চৈত্র মাসের শেষে
চৈত্র মাসের শেষে একদা রাত্রিকালে রাজা ভূপ সিংহ প্রাসাদের ছাদে উঠিয়া একাকী পদচারণ করিতেছিলেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি চন্দ্রহীন; পঞ্চমী তিথির চাঁদ বিলম্বে উঠিবে। নক্ষত্ৰ-বিকীর্ণ স্বল্পান্ধকারে পরিক্রমণ করিতে করিতে রাজা চিন্তা করিতেছিলেন।
মাত্র কয়েক মাস পূর্বে চঞ্চরীকে লইয়া ময়ূর দিল্লী গিয়াছে, এখনও তাহার ফিরিবার সময় হয় নাই। কিন্তু সকলের মনেই উদ্বেগপূর্ণ প্রতীক্ষ্ণ, সকলেই যেন অন্যমনস্ক। রাজসংসারের ভৃত্যপরিজন নিঃশব্দে কাজ করিয়া যায়, কাহারও মুখে হাসি নাই। সীমন্তিনীর মুখে শীর্ণ কঠিনতা; রাজকুমারী সোমশুক্লা দিন দিন যেন শুকাইয়া যাইতেছেন। রাজা মনে মনে ভাবিতেছেন—এই তাহার শেষ চেষ্টা, এ চেষ্টা যদি নিস্ফল হয়, আর কিছু করিবার নাই। ময়ূর কি পারিবে? যদি না পারে—
সম্প্রতি রাজার মনে একটু নির্বেদের ভাব আসিয়াছে। প্রতিহিংসা কি এতই বড়! যদি তাঁহার প্রতিহিংসা চরিতার্থ না হয় তাহাতেই বা কি? সূর্য-চন্দ্রের গতি রুদ্ধ হইবে না। তিনি একদিন মরিবেন, মহাপাপী আলাউদ্দিনও মরিবে; তখন প্রতিহিংসা কোথায় থাকিবে? জীবন অনিত্য, হিংসাদ্বেষ অনিত্য; মৃত্যুই পরম অবসান।
পূর্বাকাশে পীতাভ খণ্ডচন্দ্র উদয় হইল। রাজপুরী সুপ্ত, নগর সুপ্ত, পৃথিবীও সুপ্ত। এই সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে মহাপ্রকৃতি যেন দীপ জ্বালিয়া দিয়াছে। এই পরম মুহূর্তেও কি মানুষের মনে হিংসাদ্বেষ আছে! হায়, সংসারে যদি হিংসাদ্বেষ না থাকিত!
ময়ূর কি ফিরিয়া আসিবে? তাহার প্রতি ভূপ সিংহের মেহ জন্মিয়াছিল, বিশ্বাস জন্মিয়াছিল; সে যদি ফিরিয়া না আসে, যদি রামরুদ্রের মতো সেও ঘাতকের হস্তে হত হয়—
নিস্তব্ধ বাতাসে অশ্বের ক্ষীণ হ্রেষাধ্বনি শুনিয়া রাজা সেই দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। রাজপুরীর সম্মুখ পথ দিয়া একদল লোক আসিতেছে। রাজার চোখের দৃষ্টি এখনও তীক্ষ্ণ আছে, তিনি। দেখিলেন যাহারা আসিতেছে তাহাদের মধ্যে একটা দোলা এবং একজন অশ্বারোহী রহিয়াছে। রাজা রুদ্ধশ্বাসে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর দ্রুত ছাদ হইতে নামিতে লাগিলেন। নিশ্চয় ময়ূর ফিরিয়াছে। কিন্তু সঙ্গে দোলা কেন? তবে কি চঞ্চরীকে ফিরাইয়া আনিয়াছে!
দ্বিতলে অবতরণ করিলে কুমারী সোমশুক্লা পিছন হইতে চকিতস্বরে ডাকিলেন—পিতা! কিন্তু রাজা শুনিতে পাইলেন না।
ময়ূর প্রাসাদ সম্মুখে অশ্ব হইতে অবতরণ করিল। রাজা একাকী দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহার পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া বলিল—আর্য, আমি ফিরে এসেছি। কার্যসিদ্ধি হয়েছে।
কার্যসিদ্ধির কথা রাজার কানে পৌঁছিল কিনা সন্দেহ; তিনি কম্পিত স্বরে বলিলেন— দোলায় কে?
ময়ূর বলিল—একটি স্ত্রীলোক আপনার দর্শন চায়, তাকে সঙ্গে এনেছি। মহারাজ, আপনি নিজ কক্ষে গিয়ে বসুন, আমি এখনি দর্শনপ্রার্থিনীকে নিয়ে আসছি।
রাজা কক্ষে গিয়া স্বয়ং দীপ জ্বালিলেন, তারপর ভূমিতলে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার দেহমনের সমস্ত শক্তি যেন ফুরাইয়া গিয়াছে, স্নায়ুমণ্ডল আলোড়িত হইতেছে। ময়ূর কাহাকে সঙ্গে আনিয়াছে? কে তাঁহার দর্শনপ্রার্থিনী?
ময়ূর দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, সঙ্গে কৃষ্ণাননা একটি স্ত্রীলোেক। দ্বারের কাছে ক্ষণকাল ন যযৌ ন তস্থৌ থাকিয়া স্ত্রীলোকটি ছুটিয়া আসিয়া রাজার পদপ্রান্তে পড়িল, অবরুদ্ধস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—পিতা, আমাকে কি গৃহে স্থান দেবেন? আমি দাসী হয়ে থাকব, আমার পরিচয় কেউ জানবে না—
রাজা পক্ষাঘাতগ্রস্তের ন্যায় ক্ষণেক নিশ্চল রহিলেন, তারপর উন্মত্তবৎ চিৎকার করিয়া উঠিলেন—শিলা! শিলা!
ময়ূর দ্বারের কাছে প্রহরীর ন্যায় ঋজুদেহে দাঁড়াইয়া রহিল। শিলাবতী প্রথমে ময়ূরের সঙ্গে পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিতে চাহেন নাই, বলিয়াছিলেন—আমি ভ্ৰষ্টা ধর্মচ্যুতা, আমাকে গৃহে স্থান দিলে পিতার কলঙ্ক হবে। তিনি যদি আমাকে গ্রহণ না করেন? ময়ূর বলিয়াছিল—যদি গ্রহণ না করেন আমরা দুই ভাই-বোন অন্য কোথাও চলে যাব। বিস্তীণা পৃথিবীতে কি দুটি মানুষের স্থান হবে না? তখন শিলাবতী সম্মত হইয়াছিলেন।
ময়ূর চাহিয়া দেখিল, রাজার বাহ্যজ্ঞান নাই, তিনি কন্যাকে শিশুর মতো আদর করিতেছেন—মা আমার! মা আমার! কন্যা! কন্যা! কন্যা!
ময়ূর একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। এই হৃদয়াবেগ হইতে দূরে সরিয়া যাওয়াই ভাল। সে দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে, আবার ইতস্তত করিতেছে, এমন সময় কেহ তাহার হস্ত স্পর্শ করিল। ময়ূর ফিরিয়া দেখিল, সোমশুক্লা!
সোমশুক্লার মুখ ঈষৎ কৃশ, চোখের কোলে ছায়া, কিন্তু তাঁহার হাসি দেখিয়া ময়ূরের মনে হইল ইহার অধিক পুরস্কার বুঝি পৃথিবীতে আর নাই। সে কুমারীর হাত ধরিয়া উদ্যানে লইয়া গেল।
চাঁদ আর একটু উপরে উঠিয়াছে, আর একটু উজ্জ্বল হইয়াছে। চন্দ্রালোকে দুইজনে পরস্পরের মুখ দেখিলেন, তারপর সোমশুক্লা ভঙ্গুর কণ্ঠে বলিলেন—ভাল ছিলে?
এই কয়েক মাসের অদর্শন যেন তাঁহাদের মনের ব্যবধান সরাইয়া দিয়াছে, প্রকৃত সম্বন্ধ জানাইয়া দিয়াছে। ময়ূর বলিল—তোমার শঙ্খ আমার সমস্ত বিঘ্ন দূর করেছে, অতি সহজে কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এবার তোমার শঙ্খ তুমি ফিরিয়ে নাও।
ময়ূর বক্ষ হইতে শঙ্খ লইয়া শুক্লার সম্মুখে ধরিল। শুক্লা হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন—তুমি পরিয়ে দাও।
তারপর কতক্ষণ কাটিয়া গেল কেহ জানিল না। একটি বৃক্ষশাখায় একদল পাখি সমস্বরে কলকূজন করিয়া আবার নীরব হইল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে।
ময়ূর বলিল—আমি যাই।
শুক্লা জিজ্ঞাসা করিলেন—কোথায় যাবে?
ময়ূর বলিল—রাজার কাছে। তিনি বলেছিলেন যদি কার্যসিদ্ধি হয়, আমাকে অদেয় তাঁর। কিছুই থাকবে না। তাই পুরস্কার চাইতে যাচ্ছি।
রাজা আপন কক্ষে ঋজু দেহে বসিয়া ছিলেন। তাঁহার মুখ প্রফুল্ল, মনে হয় দশ বছর বয়স কমিয়া গিয়াছে। ঝটিকাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র শান্ত হইয়াছে। ময়ূর প্রবেশ করিতেই তিনি অধরে অঙ্গুলি রাখিয়া ইঙ্গিত করিলেন, পাশের দীপহীন কক্ষে ভূমিশয্যায় পড়িয়া শিলাবতী ঘুমাইতেছেন, যেন সতেরো বছরের পুঞ্জীভূত গ্লানি নিদ্রার কোলে নামাইয়া দিয়াছেন।
রাজা চুপিচুপি বলিলেন—শিলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ও আমার কাছে এই রাজভবনেই থাকবে। সাবধান, ওর প্রকৃত পরিচয় যেন কেউ জানতে না পারে। তুমি ওকে দিল্লী থেকে এনেছ এই ওর একমাত্র পরিচয়।
ময়ূর বলিল—তাই হবে আর্য। আমার জ্যেষ্ঠ সহোদরা।
রাজা তখন ময়ুরের স্কন্ধে হাত রাখিয়া গভীর প্রীতিভরে বলিলেন বৎস, তুমি আমার পুত্রের তুল্য। তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম তার শতগুণ কাজ তুমি করেছ। কি পুরস্কার চাও বল।
ময়ূর ধীরে ধীরে বলিল—মহারাজ, যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমি আপনার কাছে কুমারী সোমশুক্লার পাণি প্রার্থনা করি।
রাজা ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন—সোমশুক্লা, কিন্তু—কিন্তু–
ময়ূর বলিল—তিনি আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জানেন। তাঁর অমত নেই।
রাজা বলিলেন—কিন্তু—তুমি অজ্ঞাতকুলশীল। তোমার সঙ্গে শুক্লার বিবাহ দিলে সপ্তমপুরের রাজাদের কাছে তোমার কী পরিচয় দেব?
ময়ূর নীরব রহিল। রাজা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া আকাশপাতাল ভাবিতে লাগিলেন। তাঁহার পুত্র নাই, তাঁহার মৃত্যুর পর জামাতাই রাজ্য পাইবে। ময়ূরের মতো যোগ্য উত্তরাধিকারী কোথায় পাওয়া যাইবে? কিন্তু তবু—অজ্ঞাতকুলশীল–। শীল রক্ষা করা রাজার কর্তব্য। উচ্চকুলশীল দুরাচার লম্পটের সহিত রাজকন্যার বিবাহ হইলে কেহ নিন্দা করে না—কিন্তু–
রাজা বলিলেন—অন্য কোনো পুরস্কার চাও না?
না আর্য।
রাজা গুম্ফ আকর্ষণ করিতে করিতে আবার চিন্তায় মগ্ন হইলেন।
কক্ষের বাহিরে তখন প্রভাত হইয়াছে। ঘরের প্রদীপ ম্লান হইয়াছে, রাজপুরী যে জাগিয়া উঠিতেছে তাহার শব্দ আসিতেছে।
সহসা ভট্ট নাগেশ্বর দ্বারের কাছে আবির্ভূত হইয়া বলিয়া উঠিলেন—হা হতোস্মি। একি বয়স্য, রাত্রে কি নিদ্রা যাননি? বলিয়াই ময়ূরকে দেখিয়া থামিয়া গেলেন। পাশের ঘরে সুপ্তা শিলাবতীকে তিনি দেখিতে পাইলেন না।
রাজা যেন অকূলে কূল পাইলেন, হাত বাড়াইয়া বলিলেন এস বয়স্য।—ময়ূর, যাও বৎস, তুমি নাগেশ্বরের গৃহে গিয়ে বিশ্রাম কর। সন্ধ্যার পর এস।
ময়ূর প্রস্থান করিলে রাজা গাত্রোত্থান করিয়া ভট্ট নাগেশ্বরকে বলিলেন—চল বয়স্য, ছাদে যাওয়া যাক, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে। তুমি অবশ্য ঘোর মূখ, তোমার পরামর্শের কোনো। মূল্য নেই, কিন্তু মূখের মুখ থেকে কদাচ জ্ঞানের কথা বাহির হতে পারে। বলিয়া তিনি উচ্চহাস্য করিলেন।
দুই দিন পরে ভূপ সিংহ সাজসজ্জা করিয়া বিদেশ যাত্রা করিলেন। তাঁহার গন্তব্যস্থান সপ্তমপুর।
বয়স্যকে লইয়া রাজা চতুদোলায় উঠিলেন। সঙ্গে অশ্বপৃষ্ঠে ময়ূর ও দশজন রক্ষী।
সপ্তমপুরের অপুত্রক রাজা সূর্যবর্মা বন্ধুকে পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। ভূপ সিংহ তাঁহার আলিঙ্গনমুক্ত হইয়া বলিলেন—ভাই, আমার কন্যা সোমশুক্লার সঙ্গে একটি যুবকের বিবাহ স্থির করেছি। যুবকটি অতি সৎপাত্র, কিন্তু নামগোত্রহীন; তুমি তাকে দত্তক নেবে এই প্রস্তাব নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। চল, অন্তরালে তোমাকে সব কথা বলি।–
দুমাস পরে সপ্তমপুরের যুবরাজ ময়ূরবর্মার সহিত পঞ্চমপুরের রাজকন্যা সোমশুক্লার বিবাহ হইল।
৪ জুলাই ১৯৬২