রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – ইন্দ্রজিতের তৃতীয়বার যুদ্ধে গমন
ভগ্নদূত কহে গিয়া রাবণ গোচর।
বীরবাহু পড়ে বার্ত্তা শুন লঙ্কেশ্বর।।
শোকের উপরে শোক হইল তখন।
সিংহাসন হৈতে পড়ে রাজা দশানন।।
চেতন পাইয়া রাজা কান্দিল বিস্তর।
লঙ্কাতে হইল কাল নর ও বানর।।
কুম্ভকর্ণ আদি করি বড় বড় বীর।
নর-বানরের বাণে ত্যজিল শরীর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল জিনিনু ত্রিভুবন।
নর-বানরের হাতে সংশয় জীবন।।
একে একে পাঠালাম যত যত বীরে।
সংগ্রামেতে গেল আর না আইল ফিরে।।
মকরাক্ষ অতিকায় বীর অকম্পন।
মহোদর মহাপাশ যত যত জন।।
ত্রিভুবন জিনিয়াছি যে সব সহায়ে।
কোথা গেল বীরগণ আমারে ত্যজিয়ে।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ আদি আর।
আশঙ্কাতে না আসিত লঙ্কাতে আমার।।
এখন বানর নরে দর্প করে চূর্ণ।
কোথা মহোদর, কোথা ভাই কুম্ভকর্ণ।।
ভাবিতে ভাবিতে রাজা হইল মূর্চ্ছিত।
হেনকালে আইল কুমার ইন্দ্রজিৎ।।
বাপের অবস্থা দেখি হইল অস্থির।
বয়ান বহিয়া পড়ে নয়নের নীর।।
মেঘনাদ বলে, পিতা ভাবি তাই মনে।
নিস্তার না দেখি নর-বানরের রণে।।
লুকাইয়া থাকিলে আগুন দেয় ঘরে।
মরি বাঁচি বারেক দেখিব যুদ্ধ করে।।
রাবণ বলে যুদ্ধে যাওয়া তোমার উচিত।
একবার যাহ পুনঃ পুত্র ইন্দ্রজিৎ।।
বড় বড় বীর পাঠাই, বড় ভাবি মনে।
ফিরিয়া না আসে কেহ রাম-দরশনে।।
যতবার তুমি যাহ যুঝিবার তরে।
সংগ্রাম করিয়া জয় এস বারে বারে।।
রাম লক্ষ্মণেরে বেঁধেছিলে নাগপাশে।
মরিয়া জীয়ন্ত হইল গরুড়-নিঃশ্বাসে।।
দশদিক চাপি কৈলে বাণ বরিষণ।
বানর কটক মরে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
ভাগ্যে ভৃত্য ছিল তার কপি হনুমান।
ঔষধ আনিয়া সবার দিল প্রাণদান।।
তোমার সংগ্রামে কারো নাহিক নিস্তার।
এবারে মারিলে তারে কে বাঁচাবে আর।।
আরবার গিয়া আজি রণে দেহ হানা।
বাহুড়িয়া যেন নাহি ফিরে এক জনা।।
বাপের বচনে ঘেমনাদ সচিন্তিত।
যোড়হাত করিয়া বলিছে ইন্দ্রজিৎ।।
বারে বারে মারিলাম শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
কোথা শুনিয়াছ মড়া পেয়েছে জীবন।।
মরিয়ে না মরে রাম একি চমৎকার।
কেমনে এমন রিপু করিব সংহার।।
মেঘনাদ-কথা শুনি কহিছে রাবণ।
আগেতে মারহ পুত্র পবন-নন্দন।।
সেই বেটা দেয় সবাকার প্রাণদান।
আর কে বাঁচাবে বল মৈলে হনুমান।।
আগে যদি তুমি তারে করিতে নিধন।
তবে আর ঔষধ আনিত কোন্ জন।।
পিতৃ-আজ্ঞা মেঘনাদ লঙ্ঘিতে না পারে।
কটক লইয়া তবে নড়ে যুঝিবারে।।
সংগ্রামেতে সাজিল কুমার ইন্দ্রজিৎ।
অসংখ্য কটক ঠাট চলিল ত্বরিত।।
যাত্রা করি মেঘনাদ রথে গিয়া চড়ে।
মন্দোদরী মায়েরে মনে তখন পড়ে।।
মাতা সম্ভাষিতে গেলে হইবে বিরোধ।
যুঝিবারে যাব আমি পিতৃ-অনুরোধ।।
সংগ্রাম জিনিয়া আমি যদি আসি ঘরে।
কহিব সকল কথা মায়ের গোচরে।।
উদ্দেশে মায়ের পদে করি নমস্কার।
ফিরে যদি আসি দেখা করিব আবার।।
যজ্ঞস্থানে চলিল কুমার ইন্দ্রজিৎ।
যজ্ঞের সামস্রী সব আনিল ত্বরিত।।
রক্তপাট ভারে ভার সুরক্ত চন্দন।
রক্ত কুসুমমাল্য আর আরক্ত বসন।।
শরপত্র বোঝা বোঝা ঘৃতের কলস।
কালো ছাগ পালে পালে বহিছে রাক্ষস।।
শরপত্র বিধিমতে করিল বিছানি।
মন্ত্র পড়ি যজ্ঞস্থলে জ্বালিল আগুনি।।
খরশান খড়্গে ছাগ কাটি শীঘ্রগতি।
অগ্নি সমর্পণ করি দিতেছে আহুতি।।
আতপ তণ্ডুল যব রাশি রাশি আনে।
ঘৃতের আহুতি সব দিতেছে আগুনে।।
রক্তবর্ণ পুষ্পমাল্য ডুবাইয়া ঘৃতে।
দশ হাজার বিপ্র বেদ পড়ে চারিভিতে।।
অগ্নির বিষম শব্দ মেঘের গর্জ্জন।
সে অগ্নির তেজ গিয়া ঠেকিল গগন।।
দক্ষিণদিকেতে গেল আগুনের শিখা।
মূর্ত্তিমান হয়ে অগ্নি আসি দিল দেখা।।
সাক্ষাৎ হইয়া অগ্নি রহে বিদ্যমান।
রুষ্ট হয়ে অগ্নি নাহি লয় তার দান।।
অগ্নি বলে নিত্য পূজা কর কি কারণে।
কত বর আমি তোরে দিব রাত্রিদিনে।।
ইন্দ্রজিৎ বলে মোরে দেহ এই বর।
রাম-সৈন্য মারিয়া পাঠাই যমঘর।।
অগ্নি-বলে হেন বার চাহ অকারণ।
কেমনে মারিবি রামে তিনি নারায়ণ।।
স্বয়ং বিষ্ণু জন্মিলেন রাম-অবতার।
রাবণেরে সবংশেতে করিতে সংহার।।
মনুষ্য নহেন রাম স্বয়ং নারায়ণ।
অনুক্ষণ চাহি আমি তাঁহার চরণ।।
রামেরে মারিতে বর কেবা পারে দিতে।
আর যজ্ঞে আমারে না পাইবে দেখিতে।।
যখন মারিস তাঁরে বাঁচেন তখন।
এত দেখি তথাপি প্রতীত নহে মন।।
শুনিয়া অগ্নির কথা বেটা পায় ত্রাস।
রথে চড়ি ইন্দ্রজিৎ উঠিল আকাশ।।
অগ্নিদেব চলিলেন আপনার দেশ।
ইন্দ্রজিৎ রণে গিয়া করিল প্রবেশ।।
রথ সঞ্চারিয়া যায় উপর গগন।
পশ্চিম দ্বারেতে যথা শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
একবার যুড়িল সাতাইশ লক্ষ শর।
বিন্ধিয়া জর্জ্জর কৈল যতেক বানর।।
ঝঞ্ঝনার শব্দবৎ বাণশব্দ শুনি।
ইন্দ্রজিৎ বলি সবে করে কাণাকাণি।।
বানর-কটক বলে শুন রঘুনাথ।
এড়ান না যাবে আজি ইন্দ্রজিৎ-হাত।।
রাক্ষসের বাণেতে কাতর কপিগণ।
হেনকালে শ্রীরামেরে বলেন লক্ষ্মণ।।
ব্রহ্ম-অস্ত্র ছাড়, কর রাক্ষস সংহার।
পৃথিবীতে যেন নাহি থাকে রাক্ষস সঞ্চার।।
শ্রীরাম বলেন তুমি নির্ব্বোধ লক্ষ্মণ।
কোন্ অপরাধে বধি সবার জীবন।।
কোন্ দোষ করিল লঙ্কার যত নারী।
অপরাধ একের অন্যেরে কেন মারি।।
শুন ভাই আমার অস্ত্রের এই পণ।
মারিবে রাক্ষসগণে বিনা বিভীষণ।।
মেঘের উপরে যেন বিদ্যুৎ ঝলকে।
শোভিছে মুকুট ইন্দ্রজিতের মস্তকে।।
লক্ষ্মণ বলেন মেঘে যুঝে ইন্দ্রজিৎ।
মেঘ সনে বেটারে বিন্ধহ অলক্ষিত।।
শ্রীরাম বলেন যুদ্ধ দেখে দেবগণ।
কি জানি সংহারি পাছে দেবের জীবন।।
উভয়ের যুক্তি বেটা শুনিল আকাশে।
লঙ্কামধ্যে যজ্ঞস্থানে প্রবেশিল ত্রাসে।।