Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রুস্তমের স্বগতোক্তি || Shamsur Rahman

রুস্তমের স্বগতোক্তি || Shamsur Rahman

কেমন সুর্যাস্ত এলো ছেয়ে চরাচরে, রক্তচ্ছটা
সর্বত্র ভীষণ জ্বলজ্বলে, ধরায় দারুণ জ্বালা
আমার দু’চোখে, আর যেদিকে তাকাই দেখি শুধু
একটি ফ্যাকাশে মুখ, নিষ্প্রভ তরুণ ফল যেন,
ভূলুণ্ঠিত গোধূলিতে। ঝকঝকে বল্লমের মতো,
মনে পড়ে, উঠেছিলো ঝল্‌সে সে ক্রুর রণক্ষেত্রে
সুকান্ত তেজস্বী যুবা। যদিও দূরন্ত যোদ্ধা, তবু
ছিলো না ঔদ্ধত্য কিংবা কর্কশতা কন্ঠস্বরে তার।
যেমন সে অশ্বারোহণে কি অস্ত্রশিক্ষায় নিপুণ
তেমনি পারদর্শী বাক্য উচ্চারণে, সৌজন্যে ভাস্বর।
শত্রুসংহারের নেশা। যে-বীরের শিরায় শিরায়
অত্যন্ত ফেনিল তার কন্ঠস্বরে রবাবের সুর
পাখির ওড়ার মতো, কখনো জানিনি আগে;

হায়,
যে অন্ধ কৃষক তীক্ষ্ম কাস্তের আঘাতে স্বপ্নময়,
সাধের ফসল তার কেটে ফেলে অকালে, আমিও
তারই মতো বিভ্রমের মনহুশ ঊর্ণাজালে বন্দী
হয়ে নিজ হাতে ক্ষিপ্র করেছি বিরানা এই বুক,
আমার বয়সী বুক। যে মহল গড়েছি নিয়ত
স্বপ্নে, যখন তা কাছে এলো আসমানী ইশারায়
প্রকৃত নির্মাণ হ’য়ে, নিজেই করেছি তাকে ধু-ধু
ধ্বংসস্তুপ। কেন তাকে দেখামাত্র হৃদয় আমার
হয়নি উদ্বেল পিতৃস্নেহে? নিমেষেই কেন চোখ
হয়নি বিপুল বাষ্পাকুল? তবে কি রক্তের টান
দুর্মর সংস্কার কোনো? শুধু জনশ্রুতি, যুগ যুগ
ধ’রে যা’ লালিত আমাদের যৌথ সরল স্মৃতিতে?
কেন তাকে দেখামত্র বর্ম খুলে ফেলে, অস্ত্র রেখে
জড়িয়ে ধরিনি বুক, নিইনি মাথার ঘ্রাণ তার?
তাহ’লে পাঁজরে তার বর্শা-চালনার আগে কেন
কাঁপেনি আমার বুক একরত্তি? কেন এই হাত
মুহূর্তে হয়নি শিলীভূত? জয়মত্ত বীর আমি,
হইনি স্থবির কেন ক্ষণকাল? কেন অহমিকা
রৌদ্রঝলসিত শিরস্ত্রাণ হ’য়ে রইলো সর্বক্ষণ?
ধিক তোকে হে মূঢ় অহমিকা, ধিক।

তাহমিনা,
মিথ্যার অক্ষরে কেন লিখেছিলে বিভ্রান্ত খেয়ালে
প্রতারক পত্র তুমি আঠারো বছর আগে? কেন
পুত্রের পিতাকে রেখেছিলে পুত্রহীন ক’রে, কেন?
তুমিতো জানো না এই হতভাগ্য পিতা পুত্রহীন
হয়েছে দ্বিতীয়বার। তুমিতো জানো না! তাহমিনা
তোমার দুলাল আজ এই বিয়াবানে কী নিষ্প্রাণ
কী নিঃস্পন্দ পড়ে আছে অশ্রুময় ঘাতক পিতার
ফজুল স্নেহের খিমাতলে!

কেন আমি আজ তাকে
মিছেমিছি করি দায়ী? রাখ্‌শারোহী রুস্তম কি ছুটে
পারতো না যেতে ভুল আত্মজার জন্মের সংবাদ
পেয়ে? কেন সে যায় নি পাঁচ দশ মাস পরে কিংবা
দু’চার বছর পরে? কেন তার রক্তে জাগেনি কল্লোল
সন্তানের অকর্ষণে? কন্যা কি সন্তান নয় তবে?
কন্যার ওষ্ঠে কি হাসি ফোটেনা কখনো কিংবা তার
মাথায় থাকেনা ঘ্রাণ? কন্যা পিতাকে দুই হাতে
ধরে না জড়িয়ে? খেলনার জন্যে করে না আবদানে
কোনোদিন? থাকে না প্রবাসী জনকের প্রতীক্ষায়?
কন্যার শিরায় প্রবাহিত হয় না কি জনকের
সতেজ শোণিত ধারা? অনবোলা পরিন্দা সে-ও তো
যোজন যোজন দূর থেকে উড়ে আসে নীড়ে তার
শাবকের কাছে স্নেহবশে, সন্তান পুত্র কি কন্যা
করে না বিচার। হায়, কোন্‌ অভিশাপে হে রুস্তম
রণমত্ত অবিচল স্নেহহীন প্রবাদপ্রতিম বীর, তুমি
রেখেছো নিজেকে দূরে এতকাল দয়িতা এবং
সন্তানের কাছ থেকে? কী এমন ক্ষতি হতো কার
যদি এ যুদ্ধের ডঙ্গা স্তব্ধ হতো অনেক আগেই,
যদি দৈববলে আফ্রসিয়াবের রণমত্ততার
হতো অবসান এই সর্বনাশা দ্বৈরথের আগে,
যদি কায়কাউসের জলপাই পাতা উঠতো নেচে
আমার পুত্রের বুকে রুস্তমের মনহুশ বর্শা
উদ্যত হওয়ার আগে? কিন্তু, হায়, তা’ হওয়ার নয়।
আমরা ধনুক যাঁর হাতে তিনি নিজস্ব ইচ্ছায়
বাঁকান যতটা আমাদের, ততটাই বেঁকে যাই,
কেউ কেউ মচকাই, কেউবা ভীষণ খান খান।
লাশ নিয়ে বসে আছি,

এখন ভীষণ ক্লান্ত আমি;
ওষ্ঠময় মরুবালি, সারামুখে খুনেলা রেখার
হিজিবিজি, মনে হয় হৃতজ্যোতি প্রবীণ ঈগল
সত্তায় নিয়েছে ঠাঁই। শুধু মাঝে-মাঝে পামীরের
উদাত্ত প্রান্তরেয়ার আলরুরুজের চূড়া থেকে
ভেসে-আসা সোহরার সোহরাব ধ্বনি, যা’ আমারই
শূন্য পাঁজরের আর্তনাদ, শুনে কেঁপে উঠি, যেন
মরুর শীতার্ত রাতে আহত নিঃসঙ্গ পুশুরাজ।

এই আমি কতদিন ছাগলের চামড়ার মশক
থেকে ঢেলে আকন্ঠ করেছি পান ঝাঁঝালো শারাব
ইয়ারের মজলিশে রাত্রির তাঁবুতে। আকৈশোর
মৃগয়াবিলাসী আমি, ছুটেছি অরণ্যে, দীর্ঘশ্বাস-
ময় প্রান্তরের বুকে, কী এক নেশায় বুঁদ হ’য়ে
করেছি শিকার বাঘ, সংখ্যাহীন পাহাড়ি হরিণ।
মাজেন্দারানের পথে লড়েছি সিংহের সঙ্গে আর
হয়েছে নিমেষে দীর্ণ আমার নেজায় ভয়ানক
আতশবমনকারী অজগর; পাথুরে জমিনে,
রেগিস্তানে কত যে মড়ার খুলি প্রত্যহ উঠেছে
বেজে দ্রুত হাওয়া-চেরা রাখশ-এর প্রখর খুরাঘাতে,
সফেদ দৈত্যের প্রাণ করেছি সংহার, গুহাবন্দী
কায়কাউসের আয়ু-রাশ্মি দীপ্র দীর্ঘস্থায়ী

করার উদ্দেশ্যে শত শত খ্যাত গর্বিত বীরের
শিরশ্ছেদ করেছি হেলায় ধূলিগ্রস্ত রণক্ষেত্রে।
শুনিনি এমন যোদ্ধা আছে ত্রিভূবনে, রক্তে যার
জমে না তুষারকণা রুস্তমের রণহুংকারে হঠাৎ।
সোহবার তোর এই বালিমাখা রক্তাক্ত শরীর,
সেই পরাক্রান্ত চিরজয়ী রুস্তমকে আজ স্তব্ধ
ইরান-তুরাণ ব্যাপী অস্তরাগে করেছে ভীষণ
ক্লান্ত ওরে, পরাজিত। মিটেছে আগ্রাসী রণক্ষুধা,
আর নয় দুনিয়া কাঁপানো দামামার অট্রহাসি,
এইতো রেখেছি বর্ম খুলে, পড়ে থাকে তলোয়ার।
সোহরাব ফিরবে না আর;

জানিনা মৃত্যুর পরে,
সে কেমন পটভূমি রয়েছে সাজানো, কোন্‌ মঞ্চ?
পুনরায় ভাঙবে কি ঘুম কোনো ভোরবেলা খুব
নিঝুম খিমায় স্নিগ্ধ হাওয়ার কম্পনে? শিরস্ত্রাণে
পরবে কি খসে দূরযাত্রী রাঙা পাখির পালক?
নতুন সামানগাঁয়ে যাবো কি আবার গোধূলিতে
কোনোদিন পথশ্রান্ত? প্রাক্তন প্রিয়ার হাত নেবো
তুলে হাতে, দেখবো মেহেদি-নক্‌শা তার করতলে
অথবা রহস্যময় কোনো সুর শুনে মরুদ্যান
ছেড়ে চলে যাবো দূর কুহকিনী নারীর গুহায়?
তুলে নেবো হাতে ফের ভল্ল, গদা, আত্মজ হননে
উঠবো কি মেতে পুনরায়? আঁজলায় নহরের
পানি নিয়ে হবো স্বপ্নাচ্ছন্ন? মৃত্যু শুধু নিরুত্তর
অন্ধকার নাকি আলো ভিন্নতর, জানিনা কিছুই।
তবে আজ জোনাকির

আসা-যাওয়া অন্য মানে প্রায়
আমার নিকট; শোনো রাখ্‌শ, নিত্যসঙ্গী কালশ্রান্ত
হে অশ্ব আমার, নেই অবসর, রাত্রি ছেয়ে আসে,
এখন প্রস্তুত হও, তোমার কেশরগুচ্ছ থেকে
ঝেড়ে ফেলো হাহাকার, আমাদের যেতে হবে দূর
আপন শস্তানে, বইতে হবে প্রিয় সওদা শোকের।
তোমার সওয়ার দুই-একজন মৃত, অন্যজন
জীবন্মৃত; ছোটো, ছোটো নিরন্তর, হে অশ্ব আমার।
আবার দাঁড়াবে এক দুঃখী পুত্রহীন পিতা
নিজের পিতার সামনে, হবে নতজানু তাঁর কাছে,
নাম যার বীর জাল এবং তুষারমৌলি তাঁর
শির; ফিরে যাবে নিজবাসভূমে সেই সওদাগরের
মতো, যে সর্বস্ব তার হারিয়ে ফেলেছে মরুপথে
প্রবল লুন্ঠনকারী তাতারস্যুর ক্রুর হাতে।
কখনো পাবো না দেখা তবু

নিয়ত খুঁজবো তাকে,
বিদেহী যুবাকে, দিকে দিকে অন্তহীন বিরানায়,
মরীচিকাময় পথে, অন্তর্লোকে যে আমাকে খুঁজে
বেরিয়েছে এতকাল বালিয়াড়ি, দুর্গম প্রান্তর,
শত্রুর শিবির আর ভুবননন্দিত যোদ্ধাসংঘে।

এখন নামুক শান্তি দিগন্তে দিগন্তে রেগিস্তানে,
এখন নামুক শান্তি আলরুরুজের জ্যোৎস্নাধোয়া
চূড়ায়, নামুক শান্তি ইতিহাস-তরঙ্গিত এই
আমূদরিয়ায় আর সামানগাঁয়ের গুলবাগে,
ফলের বাগানে রৌদ্রঝলসিত নহরে নহরে,
দিনান্তে উটের কাফেলায়, হরিণেয় পিপাসায়,
এখন নামুক শান্তি কায়কাউসের ব্যাঘ্রচর্ম
খিমায় এবং আফ্রাসিয়াবের সব অস্ত্রাগারে,
এখন নামুক শান্তি বেবাক তাতারী আস্তনায়,
এখন নামুক শান্তি রণলিপ্সু বিক্ষুব্ধ তুরাণে,
এখন নামুক শান্তি তিমিরান্ধ বিদীর্ণ ইরানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *