রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – অতিকায়ের যুদ্ধারম্ভ
পড়ে বীর পঞ্চজনা দেখিবারে পায়।
হাতে ধনু সংগ্রামে প্রবেশে অতিকায়।।
চিন্তা করি মনে মনে বলিছে তখন।
শ্রীচরণে স্থান দেহ কৌশল্যা-নন্দন।।
রাবণ-সন্তান বলে দয়া না করিবে।
দয়াময় রামনামে কলঙ্ক রটিবে।।
খুড়া দুইজন পড়ে, মহোদর আর।
রোষে অতিকায় বীর রাবণ-কুমার।।
মহাক্রোধে অতিকায় হয়ে আগুসার।
দিলেন আপন দিব্য-চাপেতে টঙ্কার।।
কিবা ঘোরতর সেই টঙ্কার নিঃস্বন।
তাহা শুনি মূর্চ্ছিত হইল কপিগণ।।
বড় বড় বীর যত ভল্লুক বানর।
তাহাদের বক্ষঃস্থল কাঁপে থর থর।।
তবে সেই রথে থাকি গভীর গর্জ্জনে।
কহিতেছে সম্বোধিয়া প্লবঙ্গমগণে।।
ওরে ওরে মহামুর্খ মর্কট সকল।
পলাও পলাও তোরা ছাড়ি রণস্থল।।
ত্রিভুবনে অতি খ্যাত অতিকায় নাম।
আসিয়াছি আমি আজি করিতে সংগ্রাম।।
আজি না রাখিব আমি ভুবন ভিতর।
আপন পিতার রিপু কপি কিংবা নর।।
তোরা কেন মর মোর সম্মুখে থাকিয়া।
হিত কহি প্রাণ লয়ে যাহ পলাইয়া।।
এত বলি সিংহনাদ করে ঘনে ঘন।
তাহে অতি ত্রাসিত হইল কপিগণ।।
আর তার অতিশয় ভয়ঙ্কর কায়।
দেখিয়া বানর সব ভয়েতে পলায়।।
কেহ কেহ সেতু দিয়া যায় সিন্ধুপারে।
কেহ প্রবেশয়ে বনে কেহ বলি-দ্বারে।।
কেহ কেহ সিন্ধুজলে থাকয়ে ডুবিয়া।
কেহ পত্র লতাদিতে গাত্র আচ্ছাদিয়া।।
কেহ কেহ প্রবেশয়ে বৃক্ষের কোটরে।
কেহ কেহ কুম্ভকর্ণ বদন-বিবরে।।
কেহ কেহ ভয়ে নিজে মৃত জানাবারে।
শয়ন করিয়া রহে শবের মাঝারে।।
কেহ কেহ শ্রীরামের নিকটে যাইয়া।
কহিতেছে অতিকায় বীরে দেখাইয়া।।
দেখ দেখ রঘুবর রণের ভিতর।
আসিয়াছে অতি বড় এক নিশাচর।।
উহারে দেখিবামাত্র যত কপিগণ।
ত্রাসিত হইয়া সবে করে পলায়ণ।।
কপিদের কথা শুনি শ্রীরঘুনন্দন।
অতিকায়ে দেখি হৈল সবিস্ময় মন।।
যদ্যপি প্রথম রণে দেখেছিলা তারে।
তথাপি বিস্ময় হৈল অন্তর মাঝারে।।
অলৌকিক পদার্থের এই ধর্ম্ম হয়।
দেখিলেও নব নব রূপে প্রকাশয়।।
তবে রঘুপতি নিজ মিতা বিভীষণে।
জিজ্ঞাসা করেন অতি মধুর বচনে।।
দেখ মিতা বিভীষণ, রণে এল কোনজন,
পর্ব্বত প্রমাণ রথে চাপি।
নিজেও ভূধর জিতি, শ্যামবর্ণ শিলাকৃতি,
অতি ভয়ঙ্কর ভূপ্রতাপী।।
মুকুট শোভয়ে শিরে, যেন নীল ধরাধরে,
সুবর্ণের শৃঙ্গ শোভা পায়।
পিঙ্গল নয়নদ্বয়, ভুজেতে অঙ্গদচয়,
গলে নানা আভরণ তায়।।
কিবা দেখি রথখান, দশ শত পরিমাণ,
ঘোটকেতে বহিতেছে যারে।
পঞ্চ সুসারথি যার, ধ্বজ নরমুণ্ডাকার,
পতাকা উড়িছে চারি ধারে।।
দেখি রথ উপরেতে, অস্ত্র শস্ত্র নানামতে,
শূল শেল মুষল মুদগর।
তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ ভিন্দিপাল, শত শত তরবাল,
কাঠার কুঠার বহুতর।।
অতিশয় ভয়ঙ্কর, লৌহময় বাণ খর,
অষ্টত্রিংশ তূণ শোভা করে।
স্বর্ণবদ্ধ সুশোভন, দিব্য দিব্য শরাসন,
চারিদিকে রহে থরে থরে।।
দশ হস্ত পরিমাণ, দুই পাশে দুই খান,
খড়্গ দুলিতেছে ভয়ঙ্কর।
ধরিয়াছে বাম করে, একখান ধনুকেরে,
ইন্দ্রধনু সম দীর্ঘতর।।
নিরখিয়া এইজনে, পলাইছে স্থানে স্থানে,
বানর সকল ভীত মনে।
কে বটে কাহার পৌত্র, কি নাম কাহার পুত্র,
কহ মিতা মম বিদ্যমানে।।