রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলেই
রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলেই সকালের রোদটা কোমল লাগছে। যেন রোদটা স্নান করেছে, রোদের নিজেরই শীত শীত লাগছে। চায়ের কাপ হাতে রূপা ছাদে হাঁটছে। অনেকদিন গাছপালার যত্ন করা হয়নি। গাছগুলিকে দেখাচ্ছে জঙ্গুলে ঝোপের মত। মাধুরীলতা গাছে ফুল ফুটেছে। এই গাছের নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রিয় কন্যা মাধুরীর নামে নাম। ছাদের বাগানে আরেকটা গাছ আছে যার নামও রবীন্দ্রনাথের রাখা–উদয় পদ্ম। এইসব তথ্য রূপা জানে তার মায়ের কাছ থেকে। এই মহিলার গাছপালার শখ ছিল, কবিতার শখ ছিল, গানের শখ ছিল। এখন সব শখ টগরের বাবা নামের মানুষটিতে স্থির হয়েছে।
মলিনা টেলিফোন হাতে ছাদে এসেছে। রূপাকে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
আফা আপনে এইখানে? আমি সারা দুনিয়া খুঁজছি। আম্মা ফোন করছে।
রূপা টেলিফোন হাতে নিল। মলিনা বলল, কাইল রাইত কি খোয়াব দেখছি আফা শুনেন। খোয়বে রাশেদ ভাইজান বললেন, মলি কফি খাব। আমি জাইগা উঠলাম। দৌড় দিয়া রান্নাঘরে ঢুইকা গ্যাসের চুলা জ্বালাইলাম তখন বুঝলাম, খোয়াব দেখছি। কি আচানক বিষয়।
রূপা বলল, আমি টেলিফোনে কথা বলব। তুমি নিচে যাও। নাশতার জোগাড় দেখ।
মলিনা অনিচ্ছায় চলে গেল। রূপা আফা যখন কারো সঙ্গে কথা বলে তখন তার দূর থেকে শুনতে ভাল লাগে। আফার গলার স্বর এমন মিড়া।
মা কেমন আছ?
ভাল। এতক্ষণ লাগে টেলিফোন ধরতে?
মা সরি।
বেনু মেয়েটার খবর তোকে কে দিয়েছে বল।
কেউ দেয়নি মা।
কেউ তোকে বলেনি, তোর কাছে আসমানি ওহি নাজেল হয়েছে?
অনেকটা সে রকম। ঐ বিষয়ে পরে কথা বলব। আমার মন বলছে তুমি খুব খারাপ অবস্থায় আছ। তোমার তো কোথায়ও যাবার জায়গা নেই। তুমি এ বাড়িতে চলে এসো। টগর ৈনিয়ে চলে এসো।
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই মানে কি? আমার তিন ভাই আছে। এক বোন আছে।
তোমার তিন ভাই দেশের বাইরে থাকেন। বোনের সঙ্গে তোমার কোনো যোগাযোগ নেই। ছোট খালা তোমাকে সহ্যই করতে পারেন না। ঐ বাড়িতে কীভাবে থাকবে ছোট খালা রাত্রি গেটই খুলবে না।
তোদের এখানে আমি কোন যুক্তিতে উঠব?
তুমি আমার মা সেই যুক্তিতে উঠবে। সুলতান চাচা যদি আমাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে আসতে পারেন। তুমি পারবে না কেন?
উনি তোদের এখানে থাকেন।
কয়েকদিন ধরে আছেন। বাবা তাকে স্থায়ীভারে থাকতে বলেছেন। তিনি রাজি। তার না-কি আর একা একা থাকতে ভাল লাগে না। মা! তুমি কি কাঁদছ? তোমার কান্নার শব্দ পাচ্ছি।
লায়লা জবাব দিলেন না
রূপা বলল, মা! তোমার লাগানো উদয় সই গাছে ফুল ফুটেছে। মাধুরীলতা গাছে ফুল ফুটেছে। এসে দেখে যাও।
না। টগরকে নিয়ে আমি ফার্মগেটের ওভারব্রিজে কাঁথা বিছিয়ে থাকব, তাদের বাড়িতে না।
টগরকে নিয়ে এভারব্রিজে থাকা ঠিক হবে না মা।
শায়লা কঁদছেন। আগে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। এখন শব্দ করে কাঁদছেন। রূপা বলল, মী গাড়ি পাঠাব? পাঠিয়ে দেই?
শায়লা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললেন, পাঠিয়ে দে।
নাশতার টেবিলে হারুনকে অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হল। তাঁর উত্তেজনার বিশেষ কারণ ঘটেছে। পত্রিকায় খবর এসেছে–নওগাঁর একটা পুকুরের পানি দশ মিনিটে হঠাৎ উধাও! প্রথম একটা বিকট শব্দ হল তারপর দেখা গেল হড়হড় করে পুকুরের পানি নেমে যাচ্ছে।
হারুন বললেন, সরেজমিন তদন্ত করা দরকার।
সুলতান বললেন, অবশ্যই দরকার। অবশ্যই দরকার।
হারুন বললেন, এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগে আমরা নওগাঁয় যাব, না নেত্রকোনা যাব।
সুলতান বললেন, নওগাঁ। পুকুর ঘাটে তাবু খাটিয়ে বাস করতে হবে। পুকুরের পানি যেভাবে নেমে গেছে সেইভাবে উঠেও আসতে পারে।
হারুন বললেন, আমার মনে হয় আগে নেত্রকোনা যাওয়া উচিত। রাশেদ সায়েন্সের ছেলে তাকে নিয়ে নওগাঁ যাব।
সুলতান বললেন, রূপার মতামত নেয়া যাক। সে যা বলে তাই হবে। সে যা বলে তাই হবে।
রূপা বলল, চল আগে নেত্রকোনা যাই। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। মদিনাও যাবে। সেখান থেকে ফিরে সবাই দলবেঁধে পুকুর দেখে আসব আর মদিনাকে তার বাবা মার কাছে রেখে আসব।
হারুন বললেন, মলিনা একা থাকবে কেন? সেও আমাদের সঙ্গে যাক।
রূপা বলল, মলিনা যেতে পারবে না। মা টগরকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে আসছেন। মার দেখাশোনার জন্যে একজনকে দরকার।
হারুন চা খাচ্ছিলেন। তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। রূপা বলল, বাবা! তুমি এখন থেকে সুলতান চাচার সঙ্গে একতলায় থাকবে। আমার বড় ঘরটা আমি মাকে আর টগরকে দিয়ে দিব। তোমার পায়রার খুপড়িটা আমি নিয়ে নেব। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে বাবা?
হারুনের গলা দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ বের হল। এই আওয়াজের কোনো অর্থ নেই।
সুলতান হতভম্ব গলায় বললেন, তোর মা কখন আসবে?
রূপা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, মাকে আনতে অনেকক্ষণ আগে গাড়ি গিয়েছে। মনে হয় যে কোনো সময় চলে আসবেন।
হারুনের গলা দিয়ে আবারও বিচিত্র আওয়াজ বের হল।