৪. সুমনার দীক্ষা সমারোহ
সুমনার দীক্ষা সমারোহ দেখার জন্য গিয়েছিল রাহুল । দেখল, যিনি ওকে দীক্ষা দিলেন, বেশ বুড়ো একজন গেরুয়াপোশাক, তিনি ওর মাথায় একজোড়া কাপড়ে-মোড়া বালা, যা নাকি সারদা দেবীর, তা ছোঁয়ালেন । রাহুলের মনে পড়ে গিয়েছিল ওর মকদ্দমার সময়ে পেশকারবাবুর টেবিলে রাখা লাল শালুতে আগাপাশতলা মোড়া একটা মোটা বই, যার ওপর হাত রেখে সাক্ষীরা সবাই সত্য কথা বলার শপথ নিত । সেই দুজন পুলিশ ইনফরমার, লিটল অপেরা সম্পাদক, যাদের ও সাক্ষ্যদানের আগে কোনো দিন দ্যাখেনি, তারাও বইটায় হাত রেখে শপথ নিয়েছিল । ওর বিরুদ্ধ-পক্ষের সাক্ষী প্রভাস চোঙদার, কামেশ্বর চোঙদার, প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে, চঞ্চলকুমারও শপথ নিয়েছিল বইটায় হাত রেখে । যেদিন ওর মকদ্দমা শেষ হল, রাহুল জিগ্যেস করেছিল পেশকারবাবুকে যে লালশালুতে মোড়া ওটা কী বই ? পেশকারবাবু কেবল একখানা রহস্যময় হাসি একান থেকে ওকান ছড়িয়ে ওনার কয়েকটা সোনালি দাঁত দেখিয়েছিলেন ।
রাহুলের সেই কর্ডুরয় প্যান্টটা এখনও আছে, কখনও সেলাই বাড়িয়ে, কখনও সেলাই কমিয়ে, কোমরের চরিত্র যেমন-যেমন বদলেছে ।
এখন, সত্তরে পৌঁছে, স্মৃতি খুঁটে, যখন এমিলিয়া বনিয়ার মুখ, রাণোর মুখ, তহমিনা আপার মুখ, অঞ্জলির মুখ, সুরেখা রেড্ডির মুখ, মীরা ব্যানার্জির মুখ, ও, রাহুল, হুবহু মনে করতে পারেনা, এক-একটা ভাসা-ভাসা মুহূর্ত কেবল ভেসে ওঠে, এত কিছু পড়ে ফেলেছে, এত অভিজ্ঞতা জমিয়ে ফেলেছে, অতীতকে বানিয়ে ফেলা সহজ । বানিয়ে ফেলতে হয়, টুকরো টুকরো দিয়ে গড়ে, খাপচা-খাপচা । সুমিতাদি বলেছিলেন, তোর জীবনের সবকটা মেয়েকে এক নামে লীন করে ফ্যাল, আর সেই নামকে নিয়ে নতুন-নতুন অপেরা লেখ, আর হ্যাঁ, তাতে তোর সুমিতাদিকেও রাখিস কিন্তু, ভুলে যাসনি যেন । রাহুল নতুন নাম পেয়ে গেল, আচমকা, ভিলে পারলের মাছের বাজারে, যখন এক বাঙালি যুবতী ওকে বলে উঠল, স্যার, আপনিই তো রাহুল সিংহ, আমি আপনার লেখা পড়ি, বেশ ভালো লাগে আপনার প্রিডেটর ডটপেন ।
–প্রিডেটর ? হিমালয়ের তরাইয়ের সেই বাঘিনীকে মনে পড়ল রাহুলের ; তার পারফিউমে ঢাকা গন্ধ ।
–হ্যাঁ স্যার, বাংলায় তো প্রিডেটর অপেরা-লেখক আর কেউ নেই ।
–থ্যাংকস । তোমার নাম কি ?
–অবন্তিকা ।
যুবতীটি চলে যাবার পর বাড়ি ফিরে অবন্তিকাকে নিয়ে অপেরা লেখা আরম্ভ করেছিল রাহুল । প্রথম যে অপেরা লিখেছিল, ‘ব্লাড লিরিক’ শিরোনামে, মনে আছে আজও :
অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কী করেছি কবিতার জন্য আগ্নেয়গিরিতে নেমে ?
একি একি ! কী বেরোচ্ছে বাড়ি সার্চ করে
কবিতায় ? বাবার আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে মায়ের তোরঙ্গে ছেঁড়া বিয়ের সুগন্ধী বেনারসি
কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস নথি করা আছে
কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা ঢেউ চিরে হাড়মাস চিবোচ্ছে হাঙর
কবিতায় । পাকানো ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
কবিতায় । অস্হিরতা ধরে রাখা পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে ভাসছে কচি বেশ্যা-দেখা আলো
কবিতায় । বোলতার কাঁটাপায়ে সরিষা-ফুলের বীর্যরেণু
কবিতায় । নুনে-সাদা ফাটা মাঠে মেটেল ল্যাঙোট ভুখা চাষি
কবিতায় । লাশভূক শকুনের পচারক্ত কিংখাবি গলার পালকে
কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট ভিড়ে চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো-কালো মড়া চিৎকার
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরলে না কেন
কবিতায় । মুখে আগুন মুখে আগুন মুখে আগুন হোক
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো
কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
কবিতায় । যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কবিতায় , অবন্তিকা তোর খোঁজে সার্চ হল, তোকে কই নিয়ে গেল না তো !!
একজন মানুষকে, নিজেকে যে কিছু-একটা হয়ে উঠতে হয়, সে যে একজন সাবজেক্ট, সাবজেক্টের বিপরীতে যে অবজেক্ট জগৎসংসার, এ-সমস্ত ভাবনাচিন্তা, রাহুল যে পরিবারে, পাড়ায় আর পরিবেশে ছোটোবেলায় কাটিয়েছে, সেখানকার লোকেদের ছিল না । ছোটোবেলায়, আর তার পরেও অনেককাল পর্যন্ত ও জানত যে একজন মানুষের নানারকম প্রয়োজন মেটাবার দরকার হয়, আর সে-সব প্রয়োজন মেটাবার জন্য তাকে নানা উপায়-ফন্দিফিকির খুঁজতে হয় । এই কাজটা তার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । এর বাইরে, লোকটাকে নিজেকেই কিছু একটা হয়ে উঠতে হবে, সেরকম ধ্যানধারণা বা শিক্ষা, রাহুলের বাবা-জ্যাঠামশায়ের বা প্রতিবেশীদের কারোর কাছ থেকে পায়নি । কিছু জিনিসপত্র পেলে ভালো হয়, অমুক কাজটা বড়ো হয়ে করতে পারলে ভালো হয়, এমন ইচ্ছে পেয়ে বসত বটে পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে ।
চেতনা একটা নির্মিত ব্যাপার, একটা কন্সট্রাক্ট । কেউ যদি জীবনে কিছু একটা হবার আকাঙ্খা পোষণ করে তো ওটা নির্মিত, ওটা কন্সট্রাক্টেড ; অবজেকটিভ জগতটি দ্বারা নির্মিত । কিন্তু যে বাস্তবতাকে একজন লোক প্রত্যক্ষ করছে, রাহুল করছে, সেটিও কোনো না কোনো মাধ্যম আশ্রয় করেই পৌঁছোচ্ছে । ভাষার মাধ্যমে, অবধারণার মাধ্যমে, বস্তুনামের মাধ্যমে, চিহ্ণ বা ছবির মাধ্যমে । মাধ্যমের দ্বারা নির্মিত, কন্সট্রাক্টেড । রাহুলের হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা, তার মানে, মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয় । যেহেতু নির্মিত, তাই অবিরাম নির্মিত হতে থাকে । যা অবিরাম পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, তার আবার হয়ে ওঠে কেমনতরো ! কেউ কি প্রিডেটর হয়ে ওঠে ?
অঞ্জলির গল্পের মতন । অশান্তি সৃষ্টি করে উধাও হয়ে যাবার কাহিনি । রাহুল বলল, তোর বর কি স্মাগলার হয়ে উঠেছে ? তুই কি স্মাগলারের বোষ্টুমি হয়ে উঠেছিস ?
পার্স দেবার জন্য আলমারি খোলার সময় রাহুলকে তিনটে সোনার বিস্কুট দেখিয়েছিল অঞ্জলি, বেশ ভারি ; বলেছিল সাত ভরির হয় এগুলো । সোনা ! সোনার বিস্কুট দেখে গলায় শ্লেষ্মা জমে গিয়েছিল রাহুলের । হাতে তুলে নিলেও, তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়েছিল । হয়ত গিলে ফেলে, পরে গু থেকে বের করেছে এরা । ধুলেও, গু-এর মাইক্রোবস কি সহজে যায়, তাও স্মাগলারের গু । কিংবা অঞ্জলির গু-ও হতে পারে । গু থেকে বের করা সোনা দিয়ে হয়তো কারোর বিয়ের আংটি তৈরি হবে । প্রাক্তন প্রেমিকার গু থেকে পাওয়া সোনা গলিয়ে বিয়ের আংটি !
–আঙুলের ছাপের ভয় পাচ্ছিস ? কানপুরের বাড়িতে, বাথরুমে, শাওয়ারের তলায় তো তিন লক্ষ শিশু আমার স্তনমণ্ডলির দিকে উড়িয়ে যাবি বলেছিলি, অথচ আজ ওড়াতে পারলি না, তাদের কয়েকটার স্বপ্ন কি আর আমার নাইটি
ধরে ঝুলছে না ভাবছিস ! তুই সেরকমই থেকে গেলি, নাইভ, ইররেসপনসিবল, উচ্চাকাঙ্খাহীন, ম্যাদামারা, লক্ষ্মীটি-মার্কা, বেসিকালি কাওয়ার্ড । হয়ে উঠতে চাস না ।
— রাতটা থেকে যাব ? এখান থেকেই ট্রেনিং সেন্টারে চলে যাব সকালে ? তোর সঙ্গে জাস্ট একটু সময় কাটিয়ে
নেয়া । নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কয়েকটা মিথ্যা কথা বলে ফেলল রাহুল ।
জড়াজড়ি করতে চেয়েছিলিস, পেয়েছিস । আমি চেয়েছিলাম, পেলাম না । বারবার চাইবার কী আছে ? লোকে ঘরকুনো হয়, তুই মনকুনো । কুঁকড়ে ল্যাজ গুটিয়ে পিছিয়ে গিয়ে, আবার চাই চাই চাই চাই করাটা বাচ্চাদের মানায় ; তুই তো এখন একটা লোক । ইম্যাজিন ? লোক ! এ কাওয়ার্ড জেনটলম্যান, প্রোব্যাবলি উইথ ডিসফাংকশানাল সেক্স ।
–তুই কিন্তু আমায় একজন নতুন নারীকে পাইয়ে দিলি ।
–নতুন নারী ? নারী ? কীরকম শুনি । নারী শব্দটা কেমন যেন নোংরা মনে হয় । নারী শুনলেই চোখের সামনে একজন উলঙ্গ পেটমোটা ভারিবুক ভারিপাছা মাগির ছবি ভেসে ওঠে । এনিওয়ে, বল..
–জীবনানন্দ দাশের নাম শুনেছিস তো ?
–ওই বনলতা সেনের কবি ? পড়িনি, শুনেছি ।
–হ্যাঁ । বনলতা সেন কেবল জীবনানন্দেরই ছিল । সতীসাধ্বী, টাচ-মি-নট, ওয়ান-ম্যান-উওম্যান ।
–আমার লেখার নারী…..
–জানি, শি ইজ আ বিচ ! ইয়েস, আই নো হু আই অ্যাম ।
–হ্যাঁ, আমার লেখার নারী সতীসাধ্বী নয়, ওয়ান-ম্যান-উওম্যান নয়, সে পাঠকের সঙ্গেও শুতে পারে, আলোচকের সঙ্গেও ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে রাত কাটাতে পারে, সে স্মাগলারের বোষ্টুমি হতে পারে, নিজের শরীরকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারে, সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ।
–কারেক্ট, আমি এরকমই । প্রশ্ন হল যে তুই সেরকম নারী চাস কিনা ।
–কে বলল তুই আমার অপেরার নারী ? আমার কল্পনাকে জবরদখল করার চেষ্টা করছিস তুই । আমি আমার অক্ষরের নারীকে বলব না, ওইখানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে ।
–সেটাই তো হওয়া উচিত । জীবনানন্দের বনলতা সেন কি ওনার স্লেভগার্ল ছিলেন ? কবিরা নিজেদের কবিতায় এরকম স্লেভগার্ল পুষতে চায় কেন বলতো ? হিংসুটে ছিল লোকটা । প্রেমের কবিগুলো এরকম হিংসুটে হয় কেন ? প্যাট্রিয়ার্কাল? শেকসপিয়ার তাই ওনার বয়ফ্রেণ্ডকে নিয়ে সনেট লিখেছেন । পণ্ডিচেরিতে, আই মিন আশ্রমের গেস্টহাউসে, একটা কাপল ছিল, পুরুষ কাপল ।
–তোকে খুঁজে পেয়ে আমি রিডিফাইন করতে পারলুম আমার অক্ষরের নারীকে । আমার পাঠকদের, যে পাঠকই পড়বে, , তার বিছানায় আমার কল্পনার নারীকে ছেড়ে দেব ।
–নো প্রবলেম, এনি ডে । লেখিকাদেরও উচিত তাদের কল্পনার পুরুষদের অমন স্বাধীনতা দেয়া । অবশ্য পুরুষগুলোকে স্বাধীনতা দেবার দরকার হয় না, ওরা জন্মগতভাবে লেচার, তোর মতন ।
অঞ্জলির এই সান্নিধ্যের রেশ রাহুলের কলমে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে একটা লেখায়, আর সেই রচনাটার জন্যই ওকে নিয়ে টানাটানি হয়েছিল ; ওর কয়েকজন বন্ধুও বিপদে পড়েছিল, এমনকি দাদা অনিকেত, যিনি প্রকাশক ছিলেন, তিনিও । লেখাটা কিন্তু ছিল অত্যন্ত কুল ক্যালকুলেটেড একটা রচনা , সাপের ঠান্ডা রক্ত কলমে ভরে লেখা, আদ্যন্ত নিরীক্ষামূলক । প্রায় একমাস ধরে শব্দ খুঁজে, বাক্য গঠন করে, লিখেছিল । চেয়েছিল বাংলা ভাষায় ভিন্ন সংবেদের প্রসারণ, চেয়েছিল তৈরি-কথার ছবিতে স্পিড বা গতি আনতে, একটা লাইন থেকে আরেকটা লাইনকে, এই সমাজের মানুষগুলোর মতনই, আলাদা ব্যক্তিত্বের ছবি পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল।
অঞ্জলির বাড়ি থেকে রাহুল ট্রেনি হোস্টেলে ফিরতে পারেনি, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে পুলিশ ব্যারিকেডের জন্য । মিছিল থামাবার জন্য ব্যারিকেড । ডালহাউসি চার ধার থেকে বন্ধ । বাস পোড়ানো হয়েছে, শুনল । অমর বসু, রাম চ্যাটার্জি, চিত্ত বসু, মাখন পাল, মোহিত মৈত্রদের নাকি লাঠিপেটা করা হয়েছে । পেছনের স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে হাওড়ায় পৌঁছে শেওড়াফুলির লোকাল ট্রেন ধরল, ঠাকুমার আশ্রয়ে রাতটা কাটাবার জন্য । প্রচুর গল্প আছে সবাকসুন্দরীর স্টকে, সেকালের কলকাতার বাবু-বিবিদের কেচ্ছা ।
বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে ক্রিয়েটিভ লেখালিখি । ব্যাপারটা অদ্ভুত । লেখালিখি নিয়ে ব্যবসা করলে তা হয়ত হয় না, ব্যবসাদার-ব্যবসাদার ভাই-ভাই পরিবেশ থাকে, ব্যবসাদারি লাভের প্রতিযোগীতা থাকে ।
ক্রিয়েটিভ লেখালিখি, এমনকি অমন লেখালিখির পত্রিকা সম্পাদনা করলেও, বন্ধুদের শত্রু করে তুলতে পারে । ওর লেখালিখির জন্য যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপতারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল, তারা সকলেই ওর শত্রুতে রূপান্তরিত ,
কেউ-কেউ তখনই, কেউ আবার পরে, কেউ অনেক পরে যখন চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে ।
লালবাজারে অনিল ব্যানার্জি নামের ইন্সপেক্টার, যে পরে নকশাল খতমকারী হিসাবে সরকারি যশ পেয়েছিল, তার জেরায়, রাহুলের সামনেই, কেঁদে ফেলেছিল প্রভাস চোঙদার বা জুনিয়ার চোঙদার আর কামেশ্বর চোঙদার বা সিনিয়র চোঙদার। দু’জনে চুপচাপ যে মুচলেকা লিখে দিয়েছে, আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করেছে , আন্দোলনের মতের বিরোধী , তা লিখে জানিয়েছে, তা তো বহুকাল পরে, ওকে যখন চার্জশিট দেয়া হল, তখন জানতে পেরেছিল রাহুল । রাহুলের উষ্মার বিষে ওরা রূপান্তরিত হল যদুবংশের মিথ্যাবাদি চোঙদারে ।
রাহুলের যে আগাম সন্দেহ হয়নি তা নয় ; একদিন লালবাজার থেকে, ভবদেব মিত্র আর ওর বন্ধুনি রোশনির সঙ্গে হাওড়া স্টেশানে গিয়ে সিনিয়ার চোঙদারকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে নামধরে চেঁচিয়েছিল ; ওকে দেখতে পেয়ে কামেশ্বর চোঙদার দৌড়ে গিয়ে, উঠে পড়ল, প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে যে ট্রেনটা, তাতে । ভবদেব আর রোশনির আগ্রহে রাহুল সেদিন তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের ওপর দাড়িয়ে সেই লেখাটাই পড়েছিল, যেটা নিয়ে মকদ্দমা চলছিল । কত লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কী ঘটছে দেখার জন্য, কেউ-কেউ হয়তো বক্তৃতা শোনার জন্য । তার আগে ভবদেব ঘড়ির তলায় দাঁড়িয়ে নিজের ‘হত্যাকাণ্ড’ নামের লেখাটা পড়েছিল । এখন, প্রায় পাঁচ দশক পর, হাওড়া স্টেশানে পা ফেলার জায়গা নেই, কারোর সময় নেই অন্যদিকে তাকাবার, সকলেই দৌড়োচ্ছে, যাচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে । কত ফাঁকা থাকত তখনকার দিনের হাওড়া স্টেশান ।
শেয়ালদা ফাঁকা থাকত না ; সেখানে তখন অসহায় রিফিউজিদের ক্রুদ্ধ সংসারের ধ্বংসাবশেষ ।
যদুবংশের চোঙদার শুনে হরিচরণ খাঁড়ার, না, সেসময়ে নয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে, রাহুলের ওপর গোঁসা উথলে উঠেছিল । সেসময়ে তো ও চোঙদারদের ওপর খাপ্পা, ওদের অপেরায় ওকে কোনো ভূমিকা দেয়া হয়নি বলে।
রাহুলদের আন্দোলনকে টিটকিরি মেরে, একটা ফিলমে, নামকরা পরিচালক, আন্দোলনের অপেরা-নটের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ; সেই ফিলমে কয়েকজন আন্দোলনকারীর নাম নায়ক উচ্চারণ করলেও, হরিচরণের নামটা করেনি , ফিলমের লেখক নির্ণয় নিতে পারেননি যে তিনি হরিচরণ খাঁড়ার নাম উল্লেখ করবেন না কি দুর্গা বর্মণের । হরিচরণের ধারণা দেড় হাজার মাইল দূর থেকে রাহুলের কলকাঠি নাড়ায় ওর নাম বাদ গেছে । রাহুল তো একে-তাকে বাদ দেবার যে প্রথা আগেকার নট্ট কোম্পানিরা পত্তন করেছিল সেই প্রথাকেই বর্জন করতে চেয়েছিল।
যখন রাহুলের লেখাটা নিয়ে বিচার চলছিল, আর রাহুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে কাঠগড়ায় উঠেছিল জুনিয়ার চোঙদার, রাহুলের পেছনের গরাদের খাঁচার ভেতর থেকে একজন বিপজ্জনক আসামি ওকে বলেছিল, ‘তুমহারে ধন্দে কা আদমি তুমহারে খিলাফ গবাহি দে রহা হ্যায় ? ছোড়না মত । ভুন দেনা সালোঁকো । কাহাঁসে পকড়কে লায়ে থে ইন চুতিয়োঁকো তুমহারে ধন্দে মেঁ !’
জামিনে ছাড়া ছিল বলে রাহুল দাঁড়াত লোহার গরাদের খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে, আর পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকত বিপজ্জনক আসামিরা, যারা জামিন পায়নি, ডাকাতি খুন ইত্যাদির অপরাধে আটক । ওর মামলা নিয়ে প্রায়ই মন্তব্য শুনত খাঁচার ভেতর থেকে, কর্কশ কোনো উত্তেজিত কন্ঠের । রাহুলের উদাসীনতার ব্যাখ্যা বোধহয় খুঁজে পেতো না তারা ।
ধান্দা !
লেখালিখি, শেষ পর্যন্ত, সত্যিই ধান্দা হয়ে গেল ! পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এরকম সন্দেহে আক্রান্ত হয়েছে রাহুল সিংহ। ক্রিয়েটিভিটি কি ধান্দাবাজি ? তাহলে দূরত্ব তৈরি করে তা বজায় রাখাটাই এখন প্রধান কাজ । ধান্দা থেকে দূরে। সম্বর্ধনা পুরস্কার ইত্যাদি যাবতীয় জমঘট থেকে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, একক অস্তিত্ব নিয়ে, নিজের নির্জনতাকে আগলে ।
কানপুরের ফৌজদারি আদালত জামিন দিয়ে হুকুম দিয়েছিল কলকাতায় গিয়ে ম্যাজিসট্রেটের সামনে সারেনডার করতে । সারেনডার মানে যে ফৌজদারি আদালতের প্রথম ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে উকিল-মুহুরি-অপরাধীদের গিজগজে, পা রাখার জায়গা নেই এমন ঠাসাঠাসি ঘেমো ভিড়, সে ধারণা ছিল না রাহুলের ; উকিল দরকার ।
পিসেমশায় ওনার বড় ছেলে দুর্জয়, মানে ,ঝন্টুর মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছেন যে ওনার একজন পরিচিত উকিল আছে । ফৌজদারি আদালত-বাড়িটা যে এরকম ভুলভুলাইয়া, বাড়িটার বিভিন্ন ঘরে ছড়ানো তেরো-চোদ্দোটা এজলাস, তা এক নম্বর এজলাসের প্রধান বিচারক রাহুল-অনিকেতকে জামিন দিয়ে, বিচার প্রার্থনার জন্য নয় নম্বর এজলাসের
চশমাচোখ বিচারকের কাছে না পাঠালে, পোড়ো হাভেলির ভাঙা দরোজাগুলো মেলাতে পারত না রাহুল । পরে, বামপন্হীরা মসনদে বসার পর যখন ওনাদের এদিক-ওদিকে তাকাবার ফুরসত হল, বাড়িটার হাল ফিরিয়েছে ।
সে-সময়ে, যখন রাহুলের বিচার চলছিল, বাড়িটা ছিল নরকের কলকাতিয়া ভার্সান । বহু বামপন্হী নেতাকে আসতে
হতো আদালতটায়, যখন তারা বিরোধী পক্ষে ছিল । মসনদে বসার পর সারিয়ে , ওপরতলাটা তাদের প্রিয় লালরঙে রাঙিয়ে, পুরো না হলেও, অনেকটা ভোল পালটিয়ে দিয়েছে ।
কলকাতায় মাথা গোঁজবার ঠাঁই বলতে পিসেমশায়ের বাড়ি । তিন মেয়ে আর ছয় ছেলে নিয়ে একটা ছোট্টো ঘরে থাকেন উনি, খাটের তলাতে শুতে হয় ওনার বাড়ি গেলে, সকাল থেকে হাগবার লাইন লাগে, গামছা পরে স্নান করতে হয় চৌবাচ্চার ধারে দুতিনজন মিলে । অবিরাম জল পড়ে-পড়ে চৌবাচ্চার চারপাশ এমনই পেছলা যে এক হাতে চৌবাচ্চার পাড় আঁকড়ে, আরেক হাতে ঘটি নিয়ে স্নান ।
পিসেমশায় অনিকেত-রাহুলের গ্রেপ্তার হবার খবর পেতেই জানিয়ে এসেছিলেন নিজের শাশুড়িকে, মানে, রাহু-কেতুর ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীকে । তাঁর প্রিয় নাতি কেতুর গ্রেপ্তারের সংবাদে ঠাকুমা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন । কলেজে পড়ার সময়ে কেতু তাঁর সঙ্গেই থাকত, শ্যাওড়াফুলির ভেঙে-পড়া জমিদারবাড়িতে, চিলেকোঠার ঘরে । হার্ট অ্যাটাকের তৃতীয় দিনে মারা গেলেন । উনি মারা যেতে কানপুর থেকে বাবা-জ্যাঠা-কাকারা সবাই জড়ো হলেন শেওড়াফুলির খণ্ডহরে ।
ভাগ্যিস ঠাকুমাকে আগেই লেখাটা পড়ে শুনিয়ে ছিল রাহুল । খালি গায়ে, কোমরে গামছা ঝুলিয়ে, মুখময় ফিকফিকে হাসি মাখিয়ে, শুনেছিলেন ঠাকুমা । শুনে জানতে চেয়েছিলেন, এটা তোর মোচরমান মেয়েটা তো নয়, এ আবার কারা-কারা, বলিসনিতো ; অমন শক্ত-শক্ত কথা লিখিছিস, তা লোকে পড়ে বুঝতে পারবে তো ?
–লোকে বলেছে অশ্লীল ।
–তার মানে ?
–নোংরা-নোংরা ।
–তা নোংরা ব্যাপারটা কি ব্যাটাছেলেদের একচেটিয়া ?
অনিকেত আর ও গ্রেপ্তার হতে, বাবা-কাকা-জ্যাঠা আর মা-কাকিমা-জেঠিমা সবাইকে শোনাতে হয়েছে । সকলেই জানতে চেয়েছেন এরা কারা-কারা, কখন ভাব-ভালোবাসা করলি এতজনের সঙ্গে, ইশকুলের না কলেজের, না ওই সুমিতার দলের ? ঠিক জানি সুমিতাই লেলিয়ে দিয়েছে ওর দলের কয়েকটাকে, না রে ? একে নিজে সুন্দুরি, তায় আবার সুন্দুরি মেয়েদের মোচ্ছোব । সবকটা মেয়েই কি বেমমো ?
বড়-জ্যাঠা বললেন, মা মারা গেল বলে তোরা নিজেদের দায়ি করিসনি । আমাদের পরিবারে সেই সুলতানি আমল থেকে প্রত্যেকটা প্রজন্মে কেউ না কেউ গ্রেপ্তার হয়, মামলা হয়, ভোগান্তি হয় ; আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলুম, আমার কাকা গ্রেপ্তার হয়েছিল, আমার দাদুর ভাই গ্রেপ্তার হয়েছিল । বড়-জ্যাঠার কথাগুলো, অনেককাল পর, যখন ওর ভাইপো, অনিকেতের বড় ছেলে গ্রেপ্তার হল, তখন মনে পড়ে গিয়েছিল । বংশের রক্তেই তো শাসক-বিরোধিতা ।
ন্যাড়া শুধু বড় জ্যাঠা হয়েছিলেন । অন্য ভাইদের বলেছিলেন, তোদের আর বুড়ো বয়সে খোট্টাদের মতন সবাই মিলে ন্যাড়া হবার দরকার নেই ; রাহু-কেতুর মামলায় কোর্টে কি ন্যাড়ার দল যাবে ?
সবাকসুন্দরী দেবী আগাম না জানিয়ে মারা যাওয়ায়, রাহুলের বাবার মুখ গোমড়া । হেস্তনেস্ত করা হল না । খণ্ডহরের ট্যাক্স, দাদু মারা যাবার পর থেকে দিয়ে এসেছেন বাবা । ঠাকুমা মারা যেতে, ঘোষণা করে দিলেন, শোকসভাতেই, যে, আর উনি ট্যাক্স দেবেন না, এই পোড়ো-বাড়ি সম্পর্কে ওনার কোনো আগ্রহ নেই । ‘’যে জমিটা কোতরঙে মার নামে কিনেছিলুম, মা না জানিয়ে ওটা বিশেকে লিখে দিলে, ভেবেছিলুম বুড়ো বয়সে দেশে ফিরে থাকব, তা আর হল না ।’’ বিশে সবচেয়ে ছোটো ভাইয়ের নাম । নিঃসন্তান বিশে, পরে, সে জমি লিখে দিয়েছিল নিজের শালার মেয়ের নামে । শালার মেয়ে সে জমি বেচে দিয়ে, বিশে আর বিশের বউকে নিয়ে চলে গেছে কোন্নোগর।
শোকসভায় বিশে আর বিশের বউ অনুপস্হিত । ছোটোকাকা বিশেখুড়ো, ছেলেপুলে হয়নি বলে, শালার মেয়েকে পুষ্যি নিয়েছিলেন । যৌবনে বেশ যৌনরোমান্টিক ছিলেন রাহু-কেতুর বিশেখুড়ো । সবাকসুন্দরী দেবীকে দিয়ে জমি লিখিয়ে নেবার পর, যখন কানপুর ছেড়ে হঠাৎ কোতরঙে চলে গেলেন, তখন ওনার বাক্স-প্যাঁটরা সবই পড়েছিল ওনার কানপুরের ঘরে, বহু বছর, হয়তো কখনও আসবেন, এই আশায় তাতে কেউ হাত দেয়নি । কলকাতার পুলিশ রাহুকেতুর মা-বাবার আলমারি-তোরঙ্গ ভাঙার সময় ভাগ্যিস বিশেখুড়োর বন্ধ ঘরে রাখা ওনার জিনিসপত্রে হাত দেয়নি । দিলে,
ওনার তোরঙ্গের তালা ভাঙলে, যা বেরোতো তা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ত ।
কানপুরের বাড়ির পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করার নির্নয় নেয়া হলে, বিশেখুড়োর জঙধরা তোরঙ্গ ভাঙার পর,
পুরোনো জামা-কাপড়ের তলায় পাওয়া গিয়েছিল একটা পেটমোটা ফোটো-অ্যালবাম । অজস্র শাদা-কালো ফোটো, সবই
বিশেখুড়োর বউয়ের, নানা আঙ্গিকে, সম্পূর্ণ নগ্ন । আদর্শ নগরের বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন, বিশেখুড়ো আর ওনার বউ ঝিমলিকাকিমা, থাকত নির্মীয়মান বাড়িতে, দুজনে মিলে রাজমিস্ত্রি-ছুতোরদের কাজ তদারক করার জন্য । রাতে, ফ্ল্যাশলাইটে, সেই বাড়িতে, পঁচিশ বছর বয়সী ঝিমলি-বউয়ের ফোটো তুলত বিশেখুড়ো । বিশেখুড়োর কল্পনার অপ্সরাদের নগ্ন প্রতিমা বিশেখুড়োর বউয়ের নানা আঙ্গিকে ধরে রাখা । গ্রিক দেবীদের মতন, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা তেলরঙা নিউডের মতন অ্যান্টিক সোফায় আধ-শোয়া, গায়ে রবারের কালো সাপ জড়ানো ইভ বাঁহাতে আপেল ধরে আছে । কল্পনাকে যতটা অবাস্তব করে তোলা যায় ।
দুর্জয় ওরফে ঝন্টুদা ফোটোগুলো দেখতে পেয়ে, বলেছিল, চল বাইরে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে ফেলতে হবে । বাড়ির লোকেরা জানলে কেলেঙ্কারি ; বাইরের লোকেরা টুকরো-টাকরা দেখলেও টের পাবেনা ।
—জ্বালাবে তো ছিঁড়ে জ্বালিয়ে ফেলো, একটা-একটা করে অতক্ষণ কী দেখছ ?
–দেখছি, অমন সুন্দরী ছিল তো বাচ্চা হল না কেন । তুই রাজকাপুর-নার্গিসের ফিলিম দেখেছিস ?
–বরসাত দেখেছি ।
–ঝিমলিমামি হুবহু নার্গিস ।
–দেখা তো হয়ে গেছে, এবার ছিঁড়ে জ্বালিয়ে ফেল ।
–শালা, আগে যদি এগুলো পেতুম তো বিশেমামাকে ব্ল্যাকমেল করে দিদিমার জমিটা আমার নামে লিখিয়ে নিতুম।
–যাকগে, এবার নষ্ট করে ফেল ।
–করছি, করছি, একটা রেখে নিলুম, যদি কখনও ব্ল্যাকমেল করার চান্স পাই, বলা তো যায় না ।
ঝণ্টুদা একটা রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলেছিল ।
পিসেমশায় ওনার বড় ছেলে দুর্জয় ওরফে ঝন্টুকে নিয়ে অনিকেত-রাহুলদের সঙ্গে গেলেন ওনার পরিচিত ফৌজদারি উকিলের বাড়ি । উকিলের বাবাও উকিল ছিলেন, তাঁর বাবাও উকিল ছিলেন । বাড়িতেই ওনার বিশাল অফিসঘর, চারিদিকে কাচের আলমারিতে ঠাসা মোটা-মোটা আইনের বই, সোনালি আর রুপোলি অক্ষরের কোমরবন্ধ-পরা । উকিলবাবুর পশার নিশ্চয়ই ভালো । চেয়ারে, বেঞ্চে, নানা কিসিমের মানুষ-মানুষী । মেঝেতেও দেয়ালে ঠেসান-দিয়ে বসে আছে বেশ কয়েকজন ওথলাবুক-যুবতী আর ক্লান্ত পৌঢ়া, যাদের পোশাক দেখে গরিব বলে মনে হল রাহুলের ।
উকিলমশায়ের চশমাচোখ নির্দেশে ওরা বসল ওনার বিশাল টেবিলের ডানধারে । কনুইয়ের খোঁচা মেরে ঝন্টুদা রাহুলকে ইশারা করছিল জানালার বাইরে কারোর দিকে । রাহুল বিরক্ত হচ্ছিল তাতে । অনিকেত গম্ভীর ।
পিসেমশায়কে মুখ তুলে দেখতে পেলেন উকিলমশায়, বললেন, কী হল পাঁচকড়ি, আবার তোমার ছেলে কুকম্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে ? আগেই বলেছিলাম যে বিয়ের বয়স হতে চলল, দিয়ে দাও, এই বয়সে শরীর ছোঁক-ছোঁক করবেই ।
পিসেমশায় কোনো চটপট জবাব দিচ্ছেন না দেখে উকিলমশায় বললেন, কী হল, তোমায় ধরেছে নাকি ? তোমাকে তো সব্বাই চেনে এ-পাড়ায় ; আমি তো বলেও দিয়েছি যাতে তোমাকে অযথা হেনস্হা না করে ।
ঝন্টু বলল, জেঠু, কেসটা আমার মামাতো ভাইদের । ওরা ওই অপেরা-টপেরা লেখালিখি করে তো, লালবাজারে আলিপুর-বালিগঞ্জের বড়োবড়ো-বাঙালিরা নালিশ ঠুকেছে ওদের লেখার বিরুদ্ধে । ওরা অ্যারেস্ট হয়েছিল, জামিনে ছাড়া পেয়ে কলকাতার ফৌজদারি আদালতে সারেনডার করতে এয়েচে ।
–আরে সরকারের বিরুদ্ধে আর লেখা কেন ? দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে । প্রফুল্ল সেন এমনিতেই সেমসাইড গোল দিয়ে চলেছে ; ফাইল পড়ার সময় নেই, গপ্পের বই পড়বে কি পায়খানায় হাগতে বসে ?
–না, ওদের একশো কুড়ি বি আর দুশো বিরানব্বুইতে ধরেছে । ওরা মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে খামে ভরে পিচবোর্ডের মুখোশ দিয়ে এসেছিল, রাক্ষসের মুখোশ, তাতে ছাপিয়েছিল ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ । অনিকেতের পিসেমশায় বললেন ।
–পুলিশ কমিশনারকেও জোকারের মুখোশ পাঠিয়েছিল, বলে, ঝন্টু অনিকেতকে জিগ্যেস করল, আর কাকে-কাকে পাঠিয়েছিলিস রে ?
–সবাইকে, বলল রাহুল, একশো মুখোশ কিনে তার পেছনে স্লোগানটা ছাপানো হয়েছিল । তারপর যোগ করল,
সংবাদপত্র মালিক আর বুদ্ধিজীবীদেরও দেয়া হয়েছিল, কয়েকজন জেলা ম্যাজিসট্রেটকেও ।
–তাতে কী ! ও তো বেশ মজার খেলা বলতে গেলে । ইনটারেসটিং অ্যাক্টিভিটি । তাই বলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ? তার ওপর অশ্লীল ভাষায় রাষ্ট্রকে আক্রমণ ? দেখছ যে প্রফুল্ল সেন চালের যোগান দিতে, আলুর যোগান দিতে কুলিয়ে উঠছে না, রাজ্যপাট চালাতে পারছে না, কাঁচকলা খেতে বলছে । কারা কমপ্লেন করেছে কিছু জানা গেছে ? বড়োবড়ো-বাঙালি, বলেছ বেশ ।
–না, ওরা আজকেই এসেছে । আগে ওদের দিয়ে সারেনডারটা করিয়ে দিন । দুর্জয় ওরফে ঝন্টু বলল ।
–ওরা একটা আন্দোলন শুরু করেছে আর নানা বিষয়ে ইংরিজি-বাংলায় ইশতাহার ছেপেছে ; পলিটিশিয়ানদের বলেছে, বেশ্যার ডেড বডি আর গাধার ল্যাজের মিক্সচার । বলে, মুচকি হেসে, পাঁচকড়ি তাকালেন অনিকেতের দিকে ।
–পলিটিকাল ম্যানিফেস্টোতে আরও আটটা পয়েন্ট আছে, বলল অনিকেত ।
–রিলিজিয়ান নিয়েও একটা ইশ্তাহার বের করেছে, পাঁচকড়ি জানালেন উকিলকে ।
–এত কাণ্ড-কারখানা চলছে কলকাতায়, খবর পাইনি তো ! আমি কি বড়ো-বাঙালি নই নাকি ! অ্যাডভোকেট রুমেও কেউ তোলেনি ব্যাপারটা । মনে হচ্ছে গভীর পাঁকের জীবদের চটিয়েছ তোমরা । দলে তোমরা দুই ভাই না আরও সাঙ্গ-পাঙ্গ আছে ?
–আমরা তিরিশ-চল্লিশজন হবো ।
–তিইইইরিশ-চল্লিশ জন ? দলটার নাম কি ?
–সর্বভূক ।
–ভূক ? সর্ব ? ওব-বাবা । তাহলে প্রফুল্ল সেনের স্যাঙাতরা তো চটবেই । আঁতে ঘা দিয়েছ দেখছি । একে তো রিফিউজি পাবলিক রোজই ডালহাউসি অভিযান চালাচ্ছে, শহরে-শহরে মিছিল-মিটিং হচ্ছে, বাস-টাস পুড়ছে, তার ওপর তোমরা যদি ওনার গোদের ওপর কাঁইবিচি হয়ে উদয় হও, কেলেঙ্কারি কেস । গাধার ল্যাজ এবং বেশ্যার ডেড বডি, কারেক্টলি অ্যান্টিসিপেটেড ইম্যাজিনেশান বলতে হবে, তাদের কপুলেশান থেকে যদি পলিটিশিয়ানদের জন্ম দিতে হয় । আমার বাপ-ঠাকুদ্দাও এমন কেস লড়েনি ।
উকিলমশায় ওনার মুহুরিকে বললেন অনিকেত আর রাহুলের সই নিয়ে নিতে, ওকালতনামায় । অনিকেতকে বললেন, ওসব ইশ্তাহার-টিসতাহার, মুখোশ, লেখাপত্তর আর যা-যা করেছ, তার একখানা করে কপি আমার মুহুরির কাছে জমা দিও । কালকে সকাল নটায় ব্যাংকশাল কোর্টে পৌঁছৈ যেও । কোর্টটা কোথায় জানো তো ?
ঝন্টু বলল, আজ্ঞে আমি নিয়ে যাবো । জামিনদার হবার জন্য বাবাকে কী-কী নিয়ে যেতে হবে ?
–বাড়ির দলিল থাকে তো ভালো, তা নইলে ইনকাম সার্টিফিকেট এনো । দুজন আসামী তো, তাই আরেকজন জামিনদার যোগাড় করে এনো ।
ওকালতনামা সই করা হয়ে গেলে পিসেমশায় চলে গেলেন । ঝন্টু থেকে গেল অনিকেতদের সঙ্গে, ও অনিকেতের সমবয়সী আর ছোটোবেলাকার বন্ধু, এক সঙ্গে সাঁতরে গঙ্গা পারাপর করত । পিসেমশায় চলে যাবার পর, উকিলবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে, পথে নেমে, ঝন্টু বলল, ওই যে দেখছিস সামনের গলিটা , তোকে ওদিকে তাকাতে বলছিলুম, ওটাই সোনাগাছি ; যে মেয়েগুলো উকিলবাবুর চেম্বারে মেঝেয় বসে আছে, তারা সোনাগাছির, ওদের সঙ্গের লোকগুলো ফড়েবা ভেড়ুয়া , ওই যাদের বলে পিম্প, কোনো না কোনো মামলায় পুলিশ এদের ঝুলিয়ে দিয়েছে , টাকা খসাতে পারেনি, কতই বা রোজগার ওদের, বল ।
অনিকেত ঝন্টুকে বলল, শালা তুইও সোনাগাছি ট্রিপ মারিস , ধরাও পড়েছিস পুলিশের হাতে । বলিসনিতো ?
–বলব আবার কী ? বাবাও তো যায়, বাবা কি মামাদের কখনও বলেছে । মামারা জানে, আমার মাও জানে, তোদের ঠাকুমাও জানত । তোর রামায়ণ কোম্পানির বন্ধুদেরও চিনিয়ে দিয়েছি । আজ তো শনিবার, অপেক্ষা কর একটু, দেখতে পাবি কাউকে-কাউকে ।
কলকাতার আদালতের অভিজ্ঞতা ছিল না । কোথায় যে তা-ই জানত না রাহুল-অনিকেত । ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ‘সাক্ষী চাই ? সাক্ষী চাই ? এফিডেভিট করাবেন ?’ বলে চেঁচায় মক্কেল ফাঁসাবার ধান্দায় । একতলার সারাটা আদালত চত্ত্বর জুড়ে, যেখানে যে চিলতে মতন জায়গা পেয়েছে, টুলের ওপর রংচটা টাইপরাইটার রেখে ফটর-ফটর ট্যারা-বেঁকা টাইপ করে চলেছে রোগাটে খ্যাংরা বা ভেতো-পেট টাইপিস্টের কাতার । তাদের ঘিরে
চোপসানো-মুখ, আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন লিটিগ্যান্টের গ্যাঞ্জাম । নিচেতলার আদালত চত্তর জুড়ে তেলেভাজা, কাগজ-কলম,
অমলেট, ভাত-রুটির খুপরি-ঠেক । কোর্ট পেপার কেনার দীর্ঘ কিউ । ইংরেজরা যেসব বিহারিদের চাপরাসি-ঝাড়ুদার-আরদালির কাজ দিয়েছিল, তারা নিচেতলার প্রতিটি খাঁজখোঁদোল আর ফাঁকা পরিসর জবরদখল করে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার পেতে ফেলেছে । আদালত-বাড়ির পেছন দিকে শুকোয় তাদের শাড়ি শায়া ব্লাউজ বডিস জাঙিয়া ট্রাউজার স্কুলের ইউনিফর্ম শিশুর জামা । জেল থেকে জামিন না-পাওয়া খতরনাক দাগিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন ক্ষণিকের জন্য ভিড়টা সরে গিয়ে নিজের জমঘটে ফিরে আসে ।
বড় জ্যাঠা, নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে, কেতু-রাহুলের পিসেমশায়কে বলেছিলেন, পাঁচু, তুমি আর ফৌজদারি উকিল পেলে না ? রাঁঢ়-বাড়ির উকিল ধরালে ?
জবাবে কেতু-রাহুলের পিসেমশায় বলেছিলেন, ও উকিল আজ ওব্দি কোনো কেস হারেনি, ঠিক জিতিয়ে নিয়ে আসবে । চোখের সামনে খুন করল যে গুণ্ডা, তাকেই ছাড়িয়ে নিয়ে এলো, আর এ তো কোন ছার, দুচার-পাতা লেখা। আমার বিয়ের সময় তোমরা তুলতুলে কাগজে বিয়ের যেরকম পদ্য ছাপিয়েছিলে, এ সেরকমধারাই ব্যাপার ।
রাহুল-অনিকেতের জন্য বিচার্য নয় নম্বর এজলাসটা ওপরতলায়, সিঁড়ির প্রথম পাকের পর দ্বিতীয় । মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হবার আগে পর্যন্ত প্রভাস চোঙদার আর কামেশ্বর চোঙদারও নিজেদের উকিল নিয়ে এই এজলাসে হাজিরা দিয়েছে । সবাই যে-গাড্ডায় ও-ও সেই গাড্ডায় যুক্তিতে হরিচরণ খাঁড়া কোনো আলাদা উকিল করেনি । বাদবাকি যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপতারি পরোয়ানা ছিল, তারা আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে, অশোকনগর, আগরতলা, বিষ্ণুপুরে। বিচারকের মাথার ওপরের হলুদ টুনিটা ছাড়া জানলাহীন এজলাসে আলো ঢুকতে ভয় পায় । দুই-ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা, যার অবিরাম ঔপনিবেশিক কাতরানি অবসর নেবার অনুরোধ জানাতে থাকে উত্তরঔপনিবেশিক কর্ণধারদের ।
এজলাসের পেশকারকে সবাই গাংলিবাবু বলে ডাকে, যিনি চাকুরিতে যোগ দেবার সময় ছিলেন বলাই গঙ্গোপাধ্যায় নামের যুবক । রাহুলের বিচারের সন-তারিখে পৌঁছে উনি তেলচিটে কালো, মুষকো, সারাদিন বসে থাকার কুমড়োভুঁড়ি থলথলে আদল, চকচকে টাক, মোটা কালো ফ্রেমের বাইফোকাল, আর মেটে-ময়লাটে ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেই যুবকটির ধ্বংসাবশেষে রূপান্তরিত । কখনও হাসেন না । সারা কলকাতার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ নয় নম্বর এজলাসে বছরের পর বছর জমে-জমে ওনাকে চুবিয়ে রেখেছে তার সংমিশ্রণের দিনগত-পাপক্ষয়ী আরকে ।
পুলিশ কেবল রাহুলকে চার্জশিট দিয়ে, বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দেবার পর, জানা গেল, চোঙদারভাইরা মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছে বলে ওদের বিরুদ্ধে কেস তুলে নিয়েছে সরকার । ছাড়া পাবার আগে চোঙদাররা সরকারকে বলত প্রতিষ্ঠান ; ছাড়া পাবার পর খবরের কাগজ কোম্পানির সরকার ফ্যামিলিকে বলে প্রতিষ্ঠান । শুধু রাহুলকেই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে দেখে ওর বলিয়ে-কইয়ে বন্ধুরা শিস দিতে-দিতে হাওয়া । রাহুল-অনিকেতকে অবাক করে চার্জশিটের সঙ্গে রাহুলের বিরুদ্ধে যে সরকারি সাক্ষীর তালিকে দেয়া হয়েছে, তাতে কেতুর কলেজ-বন্ধু প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে আর চঞ্চলকুমারের নামও লেখা ।
অনিকেতকে রাহুল বলল, দেখলে তো, অসীম গাঙ্গুলি বিদেশ থেকে ফিরলেন, আমরা গ্রেপতার হলুম, আর এনারা ডিগবাজি খেলেন ।
–জানি, ব্যাপারটা কাকতালিয় নয়, বলল কেতু ।
চার্জশিট পাবার আগে পর্যন্ত রাহুল-অনিকেতকে জেরা করার নামে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ডাকা হতো লালবাজারের প্রেস সেকশানের ইনটারোগেশান রুমে । ডেকে বসিয়ে রাখা হতো আর শোনানো হতো পাশের ঘরে যাদের প্যাঁদানি দেয়া হচ্ছে তাদের কান্নাকাটি-কাতরানি-চিল চিৎকার । তদন্তকারী ইন্সপেক্টর আদালতকে জানাতো যে তদন্ত চলছে, অনুসন্ধান পুরো হয়নি । রাহুল-অনিকেতের বন্ধুরা যে ওই প্যাঁদানির প্রতিধ্বনিতে ভুগে-ভুগে, কেঁদে-ককিয়ে মুচলেকা লিখে, দে-পিটটান দিয়েছে, তাতে রাহুল-অনিকেতের সন্দেহ নেই ।
তদন্তকারী ইন্সপেক্টর একদিন সন্ধ্যায় অনিকেতকে জানাল যে কালকে ঠিক সকাল দশটায় পুলিশ কমিশনার আপনাদের সঙ্গে দেখা করবেন, ওনার ঘরটা জানেন তো । স্বাভাবিক যে জানত না ওরা । ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের বাইরে অন্য বিভাগে যাবার প্রয়োজন হয়নি । ঘুরে-ঘুরে লালবাজার দেখার একটা ইচ্ছে অবশ্য ছিল, ট্যুরিস্টদের মতন ।
পরের দিন পৌঁছে গেল । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর, কমিশনারের ঘরে নয়, ওনার পাশের ঘরে, কনফারেন্স রুমে যেতে বলা হল । ওরা ঘরে ঢুকে দ্যাখে একটা লম্বা টেবিলের চারিধারে বসে আছেন, বলা যায় প্রায় সকলেই পেটমোটা,
গম্ভীরমুখো লোক । কমিশনার যে কে তা বোঝা গেল, ওনার নামও পি. সি. সেন, বসবার চেয়ারও উঁচু ।
অনিকেত-রাহুলের জন্য দুটি চেয়ার ফাঁকা ছিল, তাতে ওদের বসতে বলা হল । থ্যাংকস জানিয়ে বসল । তদন্তকারী ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হল উপস্হিত কেদারানশীনদের সঙ্গে, লিগ্যাল রিমেমব্র্যান্সার, হোম ডিপার্টমেন্টের সচিব, সেনা বিভাগের কর্নেল, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার, চব্বিশ পরগণা আর হাওড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, প্রমুখ । পুলিশ কমিশনারের সামনে দুটো ঢাউস ফাইল রাখা ।
অনিকেত-রাহুল এতদিনে টের পেল যে কলকাতার, দুর্জয়ের ভাষায় বড়-বাঙালি কেউকেটারা, ওদের দুজনের সম্পর্কে যে-ধরণের নালিশ ঠুকেছেন, তা এই কর্মকর্তারা সাধারণত পান না ; এখন ওঁদের মুশকিল হয়েছে এতজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করে তা থেকে বেরোবার উপায় বের করা । পুলিশ কমিশনারই প্রথমে মুখ খুললেন, আপনারা দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনের মতন হ্যাণ্ডবিলে আর্ট মুভমেন্ট করছেন ? এভাবে ক্রিয়েটিভ আর্ট হয় ?
রাহুল বলল, এভাবে দ্রুত পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, সে হাতে পেয়ে চোখ বোলাতে বাধ্য হয়, দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনের মতন । পত্রিকা হলে তার সময় ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হতো, তাকে কিনতে হতো । হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে তার সময়ে হস্তক্ষেপ করে, তার ইচ্ছা না থাকলেও, তাকে বাধ্য করা হচ্ছে একবার পড়ে নিতে । কেবলমাত্র আগ্রহীদেরই বিলোনো হয় । দাঁতের মাজনের মতো সাধারণ পাবলিককে বিলি করা হয় না, অত ছাপাবার মত টাকাকড়িও নেই আমাদের ।
–আপনাদের লজিস্টিক্স, আই মিন ফিলজফি, একটু বুঝিয়ে বলুন তো । সেনা বাহিনীর কর্নেল জানতে চাইলেন ।
অনিকেত-রাহুল এবার নিজেদের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়ে গেল । মগজে জমে থাকা চিন্তাভাবনার খোলা হাওয়ায় উড়াল । অনিকেত জিওফ্রে চসার থেকে টেনে নিয়ে গেল সময়ের ক্ষুধায়, বর্তমান সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে । রাহুল টেনে নিয়ে গেল অসওয়াল্ড স্পেংলারের ইতিহাস দর্শনে । কথা বলতে-বলতে ওদের কন্ঠস্বর ক্রমশ বিদ্যায়তনিক হয়ে উঠছিল । দুজনের লেকচার শুনতে বসে, বুঝতে পারছিল ওরা দুজন, একেবারে অজানা চিন্তার দিকে নিয়ে চলেছে অফিসারদের ।
–আপনারা এলিট নাগরিকদের আক্রমণ করছেন কেন ? হোম ডিপার্টমেন্টের সচিবের প্রশ্ন ।
অনিকেত বলল, আমরা তো কাউকে আক্রমণ করিনি, ওনারা আক্রান্ত বোধ করছেন, ইতিপূর্বে এই ধরণের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না ।
–শুধু টেবিলের তলায় পা দুলিয়েছেন তাঁরা । মানে, ওনাদের মনোদৃষ্টিবান মানুষ বলা যায় না ।
–মুখোশ বিলি করার আইডিয়াটা কার ? জানতে চাইলেন লিগাল রিমেমব্রান্সার ।
রাহুল বলল, আমার ।
–মুখ্যমন্ত্রীকেও পাঠিয়েছেন ? কতজনকে পাঠিয়েছেন ?
–হ্যাঁ, বলল রাহুল । প্রায় একশোজনকে ।
–আমার অফিসে এসেছে, বললেন চব্বিশ পরগণার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ।
–লালবাজারে আমার দপতরেও এসেছে । ওনার সামনের একটা ফাইল ওলটাতে-ওলটাতে বললেন পুলিশ কমিশনার । অনিকেত দেখলো, ওদের বুলেটিন, পত্রিকা সবই রয়েছে ফাইলটায় ।
–টাকা-পয়সা কোথা থেকে আসে । জানতে চাইলেন হাওড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট । ওনার লোকেরা সম্ভবত হরিচরণ খাঁড়ার বাড়িতে নজরদারি করে খরচের সমস্যা সমাধান করতে পারেননি ।
অনিকেত বলল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দুই ভাই-ই করি, অন্যেরাও কখনও সখনও করে । হ্যান্ডবিলে বিশেষ খরচ হয় না ।
–টপলেস প্রদর্শনী করাবার কথা ছিল, ইনভিটেশান কার্ড পেয়েছিলেন অনেকে, তা হল না কেন ? প্রশ্ন করলেন হোম ডিপার্টমেন্টের সচিব ।
রাহুল ঠোঁটে সামান্য হাসি খেলিয়ে বলল, যারা ভেবেছিলেন যে টপলেস বলতে বুক-খোলা মেয়েমানুষ বোঝায়, তাদের ঘাড়ের ওপর মাথাটা, বা টপটা নেই । ওটাই টপলেস, নিজেরা যে প্রকৃতপক্ষে বোকা, মগজহীন, তা যাতে ওনারা বুঝতে পারেন আর আত্মধিক্কারে ভুগতে পারেন, তাই ।
–নামগুলো তো দুই ভাইয়ের খাসা ; সিংহকে রাহু আর কেতুর মুখোশ পরিয়ে রেখেছ নিজেরাই, চেয়ার ছেড়ে
ওঠার সময় বললেন পুলিশ কমিশনার ।
ঘন্টা দুয়েক দুজনকে এভাবে জেরা করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল ।
তার পরের সপ্তাহে সবাইকে রেহাই দিয়ে কেবল রাহুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হল । জেরার রকমফের দেখে রাহুল আঁচ করেছিল যে যারা নালিশ ঠুকেছে তাদের মূল লক্ষ্য ও-ই । চার্জশিটের দিন অনিকেত রাহুলকে বলেছিল, অসীমের মূল লক্ষ্য তুই, আর যারা নালিশ ঠুকেছে তাদের মূল লক্ষ্যও তুই, কিরকম মিলে যাচ্ছে ব্যাপারটা । বিশ্বাস করতে মন চাইছে না যে এটা কাকতালীয়, না কি সুতোর খেই খুঁজলে শেষটা ওঝাপুরের চৌকাঠেই পৌঁছোবে । ও তো ফিরেছে, একদিন যাবো ওর বাড়ি । পাকাবুদ্ধির চাল চেলেছে ।
রাহুল বলেছিল, প্রকৃত সূত্র প্রতিষ্ঠান, তা সে লোকটা অ-আ-ক-খ যেই হোক না কেন । অসীম গাঙ্গুলি রূপকারের কর্মী মাত্র ।
মামলা আরম্ভ হতে, কলকাতায় যাওয়া আর ফিরে আসার ঝামেলা এড়াতে রাহুল এক-একদিন এক-এক জায়গায় রাতের আশ্রয় নিতো । সুকোমল রুদ্রের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে, হরিচরণ খাঁড়ার বাসায়, বড়োবাজারে হিন্দি পত্রিকার মারোয়াড়ি সম্পাদকের ব্যবসার গদিতে ; যেখানে পারে সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিত । চোঙদার-ভাইরা মুচলেকা দেয়ার পর থেকে ওকে এড়িয়ে যেত; শুরুতে ওদের টালার ভাড়াবাড়িতে, পরে ওদের মেসবাড়িতে, রাহুলের জন্য ‘প্রবেশ নিষেধ’ বোর্ড লটকিয়ে দিয়েছিল ।
চার্জশিটের সঙ্গে পুলিশের সাক্ষীদের নাম দেখে উকিল মশায় গম্ভীর । বললেন, ও হে, ফৌজদারি মামলা হয় অবজেকটিভ এভিডেন্স দিয়ে । তোমার বিরুদ্ধে তো দেখছি বেশ কয়েকজন নট সাক্ষী হয়েছে, তোমার দলের লোকেদেরও নাম রয়েছে । কেসটাকে ওরা সাবজেকটিভ করে দিয়েছে। তোমাকেও তো কয়েকজন নট-নটী যোগাড় করতে হবে ।
শুনে, রাহুলের পিসেমশায় বললেন, এই তোমার পশার ? এখন সাবজেকটিভ-অবজেকটিভ কাজিয়ার হ্যাঙ্গাম দেখাচ্ছ ! জানতুম আমি, আগেই জানতুম, লেখালিখির কেস খুনের কেসের চেয়ে কঠিন, তা তুমি শুনলে না । শালাদের কাছে আমার মাথা কাটা গেল । একে তো এই মামলার জন্যে শাশুড়ি গত হলেন ।
উকিলমশায় চোখ থেকে চশমা বাঁহাতে নামিয়ে বললেন, কেউ খুন হলে সাক্ষীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলে না যে খুন করতে কেমন লাগে, ভালো না খারাপ, বুঝেছ ? রেপ কেস হলে সাক্ষীকে কি জিগ্যেস করা হয় যে রেপ করতে কেমন লাগে ? এই কেস সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে । জজসায়েব হয়তো নিজেই পড়তে বসবেন, তখন ? খুনের মামলায় কি জজসায়েব নিজে খুন করে দেখে নেন যে খুন করা কেমন ?
রাহুলের কিছু করার নেই, কেননা কোর্ট-কাছারির মারপ্যাঁচ ওর জানা নেই, আদালতের প্রতিদিনের কচকচি বিরক্তিকর আর গা-বেঁধানো হয়ে উঠেছে ।
একটা ডেট থেকে আরেকটা ডেটের মাঝে সপ্তাহের বেশি সময় থাকলে রাহুল চলে যেত শ্যাওড়াফুলির ঠাকুমাহীন খণ্ডহরে । ভবদেব মিত্র, মানব রায়, আর বেনারস থেকে দুই চিত্রকর বন্ধু, নির্মল মিত্র বাউলা আর অনীক খাস্তগীর এসে, খণ্ডহর গুলজার করে তুলত । ওদের গাঁজা-টানা দমকা হাসিতে উড়তে আরম্ভ করত অবহেলিত পায়রার ঝাঁক । সবাকসুন্দরী দেবী মারা যাবার পর বারোঘরের বিশাল খন্ডহরে একা থাকতে ভালো লাগত না চাপা-বেদনাবোধে আক্রান্ত রাহুলের । পুরো খণ্ডহরটাই যেন বিষাদে ভুগে নোনা ইঁটের আর্তি ঝরিয়ে চলেছে, অবিরাম । ঠাকুমা যখন ছিলেন ওনার রাঁধা হবিষ্যান্ন খেয়ে চলে যেত । বন্ধুদের কাছে খণ্ডহর প্রিয় ছিল স্বাধীনভাবে আড্ডা, মাদক ফোঁকা, ইত্যাদির স্বাধীনতার জন্য । ঠাকুমা মারা যাবার পর বাড়ির সিংদরোজার পাল্লা দুটো আর পায়খানা দুটো, যেগুলো ছিল সিংদরোজার বাইরে, সেগুলোর কপাটও চুরি হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুদের বলে দিতে হতো যে পায়খানায় গেলে বাইরেই মগ রেখে দিতে, যাতে বোঝা যায় যে ভেতরে কেউ বসে ধ্যান করছে । রাহুল কানপুরমুখো হলে ওরাও কানপুর চলে আসত।
একবার অনীক আর নির্মল বাউলা আন্দোলনের পোস্টার আঁকতে খণ্ডহরে এলো ; ভবদেব আর মানবও পৌঁছে গেল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে । সকালে মুড়ি-লাঁচা লঙ্কা খেয়ে-খেয়ে চোঁয়া ঢেঁকুর মারায় ভুগতে থাকলে, ভবদেব প্রস্তাব দিল যে রূপদর্শীর বাড়ি যাওয়া যাক রবিবারের সকালে , উনি তো একদিন রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাবার ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন দিয়ে রেখেছেন ।
রূপদর্শীর মালিকানায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ‘আয়না’তে রাহুলদের টিটকিরি মেরে চুটকি আর কার্টুন
প্রকাশিত হতো, যার মূল সুর ছিল সর্বভূকদের লেখা বিদেশি প্রভাবিত । ওরা গিয়েছিল সম্পাদকের খোঁজে । একজন
ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোক হদিশ দিলে যে রূপদর্শী হলেন পত্রিকাটির মালিক । রাহুলরা ওনার ট্যাবলয়েড দপতরে গিয়ে হাঙ্গামা করেছে শুনে রূপদর্শী এক সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর পাঠালেন যে ওরা যেদিন ইচ্ছে ওনার বরানগরের বাড়িতে রাধাবল্লভি-আলুর দম সহযোগে ব্রেকফাস্ট করতে পারে ।
সেই মত রাহুল ভবদেব অনীক নির্মল গিয়ে হাজির হল ওনার বাসায় । দরোজার বাইরে থেকেই হাঁক পাড়ছিল সবাই মিলে, “আমি দাসু রায়, আমি দাসু রায়, হামি দাসু রায়।”
উনি দরোজা খুলেই, যদিও ওদের কাউকে দেখেননি কখনও, বললেন, দাসু রায় নাম শুনেই বুঝেছি, কাদের আগমন হল ।
তর্কাতর্কি শুরু করে উনি বললেন, ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রভাবের কথা । ভবদেব প্রসঙ্গ তুলল বাংলা ভাষায় সনেটের আঙ্গিক, জীবনানন্দে ইয়েটস, মানব প্রসঙ্গ তুলল তিরিশের লেখায় ঔপনিবেশিক প্রভাব যা প্রাকঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যে দেখা মেলে না । অনীক-নির্মল তুলল রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকায় ফরাসি প্রভাব ।
রাহুল কোনো আলোচনা না করে কেবল আলুর দমের গুণগান করছিল, কত নরম আলু, কী স্বাদ, এত বড়-বড় করে কেটে ভাজার পরেও ভেতরে মশলা ঢুকতে পেরেছে ।
রূপদর্শী বুঝতে পারলেন যে রাহুল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তর্কটা চালিয়ে নিয়ে চলেছে । উনি বললেন, ও, রূপদর্শীকে গুলগল্পের টেক্কা দিচ্ছ !
রাহুল বলল, হ্যাঁ দাদা, আলু জিনিসটা আমাদের দেশের নয়, বেশি দিন হল আসেওনি । এই কন্দমূল পোর্তুগিজরা প্রথম জাহাঙ্গিরের দরবারে উপহার দিয়েছিল । ইনকাদের ধ্বংস করে লাতিন আমেরিকা থেকে স্পেন লাল আলু নিয়ে গিয়েছিল ইউরোপে । সেখান থেকে ইউরোপের উপনিবেশগুলোয় পৌঁছোয় আলু । পোর্তুগিজরা পেরু-বলিভিয়া থেকে শাদা আলু এনেছিল ভারতবর্ষে । আমাদের দেশে ওয়ারেন হেস্টিংস দেহরাদুনে আলু চাষের ব্যবস্হা করেন, তাই শাদা আলুকে অনেকে বলে নৈনিতাল আলু । চন্দ্রমুখি আলু, যাকে আপনি মনে করছেন বাংলার মাটি থেকে জন্মেছে তা ওই নইনিতাল আলু । ওই আলুর জন্যই প্রফুল্ল সেন হিমসিম খাচ্ছেন, কেননা বাঙালির পাতে আজ আর আলু না হলে চলে না।
–দাসু রায় আর কাঁচকলা, রাধাবল্লভীতে কামড় দিয়ে বলল ভবদেব মিত্র ।
রূপদর্শী রাহুলের পিঠ চাপড়ে বললেন, মক্কেল দেখছি ব্রিফ তৈরি করেই কেস লড়তে এসেছে ; ঠিক আছে নিমন্ত্রণ রইল, পরের বার ফুল কোর্স লাঞ্চ খাওয়াবো । লাঞ্চ খাবার আর সুযোগ হয়নি, কেসের অবিরাম হয়রানির জন্য, আদালতের খরচের দরুণ, পকেটে ছ্যাঁদা হয়ে যাবার যোগাড় তখন ।
রাহুল যখন, মমমমমমম, কত বছরে পড়েছে, মমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, শরিকরা সবাই বাড়িটা বেচে দেবার তোড়জোড় করায়, অনিকেত আর ও শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহর বিক্রিতে রাজি হয়ে গেল । মকদ্দমার পর রাহুল ওই বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল ; ওর খুড়তুতো বোন, তার নকশাল আন্দোলনকারী প্রেমিক পুলিশের গুলিতে খুন হয়ে গেলে, বড়ঘরের বরগায় ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল । ওই বাড়িতে গেলেই রাহুল ছোড়দা ডাকের প্রতিধ্বনির গুঞ্জন শুনতে পেত । সবাকসুন্দরী দেবীর হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পেত ।
আদালতে, যে এজলাসে ওর মকদ্দমা চলত, সেখানেই একজন বৃদ্ধের আত্মহত্যার মামলাও চলত । অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল লোকটা । বোধহয় মামলাটা লড়ে জেতার মধ্যে দিয়েই অবসাদ থেকে ছাড়ান পেয়েছিল । জানা হয়নি রাহুলের ।
এজলাসে, বিচারকের টেবিলের বাইরে, ডানদিকে দেয়াল-ঘেঁষে, জালঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বা অন্য মামলায় দণ্ড-পাওয়া দাগি আসামিদের জন্য, যারা জেল থেকে পুলিশভ্যানে এসে ওই খাঁচার পেছনের দরোজা দিয়ে ঢোকে । খাঁচার জাল আর মেঝে নোংরা হয়ে আছে গয়ের থুতু কফ বমি খইনি পিকের ছোপে । রাহুল বা ওর মতন যারা জামিনে-ছাড়া তারা ওই জালের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ায়, পায়ে ব্যথা করলে খাঁচায় ঠেসান দিয়ে । খাঁচার দাগিরা নানা মন্তব্য করতে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাহুলের সমর্থনে, কেননা লেখার বা শায়রি করার জন্য মামলার কথা তারা শোনেনি আগে ।
বিচারকের টানা টেবিল, ওনার বসার চেয়ারের বাঁদিকে, যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে আর্চ-দেয়া
দরোজার খাদির নোংরা পর্দা সরিয়ে উনি এজলাসে আসেন আর যান । এলে, সবাই উঠে দাঁড়ায়, নিশ্চিন্ত হয়, কেননা
কে কখন থেকে, কবে থেকে, তার স্বজনজ্ঞাতির ডেটের আর শুনানির জন্য অপেক্ষা করছে, তা, তাদের মুখ দেখে মনে
হয়, একশো বছর, হাজার বছর, বা তারও বেশি । এত মকদ্দমা জমে আছে যে বেশিরভাগ শুনানি হয় দশ-পনেরো মিনিটের, বড়োজোর আধঘন্টা ।
এজলাসের মেট্রপলিটান ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে আর চেয়ার-বেঞ্চে স্বাস্হ্যবতী ছারপোকাদের প্রেমনিবেদনের মাঝে বেশিক্ষণ বসতে পারেনা রাহুল । এ-এজলাস সে-এজলাস ফ্যা-ফ্যা করে, মশলাদার সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে শোনে, কী ভাবে খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-ছিনতাই-চুরি-মারপিট-পকেটমারি-লুটপাট-দখল-বেদখল-চুল্লুবিক্রি-আত্মহত্যা-বউভাগানো ইত্যাদি গল্পের জট খুলছে আর পাকাচ্ছে । ওর কেস ওঠার সময় হলে মুহুরিবাবু রাহুলকে খুঁজে-পেতে ডেকে নিয়ে যান, খাঁচায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াবার জন্য । অমন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া ওর আর কোনো ভূমিকা নেই । প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আদালতে রাহুলকে মুখ খুলতে হয়নি । মামলায় ‘আমি’ বলতে অপরাধীকে বোঝায় না, ‘আমি’ মানে অপরাধীর উকিল । উকিলই বলে, “আমি দোষী নই।”
উকিলবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের লাইটপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল ওরা তিন জন ; ঝন্টু বিড়ি ফুঁকতে আর অনিকেত-রাহুল একটা সিগারেট ভাগাভাগি করে ফুঁকতে ব্যস্ত ।
সিগারেট ফুঁকে অনিকেত চলে যাবে, ওর হাতে আড্ডা দেবার সময় নেই । তিন বছর হল ওর বিয়ে হয়েছে, মেয়ের বয়স মোটে দু’বছর, তার ওপর এই হ্যাঙ্গাম । বলল, এ নিশ্চয়ই অসীমের কাজ ; বিদেশ থেকে ফিরেই পোঁদে লেগেছে, অতুল্য ঘোষের কাগজে কাজ করত, অনেক চেনা-জানা করে ফেলেছিল, তাদের ধরাধরি করে বাঁশ দিতে নেমেছে , প্রদীপন বলেছিল যে বিদেশ থেকে কড়া চিঠি লিখতো সবাইকে, যাতে আমাদের আন্দোলনকে ভেঙে দেয়া হয়, রাহুলকেও হুমকি দিয়ে লিখেছিল, ফিরুক, তারপর দেখে নেবে, ওর গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে ।
–হ্যাঃ হ্যাঃ, আমি মাইরি কোনো নদীর পাড়ে হাগবার সুযোগ পাইনি আজও । হরিদ্বারে গঙ্গার পাড়ে হাগলে আর তার ঠাণ্ডা কনকনে জলে ছোঁচালে নাকি ছাঁৎ করে সোজা স্বর্গে যাওয়া যায়, বলল ঝন্টু ।
তিনজনে চুপচাপ বিড়ি-সিগারেট ফোঁকায় ব্যস্ত । ফোঁকা হয়ে গেলে, ফুটপাতে পা দিয়ে ঘষে নেভালো ।
ঝন্টু ফিসফিস করে বলে উঠল, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, পুরো রামায়ণ কোম্পানি চলেছে, ওরা গলিতে ঢুকুক তারপর তোদের দেখাবো কোন বাড়িতে ঢুকল ।
–বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার পড়ার এই ফল । তবে বদল্যার তো দল বেঁধে যেত না । বলল অনিকেত ।
–বুঝলিনে, বেঁধে-বেঁধে থাকলে খরচ কম, হোলসেল রেট । বলল ঝন্টু ।
–তিরিশের সময় থেকে বিদেশি কবিরা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ । নিজের দেশের কবিয়ালদের পাত্তা দেয়া হয় না । উইলিয়াম ব্লেক ছিল ছুতোর, ফ্লবেয়ার আর র্যাঁবো ছিল জাতচাষা, ওদের দেশের মণ্ডল বা ধাড়া বা বেরা, তাদের পুর্বপুরুষ ভাবতে বাঙালি কবিরা লজ্জা পায় না , যত লজ্জা নিজের বাপ-চোদ্দোপুরুষকে স্বীকৃতি দেয়ায় । গত বছর যে সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন বেরিয়েছিল, তাও মোটে পঁচিশ কপি, যেটা বিলি করা হয়েছিল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ কফিহাউসে, ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল কলকাতায় । অথচ একটা আপাত ইনোসেন্ট ছক ছিল তাতে, দেখলেই বুঝতে পারতে । ভোলা ময়রা, গোঁজলা গুঁই, লালু, নন্দলাল, রামজি, রঘু, কেষ্টা মুচি, নিতাই বৈরাগী, ভবানী বেনে, হরু ঠাকুর– এনাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছিল, এখনকার ব্রাহ্মণ, কায়স্হ, বদ্যি কবিদের । ব্যাস, কলকাতা তেলে-বেগুনে । সুকোমল রুদ্রকে ঘিরে ধরেছিল কফিহাউসের সামনে ।
–অনেকে আবার নিজেদের দেবীদেবতার জায়গায় গ্রিস-রোমের অ্যাডোনিস, আফ্রদিতি, লেডা, ভেনাস, ইউলিসিস ইত্যাদিকে এনে গৌরব বোধ করে ।
–দাঁড়াকবি নাম দিয়ে কবিয়ালদের অপমান করেছে, এমনকি বাংলা ভাষার নামকরা অধ্যাপকরাও করেছে ; ওরা বুঝতেই পারেনি, শেষ লড়াইটার জন্য সেইসব ভূমিজ কবিরা নিজের দু’পায়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল । চতুষ্পদ থেকে প্রাণীরা কেন আর কী-কী কারণে হাত দুটোকে ফ্রি করতে চাইল, করে জীবজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল, তা খতিয়ে দেখেননি । আসলে ওনারা জীবনের সমস্তকিছু সাহিত্যের মালমশলা প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা করতে চাইতেন ।
–এখন বদল্যারি ফাঁদে পড়েছে ।
–চ না, আমরাও ফাঁদে পড়ি, ঝন্টুর প্রস্তাব ।
–না না, আমরা কোনো বেশ্যার ঘরে যাবো না , বলে, চলন্ত বাসে উঠে পড়ল অনিকেত ।
–তুই চল, ঝন্টু বলল রাহুলকে, ওরা কোন বাড়িটায় ঢুকবে আমি জানি, আমিই তো রূপক মজুমদার আর প্রদীপন
চাটুজ্জেকে বাড়িটা দেখিয়েছিলুম । ওই বাড়ির মাসিটা পয়সাঅলা, দেখতে-শুনতে ভালো মেয়েদের তোলে । ওই বাড়ির সামনে যে বাড়িটা তার বারান্দা থেকে সেসব খদ্দেরদের দেখা যায় । রামায়ণ কোম্পানির শেয়ার হোলডারদের দেখতে পাবি ।
ঝন্টুর সঙ্গে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সদস্যদের পেছু নিল রাহুল । গলিটা বোধহয় ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধকার । বিটকেল গন্ধ, বেলিফুল, বিড়ি-সিগারেট আর মদের সংমিশ্রণে উড়ছে । হয়তো হরমোনে বাড়বাড়ন্ত মাংসবাজারের গন্ধ এরকম তিতকুটে হয় । ঝন্টুর পেছন-পেছন সিমেন্ট-ঝরা, ফিকে হলুদ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো রাহুল । বারান্দায় এক কোনে মোটামতন এক প্রৌঢ়া, পানের বাটা নিয়ে বসে । ঝন্টুকে দেখে বললে, আজকে তোর মাগির হপ্তাবাবুর রাত, তুই অন্য কাউকে চাস তো দ্যাখ । বারান্দার তিন দিকে ছোটো-ছোটো ঘর, কয়েকটার দরোজা বন্ধ । কয়েকটায় সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যুবতীরা, বড্ডো বেশি সাজুগুজু, টকটকে লাল ঠোঁট, গালে লালচে পাউডার, ব্লাউজ থেকে উথলে সবই দেখা যাচ্ছে, বোঁটা ছাড়া । এদের জড়িয়ে ধরলেও সহজে লিঙ্গোথ্থান হবে বলে মনে হয় না ।
–শশশ, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ ।
রাহুল দেখল সামনের বাড়িটার একটা ঘরের সামনে একজন যুবতীর সঙ্গে কথা বলছে প্রদীপন চাটুজ্জে, মস্করা করছে নিশ্চয়ই, যে-ভাবে হাসি খেলছে যুবতীর শরীর জুড়ে । কথা বলতে উনি ওস্তাদ । আন্দোলনের বুলেটিনে একবার লিখেছিলেন, বেশ্যার ঘরে আয়না থাকবেই, খাদ্যদ্রব্য কদাচিৎ দেখেছি, তবে বাসন থাকে, কাঁচের কলাইয়ের কাঁসা বা পিতলের বাসন ; বেশ্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কটি তথ্য এই হতে পারে যে এক সে উপহার পেতে ভালোবাসে দুই তার আত্মা আছে তিন তার লজ্জাহীনতা সত্যের মতো চার সে মৌলিক নির্বোধ পাঁচ সামনে কোনো সময় নেই এমন মানুষ যদি ভাবা যায় সে সেই রকম ; তার সম্পর্কে একটি কথাই গভীরতরভাবে ভেবে জানার, তার শরীর যখন একজন ভোগ করে, কী মানসিক অবস্হায় সে থাকে, লোক এলে সে সুখী হয়, বিরক্ত হয়, ঘৃণাও করে, লোককে হিংসে সে কখনও করে না, যখন লোক তাকে উলঙ্গ করে, সে বিরক্ত হয়, একবার উলঙ্গ হলে স্বস্তিবোধ করে, তার সহজ লাগে, কিন্তু বেশিরভাগ লোক একসঙ্গে উলঙ্গ হয় না, আলো নিভবার আগে অন্তত আণ্ডারওয়ার বা গেঞ্জি পরে থাকে, বেশ্যার নগ্নতা সে দ্যাখে, তাকে দেখতে দ্যায় না, তারপর কতকগুলি নিয়মকানুন তারা মানে, বেশ্যারা, সে-সময় শয়তান তাদের সাহায্য করে বা ঈশ্বর, যে-জন্য তারা কদাচিৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
–তুমি প্রদীপন চাটুজ্জের লেখাটা পড়েছিলে, বেশ্যাদের নিয়ে লেখা ? ঝন্টুকে জিগ্যেস করল রাহুল ।
–পড়েছি, পড়েছি, তুই দিয়ে গিসলি । ও নিজের কথা লিখেছে, কী করে ও জানল অন্যরা কী-কী করে ? বেশ্যারা নিজেরাই জামাকাপড় তাড়াতাড়ি খুলে ফ্যালে, যাতে কাজ সেরে পরের খদ্দেরের জন্যে ধুয়েটুয়ে রেডি হতে পারে । তাছাড়া কোনো-কোনো কচি খদ্দেরের তর সয় না, তাড়াতাড়ি শাড়ি-ব্লাউজ খুলে সরিয়ে না রাখলে তড়িঘড়ি জড়িয়ে ধরে লিকুইড ফেলে নোংরা করে দেবে । তখন ? প্রদীপন চাটুজ্জে তো হাড়গিলে, পাঁজরা গোনা যায়, তাই ঘর অন্ধকার হলে গেঞ্জি-আণ্ডারওয়ার খোলে । তোকে একদিন দিনের বেলা নিয়ে আসব, তখন রেট অনেক কম থাকে, ওসব রঙচঙ মেখে কুচ্ছিত হয়ে সাজে না , দেখতে পাবি, একদম নর্মাল, যেন পাড়ার মেয়ে । দিনের আলোয় তোর সামনে শাড়ি-ব্লাউজ খুলে দাঁড়ালে সারা ঘর আলোয় আলো হয়ে যাবে, ভালো না বেসে পারবি না ।
–ভালোবাসা, বলেছো ভালো । আমার এক বন্ধু বলে মাংসামাংসি ।
–ওই দ্যাখ, রামায়ণের অন্য ক্যারেকটারদের, একটার কাছে সবাই যাবে নাকি রে ? হোলসেল রেট পাবে মনে হচ্ছে। রূপক মজুমদারকে দেখতে পাচ্ছিস । তোর মনে আছে ? কেতুর পড়ার ঘরে ডিং হেঁকেছিল যে বেপাড়ার মেয়েদের ওইতে হাত দেবে না, এখন তো রসে-রসে টইটুম্বুর, ওইতে ওই দিতে চলেছেন । ওই দ্যাখ বসন্ত বাঁড়ুজ্জে না মুকুজ্জে, আর ওটা সাবর্ণীচরণ, লেকালিকি করে না, রামায়ণের স্যাঙাত হয়ে ঘোরে । ওই ঘাড়ে-গর্দানেটা কে রে ?
–উনি মিস্টার রায় । আর অন্যজন অর্ণব মুখোপাধ্যায় ।
–উঁচু মক্কেল । খড়মের পাহারাদার ! শরৎ চাটুজ্জের পর আবার চাটুজ্জে বাঁড়ুজ্জে মুকুজ্জে গাঙ্গুলিরা এসব পাড়াকে আলো বিলোতে এয়েচে ।
–আসল লোককে দেখছি না ? সীতাকে তো ইউরোপের নন্দনকাননে ফেলে চলে এসেছেন ।
–ওই তো, হ্যাঃ, ধুতি-পাঞ্জাবিতে, হাতে আবার গোড়ের মালা, শরৎ চাটুজ্জের গদির তালে আছে । আর ওটাও কে একজন চাটুজ্জে, ওই যে, কালো শার্ট কালো প্যান্ট, রামায়ণের আরেকটা ক্যারেকটার, ওদের সঙ্গেই আসে । আরে,
রাজপুত্তুরই তো নন্দনপালঙ্কে প্রথমে ঢুকে গেল রে । চল, কেটে পড়ি, বারান্দায় গুলতানি করবে ওরা, সিগারেট-মিগারেট
ফুঁকবে, তখন এদিকে চোখ পড়লেই তোকে দেখে ফেলবে । আমার তো বদনামের ভয়ডর নেই, তোরই মুশকিল । কফিহাউস থেকে ছড়াবে ।
–বদনাম ? কী বলছ কি, হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোটাকতক চোর-ডাকাত-খুনির সঙ্গে ।
–যা বলেছিস, আমার বাপটাই তো বদনাম, বদনামের বাপ ।
ঝন্টুর বাবা পাঁচকড়ি যৌবনে ছিলেন হেদোর কর্মকর্তা, অবিভক্ত বাংলার বিখ্যাত অ্যামেচার সাঁতারু । কলকাতার মাংসামাংসি জগতে ঢুকেছিলেন চাকরির উপরি খরচ করতে । ম্যানেজিং এজেন্সিতে তাঁর কাজ ছিল মাল কেনা-বিক্রি করার দরপত্র আহ্বান, খোলা, অর্ডার দেয়া বা নেয়া । লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যাপার, টন-টন মালপত্রের লেনদেন, জাহাজভরা সাপ্লাই। ঘুষের টাকা অঢেল । সোনাগাছির বাঁধা খদ্দের । ঘোড়দৌড়ের মাঠের জুয়াড়ি । সাঁতার কাটার সুবিধার জন্য এক-আধ ঢোঁক দিশি মদ গিলতেন, যাকে উনি বলতেন ধান্যেশ্বরী । খাঁটি স্কচ বা সিংগল মল্ট উপঢৌকন পেলেও নিতেন না । বলতেন, ধান্যেশ্বরী তো মাকালীর আরেক রূপ, নিজের মাকে ছেড়ে কেন বিদিশির পেচন-পেচন ঘুরব । মারোয়াড়ি ব্যাবসাদারদের অবদান হিসেবে পাঁচকড়িবাবুর পরিচয় হল থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ এক্সট্রা যুবতীদের সঙ্গে । তাদের সূত্রে সোনাগাছি-বৌবাজারে উত্তরণ । ওনার যৌবনে সোনাগাছির এক-একটা বাড়ি এক-একজন যৌনকর্মীর নামে খ্যাত ছিল, রাধারানির বাড়ি, চারুমতির বাড়ি, সুখময়ীর বাড়ি, যে বাড়িগুলো ঝণ্টুর সময়ে পৌঁছে অমুক-মাসি তমুক-মাসির বাড়ি হয়ে গেছে ।
–ওটা কার বাড়ি ঝন্টুদা ? জিগ্যেস করল রাহুল । রাধারানি, চারুমতি…
ঝন্টু বলল, ফিসফিসিয়ে, ওরা যেটায় গেছে সেটার নাম পাকিস্তানি মাসির বাড়ি ।
–পাকিস্তানি ? কী বলছ কি ? এখানে আবার পাকিস্তান এলো কোথ্থেকে । দেখছ তো যারা পাকিস্তান থেকে এসেছে তাদের বাঁচার লড়াইতে প্রফুল্ল সেন নাজেহাল ।
–ওই জন্যেই তো বলছি । পাকিস্তানিরা রেপ করে কচি-কচি হিন্দু মেয়েদের নষ্ট করার পর তারা এপারে পালিয়ে এসে আড়কআঠিদের খপ্পরে পড়ে । আড়কাঠিদের থেকে এই মাসি ভালো দেখতে ফর্সা মেয়েগুলোকে কিনে নিচ্ছে । জমানো পয়সা আছে কাঁড়ি-কাঁড়ি, দুবার তো খুন হতে-হতে বেঁচেছে, ভেড়ুয়াগুলোর জন্যে বেঁচে গেছে । তোকে একদিন দুপুরে নিয়ে যাব । আমার বাবা ওর বাবু ছিল এককালে । ওর ঘরে ফোটো দেখলে মনে হবে খুকি বয়সের সন্ধ্যারানি দেবী, অ্যাঃ ।
–তোমাকে দেখাতে হবে না । আমরা জর্জ ফ্রেজার নামে এক বিটনিককে নিয়ে ওদিকের একটা বাড়িতে গিয়েছিলুম। জর্জের শখ হয়েছিল বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শোবার । এক-দু দিনের জন্যে ভারতে এসে তো আর প্রেম হয় না, তাই ।
–ও, তুইও তাহলে এদের বিছানায় শুয়েছিস ?
–না, শুইনি । এখানের বিছানায় শুলে আমার লিঙ্গ দাঁড়াবে না । কোনো মেয়ের সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো না হলে আমার লিঙ্গ দাঁড়ায় না ।
–তোর আবার লিঙ্গ হবার বয়স হয়েছে নাকি ; এখনও তুই খোকানুনুর বয়সে আছিস। একটু বয়স হোক, তারপর দেখিস ; ফেলবি কড়ি আর মাখাবি তেল, মাখবি নয়, মাখাবি ।
সত্তরোর্ধ রাহুলের মনে পড়ল, পাকিস্তান হবার সময়ে যেমন রেপের শিকার মেয়েরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য এপারে পালিয়ে আসত, ঠিক তেমনই, যখন পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হবার লড়াই আরম্ভ হল, তখনও, রেপ-করা মেয়েরা পালিয়ে এসেছে প্রাণ বাঁচাবার জন্য । পাকিস্তান হবার সময়ে হিন্দু বাড়ির মেয়েরা এসেছিল । পাকিস্তান ভাঙার সময়ে হিন্দু-মুসলমান দু’ধর্মের মেয়েরা এসেছিল । তাহলে, পাকিস্তানি মাসির জায়গায় কি কোনো বাংলাদেশি মাসি বসতে আরম্ভ করেছিল ? কে জানে ! ঝন্টুদা তো চলে গেছেন লাহেরিয়াসরায়ের শ্মশানে ; পাকিস্তানি মাসিও চলে গিয়ে থাকবেন নিমতলায় ।
ঝন্টুদার কথা শুনে রাহুল বলল, না, আমার এই পাড়াগুলো পর্যটকদের মতন ঘুরে-ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে, কারোর সঙ্গে শোবার ইচ্ছে হয় না । পরে, বিদেশে গিয়ে, বিশেষ করে অ্যামস্টারডমে, রাহুল গিয়েছিল অমন এক পাড়ায় পরিক্রমণ-পর্যটনে। ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, কত হবে, থাকগে,, যা-ই হোক না কেন, কী-ই বা এসে যায় । পাড়াটার নাম ‘দ্য ওয়ালেন’ বা খালপাড় : খালে সাঁতরে বেড়াচ্ছে রাঁজহাঁস । পর্যটনের জন্য একটা সংস্হা আছে ওই
পাড়ায় । পর্যটকরা, মহিলা গাইডের, যিনি নিজে এককালে পাড়াটিতে যৌনকর্মী ছিলেন, তাঁর পেছন-পেছন, সেই খালের নৌকো থেকে নেমে,পাড়ার এগলি-সেগলি ঘুরতে-ঘুরতে ওপর দিকে তাকিয়ে, একতলায় চোখ বুলিয়ে, এটা-ওটা হাতে নিয়ে, দেখে বেড়ান চারিদিক ।