রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – কুম্ভকর্ণের যুদ্ধযাত্রা
কুম্ভকর্ণ বলে কিবা করেছ যন্ত্রণা।
তোমার সভাতে নাহি মন্ত্রী এক জনা।।
সমুদ্রের পারে কেন নাহি দিলে থানা।
তবে আর সাগর বান্ধিবে কোন্ জনা।।
ঘরেতে বসিয়া বড় দেখহ আপনা।
কোন্ ছার মন্ত্রী লয়ে তোমার মন্ত্রণা।।
আপনারে বড় দেখ বসে লঙ্কাপুরে।
বেড়িল এ হেন লঙ্কা বনের বানরে।।
বালি হৈতে সুগ্রীব যে নহে পরাক্রমে।
প্রবন্ধ করিয়া তবু জিনিল সংগ্রামে।।
পাইল অর্দ্ধেক রাজ্য মহারাণী তারা।
তোমা হৈতে বুদ্ধিমন্ত সুগ্রীব বানরা।।
এত যদি কুম্ভকর্ণ রাবণেরে বলে।
শুনিয়া রাবণরাজা অগ্নি হেন জ্বলে।।
কুড়ি চক্ষু রক্তবর্ণ কহে লঙ্কেশ্বর।
সদা থাক নিদ্রাগত ঘরের ভিতর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল জিনিলাম ত্রিভুবন।
দৈবের নির্ব্বন্ধ যাহা না হয় খণ্ডণ।।
কনিষ্ঠ নহিস্ যেন জ্যেষ্ঠ সহোদর।
রাজনীতি শিক্ষা দিস্ সভার ভিতর।।
কহিলে যে ভাল মন্দ অনেক কাহিনী।
পশ্চাতে বুঝিব সব বৈরী আগে জিনি।।
কুম্ভকর্ণ বলে, ভাই না বল বিস্তর।
বিপদ সময়ে নীতি কহে সহোদর।।
আমি হেন ভাই তব কারে কর শঙ্কা।
বৈরী মারি রাখিব কনকপুরী লঙ্কা।।
শ্রীরামের মাথা কাটি তোমারে দিব ডালি।
সীতা লয়ে চিরদিন সুখে কর কেলি।।
আগে লঙ্কা অরামা ও অবানরা করি।
সুগ্রীবের মারিয়া পাঠাব যমপুরী।।
বধিব কুমুদ আদি যত কপিগণ।
মারিব তোমার বৈরী ভাই বিভীষণ।।
হনুমানে মারি আজি লঙ্কাপুরী-বৈরী।
মারিব তাহার পর বানর কেশরী।।
চলিল সে কুম্ভকর্ণ যুঝিবার সাধে।
ভাই মহোদর গিয়া সম্মুখে বিরোধে।।
মহোদর বলে ভাই করি নিবেদন।
বহুদিন নিদ্রাগত ছিলে অচেতন।।
দেখিতে করয়ে সাধ পুরবাসী-নারী।
একবার দেখা দিতে চল অন্তঃপুরী।।
কুম্ভকর্ণ বলে, কি কহিস্ মহোদর।
সম্মুখে বিপক্ষ বসে যমের দোসর।।
চারি দ্বার মেরে আগে জিনে আসি রণ।
তবে অন্তঃপুরে হবে আমার গমন।।
মহোদর কুম্ভকর্ণ কথা দুই জনে।
সিংহাসন ছাড়ি তবে উঠিল রাবণে।।
সংগ্রামের সাজ রাজা সাজায় আপনি।
পরায় মতির পাগ থরে থরে মণি।।
কুম্ভকর্ণ সাজিয়ে রাক্ষস পুলকিত।
চারিদিকে নিশাচর সাজয়ে ত্বরিত।।
কুমারের চাক যেন মাণিক-অঙ্গরী।
কুম্ভকর্ণের আঙ্গুলে পরায় যত্ন করি।।
কতমত যতনে পরায় তোড় তাড়।
মাথার মুকুট যেন মৈনাক পাহাড়।।
স্থানে স্থানে মরকত শোভা কত তার।
গলায় তুলিয়া দিল মণিময় হার।।
রত্নেতে নির্ম্মিত দিল শ্রবণে কুণ্ডল।
রবি শশী জিনি জ্যোতি করে ঝলমল।।
মুকুটের চূড়া গিয়া আকাশেতে যোড়ে।
রাজারে প্রণাম করি যুঝিবারে নড়ে।।
যুঝিবারে কুম্ভকর্ণ চলে একেশ্বর।
গগনে মস্তক যেন নব জলধর।।
আকাশের চন্দ্র খসে, বায়ু মন্দগতি।
মেঘে রক্ত বরিষয় কাঁপে বসুমতী।।
আকাশে অমর কাঁপে সাগর উথলে।
গড়ের বাহির হয়ে যুঝিবারে চলে।।
কুম্ভকর্ণ হৈল যদি গড়ের বাহির।
বানর দেখিয়া করে গর্জ্জন গভীর।।
বড় বড় কপিগণের বড় বড় লম্ফ।
কুম্ভকর্ণে দেখিয়া সবার হৈল কম্প।।
ভয়ে শুখাইল মুখ কাঁপিল অন্তর।
গাছ পাথর ফেলাইয়া পলায় বানর।।
চুল নাহি বান্ধে কেহ না পরে কাপড়।
বড় বড় বানর উঠিয়া দিল রড়।।
বানরের ভঙ্গরবে কর্ণে লাগে তালি।
শত কোটি বানরে পলায় শতবলী।।
হিঙ্গুলিয়া বানর হিঙ্গুল জিনি অঙ্গ।
আশী কোটি বানরে পলায় শরভঙ্গ।।
মলয় পর্ব্বতের বানর বর্ণ যেন গৌরি।
ছত্রিশ কোটি বানরেতে পলায় কেশরী।।
গয় গবাক্ষ পলাইল ভাই দুই জন।
বানর পঞ্চাশ কোটি দোঁহার ভিড়ন।।
আশী কেটি বানরে পলায় হনুমান।
ভল্লুক কটকে পলায় মন্ত্রী জাম্ববান।।
পলায় সুষেণবেজ রাজার শ্বশুর।
তিন কোটি বৃন্দ ঠাট যাহার প্রচুর।।