Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রোদ পড়েছে বারান্দায়। কালো সাদা বেড়ালটি এদিক ওদিক হাঁটছে। ও কি কাঁটা খুঁজছে, নাকি মায়াকে খুঁজছে। মায়া ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, মায়ার লেপের তলে ও গুটিসুটি ঘুমিয়ে থাকত। ও কি জানে মায়া নেই?

মায়া নিশ্চয় খুব কাঁদছে। ‘দাদা দাদা’ বলেও হয়ত ডাকছে। মায়ার কি হাত পা বেঁধে নিয়েছে ওরা? মুখে কাপড় খুঁজে? ছ’ বছর আর একুশ বছর এক নয়। দু বয়সের মেয়েকে ধরে নেবার উদ্দেশ্যও এক নয়। সুরঞ্জন অনুমান করতে পারে একুশ বছর বয়সের একটি মেয়েকে নিয়ে সাতজন পুরুষ কি করতে পারে। তার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে ওঠে ক্ষোভে, যন্ত্রণায়। মরে গেলে যেমন কাঠ হয়ে পড়ে থাকে শরীর, অনেকটা সেরকম। সুরঞ্জন কি বেঁচে আছে? বেঁচে তো আছেই। মায়া নেই। মায়া নেই বলে মায়ার আত্মীয়রা বেঁচে থাকবে না? জীবনের ভাগ কেউ কাউকে দেয় না। মানুষের মত স্বার্থপর প্রাণী জগতে আর নেই।

হায়দার খুঁজেছে ঠিকই। তবু সুরঞ্জনের মনে হয়, হায়দার যেন ঠিক মন দিয়ে খোঁজেনি! সুরঞ্জন মুসলমান দিয়ে মুসলমানদের খুঁজিয়েছে, কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তুলতে হয়, তেমন। শুয়ে শুয়ে উঠোনের রোদে শোয়া বেড়ালটি দেখতে দেখতে সুরঞ্জনের হঠাৎ সন্দেহ হয়, হায়দার আসলে জানে মায়াকে কারা নিয়ে গেছে। ও যখন সুপারস্টারে খাচ্ছিল, হাপুস হুপুস করে, ওর মুখে কোনও দুশ্চিস্তার ভাঁজ ছিল না। বরং খাবার পর বেশী তৃপ্তির ঢেকুর ছিল, সিগারেটের ধোঁয়াও যখন ছাড়ল, এত আয়েশ ছিল ওর ধোঁয়া ছাড়ায়, মনে হয়নি ও কাউকে খুঁজতে বেরিয়েছে, এবং খুঁজে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। গুর আবার রাতভর নিশাচরের মত শহর ঘুরুবার শখ আছে। ও কি শখ মেটালো। তবে? মায়াকে ফিরে পাবার সত্যিকার কোনও উৎসাহ ছিল না? যেটুকু ছিল তা যেন তেন করে বাঞ্ছাস্ট্রের দায় শোধ। থানার লোককেও তেমন জোর দিয়ে বলেনি, পাটির যে ছেলেদের সঙ্গে সে কথা বলেছে, আগে পার্টির কথা সেরে পরে বলেছে, যেন মায়ার বিষয়টি জরুরি কুতুব এক নম্বরে নয়, দুই নম্বরে। হিন্দুৱা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তাই বলেই কি?

সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না মায়া পাশের ঘরে নেই, যেন সে এক্ষুণি ওঘরে গেলেই দেখতে পাৰে মায়া সুধাময়ের ডান হাতটির ব্যায়াম করিয়ে দিচ্ছে। যেন ওঘরে গেলেই শ্যামলা মেয়েটির মুখে দাদা কিছু একটা করা-র আকুলতা ফুটে উঠবে। মেয়েটার জন্য কিছুই করা হয়নি। থাকে না দাদার কাছে আবদার, বেড়াতে নাও, ওটা কিনে দাও, এটা দাও। আবদার তো করেই ছিল মায়া, সুরঞ্জন রাখেনি, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে৷ দিনরাত। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, পার্টি-কে মায়া, কে কিরণময়ী, কে সুধাময়, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনে তার দরকার কী! সে এই দেশকে মানুষ বানাতে চেয়েছিল, সুরঞ্জনের সাধের দেশটি কি মানুষ হয়েছে আদৌ?

নটা বাজলেই হায়দারের বাড়ি ছোটে সুরঞ্জন। কাছেই বাড়ি।–তখনও ঘুমোচ্ছে হায়দার। বাইরের ঘরে অপেক্ষা করে সে। অপেক্ষা করতে করতে তার সন্দেহ হয়, ওদের সাতজনের একজনের নাম ছিল রফিক, ছেলেটিকে বোধহয় চেনে হায়দার। এমনও হতে পারে রফিক তার আত্মীয় হয়। গা শিউরে ওঠে সুরঞ্জনের। দুঘণ্টা পর ঘুম ভাঙে হায়দারের। সুরঞ্জনকে বসে থাকা দেখে সে জিজ্ঞেস করে–ফিরেছে?

—ফিরলে কি আর এসেছি তোমার কাছে?

—ও। হায়দারের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে লুঙ্গি পরা, খালি গা, গা দু হাতে চুলকোয়। বলে–এবার শীত পড়েনি তেমন, তাই না? আজও সভানেত্রীর বাড়িতে মিটিং আছে। সম্ভবত মিছিল করার প্রস্তুতি চলবে। গোলাম আজমের ব্যাপারটা যখন তুঙ্গে, তখনই শাল দাঙ্গা বাঁধল। আসলে এগুলো হচ্ছে বি এন পি-র চাল, বুঝলে! ইস্যুটািকে ঘুরিয়ে দেওয়াই তাদের ইচ্ছে।

—আচ্ছা হায়দার, রফিক নামের কোনও ছেলেকে চোন? ওদের মধ্যে রফিক নামের একটি ছেলে ছিল।

—কোন পাড়ার?

—জানি না। বয়স একুশ বাইশ হবে। এ পাড়ারও হতে পারে।

—এরকম কাউকে চিনি না তো! তবু লোক লাগাচ্ছি।

—চল বেরোই। দেরি করাটা তো ঠিক হচ্ছে না। মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বাবার স্ট্রোক হয়েছে, এই টেনশনে আবার না বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

—এ সময় আমার সঙ্গে ঘোরাটা তোমার ঠিক হবে না।

—কেন, ঠিক হবে না কেন?

–বুঝতে পারছি না কেন। বোঝার চেষ্টা কর।

সুরঞ্জন বুঝবে না কেন, ঠিকই বুঝতে পারছে হায়দার কেন বলছে তার না থাকবার কথা। তার সঙ্গে থাকাটা এখন ঠিক হবে না। কারণ সুরঞ্জন হিন্দু, হিন্দু হয়ে মুসলমানদের গাল দেওয়া ঠিক ভাল ঠেকে না। সেই মুসলমান চোর হোক, কী বদমাশ হোক, কী খুনি হোক। মুসলমানের কবজ থেকে হিন্দু মেয়েকে ছিনিয়ে আনাটাও বোধহও বেশি ঔদ্ধত্য দেখানো হয়ে যায়।

সুরঞ্জন ফিরে আসে। কোথায় ফিরবে। সে? বাড়িতে? ওই খাঁ খাঁ করা বাড়িতে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। সুরঞ্জন মায়াকে ফিরিয়ে আনবে এই আশায় চাতক পাখির মত তৃষ্ণা নিয়ে বসে আছেন ওঁরা। মায়াকে ছাড়া বাড়ি ফিরতে তার ইচ্ছে করে না। হায়দার নাকি লোক লাগিয়েছে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওর লোকেরা মায়াকে একদিন উদ্ধার করবে, আবার সংশয় দানা বাঁধে, মায়া নেই তাতে ওদের কী, ওদের তো আর মায়ার জন্য কানও মায়া নেই। হিন্দুদের জন্য মুসলমানের মায়া থাকবে কেন, মায়া থাকলে আজ পাশের মুসলমান বাড়ি তো লুট হয় না, ওদের বাড়ি ভাঙা হয় না, ভাঙা হয় কেবল রঞ্জনের বাড়ি, পোড়ানো হয় গোপাল হালদারের বাড়ি, কাজলেন্দু দে’র বাড়ি। সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে না। পথে পথে ঘোরে। সারা শহর ঘুরে মায়াকে খোঁজে। কী অপরাধ ছিল মায়ার যে ওকে ওরা জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? হিন্দু হবার অপরাধ এত বেশি? এত বশি যে তার বাড়িঘর ভাঙা যায়, তাকে ইচ্ছেমত পেটানো যায়, তাকে ধরে নেওয়া যায়, তাকে ধর্ষণ করা যায়। সুরঞ্জন এদিক ওদিক হাঁটে, দৌড়োয়। রাস্তায় একুশ বাইশ বছরের যে কোনও ছেলেকে দেখেই মনে হয় এই ছেলেই বোধহয় মায়াকে নিয়েছে, তার ভতর সংশয় জমা হয়। হতেই থাকে।

ইসলামপুরের এক মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে সে এক ঠোঙা মুড়ি কেনে। দোকানচঅলা তার দিকে আড়ে আড়ে তাকায়, সুরঞ্জনের মনে হয় এই লোকটিও বোধহয় জানে যে তার বোন অপহৃত। সে এলোমেলো হাঁটে, নয়াবাজারের ভাঙা মঠের ওপর বসে থাকে। কিছুক্ষে স্বস্তি পায় না। সুরঞ্জন। কারও বাড়িতে গেলে সেই বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ। সেদিন তো সেলিম বলেই বসল, তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙতে পারিস, আমরা মন্দির ভাঙলে ক্ষতি কী? সেলিম অবশ্য হাসতে হাসতে বলছিল, হেসেছে বলে সেলিমের মনে যে এই প্রশ্নটি কাজ করেনি তা নয়।

মায়া যদি এর মধ্যে বাড়ি ফেরে, ফিরতেও তো পারে। ধর্ষিতা হয়েও সে ফিরে আসুন তবু ফিরে তো আসুক। মায়া ফিরেছে, ফিরেছে এই ভাবনায় সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে, দেখে দুটো মানুষ চোখ কান নাক সজাগ রেখে বসে আছে নিম্পন্দ নিথর, মায়ার অপেক্ষায়। মায়া যে ফেরেনি। এর চেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম ভয়ঙ্কর সংবাদ আর কী আছে! বালিশে মুখ ডুবিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সুরঞ্জন। ওঘর থেকে সুধাময়ের গোঙানোর শব্দ আসে। রাতের স্তব্ধতা ফুঁড়ে বিঝির ডাকের মত ভেসে আসা কিরণময়ীর মিহি কান্না সুরঞ্জনকে একফোঁটা ঘুমোতে দেয় না। তার চেয়ে যদি বিষ পাওয়া যেত, তিনজনই খেয়ে মরে যেতে পারত। কষ্টগুলো এভাবে ফালি ফালি কাটত না তাদের। কী দরকার বেঁচে থেকে? হিন্দু হয়ে এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ হয় না।

সেরেব্রাল থ্রমবসিস বা এমবলিসম জাতীয় কিছু ঘটেছে সুধাময় অনুমান করেন। যদি হেমোরেজ হত নির্ঘাত মরে যেতেন। মরে গেলে খুব কি মন্দ হত? সুধাময় মনে-মনে বড় একটি হেমোরেজ। আশা করছেন। তিনি তো অর্ধেক মৃতই ছিলেন, নিজের বিনিময়ে যদি মায়া অন্তত বাঁচতে পারত। বড় বেঁচে থাকবার শখ ছিল মেয়েটির। একা একই পােরন্সলর বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাঁর অসুস্থতাই তার অপহরণের জন্য দায়ী। অপরাধের ঘুণ প্ৰামায়কে কুরে খায়। বারবার তাঁর ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। তিনি কিরণময়ীকে একক্স স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়ান। নেই, কেউ নেই। সুরঞ্জনও কাছে নেই, মায়া * তাঁর জল খেতে ইচ্ছে করে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে জিভ, আলজিভ, কণ্ঠদেশ।

কিরণময়ীকেও তিনি কম কষ্ট দেননি। পুজো করবার অভ্যোস ছিল কিরুণাময়ীর। বিয়ের পরই সুধাময় জানিয়ে দেন এ বাড়িতে পুজোটুজো চলবে না। কিরণময়ী গান গাইতে জানতেন ভাল, লোকে বলত বেহায়া বেশিরম মেয়ে, হিন্দু মেয়েদের লজ্জা-শরম নেই এই সব কটাক্ষ কিরণময়ীকে অস্বস্তিতে ফেলত। নিজেকে সংযত করতে করতে কিরকময়ী গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন। এই যে তিনি গান ছাড়লেন, সুধাময় আর কতটুকুছ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়ত তিনিও এরকম ভাবতেন লোকে যখন মন্দ বলৱ তখন কী আর করা। একুশ বছর তিনি কিরণময়ীকে পাশে নিয়ে শুয়েছেন। কেন্ম শুয়েছেনই। কিরণময়ীর সতীত্বকে আগলে রেখেছেন। কি দরকার ছিল তাঁর স্ত্রীর সতী উপভোগ করবার? এও তো এক ধরনের পারভারশান। শাড়ি গয়নার দিকেও কিক্সমবায়ীর তেমন আকর্ষণ ছিল না। কখনও তিনি বলেননি ওই শাড়িটি চাই, বা একজাড়া ইয়ারিং দরকার। সুধাময় প্রায়ই বলতেন-কিরণময়ী, তুমি কি মনে কোনও কষ্ট লুকিয়ে রাখা?

কিরণময়ী বলতেন–না তো। আমার এই সংসারেই আমার স্বপ্ন সুখ সব। নিজের জন্য আমি আলাদা করে কোনও আনন্দ চাই না।

সুধাময়ের মেয়ের শখ ছিল। সুরঞ্জনের জন্মের আগে কিরণময়ীর পেটে স্টেথেসকোপ লাগিয়ে বলতেন—আমার মেয়ের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি কিরণময়ী। তুমি শুনবে?

সুধাময় বলতেন— বাপ মা’কে শেষ বয়সে মেয়েরাই দেখে। ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। মেয়েরাই স্বামী সংসার ফেলে বাপ মায়ের যত্ন করে। আমি তো হাসপাতালে থাকি, দেখি। অসুস্থ বাপ মা’র শিয়রে বসে আছে মেয়েরা। ছেলে আছে, অতিথির মত দেখতে হয়ত আসে, এর বেশি না।

স্টেথোর নল কিরণময়ীর কানে লাগিয়ে তিনি তাঁকেও শোনাতেন হৃদপিণ্ডের লাবড়াব শব্দ। জগতসুদ্ধ সবাই পুত্ৰ চায়, আর সুধাময় চাইতেন কন্যা। ছোটবেলায় সুরঞ্জনকে ফ্রক পরিয়ে সুধাময় বেড়াতে নিতেন। মায়া জন্ম নেবার পর সুধাময়ের আশা পূরণ হল। ‘মায়া’ নামটি সুধাময় নিজেই রেখেছিলেন, বলেছিলেন—এ আমার মায়ের নাম। আমার এক মা গেছেন, আরেক মা এলেন।

রাতে মায়াই সুধাময়কে ওষুধ খাইয়ে দিত। ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। কখন। তিনি ‘মায়া মায়া’ বলে তাঁর প্রিয় কন্যাকে ডাকেন। পড়শিরা ঘুমিয়ে গেছে সব। তাঁর ডাকটি জেগে থাকা কিরণময়ী শোনেন, সুরঞ্জন শোনে, সাদা কালো বেড়ালটিও শোনে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress