পঞ্চমপুরের রাজসংসারে আশ্রয়লাভ
পঞ্চমপুরের রাজসংসারে আশ্রয়লাভ করিবার পর ময়ূরের জীবনযাত্রায় একটি মন্দমন্থর ছন্দ আসিয়াছিল, দুই মাস পরে সেই ছন্দের যতিভঙ্গ হইল। রাজা ভূপ সিংহ তাহাকে নিভৃত কক্ষে আহ্বান করিয়া বলিলেন—উপবেশন কর। তোমার প্রকৃত কর্মের সময় উপস্থিত।
ময়ূর রাজার সম্মুখে বসিল। ভূপ সিংহ কিয়ৎকাল গম্ভীর দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন—ময়ূর, গত দুই মাস ধরে আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার গতিবিধি লক্ষ্য করেছি। আমার বিশ্বাস জন্মেছে, যে-কাজের ভার আমি তোমাকে দেব তা তুমি পারবে।
ময়ূর জোড়হস্তে বলিল—আজ্ঞা করুন আর্য।
রাজা বলিলেন—তোমাকে দিল্লী যেতে হবে। কিন্তু একা নয়, তোমার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক থাকবে।
রাজা সপ্রশ্ন নেত্রে ময়ূরের পানে চাহিলেন, ময়ূর তিলমাত্র বিচলিত না হইয়া নিষ্পলকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল—তারপর আজ্ঞা করুন আর্য।
রাজা সন্তোষের নিশ্বাস ফেলিলেন—দিল্লী এখান থেকে বহুদূর, পথও অতি দুর্গম। দিল্লী ফ্লেচ্ছ জাতির রাজধানী, সেখানকার ম্লেচ্ছগণ ঘোর দুবৃত্ত এবং দুর্নীতিপরায়ণ, সেখানে হিন্দুর জীবনের কোনো মূল্য নেই। তোমাকে এই শত্ৰুপুরীতে যেতে হবে একটি সুন্দরী নারীকে নিয়ে। তোমার দায়িত্ব কতখানি বুঝতে পারছ?
পারছি মহারাজ। তারপর আদেশ করুন।
তুমি যাকে নিয়ে যাবে তার নাম চঞ্চরী। তাকে বোধ হয় দেখেছ, সে সুন্দরী। কোনো বিশেষ কারণে আমি তাকে আলাউদ্দিনের কাছে উপঢৌকন পাঠাতে চাই।
রাজা ক্ষণেকের জন্য নীরব হইলেন, ময়ূরও চুপ করিয়া রহিল; সে যে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছে তাহার আভাসমাত্র দিল না।
রাজা আবার আরম্ভ করিলেন—কেন আমি চঞ্চরীকে আলাউদ্দিনের কাছে পাঠাচ্ছি তা জানতে চেয়ো না, গূঢ় রাজনৈতিক কারণ কাছে। তুমি কেবল চঞ্চরীকে দিল্লীতে নিয়ে যাবে, সেখানে পৌঁছে চেষ্টা করবে চঞ্চরী যাতে আলাউদ্দিনের দৃষ্টিপথে পড়ে, সুন্দরী নারী দেখলেই সে তাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। তুমি প্রতিরোধ করবে না, আলাউদ্দিনকে মারবার চেষ্টা করবে না। তারপর সাতদিন অতীত হলে এই পত্রটি কোনো উপায়ে তার কাছে পৌঁছে দেবে।
জতুমুদ্ৰানিবদ্ধ একটি ক্ষুদ্রাকৃতি পত্র তিনি ময়ূরের হাতে দিলেন। সে দেখিল রাজার কপালের শিরা-উপশিরা স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষুৰ্ধয় রক্তাভ। কিন্তু তিনি ধীরভাবে বলিলেন—এই তোমার কাজ। তুমি অশ্বপৃষ্ঠে যাবে, চঞ্চরী দোলায় থাকবে। দশজন সশস্ত্র বাহক তোমাদের সঙ্গে থাকবে, তারা দোলা বহন করবে, যদি পথে দস্যু-তস্কর আক্রমণ করে তারা লড়াই করবে। দস্যু-তস্কর সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখলে অপহরণের চেষ্টা করতে পারে, তুমি সর্বদা সতর্ক থাকবে।
রাজা বক্তব্য শেষ করিলে ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল—কবে যাত্রা করতে হবে?
রাজা বলিলেন—কাল প্রত্যুষে। সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন প্রস্তুত আছে। তুমি আমার আদেশ বর্ণে বর্ণে পালন করবে।
ময়ূর শুধু বলিল—হাঁ মহারাজ।
রাজা বলিলেন—বৎসরাবধি কাল আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষ্ণ করব। যদি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসতে পারো, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই থাকবে না। আশীর্বাদ লও বৎস।
সে-রাত্রে ময়ূর ঘুমাইতে পারিল না, শয্যায় শুইয়া আসন্ন যাত্রা সম্বন্ধে নানা কথা চিন্তা করিতে লাগিল। কি করিয়া কোন্ কার্য করিবে, বিপদে পড়িলে কিভাবে আচরণ করিবে, তাহার ধনুর্বিদ্যা কোন্ কাজে লাগিবে, এইসব চিন্তা। চঞ্চরীর ভাগ্যের কথা সে অধিক চিন্তা করিল না, চঞ্চরী এই চতুরঙ্গ খেলার ক্রীড়নক, অদৃষ্ট তাহাকে নিয়ন্ত্রিত পথে লইয়া যাইতেছে। ময়ূর নিমিত্ত মাত্র।
এইসব ভাবনার মধ্যে রাত্রি তিন প্রহর কাটিয়া গেল। ঘরের বাহিরে অনিমেষ জ্যোৎস্না, যেন প্রকৃতির অঙ্গে রূপালী তবক মুড়িয়া দিয়াছে। ময়ূর শয্যায় উঠিয়া বসিল। রাত্রি শেষ হইতে বেশি বিলম্ব নাই।
দ্বারের বাহিরে একটি নিঃশব্দ মূর্তি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। চন্দ্রালোকে মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। ময়ূরের হৃদ্যন্ত্র দুন্দুভির ন্যায় ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সে ত্বরিতে উঠিয়া মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইল।
রাজনন্দিনি।
সোমশুক্লা স্থিরায়ত নেত্রে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, কথা বলিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর ময়ূর হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—ভেবেছিলাম যাত্রার আগে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।
সোমশুক্লা এবার কথা বলিলেন, তাঁহার কণ্ঠ একটু কাঁপিয়া গেল,—ময়ূরভদ্র, আমার এই শঙ্খ-কঙ্কণ আপনি গ্রহণ করুন। এটি সঙ্গে রাখবেন, আপনার কল্যাণ হবে।
ক্ষণকাল নিশ্চল থাকিয়া ময়ূর সোমশুক্লার সম্মুখে নতজানু হইল, অঞ্জলিবদ্ধ হস্ত তাঁহার দিকে প্রসারিত করিল। সোমশুক্লা মণিবন্ধ হইতে কঙ্কণ খুলিয়া তাহার অঞ্জলিতে রাখিলেন। ময়ূর রুদ্ধ স্বরে বলিল—দেবি, আমি আর কী বলব? আমি—আমি—
সোমশুক্লা অঙ্গুলি দিয়া তাহার ললাট স্পর্শ করিলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন—এখন কিছু বলবেন না। আপনি ফিরে আসুন, তারপর আপনার কথা আপনি বলবেন, আমার কথা আমি বলব।
উদ্বেল হৃদয়ে ময়ূর মস্তক নত করিল।
সোমশুক্লা প্রাসাদে ফিরিয়া গেলেন। নিজ কক্ষে গেলেন না, ক্ষণেক ইতস্তত করিয়া সীমন্তিনীর কক্ষের বাহিরে দ্বারের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন।
ঘরে দীপ জ্বলিতেছে। চঞ্চরী উত্তেজিত হাসিমুখে মায়ের সম্মুখে বসিয়া আছে, সীমন্তিনী তাহাকে বস্ত্র-অলঙ্কারে সাজাইয়া দিতেছে। সীমন্তিনীর মুখ কঠিন কিন্তু তাহার দুই চক্ষু দিয়া অবশে অশ্রুধারা ঝরিয়া পড়িতেছে। রাজকুমারী ছায়ার মত দ্বারের নিকট হইতে সরিয়া গেলেন।–
ঊষাকালে ক্ষুদ্র যাত্রীদলের দুরদুর্গম যাত্রা আরম্ভ হইল।