রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – রাবণের প্রথম দিবস যুদ্ধে গমন
প্রহস্ত পড়িল রণে শুন লঙ্কেশ্বর।
রাবণ বলে কাল হলো নর ও বানর।।
রাবণ বলিলা, যেন ধনু ধর্ত্তে জানে।
ছোট বড় রাক্ষস চলুক মোর সনে।।
সেনাপতি পড়িল রাজ্যের চূড়ামণি।
আর কারে পাঠাইব যাইব আপনি।।
ছত্রিশ কোটি রাবণের মুখ্য সেনাপতি।
সাজিয়া চলিল সবে রাবণ সংহতি।।
ভাই ভাইপো আদি কুমার ভাগ নড়ে।
হাতী ঘোড়া ঠাট সৈন্য নড়ে মুড়ে মুড়ে।।
যুঝিবার তরে নড়ে রাজা সে রাবণ।
সর্ব্বাঙ্গে ভূষিত করে রাজ-আভরণ।।
মেঘের চপলা যেন গলায় উত্তরী।
মৃগমদ লেপিলেক সুগন্ধি কস্তূরী।।
দশ ভালে দশ মণি করে ঝলমল।
চন্দ্র সূর্য্য জিনি শোভা কর্ণের কুণ্ডল।।
রাবণের রথখান সাজায় সারথি।
নানা রত্ন মণি মুক্তা সাজাইল তথি।।
কনকে রচিত রথ মাণিক্যের চাকা।
রত্নে, কলসে সাজে নেতের পতাকা।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ রথ সাজায় সুন্দর।
রথের উপরে উঠে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
খাণ্ডা টাঙ্গী শেল শূল মুষল মুদগর।
নানা জাতি অস্ত্র তুলে রথের উপর।।
গদা শাবল লয় কেহ কাছেতে কামান।
বিচিত্র নির্ম্মাণ করে লয় ধনুর্ব্বাণ।।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কটক চলে মুড়ে মুড়ে।
বিংশতি যোজন পথ সৈন্য আড়ে যোড়ে।।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী।
রাবণের বাদ্যভাণ্ড সাত অক্ষৌহিণী।।
এক লক্ষ দগড় দুলক্ষ করতাল।
দু-সহস্র ঘন্টা বাজে মৃদঙ্গ বিশাল।।
ভেউরী ঝাঁঝরী বাজে তিন লক্ষ কাড়া।
চারি লক্ষ জয়ঢাক ছয় লক্ষ পড়া।।
বাজিল চৌরাশী লক্ষ শঙ্খ আর বীণে।
তিন লক্ষ তাসা বাজে দামামার সনে।।
ঢেমচা খেমচা বাজে দুই লক্ষ ঢোল।
তিন লক্ষ পাখোয়াজ বিস্তর মাদল।।
জয়ঢাক রামকাড়া বাজে জগঝম্প।
পাখোয়াজ তবলা বাজে ত্রিভুবনে কম্প।।
বাজিল রাক্ষসী ঢাক পঞ্চাশ হাজার।
দুন্দুভি ডম্বরু শিঙ্গা সংখ্যা করা ভার।।
খঞ্জনী খমক বাজে সেতারা তবোল।
প্রলয়ের কালে যেন উঠে গণ্ডগোল।।
তুরী ভেরী রণশিক্ষা বারো লক্ষ বাঁশী।
দগড়ে রগড় দিতে দশ লক্ষ কাঁসী।।
টিকারা টঙ্কার আর চৌতাল মোচঙ্গ।
বাদ্য শুনে বানরের বেড়ে গেল রঙ্গ।।
তিন কোটি বৃন্দ ঠাটে সাজিল রাবণ।
শত কোটি রবি জিনি রথের কিরণ।।
রত্নময় কলসে পতাকা সারি সারি।
সংগ্রামেতে সাজিল লঙ্কার অধিকারী।।
রাবণ করিল যদি রথে আরোহণ।
ভয় পেয়ে মন্দ বায়ু বহিছে পবন।।
রবি হৈল মন্দ-তেজ চাপিয়া কিরণ।
সশঙ্কিত স্বর্গের সকল দেবগণ।।
ধনুক ধরিতে জানে যত নিশাচর।
রাবণের সঙ্গে চলে করিতে সমর।।
রাক্ষসের সিংহনাদ ধনুক টঙ্কার।
পশ্চিম দ্বারেতে যায় করি মার মার।।
মণিময় মুকুট শোভিছে দশ মাথে।
ত্রিভুবন বিজয়ী ধনুক বাণ হাতে।।
সৈন্য দেখে দশানন দাণ্ডাইয়া রথে।
বিভীষণে জিজ্ঞাসা করেন রঘুনাথে।।
শত কোটি রবি শশী জিনিয়া কিরণ।
বল দেখি সংগ্রামে আইল কোন্ জন।।
বিভীষণ বলে, রণে এল দশানন।
জ্যেষ্ঠ ভাই আমার বিজয়ী ত্রিভুবন।।
ব্রহ্মার নির্ম্মিত রথ বহুরূপ ধরে।
তুষ্ট হয়ে দেবগণ দিলা ধনেশ্বরে।।
কুবেরে জিনিয়া রথ নিলেক রাবণ।
আসিয়াছে সেই রথে করি আরোহণ।।
কোটি সূর্য্য জিনিয়া সৌন্দর্য্য খরতর।
রথের কিরণ কত দেখ রঘুবর।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কবিত্ব সুন্দর।
রাম রাবণের যুদ্ধ শুন অতঃপর।।