পূজার ছুটিতে হিমাচল অঞ্চলে
পূজার ছুটিতে হিমাচল অঞ্চলে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। রেলের চাকরিতে আর কোনও সুখ না থাক, ঐটুকু আছে— বিনা খরচে সারা ভারতবর্ষটা ঘুরিয়া আসা যায়। আমি হিমালয়ের কোন দিকে গিয়াছিলাম, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। — তবে সেটা দাৰ্জিলিং কিংবা সিমলা পাহাড় নহে। যেখানে গিয়াছিলাম। সে স্থান আরও নির্জন ও দুরধিগম্য; রেলের শেষ সীমা ছাড়াইয়া আরও দশ-বারো মাইল রিকশা কিংবা ঘোড়ায় যাইতে হয়।
হিমালয়ের নৈসৰ্গিক বর্ণনা করিয়া উত্ত্যক্ত পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইবি না; সচরাচর আশ্বিনমাসে পাহাড়ের অবস্থা যেমন হইয়া থাকে, তাহার অধিক কিছু নহে। গিরিক্ৰোড়ের এই ক্ষুদ্র জনবিরল শহরটি এমনভাবে তৈয়ারি যে, মানুষের হাতের কাজ খুব কমই চোখে পড়ে। যে পথটি সর্পিল গতিতে কখনও উচু কখনও নিচু হইয়া শহরটিকে নাগপাশে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, পাইন গাছের শ্রেণীর দ্বারা তাহা এমনই আচ্ছন্ন যে, তাহার শীর্ণ দেহটি সহসা চোখেই পড়ে না। ছোট। ছোট পাথরের বাড়িগুলি পাহাড়ের অঙ্গে মিশিয়া আছে। মাঝে মাঝে পাইনের জঙ্গল, তাহার মধ্যে পাথরের টুকরা বসাইয়া মানুষের বিশ্রামের স্থান করা আছে। রাত্রিকালে ক্কচিৎ ফেউয়ের ডাক শুনা যায়। শীত চমৎকার উপভোগ্য।
সেদিন পাইন গাছের মাথায় চাঁদ উঠিয়ছিল। আধখানা চাঁদ, কিন্তু তাঁহারই আলোয় বনস্থলী উদ্ভাসিত হইয়াছিল। আমি একাকী পাইন বনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম। গায়ে ওভারকোট ছিল, মাথায় একটা অদ্ভুত আকৃতির পশমের টুপি পরিয়াছিলাম। এ দেশের পাহাড়ীরা এইরকম টুপি তৈয়ারি করিয়া বিক্রয় করে। চাঁদের আলোয় আমার দেহের যে ছায়াটা মাটিতে পড়িয়াছিল, তাহা দেখিয়া আমারই হাসি পাইতেছিল। ঠিক একটি জংলী শিকারীর চেহারা,—হাতে একটা ধনুক কিংবা বশ্য থাকিলে আর কোনও তফাত থাকিত না।
এখানে আসিয়া অবধি কোনও বাঙালীর মুখ দেখি নাই, অন্য জাতীয় লোকের সঙ্গেও বিশেষ পরিচয় হয় নাই, তাই একাকী ঘুরিতেছিলাম। বাহিরের শীতশিহরিত তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রকৃতি আমাকে গভীর রাত্ৰিতে ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়াছিল। এই প্রকৃতির পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার মনে হইতেছিল, এ-দৃশ্য যেন ইহজগতের নহে, কিংবা যেন কোন অতীত যুগ হইতে ছিঁড়িয়া আনিয়া অর্ধ ঘুমন্ত দৃশ্যটাকে কেহ এখানে ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে। বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে ইহার কোনও যোগ নাই, চন্দ্রাস্ত হইলেই অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো ইহা শূন্যে মিলাইয়া যাইবে।
এ বন রাত্রিকালে খুব নিরাপদ নহে জানিতাম, ফেউয়ের ডাকও স্বকৰ্ণে শুনিয়াছি; কিন্তু তবু এক অদৃশ্য মায়া আমাকে ধরিয়া রাখিয়াছিল। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইবার পর একটি গাছের ছায়ায় পাথরের বেদীর উপর বসিয়া পড়িলাম। নিস্তব্ধ রাত্রি। মাঝে মাঝে মৃদু। বাতাসে গাছের পাতা অল্প নড়িতেছে; দু-একটা ফল বৃন্তচু্যত হইয়া টুপটাপ করিয়া মাটিতে পড়িতেছে। ইহা ছাড়া জগতে আর শব্দ নাই।
আমি ভিন্ন এ-বনে আরও কেহ আছে। বনভূমির উপর আলো ও ছায়ার যে ছক পাতা রহিয়াছে তাহার উপর একটি নিঃশব্দে সঞ্চরমাণ শুভ্ৰমূর্তি মাঝে মাঝে চোখে পড়িতেছে। মূর্তি কখনও তরুচ্ছায়ার অন্ধকারে মিলাইয়া যাইতেছিল, কখনও অবাস্তব কল্পনার মতো চন্দ্ৰলোক-কুহেলি ভিতর দিয়া চলিয়া যাইতেছিল। ক্রমে একটি ক্ষীণ তন্দ্ৰামধুর কণ্ঠস্বর কানে আসিতে লাগিল,—ঐ ছায়ামূর্তি গান করিতেছে। গানের কথাগুলি ধরা গেল না, কিন্তু সুরটি পরিচিত, যেন পূর্বে কোথায় শুনিয়াছি। ঘুম-পাড়ানী ছড়ার মতো সুর, কিন্তু প্রাণের সমস্ত তন্ত্রী চির-পরিচয়ের আনন্দে ঝংকৃত করিয়া তুলে।
গান ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে লাগিল। এই গান যতই কাছে আসিতে লাগিল, আমার শরীরের স্নায়ুমণ্ডলেও এক অপূর্ব ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল। সে অবস্থা বর্ণনা করি এমন সাধ্য আমার নাই। সে কি তীব্র অনুভূতি! আনন্দের কোন উদ্দামতম অবস্থায় মানুষের শরীরে এমন ব্যাপার ঘটিতে পারে জানি না, কিন্তু মনে হইল, দেহের স্নায়ুগুলা এবার অসহ্য হৰ্ষবেগে ছিঁড়িয়া-খুঁড়িয়া একাকার হইয়া যাইবে।–যে গান গাহিতেছিল, সে নারী এবং যে ভাষায় গান গাহিতেছিল তাহা বাংলা; কিন্তু সে জন্য নহে। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যে সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার অন্য কারণ ছিল। এই গান এই কণ্ঠে গীত হইতে আমি পূর্বে শুনিয়াছি— বহুবার শুনিয়াছি। ইহার প্রত্যেকটি শব্দ আমার কাছে পুরাতন। কিন্তু তফাত এই যে, যে-ভাষায় এ গান পূর্বে শুনিয়াছিলাম, তাহা বাংলাভাষা নহে। সে ভাষা ভুলিয়া গিয়াছি, কিন্তু গান ভুলি নাই! কোথায় অন্তরের কোন নির্জন কন্দরে এতকাল। লুকাইয়া ছিল, শুনিবা মাত্র প্ৰতিধ্বনির মতো জাগিয়া উঠিল। গানের কথাগুলি বাংলায় রূপান্তরিত হইয়া অসংযুক্ত ছড়ার মতো প্রতীয়মান হয়, কিন্তু একদিন উহারই ছন্দে আমার বুকের রক্ত নৃত্য করিয়া উঠিত। গানের কথাগুলি এইরূপ :
বনের চিতা মেরেছে মোর স্বামী
ধারালো তীর হেনে!
চামড়া তাহার আমায় দেবে এনে
পারবো গায়ে আমি।
আমার চুলে বিনিয়ে দেব, ওরে,
স্বামী আমার– নিটোল দেহ তার
কঠিন যেন শিলা!
গায়িকা আরও কাছে আসিতে লাগিল। আমি দাঁড়াইয়া উঠিয়া রোমাঞ্চিত।–দেহে প্ৰতীক্ষা করিতে লাগিলাম। ওঃ, কত কল্পান্ত পরে সে ফিরিয়া আসিল! আমার প্রিয়া—আমার সঙ্গিনী— আমার রুমা! এত দিন কি তাহারই প্ৰতীক্ষায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিতেছিলাম?
যে তরুচ্ছায়ার নিম্নে আমি দাঁড়াইয়াছিলাম, সে গাহিতে গাহিতে ঠিক সেই ছায়ার কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইল। আমাকে সে দেখিতে পায় নাই, চাঁদের দিকে চোখ তুলিয়া গাহিল,—
স্বামী আমার,–নিটোল দেহ তার
কঠিন যেন শিলা!
তাহার উন্নমিত মুখের পানে চাহিয়া আর আমার হৃদয় ধৈর্য মানিল না। আমি বাঘের মতো লাফাইয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলাম। কথা বলিতে গেলাম, কিন্তু সহসা কিছুই বলিতে পারিলাম না। যে ভাষায় কথা বলিতে চাই, সে ভাষার একটা শব্দও স্মরণ নাই। অবশেষে অতি কষ্টে যেন অর্ধজ্ঞাত বিদেশী ভাষায় কথা কহিতেছি, এমনই ভাবে বাংলায় বলিলাম, তুমি রুমা— আমার রুমা!
তাহার গান থামিয়া গিয়াছিল, সে ভয়-বিস্ফারিত নয়নে চাহিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, কে? কে?
তাহার মুখের অত্যন্ত কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলাম, আমি আমি! রুমা চিনতে পারছ না?
সভয় ব্যাকুল-কণ্ঠে সে বলিল, না। কে তুমি? তোমাকে আমি চিনি না। হাত ছেড়ে দাও!
জলবিম্ব যেমন তরঙ্গ-আঘাতে ভাঙিয়া যায়, তেমনই এক মুহুর্তে আমার মোহ-বুদ্বুদ ভাঙিয়া গেল। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খাইয়া বর্তমান জগতে ফিরিয়া আসিলাম। তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া লজ্জিত অপ্রতিভভাবে বলিলাম, মাপ করুন। আমার ভুল হয়েছিল।
রুমা চিত্রপিতার মতো স্থির অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া রহিল। আমিও তাহার পানে চাহিলাম! এই আমার সেই রুমা! পরিধানে সাদা শালের শাড়ি, আর একটি ত্রিকোণ শুভ্র শাল স্কন্ধ বেষ্টন করিয়া বুকের উপর বুচ দিয়া আটা, পায়ে সাদা চামড়ার জুতা। মস্তক অনাবৃত, কালো কেশের রাশি কুণ্ডলিত আকারে গ্ৰীবামূলে লুটাইতেছে। মুখখানি কুমুদের মতো ধবধবে সাদা, বয়স বোধ করি আঠারো-উনিশের বেশি নহে–একটি তরুণী রূপসী শিক্ষিতা বাঙালী মেয়ে!
কিন্তু না, এ আমার সেই রুমা! যাহাকে আমি তাহার স্বজাতির ভিতর হইতে কাড়িয়া আনিয়াছিলাম, যে আমার সন্তান গৰ্ভে ধারণ করিয়াছিল, এ সেই রুমা! আজি ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সে আমার কাছে আসিল? আমাকে সে চিনিতে পারিল না?
আমার গলার পেশীগুলি সংকুচিত হইয়া শ্বাসরোধের উপক্ৰম করিল। আমি রুদ্ধস্বরে আবার বলিয়া উঠিলাম, রুমা, চিনতে পারছি না?
রুমা স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, মোহাবিষ্ট স্বরে কহিল, আমার নাম রমা।
না—না—না, তুমি রুমা! আমার রুমা! মনে নেই, গুহার মধ্যে আমরা থাকতুম, ওপরে পাহাড়, নীচে উপত্যকী? তুমি গান গাইতে— যে গান এখনই গাইছিলে, সেই গান গাইতে, মনে নেই?
রুমার দুই চক্ষু আরও তন্দ্ৰাতুর হইয়া আসিল। ঠোঁট দুটি একটু নড়িল, বলিল, মনে পড়ে না—কবে—কোথায়…
মাথার টুপিটি অধীরভাবে খুলিয়া ফেলিয়া আমি ব্যগ্রস্বরে কহিতে লাগিলাম, মনে পড়ে না? সেই উপত্যকায় তোমরা একদল যাযাবর এসেছিলে, তোমাদের সঙ্গে ঘোড়া উট ছিল, তোমরা আগুন জ্বেলে মাংস সিদ্ধ করে খেতে। হ্রদের জলে যে লম্বা ঘাস জন্মাতো, তার শস্য থেকে চাল তৈরি করতে তুমিই যে আমায় শিখিয়েছিলে। ভেড়ার লোম থেকে কাপড় বোনবার কৌশল যে আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছিলুম! মনে পড়ে না? একদিন অন্ধকার রাত্ৰিতে আমরা তোমাদের আক্রমণ করলুম! তোমার দলের সব পুরুষ মরে গেল! তোমাকে নিয়ে আমি যখন পালাচ্ছিলাম, তুমি লোহার ছুরি দিয়ে আমার কপালে ঠিক এইখানে মারলে?
কপালের দিকেই রুমা একদৃষ্টি তাকাইয়া ছিল। আমার মনে ছিল না যে, কপালের ঠিক ঐ স্থানটিতেই আমার একটা রক্তবর্ণ জড়ুল আছে। কপালে হাত পড়িতেই স্মরণ হইল, নিজেই চমকিয়া উঠিলাম। বহু পূৰ্ব্বজন্মে যেখানে রুমার ছুরিকাঘাতে ক্ষত হইয়াছিল, প্রকৃতির দুর্জেয় বিধানে ইহজন্মে তাহা রক্তবর্ণ জড়ুলারুপ ধরিয়া দেখা দিয়াছে! রুমা সেই চিহ্নটার দিকে নির্নিমেষনেত্ৰে চাহিয়া হঠাৎ চিৎকার করিয়া আমার বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, গাক্কা! গাক্কা?
গাক্কা! হাঁ, ঐ বিকট শব্দটাই তখন আমার নাম ছিল। বজ্রকঠিন বন্ধনে তাহাকে বুকের ভিতর চাপিয়া লইলাম, বলিলাম, হ্যাঁ, গাক্কা—তোমার গাক্কা। চিনতে পেরেছ, রুমা! ওঃ, আমার জন্মজন্মান্তরের রুমা!
কতক্ষণ। এইভাবে কাটিল, বলিতে পারি না। এক সময় সযত্নে তাহার মুখখানি বুকের উপর হইতে তুলিয়া ধরিয়া দেখিলাম,–রুমা মূর্ছা গিয়াছে।