লজ্জা (Lojja) : 12
গোপালদের বাড়ি লুট হয়েছে। সুরঞ্জনদের পাশের বাড়িই। একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে আসে সুরঞ্জনদের বাড়িতে। গোপালের ছোট বোন। সে এসে ভাঙা ঘরদোর দেখে। ঘরগুলোয় নিঃশব্দে হাঁটে। সুরঞ্জন শুয়ে শুয়ে মেয়েটিকে দেখে, বেড়ালের মত মেয়েটি। এই বয়সেই চোখে নীল ভয় তার, মেয়েটি সুরঞ্জনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গো গোল চোখে তাকায়। সুরঞ্জন মেঝেতেই পড়ে ছিল সারারাত। বারান্দার রোদ দেখে ঠাহর হয়। বেলা হয়েছে অনেক। ইশারায় মেয়েটিকে ডাকে সে। জিজ্ঞেস করে—তোমার নাম কি?
–মাদল।
—কোন স্কুলে পড়?
—শেরে বাংলা বালিকা বিদ্যালয়।
স্কুললটির নাম আগে ছিল ‘নারী শিক্ষা মন্দির। লীলা নাগের করা। লীলা নাগের নাম কিন্তু আজ উচ্চারিত হয় কোথাও? মেয়েদের যখন লেখাপড়া করবার নিয়ম ছিল না, তখন তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে স্কুলে পড়বার জন্য মেয়েদের উৎসাহ দিতেন। ঢাকা শহরে তিনি নিজে খেটে মেয়েদের স্কুল গড়েছিলেন। সেই স্কুলটি এখনও আছে, মানে সেই দালানঘরটি আছে, কিন্তু নামটি বদলে গেছে। সম্ভবত লীলা নাগের নাম উচ্চারণ করা বারণ, নারী শিক্ষা মন্দির নামেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে কি না কে জানে। এও ঠিক বি এম কলেজ, এম সি কলেজের মত। সংক্ষেপের জট খুললে মুসলমানের দেশে হিন্দুত্ব না আবার প্রকট হয়ে ওঠে। একাত্তরেও ঢাকার রাস্তার নাম বদলের চক্রান্ত চলেছিল, পাকিস্তানিরা শহরের দুশ চল্লিশটি রাস্তার নাম পরিবর্তন করে ইসলামিকরণ করেছিল–লালমোহন পোদ্দার লেনকে আবদুল করিম গজনভী স্ট্রিট, শাঁখারি নগর লেনকে গুল বদন স্ট্রিট, নবীন চাঁদ গোস্বামী রোডকে বখতিয়ার খিলজি রোড, কালীচরণ সাহা রোডকে গাজী সালাউদ্দিন রোড, রায়ের বাজারকে সুলতানগঞ্জ, শশীভূষণ চ্যাটার্জি লেনকে সৈয়দ সলীম স্ট্রিট, ইন্দিরা রোডকে আনার কলি রোড এরকম।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে–আপনি মাটিতে ঘুমোচ্ছেন কেন?
—মাটি যে আমার ভাল লাগে।
—মাটি আমারও খুব ভাল লাগে। আমাদের এ বাড়িতে উঠেন ছিল, এ বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি, নতুন বাড়িতে উঠোন নেই। মাটিও নেই।
–তা হলে তুমি খেলা করতেও পারবে না। মেয়েটি সুরঞ্জনের মাথার কাছে বসে। খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে। তারও ভাল লগছে সুরঞ্জনের সঙ্গে গল্প করতে। সে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে—আমার খুব মায়া হচ্ছে চলে যেতে। মেয়েটি মায়া শব্দটি উচ্চারণ করতেই সুরঞ্জনের গা ঝিমঝিম করে ওঠে। মেয়েটিকে সে আরও কাছে বসতে বলে। যেন এ মায়া। ছোটকালের মায়া, দাদার কাছে বসে গল্প করত যে মেয়েটি। স্কুলের গল্প, খেলাধূলার গল্প। কতদিন মায়াকে কাছে বসিয়ে গল্প করা হয়নি। নদীপাড়ে মাটির ঘর বানাত সুরঞ্জনরা ছোটবেলায়। মায়াও বানাত। বিকেলে বানিয়ে রাখত, রাতের ফুঁসে ওঠা অন্ধকার জল ভেঙে দিত তাদের মাটির খেলাঘর। হাওয়াই মিঠাই খেয়ে জিভ গোলাপি করবার সেই দিন, সেই মহুয়া মলুয়ার দিন, বাড়ি পালিয়ে কাশবনে ঘুরে বেড়াবার দিন…মেয়েটিকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয় সুরঞ্জন। মায়ার মত নরম নরম হাত। মায়ার হাত দুটো এখন কারা ধরে আছে, অনেকগুলো নির্মম নিষ্ঠুর কর্কশ হাত নিশ্চয়ই। মায়া কি ছুটতে চাইছে? ছুটতে চাইছে, পারছে না? আবার তার ঝিমঝিম করে ওঠে গা। সে ধরেই রাখে মাদলের হাতখানা। যেন মায়া সে। ছেড়ে দিলে কেউ ধরে নিয়ে যাবে। কেউ বেঁধে ফেলবে শক্ত দাঁড়িতে। মাদল বলে–আপনার হাত কাঁপছে কেন?
—কাঁপছে? তোমার জন্য খুব মায়া হচ্ছে বলে। তুমি যে চলে যাবে।
—আমরা তো আর ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। যাচ্ছি মিরপুরে। সুবলরা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে।
—তোমাদের বাড়িতে যখন ঢোকে ওরা, কি করছিলে তখন?
—বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। ভয়ে। ওরা আমাদের টেলিভিশনটা নিয়ে গেছে, আলমারি থেকে গয়নার বাক্স নিয়ে গেছে। বাবার টাকাও নিয়েছে।
–তোমাকে কিছু বলেনি। ওরা?
–যাবার সময় আমার গালে জোরে দুটো চড় মেরেছে। বলেছে চুপ করে থাক, কাঁদবি না।
—আর কিছু করেনি? তোমাকে ধরে নিতে চায়নি?
–না। মায়াদিকে ওরা মারছে খুব, তাই না? আমার দাদাকেও মেরেছে। দাদা ঘুমিয়ে ছিল। দাদার মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। রক্ত বেরিয়েছে অনেক।
সুরঞ্জন ভাবে, মায়ার বয়স যদি মাদলের মত হত, তবে বোধহয় বেঁচে যেত। অমন টেনে হিঁচড়ে ওকে কেউ নিত না। মায়াকে ওরা ক’জন মিলে ধর্ষণ করছে? পাঁচজন? সাতজন? নাকি আরও বেশি। মায়ার কি খুব রক্ত ঝরছে?
মাদল বলে—মা পাঠাল, বলল মসিমার সঙ্গে দেখা করে আয়। মাসিমা যে খুব কাঁদছেন।
—মাদল, তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?
—মা চিন্তা করবে।
–তোমার মা’কে বলে যাবে।
মায়া খুব বলত ‘দাদা, একবার কক্সবাজার বেড়াতে নেবে? চল না মধুপুর জঙ্গলে যাই? আমার খুব সুন্দরবনেও যেতে ইচ্ছে করে।’ ক’দিন জীবনানন্দের কবিতা পড়ে ধরল ‘নাটোর যাব।’ সুরঞ্জন মায়ার সব আবদারই ছোঃ বলে উড়িয়ে দিত। বলত ‘রাখ তোর নাটোর-ফাটোর। তার চেয়ে তেজগাঁর বস্তিতে যা, মানুষ দেখ। মানুষের জীবন দেখ। ওসব গাছ পাথর দেখার চেয়ে জীবন দেখা অনেক ভাল।’ মায়ার উৎসাহ চুপসে যেত। আজ ভেবে সুরঞ্জনের মনে হয় কী লাভ হয়েছে তার জীবন দেখে? কী লাভ হয়েছে জন্ম থেকে মানুষের ভাল চেয়ে? শ্রমিক কৃষকের আন্দোলন, প্রলেতারিয়েতের উত্থান, সমাজতন্ত্রের বিকাশ, এসব কথা ভেবে কী লাভ হল, সেই তো পতনই হল সমাজতন্ত্রের, সেই তো নামানেই হল লেনিনকে দড়ি বেঁধে টেনে। সেই তো হলই হার, মানবতার গান গেয়ে বেড়িয়েছে যে ছেলে, তারই ঘরে আজ চূড়ান্ত অমানবিক হামলা।
মাদল ধীরে উঠে যায়। তার হাত থেকে মায়ার মত মাদলের নরম হাতটি সরে যায়। হায়দার আজও আসছে না। নাকি সে রণে ভঙ্গ দিয়েছে! সে আর ঝামেলায় জড়াতে চায় না। সুরঞ্জনও বোঝে মায়াকে খোঁজাখুঁজি করা বৃথা। মায়া যদি ফেরত আসে, সেই ছ’বছর বয়সের মত ফেরত আসবে। সুরঞ্জনের বড় খালি খালি লাগে। মায়া যখন পারুলদের বাড়ি ছিল, এ বাড়িও তখন এমনই নিস্তব্ধ ছিল, তবু কোনও খারাপ লাগা তার ছিল না। জানত সে মায়া আছে, ফিরবে। আর এখন শ্মশান শ্মশান লাগে বাড়িটি। যেন কেউ মরেছে। ঘরে মদের বোতল, পায়ের কাছে গড়ানো গ্লাস, ছড়ানো বই দেখতে দেখত সুরঞ্জনের খালি বুকটা জলে ভরে যায়। চোখের জলগুলো যেন সব বুকে গিয়ে জমেছে।
এবার কামাল, রবিউল, কেউ খোঁজ নেয়নি সুরঞ্জনের। ভাবছে হয়ত, যাদের জীবন তারাই সামলাক। বেলাল যে গত রাতে এল, তার কণ্ঠেও সে একই সুর শুনেছে ‘তোরা আমাদের বাবরি মসজিদ ভেঙেছিস কেন? সুরঞ্জন ভাবে, বাবরি মসজিদ ভারতীয়দের মসজিদ, এ মসজিদ বেলালের হতে যাবে কেন? আর সুরঞ্জনরা বাবরি মসজিদ ভাঙল কি করে? সুরঞ্জন নিজে কখনও ভারতেই যায়নি। সে কি করে মসজিদ ভাঙল, বেলাল কি ভারতের হিন্দু আর এ দেশের হিন্দুকে এক করে দেখছে? হিন্দুরা মসজিদ ভেঙেছে এর অর্থ সুরঞ্জনরা ভেঙেছে? অযোধ্যার হিন্দু মৌলবাদী এবং সুরঞ্জন এক? বেলাল কামাল হায়দারের মত নয় সে? সে কি কেবলই হিন্দু? ভারতের মসজিদ ভাঙবার দায় সুরঞ্জনের? ধর্মের কাছে দেশ আর জাতি তুচ্ছ হয়ে যায়? সে না হয় যারা অশিক্ষিত, দুর্বল যারা ধর্মের খুঁটি আঁকড়ে বাঁচে, তারা ভাবে; কিন্তু বেলাল কেন? বেলাল উচ্চশক্ষিত ছেলে, ফ্রিডম ফাইটার, ধর্মের ক্লেদে তারও পা ফসকে যাবে কেন? এ সব প্রশ্ন সে কোনও উত্তর পায় না। দুটো কলা আর বিস্কুট রাখা টেবিলে। কিরণময়ী রেখে গেছেন নিঃশব্দে। ওগুলো না ছুঁয়ে তার বরং বোতলের বাকি মদটুকু চকঢক করে পান করতে ইচ্ছে করে। কাল অচেতন ঘুমিয়ে ছিল, মায়া এসে বার বার তাকে চুৰ্ণ করেছি। চেতন ফিরলেই মেয়েটির মুখ ভাসে। চোখ বুজলেই মনে হয় তাকে ছিড়ে খাচ্ছে একপাল কুকুর।
হায়দার জানাতেও আসেনি মায়ার খবর কোথাও পাওয়া গেল কি না। সন্ত্রাসীদের হায়দার যতটা চেনে, সুরঞ্জন ততটা চেনে না বলে ওর আশ্রয় নেওয়া। নইলে সে তো বেরিয়ে পড়তে পারত গলি-ঘুপচির ভেতর। অবশ্য হিন্দুদের রেপ করতে এখন আর গলি-ঘুপচির দরকার হয় না, সে প্রকাশ্যেই করা যায়। প্রকাশ্যে যেমন লুট হয়। ভাঙা পোড়া হয়। হিন্দুদের অত্যাচার করতে আজকাল এত রাখঢাকের দরকার হয় না। কারণ সরকারের সায় তো একরকম আছেই। সরকার তো আর সেকুলার রাষ্ট্রের সরকার নয়। মৌলবাদীদের স্বাৰ্থই কায়দা করে রক্ষা করছে তারা। শেখ হাসিনা সেদিন বলেছেন ভারতীর চৌদ্দ কোটি মুসলমানের জানমাল রক্ষা করবার খাতিরে দেশে সাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে হবে। শেখ হাসিনাকে কেন ভারতের মুসলমানের নিরাপত্তার কথা আগে ভাবতে হয়? এ দেশের মানুষের নাগরিকের অধিকারের কারণেই কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা জরুরি নয়? নিজ দেশের নাগরিকের জানমালের চেয়ে ভারতীয় মুসলমানের জনগণের প্রতি দরদ বেশি দেখাতে হয় কেন? তবে কি ধরে নিতে হবে জামাতি ইসলামি যে ভারত বিরোধিতা এবং ইসলাম মশলায় আজ রান্না চড়াচ্ছে জনগণকে গেলাবে বলে, সেইন মশলা আওয়ামি লিগকেও ব্যবহার করতে হচ্ছে? এও কি কমুনিস্টদের ইসলামি মুখোশ পরবার কৌশল? ভারতের মুসলমানের স্বার্থে নয়, সবচেয়ে মৌলিক এবং যৌক্তিক কারণ হল ‘সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ। নিজের ধর্ম ও বিশ্বাসসহ জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবার অধিকার এ দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে হিন্দুদের জন্য স্বীকৃত। কোনও ধর্ম বা কোনও রাজনৈতিক দলের কৃপায় নয়, কোনও ব্যক্তিবিশেষের করুণায় নয়, হিন্দুদের বাঁচবার অধিকার রাষ্ট্ৰীয় নীতিমালায় আছে বলেই তারা আর দশটা মানুষের মত বাঁচবে। কেন সুরঞ্জনকে কামাল বেলাল বা হায়দারের আশ্রয়ে বা অনুকম্পায় বেঁচে থাকতে হবে?
চট্টগ্রামের মিরসরাই-এ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কমল ভৌমিকের বাড়িতে আগুন ধারালে তার কাকী সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। কুতুবদিয়ার হিন্দু পল্লীতে আগুন ধরিয়ে দিলে তিনটি শিশু পুড়ে মারা গেছে। সাতকানিয়ার নাথপাড়ায় সূর্যমোহন আগুনে পুড়েছে। মিরসরাই-এর বাসুদেবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গ্রামে কারা আক্রমণ করেছে, বাসুদেব বলেছে।–রাতে যারা মারে, দিনে তারাই এসে সমবেদনা জানিয়ে বলে ‘তোরা গো লাই পরাণ পুড়ে। খাজুরিয়ার যাত্রামােহন নাথকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেছে, ‘তার থেকে আমাকে গুলি করে দিন, সেটা ভাল হবে। * আর এদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হওয়ার ছ’দিন পর বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, জাতীয় সমন্বয় কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট মিলে সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি গঠন করেছে। সাম্প্রদায়িকতার আগুন যখন নিভেছে কমিটি গঠন করা হল তখন। এই কমিটি একটি শান্তি মিছিল আর একটি গণসমাবেশ ছাড়া আর কোনও কর্মসূচী এখন পর্যন্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। গণসমাবেশ থেকে জামাত শিবির ফ্রিডম পাটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবি জানানো হবে। এই দাবি সম্পর্কে সম্প্রীতি কমিটি কতটা গুরুত্ব দেবে, সরকার জামাত শিবির ফ্রিডম পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে সম্প্রীতি কমিটি এ নিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে যাবে কি না। এ নিয়ে সুরঞ্জন জানে নেতারা কোনও কিছু বলবে না। কমিটির কেউ কেউ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবার কথা বলেছেন। কিন্তু শনির আখড়ার ক্ষতিগ্রস্ত একজন বলেছেন—’শনির আখড়া ভাঙচুর করেছে যারা, আমাদের ঘরবাড়ি যারা পুড়িয়েছে, লুটপাট করেছে, তাদের আমরা চিনি; কিন্তু মামলা আমরা করব না। কারণ বিরোধী দলগুলো যখন আমাদের ওপর আক্রমণ ঠেকাতে পারল না, তখন মামলার পর আমাদের নিরাপত্তা তারা দিতে পারবে না। * মামলা করা নিয়ে সারা দেশে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াই হবে, মামলা করবার আহ্বানকে সুরঞ্জন রাজনৈতিক স্টােস্টই মনে করছে। গণতান্ত্রিক শক্তি দ্রুত কর্মসূচী নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংস্ৰতা রোধে এগিয়ে যেতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সেই তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত এবং কাজও করছে দ্রুত। এক সপ্তাহ পর সর্বদলীয় সম্প্ৰীতি কমিটি গঠন করে গণতান্ত্রিক (?) রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলোর আত্মসন্তুষ্টির কোনও কারণ নেই। পাকিস্তান এবং ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কম হয়েছে এরকম তৃপ্তি অনেক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আছে, কিন্তু সুরঞ্জন বোঝে না। ওরা কেন বুঝতে চায় না। বাংলাদেশে ঘটনা ঘটে একতরফা। এখানের হিন্দুরা ভারতের মুসলমানের মত পাল্টা আঘাত করে না। সেই কারণে পাল্টা-পাল্টি হয় না। এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রেই মৌলবাদী-ফ্যাসিবাদী অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সরকারি দলগুলো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য। মৌলবাদীরা শক্তি সঞ্চয় করছে। ভারতে, তাজিকিস্তানে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে, আলজেরিয়ায়, মিশরে, ইরানে, সার্বিয়ায়। তাদের লক্ষ একটিই, গণতান্ত্রিক শক্তিকে আঘাত করা। জার্মানির সরকার তিনজন তুর্কি নারীকে পুড়িয়ে মারবার অপরাধে দুটো ফ্যাসিবাদী দলকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতেও নিষিদ্ধ হয়েছে মৌলবাদী দলগুলো, অবশ্য ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা ক’দিন টেকে বলা যায় না। আলজেরিয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছে। মিশর সরকার কঠোর হাতে দমন করছে মৌলবাদীদের। তাজিকিস্তানে যুদ্ধ হচ্ছে মৌলবাদী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে। বাংলাদেশ সরকার কি মৌলবাদী ফ্যাসিবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ করার কথা একবার ভুলেও বলেছে! আর যে দেশেই হোক, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি অন্তত এ দেশে বন্ধ হবে না; সুরঞ্জন ভাবে।
ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোর কল্যাণে ক্ষমতাসীন বি এন পি সরকার গোলাম আজম বিচারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের গতিমুখ ঘুরিয়ে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে জামাত শিবির ফ্রিডম পার্টি এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলের তৎপরতা সরকারকে সাহায্য করেছে। জামাতে ইসলামি দেশবাসীর মন অন্যদিকে ফিরিয়ে স্বস্তি পেয়েছে গোলাম আজম-বিচার আন্দোলনের চাপ থেকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মিছিলে শ্লোগান উঠেছে-‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজাদের রুখবে এবার বাংলাদেশ। আহা বাংলাদেশ। সুরঞ্জন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেশালা শুয়োরের বাচ্চা বাংলাদেশ। গালিটি সে বারবার উচ্চারণ করে। তার বেশ আনন্দ হয়। হোসেও ওঠে। হঠাৎ, হাসিটিকে নিজের কাছেই বড় ক্রুর মনে হয়।
মদল কিরণময়ীর গা ঘেঁষে বসে থাকে। বলে—মাসিম, আমরা মিরপুর চলে যাচ্ছি। ওখানে গুণ্ডারা যেতে পারবে না।
–কোন পারবে না?
—মিরপুর তো অনেক দূর।
মাদল এরকমই বোঝে যে গুণ্ডারা কেবল টিকাটুলিতে থাকে। তারা মিরপুর দূর বলে ওখানে যায় না। কিরণময়ী ভাবেন যারা হিন্দুদের বাড়ি লুট করে, ভাঙে পোড়ায়, মায়াদের নিয়ে যায়, তারা কি কেবল গুণ্ডা? গুণ্ডারা তো হিন্দু মুসলমান মানে না, সব বাড়িই আত্রিমণ করে। যারা ধর্ম দেখে লুট করে, হরণ করে, তাদের গুণ্ড বললে গুণ্ডা নামটিকেই বরং অপমান করা হয়।
সুধাময় শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজই তো নেই তার। আচল অথর্ব জীবন নিয়ে কী প্রয়োজন বেঁচে থেকে। খামোেকা কিরণময়ীর কষ্ট। সৰ্বংসহা মানুষ এইকিরণময়ী। এতটুকু ক্লান্তি নেই তাঁর। সারারাত চোখের জল ফেলেন, তাঁর কি আর চুলে ধরাতে ইচ্ছে করে। তবু ধরাতে হয়। পেটের যন্ত্রণা তো সব ছাপিয়ে ওঠে। সুরঞ্জন তো বাদই দিয়েছে নাওয়া-খাওয়া, কিরণময়ীও অনেকটা। সুধাময়েরও রুচি হয় না। মায়া যে আজও ফিরছে না! মায়া কি ফিরিবে না? তাঁর জীবনের বিনিময়ে যদি পারতেন মায়াকে ফিরিয়ে আনতে! যদি চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বলা যেত–’মায়াকে ফেরত চাই। মায়াকে ফেরত চাইবার অধিকার আমার আছে।’ অধিকার? অধিকার শব্দটি এখন সুখময়ের কাছে ভূতুড়ে একটি শব্দ মনে হয়। ছেচল্লিশে, তখন কত আর বয়স সুধাময়ের, কালীবাড়ির এক দোকানে সন্দেশ খেয়ে তিনি বলেছিলেন—’এক গ্লাস পানি দাও তো ভাই।’ শহরে তখন ঘন হয়ে উঠছিল হিন্দু মুসলমানে অসন্তোষ। মিষ্টির দোকানে তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল কিছু মুসলমান। ‘জল’ বলতে পারেনন সুধাময়। ভয়ে? ভয়েই হবে, আর কী!
ইংরেজরা এ কথা বুঝেছিল যে হিন্দু মুসলমানের একতা এবং সদ্ভাব ভাঙতে না পারলে তাদের পক্ষে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাদের কূটবুদ্ধি থেকেই জন্ম নিল ডিভাইড এন্ড রুল নীতি। এরকম কি হতে পারে, সুধাময় ভাবেন, যেখানে শতকরা নব্বইজন চাষী মুসলমান, সেখানে নব্বই ভাগ জমি ছিল হিন্দুর, জমি থেকেই রুশ চীনে বিপ্লব, জমি থেকেই বাংলায় হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষ। জমিঘটিত ব্যাপার ধর্মঘটিত হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাংলাদেশেই ১৯০৬ সালে সাম্প্রদায়িক নীতির ওপর ভিত্তি করে মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে সাম্প্রদায়িক বিষে কলুষিত করবার জন্য এই দলটিই দায়ী { অবশ্য কংগ্রেসকেও ছেড়ে দেওয়া যায় না। সাতচল্লিশের পর থেকে চব্বিশটি বছর সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পাকিস্তানের শাসকরা ইসলামি জিগির, ভারত বিরোধী ধ্বনি আর সাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুলে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিল। একাত্তরে সেই অধিকার ফিরে পেয়ে সুধাময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু এই নিঃশ্বাসটি তাঁর মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে আসে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্ৰীয় চার মূল নীতির একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়। এটি ছিল সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে এক দুৰ্জয় বর্ম। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকেই সাম্প্রদায়িকতার নতুন আবির্ভাব ঘটল। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জোট বাঁধলা সহিংসতা, মৌলবাদ, ধমন্ধিতা, স্বৈরাচার। সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে অভদ্রজন্যোচিত করবার জন্য দরকার হয় একটি আদর্শভিত্তিক তত্ত্ব। পাকিস্তান বানাবার আগে এই তত্ত্বের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, আর বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর নাম হল ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ধুয়ে ‘বাংলাদেশি হতে হবে তাদের, বাংলাদেশি গরু গাধা ধান পাটের মত মানুষও এখন বাংলাদেশি! অষ্ট আশি সালে অষ্টম সংশোধনীর পর বাংলাদেশ সংবিধানে লেখা হল–The state religion of the Republic is Islam, but other religions may be practised in peace and harmony in the Republic. এখানে may be কথাটা বলা হল কেন? কেন shall be নয়? মৌলিক অধিকার-এর ক্ষেত্রে লেখা অবশ্য আছে। ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী শপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ কিন্তু বৈষম্যের কথা স্বীকার না করলে হবে কী, বৈষম্য যদি বিরাজ না-ই করে তবে ‘মায়াকে কোন ধরে নিয়ে যাবে ওরা। কোন গাল দেবে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে? গুণ্ডারা কি মালাউনের বাচ্চা বলে গাল দেয়? তা হলে এসব গুণ্ডামি নয়, অন্য কিছু। যা দিনদিন স্বাধন হয়ে আসছে, স্কুলের বদলে মাদ্রাসা বাড়ছে দেশে, মসজিদ বাড়ছে, ইসলামি জলসা বাড়ছে, মাইকে আজান বাড়ছে, এক মহল্লায় দু-তিন বাড়ি পর পর মসজিদ, চারদিকে তার মাইক। হিন্দুদের পুজোর সময় অবশ্য মাইক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যদি মাইক বাজেই, তবে মুসলমানের মাইকই কেন বাজবে শুধু? জাতিসংঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৮ ধারায় আছে ‘প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা-বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একই অথবা অপরের সহিত যোগসাজশে ও প্রকাশে বা গোপনে নিজ ধৰ্ম বা বিশ্বাস শিক্ষাদান, প্রচার, উপাসনা ও পালনের মাধ্যমে প্রকাশ করবার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।’ তাই যদি হয় তবে হিন্দুদের মন্দির ভাঙলে কেন, মন্দিরে যদিও বিশ্বাস নেই। সুধাময়ের, তবে ভাঙবার বেলায় কেবল মন্দির ভাঙবার পক্ষপাতী তিনি নন মোটেও। আর এই যে এত ভাঙা পোড়া হচ্ছে, কিছু কি শাস্তি কুরাদ নেই। এদের জন্য টু পেনাল কেড়ে শাস্তি লেখা এক বছরের জেল, বড়জোর দুই। খুব বেশি হলে তিন।
সুধাময়ের অসুস্থতা ছাপিয়ে আর সকল অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করে নেয়। একটি দেশ ক্ৰমে ক্ৰমে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ বছর সংগ্রামের পর পাকিস্তানের থাবা থেকে বাঙালি মুক্তি পেল, স্বাধীন একটি দেশের সংবিধান রচিত হল ‘we, the people of Bangadesh, having proclaimed our Independence on the 26th day of Marcu 1971 and through a historic struggle for national liberation, established the independent, sovereign People’s Republic of Bangladesh.
Pledging that the high ideals of nationalism, socialism, democracy, and secakrism, which inspired our heroic people to dedicate themselves to, and our rave martyrs to sacrifice their lives in, the national liberation strugie, shall be the fundamental principles of the constitution.
Suggle for national liberation বদলে ১৯৭৮-এ হয়ে গেল a historic war for natical independence. Oris Pat & …high ideals of absolute trust and faith in the Almighty Allah, nationalism, democracy and socialisFa mealing economic and social justice, তার ওপর liberation struggle হয়ে গেল independence.
বাত্তরের সংবিধান পাল্টে আটাত্তরে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম (দয়ালু, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে। ) বসানো হল। সংবিধানের বারো নম্বর ধারাটি পুরো ভ্যানিস করে দেওয়া হয়। ধারাটি এরকম ছিল Secularism and freedom of religion.
The principle of secularism shall be realised by the elimination of
a. communalism in all its forms.
b. the granting by the State of political status in favour of any religion.
c. the abuse of religion forpolitical purposes.
d. any discrimination against, or persecution of, persons practising a particular religion.
সেকুলারিজম উড়িয়ে দিয়ে ২৫(২) নম্বর ধারায় যোগ করা হয় ‘রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিত মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।
বাহাত্তরে সংবিধানের ছয় নম্বর ধারায় ছিল The citizenship of Bangladesh shall be determined and regulated by law; citizens of Bangladesh shall be known as langalees. জিয়াউর রহমান করলেন The citizens of Bangladesh shall be known as Bangladeshis.
সুধাময় চোখে অন্ধকার দেখেন। দুপুরও গড়ায়নি এখনই ঘর কেন অন্ধকার হবে। তবেকি তাঁর চোখের জ্যোতি কমে যাচ্ছে। নাকি অনেক দিন হল চশমা পাল্টানো হচ্ছে না, তাই। নাকি ছানি পড়ছে চোখে, নাকি বারবার জল এসে ঝাপসা করে দিচ্ছে তাঁর চোখ।
সুরঞ্জনটাও কেমন পাল্টে যাচ্ছে। কাছে এসে একটিবার বসেও না। মায়াকে ধরে নিয়ে যাবার পর দিন থেকে এঘরে সে ভুলেও পা দেয় না। সুধাময় এঘর থেকেই ওঘরের আড্ডায় মদ খাবার শব্দ শোনেন। ছেলেটি কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? ঘরে বসে মদ্যপান করতে কখনও তিনি সুরঞ্জনকে দেখেননি। সে হয়ত এখন আর কাউকে কেয়ার করছে না। মায়াকেও ভুলে গেল দুদিনে! সুধাময়ের বিশ্বাস হয় না, তার হঠাৎ স্তব্ধতা সুধাময়কে আরও ব্যাকুল করে তোলে, ছেলেটি উচ্ছন্নে যাচ্ছে না তো!
সুরঞ্জন কোথাও বেরোবে না। মায়াকে যে খুঁজে কোনও লাভ নেই তা সে বুঝে গেছে। তার চেয়ে ঘরে বসে থাকাই ভাল, রাস্তায় বেরোলেই লোকে বলবে ‘শালা মালাউনের বাচ্চারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে। এদের সব ঠেঙিয়ে ভারত পাঠানো উচিত। ‘ এসব শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে সুরঞ্জনের। সে এখন কোনও সমাজতান্ত্রিক পাটি, বামপন্থী নেতা-ফেতায় বিশ্বাস করে না। অনেক বামপন্থীকেও সে তাকে গাল দিতে শুনেছে ‘শালা মালু, মালাউনের বাচ্চা’ বলে। কৃষ্ণবিনোদ রায়কে সবাই বলত কবীর ভাই। বারীন দত্তকে নাম পাল্টে আবদুস সালাম হতে হয়। কমিউনিস্ট পাটিতেও যদি হিন্দু নাম পাল্টাতে হয়, তবে কোন পাটিতে আর ভরসা করা যায়! নাকি সে জামাতে নাম লেখাবে? সোজা গিয়ে নিজামিকে বলবে—’হুজুর, আসসালামু আলায়কুম!’ পরদিন খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে খবর বেরোবে ‘হিন্দুর জামাতি ইসলামে যোগদান।‘ জগন্নাথ হলেও নাকি জামাতি ইসলামি ভোট পায়, এর কারণ টাকা। মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেলে কে ভোট দেবে না জামাতিকে? সুরঞ্জন শোধ নিতে চায় বামপন্থী দলগুলোর ওপর, যে দলগুলো তাকে আশার বদলে হতাশায় ডুবিয়েছে, দলের লোক একের পর এক অন্য দলে ঢুকে গেছে। আজ এক কথা বলে কাল আরেক কথা বলেছে। কমরেড ফরহাদ মারা গেলে সি পি বি অফিসে কোরানখানি আর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন হয়েছে। মহা সমারোহে কমরেডের জানাজা হয়েছে। কেন হয়েছে, কেন কমিউনিস্টদের ইসলামের পতাকা তলেই শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয়? জনগণের নাস্তিক অপবাদ থেকে বাঁচবার জন্য তো! কই তাতে বেঁচেছে কি তারা? এত কপাল ঠুকেও দেশের সবচেয়ে পুরনো পার্টিটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দোষ সুরঞ্জন জনগণকে দেয় না, দেয় বামপন্থী নামের দিশেহারা নেতাদেরই।
দেশে আজ মাদ্রাসা বাড়ছে। একটি দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেবার জন্য এই পরিকল্পনাটি অত্যন্ত উত্তম বৈকি। শেখ মুজিবই বোধহয় গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসার প্রসার করেছিলেন। কোথা দিয়ে কে যে দেশটির সর্বনাশ করে গেছে, যে জাতি ভাষা আন্দোলন করল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করল, সে জাতির এমন সর্বনাশ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কোথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই বোধ, কোথায় ‘বাংলার হিন্দু বাংলার বৌদ্ধ বাংলার খ্রিস্টান বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালির সেই সুর, সেই চেতনা? সুরঞ্জন বড় এক বোধ করে। বড় একা। ফেন সে বাঙালি নয়, মানুষ নয়, হিন্দু একটি দ্বিপদী জীব নিজের মাটিতেই নিজে ‘পরবাসী’ হয়ে বসে আছে।
এ বংশের মন্ত্রণালয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় আছে। ধর্মীয় খাতে বিগত বছরের বাজেট ছিল বেশ উপাদেয়। সুরঞ্জন একে উপাদেয়ই বলবে। অনুন্নয়ন খাতে ছিল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সাহায্য মঞ্জুরি; ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা ১,৫০,০০,০০০ টাকা। ওয়াকফ প্রশাসক মজুরি ৮,০০,০০০ টাকা। অন্যান্য ধৰ্মীয় উদ্দেশ্যে মজুরি ২,৬০,৭৫,০০০। জাকাত ফান্ড প্রশাসক মঞ্জুরি ২,২০,০০০। ইসলামিক মিশন প্রতিষ্ঠান বাবদ অয় ২,৫০,০০,০০০। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আমানত তহবিল ২,৫০,০০০। মসজিদে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ১,২০,০০,০০০। মসজিদে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ ৫০,০০,০০০। ঢাকা তারা মসজিদ ৩,০০,০০০। মোট ৮,৪৫,৭০,০০০ টাকা। বায়তুলমোকারম মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ : ১৫,০০,০০০। প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনমুখী কার্যক্রম নিবিড়করণ ও প্রসারের জন্য থোক বরাদ্ধ সহ মোট অনুন্নয়ন বরাদ্দ :, ১০,৯৩,১৮,০০০। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আমানত তহবিল হিসেবে বরাদের পরিমাণ মাত্র ২,৫০,০০০ টাকা। দেশে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু প্রায় আড়াই কোটি। আড়াই কাটি লোকের জন্য আড়াই লাখ টাকার বরাদ্দ বেশ মজার বৈকি।
উন্নয়ন খাতে, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়; বাংলায় ইসলামি বিশ্বকোষ : সংকলন ও প্রকাশন ২০,০০,০০০। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্ৰ প্রকল্প **০,০,০০০। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা অনুবাদ ও গবেষণা কার্যক্রম ১,৬৮, ৭,০০০। ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি উন্নয়ন কাৰ্যক্রমে ১৫,০০,০০০। মসজিদ পাঠাগার প্রকল্প ২৫,০০,০০০। নতুন জেলাসমূহে ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র সম্প্রসারণ, ঈমান প্রশিক্ষণ/ট্রেনিং একাডেমি ১,৫০,০০,০০০। মোট উন্নয়ন বরাদ্দ ৫,৬৮,৭৫,০০০ টাকা। তারপর অন্যান্য ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মজুরি উপখাতে ২,৬০,০০০ টাকার বিভাজন হয়েছে এরকম, ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠান/ উৎসব উদযাপন ইত্যাদি ৫,০০,০০০। ইসলাম ধৰ্মীয় সংগঠনের জন্য কর্মসূচী ভিত্তিক সাহায্য মঞ্জুরি ৮,৬০,০০০। মাননীয় সংসদ সদস্য/ সদস্যদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন মসজিদ সংস্কার মেরামত ও পুনবার্বাসনের জন্য ২,০০,০০,০০০। বিদেশ থেকে আগত ও বিদেশ গমনকারী ধর্মীয় প্রতিনিধি দলের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ১০,০০,০০০। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংস্থা সংক্রান্ত চাঁদা ৬,৪০,০০০। নও মুসলমান, দুঃস্থ পুনর্বাসনের জন্য ১০,০০,০০০। ১৯৯২ সালে ধর্মীয় খাতের বাজেট বরাদ্দে দেখা যায় যে উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ১৬,৬২,১৩,০০০। এই বাজেটের নও মুসলমানদের পুনর্বাসনের খাতট বেশ মজার। দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই খাতে। অথচ উন্নয়ন খাতে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও বরাদ্দ নেই। বহু ধর্মে বহু বর্ণে অধ্যুষিত একটি দরিদ্র দেশের জন্য বিশেষ একটি ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের এই প্রলোভন অত্যন্ত লজ্জার। দেশের মেরুদণ্ড ভাঙা মাথা পিছু বিদেশি ঋণের বোঝা কত তা কি একবার আমরা হিসেব করি! এরকম যদি অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব তবে জাতীয় বাজেটে ইসলাম বিষয়ে এত মোটা কম বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? এবং এই বাজেটের বৈষম্যমূলক বরাদ্দ জাতীয় সম্প্ৰীতি নষ্ট করছে। কেউ কি ভাবে না এসব? সুরঞ্জন এইসব বৈষম্যের কথা ভাবতে ভাবতে দেখে দরজা খুলে কাজল দেবনাথ ঢোকেন।
—কি ব্যাপার অসময়ে শুয়ে আছ যে সুরঞ্জন?
—আমার আবার সময় অসময় কি! সুরঞ্জন সরে কাজলের বসবার জায়গা করে দেয়।
–মায়া ফিরেছে?
–নাহ। সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
—কি করতে পারি বল তো? কিছু একটা করা উচিত আমাদের।
–কি করবেন?
কাজল দেকনাথের কাঁচা পাকা চুল, বয়স চল্লিশের ওপর, ঢিলেঢালা শার্ট পরেছেন, কপালে তাঁরও ভাঁজ পড়েছে ভাবনার। সিগারেট বের করেন, বলেন–খাবে নাকি?
–দিন। হাত বাড়ায় সুরঞ্জন। অনেকদিন সিগারেট কেনা হয় না। তার ৷ পয়সা, কার কাছে চাইবে সে, কিরণময়ীর কাছে? লজ্জায় তো ওঘরে যাওয়াই সে বাদ দিয়েছে। মায়া হারিয়ে যাবার লজ্জা যেন তারই, এরকমই মনে হয় সুরঞ্জনের। দেশ নিয়ে সে-ই তো বেশি লাফিয়েছে, এদেশের মানুষ অসম্প্রদায়িক একথা তো সেই চেয়েছে বেশি প্রমাণ করতে, লজ্জা তাই তারই। সে এই লজ্জিত মুখ নিয়ে দাঁড়াতে চায় না। সুধাময়ের মত একজন আদর্শবান, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের সামনে।
খালি পেটে সিগারেট ফোঁকে সুরঞ্জন। মায়া দেখলেই হয়ত ধরে বসত, বলত— খবরদার ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। দাদা। খালি পেটে সিগারেট খােচ্ছ তো, নির্ঘাত ক্যান্সার হবে। মারবে।
সুরঞ্জনের যদি ক্যান্সার হত। মন্দ হত না। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করত। কোনও প্রত্যাশা নিয়ে তাকে বাঁচতে হত না।
কাজল দেবনাথ কি করবেন, কিছু খুঁজে পান না। তিনি বলেন—আজ তোমার বোনকে নিয়ে গেছে। কাল আমার মেয়েকে নেবে। নেবেই তো। আজ গৌতমের মাথায় কোপ পড়ল। কাল তোমার বা আমার মাথায় পড়বে।
সুরঞ্জন বলে–আমরা আগে মানুষ না হিন্দু, বলুন তো?
কাজল ঘরটির চারপাশ তাকিয়ে বলেন–এঘরেও এসেছিল, তাই না?
–হ্যাঁ।
–মায়া কি করছিল তখন?
–শুনলাম। বাবার জন্য ভাত মাখছিল।
–ওদের কিছুমার দিতে পারল না?
–কি করে দেবে। ওদের হাতে মোটা মোটা লাঠি, রড। আর হিন্দুর কি ক্ষমতা আছে মুসলমানের গায়ে হাত তোলা? ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা পাল্টা মারে। দুদিলে মারামারি হলে তাকে বলে দাঙ্গা। ওখানে হচ্ছে দাঙ্গা। আর লোকে এদেশের ঘটনাকে দাঙ্গা বলে। এখানে যা হচ্ছে তা হল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, এর নাম অত্যাচার বলা যায়, নির্যাতন বলা যায়। এক দল আরেক দলকে আচ্ছাসে পেটাচ্ছে, মারছে।
—মায়া কি ফিরবে মনে হয়?
—জানি না। সুরঞ্জন মায়ার প্রসঙ্গে গেলেই লক্ষ করে তার গলার কাছে কি যেন আটকে আছে। বুকের মধ্যটা খালি হয়ে যায়।
–কাজলদা, দেশে আর কি কি ঘটল?
সুরজন মায়া প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরতে চায়।
কাজল দেকনাথ ঘরের ছাদের দিকে ধোঁয়া ছুঁড়ে দেন, বলেন— আঠাশ হাজার ঘরবাড়ি, দুহাজার সাতশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তিন হাজার ছয়শ মন্দির ক্ষতিগ্ৰস্ত, বিধ্বস্ত। বারো জন হত, দুশ কোটি টাকার ক্ষতি। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। তেতাল্লিশটি জেলায় ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে দু হাজার ছয়শ মহিলা। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ মন্দিরগুলো হচ্ছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রায় পাঁচশ বছরের প্রাচীন মন্দির, এটি ছিল সিলেটের দক্ষিণে, বানিয়াচংয়ের প্রায় কয়েকশ বছরের প্রাচীন কালী বাড়ি, চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম, তুলসীধাম, ভোলার মদনমোহন আখড়া, সুনামগঞ্জ আর ফরিদপুরের রামকৃষ্ণ মিশন।
সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে–সরকার কিছু সাহায্য-টাহায্য দেয়নি? –
-না। সরকার তো দেয়নি, কোনও সাহায্য সংস্থাকেও অনুমতি দেয়নি। অবশ্য বেসরকারি কিছু সংস্থা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ খোলা আকার নিচে বসে আছে। কাপড় নেই, খাবার নেই, ঘর নেই, ধর্ষিতা মেয়েরা এক একজন বোবা হয়ে গেছে, রা নেই। ব্যবসায়ীরা সব হারিয়ে হাঁ হয়ে বসে আছে। এখনও ওদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে, জায়গা জমি দখল করছে। ঘরবাড়ির ক্ষতি বরিশাল বিভাগে পঁচাত্তর কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগে বিশ কোটি টাকা। ঢাকা বিভাগে দশ কোটি। খুলনা আর রাজশাহী বিভাগে এক কোটি করে। মোট একশ সাত কোটি টাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে বাইশ কোটি টাকা। মন্দির সব মিলিয়ে সাতান্ন কোটি টাকা।
–আর ভাল লাগে না কাজলদা। আর ভাল লাগে না।
—সবচেয়ে খারাপ কি হচ্ছে জানো তো? দেশ ত্যাগ। এবারের ভয়াবহ দেশত্যাগকে ঠেকাবার আর উপায় নেই। সরকারি মহল থেকে সবসময় বলা হয়েছে দেশ ত্যাগ করছে না হিন্দুরা। কলকাতার দেশ পত্রিকা একবার লিখল না বছরে প্রায় লাখ দেড়েক বাংলাদেশির অনুপ্রবেশ ঘটছে এখানে এবং এর প্রধান অংশই আর ফিরে যাচ্ছে না। গত দুই দশকে পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ছটি সেনসাস রিপোর্ট কী বলছে দেখ, ১৯৪১ সালে মুসলমান ছিল ৭০.৩%, হিন্দু ছিল ২৮.৩%। ১৯৫১ সালে মুসলমান ছিল ৭৬.৯%, হিন্দু ছিল ২২.৫০%,। ১৯৬১ সালে মুসলমান ছিল ৮০.৪%, হিন্দু ১৮.৫%,। ১৯৭৪ সালে মুসলমান ৮৫.৪%, হিন্দু ১৩.৫%। ১৯৮১ সালে মুসলমান ৮৬.৭%, হিন্দু ১২.১%,। ১৯৯১ সালে মুসলমান ৮৭.৭৪%, হিন্দু ধর ১২.৬%। এর মানেটা কি, প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, হিন্দুর সংখ্যা কমছে। কমছে কেন, যাচ্ছে কোথায় তাহলে? সরকার যদি বলেনই যে মাইগ্রেশন হচ্ছে তবে সেনসাসের এমন রিপোর্ট কেন। এখন নতুন সেনসাসে কি নিয়ম হয়েছে জানো হিন্দু মুসলমান আলাদা করে গুনবে না।
–কারণ?
–কারণ হিন্দু সংখ্যা কমে যাওয়ার হিসেবটা পাওয়া যাবে বলে।
—তাহলে বলা যায় এই সরকার খুব চতুর, তাই না কাজলদা? সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে।
কাজল দেবনাথ কিছু না বলে আরেকটি শলা ঠোঁটে নেন। জিজ্ঞেস করেন–এ্যাসট্রে আছে?
–পুরো ঘরটাকেই এ্যাসট্রে ধরে নিন।
—তোমার বাবা মা’র সঙ্গে যে দেখা করব, কি সান্ত্বনা ওঁদের দেব বলা! কাজল দেবনাথ মাথা নীচু করেন লজ্জায়। যেন তাঁর নিজের ভাই মায়াকে অপহরণ করেছে, এমন তাঁর লজ্জা ৷
আবার মায়া প্রসঙ্গ। আবার তার বুক থেকে অগ্নিগিরির লাভার মত বেরোয়। সুরঞ্জন প্রসঙ্গ পাল্টে বলে— আচ্ছা কাজলদা, জিন্নাহ তো বলেই ছিল এখন থেকে সবাই আমরা পাকিস্তানি, কোনও হিন্দু মুসলিম নয়। তারপর কি হিন্দুদের ভারত যাওয়া কমেনি?
—জিন্নাহ ছিল ইসমাইলিয়া খোজা। মুসলমান হলেও ওরা হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন মানত। ওর পদবী আসলে খোজানি। নাম ছিল ‘ঝীনাভাই খোজানি’। ঝীনাটুকু রেখে বাকি নাম সে বাদ দিয়েছিল। জিন্নাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বটে, তারপরও হিন্দুরা বৈষম্যের শিকার হয়। তা নাহলে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১১ লাখ হিন্দু ভারতে চলে যাবে কেন? ভারতে তারা রিফিউজি হিসেবে পরিচিত হয়।
–পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গায় অনেক মুসলমান এদেশেও চলে এসেছে।
–হ্যাঁ, আসাম আর ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে বহু মুসলমান এদেশে, চলেও গেছে। কারণ তখন ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে ‘নেহেরু লিয়াকত চুক্তি’ হয়েছিল, চুক্তিতে বলা হয় ‘দুদেশেই সংখ্যালঘুরা ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ভোগ করবে।’ তাদের জীবন, সংস্কৃতি ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়, মত প্রকাশ এবং ধর্মীয় আচরণের স্বাধীনতাকেও স্বীকার করা হয়। এই চুক্তির শর্ত মতে ওখান থেকে আসা লোকগুলো ফিরে যায়। কিন্তু এখন থেকে যাওয়া লোকগুলো আর ফেরেনি। না। ফিরলেও তখনকার মত যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের আইনসভায় এমন দুটো আইন পাস হয়, ইস্ট বেঙ্গল ইভাকুই প্রোপার্টি এ্যাক্ট অব ১৯৫১ আর ইস্ট বেঙ্গল ইভাকুইস এ্যাক্ট অব ১৯৫১। এসব কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশত্যাগ করা লোকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষ। এসব তোমার বাবা ভাল জানবেন।
— বাবা এসব কিছুই বলেন না। আমাকে, দেশত্যাগের কথা উঠলে তিনি ফায়ার হয়ে যান। কিছুতে সহ্য করতে পারেন না।
–দেশত্যাগ কি আমরাই মানি? কিন্তু যারা যাচ্ছে, গোপনে চলে যাচ্ছে, তাদের তুমি ফেরাবে কি বলে? কিছু একটা আশ্বাস তো তাদের দিতেই হবে। নইলে নিজের মাটি থেকে কেউ যেতে চায়? শাস্ত্রে একটা কথা আছে না যে যে অপ্রবাসী সে-ই সবচেয়ে সুখী। মুসলমানরা হিজরত করে অভ্যস্ত। তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে ইতিহাসই বলে। কিন্তু হিন্দুর জন্য মাটি একটি ব্যাপার বটে।
বলতে বলতে কাজল দেবনাথ উঠে বারান্দায় যান। সম্ভবত আবেগকে প্রশমিত করবার জন্যই।
ফিরে এসে বলেন–বড় চা খেতে ইচ্ছে করছে। চল কোনও চায়ের দোকানে যাই।
সুরঞ্জন আর কাপড় পাল্টায় না। যে কাপড় ছিল, স্নান নেই, খাওয়াও কদিন পেটে পড়েছে ঠিক নেই। সে গায়ের লেপ ফেলে ঝাঁট করে দাঁড়িয়ে যায়। বলে —চলুন। শরীরে জং ধরে গেছে শুয়ে থাকতে থাকতে।
দরজা খোলা রেখেই বেরোয় সুরঞ্জন। কেন আর বন্ধ করবে। অঘটন যা ঘটবার ঘটেই তো গেছে। হাঁটতে হাঁটতে কাজল দেকনাথ জিজ্ঞেস করেন— বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে তোমার?
–মা রেখে যান ঘরে, কখনও খাই কখনও খাই না। ইচ্ছে করে না। ভাল লাগে না আমার। সুরঞ্জন আঙুলে মাথার চুলগুলো আঁচড়ায়। এ ঠিক চুল নিপাট করবার উদ্দেশ্যে নয়। ভেতরের যন্ত্রণা কমাবার জন্য।
সুরঞ্জন পুরনো প্রসঙ্গে ফেরে—উনসত্তর, সত্তরে বোধহয় হিন্দুদের মাইগ্রেশন কম হয়েছে কাজলদা।
—ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন শুরু হল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত হিন্দুরা কম গেছে। ফিফটি ফাইভ থেকে ষাট পর্যন্ত প্রচুর গেছে। সিক্সটি থেকে পয়ষট্টি পর্যন্ত দশ লাখ মত লোক চলে গেছে। যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় এক কোটির মত ভারতে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে আশি ভাগই ছিল হিন্দু। যুদ্ধের পর ফিরে এসে হিন্দুরা দেখেছে তাদের ঘরবাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। অনেকে তখন চলে গেয়ে কেউ থেকে গেছে আশায় আশায়। স্বাধীন দেশ তাদের নিরাপত্তা দেবে এই আশা। তারপর তো দেখছই চুয়াত্তরেও মুজিব সরকার শত্ৰু সম্পত্তির নাম ছাড়া আর কিছু চেঞ্জ করল না। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতায় বসাল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিল। এরপর এরশাদ এসে ইসলামি পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করল। বিরাশির বাইশে ডিসেম্বর এরশাদ ঘোষণা করল ইসলাম ও কোরানের নীতিই হবে দেশের নতুন সংবিধানের ভিত্তি। চব্বিশ বছর ধর্মের নামে শোষিত হবার পর ধর্ম আবার রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসবে সদম্ভে, তাই বা কে ভেবেছিল।
একটি চায়ের দোকান দেখে থামে। ওরা। কাজল দেবনাথ সুরঞ্জনের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বলেন–তোমাকে খুব অন্যমনস্ক লাগছে। যে প্রশ্নগুলো তোমার খুব ভাল করেই জানা তাই আবার জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করছ। কেন? মনে হচ্ছে তোমার ভেতর প্রচণ্ড অস্থিরতা। এ সময় স্থির হও সুরঞ্জন। তোমার মত প্রতিভাবান ছেলে হতাশায় ভুগলে চলবে কেন?
একটি টেবিলে মুখোমুখি দুজন বসে। কাজল দেবনাথ জিজ্ঞেস করেন— চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে?
সুরঞ্জন মাথা নাড়ে। খাবে। দুটো সিঙ্গাড়া খায় সে। কাজল দেবনাথও নেন। সিঙ্গারা খেয়ে দোকানের ছেলেটিকে বলেন–পানি দাও।
পানি শব্দটি সুরঞ্জন শোনে। কাজল দেকনাথ বাড়িতে জল বলেন। কিন্তু আজ তিনি পানি বললেন। এ কি অভ্যোস হয়ে গেছে পানি বলায়, তাই বললেন? নাকি ভয়ে বলান? সুরঞ্জনের জানতে ইচ্ছে করে। প্রশ্ন করতে গিয়েও সে করে না। তার মনে হয়, একসঙ্গে অনেকগুলো চোখ তাদের লক্ষ করছে। চায়ে দ্রুত চুমুক দেয় সে। ভয়ে? এ ভয় জন্মাচ্ছে কেন? গরম চায়ে হঠাৎ চুমুক পড়াতে তার জিভ পুড়ে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে যে ছেলেটি পাশের টেবিল থেকে দেখছে, তার থুতনিতে দাড়ি, মাথায় একটি কুরাশি বোনা টুপিও। বয়স বাইশ একুশ হবে। সুরঞ্জনের মনে হয় মায়াকে যারা নিয়ে গেছে, এই ছেটি নিশ্চয়ই ছিল তাদের মধ্যে, না হলে এত কান পেতে আছে কেন? এত কেন একি মনোযোগ! সুরঞ্জন লক্ষ্য করে ছেলেটি মিটমিট হাসছে। তবে কি এই জন্য হাসছ যে কেমন বুঝছ মজা, বোনটিকে তো যাচ্ছেতাই করে খেলছি আমরা। চা শেষ হয় না রঞ্জনের। বলে— চলুন উঠি কাজলদা। ভাল লাগছে না।
—এত তড়িঘড়ি উঠতে চাইছ যে?
–ভাল লাগছে না।