Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লোকসংস্কৃতির সেকাল-একাল || Sankar Brahma

লোকসংস্কৃতির সেকাল-একাল || Sankar Brahma

লোকসংস্কৃতির সেকাল-একাল

একটি দেশের বা একটি জাতির পরিচয় তার লোকসংস্কৃতি৷ লোকসংস্কৃতিই এ দেশের মূল সংস্কৃতির ভিত্তি৷ এখানকার সাহিত্য, জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনাচরণ লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে৷ সাধারণ মানুষের ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য,পেশা–এ সব নিয়েই গড়ে ওঠে ‘লোকসংস্কৃতি’৷
এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর৷ কোনো কৃত্রিমতা থাকে না এতে৷ এটা সহজাত, সহজিয়া আর স্বাভাবিক বহতা নদীর মতো৷ পোশাকি সংস্কৃতির বিপরীতে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি৷ এর কোনো বিনাশ নাই৷ আছে আধুনিক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উপাদান৷
এই সংস্কৃতির ভাষাও লোকজ৷ যাকে বলা হয় লোকভাষা৷ সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মুখে, কথায়, ভাষার ব্যবহারে, লেখায় এর প্রকাশ৷ গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনা,জীবনবোধের প্রকাশ৷ তাঁদের পোশাক, খাবার, প্রার্থনা, পূজা-পার্বণ, ফসল, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বাসস্থান, বাহন, জীবন সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ – এ সবই লোকসংস্কৃতিকে রূপ দেয়৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে৷ লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে, খেলাধুলাতেও প্রকাশ পায় লোকসংস্কৃতি৷

বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতিরূপ বাংলার লোকসংগীত। বাংলার অসংখ্য সংগীত সম্পদের মধ্যে ভাওয়াইয়া, চটকা, সারিগান, পটুয়া, সঙের গান, বাউলগান, কীর্তন, জারিগান, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি কিংবা তবলাযোগে এই সকল সংগীত গীত হত। প্রেম, উপাচারসমূহ, দর্শন, ভক্তি, কর্ম ও শ্রম ইত্যাদি ছিল লোকসংগীতের বিষয়। বিংশ শতকের প্রথম লগ্ন থেকে বিভিন্ন আধুনিক সংগীতশিল্পীর প্রয়াসে এই ধরনের সংগীতের জনপ্রিয়তা পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দীর্ঘকাল পূর্বে ভারতের পূর্বপ্রান্তে গড়ে ওঠে যে ভিন্ন স্বাদের সংস্কৃতি তা বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। শিল্পকলায়, খাদ্য রসিকতায়, ঐতিহ্যে বাংলা সবার থেকে আলাদা। সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে বাঙালি জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণে উদ্যত হলেও বাঙালি সম্পূর্ণ রূপে বিস্মৃত হয়নি তার অতীত ঐতিহ্যকে। তাই শহর থেকে গ্রামে বহু রূপে আজও অব্যাহত বাংলার প্রাচীন সত্তা। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে আছে প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন, লোককথা৷ এরমধ্যে আছে প্রকৃতির কথা, ঋতুর কথা, ভালো-মন্দের কথা, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দিকের কথা৷এ সবের সঙ্গে আছে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, আছে যুক্তির সম্পর্কও৷ বাঙালির চলনে-বলনে-চিন্তনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও প্রাদেশিক বিভিন্ন স্থানে বিশেষত গ্রামবাসী, মফস্সল অধিবাসী ও আদিবাসীদের অবলম্বন করে আজও লালিতপালিত হচ্ছে বাংলার লোকসংস্কৃতি। এমনকি শহুরে জীবনেও অবসরের আস্বাদ এনে দেয় বাংলার প্রাচীন সত্তা তার গানের ছন্দে, নৃত্যের তালে, পূজার্চনার রীতিনীতিতে ও নাট্যবিলাসিতায়। শুধু তাই নয়, বর্তমানের আধুনিকতার সূর্যালোক প্রাপ্ত শহুরে জীবনের চলচ্চিত্র ধারাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে বাংলার লোকসংস্কৃতি। বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকনৃত্য তাদের নিজস্ব বিশিষ্টতা ও সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এগুলির মধ্যে ছৌ-নাচ, গম্ভীরা নৃত্য, টুসু, সাঁওতালি নৃত্য, খেমটা নাচ, মুসলিমদের লাঠিনাচ, ঝুমুর নাচ প্রভৃতির নাম নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। সাধারণভাবে বিবাহ, পূজাপার্বণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ কিংবা ফসল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন ঘটে বাংলায়।
শুধু নৃত্যগীতের সমাহারে নয় নাট্য-ঐতিহ্যও বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বোলান, গম্ভীরা, পালাকীর্তন, ভাসান, ঘাটু, আলকাপ, পুতুলনাটক ইত্যাদি বাংলার লোকনাট্যের ঐতিহ্যের ধারার অনবদ্য কিছু সংযোজন। বিভিন্ন বীরত্বব্যত্মক কাহিনি, প্রেম ও বিরহ, পুরাণ—সবই ছিল লোকনাট্যের বিষয়। অবশ্য, লোকনাট্যের বিষয় হিসেবে সর্বাধিক প্রিয় ছিল পুরাণ ও দেবদেবী।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ তার দেবতা ও প্রকৃতি দ্বারা চালিত লোকাচার সমূহ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ও বৃক্ষকে দেবজ্ঞানে পূজা করা প্রাচীন বাংলার প্রধান আচরণীয় বিষয় ছিল। সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা—এই সকল উপজাতি নৃত্যগীত সহযোগে দেবতার পূজার্চনায় বিশ্বাসী ছিল।
মনসার পুজো, ধর্মদেবতার পুজো, শিবরাত্রি প্রতিপালনসহ বিভিন্ন ব্রতপালন বাংলার লোক-ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাংলা তার শিল্পকলাতেও স্বয়ংসমৃদ্ধ। বাংলার শিল্প কলাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের আলপনা, পটুয়া শিল্প – যাদের মধ্যে কালীঘাটের পট অত্যন্ত বিখ্যাত এবং টেরাকোটার নাম উল্লেখযোগ্য। পটে যেমন অঙ্কিত হয় বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের দেহাবয়ব তেমনি পোড়ামাটি দিয়ে বিভিন্ন কলাকৃতি নির্মিত হয়ে থাকে টেরাকোটার কাজে। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, নদিয়া, বাঁকুড়া প্রভৃতি স্থান এই সকল কলাকৃতির জন্য বিখ্যাত ছিল।
প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বিভিন্ন লোকসাহিত্য।
যেমন, সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য জ্ঞাপক মনসামঙ্গল, রাঢ়ের ধর্মদেবতার কাহিনি ধর্মমঙ্গল, দেবী চণ্ডীর কাহিনি চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি। বিভিন্ন বাংলা মহাকাব্য, কবিতা, গীতিকাও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। যেমন— ময়মনসিংহ গীতিকা, নাথ গীতিকা, বিভিন্ন রূপকথা, রাজারাজড়ার গল্প, ঈশপের গল্প সব ক্ষেত্রেই বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যের অবাধ বিচরণ।
লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা যায়। ১).বস্তুগত,২).মানসজাত,৩).অনুষ্ঠানমূলক ও ৪).প্রদর্শনমূলক৷

১).গ্রামীণ জনপদের লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে, তা বস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান৷ যেমন বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি৷

২).মৌখিক ধারার লোকসাহিত্য মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ লোককাহিনী, লোকসংগীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি মৌখিক ধারার সাহিত্য৷
“আমার দেশের জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শিদি
আরও কত সুরের সাথে মিশে আছে
আমার মায়ের মুখ”— আশরফ সিদ্দিকী

৩).অনুষ্ঠান মূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান৷ বাউল, গম্ভীরা, জারি গানের সঙ্গে নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ জড়িত৷ হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ৷

৪).প্রদর্শনমূলক – হস্তশিল্প লোকসংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ভুবন৷ এ সব হস্তশিল্পে মানুষের মেধা, নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়৷ যেমন নকশিকাঁথায় পায় শিল্পী মনের প্রকাশ৷ বেতশিল্প, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, চামড়াশিল্প, বুননশিল্প সমৃদ্ধ করেছে লোকসংস্কৃতিকে৷ মসলিনের যুগ পেরিয়ে আজকের জামদানি লোকশিল্পেরই অবদান৷

সাধারণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসকারী অক্ষরজ্ঞানহীন ও ঐতিহ্যের অনুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়৷
এই ধরণের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা,সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস-সংস্কারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির মধ্য মিল আছে৷ বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখেন৷ একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়া’৷
বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে৷ কোথাও তা ‘শস্যরানি’, কোথাও ‘শস্যপুতুল’, কোথাও বা ‘শস্যমাতা’ নামে অভিহিত৷ তাই লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ আছে৷

বাংলাদেশে কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব৷ গ্রামীণ জীবনের একটি যাত্রাপালা সহজ এবং সাধারণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ সহজেই বলা যায় আধুনিক সংস্কৃতি ভিত্তিই হলো লোকসংস্কৃতি৷ পার্থক্যটি হলো ভাষার৷ লোকসংস্কৃতির ভাষা লোকজ বা আঞ্চলিক৷ লালন ফকির বা হাসন রাজার গান লোকগান৷ লোকজ ভাষার ব্যবহার আছে তাঁদের গানে৷লোকসংস্কৃতি সাধারণের মানুষের জীবন প্রাধান্য পায়৷

বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি বা ‘Folk Lore’-এরই ধারক হল বাংলার লোকসংগীত, লোকনাটক, লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে আজ অবশ্য মৃতপ্রায় লোকসংস্কৃতির ধারা পুনর্জাগরিত হয়েছে। তবে, বাংলার এই প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের ধারাকে বজায় রাখতে বাংলার লোকনাট্যকলা, আলপনা দেওয়ার মতো শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে হবে। তবেই এদের পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

আমাদের লোকসংস্কৃতির চর্চা আরও বাড়াতে হবে৷ এই চর্চাই পারে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করতে৷ তাই এই সংস্কৃতির চর্চাই আমাদের সংস্কৃতিবান করবে৷

লোকসংস্কৃতির নানা বিকৃত রূপ আমরা আজকাল দেখতে পাই৷ বাউল গানের সুরকে বিকৃত করে গাওয়া হয়৷ লোকগানের সুর বিকৃত করা হয়৷ এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতিকর৷ এটা যাঁরা করেন,তাঁরা লোকসংস্কৃতির ক্ষতি করেন৷ লোকসংস্কৃতি মানে হলো লোকজ্ঞান৷ আমাদের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা,সেটা লোকসংস্কৃতির অবদান৷ আমাদের এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আমাদের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ তাঁদের চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তা না হলে আমাদের তরুণরা জাগবে কীভাবে?
এই ব্যাপারে আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে কম বেশী, সেটা অস্বীকার করলে চলবে না মোটেও ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *