শতধারায় বয়ে যায় (Shotodharay Boye Jai) : 12
৫৬.
ঘুম যখন ভাঙল, দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ঘরের জানালা-দরজা হাট করে খোলা। শোবার সময় বন্ধ করার কথা মাথায় ছিল না বিনয়ের।
মরা মরা, নিস্তেজ একটু রোদ তেরছা হয়ে ঘরের মেঝেতে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। কতক্ষণ আর? বড় জোর মিনিট পনেরো কুড়ি। তারপর ওটুকুও আর থাকবে না, ঝপ করে সন্ধে হয়ে যাবে।
দিনের তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতের শেষে আর উত্তরে বাতাসের দাপট নেই। দক্ষিণ দিক থেকে বাতাসটা বইছে তাতে ঠাণ্ডার আমেজ মাখানো। গায়ে বেশ আরামেই লাগে।
সূর্যটা ডান পাশে আড়ালে চলে যাওয়ায় সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। তবে আকাশ জুড়ে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। সারাদিন খাদ্যের খোঁজে ঘোরাঘুরির পর এখন যে যার আস্তানায় ফিরে চলেছে।
আজ আর কোনও কাজ নেই বিনয়ের। সকালের দিকে শান্তিনিবাস-এ আসার জন্য তোড়জোড় ছিল। সুধাদের বাড়ির আবহাওয়া ছিল ভারী, মন খারাপ করে দেবার মতো। এখন খানিকটা হালকা বোধ করছে বিনয়। সুধাদের জন্য ততটা ক্লেশ আর নেই।
পাতলা কম্বলের ভেতর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছিল না। অনন্ত আলস্য তাকে যেন ঘিরে রেখেছে।
কতক্ষণ শিয়রের দিকের খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, বিনয়ের খেয়াল নেই। হঠাৎ সুবলের গলা কানে এল, বাবুর ঘুম নি ভাঙছে?
হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল বিনয়। সুবল ততক্ষণে ভেতর দিকের টানা বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সবে কৈশোর পেরিয়েছে ছেলেটা। এখনও তার চোখেমুখে আশ্চর্য সারল্য মাখানো। প্রথম যেদিন এখানে আসে, সেটা লক্ষ করেছিল বিনয়। একটু হেসে সে বলল, হ্যাঁ, ভেঙেছে। কিছু বলবে?
হ। ম্যানেজারবাবু জিগাইল, অহন নি চা খাইবেন? খাইলে আমারে দিয়া যাইতে কইল।
দেখা যাচ্ছে, মতিলাল চাকলাদার সত্যিই কাজের লোক। বোর্ডারদের সুখ-সুবিধার দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। কাকে কখন কী পাঠাতে হবে, সমস্ত মনে থাকে। বিনয় বলল, হ্যাঁ, খাব। তুমি নিয়ে এস। আমি ততক্ষণে নিচে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসি।
সুবল জানালো, নিচে যাবার দরকার নেই। দোতলায় এবং তেতলায় একটা করে ছোট চানের ঘর আছে। সেখানে অবশ্য জলের কল নেই। তবে চৌবাচ্চা রয়েছে। মেসের কাজের লোকেরা দিনে তিন-চারবার জল ভরে দিয়ে যায়। তাতে হাতমুখ ধোয়া, চান–সবই চলে। তেতলার চানঘরটা প্রসাদের ঘর ছাড়িয়ে, ভেতর দিকের বারান্দার শেষ মাথায়, জানিয়ে দিয়ে সুবল চলে গেল।
মুখ-টুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে বিনয় দেখল, সুবল এর মধ্যে কাঁচের গেলাস ভর্তি চা আর দুখানা বড় এস বিস্কুট এনে বিছানায় কাগজ পেতে তার ওপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই মলিন রোদটুকু এখন আর নেই। সন্ধে নামতে শুরু করেছে। ভেতরটা ঝাপসা। বাতাসের পরাক্রম হঠাৎ করে যেন বেড়ে যেতে লাগল।
সুবল বলল, কপাট-কুপাটগুলান আউজাইয়া (ভেজিয়ে) দেই?
বিনয় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও
শুধু দরজা-টরজাই বন্ধ করল না সুবল, আলোও জ্বালিয়ে দিল। হাওয়ার দাপট ঠেকানো গেছে। বিছানায় বসতে বসতে বিনয় সুবলকে বলল, বোসো
ঘরে টুল বা চেয়ার টেয়ার নেই। বসতে হলে সুবলকে বিছানাতেই বসতে হয়। সে প্রায় সিঁটিয়ে যাচ্ছিল।
একরকম ধমকে সুবলকে বিছানায় বসালো বিনয়। আমার জন্যে তো চা এনেছ। তোমারটা?
সুবল জড়সড়। বলল, আমি চা খাই না
তাহলে এই বিস্কুটগুলো খাও।
সুবল কিছুতেই নেবে না। জোর করে তার হাতে বিস্কুট গুঁজে দিল বিনয়। বড়রা কিছু দিলে না বলতে নেই। প্রসাদদাকে যেমন দাদা মনে কর, আমাকেও তেমনি তোমার দাদা ভাববে। যখন কিছু দেব, না বলবে না। মনে থাকবে?
বিনয়ের কথায় এমন আন্তরিকতা আর মায়া মাখানো যা সুবলকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। আবেগে গলার কাছটা কাঁপছে তার। কথা বলতে পারছিল না। আস্তে মাথা কাত করে জানালো-মনে থাকবে।
একটু নীরবতা।
তারপর আচমকা উঠে দাঁড়ায় সুবল। চকিতে কিছু যেন মনে পড়ে গেছে।
বিনয় অবাক। আসলে একা একা বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। মেস-বাড়ি এখনও নিঝুম। কাজকর্ম সেরে কেউ ফিরে আসেনি। তাছাড়া বোর্ডারদের কারও সঙ্গে আলাপ-টালাপ হয়নি। চেনাজানার মধ্যে এক ম্যানেজার মতিলাল চাকলাদার। কিন্তু সে ব্যস্ত মানুষ, আড্ডা দেবার মতো ফুরসত তার নেই। কিন্তু বিনয়ের হাতে এই বিজন সন্ধেয় আজ অঢেল সময়। ভেবেছিল সুবলের সঙ্গে খানিক্ষণ গল্প করে কাটিয়ে দেবে। জিজ্ঞেস করল, কী হল, উঠে পড়লে যে? তোমাদের বাড়ির খবর তো কিছুই জানা হল না।
সুবল কুণ্ঠিতভাবে বলল, অহন আর বইতে পারুম না। ম্যানেজারবাবু আপনেরে চা দিয়াই চইলা যাইতে কইছিল। তলে (নিচে) কী জারারি কাম আছে। আর দেরি করলে চেইতা (রেগে) যাইব। আপনে তো ম্যাসেই (মেসেই) থাকবেন। পরে আমাগো কথা শুইনেন।
সুবল চলে গেল।
পড়ার মতো এমন কিঁছুই সঙ্গে নেই যে সন্ধেটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। তার বইপত্র সব সুধাদের বাড়িতে পড়ে আছে। মনে করে যদি নিয়ে আসত। এখন কী আর করা!
কিন্তু না, ভূতের মতো হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হল না। চা খাওয়া যখন শেষ হয়ে এসেছে সেই সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল হারু আর দুলাল। দুজনের শরীরেই অপুষ্টির ছাপ। ভরপেট খেতে যে পায় না–গর্তে বসা চোখ, গায়ের ফ্যাকাসে চামড়া, ভাঙা গাল দেখলেই টের পাওয়া যায়। পরনে ময়লা পাজামা আর শার্টের ওপর জেলজেলে সোয়েটার।
প্রথম যেদিন শান্তিনিবাস-এ প্রসাদের কাছে আসে সেদিনই হারু আর দুলালকে দেখেছিল বিনয়। ওদের সঙ্গে আলাপ হয়নি, তবে দুজনের সম্বন্ধে অনেক কথাই প্রসাদের মুখে শুনেছে। ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জের কাছাকাছি নগণ্য এক শহর কমলাপুরে ওদের ছিল আদি বাড়ি। রীতিমতো সচ্ছল অবস্থা।
দেশভাগের পর সমস্ত কিছু পলকে ওলটপালট হয়ে গেল। পাকিস্তান হবার পর ঘাতকবাহিনী হারু আর দুলালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিরুপায়, আতঙ্কগ্রস্ত দুলালরা অগত্যা সর্বস্ব খুইয়ে এক জামা-কাপড়ে কলকাতায় চলে আসে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুই বাবা ওদের কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু নিয়মিত মাইনে দিতে পারত না। ফলে ওরা কলেজে যেত না। নাম কাটা গিয়েছিল।
বিনয়ের মনে আছে, সেদিন এই নিয়ে প্রসাদ দুলালদের যথেষ্ট বকাঝকা করেছেন। তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজের বকেয়া মাইনে মিটিয়ে ফের ক্লাস করতে বলেছিলেন। এতটুকুই শুধু ওদের সম্বন্ধে জানা আছে বিনয়ের।
পায়ে পায়ে অভাব। আধপেটা খেয়ে থাকা। জীবনযুদ্ধ বলে একটা শব্দ দিবারাত্রি তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তবু মুখে হাসি লেগেই থাকে হারুদের। ঘরে ঢুকেই তারা কলবলানি শুরু করে দেয়।
হারু বলে, প্রসাদকাকার মুখে আপনের কথা ম্যালা শুনছি। হেই দিন আপনেরে দেখছিও। কিন্তুক আলাপ পরিচয় হয় নাই। এই ম্যাসে আইয়া থাকবেন শুইনা কী ভাল যে লাগছে। ঠিক কইরাই রাখছিলাম আপনে যেই দিন আইবেন, দেখা করুম।
বিনয় হাসে, তাই বুঝি?
দুলালও তড়বড় করে তার উচ্ছ্বাস জানায়।
আত্মীয়-পরিজন নয়। দীর্ঘকালের পরিচিত হলে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেরকমও কিছু নয়। আগে একবারই মাত্র তাদের দেখেছে। অথচ দুই যুবক তার জন্য ব্যগ্র হয়ে রয়েছে। হারুদের দেখতে দেখতে মন ভরে যাচ্ছিল বিনয়ের। বলল, সেদিন শুনে গিয়েছিলাম, তোমরা আবার কলেজে যাবে। তোমাদের নাইট ক্লাস, না?
হ।
তাহলে সন্ধেবেলায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে এসেছ যে? প্রসাদদা জানতে পারলে কিন্তু ভীষণ রাগ করবেন।
আইজ কলেজের ফাউন্ডেশন ডে। হের লেইগা কলেজ ছুটি।
আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো গল্প চলল। তারপর হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। তোমাদের এখানে ফার্নিচারের দোকান আছে?
হারু জিজ্ঞেস করল, আছে। ক্যান কন তো?
ঘরের অবস্থা তো দেখছ। কেউ এলে বসতে দেবার কিছু নেই। দুটো চেয়ার আর একটা টেবল কিনব।
আমরা আপনেরে লইয়া যামু। কবে যাইতে চান?
আজ হাতে কোনও কাজ নেই। এখন গেলে দোকান খোলা পাওয়া যাবে?
ছয়টাও বাজে নাই। কলকাতায় রাইত আটটা সাড়ে-আটটা তরি (পর্যন্ত) দোকানপাট খুলা থাকে। লন যাই
তার জন্য কিছু করতে পারবে, তাই ছেলে দুটো উৎসাহে যেন টগবগ করছে। বিনয় জামাকাপড় পালটে, গোটাকয়েক টাকা পকেটে পুরে হারুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
সারাদিন ঝিমিয়ে থাকার পর শান্তিনিবাস এই সন্ধেবেলায় সরগরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিনয়ের চোখে পড়ল, ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। অফিস-টফিস করে কিংবা অন্য কাজকর্ম চুকিয়ে বেশ কজন বোর্ডার ফিরে এসেছে। আগের দিন যে এসেছিল তখন এদের সঙ্গে দেখা হয়নি বিনয়ের। ওরাও তাকে দেখেনি। পরস্পর সম্পূর্ণ অচেনা। তাই কথাবার্তা নয়, একটু চোখাচোখি হল শুধু। শান্তিনিবাস-এ যখন থাকছে তখন পরে সবার সঙ্গেই আলাপ হবে।
একতলায় আসতেই দেখা গেল, চাতালের বাঁ দিকের বারান্দায় দুটো লোক পাহাড় প্রমাণ আনাজ কাটতে বসেছে। পাশের রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়েছে। খোলা জানালা দিয়ে গল গল করে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছিল। চোখ জ্বালা করতে লাগল বিনয়দের।
চাতাল বাঁয়ে রেখে প্যাসেজে এসে ম্যানেজারের ঘরের সামনে একটু দাঁড়াল বিনয়। আগে যেমন দেখেছে, এখনও মতিলালকে অবিকল সেই ভঙ্গিতেই দেখা গেল। হাতে কলম, টেবলে পেল্লায় জাবদা খাতা, তার ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে লোকটা।
বিনয় তাকে ডেকে বলল, ম্যানেজারবাবু, আমি হারুদের সঙ্গে একটু ঘুরে আসছি।
মুখ তুলে চশমার ওপর দিয়ে তাকায় মতিলাল।-বিনয়বাবু সিজন চেঞ্জের সময় বাতাসে চোরা ঠাণ্ডা আছে। দেখবেন জ্বর জারি যেন না হয়।
প্রসাদ ম্যানেজারকে তার ওপর নজর রাখতে বলেছিলেন। সে গার্জেনগিরি ফলাতে শুরু করেছে। তাকে নাবালক ভাবছে নাকি? যাই ভাবুক, খুব একটা খারাপ লাগল না বিনয়ের। বরং একটু মজাই পায়। বলল, না না, বেশিক্ষণ বাইরে থাকব না।
আমাদের মেসে রাতের খাওয়া কিন্তু দশটার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলা হয়।
তার অনেক আগেই ফিরে আসব।
দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়ায় বিনয়। আজকের দিনটা তো মোটামুটি আলস্যের মধ্যে কেটে গেল। একেবারেই ব্যস্ততাহীন। কিন্তু কাল থেকে ফের পুরোনো রুটিনে ফিরে যেতে হবে। সেই জবরদখল কলোনি বা ত্রাণশিবিরগুলোতে ছোটাছুটি। সে বলে, কাল সকালে আমি চান করে বেরিয়ে যাব। গরম জল পাওয়া যাবে?
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কখন দরকার?
সাড়ে সাতটায় পেলে ভাল হয়।
পাবেন। সুবল আপনাদের তেতলার বাথরুমে দিয়ে আসবে। কিন্তু
কী?
অত সকালে তো ভাত দেওয়া যাবে না। রান্না নামতে সেই নটা
আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। দুপুরেও ফিরব না। বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।
রাস্তায় এসে হারুদের বকবকানি চলতে লাগল। একটু এগুতেই ডান পাশে একটা লম্বা ব্যারাক টাইপের বাড়ি। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনি, মাথায় টিনের চাল, লাইন দিয়ে অগুনতি ঘর। সেটা দেখিয়ে দুলাল বলল, এই বাড়িতে আমরা থাকি।
আগের দিনই প্রসাদ বিনয়কে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সে কিছু বলল না।
দুলাল সামনের বাঁকের মাথায় পাশাপাশি একটা লঞ্জি আর একটা কবিরাজখানার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।রাইতে আমি লন্ড্রিতে শুই, আর হারু শোয় কবিরাজের গদিতে।
বিনয় লক্ষ করল, লটার নাম দি গ্রেট বেঙ্গল ডাইং অ্যাণ্ড ক্লিনিং হাউস। কবিরাজখানাটার, নাম বেশ আধুনিক-আরোগ্যধাম। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বাড়ি থাকতে ওখানে গিয়ে শোও কেন?
আমাগো দুই ফেমিলির একখান কইরা তো ঘর। ভাই-বইন মিলাইয়া আমরা ছয়জন। হারুরা সাতজন। ঘরে জাগা কই যে শুমু! লরি মালিক হারাধনদা আর কবিরাজ মাধব স্যান (সেন) দয়া কইরা শুইতে দ্যায়। নাইলে ফুটপাথে পইড়া থাকতে হইত।
হারু বলে, যদি কুনো কারণে দরকার হয়, দিনের বেলা হইলে আমাগো বাড়ি খবর দিয়েন। রাইত দশটার পর হইলে লন্ড্রি কি কবিরাজখানায়
বিনয় উত্তর দিল না। এই উদ্বাস্তু যুবক দুটি কী কষ্ট করেই না এই পৃথিবীতে টিকে আছে। পরক্ষণে শিয়ালদা স্টেশনে গাদাগাদি করে পড়ে থাকা মানুষগুলোর সারি সারি মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। তৎক্ষণাৎ মনে হয়, সেই তুলনায় হারুরা তো স্বর্গে রয়েছে। তবু বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে।
মহেশ হালদার লেন থেকে হরিশ মুখার্জি রোডে এসে পড়ে বিনয়রা। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দুলাল বলে, আপনেরে একখান কথা কমু, প্রসাদকাকায় য্যান জানতে না পারে।
কৌতূহলও হয়, সেই সঙ্গে বিস্ময়ও বোধ করে বিনয়।–কী কথা?
প্রসাদকাকার মুখে শুনছি, আপনে খবরের কাগজে কাম করেন। রিপোর্টার। কত বড় বড় লোকের লগে আপনের জানাশুনা। তাগো কইয়া আমাগো একটা চাকরি বাকরি কি জুটাইয়া দিতে পারেন?
বিনয় চমকে ওঠে, পড়াশোনা করছ। এখনই চাকরি কীসের?
আপনে কি আমাগো ফেমিলির অবস্থা জানেন?
প্রসাদদার কাছে শুনেছি।
প্রসাদকাকায় আমাগো লেইগা ম্যালা পয়সা খরচ করেন। কলেজের মাইনা দ্যান, বইপত্তর কিনা (কিনে) দ্যান, টিফিনের টাকা দ্যান। তিনি কন কম পক্ষে গ্র্যাজুয়েটটা হ। বি.এ পাশ করলে ভাল চাকরি মিলব।
ঠিকই তো বলেন।
কিন্তুক সোংসারের এমুন হাল যে মইধ্যে মইধ্যে উপাস দিয়া থাকতে হয়। গ্রাজুয়েট হইলে দশখান হাত দশখান পাও (পা) কি গজাইবা? আগে তো বাইচা থাকন দরকার। প্রসাদ কাকারে এই কথাখান বুঝাইতে পারি না।
প্রথম যেদিন বিনয় শান্তিনিবাস-এ আসে, প্রায় এ জাতীয় কথা তার সামনেই হারুরা প্রসাদকে বলেছিল। প্রসাদ যেখানে আছেন সেখানে নাক গলানো ঠিক নয়। বিমর্ষ বোধ করলেও বিনয় বলে, আমি তো সবে কাজে ঢুকেছি। কজনকেই বা চিনি। প্রসাদদাকে তোমাদের কথা বুঝিয়ে বল
হারুরা আঁতকে ওঠে।–ওরে বাবা, পড়া ছাড়নের কথা কইলে তেনি আমাগো খাইয়া ফালাইবেন–
বিনয় কী আর বলবে। চুপ করে থাকে। সে যদি হারুদের জন্য চাকরির চেষ্টা করে, প্রসাদ জানতে পারলে কি খুশি হবেন? তিনি রেগে যান এমনটা ভাবতেই পারে না বিনয়।
হরিশ পার্ক, মিত্র ইনস্টিটিউশন পেছনে ফেলে একটা গলির ভেতর দিয়ে ওরা রসা রোডে পৌঁছে যায়। তারপর পূর্ণ সিনেমার ফুটপাথ ধরে খানিকটা হেঁটে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে বিরাট এক কাঠগোলায় বিনয়কে নিয়ে এল হারু আর দুলাল।
একধারে ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে বড় বড় গাছের গুঁড়ি। আর-এক কোনায় লম্বা লম্বা দাঁত-ওলা করাত দিয়ে কাঠ চেরাই হচ্ছে। অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের আসবাব-খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল ইত্যাদি। কোনওটা পুরোপুরি বানানো হয়েছে, কোনওটা আধাআধি। দুটো চেয়ার আর একটা মাঝারি টেবল পছন্দ করল বিনয়। দরদাম করে ঠিক হল একুশ টাকা। গোলাওলা পাঁচটাকা অ্যাডভান্স নিয়ে শান্তিনিবাস-এর ঠিকানা টুকে নিল। চেয়ার দুটো আর টেবলের কিছু কাজ বাকি ছিল। কাজ শেষ করে রং-পালিশ চড়িয়ে সামনের রবিবার পাঠিয়ে দেবে।
কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে বিনয়রা ফের ট্রাম রাস্তায় চলে আসে। হারুরা তার জন্য অনেকটা খাটাখাটনি করেছে। ওদের কিছু খাওয়ানো দরকার।
তিন ঠোঙা মশলা মুড়ি আর তিন ঠোঙা গরম গরম কুড়মুড় ভাজা কিনে খেতে খেতে ওরা হাঁটতে থাকে।
যেজন্য বেরুনো সেই চেয়ার টেবলের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। অকারণে ঘোরাঘুরি করার মানে হয় না। বিনয় বলল, চল, ফেরা যাক—
পূর্ণ সিনেমার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কোনাকুনি উলটো দিকের ফুটপাথে নজর চলে যায় বিনয়ের। সেই মেয়েটা অর্থাৎ আরতি চট বিছিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে আছে। খাতা, কলম, ধূপকাঠি, আদর্শলিপি, পেন্সিল ইত্যাদি রকমারি জিনিস। আশ্চর্য, আরতির কথা সে ভুলেই গিয়েছিল।
কিন্তু আরতি তো সকালের দিকে নটা অবধি দোকানদারি করে। তারপর তার বাবা চেতলার এক গুদামে কাজ সেরে এসে বসে। তখন মেয়েটা স্কুলে চলে যায়। বিকেলের দিকে আর আসে না। আজ কী এমন হল যে তাকে সন্ধেবেলাতেও পসরা নিয়ে বসতে হয়েছে!
হারুদের নিয়ে রাস্তার ওপারে চলে যায় বিনয়। আগে খেয়াল করেনি, এবার দেখা গেল, আরতির পাশে একটা আধবুড়ো লোক বসে আছে।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ?
কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে আরতি। ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফোটে। ও, আপনে! হেই আইছিলেন। হেরপর তো আমাগো দোকানে আর আহেন নাই।
এবার থেকে আসব। কাছেই একটা মেসে চলে এসেছি। তা সন্ধেবেলায় তো তুমি এখানে বসো না—
না। আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষা হইয়া গ্যাছে, রেজাল্টও বাইর হইছে। পরের ক্লাস শুরু হইতে কয় দিন দেরি। ঘরে আজিরা (বেকার) বইসা কী করুম। চইলা আইলাম।
আধবুড়ো লোকটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আরতিকে জিজ্ঞেস করল, তুই বাবুরে চিনস নিকি?
আরতি বলল, চিনুম না? আমাগো দোকান থিকা কত জিনিস হেই দিন কিনা (কিনে) লইয়া গ্যালেন– বলে প্রৌঢ়টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার বাবা রাধানাথ পাল।
বিনয় রাধানাথকে বলে, আপনার কথা আরতির কাছে শুনেছি। খুব কষ্ট করে ওকে আর ওর ভাইবোনদের পড়াচ্ছেন।
নিজের কষ্টের ব্যাপারটা কানেই তুলল না রাধানাথ –বাবু, আমার এই মাইয়াটা হীরার টুকরা। ফুটপাথে দোকান চালাইতে চালাইতে এইখানে বইসাই পইড়া পইড়া সিক্স কেলাস থিকা ফাস্ট অইয়া সেভেনে উঠছে। ভাল কইরা খাইতে দিতে পারি না, ভাল একখান জামা দিতে পারি না। কয় বিএ এম এ পাস করব। যদ্র চায় তদূর পড়ামু। বাবু, আশীৰ্বাদ করেন অর মনের ইচ্ছাখান য্যান পূন্ন (পূর্ণ) হয়।
বিনয় বলল, নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে।
কিছু খাতা-পেন্সিল কিনে রাস্তার ওধারে চলে যায় বিনয়। হারুরা পাশাপাশি হাঁটছে।
বিনয় বলল, বাপ মেয়ে, দুজনের ডিটারমিনেশন দেখলে? এত অভাব, কিন্তু পড়া ছাড়ার কথা ভাবে না।
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। কিন্তু হারুরা নীরব। ওরা কতটা উদ্দীপ্ত হয়েছে, বোঝা গেল না।
মহেশ হালদার লেনে এসে পরে দেখা করবে বলে হারুরা ওদের বাড়ি চলে গেল।
আর-একটু এগিয়ে শান্তিনিবাস-এর সামনে আসতেই বিনয়ের চোখে পড়ল, সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুবল অস্থিরভাবে এধারে ওধারে তাকাচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তরাতরি চলেন। হেই বাবু আপনের লেইগা কতক্ষণ বইয়া রইছে।
বিনয় অবাক। জিজ্ঞেস করে, কোন বাবু?
হেই যেনি দ্যাশের লেইগা জেল খাটছেন। স্বদেশীবাবু
তার মানে স্বাধীনতা-সংগ্রামী হরিচরণ বসু।
৫৭.
বোর্ডাররা ফিরে এসেছিল। শান্তিনিবাস এখন রীতিমতো সরগরম।
কোনওদিকে তাকায় না বিনয়। সুবলের সঙ্গে তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। প্রসাদ বলেছিলেন, হরিচরণ তার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক। আজ যে কোনও সময় মেসে চলে আসতে পারেন। কিন্তু রাত্তিরে সত্যি সত্যিই যে আসবেন, ভাবতে পারেনি বিনয়।
তেতলায় এসে দেখা গেল, প্রসাদের ঘরে বেশ ভিড় জমেছে।
এতগুলো মানুষের মধ্যে প্রথমেই যাঁর দিকে নজর চলে যায় তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। প্রসাদের ইজি চেয়ারটায় তিনি বসে আছেন। চুল ধবধবে সাদা। এই বয়সেও স্বাস্থ্য বেশ মজবুত। চওড়া কপাল। গাল ভেঙে খানিকটা বসে গেছে। খাড়া নাক। ধারালো চিবুক। শিরদাঁড়া কিন্তু টান টান। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পরনে ধুতি এবং পাঞ্জাবির ওপর খদ্দরের মোটা চাদর। বয়স্ক মানুষটিকে ঘিরে রয়েছে আশ্চর্য এক ব্যক্তিত্বের দ্যুতি। বিনয় আন্দাজ করে নিল, ইনিই হরিচরণ বসু।
হরিচরণের ডান পাশে কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছেন একজন প্রৌঢ়। তাঁর চেহারায় হরিচরণের আদলটি আবছাভাবে বসানো। ওঁর ছেলে? নাকি খুব ঘনিষ্ঠ কেউ যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে?
সামনের দিকে একটা মোড়ায় বসেছে মেস-ম্যানেজার মতিলাল চাকলাদার। তাছাড়া আরও কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভব তারা শান্তিনিবাস-এর বোর্ডার। সবাই সসম্ভ্রমে হরিচরণের সঙ্গে কথা বলছে। মতিলালই প্রথম বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। ব্যস্তভাবে সে উঠে দাঁড়ায়। আসুন, আসুন বিনয়বাবু। মেসোমশাই সেই কখন থেকে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। বলে বয়স্ক মানুষটি অর্থাৎ হরিচরণের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়।
বিনয় হরিচরণকে প্রণাম করল। তিনি সস্নেহে তার হাত ধরে সামনের একটা খালি মোড়ায় বসিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আর তুমিই নেই! কোথায় গিয়েছিলে?
কোথায়, কী উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল, জানিয়ে দেয় বিনয়।
মতিলাল কাজের মানুষ। সে উঠে পড়ল। বিনয়কে বলল, রাত্তিরে মেসের এতগুলো লোক খাবে। দেখি রাঁধুনী ঠাকুর রান্নাবান্নার কতটা কী করল। আপনি মেসোমশায়ের সঙ্গে কথা বলুন
শুধু ম্যানেজারই না, হরিচরণের ডান পাশে যে প্রৌঢ়টি বসে ছিলেন সে ছাড়া অন্যরা আর বসল না। বিনয়কে জানালো, এই মেসেই আমরা থাকি। প্রসাদবাবুর কাছে আপনার কথা শুনেছি। পরে ভাল করে আলাপ হবে। বিনয় এবং হরিচরণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারাও চলে গেল।
এই লোকগুলো যে এই মেসের বাসিন্দা আগেই তা অনুমান করে নিয়েছিল বিনয়। সে যখন চেয়ার টেবল কিনতে হারুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল সেই সময়টা ওরা হরিচরণকে সঙ্গ দিয়েছে।
এর আগে মাত্র একজন স্বাধীনতা-সংগ্রামীকেই দেখেছে বিনয়। রাজদিয়া হাইস্কুলের হেডমাস্টার মোতাহার হোসেন চৌধুরি। তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। বেয়াল্লিশের কুইট ইণ্ডিয়া মুভমেন্ট আর রশিদ আলি ডে আন্দোলনের সময় কিছুদিন জেল খেটেছেন। যুদ্ধের সময় ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এও ইংরেজের পুলিশ তার ওপর কম নির্যাতন চালায়নি। বাড়িতে কতবার যে তল্লাশি চালিয়েছে। দু-চার দিন পর পর তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হতো।
মোতাহার হোসেনের পর ভারতবর্ষের আর-একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্বচক্ষে দেখল বিনয়। অদ্ভুত এক শিহরন অনুভব করছিল সে। বলল, প্রসাদদার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। দেশের জন্য আপনার কত যে স্যাক্রিফাইস! প্রসাদদা সেদিন বলেছিলেন, ইংরেজদের জেলে জীবনের সবচেয়ে ভ্যালুয়েবল কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন।
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন হরিচরণ। সামান্য উত্তেজিত দেখালো তাঁকে। বললেন, ও কিছু না। দেশকে কী বলা হয় জানো?
দেশকে তো অনেক কিছুই বলা যেতে পারে। হরিচরণ ঠিক কোনটা ইঙ্গিত করেছেন, বোঝ যাচ্ছে না। বিনয় তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হরিচরণ গভীর স্বরে বললেন, দেশ হল মা। দেশমাতৃকা। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায় থেকে শুরু করে সব কবি, বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ভারতবর্ষকে জননী বলেছেন। মায়ের মুক্তির জন্যে কটা বছর জেল খেটেছি, সেটা কি খুব বড় কৃতিত্বের ব্যাপার হল?
বিনয় টের পাচ্ছিল ভারতবর্ষ সম্পর্কে হরিচরণের মধ্যে অনন্ত আবেগ বদ্ধমূল হয়ে আছে। তার প্রতিটি কথায় তা বেরিয়ে আসছিল।
একটু চুপচাপ।
তারপর হরিচরণ বললেন, প্রসাদ বলছিল, তুমি রিসেন্টলি পাকিস্তান থেকে এসেছ
আজ্ঞে হ্যাঁ। এই দুআড়াই মাস হল
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয় সম্পর্কে সব জেনে নিলেন হরিচরণ। কোথায় দেশ, সেখানে এখনও কেউ রয়েছে কি না, কলকাতায় আত্মীয় পরিজনেরা থাকলে কোথায় আছে, ইত্যাদি। নানা প্রশ্নের পর বললেন, কী মনে হয় তোমার, যেভাবে বোজ হাজার হাজার রিফিউজি চলে আসছে, ইস্ট পাকিস্তানে কি মাইনোরিটি বলে কেউ থাকবে না?
এভাবে, কখনও চিন্তা করেনি বিনয়। একটু চুপ করে থেকে সে জানায়, পূর্ব বাংলায় এখনও এক কোটির মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। ট্রেন, স্টিমার বোঝাই হয়ে তাদের অনেকেই দলে দলে চলে আসছে। এটা যেমন ঠিক, তেমনি যারা আসেনি তাদের অনেকেই এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত যে ইণ্ডিয়ার দিকে পা বাড়িয়ে আছে। এমনটা চললে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, বিনয় জানে না।
হরিচরণ বললেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এত বড় হিউম্যান ট্র্যাজেডি ভারতবর্ষে আর কখনও ঘটেছে বলে জানি না। মুখে শুধু হা-হুতাশ না করে এখনই স্ট্রং স্টেপ নেওয়া দরকার। নইলে এই এক্সোডাস বন্ধ করা যাবে না।
বিনয় উত্তর দিল না।
হরিচরণের প্রশ্ন বা আলোচনা বিশেষ একটা জায়গায় স্থির থাকছে না। দাঙ্গা এবং দেশভাগের নানা বিপজ্জনক প্রান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিনি বলতে লাগলেন, পূর্ব পাকিস্তানের এই তো অবস্থা। তুমি নিশ্চয়ই জানো, ওয়েস্ট পাঞ্জাব থেকে ট্রেন ভর্তি হয়ে রিফিউজিরা চলে এসেছে দিল্লি আর ইস্ট পাঞ্জাবে। মুসলমানরাও একই পদ্ধতিতে চলে গেছে ওপারে।
বিনয় বলল, কাগজে পড়েছি।
সামনের দিকে ঝুঁকে হরিচরণ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার স্যাক্রিফাইসের কথা বলছিলে না?
তাঁর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা শ্লেষের সুর ছিল যাতে হকচকিয়ে যায় বিনয়। বলে, আজ্ঞে হা–মানে
কণ্ঠস্বর অনেকটা উঁচুতে তোলেন হরিচরণ, আমার মতো হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর ইংরেজের জেলে পচেছে। কত সোনার টুকরো ছেলে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছে। দেশভাগ হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নতুন ইহুদি বানিয়ে দেওয়া হবে–ফ্রিডম-ফাইটারদের এত স্যাক্রিফাইস কি সেই জন্য?
ভারতবর্ষ বিভাজনের কারণে একটা জাতির জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল, সেজন্য ক্ষোভ, কষ্ট আর আক্ষেপের শেষ নেই হরিচরণের। সব স্বাধীনতা-সংগ্রামীই বুঝি বা তার মতোই অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন। চোখের সামনে তারা দেখলেন, অসংখ্য শহিদের জীবন দান, অজস্র মানুষের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে গেছে। মোতাহার হোসেনকেও দেশভাগের পর পুরোপুরি ভেঙে পড়তে দেখেছিল বিনয়। হরিচরণের মতোই।
কী উত্তর দেবে বিনয়? সে নীরবে বসে থাকে।
হরিচরণ জিজ্ঞেস করলেন, পাটিশানের আগে দাঙ্গায় কত লোক মারা গেছে বলে তোমার ধারণা?
প্রশ্নটা এমনই আকস্মিক যে হকচকিয়ে যায় বিনয়। সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের আগে দাঙ্গা কি কোনও একটা বিশেষ অঞ্চলে ঘটেছে? কলকাতা, বিহার নোয়াখালি, ঢাকা থেকে লাহোর, করাচি, বোম্বে, সুদূর সিন্ধুপ্রদেশ–গোটা উপমহাদেশ জুড়ে তখন রক্তের সমুদ্র। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের পাহাড়।
বিনয় অস্বস্তি বোধ করে। দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যাটা ঠিকমতো জানাতে না পারলে হরিচরণ কি রেগে যাবেন? ভয়ে ভয়ে সে বলে, সারা ইন্ডিয়া জুড়ে রায়ট হয়েছে। এত লোক মরেছে যে তার সঠিক রেকর্ড আছে বলে মনে হয় না।
রেকর্ড না থাক, আন্দাজ তো একটা করতে পারো
মিনিমাম লাখ খানেক
নো নো জোরে জোরে মাথা ঝাঁকান হরিচরণ, আমার হিসেবে অ্যাবাউট থ্রি মিলিয়ন। ত্রিশ লাখের কাছাকাছি। এরা সবাই ভেরি অর্ডিনারি পিপল। গরিব হতভাগ্য মানুষের দল
পূর্ব বাংলার এক নগণ্য শহরে থেকে হত্যার খতিয়ান জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় রাজদিয়ার কারও গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। কিন্তু ঢাকায়? নারায়ণগঞ্জে? বরিশাল কি নোয়াখালিতে? এই জায়গাগুলো তো রাজদিয়া থেকে এমন কিছু দূরে নয়। চল্লিশ থেকে এক শ দেড় শ মাইলের মধ্যে। ওই এলাকাগুলোয় তখন রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে। বিনয়রা সেই সময় এমনই ত্রস্ত, বিহ্বল আর উৎকণ্ঠিত যে ভারতবর্ষ তো বিশাল ব্যাপার, শুধু পূর্ব বাংলায় কতজন খুন হয়েছে, তার খুঁটিনাটি হিসেব রাখার চিন্তাও মাথায় আসেনি।
হরিচরণ থামেননি। বললেন, যে কারণে এত রক্তপাত, এত হত্যা, সেই পার্টিশান তো হয়েই গেছে। তারপরও কি দাঙ্গা থেমেছে?
বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে।-না, থামেনি।
তাহলে এই পার্টিশানের কি প্রয়োজন ছিল?
অস্পষ্টভাবে বিনয় কিছু একটা উত্তর দিল। ঠিক বোঝা গেল না।
একটু ভেবে হরিচরণ জিজ্ঞেস করেন, স্বাধীনতার পরও দাঙ্গায় কত লোক মারা গেছে?
কাঁচুমাচু মুখে বিনয় বলে, ঠিক বলতে পারব না।
হরিচরণ ধমকে ওঠেন, তুমি একজন সাংবাদিক। পার্টিশান, দেশভাগ নিয়ে কাজ করছ। এ সব তোমার জানা উচিত। থরো ধারণা না থাকলে আর সমস্ত তথ্য না জানলে পার্টিশানের কারেক্ট চিত্রটা তুলে ধরবে কী করে?
বিনয় বলল, আমি সবে কাগজে জয়েন করেছি। আপনি যা বললেন সেই সব ইনফরমেশন পুরোনো নিউজপেপার আর বইপত্র ঘেঁটে জোগাড় করে নেব।
হরিচরণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। অনেকটা স্বগতোক্তির ধরনে বললেন, এই রায়ট কোনও দিনই থামবে কি না সন্দেহ। ওপার থেকে উদ্বাস্তুদের আসাও বন্ধ হবে না। কেন জানো?
কেন? নিজের অজান্তেই যেন শব্দটা বিনয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
টু নেশন থিয়োরির বিষ মানুষের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম দুই কমিউনিটির মধ্যে বিদ্বেষ আর ঘৃণাটা এখন ডিপ-রুটেড। ওটা যতক্ষণ না উপড়ে ফেলা যাচ্ছে, হাজার বছরেও এই সমস্যার সমাধান হবে না। একটা কথা ভেবে আমার ভীষণ ভয় হয়।
প্রশ্ন না করে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
হরিচরণ বলতে লাগলেন, সেটা কী জানো? এখন থেকে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট যদি সাবধান না হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের কুফল আমাদের দেশেও এসে পড়বে। আজ হোক, কাল হোক বা দশ বিশ বছর পরেই হোক, তার হাত থেকে নিস্তার নেই। সেকুলার ভারতের পক্ষে সেটা হবে মারাত্মক।
ভবিষ্যতের নিরাশাজনক, ভয়ঙ্কর এক পরিণামের কথা চিন্তা করে মুহ্যমানের মতো বসে থাকেন বৃদ্ধ স্বাধীনতা-সংগ্রামী।
বিনয় অবাক। পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও ভারত এক সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এখানে সব ধর্ম, সব ভাষা, সব জাতির মানুষের সমানাধিকার। দ্বিজাতি তত্ত্ব কীভাবে এ-দেশের আবহাওয়া বিষময় করে তুলবে, সেটা ভেবে পেল না বিনয়।
একটু চুপচাপ।
তারপর হরিচরণ বললেন, ও-সব আলোচনা এখন থাক। তোমার কাছে একটা বিশেষ দরকারে আজ আমাকে আসতে হয়েছে।
অপার বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর বলে, কী দরকার বলুন
তুমি ইস্ট পাকিস্তান, রায়ট, রিফিউজিদের নিয়ে যা লিখছ সেগুলো আমাদের এই সময়ের সত্যিকারের ছবি। টু পিকচার। কিন্তু একটা বিরাট দুঃখের দিক বাদ থেকে যাচ্ছে। তার রেকর্ড না থাকলে এই সময়ের ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না। মস্ত ত্রুটি থেকে যাবে।
বিনয় বলল, আমি তো সব কিছুই তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। কোথায় ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।
বিনয়ের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে হরিচরণ বলেন, এই যে এত রায়ট হচ্ছে তার দুটো টার্গেট কী বলতে পার? প্রশ্নটা করে তার উত্তর নিজেই দিলেন, ল্যাণ্ড আর ইয়াং উইমেন। জমি আর যুবতী মেয়ে।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে। এই দুটো দিকের কথা সেও বহুবার ভেবেছে।
হরিচরণ বিমর্ষ সুরে বলতে থাকেন, অসংখ্য মানুষের ল্যাণ্ড প্রপার্টি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেসব আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মেয়েদের। হাজার হাজার যুবতী মেয়ে নিখোঁজ।
হরিচরণ সবিস্তার বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। যাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের কারওকে কারওকে উদ্ধার করে ইণ্ডিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এই ধর্ষিতা মেয়েদের মা-বাবা বা অভিভাবকরা নিজেদের সংসারে তাদের ফিরিয়ে নিতে একেবারেই রাজি নয়। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এদের জন্য কিছু উদ্ধারাশ্রম খোলা হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো খুবই কম। এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে, বেশ কয়েকটা হোমের মেয়েদের নোংরা কাজে লাগানো হচ্ছে। একবার যাদের সম্ভ্রম নষ্ট হয়েছে তাদের প্রতি কারও সহানুভূতি বা মমতা নেই। ওদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে নরকের দিকে। উদ্ধারাশ্রমে যে মেয়েদের জায়গা হচ্ছে না, শকুনের মতো আঁকে ঝকে দালালরা তাদের পৌঁছে দিচ্ছে বারবনিতাদের পাড়ায়। কলকাতা এবং চারপাশের বেশ্যাপল্লিগুলো ভরে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা লাঞ্ছিতা এই মেয়েদের দিয়ে।
শুনতে শুনতে সীমাহীন আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা যেন থমকে গেছে বিনয়ের। শ্বাস আটকে আসছে। বার বার ঝিনুকের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। তাকে কত খুঁজেছে বিনয়, কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অধর ছুঁইমালী খবর দিয়েছিল, তাকে একটা মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশনে দেখেছে। লোকটা ভাল না মন্দ, তার মাথায় কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে কি না, শেষ অবধি ঝিনুককে সে নরকের খাসতালুকে পৌঁছে দিয়েছে কি না, কে জানে।
হরিচরণ বলছিলেন, আমরা কজন ফ্রিডম-ফাইটার ইস্ট পাকিস্তানের দুঃখী মেয়েদের জন্যে একটা হোম খুলেছি। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য কম। শখানেকের মতো মেয়েকে শেলটার দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কলকাতার চারপাশের রেড-লাইট এরিয়া ঘুরে ঘুরে অনেক মেয়েকে উদ্ধার করে এনেছি। আরও আনব। তিনি জানালেন, একটা মাঝারি তেতলা বাড়িতে কাজ চালাচ্ছেন। তাদের বিরাট পরিকল্পনা। মেয়েগুলো যাতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্য ওদের নানারকম হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে। তাঁত বোনা, চামড়ার কাজ, নানারকম হ্যাঁক্র্যিাফট, এ-সব শিখলে, ওদের তৈরি প্রোডাক্ট বাজারে বিক্রি করে মোটামুটি লাভ হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। বড় জমি না পেলে তেমন কিছুই করা যাবে না। হরিচরণরা এজন্য সরকারের কাছে বরানগরে বিঘে, খানেক জমি চেয়েছেন। ছমাস হয়ে গেল, প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। সরকারি ব্যাপার তো। সমস্ত বিষয়ে গড়িমসি। তাদের আঠারো মাসে বছর।
হরিচরণ বললেন, কলকাতার সব কাগজগুলোকে বলেছি। তারা এই নিয়ে লিখবে। প্রসাদকেও বলেছিলাম। সে জানালো রিফিউজিদের নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট তোমাকে দেওয়া হয়েছে। যা লেখার তুমিই লিখবে। কাগজগুলো শোরগোল তুললে সরকারি কর্তাদের কানে জল ঢুকবে। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, কী, লিখবে তো?
অন্যমনস্কর মতো বিনয় বলল, লিখব। কয়েক লহমা থেমে থাকার পর ঝিনুকের জন্য তার হৃৎস্পন্দনের গতি এখন অনেক বেড়ে গেছে। সে যেন বুকের ভেতর লক্ষ লক্ষ হাতুড়ি পেটার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল।
হরিচরণ বলছিলেন, তোমাদের লেখালিখিতেও যদি কাজ না হয়, বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করব। জমি আমাদের চাইই ।
তার শেষ কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল না বিনয়। আচমকা সে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের হোমে ঝিনুক নামে কোনও মেয়ে আছে? তার চোখেমুখে, কণ্ঠস্বরে তীব্র উৎকণ্ঠা।
হরিচরণ অবাক।–কে ঝিনুক?
পরিচয় দিতে গিয়েও থমকে যায় বিনয়। বলে, আমার জানাশোনা একটি মেয়ে। দাঙ্গায় ওর সর্বনাশ হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই ও নিখোঁজ।
হরিচরণ খানিক ভেবে বললেন, এতগুলো মেয়ে আমাদের হোমে রয়েছে। সবার নাম কি মনে আছে!
আমি যদি আপনাদের হোমে একদিন যাই?
ঝিনুকের খোঁজে? ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাব? বলে একটু চুপ করলেন হরিচরণ, তারপর বললেন, ঝিনুকের জন্যে না হলেও তোমাকে আমি নিয়ে যেতাম। আমাদের হোমের মেয়েগুলোকে নিয়ে কাগজে লেখা খুব জরুরি।
আপনারা তো ইস্ট পাকিস্তানের মেয়েদের উদ্ধার করতে ব্রথেলগুলোতে যান?
হ্যাঁ, যাই
আপনাদের হোমে ঝিনুককে না পাওয়া গেলে আপনাদের সঙ্গে ব্রথেলগুলোতে গেলে আপত্তি নেই তো?
বিনয়ের উদ্দেশ্যটা অনুমান করতে পারছিলেন হরিচরণ। বললেন, ঠিক আছে, যেও। দেখ যদি মেয়েটাকে খুঁজে পাও–।
একসময় উঠে পড়লেন হরিচরণ। অনেক রাত হয়েছে। আজ, চলি হঠাৎ কিছু খেয়াল হতে তাঁর সঙ্গী প্রৌঢ়টিকে দেখিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন, ওই দেখ, তোমাদের আলাপই করিয়ে দেওয়া হয়নি। ও আমার ভাইপো হিমাংশু। আমি ওদের কাছেই থাকি। এই রাস্তারই বত্রিশ নম্বর বাড়ি। মাঝে মাঝে যেও
বিনয় আগেই আন্দাজ করেছিল, প্রৌঢ়টি হরিচরণের আত্মীয়স্বজন কেউ হবেন। বলল, নিশ্চয়ই যাব।
হরিণচরণরা চলে গেলেন। বিনয় তাঁদের সঙ্গে নিচে এসে রাস্তা অবধি এগিয়ে দিল।
৫৮.
কার অনবরত ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল বিনয়ের। গা থেকে মোটা চাদরটা সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে সে। সব দরজা জানালা বন্ধ। শিয়রের দিকের দেওয়ালের মাথায় উঁচু ঘুলঘুলি দিয়ে সোনালি রোদের দু-চারটে সরু-মোটা ফালি এসে পড়েছে ঘরে। ওই সামান্য আলোয় কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়।
ঘুমের ঘোর লেগে আছে চোখে। প্রথমটা বিনয় বুঝে উঠতে পারল না কে ডাকছে কিংবা এই মুহূর্তে সে কোথায় রয়েছে।
দুয়ার খুলেন। ম্যালা বেইল (অনেক বেলা) অইয়া গ্যাছে। ফের ডাকটা শোনা যায়। এবার কণ্ঠস্বর অনেকটা উঁচুতে উঠেছে। সেটা চেনাও গেল। সুবল।
বিছানা থেকে নেমে প্রথমে ভেতর দিকের দরজা খুলে দিল বিনয়। সুবলকে বলল, এস
সুবল বলে, অহন যামু না। আপনে মুখ ধুইয়া তরাতরি দাদার ঘরে আসেন। আমি চা লইয়া এটু পরে হেইখানে যামু প্রসাদকে দাদা বলে সে।
আমার চানের জন্যে বাথরুমে গরম জল দিয়েছ?
কালই সুবলকে গরম জলের কথা বলা হয়েছিল। কেন না সকালে চানটান সেরে একটু কিছু খেয়ে সে রিফিউজিদের কলোনি কি রিলিফ ক্যাম্পে চলে যাবে।
সুবল বলল, না, দেই নাই। দাদায় অহন আপনেরে বাইর অইতে না করছে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমি কইতে পারুম না। তেনির কাছে গ্যালে জানতে পারবেন।
উদ্বাস্তুদের কলোনি টলোনিতে রোজ সকালে যাবার অ্যাসাইনমেন্ট প্রসাদই তাকে দিয়েছিলেন। কী এমন ঘটল যে আজ যেতে বারণ করছেন? কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। তারপর অন্যমনস্কর মতো ঘরের বাকি দরজা জানালাগুলো খুলে দিল। শীতল রোদ আর ঠাণ্ডা বাতাস ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শীতটা প্রায় চলেই গিয়েছিল। দার্জিলিংয়ে প্রচুর বরফ পড়ায় আবার সেটা সাময়িক হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
জাফর শা রোডে থাকতে তার বাসি, ধামসানো বিছানা ঝেড়ে, বেডশিট টান টান করে পেতে দিত উমা কি সুধা। শান্তিনিবাস-এ উমাও নেই, সুধাও নেই। নিজের যাবতীয় কাজ বিনয়কেই করতে, হবে। আজ থেকেই তার স্বাবলম্বী হবার ট্রেনিং শুরু।
বিছানাটা মোটামুটি গোছগাছ করে গামছা, দাঁতের মাজন, জিভছোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়। তার পাশের ঘরটাই প্রসাদের। ভেতর দিকের রেলিং-লাগানো লম্বা প্যাসেজ ধরে তেতলার চান ঘরের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ল, প্রসাদ তার ইজি চেয়ারটিতে বসে আছেন। সামনের নিচু টেবলটায় এক পাউন্ড ওজনের লম্বা লম্বা পাউরুটির স্তূপ। ছুরি দিয়ে খুব যত্ন করে সমান মাপে কেটে কেটে রাখছেন। টেবলের পাশে শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে কেরোসিনের স্টোভ জ্বলছে। স্টোভটার মাথায় মাখনের মস্ত একটা কৌটো।
প্রথম যেদিন শান্তিনিবাস-এ বিনয় আসে, অবিকল এইভাবেই প্রসাদকে পাউরুটি কাটতে দেখেছিল বিনয়। রুটি কাটা হল স্লাইসগুলোতে মাখন লাগানো হবে। এই এলাকার বস্তিগুলোতে যে শীর্ণ, খেতে না-পাওয়া, কালো কালো বাচ্চাগুলো থাকে, কিছুক্ষণের মধ্যে ঝাঁকে ঝাকে তারা হানা দেবে। প্রসাদ বলেছিলেন; এই বাচ্চাগুলো পেট ভরে খেতে পায় না। অপুষ্টিতে ভোগে। তাই
এই রুটি-মাখন বিতরণ। এটা প্রসাদের নিত্যকর্মপদ্ধতির মধ্যে পড়ে।
বিনয় দাঁড়ায় না। বাথরুমের কাজ সেরে নিজের ঘরে গিয়ে বাসি জামাকাপড় পালটে, গায়ে। চাদর জড়িয়ে প্রসাদের ঘরে চলে আসে।
মুখ তুলে এক পলক বিনয়কে দেখে প্রসাদ বললেন, এসে গেছ! গুড। আমাকে একটু হেল্প কর। রুটির স্নাইসগুলোতে মাখন লাগিয়ে চিনি ছড়িয়ে দাও।
সেদিনও বিনয়কে এই কাজটাই করতে হয়েছিল। চামচে করে গলা মাখন তুলে নিঃশব্দে রুটিতে মাখাতে থাকে সে।
প্রসাদ এবার বললেন, কাল অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ। তুমি ঘুমোচ্ছ। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর ডাকিনি।
বিনয় বলল, একা একা ভাল লাগছিল না। আপনার জন্যে অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম। তারপর সুবলকে দিয়ে রান্নাঘর থেকে ভাত টাত আনিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়েছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, খেয়াল নেই।
আমার তো ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো হয়ে যায়। নাইট ডিউটি না থাকলে তোমার ছুটি হবে অনেক আগে। কালই তো বলেছি আমার জন্যে অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকবে না।
আচ্ছ বিনয় কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু মনের ভেতর খিচটা থেকে গেছে। কেন যে প্রসাদ তাকে আজ বেরুতে বারণ করলেন, বোঝা যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করে যে জেনে নেবে, তেমন সাহসও হচ্ছে না।
ম্যানেজারের কাছে শুনলাম, কাল হরিচরণবাবু এসেছিলেন। কেমন লাগল তাকে? প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন।
ভীষণ ভাল। অতবড় ফ্রিডম-ফাইটার, কিন্তু এতটুকু অহঙ্কার নেই।
প্রসাদ বললেন, শুধু তাই না, হানড্রেড পারসেন্ট আইডিয়ালিস্ট। এই তো সেদিন দেশ স্বাধীন হল। এর মধ্যেই বেশ কিছু পুরোনো স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভোল পালটে গেছে। আদর্শবাদ টাদ শিকেয় তুলে আখের গোছাবার ব্যবস্থা করছে। লোভ, লোভ, লোভ। দেশের জন্যে একসময় কিছু করেছে, এখন সুদে-আসলে তার রিটার্ন চায়। শেষ জীবনটা যাতে সুখে আরামে কাটিয়ে দিতে পারে। বিনয়, খবরের কাগজে কাজ করছ। এদের অনেকেরই সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে। তখন এই লোকগুলোর স্বরূপ বুঝতে পারবে। তবে হরিচরণবাবুর মতো পেট্রিয়টরা একেবারে অন্য ধাতের। সৎ, নির্লোভ।
কালই তা বুঝতে পেরেছিল বিনয়। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার মন অপার শ্রদ্ধায় ভরে যাচ্ছিল। বলল, দেশভাগটা উনি মেনে নিতে পারেননি। এই নিয়ে ওঁর ভীষণ ক্ষোভ।
হ্যাঁ। হরিচরণবাবুদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক।
হই হই করতে করতে বোগা রোগা এক পাল ছেলেমেয়ে পাঁচ মিনিটের ভেতর তাদের ভাগের রুটি-মাখন নিয়ে কলর বলর করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় নেমে গেল। প্রথম যেদিন বিনয় এই মেসে আসে সেদিনও এই ছেলেমেয়ের দঙ্গলটা দেখেছিল।
এদিকে সুবল চা-বিস্কুট নিয়ে এসেছে। বিনয় আগেই শুনেছিল, মেস থেকে দুপুরে এবং রাত্তিরে ভাত দেওয়া হয়। আর সকাল-সন্ধেয় চা-বিস্কুট। কিন্তু জলখাবারটা বোর্ডারদের আলাদা কিনে খেতে হয়।
এখনও সকালের খাবার খাওয়া হয়নি। রুটি-মাখন বস্তির বাচ্চাদের জন্য। সে-সব প্রসাদ কোনও দিন খান না। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী আনাব বল। লুচি ছোলার ডাল, না হিঙের কচুরি আর আলুর দম?
বিনয় আজ সেদিনের মতো প্রসাদের গেস্ট নয়, এই মেসেরই একজন বোর্ডার। অতিথি হলে আপ্যায়ন করতেন–ঠিক আছে। কিন্তু অন্য একটি বোর্ডারের জন্য অহেতুক খরচ করবেন, এতে ভীষণ সঙ্কোচ বোধ করছিল বিনয়। অথচ মুখের ওপর আপত্তি করা যাচ্ছে না। সে চুপ করে থাকে।
মুখ-চোখ দেখে বিনয়ের মনোভাব আঁচ করে নিয়ে প্রসাদ হালকা গলায় বললেন, খাওয়ার ব্যাপারে এত লজ্জা কীসের? ঠিক আছে, পরে তুমি একদিন আমাকে খাইয়ে দিও। সুবলকে দিয়ে দোকান থেকে চুরি আর মিষ্টি টিষ্টি আনিয়ে নিলেন।
খেতে খেতে ফের হরিচরণের প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন প্রসাদ, উনি আর ওঁর কজন বন্ধু একটা বড় হোম করছেন। ইস্ট পাকিস্তানে দাঙ্গায় যে মেয়েদের সর্বনাশ হয়েছে তাদের এনে এনে ওই হোমে শেলটার দেওয়া হচ্ছে। হরিচরণবাবু এ-সব কি তোমাকে জানিয়েছেন?
হ্যাঁ। হোমটা নিয়ে লিখতেও বলেছেন।
বিরাট কাজে ওঁরা হাত দিয়েছেন। যেভাবে পারা যায়, ওঁদের সাহায্য করা উচিত। তুমি সব ইনফরমেশন জোগাড় করে ডিটেলে লিখে অ৫ কে দেবে। নির্যাতিত মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হরিচরণরা যা পরিকল্পনা করেছেন তা নিয়ে কালই বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যে কারণে আজ বিনয়ের ক্যাম্প বা কলোনিতে যাওয়া বন্ধ করেছেন তার ধার-কাছ দিয়েও যাচ্ছেন না প্রসাদ। একরকম মরিয়া হয়েই কথাটা তুলল বিনয়।
প্রসাদ বললেন, ওটা আমি ভুলে যাইনি। এখনই তোমাকে বলতাম। হরিচরণবাবুর সঙ্গে কাল তোমার কী কথা হয়েছে, সেটা আগে জেনে নিলাম। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, তুমি কাল অফিসে যাওনি। এদিকে ভীষণ খারাপ একটা খবর এসেছে।
বিনয় চমকে উঠে, কী খবর?
আসাম থেকে মাঝে মাঝে কিছু রিফিউজি চলে আসছিল। সংখ্যায় কম। কিন্তু কাল থেকে দলে দলে আসতে শুরু করেছে। বলতে পার ঢল নেমেছে। আজ দুটো আড়াইটা নাগাদ একটা ট্রেন এইরকম উদ্বাস্তু বোঝাই হয়ে শিয়ালদায় ঢুকবে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে তুমি আর আমি বেরিয়ে পড়ব। তুমি সোজা শিয়ালদায় চলে যাবে। আমি অফিসে গিয়ে সেখানে একজন ফোটোগ্রাফার পাঠিয়ে দেব।
বিনয় চমকে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত নেমেছে ইন্ডিয়ায়। চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে সীমান্ত পেরিয়ে তারা রোজই হাজারে হাজারে চলে আসছে। বেশির ভাগই অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে। আসামে এবং ত্রিপুরাতেও যাচ্ছে অজস্র। এ তো চলছেই।
উদ্বাস্তুদের নিয়ে আসামে সেই দেশভাগের পর থেকেই নানা ধরনের অশান্তি শুরু হয়েছিল। বিনয় তা জানে। কিছু উদ্বাস্তু সেখানে টিকতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে। এমন কারও কারও সঙ্গে বিনয়ের দেখাও হয়েছে। কিন্তু ট্রেন বোঝাই হয়ে তাদের আসার খবরটা এই প্রথম শোনা গেল।
প্রসাদ থামেননি, যারা আসছে, তাদের কোন পরিস্থিতিতে আসাম ছাড়তে হল, ডিটেলে সব জেনে নেবে। ফোটোগ্রাফারকে দিয়ে তাদের ছবি তোলাবে। তারপর অফিসে এসে বড় করে একটা রিপোর্ট লিখে দেবে।
বিনয় এতক্ষণে বুঝতে পারল, জবরদখল কলোনি বা ত্রাণশিবিরগুলোতে গিয়ে তথ্য জোগাড় করার চাইতেও আসাম থেকে চলে-আসা উদ্বাস্তুদের ব্যাপারটা এই মুহূর্তে অনেক বেশি জরুরি।
একটু ভেবে প্রসাদ ফের শুরু করলেন, আসাম থেকে সব উদ্বাস্তু যদি চলে আসতে থাকে ওয়েস্ট বেঙ্গলের সমস্যা মারাত্মক বেড়ে যাবে।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। হ্যাঁ
মেসের খাওয়ার ঘরটা একতলায়। বারোটা নাগাদ চানটান সেরে প্রসাদের সঙ্গে সেখানে চলে এল বিনয়। বাইরে বেরুবার মতো পোশাক পরে, তৈরি হয়ে এসেছে দুজনে। খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে এখন থেকেই ওরা বেরিয়ে পড়বে।
খাবার ঘরে এই প্রথম এল বিনয়। কাল রাতে ওপরে তার ঘরে ভাত মাছ টাছ সুবলকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিল। তাই নিচে আর নামা হয়নি।
ঘরটা বেশ বড় মাপের। সেটার তিন পাশে গায়ে গায়ে লাগা আরও তিনটে ঘর, সামনের সরু প্যাসেজের উলটো দিকে কিচেন। আলো-হাওয়া খেলে না। এই দুপুরবেলাতেও ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার। তাই মাথার ওপর দুটো বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব সারাক্ষণই সে দুটো জ্বলে।
টেবল চেয়ার নেই। খাওয়ার ব্যবস্থা মেঝেতে বসে। দেওয়ালের ধার ঘেঁষে লাইন দিয়ে আসন পাতা।
শান্তিনিবাস এখন একেবারে নিঝুম। বোর্ডাররা অনেক আগেই যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে।
খাওয়ার ঘরটা ফাঁকা। প্রসাদরা আসনে গিয়ে বসতেই একটি আধবয়সী লোক দৌড়ে এল। গোলগাল চেহারা, গোল মুখ, গাওয়া ঘিয়ের মতো গায়ের রং। ঝাকড়া চুল ঝুঁটি বাধা। পানের রসে মুখ টইটম্বুর। চোখে এবং ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি লেগে আছে। তার সঙ্গে রয়েছে একটা সতেরো আঠারো বছরের ল্যাংপেঙে ছেলে।
প্রসাদ ঝুঁটি-বাঁধা লোকটি এবং ছেলেটার সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মাঝবয়সীটি। মেসের রাঁধুনী ঠাকুর। নাম বলরাম। আদি বাড়ি ওড়িশার বালেশ্বর জেলায়। পঁচিশ বছরেরও বেশি শান্তিনিবাস-এর রান্নাঘর সামলাচ্ছে। ছেলেটির নাম গণেশ। বলরামের সহকারী।
প্রসাদ বললেন, বিনয়বাবু মেসে নতুন এসেছেন। আমার পাশের ঘরে আছেন।
বলরাম মানুষটি খুবই বিনয়ী। ভদ্র। বলল, তাঙ্কর (তার) এইটি আসিবার কথা গতকালই ম্যানেজারবাবু কহিথিলা।
প্রসাদ বললেন, বাবু এই প্রথম মেসে থাকছেন। যত্ন করে খাইও
সে আপনাঙ্কর ভাবিবার কিছি দরকার নাই। প্রভু জগন্নাথ কুপায়ে মু তার সব ব্যবস্থা করি পারিবি।
আমাদের এখনই বেরুতে হবে। তাড়াতাড়ি খেতে দাও–
বলরামরা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল। একটু পর বড় কাঁসার থালায় ভাত, বাটিতে বাটিতে ডাল, তরকারি, মাছ ইত্যাদি এনে দুজনের সামনে সাজিয়ে দিল। কাঁসার গেলাসে দিল খাবার জল।
দ্রুত খাওয়া চলছে।
বলরাম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পলকহীন। তার রান্না নতুন বোর্ডারটির কেমন লাগছে, জানার জন্য ভীষণ উগ্রীব। জিজ্ঞেস করল, রসুই কিমিতি হেইচি বাবু?
সত্যিই বলরামের রান্নার হাত চমৎকার। বিনয় বলল, খুব ভাল।
বলরামের মুখ খুশিতে ভরে যায়। একটা বাটি থেকে পাতে তরকারি ঢেলে ভাত দিয়ে মেখে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বিনয়ের মনে হল, স্বাদটা পরিচিত নয়। একটু অন্যরকম।
বলরাম লক্ষ রাখছিল। জিজ্ঞেস করল, যেটা খাইলে সোটা কন জিনিস কহন্তু
বলরাম ওড়িয়া বললেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। বিনয় বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না।
বলরাম ভুরু দুটো সামান্য নাচিয়ে ছড়া কাটল :
পিলাটি দিনরে (ছেলেবেলায়) মুণ্ডরে টুপি
কুষ্ণ অবতারে মহিলা গুপি।
রাম অবতারে রাবণ মারি
আজি হইথিলা সেই তরকারি।
কিছুই বোধগম্য হল না। হাঁ করে বলরামের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
প্রসাদ পাশ থেকে হেসে হেসে বললেন, বুঝলে না তো?
না
প্রসাদ বুঝিয়ে দিলেন। কচি বাঁশের কোঁড় যখন বেরোয়, তার ওপর মাটির হাঁড়ি চাপা দেওয়া হয়। বাঁশটি হাঁড়ির ভেতর বাড়তে বাড়তে গোলাকার হয়ে আটকে থাকে। তখন সেটা বার করে কেটে কুটে ঘি গরম মশলা দিয়ে উপাদেয় ব্যঞ্জন তৈরি করা হয়। এই মুহূর্তে তাই দিয়েই ভাত খাচ্ছে বিনয়। সে বলল, কিন্তু রাম, কৃষ্ণ–এঁদের সঙ্গে তরকারির কী সম্পর্ক?
প্রসাদ বললেন, রাম অবতারে এই বাঁশ দিয়ে তীর ধনুক তৈরি করে রাবণকে মারা হয়েছিল। সেই বাঁশই কৃষ্ণের হাতে বাঁশি হয়েছে। তাই ছড়াটাকে রহস্যময় করে তোলার জন্য রাম, রাবণ আর কৃষ্ণকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এবার মাথায় ঢুকল?
বিনয় হেসে ফেলল। ঢুকেছে। বলরামকে খুব ভাল লেগে গেল তার। বেশ মজাদার মানুষ। কিছুক্ষণের জন্য আসামের চিন্তাটা সে ভুলিয়ে রাখল।
খাওয়া দাওয়ার পর প্রসাদরা রসা রোডে এসে বাস ধরল। ধর্মতলায় পৌঁছবার পর গাড়ি বদলে প্রসাদ চলে গেলেন নতুন ভারত-এর অফিসে। বিনয় এল শিয়ালদায়।
শিয়ালদার লেশমাত্র পরিবর্তন নেই। সেই এক দৃশ্য। অজস্র মানুষ থিক থিক করছে চারদিকে। সর্বক্ষণ ঝগড়াঝাটি, চিৎকার। বাতাসে দুর্গন্ধ অনড় হয়ে আছে। সমস্ত কিছু নোংরা, দুষিত, কুৎসিত।
মেন স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি সরকারি রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অস্থায়ী অফিস। সেখানে আসতে অলোকপ্রসাদ সেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি এখানকার অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন। উদ্বাস্তুদের জন্য সৌম্য, ভদ্র, হৃদয়বান এই মানুষটির অপার সহানুভূতি।
প্রথম যেদিন রামরতন গাঙ্গুলির মৃতদেহ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিনয় শিয়ালদায় এসেছিল সেদিনই অলোকপ্রসাদের সঙ্গে তার আলাপ। তারপর যতবার সে এই স্টেশনে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করেছে। বয়স্ক মানুষটি বিনয়কে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সে যে খবরের কাগজে চাকরি পেয়েছে, সেটা জেনে গেছেন। উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়ে তাকে প্রচুর সাহায্য করেন।
গোড়ার দিকে বিনয়কে আপনি করে বলতেন অলোকপ্রসাদ। ঘনিষ্ঠতা হবার পর আপনিটা তুমি হয়ে গেছে।
অন্যদিন বিনয়কে দেখলে হই হই করে ওঠেন অলোকপ্রসাদ। আজ তাকে ভীষণ চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। বললেন, বোসো
বিনয় নিঃশব্দে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
তুমি কি খবরটা পেয়েছ?
আসাম থেকে উদ্বাস্তুদের চলে আসার কথা বলছেন কি?
হ্যাঁ।
পেয়েছি।
খুব খারাপ ব্যাপার। বিমর্ষ মুখে অলোকপ্রসাদ বলতে লাগলেন, ইস্ট বেঙ্গল থেকে রোজ রিফিউজি আসছে। তাদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। তার ওপর আসাম থেকে আসা বেড়ে গেল। সমস্যাটা বিরাট আকার নিচ্ছে। কলকাতার চারপাশের ক্যাম্পগুলো বোঝাই হয়ে গেছে। আসাম থেকে যারা আসছে তাদের কোথায় রাখা হবে, রিহ্যাবিলিটেশনের কী ব্যবস্থা করা যাবে, কে জানে।
দূরে গম গম আওয়াজ শোনা গেল।
অলোকপ্রসাদ এবং বিনয়, দুজনেই চকিত হয়ে ওঠে। ডিসটান্ট সিগনালের ওধারে সারা আকাশ কালো ধোঁয়ায় ভরে দিয়ে একটা ইঞ্জিন গাঁক গাঁক করতে করতে দৈত্যের মতো ছুটে আসছে।
অলোকপ্রসাদ বললেন, ওই বোধহয় আসামের ট্রেন এসে গেল।
৫৯.
সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক হাজার উদ্বাস্তু বছরের পর বছর মুখ গুঁজে পড়ে আছে। সেই যে ঝিনুককে নিয়ে হেমন্তের রাত্তিরে রিফিউজিস স্পেশাল-এর গাদাগাদি। ভিড়ে এখানে এসে বিনয় নেমেছিল সেদিন যেমন দেখেছে আজও ছবিটা অন্যরকম কিছু নয়। অবিকল একই রয়ে গেছে।
আসাম থেকে নতুন উদ্বাস্তুরা যে আসছে সেই খবরটা কীভাবে যেন চাউর হয়ে গিয়েছিল। ট্রেন আসতে দেখে পুরানোদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সবাই হইচই বাধিয়ে দেয়।
সমস্ত স্টেশনে তুমুল কলরোল। বিপুল জনতা একসঙ্গে চেঁচামেচি জুড়লে কিছুই বোঝা যায় না। দুর্বোধ্য শব্দপুঞ্জ থেকে এইটুকু শুধু শোনা যাচ্ছে–
আসাম থিকা নয়া রিফুজ আইতে আছে।
শিয়ালদায় আর পাও (পা) ফেলানের জাগা নাই। রিফুজে রিফুজে ঠাসা। হের উপুর মানুষ আইলে হেরা কই থাকব?
আসামে কী তাফাল (গোলমাল) যে হইল, ক্যাঠা জানে!
অলোকপ্রসাদ প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি চলে এলেন। সঙ্গে তার সহকারীরা রয়েছে। আর আছে পুলিশবাহিনী। ওদের সঙ্গে বিনয়ও এসেছে।
পুরানো উদ্বাস্তুরা যে যার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল। হয়তো কৌতূহলে, হয়তো উৎকণ্ঠায়। আসামে কী ধরনের সংকট হয়েছে তা জানার জন্য ওরা উদগ্রীব। পুলিশ ঠেলে, ধমকে ফের তাদের বরাদ্দ সীমানার ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই-এই বাহার মাতৃ আও–পুরানো উদ্বাস্তুদের সঙ্গে নতুনরা মিলেমিশে দলা পাকিয়ে যাক, সেটা রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের লোকেরা অর্থাৎ অলোকপ্রসাদরা চাইছেন না। পুলিশবাহিনীকে সেই রকমই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রেন স্টেশনে ঢুকে পড়ল। বিশাল ইঞ্জিন লম্বা দৌড় শেষ করে এখন ফোঁস ফোঁস শ্বাস ছাড়ছে।
এই ট্রেনটা পুরোপুরি রিফিউজি স্পেশাল নয়। তিনটে কামরায় রয়েছে আসামের উদ্বাস্তুরা। বাকিগুলোতে অন্য প্যাসেঞ্জার।
বিনয় চকিতে একবার প্ল্যাটফর্মের দূর প্রান্তে তাকায়। প্রসাদ মেস থেকে বেরুবার সময় বলেছিলেন, নতুন ভারত-এ গিয়েই একজন ফোটোগ্রাফার পাঠিয়ে দেবেন। হয়তো স্বপন কিংবা অমর আসবে। কিন্তু এখনও তাদের পাত্তা নেই।
বিনয় আর দাঁড়াল না, সোজা উদ্বাস্তুদের কম্পার্টমেন্টগুলোর সামনে চলে এল। বাচ্চাকাচ্চা, যুবক-যুবতী, বুড়োবুড়ি–নানা বয়সের মানুষে তিনটে কামরা বোঝাই।
বিনয় তো এই প্রথম উদ্বাস্তু দেখছে না। সারি সারি ক্ষয়াটে, আতঙ্কগ্রস্ত সব মুখ। চোখ এক আঙুল গর্তে, গাল ভেঙে হাড় বেরিয়ে পড়েছে। ঘোলাটে দৃষ্টি। পরনে নোংরা জামাকাপড়। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন মানুষের একটা দঙ্গল।
কেউ ট্রেন থেকে নামেনি নতুন জায়গায় এসে। উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছে। একেবারে বোবা। বাচ্চাগুলো কিন্তু পরিত্রাহি চেঁচিয়ে চলেছে।
মাঝবয়সী একটা লোক তার কামরার জানালার ধারে বসে বিহ্বল দৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিনয় তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার কী নাম?
লোকটা চমকে ওঠে। হঠাৎ একটি যুবক কলকাতায় পৌঁছতে না পৌঁছতে তার নাম জানতে চাইবে, এটা ভাবতে পারেনি। এর পেছনে কোনও অভিসন্ধি রয়েছে কি না, কে জানে। ত্রস্তভাবে সে জিজ্ঞেস করে, নাম জিগান ক্যান?
সহৃদয় ভঙ্গিতে বিনয় বলে, ভয় নেই, বলুন
একটু চিন্তা করে লোকটা বলেই ফেলল, মহাদেব শীল
দেশ ছিল কোথায়?
ফরিদপুরে। গেরামের নাম আশুগঞ্জ। পালংয়ের কাছে।
পরিবারে কতজন মানুষ?
পাঁচজন। আমি, আমার বউ আর তিন পোলা-মাইয়া।
এখন তো আসাম থেকে আসছেন?
আস্তে মাথা নাড়ে মহাদেব। প্রাথমিক ভয় কেটে যাচ্ছে তার। ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে। সে বলল, হ। উইহানে আর থাকন গ্যাল না। আসলে
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মহাদেব, হঠাৎ কেউ ডেকে ওঠে, ছুটোবাবু না?
বিনয় অবাক। ডাকটা এসেছে কামরার ভেতর থেকে। কে হতে পারে? জানালা দিয়ে ভেতরে মুখ বাড়াতেই চোখে পড়ল। হারান ঘোষ। চেনা মুখ। সুজনগঞ্জের হাটে প্রথম যেদিন বিনয় যায়, অবনীমোহন, যুগল আর সে হারানের মিঠাইয়ের দোকানে রসগোল্লা, পানতুয়া আর মাঠা খেয়েছিল। সেই সঙ্গে একদলা ধবধবে মাখন। দইয়ের ঘোলকে যে পূর্ব বাংলায় মাঠা বলে সেই প্রথম জেনেছিল।
তারপর যতবার সুজনগঞ্জে গেছে, হারান ঘোষের দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেয়েছে। মাথায় মাঝারি, গোলগাল চেহারায় সামান্য থলথলে ভাব-এই ছিল সেদিনের হারান। এখন তাকে চেনাই যায় না। শরীর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কণ্ঠমণি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। হাড়ের ওপর খসখসে, জিলজিলে। চামড়া জড়ানো।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিনয় কলকাতায় আসার অনেক আগেই হারান ঘোষরা ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল। তবে কোথায় কোন দিকে ছিটকে পড়েছিল, জানত না। তাকে একরকম ভুলেই গিয়েছিল সে।
আসাম থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জটলায় হারানকে দেখা যাবে, ভাবাই যায়নি। বিনয় বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে।
হারান ঘোষ আচমকা হাউ হাউ কান্না জুড়ে দেয়। জড়ানো, দুর্বোধ্য স্বরে একনাগাড়ে কী বলে। যায়, তার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।
বিনয় হতচকিত। বলে, কাঁদবেন না, কাঁদবেন না। নিচে নেমে আসুন- বয়সে অনেক বড়। দেশে থাকতে হারানকে আপনি করে বলত সে।
হারান ঘোষ কামরার ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। কান্না চলছিলই। তার মধ্যেই, গলাটা সামান্য পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, আমরা অ্যাকেরে (একেবারে) শ্যাষ ছুটোবাবু। বাইচা থাকনের আর আশা-ভরসা আছিল না। আপনেরে শিয়ালদার ইস্টিশনে দেইখা অকূলে কূল পাইলাম। আমাগো রক্ষা করেন ব্যাকুলভাবে বিনয়ের দুহাত জড়িয়ে ধরে সে।
অথই নৈরাশ্য আর দুর্ভাবনায় তলিয়ে যেতে যেতে বিনয়কে পেয়ে আলোর ক্ষীণ একটা রশ্মি যেন হারানের চোখে পড়েছে। তার শেষ অবলম্বন।
বিনয় জানে, ছিন্নমূল মানুষেরা সীমান্তের এপারে এসে এই পশ্চিমবঙ্গেই কীভাবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হারান ঘোষকে তা বলে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে দেওয়া যায় না। তার মনে সাহস জাগিয়ে তোলার জন্য বলল, শান্ত হোন। পাকিস্তান থেকে যারা আসছে, সরকার তাদের জন্যে খুবই চেষ্টা করছে। আপনাদেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই স্টেশনে বড় বড় সরকারি, অফিসাররা রয়েছেন। তাদের আমি বলে দেব। বলতে বলতে বিনয়ের ভেতরকার নবীন সাংবাদিকটি তৎপর হয়ে ওঠে। আসামের এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে অফিসে ফিরে গিয়ে একটা প্রতিবেদন খাড়া করতে হবে। তাই তথ্য দরকার।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, অনেকদিন আপনাদের খবর জানি না। দেশ ছেড়েছিলেন কবে?
সরকারি অফিসারদের বিনয় বলে দেবে, তা শোনার পর থেকে উদ্ভ্রান্ত ভাব অনেকটাই কেটে গেছে হারান ঘোষের। চোখ মুছে বলল, বচ্ছর দ্যাডেক (দেড়েক) আগে। আপনেগো রাইজদায় (রাজদিয়ায়) অশান্তি হয় নাই। কিন্তুক আমাগো সুজনগঞ্জের উই দিকের গেরামগুলায় জবর গণ্ডগোল, অইছে।
ঢাকা বরিশাল নোয়াখালি ফরিদপুর–অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর মুখে যা শোনা। গেছে বা যাচ্ছে, হারান ঘোষ হুবহু তাই বলতে লাগল। সেই একই আতঙ্কের বিবরণ। হুমকি, আগুন, ধর্ষণ, হত্যা। তার অনিবার্য পরিণতি যা হয়–সুজনগঞ্জ এবং তার চারপাশের গ্রামগুলো ফাঁকা করে মানুষ ইণ্ডিয়ায় চলে যেতে থাকে। হারানরা গেল আসামে। প্রথমে উঠেছিল বরপেটায়। সেখানে– টেকা গেল না। বউ-ছেলেমেয়ের হাত ধরে সেখান থেকে পাড়ি দিল হোজাইতে। তারপর দরং। কোথাও পাঁচ মাস। কোথাও দু মাস। কোথাও ছ মাস। যেখানেই গেছে থিতু হয়ে বসার সময় পায়নি। খালি খেদানি। খেদানি। খেদানি। আসামের চৌহদ্দি ছেড়ে ভাগো।
হারান ঘোষ বলতে লাগল, দ্যাশ থিকা আইলাম ইন্ডিয়ায়। ভাবলাম চৈদ্দ পুরুষের ভিটামাটি তো পাকিস্থানে ফালাইয়া আইছি। এইহানে হগল পামু। কিন্তুক
শুনতে শুনতে মন ভারী হয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কী?
পাকিস্থানে একবার রিফুজ হইছি। আসামে গিয়া হইলাম আরও তিন বার। অথচ দ্যাখেন গিয়া কপিলি নদী, কলং নদী, ব্রহ্মপুত্তের চর, শিরচরের দিকে ময়মনসিংয়া মুসলমানে ভইরা গ্যাছে। আমাগো লাখান রিফুজগো লেইগাই খালি জাগা নাই। এর মধ্যে কম্পার্টমেন্ট থেকে অনেকে নেমে এসে গোল হয়ে বিনয়দের ঘিরে ধরেছে। বিনয়ের সঙ্গে হারান ঘোষকে কথা বলতে দেখে তারা আম্বিত। ওদের হয়তো ধারণা হয়েছে, হারানের যদি কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়, বিনয়কে ধরলে তাদেরও একটা গতি হবে। সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, বাবু, আমরাও আসামে গিয়া তিন চাইর বার কইরা রিফুজ হইছি।
বিনয় দ্রুত ভিড়ের লোকজনকে দেখে নেয়। তারপর একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের দেশ ছিল কোথায়?
কেউ বলে, বরিশাল, কেউ ফরিদপুর, কেউ ময়মনসিং, কেউ বা নোয়াখালি। পূর্ব পাকিস্তানের নানা ডিস্ট্রিক্ট থেকে আসামে উদ্বাস্তু গেছে। কোনও একটা বিশেষ অঞ্চল থেকে নয়।
বিনয় জানতে চায়, ওখানে সরকারি সাহায্য টাহায্য কিছু পেয়েছেন?
সাহাইয্য! কী যে কন! একহান ফুটা পহাও (পয়সা) পাই নাই।
লোকগুলো আরও জানায়, নানা জাতের মানুষ-কামার কুমোর ছুতোর নাপিত–পূর্ব বাংলায় থাকতে যে যা করত, আসামে গিয়েও তাই শুরু করেছিল। তবে শতকরা নব্বই ভাগই ফাঁকা জমিতে চাষবাস করছিল। ওখানকার মাটি ভাল। প্রচুর ধান পাট ফলে। দেশ হারানোর দুঃখ তাদের অনেকটাই লাঘব হয়ে যেতে পারত। কিন্তু স্থানীয় মানুষজন অর্থাৎ আসামের ভূমিপুত্ররা চায় না উদ্বাস্তুরা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকুক, তাদের রুজি-রোজগারে ভাগ বসাক। তাই প্রথম দিকে শাসানি শুরু করল, তারপর দল বেঁধে হামলা। ধান রুইবার পর চারা বেরুলে নষ্ট করে দিত। কোথাও বা ধান পাকলে রাতারাতি কেটে নিয়ে যেত। সর্বক্ষণ ত্রাস, সর্বক্ষণ অনিশ্চয়তা। এর মধ্যে তো বাস করা যায় না। অগত্যা আসামের ভরসা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে তারা পা বাড়াল। কীভাবে শেষ অবধি কলকাতায় এসে পৌঁছেছে তারও সবিস্তার বিবরণ দিল।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের কলকাতায় চলে আসার জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছিল দেশভাগের ঠিক পরে পরেই। তাদের আলাদা স্টিমার। আলাদা ট্রেন। সেগুলোর মার্কামারা একটা নামও দেওয়া হয়েছে।রিফিউজিস স্পেশাল। এই ট্রেন এবং স্টিমারে অন্য কোনও প্যাসেঞ্জার ভোলা হয় না।
কিন্তু আসাম থেকে উৎখাত হওয়া উদ্বাস্তুদের জন্য ওই ধরনের ট্রেনের কোনও বন্দোবস্ত নেই। এই নতুন ইহুদির দল আমিনগাঁ স্টেশনে এসে দুদিন পড়ে ছিল। সেখান থেকে আসাম মেল ধরে রাজাভাতখাওয়ায় এসেছে। কারও টিকেট নেই। রেলের লোকেরা জোর করে তাদের নামিয়ে দেয়। রাজভাতখাওয়ায় একদিন কাটিয়ে ফের ট্রেন ধরে কাটিহার। কাটিহার থেকে মণিহারি ঘাট হয়ে সাহেবগঞ্জ। সেখান থেকে ফের ট্রেন এবং শিয়ালদা। খেপে খেপে ছদিন লাগল এখানে পৌঁছতে।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনাদের কী মনে হয়, পাকিস্ত্রনের যে রিফিউজিরা আসামে গিয়েছিল তারা সবাই পশ্চিমবাংলায় চলে আসবে?
লোকগুলো বেশ ধন্দে পড়ে যায়। এ প্রশ্নের সঠিক জবাব তাদের জানা নেই।
হারান ঘোষ বলল, হগলে আইব কি না কইতে পারুম না। তয় (তবে) আসামের ইস্টিশানে ইস্টিশানে কইলকাতার ট্রেন ধরনের লেইগা ম্যালা মাইনষেরে বইয়া থাকতে দেখছি।
বিনয়দা-বিনয়দা গলার স্বর উঁচুতে তুলে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে অমর এসে হাজির। তার কাঁধ থেকে একটা ঢাউস ক্যামেরা ঝুলছে। সে নতুন ভারত-এর একজন প্রেস ফোটোগ্রাফার।
হারান ঘোষদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফোটো তোলার ব্যাপারটা খেয়াল ছিল না বিনয়ের। বলল, যাক, তুমি এসে গেছ।
প্রসাদদা পাঠিয়ে দিলেন। বাস পেতে দেরি হচ্ছিল, নইলে আধঘন্টা আগে পৌঁছে যেতাম। বলুন, কী ছবি তুলব।
হারানদের দেখিয়ে বিনয় বলে, আগে এদের ছবি নাও। তারপর যে তিনটে কামরায় রিফিউজিরা রয়েছে সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, প্রত্যেকটা কম্পার্টমেন্টে উঠে যতগুলো পার, ভেতরকার ছবি তুলবে। ডেভলাপ করার পর ওদের মুখগুলো যেন স্পষ্ট বোঝা যায়।
অমর করিতকর্মা ছেলে। ক্যামেরা বাগিয়ে চটপট কাজ শুরু করে দিল।
হারান ঘোষের ছবি ভোলা হলে সে বিনয়কে বলে, ছুটোবাবু ছয়দিন ছান (স্নান) নাই, দুগা (দুটি) চিড়ামুড়ি ছাড়া প্যাটে কিছু পড়ে নাই। আমাগো কথা না হয় ছাড়ান দ্যান, কিন্তুক, পোলাপানগুলান খিদায় জবর কাতর অইয়া পড়ছে। খাইতে না পারলে বাঁচব না।
বিনয় ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকটা তার মাথায় ছিল না। এত মানুষকে সে তো আর খাওয়াতে পারবে না। যা করার ত্রাণ এবং পুনর্বাসন দপ্তরকেই করতে হবে। বলল, আসুন তো আমার সঙ্গে
খানিক দূরে অলোকপ্রসাদ এবং অন্য অফিসারেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তিন কামরার উদ্বাস্তু ছাড়া ট্রেনের বাকি প্যাসেঞ্জাররা লটবহর নিয়ে চলে গেছে। হারান ঘোষদের নিয়ে বিনয় সোজা অলোকপ্রসাদের কাছে চলে আসে। বলে, স্যার, আসামের এই রিফিউজিরা ছদিন প্রায় কিছু খায়নি। ওদের
হাত তুলে বিনয়কে থামিয়ে দিলেন অলোকপ্রসাদ।–অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের ভেতর চিড়েগুড় এসে যাবে।
মানুষটি হৃদয়বান। ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর সবার আগে কী প্রয়োজন সেদিকে তার লক্ষ ছিল। সেই অনুযায়ী এর ভেতর ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। অলোকপ্রসাদ সম্পর্কে বিনয়ের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। যত তাকে দেখছে, সেটা বেড়েই চলেছে।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, স্টেশন তো বোঝাই। আসামের রিফউজিরা কোথায় থাকবে, ঠিক হয়েছে?
দমদম ক্যান্টনমেন্টের কাছে সেকেণ্ড গ্রেট ওয়ারের একটা ফাঁকা ব্যারাক আছে। কণ্ডিশন খুব ভাল নয়। রিলিফ কমিশনার অর্ডার দিয়েছেন, আপাতত লোকগুলোকে সেখানে শেলটার দিতে
কিন্তু
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন অলোকপ্রসাদ।
হারান ঘোষদের দেখিয়ে বিনয় বলে, এরা বলছিল, আসাম থেকে আরও রিফিউজি আসছে। তাদের থাকার কী হবে?
অলোকপ্রসাদ বললেন, মিনিস্টার আর ডিপার্টমেন্টের কর্তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাই হবে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিনয় বলে, স্যার, আজ চলি। আসামের রিফিউজিদের ওপর বড় করে একটা লেখা তৈরি করতে হবে।
সে তো করতেই হবে। অলোকপ্রসাদ হাসলেন, যার যা কাজ
হারান ঘোষের দিকে ফিরে বিনয় বলে, এখন আমাকে যেতে হবে। অলোকপ্রসাদের প্রসঙ্গ টেনে বলল, স্যার কী বলছেন, সব শুনলেন। কোনও চিন্তা নেই
মলিন মুখে হারান বলে, আপনের লগে আর দেখা অইব না ছুটোবাবু?
নিশ্চয়ই হবে। আপনারা যেখানে থাকবেন, আমি ঠিক সেখানে চলে যাব।
তবু আপনের ঠিকানাখান দ্যান
বিনয় হারানের মনোভাবটা আঁচ করে নিল। এই অচেনা শহরে খড়কুটোর মত যাকে আঁকড়ে ধরেছে তাকে হাতছাড়া করতে চায় না। ঠিকানা জানা থাকলে তাকে খুঁজে বার করা যাবে।
বিনয় একটুকরো কাগজে নতুন ভারত-এর ঠিকানা লিখে হারানকে দিল। এদিকে ছবি তোলার কাজ শেষ করে চলে এসেছে অমর। তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়।
অফিসে গিয়ে খুব যত্ন করে আসামের উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে একটা বড় প্রতিবেদন লিখে প্রসাদকে দিয়ে যখন শান্তিনিবাস-এ ফিরে এল, বেশ রাত হয়েছে। সাড়ে নটা বাজে। তেতলায় উঠতেই চোখে পড়ল, তার ঘরে আলো জ্বলছে। রীতিমতো অবাকই হয় বিনয়। সে মেসে নেই, কে আলো জ্বালতে পারে? ত্বরিত পায়ে দরজার সামনে আসতেই দেখতে পায় একটা মোড়ায় বসে অপেক্ষা করছে নিত্য দাস। আর মেঝের এক ধারে পুরানো খবরের কাগজ পেতে তার ওপর বসে আছে সুবল।
মোড়াটা প্রসাদের। নিত্য দাসের বসার জন্য নিশ্চয়ই সুবল এনে দিয়েছে।
অসীম বিস্ময়ে বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনি!
নিত্য দাস উঠে দাঁড়ায়, টালিগঞ্জে সুধাদিদির বাড়ি গিয়া হেনলাম আপনে উনাগো কাছে আর থাকেন না। ঠিকানা লইয়া এইহানে আইয়া বইয়া আছি। হ, ঘণ্টা-দ্যাড়েক তো অইবই।
কোনও দরকার আছে?
জবর দরকার।
৬০.
এত রাতে নিত্য দাসকে দেখে বিনয় অবাক তো হয়েছিলই, ভেতরে ভেতরে চাপা একটা উৎকণ্ঠাও টের পাচ্ছিল। মনে হচ্ছে, লোকটা কোনও সুখবর নিয়ে আসেনি। নিত্যকে বসতে বলে নিজের বিছানার এক প্রান্তে বসে পড়ে সে। তারপর সুবলকে দুকাপ চা আনতে বলে সোজা নিত্যর মুখের দিকের তাকায়।-এবার বলুন।
নিত্য দাস বলল, আইজই আমার লোক বডার থিকা হ্যামকত্তার চিঠি লইয়া আইছে। খুব জরারি চিঠি।
হেমনাথের কথা এর মধ্যে সেভাবে ভাবার সময় পায়নি বিনয়। সকালে উঠেই জবরদখল কলোনি কি ত্রাণশিবিরগুলোতে ছোটা, সকাল কি সন্ধেয় অফিসে ফিরে সেগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা, সুধাদের বাড়ি থেকে মেসে উঠে আসা-এ-সবের সঙ্গে একটা নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে। আসাম থেকে তাড়া খাওয়া উদ্বাস্তুদের ঢল নামতে শুরু করেছে পশ্চিম বাংলায়। নানা ঘটনা, উৎখাত হওয়া, আতঙ্কগ্রস্ত, অগুনতি মানুষ, এইসব ব্যাপারে সে এমন জড়িয়ে পড়েছে যে অন্য কোনও দিকে তাকাবার কথা মনেও হয়নি। নিত্য দাস এত রাত্তিরে ফের হেমনাথ সম্পর্কে পুরানো উদ্বেগ ফিরিয়ে আনল।
নিত্য জামার পকেট থেকে একটা লম্বা খাম বার করে ফেলেছিল। সেটা বিনয়কে দিতে দিতে বলল, এই ন্যান (নিন)।
খামটার ওপর বিনয়ের নাম ছাড়াও একধারে ইংরেজিতে লেখা আছে ভেরি আর্জেন্ট। মুখ ছিঁড়ে ভেতর থেকে চিঠি বার করে পড়তে শুরু করে বিনয়। সুবল চা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে তার লক্ষ্য নেই।
চিঠির বয়ানটা এইরকম :
স্নেহের বিনু,
অনেকদিন পূর্বেই তোমার পত্রের উত্তর দিব ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম। কিন্তু জয়নাল নামে নিত্য দাসের যে লোকটি চিঠিপত্র লইয়া বর্ডারে যায়, সে না আসায় ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হইতেছিল, তোমাদের সহিত যোগসূত্রটি বুঝি বা ছিন্ন হইয়া গেল। কিন্তু সৌভাগ্যই বলিতে হইবে, হঠাৎ সে আসিয়া হাজির। লোকটি ভাল এবং তাহার দায়িত্ববোধ আছে। জানাইল হঠাৎ মেয়ের শাদি ঠিক হওয়ায় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তাই রাজদিয়ায় আসিতে পারে নাই। ইহাতে আমার যে অসুবিধা হইয়াছে এবং কলিকাতায় তোমাদের যে পত্রাদি দিতে পারি নাই, সেইজন্য যথেষ্ট আক্ষেপও করিয়াছে।
যাহা হউক, তোমরা এখানকার খবর শুনিলে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িবে, তবু না জানাইয়া উপায় নাই। তুমি জানো, আমি আশাবাদী এবং মানুষের শুভ বুদ্ধির উপর আমার গভীর আস্থা আছে। কিন্তু সেই আস্থাটি বজায় রাখা আর সম্ভব হইতেছে না।
তোমাকে পূর্বের একটি পত্রে জানাইয়াছিলাম, ইন্ডিয়া হইতে বেশ কিছু বিহারি মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে চলিয়া আসিয়াছে। অধিকাংশই আছে ঢাকা শহরে, মীরপুর অঞ্চলে। অন্যান্যরা খুলনা, যশোহর, রাজশাহী, ময়মনসিং ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের একটি অংশ রাজদিয়াতেও আসিয়া হাজির হইয়াছে।
ছিচল্লিশ সালে বিহারে যে রায়ট হইয়াছিল, এই লোকগুলি তাহা ভুলে নাই। ইণ্ডিয়া হইতে আসা এই মুসলিম উদ্বাস্তুরা খুবই বিদ্বেষপরায়ণ। ইহাদের মতে পাকিস্তান কায়েম হইয়াছে শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য। সেখানে অন্যদের স্থান নাই।
তুমি রাজদিয়ায় থাকিতে থাকিতেই এই অঞ্চলে ভাঙন ধরিয়াছিল। বারুইপাড়া, কর্মকারপাড়া, তাতিপাড়া প্রভৃতি এলাকার অনেকেই ত্রাসে দেশ ছাড়িয়া ইণ্ডিয়ায় চলিয়া গিয়াছে। বিহারিরা তাহাদের ফাঁকা জমি বাড়ি গায়ের জোরে দখল করিয়া বসিয়া পড়িয়াছে।
যাহারা চলিয়া গিয়াছে তাহাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু যাহারা এখনও দেশের মাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া আছে, বিহারিরা এতদিন তাহাদের উপর হামলা চালায় নাই। শুধু কথাবার্তা এবং আচরণে বুঝাইয়া দিয়াছে, মুসলিম ছাড়া অন্য সবাই পাকিস্তানে অবাঞ্ছিত। ব্যস, ওই পর্যন্তই। কিন্তু ইদানীং পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি শুরু হইয়াছে। যাহারা দেশত্যাগ করে নাই তাহাদের সম্পত্তির দিকেও বিহারিরা হাত বাড়াইতেছে। অবশ্য স্বীকার করিতেই হইবে, এখানকার বাঙালি মুসলমান, যাহারা পুরুষানুক্রমে আত্মীয়ের মতো বাঙালি হিন্দুদের পাশাপাশি বাস করিয়া আসিয়াছে, তাহাদের কেহ … কেহ বিহারিদের এ জাতীয় অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করিয়াছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাধাও দিয়াছে কিন্তু বিহারিরা কর্ণপাত করে নাই।
এই অবস্থায় মানসিক অস্বস্তিতে দিন কাটিয়া যাইতেছিল। তবে আমি বা আমার মতো বহু মানুষ মোটামুটি নিরুপদ্রবেই ছিলাম। এতাবৎ আমাদের উপর সরাসরি ঝঞ্জাট হয় নাই। কিন্তু চারদিকের বেড়া-আগুনের আঁচ শেষ অবধি আমার গায়ে আসিয়া লাগিয়াছে।
ইরফান আলি নামে এক বিহারি মুসলমান একদিন হঠাৎ আমাদের বাড়ি আসিয়া হাজির। লোকটি মধ্যবয়সী। আলিশান চেহারা। বুক পর্যন্ত দাড়ি। সে বাংলা, হিন্দি এবং উর্দু মিশাইয়া বলিল, আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু বাতচিত আছে–
ইরফানকে আমাদের বাহির বাড়ির বড় ঘরখানিতে বসাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কী বাতচিত?
আমরা জানতে পেরেছি, আপনি বহুৎ জমিনের মালিক। লগভগ তিন শ কানি হোবে।
অত নেই। শখানেক কানির মতো হতে পারে। কিন্তু আমার জমির ব্যাপারে আপনার কী দরকার?
আপনারা তিন আদমি। আপনি, আপনার বিবি আউর এক বহিন। অত জমি দিয়ে কী করবেন?
লোকটা আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর লইয়াই আসিয়াছে। আমি যত অবাক হইয়াছি তাহা অপেক্ষা ভয় পাইয়াছি অনেক বেশি। তবু সাহসে ভর করিয়া বলিলাম, আমার সম্পত্তি নিয়ে কী করব সেটা আমি বুঝব। অন্যের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নাই।
ইরফান আলি ইতর প্রকৃতির লোক। চোখ পাকাইয়া, দাঁতে দাঁত ঘষিয়া, আমার মুখের সামনে আঙুল নাড়িয়া নাড়িয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, জবান সামহালকে বাত করবেন। সবসময় ইয়াদ রাখবেন, ইয়ে পাকিস্তান হ্যায়।
বিনু, কতকাল ধরিয়া আমরা রাজদিয়ায় বাস করিয়া আসিতেছি। আট-দশ পুরুষ তো হইবেই। ইরফান আলির স্পর্ধায় হতভম্ব হইয়া গেলাম। আমার বাড়িতে আসিয়া আমার সহিত চোখ গরম করিয়া কথা বলে। এমন অপমানিত জীবনে আর কখনও হই নাই।
ইরফান এবার বলিল, আপনার এত জমিন আছে। তা থেকে আমাকে পঁচিশ কানি দিয়া দিন
তাহার কথা শুনিয়া আমার ধন্দ লাগিল। দিয়ে দিনবলিতে কী বুঝাইল, প্রথমটা ধরিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কি জমি কিনতে চান? সামান্য চিন্তা করিয়া তারপর বলিলাম, সাত পুরুষের বিষয় আশয় থেকে এক ছটাক মাটিও আমি বিক্রি করব না।
ইরফান আলি এমন কথা বোধহয় পূর্বে কখনও শোনে নাই। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে সে তাকাইয়া থাকে। তারপর বহুৎ তাজ্জবকি বাত বলিয়া হুঙ্কার ছাড়িল, পাকিস্তানে এসে আমি জমিন খরিদ করব! আপনার ওই জমিন আমার নামে লিখে দিন। মুফত–
এমন যে কেহ বলিতে পারে, কোনওদিন কল্পনাও করি নাই। আমি সম্পূর্ণ দিশাহারা হইয়া পড়িলাম।
বিনু, তোমার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, যুগল চলিয়া যাইবার পর করিমই আমাদের সর্বক্ষণের কামলা। তাহার দূর সম্পর্কের এক মাসতুতো ভাই হালিমকেও রাখা হইয়াছিল। দুইজনেই অত্যন্ত। বিশ্বাসী এবং দায়িত্বশীল। দেশভাগের পর রাজদিয়ার কত লোকই তো রাতারাতি পালটাইয়া গিয়াছে। কিন্তু করিমদের পরিবর্তন হয় নাই। তাহারা আগের মতোই আছে।
ইরফানের সহিত যে-ঘরে বসিয়া কথা বলিতেছিলাম, কিছু লইবার জন্য কখন করিম সেখানে আসিয়া দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছে, লক্ষ করি নাই। তুমি জানো, করিম মানুষ ভাল হইলেও রগচটা ধরনের। সে আমার আর ইরফানের যাবতীয় কথাবার্তা শুনিয়াছিল। হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া চিৎকার করিয়া উঠে, হালার পুত পশ্চিমা, হ্যামকুত্তার লাখান মানী লোকের লগে ম্যাজাজ চড়ইয়া কথা কও! তেনি এই রাইজদার হগল মাইনষের বাপের সোমান। মাগনায় তেনার জমিন ল্যাখাইয়া লইতে আইছ!
করিমের মারমুখী চেহারা দেখিয়া ইরফান প্রথমটা হতচকিত। একটি বাঙালি মুসলমান স্বজাতির পাশে না দাঁড়াইয়া আমার পক্ষে লড়াই করিতেছে, ইহাতে সে আশ্চর্য হইয়া যায়। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলাইয়া লয়। লাফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া গলা চড়ায়, কে তুই?
করিম বলে, আমি এই বাড়ির পোলা। দুই পুরুষ ধইরা হ্যামকত্তার নুন খাই। তেনার মেহেরবানিতে বাইচা আছি। ইন্ডিয়া থিকা আইয়া তেনারে অসোম্মান কর! বাইর হ হালা, বাইর হ। অক্ষণই যাবি–নাইলে
প্রচণ্ড রাগে কাঁপিতে থাকে ইরফান। সে একটি মতলব আঁটিয়া আসিয়াছিল। ভাবিয়াছিল, আমার উপর চাপ সৃষ্টি করিয়া কাজ হাসিল করিবে। আমি ভয়ে ভয়ে জমি লিখিয়া দিব। কিন্তু একটি রোগা পটকা বাঙালি মুসলমান যে এইভাবে রুখিয়া দাঁড়াইবে এবং তাহার অভিসন্ধি বানচাল করিয়া দিবে, ভাবিতে পারে নাই। ইরফান আলি করিমকে কুৎসিত গালিগালাজ করিতে থাকে।
করিমও সমানে সমানে জবাব দিতে লাগিল। তাহার মাথায় তখন খুন চড়িয়াছে। পারিলে ইরফানকে ছিঁড়িয়া খায়। কী তাহার চোটপাট!
আগেই জানাইয়াছি, ইরফানের লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড শরীর। ইচ্ছা করিলে সে করিমকে পিষিয়া ফেলিতে পারে। কিন্তু করিমের রাগ দেখিয়া সম্ভবত কিঞ্চিৎ ঘাবড়াইয়া যায়। আরও কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচির পর সে আপাতত রণে ভঙ্গ দেয়। যাইবার সময় আমাকে শাসায়, যেভাবে হউক, আমার ওই জমি সে দখল করিবেই। করিম ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠে, তর (তোর) তালুকদারি নিকি! ইচ্ছা হইল, আর কাইড়া নিলি! পঁচিশ কানি কি রে, এক মুঠা মাটিও তুই পাবি না। মাথা নিচা কইরা যা গিয়া। ম্যালা তেরিমেরি করলে পুইতা ফালামু।
ইরফান আলি আর দাঁড়ায় না। শাসাইতে শাসাইতে চলিয়া যায়।
আমি স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলাম। যাহারা চলিয়া গিয়াছে তাহাদের পরিত্যক্ত বিষয়সম্পত্তি জবরদখল করে, সে এক কথা। কিন্তু আমি দেশত্যাগ করি নাই। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব মানিয়া লইয়া জন্মভূমিতেই থাকিয়া গিয়াছি। এমত অবস্থায় একটি লোক জুলুম করিয়া জমি কাড়িয়া লইতে চায় জানিয়া ভীষণ বিচলিত হইয়া পড়িলাম। জিন্না প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, পাকিস্তানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার সমানাধিকার থাকিবে। রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবে। কাহারও ধনসম্পত্তি অন্য কেহ যাতে ছিনাইয়া লইতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখিবে। কিন্তু ইরফান যাহা বলিয়া গেল তাহাতে শঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছি।
আমি করিমকে বকাবকি করিলাম, কেন তুই লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করলি? আমি ইরফান আলিকে ভাল কথায় বুঝিয়ে দিতাম, সে যা চায় সেটা ঠিক নয়
করিম বলিয়াছে, আপনে কি মনে করেন, ভালা কথায় নরম কথায় কুনো কাম অইত! উই পশ্চিমাটা আস্ত শয়তানের হাড্ডি। ও যদিন ম্যাজাজ দেখায়, আমাগোও তার বিশ ডবল ম্যাজাজ দেখাইতে হইব। রুইখা না খাড়ইলে ও মাথার উপুর চইড়া বসব। আইজ পঁচিশ কানি চাইতে আছে, কাইল কইব আরও পঁচিশ দাও। হের পরের দিন কইব, পুরাটাই দিয়া দাও।
করিম নিরক্ষর। কিন্তু সার সত্যটি তাহার কাছে অতি স্পষ্ট। সে ঠিকই বলিয়াছে, ইরফানের খাই সহজে মিটিত না। তাহার জুলুমের কাছে মাথা নোয়াইলে সে নিশ্চয়ই পাইয়া বসিত।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ একটি প্রশ্ন আমার মনে দেখা দিয়াছিল। চিরকাল যে হেমনাথ রাজদিয়া অঞ্চলের ছোট-বড় সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছে, সে কিনা ইরফান আলির মত উদ্ধত, লোভী। একটি দুবৃত্তকে বুঝাইয়া সুঝাইয়া নিরস্ত করিতে চাহিয়াছে! কোথায় ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে বাড়ির বাহির করিয়া দিবে তা নয়। সে যেন নিজের অজান্তে আপসকামী হইয়া উঠিয়াছে। পাকিস্তান কি আমার শক্তি হরণ করিয়া লইতেছে?
ইরফান চলিয়া গেলেও করিম তখনও যায় নাই। সে বলিল, বড়কত্তা, উই পশ্চিমাটা মানুষ ভালা না। জমিন পায় নাই। ও কিলাম (কিন্তু) আপনেগো সব্বনাশ করতে পারে। এত বড় বাড়িত আপনেরা খালি তিনজনে থাকেন। হালার পুতে রাইতে লোজন লইয়া আইয়া আকাম (কুকাজ) কইরা যাইতে পারে। আপনেগো বস (বয়স) অইছে। ঠেকাইতে পারবেন না। আমারে এইহানে থাকনের ব্যাবোস্থা কইরা দ্যান। আমি রাইত জাইগা আপনেগো পরি (পাহারা) দিমু।
করিমের ইঙ্গিতটা বুঝিয়াছি। ইরফান আলি রাত্তিরে হানা দিয়া আমাদের খুন করিতে পারে। সেই কারণে সে আমাদের আগলাইয়া রাখিতে চায়। তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরিয়া গেল। যুগলের জন্য যে ঘরখানা তোলা হইয়াছিল সেটা ফাঁকা পড়িয়া আছে। সেখানে করিম, তাহার বউ এবং দুই ছেলেমেয়ের থাকার বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। সারারাত না ঘুমাইয়া সে আমাদের পাহারা দেয়।
কিন্তু করিম আমাদের রক্ষার দায়িত্ব নিলেও পুরাপুরি যে নিশ্চিন্ত হইব তাহার উপায় নাই। রাজদিয়া ঘোট শহর। রাস্তার বাহির হইলে প্রায়ই ইরফানের সঙ্গে দেখা হয়। সে হুমকি দেয়, ইয়ে পাকিস্তান হ্যায়। ও জমিন আপনি রাখতে পারবেন না। আমাকে দিতেই হবে।
গোড়ার দিকে করিম ছাড়া অন্য কেউ ইরফান আলির কথা জানিত না। কিন্তু পরে রাজদিয়ায় আমাদের যে-সব শুভাকাঙ্ক্ষী রহিয়াছে তাহাদের কাছে গেলাম। যেমন মোতাহার হোসেন, সৈয়দ বাড়ির আমিনুল, মৃধাবাড়ির জামাল ইত্যাদি। তাহারা ভরসা দিল, চিন্তা নাই। আমাকে থানায় লইয়া গিয়া ইরফান আলির নামে একটি নালিশও দায়ের করিল। কিছুদিন হইল রাজদিয়ায় একজন নূতন ওসি আসিয়াছে। তাহার বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন। বেশ মিষ্টভাষী। জানাইলেন, তিনি যতদিন রাজদিয়ায় আছেন, কেউ আমার ক্ষতি করিতে পারিবে না। তবে ইরফান আলিরা ইন্ডিয়ায় সর্বস্ব হারাইয়া পাকিস্তানে আসিয়াছে। ওসির অনুরোধ, আমি যেন তাহাকে সাহায্য করি।
যতদূর বুঝিলাম, ওসি জমিটা ইরফান আলির নামে লিখিয়া দিবার আভাস দিয়াছেন। মোতাহারদেরও তেমনই ধারণা। তোমাকে আগেই জানাইয়াছি, বিহারিরা যখন প্রথম রাজদিয়ায় আসে, বাঙালিরা তাহা সুনজরে দেখে নাই। কিন্তু অতি সম্প্রতি অবস্থা আর তেমনটা নাই। ইরফান আলির মতো লোকেদের পাশেও এখানকার অনেকেই গিয়া ভিড়িতেছে। ইহা মহা বিপদের কারণ।
সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া তোমার দুই দিদা এমনই সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে যে পাকিস্তানে আর এক দণ্ডও থাকিতে চাহিতেছে না। আমার অন্তরাত্মাও আতঙ্কে শুকাইয়া গিয়াছে। তোমরা সকলেই জানো, হাজার হাজার মানুষ যখন দেশ ছাড়িয়া ইণ্ডিয়ায় চলিয়া যাইতেছে তখনও স্থির করিয়াছিলাম, জন্মভূমি ত্যাগ করিব না। যাহাই ঘটুক, রাজদিয়াতেই আমৃত্যু থাকিব। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা আর অটুট নাই, ধসিয়া পড়িছে।
তুমি বেশ কিছুদিন পূর্বে শাজাহান সাহেব নামে এক ভদ্রলোকের কথা জানাইয়াছিলে। তিনি তাহার পশ্চিমবঙ্গের বিষয়সম্পত্তি আমাদের প্রপার্টির সহিত এক্সচেঞ্জ করিয়া পাকিস্তানে চলিয়া আসিতে চান। তখন আমি রাজি হই নাই। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত পালটাইয়া গিয়াছে। এই চিঠি পাওয়া মাত্র শাজাহান সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা পাকা করিয়া ফেলিবে। আদৌ বিলম্ব করিবে না। তোমার চিঠি পাইলে আমি জমি বাড়ির দলিলপত্র লইয়া ঢাকায় গিয়া প্লেনে কলিকাতায় চলিয়া যাইব। বাকি কাজ সেখানে সম্পন্ন হইবে।
তারপাশা এবং গোয়ালন্দ দিয়া স্টিমারে আর ট্রেনে গেলে বর্ডারে পাকিস্তানি পুলিশ দলিলগুলি কাড়িয়া লইতে পারে। তাই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়।
কেন ঢাকায় যাইতেছি রাজদিয়ায় কেউ জিজ্ঞাসা করিলে বলিব–বিশেষ প্রয়োজন। কলিকাতার কথা ঘুণাক্ষরেও কাহাকেও জানাইব না। এক জানিবে শুধু তোমার দুই দিদা। মোতাহারদের জানাইলে ক্ষতি নাই, কিন্তু তাহারা টের পাইলে কিছুতেই দেশ ছাড়িতে দিবে না।
তোমার আগের দুটি পত্রে ঝিনুক সম্পর্কে কিছুই জানাও নাই। সকলের কথা লিখ, শুধু ঝিনুক বাদে। তাহার জন্য আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত আছি।
যত সত্বর সম্ভব উত্তর দিবা। তোমার পত্রের আশায় অধীরভাবে অপেক্ষা করিয়া থাকিব।
তোমাদের কুশল কামনা করি। আশীর্বাদক, দাদু
পুনশ্চ : জন্মভূমির উপর হইতে আমাদের মন উঠিয়া গিয়াছে। আরও একবার মনে করাইয়া দিতেছি, সম্পত্তি এক্সচেঞ্জের কাজটি অবশ্যই করিবে। অন্যথা না হয়।
চিঠিটা পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিনয়। এতক্ষণ কার চিঠি পড়ল বিনয়? একজন হেমনাথ মিত্রকেই সে চেনে যিনি রাজদিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়, সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ। এবং প্রচণ্ড দুঃসাহসীও।
কিন্তু চিঠিটার প্রতিটি লাইন থেকে এক আতঙ্কগ্রস্ত বৃদ্ধের মুখ ভেসে উঠছিল।
এই সেদিন অবধি অনমনীয় জেদে বার বার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, যাই ঘটুক, যত সংকটই আসুক, জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তাঁর সেই অদম্য সংকল্প, সেই অটুট দৃঢ়তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। স্বপ্ন দেখতেন, পূর্ব পাকিস্তানেই সমস্ত ভেদ-বিভেদ এবং সাম্প্রদায়িক নষ্টামি ধ্বংস হয়ে নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আকাশছোঁয়া মিনার মাথা তুলে দাঁড়াবে, অপার মহিমায়। হেমনাথের সেই স্বপ্ন এবং উদ্দীপনার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। তার কল্পনার আকাশকুসুমগুলি মরে ঝরে শেষ। কতখানি বিপন্ন বোধ করলে হেমনাথের মতো মানুষ এরকম চিঠি লিখতে পারেন, ভাবতেই সমস্ত বোধবুদ্ধি অসাড় হয়ে যাচ্ছিল বিনয়ের। পাকিস্তানের অবস্থা কতখনি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে সেটাও বোঝা যাচ্ছিল।
খানিক দূরে বসে নিত্য দাস বিনয়ের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। বিনয়ের মুখচোখ লক্ষ করতে করতে কিছু একটা আঁচ করে নিয়ে চাপা গলায় ডাকল, ছুটোবাবু
ঘরে যে অন্য একটা লোক রয়েছে, খেয়াল ছিল না বিনয়ের। চমকে উঠে সে বলে, ও আপনি!
উদ্বেগের সুরে নিত্য দাস বলল, আমার যে লোক বডারে গিয়া জয়নালের কাছ থিকা এই চিঠি আনছে, জয়নাল হেরে কইছে রাইজদার গতিক ভালা না। আর হ্যামকত্তায় খুব বিপদের মইদ্যে আছেন। একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, চিঠিতে হ্যামকায় কি হেই হগল লেখছেন?
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, হা- সে আন্দ করে নেয়, চিঠির পুরো বয়ানটা নিত্যর জানা নেই। বিশদভাবে সেটা তাকে বলল বিনয়। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না।
নিত্য দাস আঁতকে ওঠে, এইটাই আমি ডরাইহিলাম ছুটোবাবু। আপনেগো কত বার হুইশার কইরা দিছি, হ্যামকত্তায় দ্যাশে থাকতে পারবেন না। দুই দিন আগে হউক আর চাইর দিন পরেই হউক, রাইজদা ওনারে ছাড়তেই হইব। শ্যাষম্যাশ আমার কথাই ফলতে চলছে।
দুশ্চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেছে বিনয়ের। সে বলল, ছোটদি বড়দি হিরণদা আমি, সবাই প্রত্যেকটা চিঠিতে লিখেছি, চলে আসুন। কিন্তু কারও কথা উনি কানে তোলেননি। নিজের জেদ নিয়েই পড়ে থেকেছেন। তার কণ্ঠস্বর থেকে ক্ষোভ, হতাশা এবং ত্রাস ফুটে বেরুতে থাকে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিনয় ফের শুরু করে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় রাজদিয়ার জমিজমা এক্সচেঞ্জ করে দাদু আর দিদাদের ইণ্ডিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, এর ভেতর শাজাহান সাহেবের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকায় নিত্য দাস। না। আপনেরা কইয়া দিলেন, এচ্চেঞ্জ করবেন না। হের পর আর ওনার বাড়ি যাই নাই। অতদূর আগাইয়া কামটা হইল না। কোন মুখে যামু কন?
নিত্যকে ক্ষুব্ধ দেখায়। তার ক্ষোভের যথেষ্ট কারণও আছে। হেমনাথদের সম্পত্তি বিনিময়ের কাজ অনেকটাই পাকা করে ফেলেছিল সে, কিন্তু হেমনাথ বেঁকে বসায় সমস্ত ভেস্তে যায়। তারপর সংকোচে আর শাজাহান সাহেবের কাছে যায়নি।
বিনয় বলে, আবার না গেলেই যে নয়। দাদু কী ধরনের বিপদের মধ্যে আছেন, তা আপনি নিজেও জানেন।
হেমনাথের জন্য উৎকণ্ঠা নিশ্চয়ই হচ্ছে নিত্য দাসের। কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড় ব্যাপার তা হল হেমনাথ এবং শাজাহান সাহেবের বিপুল বিষয় আশয় এক্সচেঞ্জ করিয়ে দিতে পারলে তার হাতে বিরাট অঙ্কের দালালি এসে যাবে। কানের কাছে অবিরল টাকার ঝনৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সুযোগটা যখন নতুন করে এসেই পড়েছে যেভাবেই হোক তা কাজে লাগাতেই হবে।
নিত্য দাস পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো বলে, হ্যামকত্তার এত বড় বিপদ। আমি কি হাত-পাও গুটাইয়া বইয়া থাকতে পারি? দুই-চাইর দিনের মইদ্যে নিয্যস শাজাহান সাহেবের লগে দেখা করুম।
ব্যগ্রভাবে বিনয় বলল, দু-চার দিন না, কালই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
একটু ভেবে নিত্য দাস বলল, কাইল অইব না। অন্য একজনেরে কথা দেওন আছে। তেনার লগে দেখা করতে লাগব।
না। কালই যেতে হবে। একেবারেই দেরি করা যাবে না।
হেমনাথের জন্য বিনয় যে কতখানি উৎকণ্ঠিত তা বুঝতে পারে নিত্য দাস। একটু চুপ করে থেকে বলে, ঠিক আছে।
আর-একটা কথা
কী?
আমিও আপনার সঙ্গে যেতে চাই।
খানিকক্ষণ থতিয়ে থাকে নিত্য দাস। বেশ অবাক হয়েই তারপর বলে, আপনে যাইবেন ক্যান?
নিত্যর মনোভাব চকিতে আন্দাজ করে নেয় বিনয়। হয়তো লোকটার মনে খটকা দেখা দিয়েছে। বিনয় সরাসরি গিয়ে কথা বললে তার দালালির টাকাটা কমে যেতে পারে। বা এই জাতীয় কিছু।
বিনয় বলল, চিন্তা করবেন না। আপনার পাওনা ঠিকই পাবেন। আমি গেলে শাজাহান সাহেব বুঝতে পারবেন, এক্সচেঞ্জটা কতখানি জরুরি।
নিত্য দাস আরাম বোধ করে। বিব্রতভাবে বলে, না না, ট্যাকার কথা মনেও আনি নাই। হ্যামকত্তায় আমার বাপের লাখান। তেনার লেইগা কিছু করতে পারলে জনম সার্থক। হের ভিতরে ট্যাকা পহার হিসাব আহে ক্যান? আপনের কষ্ট অইব তাই কইছিলাম। ঠিক আছে, যখন ইচ্ছা অইছে,-যাইবেন।
বিনয় বলে, আপনি বলেছিলেন, শাজাহান সাহেব হাওড়া না হুগলি, কোথায় যেন থাকেন।
হাওড়ার আন্দুলে ওনাগো বাড়ি। তয় জমিনজুমিন, হগল হুগলি জিলায়।
কখন গেলে ওঁকে পাওয়া যাবে?
সকালের দিকে গেলেই ভালা হয়। বেইল (বেলা) চেতলে (চড়লে) বাইর অইয়া পড়তে পারেন।
ঠিক আছে, কাল কখন এখানে আসতে পারবেন, বলুন। আমি রেডি হয়ে থাকব।
হাওড়ার আব্দুল তো কাছাকাছির পথ না। যাইতে ম্যালা (অনেক) সোময় লাগব। ধরেন সকাল আটটার ভিতরে চইলা আহুম বলতে বলতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় থেমে যায় নিত্য দাস।খাড়ন, খাড়ন, আগে আমরা হাওড়া যামু না
তা হলে কোথায় যাবেন?
পার্ক ছার্কাছের (সার্কাসের) বেগবাগানে।
সেখানে কেন?
নিত্য দাস বুঝিয়ে দিল। বেকবাগানে শাজাহান সাহেবের এক ভগ্নীপতি থাকেন। নাম ফজলুর রহমান। মাঝে মাঝে শাজাহান সাহেব বোনের বাড়ি এসে থাকেন। আন্দুলে বসে সম্পত্তি বিনিময়ের জন্য গ্রাহক পাওয়া মুশকিল। বেকবাগানে থাকার সুবিধা, এখানে নিত্য দাসের মতো টাউটদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের নানা অঞ্চলের জমিজমা বাড়িঘরের খবর নিয়ে দালালেরা আসে। নিত্য দাস সেখানে বেশ কয়েকবার গেছে। অবশ্য শাজাহান সাহেবের আঙ্গুলের বাড়িতে যে যায়নি তা নয়। তবে বেকবাগানে গিয়েই বেশি দেখা করেছে।
নিত্য দাস বলতে লাগল, আন্দুলে গিয়া যদিন হুনি, শাজাহান সাহেব পার্ক ছার্কাছে বইনের বাড়িত রইছেন, অতখানি যাওনই সার। হুদাহুদি (শুধুশুধু) হয়রানি। হের থিকা আগে বেকবাগানে যামু
নিত্যর কথাগুলি যুক্তিসঙ্গত। বিনয় বলল, সেটাই ভাল।
নিত্য দাস চলে যাবার পর অনেকক্ষণ নিঝুম বসে থাকে বিনয়। হেমনাথের জন্য উৎকণ্ঠাটা ডালপালা মেলে চার দিক থেকে তার ওপর প্রবল চাপ দিতে শুরু করেছে। কাল শাজাহান সাহেবের সঙ্গে যেখানেই যোক-বেকবাগান বা আন্দুল–দেখা করতেই হবে। এক্সচেঞ্জের যে শর্তই তিনি দিন না, তাতেই রাজি হয়ে যাবে বিনয়। বিনিময়ের পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ করে পনেরো দিনের মধ্যে হেমনাথ, স্নেহলতা আর শিবানীকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে ফেলবে। এটা তাকে করতেই হবে।
হেমনাথের চিন্তাটা বিনয়কে এমনই উতলা করে তুলেছে যে অন্য কিছুই ভাবতে পারছিল না। আচমকা সুধা সুনীতি হিরণদের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিত্য দাস যখন জাফর শা রোডে গিয়েছিল, সুধারা নিশ্চয়ই জেনে গেছে, হেমনাথ চিঠি লিখেছেন। কিন্তু খামের মুখ আটকানো ছিল। চিঠিতে কী আছে, ওদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। তবে এটা এমন ব্যাপার যে সুধাদের জানানো দরকার।
এখন অনেক রাত। তার ওপর বেশ শীত। আজ টালিগঞ্জে গেলে কখন ফিরবে সে? বিনয় ঠিক করে ফেলল, কাল সময় করে একবার সুধাদের কাছে যাবে।
সেই দুপুরবেলায় আসামের উদ্বাস্তুদের জন্য শিয়ালদা স্টেশনে ছোটা। সেখান থেকে নতুন ভারত-এর অফিসে গিয়ে লম্বা একখানা রিপোর্ট লিখে শান্তিনিবাস-এ ফিরে আসা। সমস্ত শরীর জুড়ে অপার ক্লান্তি তো ছিলই। হেমনাথের চিঠিখানা পড়ার পর তার সঙ্গে যোগ হল আকণ্ঠ উদ্বেগ।
খিদেতেষ্টার বোধটাই এই মুহূর্তে নষ্ট হয়ে গেছে বিনয়ের। সে ঠিক করে ফেলল, আজ আর কিছু খাবে না। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বে।
চান-ঘর থেকে ঘুরে এসে সে যখন বিছানার চাদর টান টান করে পেতে নিচ্ছে সেই সময় ফের সুবল এসে হাজির। জিজ্ঞেস করল, আপনে কি নিচে গিয়া খাইবেন, না খাওনেরটা (খাবার) উপুরে নিয়া আসুম?
প্রসাদ মতিলাল চাকলাদারকে বিনয়ের সুখ সাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখতে বলেছিলেন। মতিলাল সেই দায়িত্ব সুবলকে দিয়েছে। সেটা একেবারে বেদবাক্য হিসেবে ধরে নিয়েছে সুবল। যতক্ষণ বিনয় মেসে কাটায় ছেলেটার চোখ থাকে তার ওপর। বিনয়ের এতটুকু অসুবিধা হতে দেয় না সে।
বিনয় বলল, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু সুবল কোনও কথা শুনল না। শীতের লম্বা রাত উপোস দিয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে, সেটা জানিয়ে একলা থেকে ভাত মাছটাছ নিয়ে এল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু-চার গ্রাস খেয়ে আঁচিয়ে এসে শুয়ে পড়ে বিনয়। এঁটো থালা গেলাস টেলাস তুলে নিয়ে, আলো নিভিয়ে, বাইরে থেকে দরজার পাল্লাটা টেনে দিয়ে চলে যায় সুবল।