Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রূপোর রেকাবি || Adrish Bardhan

রূপোর রেকাবি || Adrish Bardhan

রূপোর রেকাবি

ডাক্তার! ডাক্তার!

চোখ রগড়াতে রগড়াতে খাট থেকে নেমে এলেন ডক্টর ওঙ্কারনাথ নাগ। বীতনিদ্র রজনীর জ্বালা তখনও চোখের পাতায়–ঘোর কাটেনি মগজ থেকে। সাত সকালেই আবার কে ডাকে?

দরজা খুলে দেখলেন সহাস্যমুখ এক যুবাপুরুষকে। পরনে মুগার পাঞ্জাবি। চুনোট করা ধুতির কেঁচা লুটোচ্ছে জরিদার নাগরার ওপর। দুই চক্ষু ঝকঝক করছে কৌস্তুভমণির মতো।

ইন্দ্রনাথ! এত সকালে?

তদন্তে বেরিয়েছি, ঘরের মধ্যে পা দিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ রুদ্র। সাহাভবনে কাল রাত্রে বিরাট চুরি হয়ে গিয়েছে। ফোন করেছিলেন সকালবেলাই!

চোখ কপালে তুলে বললেন ডাক্তার নাগ, সেকী কথা! কাল রাতেই তো গিয়েছিলাম বুড়িকে দেখতে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম।

সায় দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, সেই জন্যেই তো এসেছি তোমার কাছে।

কথার সুর কানে বাজল ওঙ্কারনাথের। অথচ কথাটা পেঁচিয়ে বলেনি ইন্দ্রনাথ। চোখ তুলে তাকালেন ডাক্তার।

বিষ্ণুমণি চক্ষু অতীব প্রশান্ত সন্দেহের ঝিলিক তো নেই!

আমার কাছে কেন?

যেতে-যেতে বলব। এখুনি বেরোবে তো?

হ্যাঁ। বুড়িকেও দেখতে যাওয়ার কথা আছে। তার আগে কয়েকটা ভিজিট সেরে নেব। শেষকালে যাব চেম্বারে।

আমি বসছি।–তৈরি হয়ে নাও।

.

কিন্তু শুধু বসল না ইন্দ্রনাথ, কথা বলতে লাগল। অনর্গল কথা বলে চলল। হাজার হাজার কথা সুতীক্ষ্ণ ভল্লের মতো সবেগে বেরিয়ে আসতে লাগল মুখ দিয়ে। রাজনীতির কথা, সমাজ পিঞ্জরের কথা, বারবণিতাদের দুরবস্থার কথা, আধুনিক সাহিত্যের কথা, চিকিৎসায় অব্যবস্থার কথা, গ্রামে দুশ্চিকিৎসার কথা, ওঙ্কারনাথের পশারের কথা, রুগিদের কথা, ভেষজশিল্পের কথা, জাল ওষুধের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মাথা ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল ওঙ্কারনাথের। কঁচা ঘুম ভাঙার পর থেকে সেই যে বাক্যস্রোত শুরু হয়েছে নায়গ্রা জলপ্রপাতের মতো বিরামহীনভাবে ঝমাঝম শব্দে আছড়ে পড়ছে কানের পরদায়। যেন অবিরাম বর্ষিত লৌহগুলিকায় বিদীর্ণ হয়ে চলেছে কর্ণপটহ। গাড়ি বের করেছেন, একটির পর-একটি রুগির বাড়ি গেছেন, নাড়ি টিপেছেন, নিদান নির্ণয় করেছেন, ব্যবস্থাপত্র লিখেছেন– ফাঁকে-ফাঁকে জবাব দিয়েছেন শুধু চিন্তাসূত্রকে অটুট রাখার জন্যে। গাড়ি চালাতে-চালাতেও সহস্র আয়ুধের মতন প্রশ্নের ধারাবর্ষণের জবাব দিয়ে গিয়েছেন–সেইসঙ্গে আপ্রাণ প্রয়াস পেয়েছেন শকটচালনায় নিবিষ্ট থাকতে। অর্জুনের ক্ষুর প্রবাণও বুঝি সহনীয়। নবনীতকোমল ইন্দ্রনাথের রসনা এত কঠিন, এত শাণিত? পাষাণ-প্রক্ষেপক ভূষণ্ডী অস্ত্র বললেও চলে। শব্দরূপ লৌহগুলিকার মুহুর্মুহুঃ আঘাতে ক্রমশ বিহ্বল বিপর্যস্ত হয়ে এসেছে ডাক্তারের রাতজাগা অবসাদক্লান্ত মগজ, বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা অনুভব করেছেন প্রতিটি স্নায়ুতন্তুতে।

অবশেষে আসল প্রশ্নে এসেছে ইন্দ্রনাথ–ছেড়েছে শক্তিশেল!

কালরাতে কোথায় ছিলে? সাহাদের বাড়ি। তারপর?

পালেদের বাড়ি।

তারপর?

আমার বাড়ি।

কটায় বাড়ি ফিরেছিলে?

রাত দুটোয়।

পালেদের বাড়ি কটায় গিয়েছিলে?

রাত দশটায়।

কাকে দেখতে?

পালেদের ছেলেটার অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে–এই ভয়ে ডেকেছিলেন মহীতোষ পাল।

গিয়ে কী দেখলে?

অ্যাপেন্ডিসাইটিস নয়–বদহজম। তখন রাত কটা?

সাড়ে দশ।

সাড়ে দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত কোথায় ছিলে মনে পড়ছে?

নিরুক্ত পাণ্ডুর মুখে বললেন ওঙ্কারনাথ, না।

.

সাহাদের বাড়ি এসে গিয়েছে। পঞ্চু সাহা এ অঞ্চলের একদা ধনী ব্যবসায়ী। বড়বাজারে রজত-সামগ্রীর ভূরিবিক্রয়ী ছিলেন।

কথিত আছে, ত্রিপুরাসুর বধকালে মহাদেবের রোষপূর্ণ দক্ষিণ নেত্র থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়ে তাতে রুদ্রের উদ্ভব হয়; সেই সময়ে বাম নেত্র থেকে যে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে, তা থেকে রৌপ্যের জন্ম হয়। রূপো চিরযৌবনকারক, বাত-প্রমেহাদি রোগ-নাশক। কিন্তু বিধি বাম! তাই চিরযৌবন অভিলাষী পঞ্চু সাহা রূপাজিবা পল্লীতে যুবতী সাহচর্য করতে গিয়ে প্রমেহ রোগেই আক্রান্ত হলেন এবং অশেষ কষ্ট পেয়ে অবশেষে উর্বশী-মেনকা-রম্ভার দর্শনকামনায় ইহলোক ত্যাগ করলেন।

সেটা বছর দুই আগের কথা। মিনসের পদস্থলনে বিধবা বুড়ি বড়ই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। গোটা দুনিয়াটাকে বিষনয়নে দেখতে শিখেছিলেন। অবিশ্বাসের বিষ সিঞ্চিত হয়েছিল অণুপরমাণুতে। তাই লাটে তুলে দিয়েছিলেন রজতবাণিজ্য; এমনকী ব্যাঙ্ক থেকেও বস্তাভরতি নোট তুলে এনেছিলেন পাছে ব্যাঙ্কও তাকে পথে বসায় এই ভয়ে। দোতলায় পালঙ্কের গদীর মধ্যে তুলো সরিয়ে নোট ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। রূপোর বিস্তর রেকাবি রেখেছিলেন একতলায়।

কাকপক্ষীও জানত না–জানত শুধু নিশিকুটুম্বরা। অলৌকিক ক্ষমতা তাদের। গৃহস্থর গোপন কাহিনিও যেন মন্ত্রবলে জেনে ফেলে। এহেন একজন দৈবজ্ঞ নিশিকুটুম্ব কাল রাতে তাকে পথে বসিয়ে গিয়েছে। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে গভীর নিদ্রিতা বৃদ্ধা কিছুই টের পাননি।

ডাক্তার ক্লান্ত চরণে উঠে গেলেন দোতলায়। বুড়ি বড় শক পেয়েছেন। ভালো করে কথাও বললেন না ডাক্তারের সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। ওষুধের ব্যবস্থা করে ডাক্তার নেমে এসে দেখলেন, দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ। বেরোতে না দেওয়ার মতলব।

কথা বলারও প্রবৃত্তি হল না ডাক্তারের। কাঁধের ধাক্কা দিয়ে ইন্দ্রকে সরিয়ে দিলেন, হাতল। ঘুরিয়ে ল্যাচ খুললেন, বেরিয়ে এলেন রোয়াকে।

সেই সময়ে খেয়াল হল, হাতটা চটচট করছে। হাত শুঁকে দেখলেন দুর্গন্ধ। দরজার হাতলে নোংরা মাখিয়ে রেখেছে কে!

পেছন থেকে শোনা গেল ইন্দ্রনাথের নিরীহ কণ্ঠস্বর, ডাক্তার, ওটা আমিই লাগিয়েছি– তোমার অঙ্গুলাঙ্ক, মানে ফিংগারপ্রিন্ট নেব বলে।

বক্তৃতপ্ত চোখে ইন্দ্রনাথকে ভস্মীভূত করার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। পরক্ষণেই বেগে ফের ভেতরে এলেন, টপাটপ ধাপ টপকে গেলেন দোতলায়, শয়নকক্ষ সংলগ্ন কলতলায় হাত ধুয়ে নেমে এলেন একতলায়।

ইন্দ্রনাথ ততক্ষণে তাঁর গাড়িতে গিয়ে বসেছে। ডাক্তার আসতেই বলল, চল, পালেদের বাড়ি যাই।

দরকার নেই।

হ্যাঁ, দরকার আছে। ছেলেটাকে একবার দেখে এসো।

ঠোঁট কামড়ে ধরলেন ডাক্তার। প্রতিবাদ করলেই তো শুরু হবে জিহ্বা সঞ্চালন। অগ্নির সাতটি জিভ আছে বলে তিনি সপ্ত জিহু। ইন্দ্রনাথের জিহ্বার সংখ্যা বোধকরি সাত সাততে ঊনপঞ্চাশ। তাই নীরবে এবং সভয়ে গেলেন পালেদের বাড়ি। মহীতোষ পাল এবং তাঁর গৃহিণী তো অবাক অসময়ে ডাক্তারকে দেখে। বিখ্যাত গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্রের আগমনে যেন বেশি পুলকিত হলেন মহীতোষ গৃহিণী। মহীতোষবাবু গেলেন ভেতর ঘরে। ছেলেটার উদর টিপতে লাগলেন ডাক্তার। ইন্দ্রনাথ কিন্তু সোৎসাহে বাক্যস্রোত অব্যাহত রাখল পাল-গৃহিণীর সঙ্গে। ব্যবস্থাপত্র লেখা সাঙ্গ হতেই দুজনে বেরিয়ে এসে বসল গাড়িতে। স্টার্ট দিয়ে লোহিতনয়নে শুধোলেন ডাক্তার, এবার?

ইন্দ্রনাথ বললে, গাড়ির বুট-য়ের মধ্যে কী রেখেছ?

কিছু না!

ড্যাশবোর্ডের ছোট্ট খুপরির দিকে হাত বাড়াল ইন্দ্রনাথ। চকিতে হাত বাড়ালেন ডাক্তারও। কিন্তু তার আগেই বুট খুলে একটা প্যাকেট বার করে আনল ইন্দ্রনাথ। ধাতব ঝনৎকার শোনা গেল পুলিন্দার মধ্যে।

প্যাকেট ছিঁড়তেই ঝকঝক করে উঠল অনেকগুলো রূপোর রেকাবি। সাদা হয়ে গেল। ডাক্তারের মুখ।

সাহাবুড়ির রূপোর রেকাবি। এখানে এল কী করে? ইন্দ্রনাথের প্রশ্ন।

জবাব দিতে পারলেন না ডাক্তার।

আমি বলছি, কী করে এল এখানে। মহীতোষবাবু রেখে গেছেন। যখন কথা বলছিলাম, ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে, উনি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বুটের মধ্যে রেখে গেছেন তোমাকে চোর প্রতিপন্ন করার জন্যে–। এখন মনে পড়ছে কাল রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত দুটোর মধ্যে কোথায় ছিলে?

হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তড়িৎ-স্পৃষ্টের মতন বললেন ডাক্তার। মহীতোষবাবুর বাড়ির সামনেই ছিলাম। চাকা থেকে হাওয়া বেরিয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, হাওয়া বার করে দেওয়া হয়েছিল। দিয়েছিলেন পাল-দম্পতি–যাতে তোমার অ্যালিবি, মানে অন্যত্রস্থিতি অস্পষ্ট থাকে। সেই ফাঁকে দুজনে মিলে সরিয়ে দিয়েছিলেন সাহাবুড়ির ঐশ্বর্য। কী অপূর্ব কূটযোগ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। জয় হোক পাল দম্পতির। শুধু একটা ভুল করেছিলেন বলেই তোমাকে ফাঁসানো গেল না।

কী? স্খলিত কণ্ঠ ডাক্তারের।

শোওয়ার ঘরের কোথায় কী আছে, ডাক্তারের পক্ষে জানা সম্ভব–মায় গদীর ভেতর নোট পর্যন্ত। কিন্তু একতলার খবর রাখা কোনও ডাক্তারের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই দরজার হাতলে নোংরা লাগিয়ে তোমার হাত যখন ময়লা করে দিলাম, তুমি আমার পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে সটান ওপরে দৌড়লে হাত ধুতে–অথচ সিঁড়ির পাশেই ছোট্ট ঘরে ছিল হাত ধোওয়ার বেসিন–পাশেই আলমারির মধ্যে থাকত রূপোর রেকাবি। সাহাবুড়িকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে এসেছ, এ গল্প নিশ্চয় পাল-দম্পতির কাছে করেছিলে? তৎক্ষণাৎ প্ল্যানটা মাথায় এসেছিল পাল-দম্পতির। সাধু! সাধু! আমি চললাম পালেদের বাড়িটাকাগুলো উদ্ধার করতে। ডাক্তার, তুমি বাড়ি যাও–একটু ঘুমোও। মুখটা বড় শুকিয়ে গেছে। আমার বাঁচালতা মাপ কোরো–এটা এক ধরনের প্রতি-পরীক্ষা–এক্ষেত্রে অপরিহার্য ছিল। সত্যনিষ্কর্ষণের উপায় উপকরণ বলতে পার। ভোরবেলা যখনি শুনেছি, তোমার ইঞ্জেকশনের জন্যেই সাহাবুড়ি মড়া-ঘুম ঘুমিয়েছে, নিশ্চিত হয়েছিলাম পুলিশ তোমাকে ছুঁলো বলে, তাই বন্ধুকৃত্য করে গেলাম পুলিশ আসার আগেই।–গুডবাই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *