভাগ্য তাদের হতো না। স্বাভাবিক জীবন থেকে ওরা বঞ্চিত হতো না। বিয়ে হতো, সন্তান হতো। স্বামী-সংসার আত্মীয়-পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, যেমন আবহমান কাল হাজার হাজার তরুণী কাটিয়ে এসেছে।
হরিচরণ থামেননি, নিশিবালা তুমি ওদের মায়ের মতো। মেয়েগুলোকে ছেড়ে দাও। তোমাকে আগেও এসে বলে গেছি, এখনও বলছি, আমরা একটা হোম খুলেছি। দেশভাগ হওয়ার জন্যে যে মেয়েদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, তাদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। ওরা যাতে পুরনো দুঃস্বপ্ন ভুলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেই চেষ্টা করছি। তুমি ওদের আটকে রেখো না।
বিনয়ের খোলসটা আবার সারা শরীরে জড়িয়ে নিয়েছিল নিশিবালা। তবু তার চোখমুখ দেখে মনে হল, হরিচরণের আর্জি তাকে লেশমাত্র নাড়া দিতে পারেনি। সে চুপ করে থাকে।
আভা বলেছিল, রেণুবালা নারী মঙ্গল কেন্দ্র-এ যাবার আগে সে ছিল যমের পুরীতে। হরিচরণের মতো একজন অতি শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা কোন নরক ঘেঁটে ঘেঁটে লাঞ্ছিত মেয়েদের তুলে নিয়ে তাদের হোমে আশ্রয় দিয়েছেন, এবং এ-জাতীয় আরও অনেককে উদ্ধার করতে অনবরত ছোটাছুটি করছেন, এতক্ষণে জানতে পারল বিনয়।
খানিকক্ষণ নীরব থাকার পর নিশিবালা বলল, বাবা, আপনি যা কইচেন, সেটি আর সোম্ভব লয়–
কণ্ঠস্বর সামান্য উঁচুতে তুলে হরিচরণ জিজ্ঞেস করেন, কেন নয়? তুমি কি চাও না, মেয়েগুলোর ভাল হোক?
দুটো প্রশ্নকেই তেমন আমল দিল না নিশিবালা।–আমার চাওয়া-চাওয়ির ওপর একন আর কিছু নের্ভর করে না।
তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
আপনাদের মতো পণ্ডিত নোক এই সোজা কতাটা বুঝতে পারলেন না? রীতিমতো অবাকই হল নিশিবালা, অদ্দেষ্ট বাবা, অদ্দেষ্ট
ব্যাপারটা এখনও বোধগম্য হল না। হরিচরণ জিজ্ঞেস করলেন, কীসের অদৃষ্ট?
একবার আমাদের একেনে নাম নেখালে আর ফেরার উপায় লেই। নেয়তি–সবই নেয়তি।
হরিচরণ কী উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, মেয়েমানুষটা ফের বলে ওঠে, বাবারা, ওরা য্যাকন নদ্দমার পাঁক গায়ে মেকেছে, বাকি জেবনটা ওই পাঁক মেকেই যেতে হবে। এটাই ওদের কপালের নেখন (লেখন)।
মেয়েগুলোর এই নোংরা, গ্লানিকর জীবন যে নিয়তি-নির্দিষ্ট সে-সম্বন্ধে লেশমাত্র সংশয় নেই নিশিবালার। তার কথাগুলো হরিচরণের এক কান দিয়ে ঢুকে আর-এক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। বললেন, তবু আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি না
য্যাতই চেষ্টা করুন, মেইয়েছেলে একবার এ-পাড়ায় এসে ঢুকলে তাদের সতী সাবিত্তিরি করা যায় না। ওরা একেনে য্যাকন ঢুকেছে, একেনেই থেকে যাবে।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন পীতাম্বর। এবার বললেন, ঠিক আছে, ওদের ডাকো। আমরা একটু কথা বলি। যদি সব শুনে মনে করে আমাদের সঙ্গে গেলে ভাল হবে–যাবে। নইলে তুমি যা বললে তাই হবে। এখানেই থাকবে।
নিশিবালা এই প্রথম অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, না না, ডাকা যাবে না। বাবারা, বুজতে পারছেন না–এটা আমাদের ব্যবসা। কেন সেটি মাটি করতে চাইছেন?
বিনয় হরিচণদের পাশে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু তার নজর বার বার দূরের কুঠুরিগুলোর দিকে চলে যাচ্ছিল। মেয়েগুলোরও কৌতূহলের সীমা-পরিসীমা নেই। নিশিবালার তাড়ায় চাতাল থেকে ওদের চলে যেতে হয়েছিল; কিন্তু দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে জোড়া জোড়া চোখ এদিকেই স্থির হয়ে আছে। কান খাড়া করে হরিচরণদের কথাগুলো তারা গোগ্রাসে গিলছিল।
এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিনয় টের পেয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের ধর্ষিতারা অনেকেই রসাতলের এই শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে। এমনও হতে পারে, নিখোঁজ হয়ে যাবার পর ঝিনুকও নানা জায়গায় ধাক্কা খেতে খেতে এই নরকে ঠাঁই নিয়েছে; চিন্তাটা মাথায় আসতেই দম আটকে যায়। উদ্ভ্রান্তের মতো তার চোখ কুঠুরির পর কুঠুরি পেরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়েগুলোর মুখ দেখতে থাকে। না, ঝিনুক নেই।
শ্বাস-প্রশ্বাস ফের যখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, আচমকা খেয়াল হয়, মানিকতলার এই ভোলার চালের বস্তিটাই তো একমাত্র নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এরকম আরও কত যে নরকের খাসতালুক রয়েছে। তার লেখাজোখা নেই। তেমন কোথাও তো ঝিনুক থাকতে পারে। হরিচরণরা একের পর এক এই সব এলাকায় হানা দিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করে আনার চেষ্টা করছেন। বিনয় সব সময় পারবে না, তার মাথায় অফিসের হাজারটা অ্যাসাইনমেন্ট চাপানো রয়েছে। সে ঠিক করে ফেলল, কাজের ফাঁকে ফাঁকে হরিচরণদের সঙ্গে মেয়েপাড়াগুলোতে যাবে।
ঈশ্বর সম্বন্ধে বিনয়ের ধারণা ধোঁয়াটে। পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, আবার অবিশ্বাসটাও তত জোরালো নয়। তবে এই মুহূর্তে মনে মনে ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করল, হে ঈশ্বর, নিষিদ্ধ পল্লিগুলোতে যাব ঠিকই, কিন্তু ঝিনুকের সঙ্গে যেন ওইসব এলাকায় দেখা না হয়।
ওদিকে নিশিবালা বলছিল, বাবারা, বেলা পড়ে গেছে। এবেরে আপনারা আসুন। মেয়েরা একনও তৈরি হয়নি। ইদিকে দোকান খোলার সময় হয়ে এল।
সূর্যটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর আড়ালে সেটা নেমে গেছে। যে নিবু নিবু মলিন আলোটুকু এখনও আবছা ভাবে রাস্তাঘাট, দালান কোঠা এবং গাছপালার গায়ে লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? চারদিক ঝাপসা ঝাপসা। সারা শহর যেন গায়ে উলঙ্গ বাহার শাড়ি জড়িয়ে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে সন্ধে নেমে যাবে।
নিশিবালা আকাশের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো তাড়া লাগায়, যান বাবারা, যান। সোনার চাঁদেরা একুনি এসে পড়বে
সোনার চাঁদ?
হেই যে গো-মাতাল দাঁতালের পাল। আমাদের রাত্তিরির খদ্দের। এক-একটা গু-খেকোর ব্যাটা। তাদের যা মুখ-কী কইব! যেন কঁচা নদ্দমা। আপনাদের মতো মান্যিগণ্যি নোকেরা সে-সব খিস্তি খেউড় সহ্যি করতে পারবেন না। বাবারা, আর দেরি করবেন না।
এরপর আর বসে থাকা যায় না। উঠে পড়তে পড়তে হরিচরণ বললেন, আজও আমরা খালি হাতে চলে যাচ্ছি। তবে ফের আসব–
নিশিবালা ঝাঝালো গলায় বলে, না। হাতজোড় করে কইচি, আসবেন না।
হরিচরণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
নিশিবালা গলার স্বর আরও অনেকটা ওপরে তোলে। আমাদের মেয়েগুলোনকে ফুসলে ফুসলে নে যাবেন। আর আমরা কারবার গুটিয়ে কপালে তেলক কেটে কেত্তন গাইব–সিটি হবে না। ঢের সোম্মান আপনেদের দিইচি। এর পর এলে ঝামেলি হয়ে যাবে। মাথা গরম হলে আমার মুখি নাগাম (লাগাম) থাকে না। বাপ মা, চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছাড়ি। চলে যান–চলে যান
নিশিবালার আসল স্বরূপটি উগ্র মূর্তিতে বেরিয়ে আসতে থাকে। নরকের এই অন্দর মহলে সে যে জবরদস্ত পাহারাদারনী, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। এখানকার একটি মেয়েকেও সে যে সহজে, ছেড়ে দেবে না, সেটা পরিষ্কার।
হরিচরণের ধৈর্যের, সহনশীলতার সীমা-পরিসীমা নেই। তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। হাসি মুখে, খুব স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, আমাদের অপমান করবে তো?
নিশিবালা উত্তর দিল না। তার চোখের তারা দুটো ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে।
হরিচরণ থামেননি, ঠিক আছে, তাই কোরো। যত পার গালাগাল দিও। কিন্তু আমাদের গায়ের চামড়া ভীষণ পুরু। ও-সব বিধবে না। একটা কথা শুনে রাখ, যতক্ষণ না মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছ, আমরা আসবই। ওরা এখানে থাকবে, না আমাদের সঙ্গে যাবে, সেটা ওদের মুখেই শুনতে চাই।
হরিচরণ বিনয়দের দিকে ফিরে বললেন, চল হে–
ওরা যখন সদর দরজায় চলে এসেছে, ঠিক সেই সময় একটি যুবতী মেয়েকে দেখা গেল। গলির দিক থেকে সে এখানেই আসছে। বয়স তেইশ চব্বিশ।
ঘনিয়ে আসা সন্ধের অস্পষ্ট অন্ধকারেও তরুণীটিকে চেনা গেল– ছায়া। জামতলি হাইস্কুলের মৃত হেডমাস্টার রামরতন গাঙ্গুলির মেয়ে।
মুহূর্তে বিনয়ের হৃৎপিণ্ডের উত্থানপতন বন্ধ হয়ে গেল।
চারপাশের বাড়িগুলোতে এর মধ্যে দু-চারটি আলো জ্বলে উঠেছে। কর্পোরেশনের লোকেরা এসে কখন যে রাস্তায় গ্যাস বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে দিয়েছিল টের পাওয়া যায়নি।
ছায়া থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েক পলক বিহুলের মতো তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। নরকের সিংদরজায় আচমকা বিনয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, হয়তো সে ভাবতে পারেনি। বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। তার মুখে কত রকমের অনুভূতি যে ফুটে উঠতে থাকে! ভয়। আতঙ্ক। গহিত কোনও অপরাধ ধরা পড়ে যাবার জন্য তীব্র গ্লানিবোধ। চকিতে মুখ ফিরিয়ে এক দৌড়ে মেয়েপাড়ায় ঢুকে পড়ে সে।
ছায়া হাত তুলে ডাকতে গিয়ে থেমে যায় বিনয়। একবার ভাবে, ভেতরে গিয়ে ছায়াকে জিজ্ঞেস করে, এখানে কী করে এসে সে পৌঁছল? তার মা এবং অন্য দুই বোন কোথায় রয়েছে? কিন্তু কিছুই করা গেল না। কেউ যেন পেরেক ঠকে তার পা দুটো রাস্তায় গেঁথে দিয়েছে।
এদিকে হরিচরণরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তাদের খেয়াল হয়, বিনয় সঙ্গে আসেনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে হরিচরণ গলা উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগলেন, বিনয়-বিনয়
প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে যেন সম্বিত ফিরে পায় বিনয়। ছুটতে ছুটতে হরিচরণদের কাছে চলে আসে সে।
হরিচরণ জিজ্ঞেস করেন, ওখানে কী করছিলে?
ছায়ার কথা জানাতে গিয়েও কী ভেবে জানায় না। বিনয় শুধু বলে, না, কিছু না
হরিচরণ স্থির দৃষ্টিতে বিনয়কে লক্ষ করেন। তবে আর কোনও প্রশ্ন করেন না।
বড় রাস্তায় এসে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বালিগঞ্জের বাস এসে গেল। পীতাম্বর উঠে পড়লেন। বালিগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে তিনি কসবায় রেণুবালা নারী মঙ্গল কেন্দ্র-এ চলে যাবেন।
হরিচরণদের ধর্মতলায় গিয়ে ভবানীপুরের বাস বা ট্রাম ধরতে হবে। স্টপেজে মিনিট দশেক দাঁড়াবার পর তাদের বাসও এসে গেল।
ফাঁকা বাসে হরিচরণের পাশে মুহ্যমানের মতো বসে ছিল বিনয়। রামরতন গাঙ্গুলি নামে একটি মানুষ নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, বিশাল কেরিয়ারের স্বপ্নকে হেলায় তুচ্ছ করে পূর্ব বাংলার অজ গ্রামগুলোতে শিক্ষার আলো জ্বালাবার ব্রত নিয়েছিলেন। আদর্শবাদী মানুষটি সারা জীবন জাতি গঠনের কাজে নিজের সর্বস্ব সঁপে দিয়েছিলেন। আর তার পরিবার? ছায়া কোথায় এসে ঠেকেছে তা তো নিজের চোখেই দেখে এল বিনয়। অন্য দুই মেয়ে-মায়া এবং বাসন্তী, তাঁর স্ত্রী-তারা কোথায় আছে, কীভাবে তাদের দিন কাটছে, কিছুই জানা হয়নি। তবে ওরা যে কেউ ভাল নেই সেজন্য খুব জোরালো অনুমানশক্তির দরকার নেই। রামরতন গাঙ্গুলির পরিবারের কি এমন পরিণতি প্রাপ্য ছিল?
অপরাধবোধ, পাপবোধ আর অসহ্য গ্লানিতে কুঁকড়ে যাচ্ছে বিনয়। এই সেদিন টাকা নিয়ে মদন বড়াল লেনে বিমলের বাসায় গিয়েছিল সে। গিয়ে কী শুনল? রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েরা কারওকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছে। মাত্র দুটো দিন দেরি হওয়ার কারণে ছায়াদের চরম ক্ষতিটা হয়ে গেল। তীব্র অনুশোচনায় তার বুকের ভেতরটা পুড়তে থাকে। তার মধ্যেই সে মনস্থির করে ফেলে ছায়াকে মানিকতলার ওই নরককুণ্ড থৈকে উদ্ধার করে আনবে। সুস্থ, স্বাভাবিক নিরাপদ জীবনে মেয়েটা যাতে ফিরতে পারে সেজন্য যা যা করা দরকার তাই করবে বিনয়।
সারারাত ভাল করে ঘুমোতে পারেনি বিনয়। বার বার ছায়ার মুখটা তার চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল। আবেগের বশে, প্রবল অনুতাপে সে ভেবে রেখেছে মানিকতলার ওই আস্তাকুঁড় থেকে ছায়াকে বার করে আনবে। কিন্তু সমস্যা হল সেটা কীভাবে সম্ভব? পদ্ধতিটা কী? বিকেলে পলকের জন্য দেখা হলেও ছায়া কথা বলেনি। দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরেও যদি দেখা হয়, সে এড়িয়ে যাবে। এদিকে নিশিবালা ছায়াকে কোনওভাবেই হাতের মুঠো থেকে বেরুতে দেবে না। তার পোষা গুণ্ডাবাহিনী রয়েছে। ছায়াকে বার করে আনতে গেলে সে তাদের লেলিয়ে দেবে।
হঠাৎ অদম্য জেদ বিনয়ের ওপর ভর করে। হরিচরণ বলেছিলেন, দুচারদিন পর আবার মানিকতলার ওই মেয়েপাড়ায় যাবেন। কিন্তু এত দেরি করা চলবে না। যা করার ঝড়ের গতিতে করতে হবে। কালই আবার মানিকতলায় যাবে সে। এবার একা। যে পাপ করেছে তার স্খলন না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
পরদিন সকালে উঠে গরম জলে চান সেরে প্রসাদের ঘরে এসে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে রুটি কেটে মাখন লাগাতে লাগল বিনয়। দিনের কর্মসূচি এভাবেই শুরু হল তার।
বিফিউজিদের রোগা রোগা বাচ্চাগুলো তাদের বরাদ্দ রুটি-টুটি নিয়ে যাবার পর সকালের জলখাবার খেয়ে, প্রসাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়। আজ আর দূরের কোনও কলোনি বা ক্যাম্পে যাবে না সে। তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
তার মাথায় মানিকতলার মেয়েপাড়াটা অবিরল পাক খেয়ে চলেছে। অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ্য নেই। ঢাকুরিয়া লেকের কাছাকাছি একটা ক্যাম্পে গিয়ে কোনও রকমে কাজ সেরে খালসা হোটেলে রুটি মাংস খেয়ে সে ছুটল মানিকতলায়। বারোটা নাগাদ সেখানে পৌঁছে গেল।
সদর দরজায় বাইরে থেকে ভেতরের চৌকো, মস্ত চাতালে কালকের সেই দৃশ্যটাই দেখতে পেল বিনয়। এই ভরদুপুরে এখানকার মেয়েরা থোকায় থোকায় বসে আছে। চলছে কলকলানি। মাঝে মাঝে কোনও রগড়ের কথায় উঠছে হাসির লহর। এ ওর গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে।
একটু লক্ষ করতে অবশ্য খানিকটা তফাত চোখে পড়ল। কাল বিনয়রা এসেছিল পড়ন্ত বেলায়। তখন মেয়েগুলো পরিপাটি করে সাজতে বসেছে। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকাটা নরক গুলজার হয়ে উঠবে, চলছিল তারই আয়োজন।
কিন্তু এই দুপুরবেলায় সবাই রয়েছে হালকা রং-তামাশার মেজাজে। সন্ধের এখনও ঢের দেরি। বেলা হেললে তবেই না সাজগোজের জিনিস নিয়ে বসবে।
বিনয় লক্ষ করল, সবারই চান হয়ে গেছে। তাদের ভোলা চুল পিঠময় ছড়ানো। গুলতানি করতে করতে রোদে ভেজা চুল শুকিয়ে নিচ্ছে তারা।
সদর দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়েই আছে বিনয়। মাথায় প্রবল জেদ ঠেসে নিয়ে মানিকতলায় ছুটে এসেছিল কিন্তু এখন কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ভেতরকার জমাট সাহস, মনের জোর আর আগের মতো অটুট নেই, ধসে ধসে পড়ছে। তবু তারই মধ্যে মেয়েদের দঙ্গলে ছায়াকে খুঁজতে লাগল।
চাতালের মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে চটের আসনে থেবড়ে বসে পান চিবুচ্ছিল নিশিবালা। হঠাৎ সে বিনয়কে দেখতে পায়। কিছুক্ষণ মেয়েমানুষটার চোখের পাতা পড়ে না। একসময় হাতের ভর দিয়ে থলথলে বিপুল শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করায়। একমুখ হেসে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকতে থাকে, অ মা, কালকের সেই কচি বাবুটি যে গ! তা উশীদের (উর্বশীদের) পাড়ায় এসে দোরগোড়ায় পেঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন–।
বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে বিনয়ের। কাল দুটো ঢাল ছিল তার সামনে-হরিচরণ এবং পীতাম্বর। সে তাঁদের আড়ালে থাকতে পেরেছিল। কিন্তু আজ নিশিবালার চোখে পড়ে গেছে। পালিয়ে যে যাবে, এখন তার উপায় নেই। তাছাড়া যে কারণে তার অনুশোচনার সীমা-পরিসীমা নেই, যে কারণে তার মানিকতলায় ছুটে আসা তার শেষ না দেখে চলে যাওয়া যায় না। বিনয় নিশিবালার দিকে চোখ রেখে চাতালে চলে এল।
কালকের মতোই একটা মেয়েকে দিয়ে চেয়ার আনিয়ে বিনয়কে বসালো নিশিবালা। এদিকে মেয়েরা কঁক বেঁধে উঠে এসে কলর বলর শুরু করে দিল।
আমাদের রসের নাগর এয়েচে গ।
বাবু কাল রাত্তিরি ঘুমুতে পারেনি বুজি? পেরানে কুরুকুরুনি জেগেছিল?
ভিড়ের ভেতর থেকে অন্য একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করে, কী করে বুজলি?
আগের মেয়েটি বলে, লইলে দুক্কুর হতে না-হতে পাড়ায় এসে হাজির হতো! আমাদের ওপর কী টান গ।
বাবুটি কত কষ্ট করে এয়েচে। তোরা তার পেছুতে লাগলি কেন? চুপ কর দিকিনি নিশিবালা হাত তুলে ধমক দেয় ঠিকই, তবে তাতে খানিক আশকারা মেশানো
মাসির কথায় কখন চুপ করতে হবে, কখন হবে না, মেয়েগুলো সেটা খুব ভালই জানে। তারা সমানে হইচই করতেই থাকে।
নিশিবালা বিনয়ের দিকে মুখ ফেরায়।–তা বাবু, সেই বুড়ো বাবা দুজন কোতায়? তেনাদের তো দেখছি না।
মেয়েগুলোর টিপন্নীতে নাকমুখ ঝাঁ ঝাঁ করছিল বিনয়ের। মুখ নামিয়ে বলল, ওঁরা আসেননি।
মুখে মিচকে হাসি ফুটিয়ে, একটা চোখ আধবোজা করে কিছুক্ষণ চবর চবর পান চিবোয় নিশিবালা। তারপর গলার স্বরে ঢেউ খেলিয়ে বলে, আপনি তা হলি তেনাদের না জানিয়ে নুকে নুকে (লুকিয়ে লুকিয়ে) এয়েছেন?
বিনয় উত্তর দিল না।
নিশিবালা গলাটা খাদে নামিয়ে দেয়, তা বাবা, আমি জানতুম, আপনি আসবেন। কালই বুড়ো বাবাদের বলেছিলুম, উঁচুক্কে বয়েসের ছোঁড়াদের এখেনে আনলে মতি ভেরম (ভ্রম) হয়। তা তেনারা আপনার কত গুণকেত্তন করলে! সে-সব এক কান দে (দিয়ে) ঢুকিয়ে আর-এক কান দেবার করে দিলুম। আরে বাপু, পুরুষ মানুষের নাড়ি-নক্ষত্তর আমার জানা হয়ে গেছে। আমাদের এই মেয়েদের বাজারে এসে ডাবগা ডবগা (ডবকা ডবকা) ঘুড়ি দেখলে তারা নাট (লাট) খেয়ে পড়ে।
কে একজন বলে ওঠে, কিন্তুন মাসি, ওই বুড়ো দুটোও তো পুরুষ মানুষ। ওদের
তাকে থামিয়ে দিয়ে নিশিবালা হাতজোড় করে বলে, তেনাদের কতা আলাদা। তেনারা হলেন গে ভগমান। দেশের কাজ করে করে জেবন শেষ করে দিলে। তোদের মতোন এক শটা ছুঁড়ি তেনাদের জাপটে ধরলেও কেতরে পড়বেনি।
বোঝা যাচ্ছে, হরিচরণ আর পীতাম্বর যে স্বাধীনতা-সংগ্রামী-সেটা নিশিবালা জানে। ওদের পৃথিবীতে এক ধরনের লোকই বিষপোকার মতো থিক থিক করে–মাতাল, লুচ্চা, লম্পট, খুনে। সমাজের নোংরা সব গাদ। নর্দমার পচা পাক। কোথায় এরা, আর কোথায় হরিচরণরা! জিতেন্দ্রিয়, দেশব্রতী মানুষ দুটি সম্পর্কে নিশিবালার অপার ভক্তি।
আর-একটি মেয়ে বলল, কেতরে পড়ার বয়েস কি আর আছে! দুই বুড়োর শরীরের রস শুক্যে (শুকিয়ে) ঝামা হয়ে গেছে।
বিনয় বসে থাকতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, তার রক্তচাপ ঝপ ঝপ করে নেমে যাচ্ছে। নিশিবালা এবং মেয়েরা কী বলে যাচ্ছে, সে-সব যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল না। আবছা, দুর্বোধ্য, একটানা আওয়াজের মতো কানে বেজে যাচ্ছে। করুণ, ফ্যাকাসে মুখে হাতজোড় করে সে নিশিবালাকে বলে, আমি একটা বিশেষ দরকারে আপনার কাছে এসেছি।
ঘাড় ঝাঁকিয়ে, ভুরু নাচিয়ে নিশিবালা বলল, পুরুষ মানষে এট্টা দরকারেই তো একেনে আসে– তার চোখে নোংরা সংকেত ফুটে ওঠে।
মরিয়া হয়ে বিনয় বলল, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। আমার কথাটা আগে শুনুন–
হয়তো করুণাই হয় নিশিবালার। ভালমানুষের মতো মুখ করে সে বলে, ঠিক আচে-বলুন।
কাল এখানে একটি মেয়েকে দেখে গিয়েছিলাম। তার নাম ছায়া। দয়া করে ছায়াকে ডাকুন। তার সঙ্গে কথা বলব।
পান চিবুনো থেমে যায় নিশিবালার। চোখের তারা একেবারে স্থির। রুক্ষ, মেচেতা-ভরা মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ সোজাসুজি বিনয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে বলে, ছায়া বলে তো একেনে কেউ নেই।
বিনয় থতমত খেয়ে যায়। মেয়েমানুষটা সরাসরি অস্বীকার করবে, ভাবতে পারেনি। বলল, কিন্তু কাল আমি নিজের চোখে তাকে দেখে গেছি।
নিশিবালা ফের আগের মতোই স্বাভাবিক। চোয়াল নড়তে শুরু করেছে, অর্থাৎ জাবর কাটা চলছে। চোখমুখের সেই কঠোরতা আর নেই। হেসে হেসে বলল, কাকে দেকতে কাকে দেকেচেন! এখেনে এলে মাতা গুইলে যায়। সব ডবকা ঘুড়িকে একরকম নাগে
বিনয় বেশ জোর দিয়েই বলল, আমার মাথা গুলিয়ে যায়নি। ছায়াকেই দেখেছি।
নিশিবালা লহমায় মেয়েপাড়ার মাসি হয়ে ওঠে। তেমনি দাপুটে, তেমনি রণচণ্ডীমার্কা। গলা চড়িয়ে, হাত নাচাতে নাচাতে বলে, বলচি লেই। তবু এক কতা! আমি কি ছায়াকে গড়িয়ে দেব?
যতই মেজাজ চড়িয়ে ছায়ার ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাক, নিশিবালা যে ডাহা মিথ্যে বলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিনয়ের। কিন্তু মেয়েমানুষটা পুরোপুরি অস্বীকার করার পর তার কী করা উচিত, ভেবে পাচ্ছে না। কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে।
নিশিবালা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই চারপাশের দঙ্গলটা থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে বিনয়ের সামনে দাঁড়ায়। এই ধরনের মেয়েরা যেমনটা হয়-নোংরা ছলাকলায় বড়ই পটু-চোখ কুঁচকে, মুখে অশ্লীল হাসি ফুটিয়ে বলে, ছায়া লেই তো কী হয়েছে। পক্ষী আচে।
শিরদাঁড়ার ভেতরটা হিম হয়ে যায় বিনয়ের। হতভম্বের মতো সে বলে, পক্ষী!
হ্যাঁ গ। নিজের বুকে একটি আঙুল রেখে মেয়েটা বলে, এই যে আমি। আমার নাম ময়না। আরও কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, আমারে দে চলবেনি?
কপালে গালে গলায় বিন বিন করে ঘাম ফুটে বেরুতে লাগল বিনয়ের। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে সে।
মেয়েটা চটুল গলায় এবার বলে, আমাকে দে না হলি আরও পক্ষী আচে গ বাবু কয়েকটা মেয়েকে দেখিয়ে বলতে লাগল, ও হল টিয়া, ও বুলবুলি, ও টুনটুনি। যারে মনে ধরে বেচে লিন (নিন)।
তার কথা শেষ হতে না-হতেই আর-একটা মেয়ে এগিয়ে এল। পক্ষী যদিন ভাল না লগে, ফুলও আচে। আমি টগর। ভিড়ের দিকে আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগল, ওই মেয়েটা মালতী, ওই মেয়েটা চাপা
অন্য একটি মেয়ে বলল, আকাশের তারা আচে, বনের লতা আচে, জোনাকি আচে, ঝরনা আছে। আরও কতরকম আচে। যারে ইচ্ছে তুলে নে ঘরে দোর দিন।
ভিড়ের মধ্যে তিন-চারটি মেয়ে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচায়, এই দুকুর বেলায়!
আরও কটা মেয়ে কাঁচা রগরগে ভাষায় বলল, মিষেদের যকন চাগাড় দ্যায়–
নিশিবালা মিটি মিটি হাসতে হাসতে বিনয়কে লক্ষ করছিল। তার বিনয়ের আটকে আসছে। মাথার ভেতর যেন চাকা ঘুরে যাচ্ছে। ঘাড় ভেঙে সে বুঝি বা হুড়মুড় করে পড়ে যাবে।
নিশিবালা বেশ মজাই পাচ্ছিল। প্রশ্রয়ের সুরে মেয়েগুলোকে হালকা ধমক দিল, ছেনালি রাক দিকিন। বাবুটি দামড়া বাছুর। সবে চোক ফুটচে। আমাদের একেনে পা দিতে না-দিতেই তারে নে পড়লি! অমনটা করলে
বাকিটা আর শোনা হল না। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল বিনয়। এক দৌড়ে চাতাল পেরিয়ে সোজা গলিতে চলে এল।
পেছন থেকে নিশিবালা চেঁচিয়ে ওঠে, অ বাবু, যাবেন নি–যাবেন নি– আমি পছন্দ করে একটা পরী আপনারে দিচ্চি
বিনয় যেভাবে পালিয়ে গেল, তাতে অন্য মেয়েগুলো ভীষণ মজা পায়। তুমুল হাসির কলরোল তুলে তারা হইহই করে ওঠে, কী ভীতু নোক রে বাবা! বুকের মদ্যি পুঁটি মাচের ধুকপুকুনি! সে কিনা মাগীপাড়ায় আসে!
ফিরেও তাকায় না বিনয়। গলি থেকে অন্ধের মতো ছুটতে ছুটতে চলে এল ট্রাম রাস্তায়। এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে ছিল তার। ফুটপাথের একধারে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে।
চোখের সামনে শহরের চেনা দৃশ্য। প্রচুর মানুষ। প্রচুর গাড়িঘোড়া। কেউ থেমে নেই। সবাই ব্যস্ত, সবাই ছুটছে।
বিনয় লক্ষ করল, বেলা হেলতে শুরু করেছে। হঠাৎ খেয়াল হল, ট্রেন লেট না করলে এতক্ষণে আসামের রিফিউজিদের চলে আসার কথা। সে আর দাঁড়াল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে শিয়ালদা রুটের একটা ট্রামে উঠে বসল।
চাকায় ধাতব আওয়াজ তুলে ট্রাম ছুটে চলেছে। জানালার বাইরে বিনয় তাকিয়ে আছে ঠিকই, তবে রাস্তার কোনও কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না। ছায়ার চিন্তাটা তার মাথায় হুল ফুটিয়ে চলেছে। মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য আজ সে ছুটে এসেছিল কিন্তু নিশিবালা স্পষ্ট জানিয়ে দিল ওই নামে কেউ তাদের ওখানে থাকে না। অথচ কাল সন্ধেবেলায় বিনয় তাকে নিজের চোখে দেখে গেছে। এতটা ভুল তার হতেই পারে না। এই যুবা বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি এত খারাপ হয়ে যায়নি। তবু একটা ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। আজ সে এতটা সময় এখানে কাটিয়ে গেল, প্রতিটি মেয়ের মুখও লক্ষ করেছে কিন্তু ছায়াকে দেখা যায়নি। এমনও তো হতে পারে, মেয়েটা সেই মুহূর্তে ওখানে ছিল না, অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে।
সে যাই হোক, ওই মেয়েপাড়ায় বিনয় আর যাচ্ছে না। একটা নিষ্পাপ তরুণীকে উদ্ধার করতে এসেছিল, নেহাতই কর্তব্যপালনের তাড়নায়। কিন্তু সেটা যে কত দুরূহ তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। ওখানকার নোংরা মেয়েমানুষগুলো তার পা থেকে মাথা অবধি পচা পাঁক মাখিয়ে দিয়েছে। সারা গা থেকে দুর্গন্ধ উঠে আসছে যেন।
বিনয় ঠিক করে ফেলল, হরিচরণকে ছায়ার কথা জানিয়ে দেবে। পারলে তিনিই মেয়েটাকে পাল থেকে বার করে নিয়ে আসতে পারবেন।
এসময় ট্রাম শিয়ালদায় পৌঁছে যায়।
৬৫.
আরও কদিন কেটে গেল।
সেই যে সুধাদের বাড়ি থেকে শান্তিনিবাস-এ বিনয় চলে এসেছিল তারপর মাত্র দু-একবার জাফর শা রোডে গেছে বিনয়। রিফিউজি কলোনি, ত্রাণশিবিরে–ছোটাছুটি তো ছিলই। আসাম থেকে কলকাতায় নতুন শরণার্থীদের ঢল নামায় নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। ভোর থেকে মাঝরাত কীভাবে যে কেটে গেছে একমাত্র সে-ই জানে। তার ওপর হরিচরণদের রেণুবালা নারী মঙ্গল কেন্দ্র আর ছায়াকে নিয়ে দুটো দিন ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
সুধাদের বাড়ি সে যেতে না পারলেও হিরণ কিন্তু দুদিন মেসে এসে দেখা করে গেছে। ঠিক ছিল খান মঞ্জিল সারিয়ে, রংটং করার পর পঞ্জিকায় শুভদিন দেখে খুব শিগগিরই গৃহপ্রবেশ করা হবে। কিন্তু হিরণ জানিয়ে গিয়েছিল, সরস্বতীকে পি. জি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বারোমাস সরস্বতী নানা অসুখ বিসুখে কষ্ট পান। হঠাৎ তার রোগটা বাড়াবাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালে না দিয়ে উপায়। ছিল না। তাই নতুন বাড়িতে যাওয়া আপাতত স্থগিত রাখতে হয়েছে। তিনি যতদিন না সুস্থ হচ্ছেন, গৃহপ্রবেশের প্রশ্নই নেই। বিনয় সময় করে একদিন হাসপাতালে গিয়ে সরস্বতীকে দেখে এসেছে।
এত যে প্রচণ্ড ব্যস্ততা তার ভেতরেও বিনয়ের মাথায় একটা ভাবনা চলছেই। অর্থাৎ হেমনাথ। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যত দুর্বিপাকই ঘটুক, দেশ ছাড়বেন না। কিন্তু তাঁর শেষ চিঠিটা পড়ে মনে হয়েছে সমস্ত আত্মবিশ্বাস ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের হাল দিনকে দিন এতটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তাতে তার মতো মানুষের পক্ষেও পৃথিবীর ওই ভূখণ্ডটি আর নিরাপদ নয়। এক মুহূর্তও তিনি আর রাজদিয়ায় থাকতে চান না।
হেমনাথ লিখেছিলেন, বিনয়রা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার এবং অবনীমোহনের দেশের বাড়িঘর জমিজমা এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে রাখে। কিন্তু সেদিক থেকে সম্পূর্ণ হতাশ হতে হয়েছে বিনয়কে।
শাজাহান সাহেবের বিষয় আশয়ের সঙ্গে হেমনাথের জমিজমা বাড়িঘর এক্সচেঞ্জ করা সম্ভব হবে না। তবে অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ-সব জানিয়ে হেমনাথকে চিঠি লিখেছিল বিনয়রা। কিন্তু তার জবাব এখনও আসেনি। হেমনাথ কবে ইন্ডিয়ায় আসবেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
নিত্য দাস কথা দিয়েছিল, সাদিনের ভেতর হেমনাথের উত্তর এনে দেবে। সাতদিনের পর আরও কদিন কেটে গেছে। কিন্তু না, হেমনাথের উত্তর তো আসেইনি, নিত্য দাসেরও পাত্তা নেই। লোকটা একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর হেমনাথের জন্য মনটা ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছে বিনয়ের। সে অন্যদিনের মতো চান টান করল না। মুখটুখ ধুয়ে প্রসাদের কাছ থেকে আজকের দিনটার জন্য ছুটি নিয়ে টালিগঞ্জের দিকে বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য, হিরণকে সঙ্গে করে কসবায় নিত্য দাসের বাড়ি চলে যাবে। লোকটা কতদূর কী করল, জানা দরকার। এটা ঠিক, হেমনাথের কোনও খবর এলে নিত্য তক্ষুনি এসে হাজির হতো। কিন্তু মন এতই উৎকণ্ঠিত যে স্থির থাকতে পারছিল না বিনয়।
জাফর শা রোডে এসে ডাকাডাকি করতে উমা দরজা খুলে দিল। কয়েকদিন বাদে তাকে দেখে মেয়েটা খুব খুশি। একমুখ হেসে কী যেন বলে উঠল। কিন্তু কিছুই যেন শুনতে পেল না বিনয়। উমার পাশ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তর তর করে ওপরে উঠতে লাগল।
দোতলায় এসে বাইরের ঘরে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে বিনয় হতবাক। যার কথা ভাবতে ভাবতে সে ছুটে এসেছে সেই নিত্য দাস কি না হিরণের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে কথা বলছে।
বিনয়কে দেখে ওরাও কম অবাক হয়নি। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর হিরণ বলল, কী আশ্চর্য, তুমি এখন আসবে, ভাবতেই পারিনি। এসএস বিনয় ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসতে না বসতেই বলে, চা খেয়ে নিত্যবাবু আর আমি তোমার মেসেই যেতাম। ভালই হল, তুমি এসে গেছ-
বিনয় বলল, আমার ওখানে যাচ্ছিলেন?
হিরণ না, উত্তরটা দিল নিত্য দাস, হ ছুটোবাবু। পাকিস্থান থিকা হ্যামকার চিঠি আইছে।
নিত্য দাস বলতে লাগল, কথা দিয়াও রাখতে পারি নাই ছুটোবাবু। হেমনাথের চিঠি আনতে দেরি হওয়ার কৈফিয়ৎ দিতে লাগল সে। জয়নাল নামে তার লোকটি গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েছিল। তার পড়শি মোতালেফ হাড়-বজ্জাত। জয়নালের মাত্র দুকানি জমি রয়েছে। তা থেকে কৌশলে কিছুটা আত্মসাৎ করার তালে ছিল। এই নিয়ে প্রচুর হাঙ্গামা হয়েছে। সে-সব সামলে রাজদিয়ায় যেতে তার দেরি হয়ে গেছে। সেই কারণে সাতদিনের ভেতর হেমনাথের চিঠি নিয়ে আসা সম্ভব হয় নি।
নিত্য দাস বলল, কাইল রাইতে চিঠিখান পাইছি। ভাবলাম, আইজ সকালে উইঠা টালিগুঞ্জে আইয়া ছুটো জামাইবাবুরে লগে কইরা আপনার ম্যাসে যামু। তা আপনে নিজেই আইয়া পড়লেন। মুখ কাচুমাচু করে বলে, ক্যান দেরি হইছে, হোনলেন। আমার কিন্তুক কুনো দুষ (দোষ) নাই
উমার কাছে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে ভেতর দিক থেকে চলে এল সুধা। তাঁর সঙ্গে দ্বারিক দত্তও এসেছেন। বাইরের ঘরে পা দিয়ে হইচই বাধিয়ে দেয় সুধা। কী ছেলে রে তুই! সেই যে মেসে গেলি, তারপর দু-একবার মোটে মুখ দেখিয়ে গেছিস! কতদিন হল তোর কোনও পাত্তাই নেই। আমাদের কথা তোর বোধহয় মনেই পড়ে না আজকাল।
দ্বারিক দত্তও একই কথা বললেন।
কিছুই প্রায় কানে যাচ্ছিল না বিনয়ের। অফিসের কাজে মরার সময় নেই, তাই আসা সম্ভব হচ্ছিল না, ইত্যাদি জানিয়ে সে নিত্য দাসের দিকে তাকায়। –দাদুর চিঠিটা কোথায়?
হিরণ বলল, এই যে আমার কাছে ব্যস্তভাবে পকেট থেকে একটা মুখ-বন্ধ খাম বার করে বিনয়কে দেয় সে।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী লিখেছেন দাদু? পড়েছেন আপনারা?
না। তোমার নামে চিঠি। তাই
বিনয় এমনিতে খুবই শান্ত, নম্র। কিন্তু এই মুহূর্তে মেজাজটা তপ্ত হয়ে ওঠে। রুক্ষ গলায় বলে, আমার নামে লিখলেও এটা গোপন কোনও ব্যাপার নয়। আমরা সবাই মিলে পরামর্শ করে যে চিঠিটা লিখেছিলাম, তিনি তার জবাব দিয়েছেন। দাদু রাজদিয়ায় কী অবস্থায় আছেন, কলকাতায় কবে আসছেন, সে-সব জানবার ইচ্ছে হল না আপনাদের? আমি কখন চিঠি খুলব সে জন্যে বসে আছেন। আশ্চর্য!
হিরণের মুখটা নিমেষে পাংশু হয়ে যায়। সুধাও কিছু বলছে না। বাকি দুজনও চুপ। রাজদিয়ার একটি বৃদ্ধের জন্য বিনয় যে কতটা উৎকণ্ঠিত, সবাই তা টের পাচ্ছিল। খামের মুখ ছিঁড়ে এক নিঃশ্বাসে হেমনাথের চিঠিটা পড়ে যায় বিনয়।
কল্যাণীষেষু
বিনু, নিদারুণ সংকটে পড়িয়া এমনই বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে রাজদিয়ায় আর এক মুহূর্তও থাকিতে সাহস হইতেছিল না। প্রতিদিন ইরফান আলি এবং তাহার সাঙ্গোপাঙ্গদের শাসানি, দেশ ছাড়ার জন্য হুমকি, পদে পদে অসম্মান, এই অবস্থায় শ্বাস আটকাইয়া আসিতেছিল। তাই তোমাকে বিষয় সম্পত্তি এক্সচেঞ্জের কথা জানাইয়াছিলাম। সিদ্ধান্ত লইয়াছিলাম, চিরতরে জন্মভূমি ছাড়িয়া চলিয়া যাইব।
তোমার জবাবী পত্র পাইয়া জানিতে পারিয়াছি, তুমি, দ্বারিক, হিরণ, সুধা, সুনীতি, আনন্দ-সকলে আমাদের জন্য কী গভীর দুশ্চিন্তায় দিন কাটাইতেছ।
তুমি লিখিয়াছ, নানা জায়গায় অনেক দৌড়াদৌড়ি করিয়াও সম্পত্তি বিনিময়ের বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পার নাই। তবে যুগলদের জবরদখল কলোনিতে প্রচুর জমি পাওয়া যাইবে–এইরূপ ভরসা মিলিয়াছে।
বর্তমানে জানাই, পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছে। করিম বিশ্বাসী মানুষ। প্রাণ গেলেও সে নিমকহারামি করিবে না। সে ছাড়া মোতাহাররা তো আছেই। তাহাদের, বিশেষ করিয়া করিমের উপর বাড়িঘরের দায়িত্ব দিয়া গোপনে দেশ ত্যাগ করিব এই ছিল অভিপ্রায়, কিন্তু খবরটি কীভাবে কীভাবে যেন চতুর্দিকে রটিয়া গিয়াছে। তাহার ফল কী হইয়াছে, অনুমান করিতে পার?
রাজদিয়া তো বটেই, আশেপাশের দেলভোগ, গিরিগঞ্জ, আবদুলাপুর, কমলাপুর, সুজনগঞ্জ ইত্যাদি গ্রামের যে-সব হিন্দু পূর্বপুরুষের ভিটামাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া আছে, তাহারা দলে দলে আসিয়া হাজির হইতেছে। ইহারা আমায় দেশ ছাড়ার কথা ভাবিতেই পারে না। সকলেই বলিল, আমি ভারতে চলিয়া গেলে তাহারা কাহার মুখ চাহিয়া পাকিস্তানে থাকিবে?
আমার নামটি হিন্দু নাম বলিয়া আমি পরবাসী। এ-দেশে আমার কোনও মর্যাদা নাই, একটা আঙুল তুলিবার মতো সামান্য ক্ষমতাও হারাইয়াছি। ওই হিন্দুরা বিপদে পড়িলে কোনওভাবেই তাহাদের রক্ষা করিতে পারিব না। তবু আমার উপর ইহাদের বিরাট ভরসা। দেশভাগের পর কিছুই যে আগের মতো নাই, হাজার বুঝাইলেও তাহারা বুঝিতে চায় না। আমার সম্বন্ধে অনন্ত আস্থা তাহাদের মধ্যে অনড় হইয়া আছে।
এই তো গেল সন্ত্রস্ত হিন্দুদের কথা। রাজদিয়া এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শতকরা সত্তর আশি ভাগ মুসলমানও চায় না, আমি চিরকালের মতো ইণ্ডিয়ায় চলিয়া যাই। নিজের সম্বন্ধে লিখিতে লজ্জা হয়, তবু যাহা ঘটনা তাহা না জানাইয়া পারিতেছি না। রাজদিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আনোয়ার আলি বলিয়াছে, আমার মতো মানুষ যদি দেশ ছাড়ে তাহা এই অঞ্চলের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাকর দৃষ্টান্ত। মোতাহার হোসেন কিছুদিন আগে আমার নিরাপত্তার জন্য প্রায়ই আসিয়া আমাদের বাড়িতে রাত কাটাইত। এখন স্থায়ীভাবে বাহিরের ঘরে থাকিতেছে। করিম তত তাহার পরিবার লইয়া এখানেই। আছে। আমাদের জমিতে চাষ করে, এমন আরও চারটি অল্পবয়সী মুসলমান কৃষাণও স্বেচ্ছায় স্ত্রী-পুত্র লইয়া করিমের ঘরের পাশে পর পর ঘর তুলিয়া বাস করিতেছে। ইহার অর্থ কোনও প্রকার হামলা হইলে তাহারা আমাদের রক্ষা করিবে।
রাজদিয়ার নাম-করা উকিল খলিল সাহেব, কলেজের তরুণ অধ্যাপকেরা, সৈয়দ এবং মীর বাড়ির ছেলেরা রোজই কেহ না কেহ আমাদের খবর লইয়া যাইতেছে।
তোমরা শুনিলে অবাক হইবে, উকিল খলিল সাহেব মুসলমান যুবকদের জুটাইয়া দিনকয়েক আগে একটি মিছিল বাহির করিয়া ইণ্ডিয়া হইতে আগত পশ্চিমা মুসলমানদের তো বটেই, যে বাঙালি মুসলমানরা আমাদের উৎখাত করিয়া জমিজমা গ্রাস করিতে চায় তাহাদেরও সতর্ক করিয়া দিয়াছেন, আমাকে শাসাইলে বা কোনও রকম ক্ষতির চেষ্টা করিলে তাহার পরিণাম ভাল হইবে না। এই লইয়া প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং দুই পক্ষে মারপিটও হইয়াছে। তবে ইহার একটি সুফল পাওয়া গিয়াছে। বর্তমানে কেহ আমাকে হুমকি দিতেছে না।
তোমাকে পূর্বের একটি পত্রে জানাইয়াছিলাম, বহু সহৃদয় মুসলমান আমার পাশে আছে। কিন্তু তাহাদের সংখ্যা যে এমন বিশাল তাহা কল্পনা করিতে পারি নাই। পাকিস্তানের পরিবেশ যারপরনাই বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে কিন্তু এই মানুষগুলিকে তাহা স্পর্শ করিতে পারে নাই।
আমার মনে একটাই দুঃখ বা ক্ষোভ জমিয়া আছে। তোমাকে জানাইয়াছি কি না মনে নাই। যদি জানাইয়াও থাকি তবু আর-একবার মনে করাইয়া দিতেছি। জিন্না সাহেব তাহার জীবিতকালে বারংবার বলিয়াছিলেন, জাতিধর্ম নির্বিশেষে পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকের থাকিবে সমানাধিকার। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই কাহারও সঙ্গে কাহারও বৈষম্য থাকিবে না।
বিনু, তুমি জানো, পাকিস্তানকে আমি স্বদেশ বলিয়া মানিয়া লইয়াছিলাম। আর দশজনের মতো আমিও এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। এখানকার আইন কানুন মাথা পাতিয়া লইয়াছি। দেশের সুস্থিতি বিপন্ন হয়, এমন কিছু কল্পনাও করিতে পারি না। সংখ্যায় অল্প হইলেও আমাদের অঞ্চলের মানুষজনের একটি অংশের কাছে আমরা অবাঞ্ছিত। নিজের মাতৃভূমিতে অন্যের পাহারায় আমাদের বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, স্বাধীনতার আগে ইহা কী কখনও ভাবিতে পারিয়াছি?
যাহা হউক, এখানকার পরিস্থিতি বিশদভাবে জানাইলাম। এই অবস্থায় দেশ ছাড়িয়া যাওয়া আর সম্ভব হইবে না। আয়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছাইয়া গিয়াছি। আর কতদিনই বা বাঁচিব? পাঁচ, দশ কি পনেরো বৎসর। দেশের মাটিতেই মৃত্যু ঘটুক। ইহাই আমাদের ভবিতব্য।
বিনু, তোমরা আমাদের জন্য চিন্তা করিও না। বিষয়আশয় এক্সচেঞ্জের জন্য ছুটাছুটি করারও দরকার নাই। যুগলকে জানাইয়া দিও, কলোনিতেও আমাদের জন্য যে জমি রাখিয়া দিয়াছে তাহা যেন অন্য উদ্বাস্তুদের ভাগ করিয়া দেয়।
যতদিন না দুই দেশের মধ্যে ডাক চলাচল স্বাভাবিক হইতেছে, নিত্য দাসের উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হইবে। তাহার লোকটি তোমাদের পত্রাদি আমাদের পৌঁছাইয়া দিবে। এবং আমার উত্তর সীমান্তের ওপারে দিয়া আসিবে। ইহা ছাড়া যোগাযোগের অন্য কোনও উপায় আপাতত নাই।
নিয়মিত পত্র লিখিবা। তোমরা আমাদের স্নেহ ও আশীর্বাদ লইও।
ইতি, দাদু
নিঃশব্দে চিঠিটা পড়ে ফেলে বিনয়। একরকম রুদ্ধশ্বাসে। তারপর মুখ তুলে তাকায়।
ঘরের বাকি সবাই উদগ্রীব বিনয়কে লক্ষ করছিল। চারপাশ থেকে একই প্রশ্ন শোনা যায়–কী লিখেছেন হেমনাথ?
উত্তর না দিয়ে হেমনাথের চিঠিটা দ্বারিক দত্তকে দেয় বিনয়। তার পড়া হলে সেটা যায় সুধার হাতে। এইভাবে চিঠির বয়ানটা সকলেরই জানা হয়ে যায়।
কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে স্তব্ধতা নেমে আসে।
তারপর গম্ভীর হতাশার সুরে নিত্য দাস বলে ওঠে, পেরথম যহন শাজাহান সাহেবের সোম্পত্তির খরব দিছিলাম, হ্যামকায় যদিন রাজি অইতেন পায়ের উপর পাও (পা) তুইলা ইণ্ডিয়ায় বাকি জনম। কাটাইয়া দিতে পারতেন। নাতি নাতিন নাতিন-জামাই-আত্মজনেরা কাছে থাকত। কত আনন্দ, কত শান্তি। কিন্তুক নিজেই ইণ্ডিয়ায় আহনের হগল পথ বন্ধ কইরা দিলেন।
একই আক্ষেপ দ্বারিক দত্তেরও। তিনি বললেন, হেমদাদা এত বড় পণ্ডিত মানুষ, কিন্তু দুরদৃষ্টি নেই। মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করে বসে। যেই চারপাশের হিন্দুরা এসে ধরে পড়ল, তার ভরসায় ওরা দেশে থেকে গেছে, অমনি গলে গেল। আরে বাবা, এই হিন্দুরা যেই মুহূর্তে সুযোগ পাবে, ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসবে। হেমদাদাকে জানাবেও না।
নিত্য দাস বলল, মুসলমানগো কথাও কনি। অহন না হয় ভালা মাইষি (মানুষ) কইরা পরি (পাহারা) দিয়া রাখতে আছে। এইটা কি বছরের পর বছর সম্ভব? হেরা যে চিরটা কাল একই রকম থাকব, জোর কইরা কি হেই কথা কওন যায়? পাকিস্থানের যা হাল, মতিগতি বদলাইয়া যাইতে কতক্ষণ? অর্থাৎ এখন যারা আবেগের বশে হেমনাথের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা আমৃত্যু তাকে আগলে আগলে রাখবে, এমন আস্থা নিত্যর নেই। পাকিস্তানের আবহাওয়া যেভাবে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তাতে কোনও মানুষের ওপরেই অনন্তকাল ভরসা রাখা যায় না।
নিত্য দাস বলতে লাগল, দ্যাশহান দুই টুকরা হওনের আগে মজিদ মিঞা কত ভালা আছিল। এই কয় বছরে হ্যায় (সে) কি আর আগের মানুষ আছে? রাতারাতি বদলাইয়া গ্যাছে। পাকিস্থানে মজিদ মিঞার লাখান মানুষ অহন লাখে লাখে।
মুখ ফিরিয়ে নিত্যর দিকে তাকায় বিনয়। মজিদ মিঞার নামটা বহুকাল বাদে শুনল সে। সঙ্গে সঙ্গে গোপন এক কুঠুরি থেকে পুরানো কষ্ট বেরিয়ে এসে বুকের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে, চল্লিশ সালে, যখন তারা রাজদিয়ায় যায়, এই লোকটা তাদের দেখার জন্য রাত্তিরে নৌকোয় দশ মাইল নদী খাল বিল পাড়ি দিয়ে সুদূর কেতুগঞ্জ থেকে চলে এসেছিল। সঙ্গে করে এনেছিল কয়েক হাঁড়ি মিষ্টি, মস্ত একটা রুই মাছ। কী আন্তরিকতা তার। বিনয়দের দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছিল। রাজদিয়ায় তাদের ধরে রাখার জন্য কত যে ব্যাকুলতা! নিজের। তেফসলা উৎকৃষ্ট জমি থেকে তিরিশ কানি অবনীমোহনকে লিখে দিতে চেয়েছিল। বিনা মূল্যে। অবনীমোহন অবশ্য রাজি হননি। এই নিয়ে মজিদ মিঞার কত অভিমান। কত ক্ষোভ। শেষ পর্যন্ত অনেক টানা হ্যাঁচড়ার পর ন্যায্য দামের অর্ধেকের বেশি তাকে নেওয়ানো যায়নি। দু-চারদিন পর পরই এটা সেটা নিয়ে হাজির হতো। কতবার যে তাদের কেতুগঞ্জের বাড়িতে বিনয়দের দাওয়াত খাইয়েছে তার লেখাজোখা নেই। হেমনাথের পরামর্শ ছাড়া একটা পাও ফেলত না। মেয়ের শাদির কথা পাকা হবে। নৌকো পাঠিয়ে হেমনাথকে নিয়ে গেল কেতুগঞ্জে। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি? কে মেটাবেন? হেমনাথ ছাড়া আবার কে। বিষয় আশয় নিয়ে মামলা বেধেছে। সেখানেও হেমনাথ। এই মানুষটি তার কাছে সব চেয়ে শ্রদ্ধেয়। সব চেয়ে আস্থাভাজন। নিজের আত্মীয় পরিজনের চাইতেও অনেক বেশি প্রিয়, অনেক বেশি বিশ্বাসের পাত্র। ছেচল্লিশে বড় রায়টের পর মজিদ মিঞা আর আগের মজিদ মিঞা রইল না। মুসলিম লিগে নাম লেখালো। দেশভাগের পর থেকে হেমনাথের ধারে কাছে ঘেঁষত না। ইন্ডিয়ায় চলে আসার আগে বিনয় শুনেছিল কেতুগঞ্জের এবং তার চারপাশের গ্রামগঞ্জগুলো থেকে যারা আতঙ্কে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে তার পেছনে ছিল এই মজিদ মিঞা। তার মতো মানুষই যদি বদলে যেতে পারে, এখনও যারা ভাল আছে তাদের পালটে যেতে কি খুব বেশিদিন লাগবে?
হেমনাথের জন্য যে প্রবল উৎকণ্ঠা হচ্ছিল তার চাপ নিতে পারছে না বিনয়। মনে হচ্ছে তার স্নায়ুগুলো ছিঁড়ে পড়বে।
এদিকে হিরণ বলছিল, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম
দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা রে?
হেমদাদু আর দুই দিদার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, দিদাদের দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু মানুষের আয়ুর কথা তো বলা যায় না। হঠাৎ যদি দাদুর মৃত্যু হয়, কী হবে দিদাদের? কে দেখবে তাদের? তার ওপর এত প্রপার্টি। দুই বৃদ্ধা কি সে-সব সামলাতে পারবেন?
এই বিষয়টা আগেও যে বিনয় ভাবে নি তা নয়। মৃত্যু এক অনিবার্য ঘটনা। অমোঘ এবং অবশ্যম্ভাবী। কেউ তা ঠেকাতে পারে না। কখন, কীভাবে মৃত্যু আসবে কারও পক্ষেই তার হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। হেমনাথ যদি আগে মারা যান, দেশের বাড়িতে স্বজনহীন দুই অসহায় বৃদ্ধা একেবারে অথৈ সমুদ্রে গিয়ে পড়বেন। শিবানী ও স্নেহলতার মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে বিনয়ের। প্রচণ্ড ত্রাসে গলা শুকিয়ে আসতে থাকে তার। এতদূরে অন্য একটা রাষ্ট্রে থেকে সে কী-ই বা করতে পারে!
দ্বারিক দত্ত বিমর্ষ মুখে বললেন, নিজের স্ত্রী, বোনের কথা ভাবে না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা নেই। হেমদাদা যে কী ধরনের মানুষ, বুঝি না।
নিত্য দাস জোরে জোরে মাথা নাড়ে।–আর কুনো আশা ভরসা নাই। হগল শ্যাষ। বিনয়ের দিকে ফিরে বলে, আমারে অন্য একহানে যাইতে অইব। আইজ যাই। হ্যামকত্তারে পত্র দিবেন তো?
বিনয় বলল, হ্যাঁ।
লেইখা রাইখেন। দুই চাইর দিন পর আপনের ম্যাস থিকা লইয়া যামু
নিত্য দাস চলে গেল। হেমনাথের চিঠিটা পড়ার পর থেকে বিনয়ের কিছুই ভাল লাগল না। ভেতরে ভেতরে উতলা ভাবটা বেড়েই চলেছে। সে এখন নিশ্চিত, হেমনাথের সঙ্গে এ-জীবনে আর দেখা হবে না। পাকিস্তানে তার, শিবানীর এবং স্নেহলতার বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে, কে জানে।
বিনয়ও উঠে পড়েছিল কিন্তু সুধারা কিছুতেই তাকে ছাড়ল না।
এতদিন পর এলি। এক্ষুনি চলে যাবি মানে? বিনয়ের দুই হাত আঁকড়ে ধরে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে সুধা। তার দুচোখ জলে ভরে গেছে। চিরকালের জেদী, অভিমানী তার এই ছোটদিটি যখন ঠিক করেছে যেতে দেবে না তখন বিনয়ের সাধ্য কী চলে যায়।
তবু বিনয় ভারী গলায় বলে, দাদুর জন্যে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। আমি বরং আর-এক দিন আসব।
সুধা বলল, আর-একদিনের কথা আর-এক দিন। মন আমাদেরও ভাল নেই। কিন্তু দুপুরবেলা না খাইয়ে তোকে কিছুতেই ছাড়ব না। হিরণ এবং দ্বারিক দত্তও তার কথায় সায় দিলেন।