রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – হনুমানের গন্ধমাদন পর্ব্বত লইয়া লঙ্কা-যাত্রা
পুনর্ব্বার হনু যায় সে গন্ধমাদন।
ঔষধ খুঁজিয়া ঘুরে পবন-নন্দন।।
পর্ব্বতে গন্ধর্ব্বগণ আছয়ে হরিষে।
নিত্য করে নৃত্যগীত স্ত্রী আর পুরুষে।।
গন্ধর্ব্বের নারীগণ পরমা রূপসী।
কেহ দেয় করতালি কেহ বাজায় বাঁশী।।
গীত বাদ্য রঙ্গরসে আছে আনন্দিত।
হেনকালে পবন-নন্দন উপস্থিত।।
হনুমানে দেখি সবে চমকিত মন।
করযোড়ে কহে কথা পবন-নন্দন।।
কে তোমরা গীত বাদ্য কর নিশাকালে।
নিবেদন করি কিছু শুনহ সকলে।।
পিতৃসত্য পালিতে শ্রীরাম আসে বন।
সঙ্গেতে জানকীদেবী অনুজ লক্ষ্মণ।।
রাবণ রাক্ষস-রাজ লঙ্কা-অধিকারী।
দণ্ডক-কাননে রামের সীতা কৈল চুরি।।
রঘুনাথ করেছেন সাগর বন্ধন।
হতেছে বিষম যুদ্ধ শ্রীরাম রাবণ।।
শক্তিশেলে পড়েছেন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
আমি আসি ঔষধ করিতে অন্বেষণ।।
ফিরে যাব লঙ্কাপুরে থাকিতে রজনী।
ঔষধ চিনায়ে দেহ বিশল্যকরণী।।
কুপিল গন্ধর্ব্ব সবে, কি বলে বানর।
কাহার নফর বেটা কাহার কিঙ্কর।।
হাহা হুহু মহারাজ এই মাত্র জানি।
কোথাকার রাম তারে কখন না চিনি।।
আসিয়া বানর বেটা কোন্ কার্য্যে ফিরে।
চুলেতে ধরিয়া সবে বেড়া কীল মারে।।
হস্ত তুলি হনু করে দেবগণে সাক্ষী।
মারিব গন্ধর্ব্ব সব, কার বাপে রাখি।।
কোপে হনুমান হৈল পর্ব্বত আকার।
চড় চাপড়েতে বীর করে মহামার।।
লাফে লাফে মারে সবে আছাড়ি আছাড়ি।
পড়িয়া গন্ধর্ব্ব সব যায় গড়াগড়ি।।
হাহা হুহু রাজা আসে চড়ি দিব্য-রথে।
হনুমানে মারিতে বেড়িল চারিভিতে।।
এক রাজ্যে দুই রাজা হাহা হুহু নাম।
হনুমান কাছে এল করিতে সংগ্রাম।।
লাফ দিয়া রথে গিয়া চড়ে হনুমান।
দুজনার ধনুক ধরিয়া দিল টান।।
কাড়িল যে দুজনার ধনুক দুই খান।
কোপে হনুমান হৈল শমন সমান।।
হাঁটুর উপরে রেখে দুই ধনুক ভাঙ্গে।
মালসাট দিয়া দাঁড়াইল সবা আগে।।
কুপিল যে হনুমান সংগ্রামের শূর।
কীল মেরে গন্ধর্ব্বের মাথা কৈল চূর।।
হনুমান একলা গন্ধর্ব্ব বহু দেখি।
হনুমান অঙ্গে সবে মারয়ে মুটকি।।
মনে ভাবে হনুমান রাত্রি বয়ে যায়।
গন্ধর্ব্ব মারিয়া কিবা হবে ফলোদয়।।
ঔষধ না পায় হনু ভাবে মনে মন।
শিখরে শিখরে ভ্রমে পবন-নন্দন।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া করে সাহসেতে ভর।
ডালে মূলে নিয়ে যাব পর্ব্বত শিখর।।
চৌষট্টি যোজন সেই গিরিবর খান।
একটানে উপাড়িল বীর হনুমান।।
দুই হাতে ধরিয়া পর্ব্বতে দিল নাড়া।
চৌষট্টি যোজন উঠে পর্ব্বতের গোড়া।।
বহু বৃক্ষ ভাঙ্গিল ছিঁড়িল লতা পাতা।
কোথাকার বৃক্ষশাপা পড়ে গেল কোথা।।
নানা জাতি সর্প পলায় শিরে মণি জ্বলে।
পর্ব্বত লইয়া উঠে গগন-মণ্ডলে।।
মাথায় পর্ব্বত তুলে নিল-হনুমান।
তুলে দিলে পারে বুঝি আর একখান।।
পর্ব্বত লইয়া চলে দক্ষিণ মুখেতে।
ভরতে প্রশংসে রাম পড়িল মনেতে।।
মারিলাম কালনেমী মায়ার পুত্তলি।
কুম্ভীরিণী মারি মুক্ত কৈনু গন্ধকালী।।
তিন কোটি গন্ধর্ব্বের মারিনু সকল।
রামের ভাই ভরতের বুঝে যাব বল।।
এতেক ভাবিয়া হনুমান হরষিত।
নন্দীগ্রামে আসিয়া হৈল উপনীত।।
পর্ব্বত লইয়া বীর দক্ষিণেতে যায়।
পর্ব্বত কন্দর নদী অনেক এড়ায়।।
না দেখে চন্দ্রের তেজ দিবা না প্রকাশে।
দক্ষিণেতে এড়াইল পর্ব্বত কৈলাসে।।
বামভিতে এড়াইল নগর বিস্তর।
অবিলম্বে উপনীত অযোধ্যা-নগর।।
রাজ্যপাট ছেড়ে ভরত নন্দীগ্রামে বৈসে।
হনুমান চলে নন্দীগ্রামের উদ্দেশে।।
নন্দীগ্রামে বৃক্ষ আদি দেখিল বিস্তর।
ছাড়াইয়া প্রবেশিল নগর ভিতর।।
সুমন্ত্র সারথি আর বশিষ্ঠ পুরোহিত।
বসিয়াছে ভরত যে পাত্রেতে বেষ্টিত।।
সিংহাসন উপরে পাদুকা বেড়া নেতে।
শ্বেত-চামর ব্যজন করিছে চারিভিতে।।
স্বর্ণ-সিংহাসন যেন শশধর-জ্যোতি।
তাহাতে পাদুকা রেখে ধরে দণ্ড-ছাতি।।
রত্নময় আসনে পাদুকা শোভা পায়।
আপনি ভরত শ্বেত-চামর ঢুলায়।।
রামের পাদুকা যত্নে সিংহাসনে থুয়ে।
স্বর্ণ-সিংহাসন যেন শশধর-জ্যোতি।।
তাহাতে পাদুকা রেখে ধরে দণ্ড-ছাতি।
রত্নময় আসনে পাদুকা শোভা পায়।
আপনি ভরত শ্বেত চামর ঢুলায়।।
রামের পাদুকা যত্নে সিংহাসনে থুয়ে।
ধরাসনে রয়েছেন ভরত বসিয়ে।।
পর্ব্বত লইয়া যায় পবন-কুমার।
অন্তরীক্ষে থাকি দেখে যত ব্যবহার।।
পর্ব্বত ছায়াতে দেশ হৈল অন্ধকার।
সভা সহ ভরতের লাগে চমৎকার।।
না দেখি চন্দ্রের তেজ অন্ধকারময়।
রামের পাদুকা লঙ্ঘে, নাহি করে ভয়।।
ভরত বলেন রাত্রে কার আগুসার।
রামের পাদুকা লঙ্ঘে এত অহঙ্কার।।
মহাবুদ্ধিমান ভরত বিক্রমে সুস্থির।
একদৃষ্টে চাহেন ভরত মহাবীর।।
শত্রুঘ্নও কোপ করি ঊর্দ্ধদৃষ্টে চান।
কোথাও আকাশ-পথে না হয় সন্ধান।।
শিশুকালে শত্রুঘন করিতেন কেলি।
খেলার বাঁটুল পড়ে আছে কতকগুলি।।
লোহার নির্ম্মিত বাঁটুল আশী লক্ষ মণ।
ভরতের হাতে তুলে দিলেন শত্রুঘ্ন।।
মনে ভাবে ভরত বাঁটুল লয়ে হাতে।
বিশেষ না জানি কেবা যায় শূন্যপথে।।
শত্রুঘ্ন বলে ভাই পাখী হেন দেখি।
খাইতে যজ্ঞের ধূম এল কোন পাখী।।
ভরত বলেন ভাই এত কেন ভয়।
পক্ষী যক্ষ রক্ষ ও গন্ধর্ব্ব যদি হয়।।
বাঁটুল মারিয়া শাস্তি করিব তাহারি।
রামের পাদুকা যেবা লঙ্ঘে তারে মারি।।
এইরূপে বিস্তর করিয়া অনুমান।
পক্ষী বটে বলি ভরত পূরিল সন্ধান।।
আশী লক্ষ মণ বাঁটুল ধনুর্গুণে যুড়ি।
জয় রাম বলিয়া বাঁটুল দিল ছাড়ি।।
ভরতের বাঁটুল সে অব্যর্থ সন্ধান।
হনুরে বাজিল লক্ষ ব্রজের সমান।।
পদের তালুকা ভাগে বাজিল বাঁটুল।
মূর্চ্ছিত হইয়া বীর বুদ্ধি হলো ভুল।।
নিস্তেজ হইল বীর শক্তি নাহি আর।
অন্তরীক্ষে ঘুরে বুলে পবন-কুমার।।
বাঁটুলে মূর্চ্ছিত হনু চক্ষে নাহি দেখে।
মুখে রক্ত উঠে তার ঝলকে ঝলকে।।
হতজ্ঞান হয়ে পড়ে পবন-নন্দন।
তবু নাহি ছাড়ে সূর্য্য ও গন্ধমাদন।।
ভূমে পড়ে করে হনু শ্রীরাম স্মরণ।
মস্তকে পর্ব্বত আছে ঘূর্ণিত লোচন।।
রাম নাম শুনি এল ভরত শত্রুঘ্ন।
হনুর নিকটে এল ভাই দুই জন।।
ভরত বলেন, কপি থাক কোন্ স্থান।
রাম যে স্মরিলে রামের কি জান সন্ধান।।
কোথা হৈতে আইলে কে কহ বিবরণ।
জান কোথা রাম সীতা কোথায় লক্ষ্মণ।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা গিয়াছেন বনে।
দেখা কি হয়েছে তব রাম সীতা সনে।।
বাক্য নাহি সরে হনু ব্যথায় আকুল।
বজ্রসম বাজিয়াছে বিষম বাঁটুল।।
সভা ছাড়ে বশিষ্ট আইল সেই স্থানে।
হনুরে সবল কৈল মন্ত্র ব্রহ্মজ্ঞানে।।
যোগেতে সকল কথা বশিষ্ঠ গোচর।
মুনি জানে যত কর্ম্ম লঙ্কার ভিতর।।
লোকাচারে প্রকাশ না কৈল মহামুনি।
ভরতের প্রতি কন সচাতুরী বাণী।।
মুনি বলে, ভরত এমন বুদ্ধি কেনে।
কি কার্য্য সাধন কৈলে মারি হনুমানে।।
পরম ধার্ম্মিক দেখি বানর-প্রধান।
রামের বৃত্তান্ত জানে পবন-সন্তান।।
বশিষ্ঠের মন্ত্রে হনুর দূর হৈল ব্যথা।
ভরত-সম্মুখে কহে শ্রীরামের কথা।।
অবধান ঠাকুর ভরত শত্রুঘন।
রাম লক্ষ্মণ সীতার শুন বিবরণ।।
বাসা করেছিলা রাম পঞ্চবটী-বনে।
সূর্পণখার নাক কান কাটেন লক্ষ্মণে।।
রাবণের ভগ্নী সূর্পণখা সে রাক্ষসী।
যুদ্ধ কৈল চৌদ্দ হাজার নিশাচর আসি।।
সবারে মারেন রাম দণ্ডক-কাননে।
পুরে যোগীবেশে সীতা হরিল রাবণে।।
সুগ্রীবেরে সঙ্গে রাম করিল মিত্রতা।
বালি মারি সুগ্রীবের দেন দণ্ড-ছাতা।।
বানর লইয়া রাম বান্ধিলা সাগর।
মিলিল অসংখ্য কপি অতি ভয়ঙ্কর।।
বাইশ অঙ্কেতে এক মহা অক্ষৌহিণী।
ইহার অধিক কপি গণিতে না জানি।।
রাক্ষস-বানরে যুদ্ধ হইল অপার।
তিন মাস রাত্রি দিবা যুদ্ধ মহামার।।
কভু হারে প্রভু জিনে তিন মাস যুঝে।
রাক্ষসের সে মায়া কাহার সাধ্য বুঝে।।
রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিৎ করে রণ।
নাগপাশে বান্ধিলেক শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে বান্ধি বৈরিগণ হাসে।
গরুড় আসিয়া মুক্ত কৈল নাগপাশে।।
মুক্ত যদি হলো নাগপামের বন্ধন।
অতিকায় ইন্দ্রজিতে মারিলা লক্ষ্মণ।।
কুপিয়া রাবণ রাজা সন্ধিহিল রণে।
ময়দানবের শেল মারিল লক্ষ্মণে।।
লক্ষ্মণে করিয়া কোলে রামের ক্রন্দন।
আমারে পাঠায়ে দেন ঔষধ কারণ।।
ঔষধ চিনিতে নাহি পারি কোনমতে।
উপাড়িয়া লয়ে যাই পর্ব্বত সমেতে।।
আমি গেলে লক্ষ্মণের বাঁচিলেক প্রাণ।
তোমার প্রহারে আমি হারাইনু জ্ঞান।।
নিস্তেজ হইনু আমি বাঁটুলে তোমার।
পর্ব্বত তুলিতে শক্তি নাহিক আমার।।
তুমি রাজ্য নিলে হে, রাবণ নিল নারী।
লক্ষ্মণ ত্যজিবে প্রাণ পোহালে শর্ব্বরী।।
তোমার প্রশংসা রাম করেন সদাই।
সর্ব্বদা চিন্তেন রাম তোমা দুই ভাই।।
দিবা নিশি সুমঙ্গল ভাবেন দোঁহার।
রাম সঙ্গে বৈরীভাব দেখি যে তোমার।।
আমারে মারিয়ে তব এই হৈল লাভ।
প্রকাশ হইল রাম সঙ্গে বৈরভাব।।
লঙ্কার বৃত্তান্ত তুমি না জান ভরত।
সকলেতে আমার চাহিয়া আছে পথ।।
ফিরিয়া যাইতে শক্তি না হয় আমার।
সহজেতে না হইবে সীতার উদ্ধার।।
লক্ষ্মণের শোকে রাম প্রবেশিবে বন।
নিষ্কণ্টকে রাজ্যভোগ কর দুই জন।।
এতেক বলিল যদি পবন-নন্দন।
ধরাতলে পড়ি কান্দে ভরত শত্রুঘ্ন।।
শোকাকুল কান্দে দোঁহে ভূমিতলে পড়ে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা বলে ডাক ছাড়ে।।
আমরা থাকিতে কেন এতেক দুর্গতি।
কটাক্ষে মারিতে পারি লঙ্কা-অধিপতি।।
ভরত বলেন, শুন বীর হনুমান।
ত্বরিতে পর্ব্বত লয়ে করহ পয়াণ।।
আমিহ তোমার সঙ্গে যাই লঙ্কাপুরে।
থাকুক ভাই শত্রুঘ্ন অযোধ্যা-নগরে।।
হনুমান বলে, তুমি যাইবে কি মতে।
শ্রীরামের আজ্ঞা নাই তোমা লয়ে যেতে।।
ভরত বলেন তবে শুনহ মারুতি।
পর্ব্বত লইয়া তুলি যাহ শীঘ্রগতি।।
হনুমান বলে, গিরি নাড়িতে না পারি।
বলহীন হইয়াছি বল না কি করি।।
যোজনেক উচ্চে যদি পার তুলে দিতে।
তবে আমি পারি এ পর্ব্বত লয়ে যেতে।।
শত্রুঘ্ন কহিতেছেন হনুমান আগে।
পর্ব্বত তুলিয়া দিতে কোন্ ভার লাগে।।
শত্রুঘ্ন আনিয়া দিল ধনু একখান।
গুণ দিয়া ভরত যুড়িল তাহে বাণ।।
ভরত বলেন বাছা পবন-কুমার।
পর্ব্বত সহিত উঠ বাণেতে আমার।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ এড়িল ভরত।
হনুমান সহ শূন্যে উঠিল পর্ব্বত।।
ঊর্দ্ধে তুলে দিল বাণে শতেক যোজন।
ভরতের বিক্রম বাখানে হনুমান।।
ভরত বড়ই বীর ভাবে হনুমান।
আমা সহ বাণেতে তুলিল গিরিখান।।
হইয়ে সাগর পার চলে বায়ুবেগে।
রাখিল পর্ব্বত লয়ে সবাকার আগে।।