২. গ্রাউন্ড ফ্লোর
গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । ওঠাতে হলে ভেতরে উঠোনে নিয়ে গিয়ে দড়ি বেঁধে বারান্দায় তুলতে হবে । বিছানা বলতে, মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘর ভাড়া মাথা-প্রতি মাসে এক টাকা , যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসত মাসে একবার । পাড়াটার নাম ছিল ঠমেল, এখনও আছে, তবে তার রূপ রস গন্ধ বর্ণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে গত কয়েক দশকে — চিনের মার্কসবাদী উদারীকরণের সঙ্গে গরিবের মাওবাদের বিয়ে, ঘটকরা বেশিরভাগই ভারতীয় মারোয়াড়ি ।
অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে, পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে আয়তাকার উঠোন ঘিরে কাঠের জনপ্রাসাদ ; টালির ছাউনি । সে-প্রাসাদের মূল দরোজা ছিল একটাই, আর তা চব্বিশ ঘন্টা খোলা ; এরকম দরোজাও হয়, সবসময় খোলা, আর এরকম দরোজাই সবচেয়ে জরুরি । দশ ফিট উঁচু, চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠের ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সিংদরোজা, তার পাল্লায় কে জানে কোন ধাতুর কারুকাজ করা তিব্বতি কলকা, ধুলো আর সময় জমে-জমে ধাতু নিজের ধাতুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, মনে হত দেখে । কতজন থাকতেন ওই প্রাসাদের ফ্ল্যাটখাঁচাগুলোয় তা অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে, প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, মাসান্তের বা পক্ষান্তের বা উৎসব-শুরুর স্নানের জন্য । ওই প্রাসাদের সবাই প্রতিদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা ছিল । প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও, সবাই সকালে যেতেন না, অভ্যাসমতো বা আয়াসমতো বা আলস্যের ফাঁকে যেতেন । তাদের মতনই প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা রাহুল বাদ দিয়েছিল ; রাহুলের বন্ধুরাও তা-ই । দিনের পর দিন স্নানহীন, পোশাক পালটাবারও দরকার হতো না, তাই ।
সেই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি আর নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন, তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হিপি-হিপিনীর দল, নেপালি কবি-শিল্পী, আর আর ভারত থেকে আসা, রাহুলদের মতন, সীমাভাঙার উচ্চাকাঙ্খীরা । একতলায়, দুতিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি চিত্রাভিনেত্রীও
থাকতেন ; তখন তো নকল স্তন বাজারে আসেনি তরুণীদের বুক দখলের প্রতিযোগীতায় ; চিত্রাভিনেত্রীর স্তন অমন
মহাকাব্যিক ছিল কোন খোরাকের গুণে , জানতে চাইলে, সামন্তের ভাড়া নিতে আসা পেয়াদা মুচকি হাসি হাতে-ধরা নেপালি রুপিয়ায় মিশিয়ে বলত, মহাকবি কালিদাস নিজের মুখে নিয়ে ফুলিয়েছেন ।
ষাটের দশকের কথা তো । সে-সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক-আউট আর ফাকিং এর উদ্দেশে দলে-দলে তরুণ-তরুণী আমেরিকা-ইউরোপ ,এমনকি জাপান থেকেও, নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন ; লন্ডন বা
অ্যামস্টারডাম হয়ে বাসে, ট্রেনে আর হিচহাইক করে তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্হান, পাকিস্তান, ভারত হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লন্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে-গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন তার নাম ছিল গন্দাসিংওয়ালা । তখনও ওয়াগার কুচকাওয়াজি আকাশঠ্যাং ডিগবাজির গেট তৈরি হয়নি । পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতন ধর্মবাজ বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি, চিনের যুদ্ধ সত্ত্বেও । সম্পর্ক এই রকমই , গালাগালি মারামারি খুনোখুনি, কত রকমের সম্পর্ক যে হয়। অথচ তা তো সম্পর্কই । এখন দাড়িয়াল পাকিস্তানিরা সুন্নতকরা খোকাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে মরতে আর মারতে পাঠায় ; যাতে মরে গিয়ে সেসব খোকারা স্বর্গের হাইপাররিয়াল হুরি-পরিদের সঙ্গে ল্যাংটো শুতে পারে, আর দাড়িয়ালরা মর্তে শুতে পারে রিয়াল নারী-মাংসের বিছানায় ।
হিপিদের সেই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি-ট্রেইল, যে যাত্রাপথ ছিল অমায়িক যথেচ্ছাচার আর মহানন্দে অলস সময় কাটাবার উত্তরণের তীর্থ । সে-সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার যুবক যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন– এখনকার মতন জব্দ-জাবেদার কোঁকড়া সময় নয়– অথচ দলে-দলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন, তবু কেউ বেরিয়ে পড়েন না ; কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে, খেঁকুরে, লোভী, জোচ্চোর, মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই । পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল লোকদেখানে শান্তিতে রয়েছে। সায়েবদের দেশের যুবক-যুবতীরা বিদেশে যায় বটে, যখন তাদের পোঁদে লাথি মেরে রাষ্ট্র পাঠায় যুদ্ধ লড়তে । বেচারা ।
ফিবছর এত বোমাবারুদ জমে যায় যে তাদের গতি করার জন্যে যুদ্ধ লড়তে হয়, না লড়ে উপায় নেই । রাষ্ট্র বলেছিল, হিপি হওয়া খারাপ, পাতা ফোঁকা খারাপ, জীবন উপভোগ করা খারাপ । মরো লড়ে, লড়ে মরো। বাবরি চুল রেখো না, ন্যাড়া হয়ে যুদ্ধ লড়তে যাও , ট্রিগারে আঙুল রেখে বলো ফাক ইউ।
ফ্রিকিং আউট হবার জন্যই কাঠমাণ্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনীরা, নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ আফিম পাওয়া যেত পথেঘাটে, অফুরন্ত, অফুরন্ত, অফুরন্ত, আর দামও নগণ্য, এমনকি অনেক সময়ে বিনে পয়সায় । তখন তা বেআইনি ছিল না । হিন্দু বা বৌদ্ধ যে কোনো মন্দিরচত্ত্বরে গেলে বুড়োদের জমঘটে বসে মাঙনায়ও ফুঁকে নেয়া যেত, হাতফেরতা দুচার টান, ভিজে ন্যাকড়ায় মোড়া ছিলিম।
হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্হান থেকে আনতেন উঁচুমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাফুলের গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গর্দা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা কিংবা ভারতীয় আফিম মিশিয়ে তৈরি হতো একরকমের মাদক, হিপিরা বলত ডেডলি-লাভার । নিজেদের দেশ থেকে ওরা আনত লাইসারজিক অ্যাসিডে চোবানো ব্লটিং-পেপার, বা আনতো এল এস ডি ক্যাপস্যুল, চব্বিশ ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘণ্টার ক্যাপস্যুল । দোয়াত-কলম ছিল বলে ব্লটিং পেপারও ছিল । ভেজা-কোকেন মাখা ব্লটিং-পেপার, কিংবা যে-লেটার প্যাডের কাগজ কালি টেনে নিতে পারে, এমন লেটার প্যাডে গুঁড়ো কোকেন মাখানো । রাহুল আর ওর দুই ছবি-আঁকিয়ে বন্ধু , অনীক খাস্তগির আর নির্মল মিত্র বাউলা, বেনারসে হিপি-হিপিনীদের পথপ্রদর্শক হবার দৌলতে, বিনে পয়সায় পেতো ব্লটিং পেপার ।
দাদা অনিকেত, অকিঞ্চন ব্যানার্জি, সুকোমল রুদ্র ফিরে যাবার পর, কাঠমাণ্ডুর কুটিরপপাসাদে রাহুল বেশ একা হয়ে গিয়েছিল । চিত্রকর দুই বন্ধু অনীক আর নির্মল বাউলা, সকালবেলা উঠেই কোথাও চলে যেত, এমনকি এক-একরাতে ফিরত না ওরা । অমনই এক রাতে, যখন ও নিঃসঙ্গ বোধ করছে, প্রথম এক এক্সট্রা লার্জ স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার আহ্বান পেয়েছিল রাহুল, ভেবেছিল, কাগজটা মুখ পোঁছার জন্য ।
হাতের কন্ঠস্বর নির্দেশ দিল, ‘ইউ ফাকিং অথর , চিউ অ্যান্ড সোয়ালো, অ্যান্ড ফরগেট এবাউট দ্য ওয়র্লড ফর দিস ডে।’
একটু চেটে, রাহুল আঁচ করল ব্লটিংটা মাদক মাখানো । মুখে ফেলে চিবিয়ে গিলে ফেলল । পুকুরে নামার মতন করে, প্রথমে বাঁ, তারপর ডান পা, আলতো নামিয়ে, নেমে গেল স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ।
হিপি-হিপিনিরা ছিলই দরিয়াদিল, এমনকি দিলফেঁক, চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্য তৈরি । স্বয়ম্ভূনাথ
মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেমপল, আর এই মন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত, নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গণ ।
এক্সট্রা লার্জ স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে, পায়ের দিকে মাথা করে, রাহুল পৌঁছে গিয়েছিল এক এক্সট্রা লার্জ মাংসল জগতে, কাঁচা সোনার বিপুলা অনিশ্চয়তায়, উচিত-অনুচিতের দোটানা-কাটানো ব্লটিং পেপারের জ্যোতির্ময়ী বিভ্রমে । ব্লটিং পেপারের মায়াজাল ওর রক্তে ছড়িয়ে পড়া ঢেউয়ের ওপর ডুবসাঁতার দিতে-দিতে রাহুল নিজের মাংসল অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত-সঙ্কুচিত করে সুযোগ-সন্ধানী সম্পর্কজাল বিছিয়ে ফেলেছিল, আর তা, মেয়েটি এক্সট্রা লার্জ বলেই, মেয়েটির
স্বীকৃতি অনুযায়ী, ওকে জড়িয়ে ওপরে তোলা যায় না, কোমরের বেড় প্রায় বুকের সমান, দেহের শক্তিও এমন যে ও-ই পুরুষদের কাবু করে ফ্যালে, হিপি পুরুষরা তার সঙ্গ একদিনের বেশি দিতে চায় না ।
মেয়েটির নাম এমিলিয়া বনিয়া । ঢলে পড়ার আগে রাহুলকে প্রস্তাব দিয়েছিল, চলো আমার সঙ্গে, নিউ ইয়র্কে ।
রাহুল হ্যাঁ-না কোনো জবাব দিতে চায়নি । কাঁচা সোনার কাদায় গড়া এমিলিয়া বনিয়াকে বেনারস যাবার প্রস্তাব দিতে, এমিলিয়া তক্ষুনি রাজি । বেনারসে সবকিছুই আছে, খাওয়ার, ফোঁকার, লুকোবার, সুযোগ আছে ।
রাহুলের আগ্রহ ছিল অভিজ্ঞতায়, নিউ ইয়র্কে নয়, ব্লটিং পেপারের সাইকেডেলিক প্রতিক্রিয়ায়, কল্পনাকে খেলিয়ে তোলায়, যার সুযোগ বেনারসেও পাওয়া যাবে । মগজের ভেতরের উড়ন্ত বিশাল ফড়িংদের পিঠে চেপে চান্ডেলা বধুদের দেশে চলে যাওয়ায়, নিজেকে কখনও ডানাঅলা মাছ, মাছ থেকে লাল রঙের পেঁচা, পেঁচা থেকে দু-পেয়ে গিরগিটি, গিরগিটি থেকে বাঘে রূপান্তরণে । সবুজ বাঘ, তিনতলা উঁচু পেঁচা, জাহাজের মাপের মাছ, ডায়নোসরের মাপের নীল গিরগিটি । হোক এক্সট্রা লার্জ, আহ্বান যতদিন আছে ততদিন সাড়া দিয়ে যাবে । তারপর, মন আর কল্পনা ভরে উঠলে, কেটে পড়বে চুপচাপ । কারোর সঙ্গে কোথাও ও পালাবে না । পালাতে হলে একাই পালাবে, যেমন ছোটোবেলায় বাড়ি থেকে পালাতো ।
এক্সট্রা-লার্জ অভিজ্ঞতা ধরা পড়ে গিয়েছিল অনীক খাস্তগিরের কাছে । ওকে মোটা তরুণীর সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখে বলেছিল, “ও, অনিকেত-সুকোমলরা ফিরে যেতেই নেমে পড়েছ মাংসের পাঁকে । ওই ব্লটিং পেপারের বেশি এগিও না,
ক্যাপসুল খেও না । খেলে হুঁশ থাকবে না, টের পাবে না তোমাকে নিয়ে কী করা হচ্ছে ।”
–এল এস ডি ক্যাপসুল ?
–হ্যাঁ, এস টি পি, বাহাত্তর ঘণ্টার ডোজ ।
–দিয়েছে ব্লটিংখানা, আমি কেন প্রেম দেব না !
অনীক আর নির্মল বাউলাদের এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা ওর চেয়ে বেশি, জানে রাহুল । ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে বেনারস হিপি-হিপিনীতে ছয়লাপ । বৈভবশালী বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের হিপি সাজিয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া-নিউইয়র্কের হিপি-জগতে মিশে যেতে উৎসাহ দিয়ে, ওদের নামে প্রচুর ডলার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে, পাতা-হ্যাশিশ টানার, চুল-দাড়ি বাড়িয়ে নোংরা থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন, যাতে সেনা বিভাগ ওদের প্রত্যাখ্যান করে, আর ওরা দেশের বাইরে কেটে পড়তে পারে, যতদিন না ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয় । লয়োলা হিন্ডেনবার্গার নামে অমনই এক হিপিনী জুটেছিল অনীক খাস্তগিরের ছবি-আঁকার স্টুডিওয়, বেনারসে, যার সঙ্গে ও লিভ টুগেদার করত ; নাক-নকশা ভালো বলে হিপিরা অনীককে ডার্ক অ্যাডোনিস নাম দিয়েছে । ছবি এঁকে কতই বা আয় হয় । হিপিনীকে সঙ্গিনী হিসেবে পেলে যৌনতা, মাদক, আর অর্থাগমের দিক থেকে কত সুবিধা । লয়োলা চলে গেছে আরেকজনের সঙ্গে, অনীক তাই কাঠমাণ্ডুতে ।
নির্মল বাউলা অনীকের তুলনায় হিপিদের সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখে, ফাই-ফরমাস খাটে । থাকার জায়গা না পেলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখে । ওর বউয়ের কোনো আপত্তি নেই, টাকাকড়ি আসলেই হল । কোনো ধনী হিপিনী আবদার করলে তার সঙ্গে গঙ্গার চড়ায় কুটির তৈরি করে আদম-ইভের ঢঙে উলঙ্গ জীবন যাপন করে, আর কাঠের আগুনে পাঁঠার ঠ্যাং পুড়িয়ে খায় ।
কাঠমাণ্ডুতে নির্মল বাউলা হিপিদলের সঙ্গে আস্তানা গাড়ার পর বাদবাকি সবাই ওর ডাকে এসে জড়ো হয়েছে । বেনারসের বাঙালি পাড়ার নির্মল বেলেল্লাপনার জন্য বেলেল্লা নামে খ্যাত ছিল ; সেই বেলেল্লা অবাঙালি-লোকমুখে হয়ে গেছে বাউলা । হাতে একতারার বদলে ছিলিম, কাঁধে সবসময়েই ঝোলা টাঙানো, মাথায় যখন-যেমন টুপি, নোংরা আলিগড়ি পাজামা, পাঞ্জাবির ওপর বন্ডি । অনীক সাধারণত কালো পাঞ্জাবিতে, ওর-ও কাঁধে তাপ্পিমারা ঝোলা, ঝোলায় ছবি আঁকার টুকিটাকি আর ছিলিম, পায়ে কোলহাপুরি ।
কাঠমাণ্ডুর নেপালি-নেওয়ারি তরুণ অপেরা-লেখকরা পছন্দ করতেন কানট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি আর জাঁড়, যা রাহুলরা খেত মাংসের আচার দিয়ে । তার আগে জানত না যে হরিণের মাংসের, মোষের মাংসের, আচার হয় ।
অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে বানানো কাচিলা মন্ডের সঙ্গে চুকুস-চুকুস । রাহুলরা রাকসিকে বলত রাক্ষসী,
মহুয়ার চেয়েও কড়া মেজাজের, জিভে কামড় দিয়ে পেটে নেমে যেত রাক্ষসী ; পেটের ভেতরে নেমে সে-রাক্ষসী তার লাল-নীল-হলুদ-বেগুনি-সবুজ চুল উড়িয়ে দিত শিরা-উপশিরায়। রাকসির গন্ধ বেশ ঝাঁঝালো ; অনেক দূর পর্যন্ত যেত তার নিশিডাক । রাকসি তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে সবাই আয় ।
নেপালের সংবাদপত্রে রাহুলদের উপস্হিতির সংবাদ সেখানকার তরুণ অপেরা-লেখকরা ফলাও করে ছড়িয়ে
দিয়েছিল বলে অনেক ব্যাপার আর জিনিসপত্র হয়ে গিয়েছিল সহজলভ্য, এমনকি বিনে পয়সায় । প্রায়ই ডাক আসত এ-দালান সে-দালান থেকে সারারাত রাকসিপান আড্ডায় অপেরার জন্য।
রাহুল আর অনিকেত দুজনেই গিয়েছিল, সঙ্গে সুকোমল রুদ্র আর অকিঞ্চন চক্রবর্তী । অনিকেত, সুকোমল, অকিঞ্চন দু-তিন সপ্তাহে ফিরে গেলেও রাহুল, চাকরি থেকে নিলম্বিত থাকায়, থেকে গিয়েছিল কয়েক মাস , ওই জনপ্রাসাদে, অনীক-নির্মল বাউলা, দুই চিত্রকর বন্ধুর সঙ্গে, যাদের সঙ্গে রাহুলের বন্ধুত্ব হয়েছিল বেনারসে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে ওরা হয়ে উঠেছিল ওদের শহরপ্রদর্শক, বেনারসে ঘাঁতঘোঁতের গাইড, আর দরকার পড়লে বিছানায় শোবার-ঘুমোবার সঙ্গী ।
অচেনা তরুণীর সাথে শুয়ে পড়তে গেলে নিজেকে অতীত থেকে ভেঙে বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হয় । কে জানে কার কোন রোগ, মনের, দেহের । রাহুল, যে চিরটাকাল একাকীত্বের বিষে ভুগেছে, বিপজ্জনক ভবিষ্যতের ফাঁদে পা দিতে ইতস্তত করেছে, আর উদ্বেগ-উৎকন্ঠার দোটানায় পড়েছে বারবার ; তবুও ওই আহ্লাদের খোঁজ থেকে বিরত হতে পারেনি। মাদকের আর যৌনতার বিভাময় হ্যালোতে আকৃষ্ট হয়েছে । যাপনকে করে তুলতে চেয়েছে অবাধ আর সীমালঙ্ঘনময় ।
রাহুলের, ওই জনপ্রাসাদে থাকার সময়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় সেই প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । নানা অপেরা-আড্ডায় সময় কাটিয়ে, ও ,রাতে ফিরে ,প্রায়ই গুলিয়ে
ফেলত। ওরা ছিল দোতলায় । কটা পাকের পর দোতলায় পৌঁছোবে তা খেয়াল রাখতে পারত না । প্রত্যেক দিন বাঁদিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেত যে, এটা নয়, নিচে বা ওপরে গিয়ে ডানদিকে যেতে হবে । কারও কারও দরোজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা, মনে হতো যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । সে ঘর কোনো হিপি-হিপিনির হলে তাদের ঘরের খড়ের বিছানায় গিয়ে চিৎপটাং গা এলিয়ে দেবার বাধা ছিল না, সকাল পর্যন্ত, বা যতক্ষণ না ধোঁয়ার খোঁয়ারি কাটছে ততক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে ।
এমিলিয়া বনিয়া এক হ্যাঁচকায় তার স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে টান দিলে, হ্যাশিশের ঝিলমিলে নেশায়, পায়ের দিকে মাথা করে ঘুম । মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা হয় তাকে বোধহয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা, নিজের গড়ে-নেয়া আকাশে-বাতাসে। ছাদ থেকে ফেলে দেয়া টিশ্যু পেপারের মতন । কত রকমের রঙের বিস্ফোরণ ঘটে নিঃশব্দে, উড়তে থাকে কমলালেবুর কোয়ার ডানা মেলে প্রজাপতির ঝাঁক ।
একদিন রাতে ফিরে, আজও স্পষ্ট মনে আছে রাহুলের, সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেল, হদিশ করতে না পেরে নিচের পাকে নেমে এলো, আরও কয়েকবার ওঠা-নামা করার পর উঠছে, একটা বাঁদিকের ঘর থেকে নোংরা পরদার ফাঁক থেকে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এলো, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা ; এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি-টানের হিন্দিতে বললেন, ‘রোজই দেখি দরোজা অব্দি আসো, ফিরে যাও কেন ?’
কাঠমাণ্ডুতে কয়েকমাস থেকে, বেনারস হয়ে, বেনারসে কুড়ি দিন আর একুশ রাত কাটিয়ে, রাহুল ফিরে গিয়েছিল শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহরে । বেনারসে ঘর ভাড়া নিয়েছিল এমিলিয়া বনিয়া, তিন তলার ছাদে একলা একটা ঘর । জীবন হয়ে গিয়েছিল গুহামানবের, অনেক সময়ে চারপেয়ে পশুর । এমিলিয়া বনিয়াকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশে, পরে, তার যাবতীয় কাণ্ড-কারখানা নিয়ে একখানা উপন্যাস লিখে ফেলেছে রাহুল, এমন কায়দায় যাতে পাঠক মনে করে ওটা বানানো গল্প ।
কলকাতা থেকে সুকোমল রুদ্রর তাড়া আসতে, যেতে হল ।
আদালত ওকে একমাসের জেলের সাজা দিতে, ও রিভিশন পিটিশনের দরখাস্ত দিল । তারপর হাতে অফুরন্ত সময়।
একদিন হঠাৎ নির্মল বাউলা এসে হাজির, দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, কদমছাঁট চুলে, টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে । বলল, অনীক একজন হাফ-হিপিনীর সঙ্গে লিভ টুগেদার করছিল, তারপর ভয়ে চলে গেছে দিল্লি ।
–হাফ-হিপিনী ?
–হ্যাঁ, আমেরিকান এমব্যাসির অফিসারের মেয়ে, সে অফিসার দিল্লিতে পোস্টেড ।
–ভয়ে ? কার ভয়ে ?
–অকিঞ্চন ব্যানার্জি চারু মজুমদারের আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বলে হাতে বেয়নেট নিয়ে পুলিশ ওদের সবায়ের পোঁদে লেগেছে ।
রাহুল বলল, পশ্চিমবঙ্গ তো আরো বিপজ্জনক, তুমি বরং কানপুর চলে যাও, জুহি পরমপুরওয়ার বস্তির লোকেদের সঙ্গে মিশে যাও । অনিকেতকে বলো কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করতে । অনীক শেষে ফাঁদে পড়েনি তো ? কে যে কার ওপর নজর রাখার জন্য কাকে ব্যবহার করছে তা টের পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে গেছে হে ।
নির্মল বাউলা সপরিবারে কানপুর পৌঁছোলে, অনিকেতের উপদেশমত ও নাম পালটিয়ে ফেলল, নতুন নাম হল রামবহল প্রসাদ, কদমছাঁট চুল, চুল থেকে উঁকি মারছে টিকি । ধুতি আর শার্ট । অনিকেত ওকে রঙিন মাছের দোকান খুলে দিল । চারু মজুমদারের আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নির্মল বাউলা আবার নিজের নামে ফিরে গেল । কিন্তু বেনারসে ফিরল না । বসত গাড়ল দিল্লিতে ।
ওরা তিনজনেই, অকিঞ্চন, অনীক আর নির্মল, বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজবদলের গোপন স্বপ্নে মজে রইল যতদিন বেঁচে ছিল । ততদিনে স্বপ্নভূমি শহর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে গভীর জঙ্গলে ।
সুমিতাদি, মানে সুমিতা চক্রবর্তী, ভবিষ্যত টের পেয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন থেকে চুপচাপ উঠে আলতো পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন ।
মার্কিন বন্ধুনি অনীক খাস্তগিরকে নিয়ে, পাড়ি মারল আমেরিকা । নির্মল নিজের নামে ফিরলে, অনীক আর অকিঞ্চন দেশে ফিরল । অনীক ওর মার্কিন বউকে না জানিয়ে ফিরে এসেছিল, এসে, ডাকে ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছিল, কেননা ততদিনে ওর এক আইরিশ বন্ধুনি দখল করে নিয়েছে ওর জীবন আর সময় ।
অকিঞ্চন ব্যানার্জিও বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল, নয়তো খুন হয়ে যেত ।
রাহুল অতীতে ফেরে ।
ঠাকুমা, সবাকসুন্দরী, তাঁর করা প্রশ্ন মনে আছে : ঘুমের মেয়ে না শোবার মেয়ে !
ঘুমের মেয়ে ? না, শোবার মেয়ে ?
ঘুমোবার বা শোবার কেন্দ্রে মেয়েরাই বা কেন ?
সারা জীবনে কোলবালিশ যে ভালোবাসা পায়, তা কি ভেবে দেখিছিস ? জিগ্যেস করেছিলেন সবাকসুন্দরী দেবী।
বালিগঞ্জ কি কেন্দ্র ? শৌখিন বাঙালিয়ানা সেদিকেই এগোচ্ছে । বুদ্ধদেব বসুর অপেরাভবন ওই এলাকাতেই । ওমুখো হতে চায়নি জীবনানন্দ দাশের গোপন বিপদসঙ্কুল অপেরা ; সবই ট্রাঙ্কে চলে গেছে, থাকের পর থাক খাতা, সযত্নে । বোধহয় জানতেন যে প্রতিটি ভবনই অবসানের দিনক্ষণ সঙ্গে করে আনে ।
জোড়াসাঁকোকে রবীন্দ্রনাথ তুলে নিয়ে গেছেন বোলপুরে । তিনি বিদায় নেবার পর সেখানে একজুট হয়েছে বিভ্রান্তি, রক্তহীনতা, অবরোধ, আপেক্ষিকতা, কলুষ, অলীকমায়া আর প্রবঞ্চনার এমন অভিকর্ষ যা শিকড়কে মাটিতে টানতে চায় না ; পারে না । ক্ষুদ্রদের কী ভাবে দৈত্যের মতন দেখায়, পোকামাকড়রা তার অনুশীলন করে ।
রবীন্দ্রনাথ ! সুমিতাদির হাত ধরে ব্রাহ্ম কবি-লেখকদের জগতে । সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলার সেই শুরু ।
হাওড়া-শেয়ালদা-দমদমে পা দিয়েই যেখানকার মানুষ নিজের মধ্যে আত্মগোপন করতে চেষ্টা করে, সেখানে কী করেই বা গড়ে উঠবে কেন্দ্র ! ফলে দোষগুলোই হয়ে উঠেছে শহরটার বৈভব । গর্তনিবাসীরাও অকারণে ছদ্মবেশ ধরে । কেউই জানে না গর্তের মুখটা গোল না চৌকো না খাপছাড়া । মাঝে-মাঝে তাদের সুপ্ত সন্ত্রাসের আপতন, অমনোযোগী মজার ক্ষণস্হায়ী সম্ভাবনার ঝলকানি কখনও-সখনও চোখে পড়েছে রাহুলের, যার ডাক নাম রাহু ।
অসীম গাঙ্গুলি আঁচ করলেন, রাহুল, যার ডাক নাম রাহু, কী ভাবছে । উনি বললেন, বেশ শ্লেষ মেশানো কন্ঠস্বরে, ‘রক্তিমকে বই ছাপতে দিয়েছিলে শুনেছি, সে বইয়ের কী দশা হয়েছে তাও শুনেছি।’ তারপর যোগ করেছিলেন, ‘স্কুল-কলেজে ভালো ফলাফল করলেই মানুষ চেনার ক্ষমতা হয় না । তোমার দাদা তো রক্তিমকে ভালো করেই চিনতো ; ওর পাহাড়টিলার বাসায় ছিল দুবছর । ওর তো উচিত ছিল তোমাকে সতর্ক করে দেয়া । অনিকেতের শ্বশুর কেন নিজের মেয়ের সঙ্গে রক্তিমের বিয়ে দিতে চাননি তা জানো তো ? আমাকে বিশ্বাস করা প্রয়োজন মনে করোনি তুমি !’
রক্তিম চাটুজ্জের নামটা আন্দোলনের নেতা হিসাবে দেখানো হয়েছে বলে ঈর্ষা, নাকি রক্তিমের অননুকরণীয়
অপেরার জনপ্রিয়তার জন্য ? নাকি পথেঘাটে রক্তিম মদ না খেয়েও মাতাল সাজার অভিনয় করতে পারে বলে ? চাপা
ঈর্ষা মানুষকে কুঁদুলে করে ।
ঈর্ষা হওয়া উচিত সঘোষ ।
নীলকমল চৌধারী, চৌধুরী নয় চৌধুরী নয়, চৌধারী, চঔধাআআআরী, চঔধাআআআরী, হুম, কারেক্ট, যে মোটা-মোটা বাংলা পাল্প-অপেরা অনুবাদ করে দেশের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে গণবিয়েতে পাওয়া বউকে খোশখেয়ালে
তরতাজা রাখে, কাল বিকেলে, ওর বড়বাজারি হিন্দি ট্যাবলয়েড দপতরে আড্ডা দেবার সময়ে বলেছিল, ‘আরে তুম ইন রংবদলু ফলানাদাদা ঢেকানাদাদা লোগোঁকো লেকর কেঁও চল রহে হো ! তুম তো হো রাহু ; সুরজকা আগ খা কর জিন্দা হো । চমকতে হুয়ে আঠ কালে ঘোড়ে পর সওয়ার হো । ছোড়ো উন বুডঢোঁকো ।’
নীলকমল চৌধারীর বাবা নীলকমলের মা মারা যাবার পর যে মেয়েটিকে বিয়ে করেন, তার বয়স ছিল নীলকমলের চেয়ে কম । বাপ-ছেলে একই যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট ; যুবতী বাপের চেয়ে ছেলেতে বেশি । বাড়িতে অবস্হা বেগতিক হয়ে উঠছে দেখে নীলকমলের বাবা সৌরঠ সভার গণবিবাহের মাঠে, যেখানে মৈথিলি ব্রাহ্মণরা বছরে একবার নিজেদের ছেলেমেয়ের পাত্রপাত্রীর খোঁজে ঢুঁ মারে, সেখানে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন নীলকমলের । চার বছরের মাথায় বউয়ের ভাইঝির প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে নিলে নীলকমল ; বিছানায় ডান পাশে পুরোনো বউ, বাঁ পাশে নতুন বউ । টিকল না , নতুন বউয়ের বোনের সঙ্গে আবার প্রেমে পড়ায় ।
বিয়ে করলেই প্রেম ফুরিয়ে যায় মনে করে ও, নীলকমল, আর তাই, বারবার প্রেমে পড়তে চায় । নিজের তৈরি ফাঁদ কাটিয়ে বেরোবার জন্য নীলকমল পালিয়ে এলো কলকাতায় । ব্যাস, কলকাতায় ওকে জাপটে ধরল চিনাদের হালুমবাঘ পাড়া । কাগজের ড্রাগনদের আড়ালে কত কী যে করা চলে, তাও জেনে ফেলল । গাঁজা চরস আফিম চিনা যৌনসেবিকা আর ওই পাড়া থেকে কয়েক চাউমিন-মোমো দোকান দূরে ওর হিন্দি ট্যাবলয়েডের দপতর । রাহুলকে বললে, ‘চলো, তুমকো চিন দেশকে নরক মে লে জাতা হুঁ , ডিভাইন কাম-এ-দুনিয়া মেঁ পহুঁচ কর তুমহারা মর্দানগি খিল উঠেগা, তুমহারে অওর মেরে তরহ চুতিয়োঁকা স্বর্গ হ্যায় ।’
–ডিভাইন কাম-এ-দুনিয়া ?
–হাঁ, তুম চাহে ভার্জিল বনো য়া দান্তে, জো মর্জি । নরক কো স্বর্গ মে বদলনা কোই মামুলি স্বার্থ নহিঁ হ্যায় ।
আবার সেই কল্পনা দখলের খেলা ; কারোরই জানা নেই স্বর্গ কীরকম, কিংবা, সকলেই জানে স্বর্গ কীরকম । এনার স্বর্গে বসিয়ে দাও ওনার স্বর্গ ; ওনার স্বর্গে বসিয়ে দাও তাঁর স্বর্গ । এভাবেই কল্পনা দখল করো ।
নীলকমলের বাড়ি ছিল সাহারসা জেলার মাহিষি গ্রামে, ছিন্নমস্তার মন্দিরের জন্য প্রতিবছর বর্ষায় মেলা হয় ওদের গ্রামে । গিয়েছিল রাহুল, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমমম, যা-ই হোক না, কী-ই বা এসে যায় । মন্দিরে পুজোর রাতে মোষ বলি হয় আর মোষের মাংসের প্রসাদ পায় ভক্তরা । দিশি সোমরস মদের সঙ্গে প্রসাদ , খেয়েছিল রাহুল, অন্য ভক্তদের মতন । রাহুল তো প্যাগান, তহমিনা আপার দেগে দেয়া জাহিল আর কাফের , কুফ্র, কুফ্র, কুফ্র কহিঁকা । রোদ-আলো-বাতাস-জল-প্রকৃতি ওর কাছে ডিভাইন, ঠাকুরদেবতাদের ঘরসাকিন-আদল নিয়ে নিশ্চিত নয়, খালি গায়ে আর মুখে মোষের রক্ত মেখে নেচেছিল । ওর মনে হয়েছিল, আর এর জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় গ্রামবাসীদের যুক্তিহীনতাকে, ভাগ্যিস ছিন্নমস্তার মন্দিরটা ছিল, নয়ত সারা গায়ে মোষের রক্ত মেখে যে রাতদুপুরে দুশো মানুষ-মানুষী মিলে নাচা যায়, সাময়িক হলেও, বেপরোয়া উন্মাদ হওয়া যায়, তা অজানা থেকে যেত । নিজের একাকীত্বকে এনজয় করার আরামদায়ক পাগলামি । ইউরোপের জ্ঞানগম্যি থেকে ছাড়ান পাবার সহজ সুযোগ এনে দিয়েছিল নীলকমল। ভিড়ের ভেতরে সেঁদিয়ে একাকীত্বের মতন আরাম নেই ।
তখন পর্যন্ত, আর এখনও, সত্তর পেরিয়ে, ‘ঈশ্বর’ ধারণাটা কোনো হিন্দু ধর্মবইতে পায়নি রাহুল । পেয়েছে কেবল দেবী-দেবতাদের কাহিনী । কোনো বইতে ‘ঈশ্বর’ নেই , অথচ আত্মীয়-স্বজন-জ্ঞাতিগুষ্টির সবাই সেই অবর্তমান ঈশ্বরের কথা বলে ; দেবী-দেবতাদের মনে করে ‘ভগবান । রাহুলের মাও গণেশ দুর্গা সরস্বতীর মূর্তি সাজিয়ে রেখেছেন ঘরের কোনে, আর তাদের সবাইকে বলেন ভগবান । মা-বাবা কেউই ঈশ্বর শব্দটা কখনও ব্যবহার করেননি কেন, অবাক লাগে রাহুলের । নীলকমলও বলত, ‘আরে ঈশ্বর নামকা কোই অস্তিত্ব নহি হ্যায়, যো তুমহারে ঘরকা দেওতা হ্যায় ওহি ভগওয়ান হ্যাঁয় সমঝলো, বিসওয়াস করনে কা জরুরত নহিঁ, সমঝনে সে মতলব হ্যায়, কোই রহে ইয়া না রহে, কেয়া ফর্ক পড়তা হ্যায় ।’
নেশা নীলকমলকে এমন নির্মোহ জাপটে ধরে ফেলেছিল, যে, প্রেমিকাদের ছাড়লেও, মগজের রাসায়নিক
ইন্দ্রজালের মোহকে ছাড়তে পারেনি । রাহুলরা ওকে ফেরত নিয়ে গিয়ে প্রথম বউয়ের কাছে সোপর্দ করলে, ওকে ভর্তি
করে দেয়া হল হাসপাতালে, লেখকদের কোটায়, একটা আলাদা ঘরে । ডাক্তার ওকে বলে দিয়েছিল যে ওর পেটের আর ফুসফুসের অবস্হা খুব খারাপ । শল্যচিকিৎসা করতে গেলে পুরো হাসপাতাল আফিম গাঁজা চরসের ধোঁয়ায় ভরে যাবে । মনের সুখে হাসিমুখে মরার অপেক্ষা করত ।
একদিন, ভিজিটিং আওয়ারে, রাহুলকে বললে, আমার জন্য কালকে একটা কনডোম এনে দিও ।
–কনডোম ?
–হ্যাঁ, একজন নার্স রাজি হয়েছে ।
কিছুক্ষণ পর একজন ময়লা মালায়ালি নার্স ঘরে ঢুকতে, নীলকমল বললে, এই যে, এই মেয়েটিই রাজি হয়েছে ; তুমি কাল একটা কনডোম নিয়ে এসো ।
নার্স রাহুলের দিকে তাকিয়ে জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁটে হাসি বুলিয়ে শুধিয়েছিল, হ্যাঁ, আপনি একটা কনডোমের প্যাকেট কাল এনে দেবেন, আজকে বরং উনি ভালো করে ঘুমিয়ে প্রেম করার জন্য চাঙ্গা হয়ে নিন ।
পরের দিন রাহুল গিয়ে দ্যাখে ঘর ফাঁকা, রুগির বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর, নতুন রুগির অপেক্ষায় । খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, কাল রাতেই মারা গেছে নীলকমল । ওর প্রথম বউ রাত থাকতেই নিয়ে গেছে ওর শবদেহ । প্রাক্তন প্রেমিকারাও শবদেহের মালিকানার প্রশ্ন তুলতে পারে ! কেন ? রাহুলরা ওর শবদেহ নিয়ে যখন দাহ করার জন্য বেরোল, বাড়ির সামনে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সমস্বরে ওর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী অপেরার লাইন আবৃত্তি করছিল । নীলকমলের অপেরায় একটা লাইনে যে ওর নাম রয়েছে, প্রথম শুনল রাহুল, শ্মশানের পথে । বইটা দিয়েছিল নীলকমল, কিন্তু আলস্যের দরুণ পড়া হয়ে ওঠেনি । আদরে পাওয়া কত বই যে অনাদরে চুপচাপ পড়ে থাকে, পড়ে থেকে-থেকে পড়েই থেকে যায়, পড়া হয়ে ওঠে না কোনো দিন । বইগুলো অপরাধবোধে ভুগে-ভুগে হলুদ-কালচে হয়ে যায় ।
সেই নীলকমল জানতে চেয়েছিল, ফলানাদাদা-ঢেকানাদাদাদের কেন সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে ।
কেন চলে চলেছ ?
আমি কেন নিয়ে চলব ? ওনারা দমবন্ধ হয়ে বাধ্য হয়ে চলে চলেছেন । অসীম গাঙ্গুলি ওনাদের দমবন্ধ করে
দিয়েছেন।
কী করে জানতে পারলেন অসীম গাঙ্গুলি যে রক্তিম চাটুজ্জেকে বই ছাপাবার টাকা দিয়েছিল রাহুল ! দাদা অনিকেত , যাঁর ডাক নাম কেতু, বলেননি নিশ্চই । হয়তো মদের ঘোরে তন্দ্রামাতাল রক্তিম চাটুজ্জে নিজেই ফাঁস করে দিয়ে থাকবেন । ঠিকই, দার্শনিক অপেরা নিয়ে লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি আর টাকা রক্তিম চাটুজ্জেকে দিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু ; উনি অত্যন্ত বাজে কাগজে পঞ্চাশ কপি বই ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, প্রুফ দেখার প্রয়োজন মনে করেননি ; নিজেই একটা প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন । সে বই জড়ো করে রক্তিম চাটুজ্জের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনেই, পেটরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । বাকপটুতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে জোরাজুরি করেছিলেন রক্তিম, যাঁর অপেরার নিশিডাকে মুগ্ধ ছিল রাহুল ; আর সে মুগ্ধতা কাটিয়ে ও কখনও, এমনকি আজও, যখন ওর বয়স, মমমমমমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, বেরোতে পারেনি, রক্তিম চাটুজ্জের সঙ্গে সম্পর্ক বিগড়ে যাবার পরও । বিগড়ে যাবার কারণ কেবল টাকা নয়ছয় নয় । কাউকে-কাউকে এক-এক সময়ে ভালো লাগে, আবার হঠাৎ ভালো লাগে না, অকারণে ।
রাহুলের বেশ আহ্লাদ হয় যখন রক্তিম চাটুজ্জের গবেষকরা, থিসিস লিখতে বসে, রাহুলকে খোঁচান , যেন রক্তিম চাটুজ্জেই ওই যন্ত্রজীবদের বকলস খুলে দিয়ে থাকবেন । কত সেলিব্রিটি আজকাল মদের বিজ্ঞাপনের মডেল হন । রক্তিম চাটুজ্জেও হতে পারতেন । কোষ্ঠকাঠিন্য আর সর্ষের তেলের চেয়ে শ্রেয় হতো যখন লুপুংগুটুর ঝর্ণার পৃষ্ঠভূমিতে ঘাসের ওপর শুয়ে বলতেন, ‘কওন কমবখ্ত হ্যায় জো বরদাস্ত করনে কে লিয়ে পিতা হ্যায় ; ম্যায় তো পিতা হুঁ কি বস সাঁস লে সকুঁ’, মহুয়া মদের খালি বোতল জলেতে ভাসিয়ে দিয়ে ! পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ছাতিম গাছের তিনটে হলুদ পাতার ডগা ।
রাহুল যখন বিভাগীয় প্রধান পদে কলকাতার দপতরে বদলি হয়ে এলো, তখন কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে ওর মৃত্যু হয়েছে । দুচারটে পত্রিকা ওর মৃত্যু নিয়ে আহ্লাদমাখা সম্পাদকীয় লিখেছিল । রাহুল তখনও কোয়ার্টার পায়নি বলে অনিকেতের বাড়িতে ছিল । ওর মৃত্যুর খবরে, অনিকেতের বাড়িতে, ছুটে এসেছিলেন কিন্তু রক্তিমই । সেখানে রাহুলকে দেখে বলে উঠলেন, ‘আরে ! তোমার মরে যাবার আনন্দে খালাসিটোলায় তোমার বন্ধুরা চিয়ার্স করছে, আর
তুমি এখানে ইজিচেয়ারে বসে ঠ্যাং নাচাচ্ছ ! চলো, বেঁচে থাকার আনন্দে স্মিরনফ ভোদকা খাওয়াবে চলো ।’ রাহুল
বলেছিল, একদিন যাবো আপনার বাড়ি স্মিরনফের বোতল নিয়ে । আপনি, আপনার স্ত্রী, দাদা, আমরা সবাই মিলে খাবো । রক্তিম বলেছিলেন, কবে আসবে ফোনে জানিও, মাংস-ভাত আর স্মিরনফ । গিয়েছিল রাহুল । সবাই নানা মাপের কাচের গ্লাসে, রক্তিমের স্ত্রী ওনার উঁচু শ্যামপেন গ্লাসে । কোথা থেকে অমলেন্দু আতর্থী জুটে গিয়েছিল সে-মৌতাতে।
রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , প্রথম কথা-কাটাকাটির দিন, অসীম গাঙ্গুলির অগোছালো ধূসরফুল তোশক পাতা খাটে , যা মনে হচ্ছিল ঘুমের আলস্য ঝেড়ে স্বপ্নে মুখরিত মজাহীন রাত কাটিয়ে তখনও বেরোতে পারেনি, আগাম ম্যারাথন লেখালিখির আঁতুড় ঘর, আর ছোট্টো টেবিলে রাখা পত্র-পত্রিকার গন্ধের উদাসীনতার মাঝে বসে , চিৎকারে লুকোনো অচেনা ভাষার মতো বক্তব্যে, প্রায়-ফাঁকা রেলস্টেশানে কোনো মহিলার অট্টহাসির আকর্ষণে ক্ষণিক স্তম্ভিত জনাকয় পাবলিকের মতন , হতবাক, থ ; যেন বহু বহু বহু বহু দুরের ছায়াপথ থেকে পাঠানো শীতে, অসীম গাঙ্গুলি মুড়ে ফেলতে চাইছেন নিজেকে। ওনার রয়েছে নির্ধারিত ছককাটা উদ্দেশ্য ,জীবনের মেপে-নেয়া গতিপথ ,আকাঙ্খার রৈখিক নকশা । গলার শিরা ফুলিয়ে বলেছিলেন, কাফকা, বালজাক, মার্সেল প্রুস্তের মতন গদ্য লিখে তাক লাগিয়ে দেবেন , বাংলা গদ্যকে এমন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবেন যা প্রদীপন চট্টো কল্পনাও করতে পারবে না ।
তাহলে সেই কল্পনাই !
কল্পনা যদি তিন মাথার মোড়ে এসে দাঁড়ায় ?
ইহুদিদের পরমপুরুষ মোজেসের পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল টেন কমাণ্ডমেন্টসের পাথরের টুকরোগুলো , সারা ঘরময় । জড়োকরা গল্পের খাজাঞ্চিখানা । টুকরো-টুকরো আয়না ছড়িয়ে মেঝেতে টুকরো-টুকরো মুখ ।
অসীম গাঙ্গুলিকে, দেখা করার দিনক্ষণ জানিয়েই গিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । অপেরাগ্রন্হ প্রকাশ করা নিয়ে কথা বলবে বলে এসেছিল, কিন্তু রাহুল ওদের আন্দোলনের একটা লিফলেট ওনার দিকে এগিয়ে দেয়া মাত্র সারা ঘর গমগম করতে শুরু করেছে বিদারের চচ্চড় আওয়াজে ।
নেতৃত্ব ! একটা ফালিকাগজে ইংরেজিতে লেখা একটা শব্দ । তার আঘাত এতো গুরুতর ! লিডার ?
রাহুল যখন এসে পৌঁছেছিল ,বাড়ি ছিলেন না উনি । মাসিমা, ওনার মা , বললেন, বোসো বাবা, তোমার প্রিয়
ইলিশ মাছ কিনতেই গেছে ও ; ফিরবে এক্ষুনি ।
অসীম গাঙ্গুলির মা কী করে জানলেন রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু, ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসে ! ও তো বলেনি কখনও । এর আগে একবারই ভাত-ডাল-আলুভাজা খেয়েছিল অসীম গাঙ্গুলির নিমপুকুরের পুরোনো বাড়িতে । নিরামিষ ।
অসীম অবশ্য রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে খেয়েছিলেন ইলিশ । মচ্ছিবাজার থেকে কিনে এনেছিল রাহুল, ঝিকমিকে রুপোলি ইলিশ।
ঘন্টাখানেক পরে বাজার করে ফিরেছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে রাহুলকে, যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, এক নজর দেখে, শরীরে গাম্ভীর্য খেলিয়ে, ভেতরে চলে গিয়েছিলেন ।
অসীম গাঙ্গুলির কন্ঠ শুনতে পেল রাহুল , ‘ইলিশ পাওয়া যায়নি ; আমেরিকান কই এনেছি ।’
আমেরিকান কই ! আমেরিকাতে কইমাছ হয় নাকি ? স্ট্রেঞ্জ ! রাহুলের জানা নেই ।
ঘরে ঢুকে, রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমেরিকান কই খাও তো ? নতুন এসেছে বাজারে। বিদেশে একে তেলাপিয়া বলে, খেতে ভালো, কাঁটা নেই । তোমাদের কানপুরে পাওয়া যায় ?’
কে জানে, হয়তো ইচ্ছে করেই ইলিশ আনেননি অসীম ; মাছের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে চাইছেন । খাবার জন্য তো আসেনি রাহুল , যার ডাক নাম রাহু । এসেছিল রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে ওর প্রকাশিতব্য বই নিয়ে কথা বলতে, আর ওদের আন্দোলনের একটা বুলেটিন দেবার জন্য ।
অসীম গাঙ্গুলির দিকে আন্দোলনের সাপ্তাহিক বুলেটিনের ফালিকাগজটা এগিয়ে দিতে, ছিনিয়ে নিয়ে, বলে উঠেছিলেন, ‘দেখেছি দেখেছি ; তোমার বন্ধু হরিচরণ খাঁড়া দিয়ে গিয়েছিল ।’
পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল রাহুল । ওনার মুখে, রাহুলের বড় জ্যাঠা যাকে বলতেন, রাগলে পরে সারা শরীরে পাথুরে জীবাশ্মর ঢেউ ছড়িয়ে ছড়িয়ে ঝির-ঝির ঝরে পড়তে থাকে, সেরকম আদল চোখে পড়ল রাহুলের ।
–লিডার ? লিডার আবার কী ? অপেরা মুভমেন্টের লিডার হয় নাকি ? হয়েছে কখনও ? কোন আন্দোলন
লিডারের নাম ঘোষণা করে আরম্ভ হয়েছিল ? সুররিয়ালিজম, সিমবলিজম, ডাডাইজম, কোনো অপেরা-আন্দোলনের
ম্যানিফেস্টোতে লিডারের নাম দেখেছ ? ম্যানিফেস্টোতে কি আঁদ্রে ব্রেতঁ লিখেছিলেন যে উনি পরাবাস্তববাদীদের নেতা ?’ মনে রাখা আর ভুলে যাওয়ার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে, একটানা প্রশ্ন করে গেলেন অসীম গাঙ্গুলি। তারপর বললেন, ‘ইংরেজিতে কেন ? আন্দোলন করতে চাইছ বাংলার অপেরাজগতে, ইংরেজিতে ম্যানিফেস্টো লিখে ? তোমার কানপুরের হিন্দি রসিকদের জানাতে চাও যে কলকাতায় আধুনিক অপেরার নেতৃত্ব এখন কার কন্ঠে ?’
শুনতে-শুনতে, রাহুলের মনে হল, যেন কন্ঠরোধী রসায়নের তোড় আটকে গেছে ফুসফুসে, যা ওগরাবার সুযোগ পেয়ে গেলেন উনি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় ।
ওহ হো ; এবার স্পষ্ট হল রূপক মজুমদার কেন রামায়ণ নট্ট কোম্পানি ছেড়ে চলে গেছেন । রূপকের কোনো ধরে রাখার লোভ নেই । ছেড়ে দেবার ক্ষমতা অনেকটা মহাশূন্যের মহাবিস্ফোরনের ক্ষমতার মতন ; একের পর এক গ্রহ আর উপগ্রহ নিজের দেহ থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশকে ভরে তুলেছে বিস্ময়ে । ধরে রাখাটা ক্ষমতা নয় ; ক্ষমতার অভাব । অন্যদের নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখার প্রয়োজন কেনই বা হবে একজনের !
অনেককাল পরে, রাহুলের বয়স তখন কত, সে যা-ই হোক, কী-বা এসে যায়, ওই একই ফালিকাগজে ছাপা আরেকটা শব্দ আতঙ্কিত করেছিল কামেশ্বর চোঙদারকে, মহাভারত নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায়ের ওসকানিতে । সেই শব্দটা ছিল ক্রিয়েটার । কামেশ্বর চোঙদার সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল প্রভাস চোঙদার, অমলেন্দু আতর্থী আর নবদেব সরখেলের রক্তে । বেচারা । রক্তদূষণে তারা ঢুকে গেল শাসকদলের ছত্রছায়ায় ।
সুমিতাদি : লিডার, ক্রিয়েটার এই সমস্ত ধারণাগুলো তো তুই বাইবেল থেকে পেয়েছিস ; লোকে তো বলবেই তোরা বিদেশি প্রভাবিত ।
রাহুল : খ্রিস্টধর্ম কি বিদেশি ?
সুমিতাদি : ধর্ম তো জাস্ট আইডিয়া, যে-আইডিয়ায় একটা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে ।
রাহুল : তবে ?
সুমিতাদি : তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ । গোঁফ-দাড়িতে ওই ভদ্রলোক, রক্তিম চট্টোপাধ্যায় না কি যেন নাম, তার মধ্যে তুই খুঁজে পেলি ওল্ড টেস্টামেন্টের মোজেসকে, আর মোজেস, সকলেই জানে, ছিলেন লিডার ; নিজের মধ্যে খুঁজে
পেলি জিশাস খ্রাইস্টকে, যিনি, সকলেই জানে, খ্রিস্টধর্মের ক্রিয়েটার ; আর হরিচরণ খাঁড়া নামের ভদ্রলোকটি হলেন সেইন্ট পিটার, খ্রিস্টধর্মের প্রচারক । অনিকেত, তোর দাদা, দাঁড়িয়ে আছেন আব্রাহামের মতন বা সেইন্ট জোসেফের মতন ।
রাহুল : না, আমার মাথায় তো অমন চিন্তা ছিল না ।
সুমিতাদি : অবচেতনে ছিল । সেইন্ট পিটার যোগাড় করতে লাগল সদস্যদের, কনভার্ট করার জন্য । কেউ-কেউ হল, কেউ-কেউ হল না, বা হয়েও পালিয়ে গেল ।
রাহুল : এটা ঠিক যে একাধজন জুডাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, ফর থার্টি পিসেস অব সিলভার ।
সুমিতাদি : ধর্ম নিয়ে যে ঝগড়াঝাঁটি হয় তা ওই লিডার-ক্রিয়েটার থেকে জন্মেছে । তোর লিডার অমুক, তার লিডার তমুক । লিডার-ক্রিয়েটারের কী-ই বা দরকার ছিল ! তোদের কাজিয়াটাও সাম্প্রদায়িক কাজিয়ার মতন ।
রাহুল : তোমার লেনিনও তো লিডার ; তোমার মার্কস তো ক্রিয়েটার । নয়কি ?
সুমিতাদি : আমি তো তোকে বলেছিলাম, যে যারা নিজেদের মার্কসবাদী বা লেনিনবাদী ঘোষণা করবে, সাম্যবাদী ঘোষণা করবে, তারা তোদের মতনই, বিশ্বাসের টুকরো-টাকরার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কাজিয়ায় মাতবে । দ্যাখ না শেষ পর্যন্ত কী হল সোভিয়েট রাষ্ট্রের আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ।
রাহুল : আমার কোনো দাবি-দাওয়া নেই, ছিল না ।
সুমিতাদি : সর্বভূক বিষবৃক্ষটার জন্ম তো তুই-ই দিয়েছিস । কী করে বলছিস তোর দায় নেই ?
রাহুল : নেই, জাস্ট নেই । যারা মালিকানার রোগে ভুগতে চায় তারা ভুগুক, তাদের ছেলে-মেয়েরা ভুগুক, চ্যালা-চামুণ্ডারা ভুগুক । আমার কিছু করার নেই ।
সুমিতাদি : সে তুই এখন যে যুক্তিই দিস না কেন, তোর ওই ক্যাথলিক স্কুলের প্রভাব তুই যে ছাড়াতে পারিসনি তা তোকে স্বীকার করতে হবে । আর তোর ওই কনট্রোভার্শিয়াল কবিতাতেও, মেয়েটি কে জানিস ? মেরি ম্যাগডালেন।
রাহুল : অঞ্জলির কথা বলছ ?
সুমিতাদি : স্মৃতির কথা বলছি । ক্যাথলিক স্কুলের স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছিস ব্যক্তিগত উত্তরণের স্মৃতি ।
উত্তরণ না বলে, আক্ষেপও বলতে পারিস । আক্ষেপের স্মৃতি ।
রাহুল : স্মৃতি থেকে তো আর আইরিশ নানদের মুছে ফেলতে পারি না । তোমাকে কি কোনো দিন স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব ভেবেছ ? নেভার ।
বহুকাল পর, রাহুলের বয়স তখন কত, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, টিভির পর্দায় ঢাকার রাজপথে
নাস্তিক-আস্তিক লড়াই দেখে রাহুল ভাবছিল, কেনই বা আস্তিকরা আফগান স্যুট পরে খুনোখুনি করছে, যখন কিনা তারা বাঙালি । তখন ওর মনে পড়েছিল সুমিতাদির কথাগুলো ; বিশ্বাস মানুষকে পোশাক পালটে ফেলতে ওসকায় । বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে হলে পালটা-বিশ্বাস দরকার হয়ে পড়ে ।
রূপক মজুমদার টুসকি বাজিয়ে মুছে ফেলতে পারতেন, পেরেছেন আজীবন । যা পেছনে তা অদৃশ্য । পালটা-বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল না ।
শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহরের চিলেকোঠায় রূপক মজুমদারকে দাদার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে দেখলেও ওনার সঙ্গে রাহুলের প্রকৃত পরিচয় হয়েছিল পরে, রাহুলের বয়স তখন কত, কোন সালে, মমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, বাগবাজারের মোড়ে, যখন রাহুল আর অনিকেত একটা অত্যন্ত নোংরা পাইস হোটেলে ভিজে কলাপাতার ওপর ভাত নিম-বেগুন ইলিশের ঝোল খেয়ে, পাণিহাটির পথে, শেয়ালদা স্টেশান যাবে বলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে । সেসময়ে শেয়ালদা স্টেশানচত্তর সংসার-ভাঙা মানুষ-মানুষীতে গিজগিজে, যেতে হবে সেইসব ভাঙা সংসার ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে ।
–তুই অনিকেতের ভাই রাহুল ? কলকাতায় ভর্তি হতে এসেছিস ? অনিকেত পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন রূপক ।
–না, ও কানপুরেই পড়বে, অনিকেত জানিয়েছিল রূপককে ।
–ওর নাম রুপক মজুমদার, ও-ই রামায়ণ নট্ট কোম্পানিটা শুরু করেছে, এই কথা বলে, অখদ্দে প্রচ্ছদের অপেরা সুভেনিরের কপি দেখিয়েছিল অনিকেত । ওই নট্ট কোম্পানি সম্পর্কে রাহুলের আগ্রহ হয়নি, মিশনারি স্কুলে শিক্ষার কারণে ওর বিচরণের ক্ষেত্র ছিল ইংরেজি-ভাষার বইপত্র । কিন্তু এত কম বয়সের নট শুনে ওর ভীতিবিস্ময় হয়েছিল ।
দ্বিতীয়বার রূপকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটা নাটকের মহড়ায়, যাতে অনিকেতের কেবল একটা এক লাইনের সংলাপ ছিল । তৃতীয়বার ধানবাদে। অনিকেতের চাকুরিস্হলে প্রায়ই আসতেন রূপক । রাহুলের মনে হতো উনি কোনো না কোনো তাৎক্ষণিক ক্রাইসিস এড়াবার জন্য অনিকেতের পাহাড়ি আস্তানাগুলোয় পৌঁছে যান । অনাথ ছিলেন, আর হয়তো তাই, তাঁর মধ্যে অধিকারবোধ, স্বত্তাধিকার, মালিকানা, স্বামীত্ব ইত্যাদি অঙ্কুরিত হতে পারেনি, যে-গুণ বা দোষগুলো ছিল অসীম গাঙ্গুলির চরিত্রে কুঁদে-কুঁদে ঠাসা । যা নিজের মধ্যে সঞ্চিত করে আহ্লাদিত হওয়া যায়, মানে, যৌনতা আর প্রজ্ঞা, তা-ই রূপকের যাপন-অভিমুখের দিশা-নির্দেশ দিয়েছে । রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সদস্যরা তাঁকে, ঈর্ষাবশত, র্যালা মজুমদার নামে ডাকত ।
রাহুলের মকদ্দমার সময়ে, ওকে সমর্থনের জন্য, একটা আবেদনের খসড়া লিখে রূপক সর্বত্র ছুটোছুটি করেছিলেন, অনেকের বাড়ি আর অফিসে গিয়েছিলেন, অনুনয়-বিনয় করেছিলেন, কিন্তু অর্নব বাগচী ছাড়া একজনেরও স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারেননি । তখনকার তরুণদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন অর্নব বাগচী, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির আরেক প্রতিষ্ঠাতা । সে-সময়ে যাঁরা নিজেদের বাঙালি মূল্যবোধ ও ডিসকোর্সের অধিপতি ভেবে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ছড়ি ঘোরাতেন, দেহাতি কানপুরি রাহুল যে তাঁদের সেসব সংজ্ঞাবলী, বৈশিষ্ট্য ও মূল্যায়নের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নান্দনিক স্তরে তাঁদের বেদখল করে দিতে চাইছে, তা অনুধাবন করতে দখলিস্বত্ত্ব-বিরোধী ও আস্তিত্বিক অনাথ রূপকের বিলম্ব হয়নি ।
রূপক মজুমদারের সঙ্গে, শেষবার দেখা হয়েছিল অনেককাল পরে, সেই যখন রাহুলের বয়স, মমমমমম, বোধহয় সাতচল্লিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, কলকাতা বইমেলায় । ছোটো-ছোটো করে চুল ছাঁটা, হেটো ধুতিতে উনি ।
ইংরেজিতে ইশতাহার ছাপানো বলে অসীম গাঙ্গুলির ক্রোধের উৎসটা ঠিক কোথায়, অনুধাবনের চেষ্টা করল রাহুল । ইংরেজির অভিকর্ষটা ভিন্ন, নিঃসন্দেহে, অসীম গাঙ্গুলির আয়ত্বের বাইরে, আপাতত ।
কানপুর তো হিন্দিভাষী অঞ্চল , যেখানে থাকে রাহুল । ওর কলেজের অধ্যাপকরা, সহপাঠীরা, বন্ধুরা, বেশিরভাগই অবাঙালি । আন্দোলনের ইশতাহার নিয়ে তাদের কাছে কি যাবে না রাহুল ? ছোটোবেলার ক্যাথলিক
স্কুলের নানদের কাছে ?
আর রাণো নামের সেই নেপালি সহপাঠিনীর কাছে, প্রথমবার অপেরা-সংলাপ লিখে কাগজটা ভাঁজ করে যার হাতে দিয়ে প্রতিদানে চুমু পেয়েছিল ? সে রচনা তো, কয়েকদিন ঘষেমেজে, রাহুল ইংরেজিতেই লিখেছিল । মাথা ঠাণ্ডা না করে কোনো লেখাই লিখতে পারে না ও, লিখে ফেলে রাখে, উড়ন্ত শব্দ আর বাক্যদের কিছুকাল যাবত ধরে-ধরে খাতার ভাঁজে নিয়ে আসে, ঘষামাজা করে, পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও পরিবর্তন-পরিমার্জন করে, বইতে ঢোকার আগে
পর্যন্ত রদবদল করে ।
রাণোকে লেখা অপেরা-সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘এক্সচেঞ্জ এ কিস’ । বোকামির চতুর কবিতাটাও আবছা মনে আছে রাহুলের :
লেট ইওর পারফিউমড হ্যালো
ফল ফর এ ফিউ সেকেন্ডস
টু এনাবল মি ইন পিকিং আপ
দি মেমরি অফ ইওর গ্ল্যান্সেস
ইউ লেফ্ট ইন দি নোটস আই লেন্ট ইউ
নট ফর নাথিং ! এট লিস্ট ইউ শুড
এক্সচেঞ্জ এ কিস, ইভন ফ্লাইং উইল ডু ।
একজন তরুণীর, যে কিনা গোঁড়া সামস্ত পরিবারের, বৈভবশালিনী, তার চুমুতে যে মদের গন্ধ থাকতে পারে, তাও হুইস্কি নয়, সম্ভবত কানট্রি লিকার, অনুমান করতে পারেনি রাহুল । চুমুর অভিজ্ঞতার চেয়ে মদের গন্ধ-মাখা ঠোঁটের অভিজ্ঞতা রয়ে গেছে স্মৃতিতে ।
–কানট্রি লিকার ?
–ইউ বুকিশ ফুল; ইট ইজ কলড কনিয়াক ।
–সত্যিই আমি শুনিনি আগে । হুইস্কি, রাম, ব্র্যানডি, ভোদকা, জিন, বিয়ার, এইগুলোই তো খেয়েছি । কানট্রি লিকার আর তাড়ি খেয়েছি ছোটোবেলা থেকে ।
–তাড়ি ? ইউ মিন টডি ? আই উড লাইক টু হ্যাভ ইট । কিন্তু তুমি যে বলেছিলে তুমি ক্যাথলিক কনভেন্টে
প্রাইমারি স্তরে পড়েছিলে ?
তাড়ির সঙ্গে কনভেন্ট স্কুলের বিরোধিতা কেন বুঝতে পারেনি রাহুল । বেথলেহেমে কি হুইস্কি, রাম, জিন, ব্র্যান্ডি, ভোদকা পাওয়া যেত ? কোন মদ খাওয়া হয়েছিল লাস্ট সাপারে ? ওয়াইন ? তখনকার দিনের ওয়াইন, বাড়িতে চোলাই করা । বেথলেহেমে কি আঙুর চাষ হতো ? কোথায় হয়েছিল লাস্ট সাপার ? বোকামি এড়াবার জন্য শিক্ষিত বোকামির আশ্রয় নিয়ে রাহুল বলল, আনব একদিন লুকিয়ে ক্লাসে, ওষুধের বোতলে ভরে, ফারমেন্ট হয়ে আরও কড়া হয়ে যেতে পারে, এলাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিও । কনিয়াকটা কী ?
–তুমি জানো নিশ্চয়ই । তুমি তাকে কগন্যাক বলে জানো, আমার মনে হয় ।
কগন্যাক যে কনিয়াক তা ফাঁস হতে না দিয়ে রাহুল বললে, না, শুনিনি আগে । বন্ধুনিদের যেভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারে, সেভাবে পুরুষ বন্ধুদের পারে না কেন, সমান্তরাল আত্মসমীক্ষায় ভেবে অবাক হল ও ।
–ফ্রান্সে ওই নামের জায়গায় এক বিশেষ ধরণের আঙুর থেকে হয় । তা থেকে তৈরি হয় ব্র্যান্ডি । ওই বিশেষত্বের জন্য সেই ব্র্যান্ডিকে বলা হয় কনিয়াক ।
–আমি খেজুর-রসের তাড়ি আনবো ; তুমি কনিয়াক খাইও ।
–বটলে একটু বেঁচে আছে । কালকে ক্লাসের পর দেবো । তোমার বই নিয়ে বেড়াবার সেই থলেটা এনো ।
বই কিনতে প্রচুর টাকার ব্যাপার । রাহুল সান্মানিক স্নাতক পড়ার সময় থেকেই পোস্টগ্র্যাজুয়েট লাইব্রেরি গিয়ে, বা অন্য সূত্রে বই এনে, পাঠ্য চ্যাপটারগুলো লিখে নিতো, একবার নয়, এক-একটা চ্যাপটার অনেকবার করে লিখে নিতো; তা করতে গিয়ে প্রায় মুখস্হ হয়ে যেত প্রতিটি বিষয় । বই নিয়ে বেড়াবার জন্য একটা পিঠ-ব্যাগ ছিল ওর ।
গঙ্গার পাড়ে রাণোদের গথিক স্হাপত্যের বিশাল হসটেলের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া গঙ্গার সুনসান ঘাটে বসে থাকা যায় বহুক্ষণ, একা, চুপচাপ, জলের দিকে তাকিয়ে, হয়তো বহু দূরে, বিঠুর দুর্গের ধ্বংসাবশেষের কাছে, টিমটিম করে ভেসে চলেছে পালতোলা নৌকো । বিঠুর দুর্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেদের সেনাকে জড়ো করেছিলেন নানা সাহেব,
তাতিয়া তোপে, রানি লক্ষ্মীবাই ; তাই ইংরেজরা কামান দেগে উড়িয়ে দিয়েছিল দুর্গের প্রাসাদ আর বিঠুরের ঘাট ।
একাকীত্বের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবেশ নিজের কল্পনায় আরেকজনকে তুলে আনতে শেখায়, অন্যকে কল্পনা বিলোতে শেখায়, জলের মতন সবাইকে কল্পনায় ডুবিয়ে বা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় সমুদ্রের বিশাল একাকীত্বের দিকে, সুন্দরবনের মোহনায়, সুন্দরী গাছেদের আকাশমুখো শেকড়ের কিনার বরাবর বইতে-বইতে, বাঘেদের সাঁতারের আদর খেয়ে, হরিণ পরিবারের উড়ালের পাশ কাটিয়ে, জেলেদের নৌকোর ঘুম ভাঙিয়ে চলে যায় নিজের মনে ।
রাহুল গিয়েছিল, বাবার কিনে দেয়া সবুজ র্যালে সাইকেল চালিয়ে, মেয়েদের হসটেলে, ইশারামতন, সন্ধ্যায়, নির্দেশানুযায়ী সাইকেল ঘন্টির তিনটে ক্রিং ক্রিং ক্রিং ।
গঙ্গার ঘাটে, ডুবে যাওয়া সূর্যের অন্ধকারে রাণো বলেছিল, গায়ে হাত দেয়া চলবে না, কেবল ঠোঁটে ঠোঁট রেখেই তুলে নেবে ; কিপ অফ ইওর হ্যান্ডস, লিপস ওনলি । রাহুলের হাত দুটো আপনা থেকেই, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গিয়ে, ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছিল । তারপর একটা চড় খেয়েছিল । চড়ের আঘাতের স্মৃতি গালেতে নেই, কেবল ঘটনাটা মনে আছে । চড় খেয়েও হাত সরায়নি । চড় মেরে চড়ের শব্দে ভয় পেয়ে গিয়েছিল রাণো, যদি কেউ শুনে ফ্যালে, জেনে ফ্যালে, তাহলে কেলেঙ্কারি— রা-স-টি-কে-শা-ন আর হি-উ-মি-লি-এ-শা-ন । রাহুলের আলিঙ্গন ওকে ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছিল । ফিসফিস করে বলেছিল ‘ডোন্ট ক্লিং ডোন্ট ক্লিং ইউ ফিশ স্মেলিং ক্লিংগার’ ।
ঠিকই, রাহুল তার পর থেকে কাউকে ক্লিং করে থাকেনি । যারা করেছে তারাই ওকে ক্লিং করেছে । গঙ্গা নদীও আর শহরটাকে ক্লিং করে নেই । শহরের বেড় ভেঙে বেরিয়ে চলে গেছে । চামড়ার কারখানাদের তেলচিটা নোংরায় ডুবে, সমুদ্রে স্নান করতে চলে গেছে গঙ্গা ।
সে-গঙ্গার পাড় আর নেই । বহু দূরে চলে গেছে গঙ্গা, শহরকে ঘেন্না করে, শহর থেকে দূরে । বালির চড়া পড়ে গেছে । পঞ্চাশ বছর পর গিয়েছিল রাহুল, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । নিজের একাকীত্ব হারিয়ে ফেলেছে নদী । চড়ার ওপর প্লাস্টিক ব্যাগ, ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল, বিয়ারের টিন, পুজোর ফুল। জলও অত্যন্ত নোংরা । পা ডুবিয়ে বসার ইচ্ছা হবে না । পায়ের ছোঁয়া বয়ে নিয়ে যাবে না সুন্দরবনের সুন্দরী গাছেদের কাছে ।
শহরের ভেতর দিয়ে নদীটা যায়নি ; শহরই লোভে পড়ে নদীর পাড়ে এসে ঘাটি গেড়েছে, নদীটাকে খেতে আরম্ভ করেছে শহরগুলো, যেভাবে কেঁচোকে মাঝখান থেকে কুরে-কুরে খেয়ে ফ্যালে পিঁপড়েরা । মানুষের আদল নিয়ে লক্ষ লক্ষ
পিঁপড়ের কাতার নোংরা করে চলেছে নদীকে, সে নদীর ঘোলা জল রাণোর প্রতিবিম্বখানা বুড়ি হবারও ঝিলমিল ধরে রাখার চরিত্র পায়নি । সে নদী আর নেই ।
রাণোর সঙ্গে প্রেমে পড়েনি রাহুল, রাণোও ওর সঙ্গে প্রেমে পড়েনি । চকিত-চুমু খাবার ইচ্ছেতে পড়েছিল,দুজনেই ।
–প্রথমবার ?
–না, খেয়েছি আগে । আবার মিথ্যা কথা বলল রাহুল । চেপে গেল অঞ্জলি দাশের বাড়ির ঘটনাগুলো ।
–প্রেমিকা ?
–না, বন্ধুর বোন, মাদুরের বেড়ার আড়ালে ফ্ল্যাশ কিস । তুমি ?
–অনেকবার । আমার ভালো লাগে, এই চুমু খাওয়া । এক ধরণের ক্রেজি তৃপ্তি নিয়ে আসে যা পড়াশুনায় একাগ্র হবার জন্য জরুরি ; ও তুমি বুঝবে না । আমি তোমাদের থেকে আলাদা দেশ, সমাজ, শ্রেণি, পরিবার-পরিবেশের মানুষ।
রাহুলের তো উল্টো, চুমুর ধান্দায় কদিন পড়াশোনায় মন বসেনি । আবার কবে আবার কবে আবার কবে সেই ফ্ল্যাশ কিসের সময় থেকেই ভুগেছে । রাণোর চুমু তাই জরুরি ছিল আগেরটা মুছে ফেলার জন্য । আবার কবে ভাবার দরকার নেই ।
অঞ্জলিকে তবু ঠোঁট থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ।
স্কুলের সহপাঠী মোহন পালের বোনকে চুমু খেয়েছিল রাহুল , ওর বোন ঝুমা রাহুলের গালে একদিন দুপুরে টক করে ঠোঁট ঠেকিয়ে কলোনির বাইরে চলে গিয়েছিল। আচমকা । রাহুলের উচিত ছিল মোহনের বোনকে অনুসরণ করা। বোকা ছিল বলে বুঝতে পারেনি যে ওভাবেও সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতে পারে কেউ । বই পড়ে-পড়ে চুমু বা ঠোঁটের আদরকে প্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার বোকামিতে ভুগত তখন রাহুল । তাই মোহনের বোনকে একা পেয়ে ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল, আর চাউনির রাগি ঝিলিক থেকে টের পেয়েছিল যে কাজটা ঠিক হয়নি ।
মোহনদের থাকার জায়গা ছিল ছোটো-ছোটো মাদুর-খুপরির ঘর । ওরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে এক
কাপড়ে এসেছিল । ওদের মাকে যারা লুঠ করে মুখে কাপড় বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তারা পাকিস্তানি বাঙালি
ছিল, বাংলাদেশি বাঙালি হয়নি । মোহন পালের বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ; আত্মহত্যা করে্ছিলেন । তারপর ওর বোন আত্মহত্যা করল, বাবা মারা যাবার দুঃখে । তারপর মোহন আত্মহত্যা করল, পৃথিবীতে ওর আর কেউ রইল না বলে । ও মরে যেতে রাহুল টের পেয়েছিল যে ও মোহনদের কেউ নয় । ওদের কল্পনাজগতে ওর ঠাঁই হয়নি কখনও । কী করে যে কারোর কল্পনার নিবাসীরূপে গ্রাহ্য হওয়া যায় তা ও আজও জানে না ।
ঝুমার শ্বাসের পান্তাভাতের বেদনাময় গন্ধ রয়ে গেছে স্মৃতিতে । কারোর আত্মহত্যার সংবাদ পড়লে বা শুনলে রাহুলের স্মৃতি পান্তাভাতের ঠাণ্ডা সুবাসে আক্রান্ত হয় । যেচে পাওয়া গোপন ক্ষত নিঃসঙ্গতায় হয়ে ওঠে দগদগে ; চুলে পাক ধরার সাথে-সাথে সেই অসহায়তার বোধ ক্রমশ ছুঁচোলো হয়ে বিঁধতে থাকে আজীবন ।
লিপিংমুহূর্ত শেষ হলে রাণো আচমকা বলে উঠেছিল, আর ইউ ট্রাইং টু বি এনাদার ট্যাগোর ?
–ট্যাগোর ? না তো ; অমন মনে হচ্ছে কেন তোমার ? রাহুল নিজেকে শুনিয়ে নিঃশব্দে বলল, রবীন্দ্রনাথকে ওর কাছে নিয়ে এসেছিলেন সুমিতাদি, সুমিতা চক্রবর্তী । রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ও কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না, ইডিয়টিক মনে হয় । রবীন্দ্রনাথ ওর স্মৃতিতে ব্যক্তিগত অঘটন । সুমিতাদি ব্রাহ্ম ছিলেন বলেই কি রাহুলের কাছে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, কেননা উনি যাঁদের বইপত্র পড়তে উৎসাহ দিতেন, পরে জানতে পেরেছে রাহুল, তাঁরা সকলেই ব্রাহ্ম । ব্রাহ্মদের দরকার ছিল একটি মাত্র ঈশ্বরের, যার দেখা চারটে বেদের কোনোটাতেই পাওয়া যায়নি, তাই যেতে হল উপনিষদে ।
পুজোর সময় কানপুরের কলকাতার দিল্লির জয়পুরের লখনউয়ের মুম্বাইয়ের প্যাণ্ডেলে ঘুরে-ঘুরে রাহুল খুঁজে ফিরেছে সুমিতাদির ঈশ্বরকে, যিনি লোপাট, উপনিষদের প্রভাবের সঙ্গেই লোপাট । তার জায়গায় ফিরে এসেছে বেদ আর পুরাণের নানা আকারের দেবী-দেবতা , যারা বছরের নির্ধারিত দিনে বা রাতে হইচইকারীদের কাঁধে চেপে দেখা দেন, যৎসামান্য অ্যাপিয়ারেন্স ফি নিয়ে । তারপর তাঁরা কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন, আর কেউ আত্মহত্যা করে সেই গাছের তলায় পড়ে থাকেন ।
–ট্যাগোরের কম বয়সে তোমার মতন সরু গোঁফ ছিল ।
–যৌবনে ট্যাগোরের সরু গোঁফ ছিল নাকি ? জানি না তো । আমি তো যতগুলো ফোটো দেখেছি সবকটাই বুড়ো বয়সের । বিষাদে ঝুলে পড়া গোঁফ ।
–ছিল । সরু । তোমার মতনই পাকাতেন । তবে উনি কুস্তি লড়তেন বলে পাকাতেন, কুস্তি লড়ার আগে উরুতে চাপড় মারতেন কুস্তিগিরদের ঢঙে ।
–রবীন্দ্রনাথ গোঁফ পাকাতেন, শুনিনি কখনও, ফোটোও দেখিনি ।
–রবীন্দ্রনাথ গোঁফ পাকাতেন, হয়তো তখন উনি বিশের কোঠায়, তোমার মতন । নাঃ, তুমি তো এখনও টিন এজার, সীমা পেরোওনি । ছাত্রীদের বয়স ছাত্রদের চেয়ে বেশি হয় । বুকে চুল গজিয়েছে ?
–না, গজাবে না হয়তো, বাবার নেই ; আমার বড়জ্যাঠার বড় মেয়ে, মানে, বড়দির অবশ্য পায়ের গোছেও লোম দেখা যায়, বোধহয় দাদুর ছিল ।
–তা না থাক, গোঁফ রেখো, আর পাকিও, বেশ ম্যানলি লাগে, আগেকার হলিউড নায়কদের মতন । যবে থেকে কিসিং সিনের বাড়বাড়ন্ত, তবে থেকে হলিউডের ফিলমে গোঁফ কামিয়ে ফেলছে নায়করা, ম্যানলিনেস দেখাবার জন্য গুলি চালাচ্ছে, ছুরিছোরা চালাচ্ছে, স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্নের ইডিয়সি ।
–সরু গোঁফ, রবীন্দ্রনাথ পাকাচ্ছেন, উরুতে চাপড় মারছেন, ছবিটা তো কল্পনা করাও বেশ আজগুবি । তুমি তো আমার চেয়ে বেশি জানো দেখছি । হলিউড ফিলম তো সপ্তাহে একবার আসে, দেখা হয় না । ওসব কিসিং-টিসিং রেগুলার দেখলে আমার পড়াশুনার বারোটা বেজে যাবে ।
–রবীন্দ্রনাথের ন্যাড়ামাথা ফোটো আছে আমাদের বাড়িতে ।
–রিয়্যালি ? ন্যাড়ামাথা রবীন্দ্রনাথ ? কেমন যেন অ্যাবসার্ড । ইমেজ বিগড়ে যায় । ন্যাড়ামাথা গায়ক দেখিনি যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে ।
–উনি ছিলেন ব্রাহ্ম, কিন্তু ট্যাগোরের বাবা ওনার উপনয়ন করিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণদের মতন । হাউ স্ট্রেঞ্জ । তারপরও ট্যাগোর নিজে ন্যাড়া হয়েছিলেন, ওনার বাবার শ্রাদ্ধের সময়ে, ব্রাহ্মণদের মতন । তখনও বোধহয় চতুর্বেদের আয়ত্বে ছিলেন, উপনিষদের জগতে প্রবেশ করেননি ।
–জানতুম না । তুমি বাড়ি গেলে আমাকে একটা ফোটোর কপি করিয়ে এনে দিও । নন-কনভেনশানাল
রবীন্দ্রনাথকে টাঙিয়ে রাখব পড়ার ঘরে । রাহুল আত্মসংবরণ করল, নয়তো ব্রাহ্ম পরিবারের সুন্দরী সুমিতাদির কথা ফাঁস করে ফেলত ; কে জানে, সুমিতাদির প্রসঙ্গে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে রাণোর । পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য রাণোর নৈতিক সমর্থন জরুরি, মনে জোর পাওয়া যায় ।
–আমাদের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আগে সবাই কলকাতায় পড়তে যেত । কলকাতা থেকে আনা, বিদেশ থেকে
আনা, বইয়ের লাইব্রেরি আছে নেপালের পোখরায় । ওনার মাথায় মেয়েদের মতন চুল আর গোঁফে তা দিচ্ছেন । অন্যটা বাবা মারা যাবার পর ন্যাড়া মাথায় ।
–গোঁফটা তাহলে কামিয়ে ফেলব ।
–এখন কামিও না । তাতে অযথা সময় নষ্ট হবে, প্রতিদিন বা একদিন অন্তর কামাতে হবে, আর তাতে সময় চলে যাবে ; পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার তো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোও উচিত নয় । হংসকুমার যাদব আর শ্যামবিহারি শ্রীবাস্তব, দুজনেই তোমার চেয়ে ভালো ফলাফল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । তাছাড়া ওদের জাতপাতের জোর আছে । তোমার তো কেউই নেই । তুমি তো বা-ঙ-গা-লি-কা-ন-ছা । গডফাদার নেই । আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় হবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে, তখন জাতপাতের খেলা আরও বেড়ে যাবে ।
–তুমি আছ , দি হিমালয়ান গডেস।
–হা হা, গুড জোক । চুমুটা মনে রাখো, আর উঠে পড়ে লাগো । ওরা দিনে বারো থেকে সতেরো ঘন্টা পড়ছে বলে খবর । আমি তো হেসেখেলে বেরিয়েই যাবো , টোটাল নম্বর যতই হোক না কেন, বেরিয়ে গেলেই হল ।
অপেরা-সংলাপের চিরকুট ফেরত দিয়ে রাণো বলেছিল, নো নিড টু রাইট স্ক্রিবলার্স জাস্ট ফর এ কিস ; উই আর নট লাভার্স । রাহুল ভেবেছিল , আবার যদি নোটস চায়, তাহলে আরেকটা অপেরা-সংলাপ লিখবে, ‘লেট মি টাচ ইট’ নামে । তা আর লেখা হয়নি, নোটস চায়নি বলে । কিন্তু ওর উপদেশ কাজে দিয়েছিল । পড়াশুনায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, অতি-একাগ্র । তা সত্ত্বেও প্রথম হতে পারেনি রাহুল ; দ্বিতীয় হয়েছিল । রেজাল্ট বেরোলে রাণো বলেছিল, ‘অ্যাজ ইউজুয়াল, একিলিস শুড নো হি হ্যাজ এ হিইইইল ।’
রাণোকে, সাত-আট বছর বয়সের অভিজ্ঞতার কথা আরেকটু হলেই বলে ফেলেছিল রাহুল ; যে কিশোরী ওর
যৌনতার উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তহমিনা আপা, বা তহমিনা বানুর কথা । তহমিনা আলি শাহ । কখনও ওরা অবধের নবাব বংশের সদস্য ছিল । তবু, তহমিনা আপা বেশ কালো, আর দুই গালে টোল পড়ত, টোলের ভেতরে রোদের, প্রদীপের, লন্ঠনের, চাঁদের আলো ধরে রাখত, ঝিকমিক করত তেল না মেখেও তেল-চুকচুকে গাল ।
তহমিনা আপাদের বাড়িতে ডিম কিনতে পাঠাত মা, হাঁসের ডিম শুধু ওদের পোড়ো বাড়িতেই পাওয়া যেত, বাজারে পাওয়া যেত না । রাহুলদের বাড়িতে তখন মুরগির ডিম আর মুরগির মাংস ঢোকেনি । একদিন দুপুরে যখন আপাদের বাড়িতে কেউ ছিল না, উনি রাহুলের হাত ধরে একটা অন্ধকার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যে ঘরে ওদের হাঁস মুরগি ছাগল থাকত । খালি-গা রাহুলের হাফ প্যান্ট একটানে নামিয়ে দিয়ে নিজের চুড়িদারও নামিয়ে নিয়েছিলেন, আর তারপর জড়িয়ে ধরেছিলেন রাহুলকে । রাহুলের হাত নিয়ে নিজের কুঁচকির মাঝে চেপে ধরে নিজেই তাকে ব্যবহার করছিলেন ; তারপর রাহুলের যৌনাঙ্গ বাঁ হাতে নিয়ে খেলতে-খেলতে নিজের কুঁচকির ভেতরে ঘষা শুরু করেছিলেন । রাহুল জিগ্যেস করেছিল, এরকম করছেন কেন । আপা কোনো উত্তর না দিয়ে ঘামছিলেন, কেঁপে-কেঁপে উঠছিলেন । রাহুলের বেশ ভালো লেগেছিল খেলাটা । ডিম কেনার না থাকলেও, আরও কয়েকবার দুপুরে, যখন আপাদের বাড়ির সবাই কোনো কাজে বাইরে, গিয়েছিল রাহুল।
দ্বিতীয়বার তহমিনা আপা কবজি ধরে জানোয়ার-ঘরের অন্ধকারে রাহুলের হাফপ্যান্ট টেনে নামাতেই রাহুল বলেছিল, আমাকে তাহলে মুরগির ডিম খাওয়াতে হবে, খাইনি কখনও ; স্কুলের বন্ধুরা বলে মুরগির মাংসও ভালো খেতে। তোমাদের রান্নাঘর থেকে মাঝে-মাঝে মাংস রাঁধার কত ভালো গন্ধ বেরোয়, মাংস খাওয়াতে হবে, নইলে আর আসব না।
–তোর বাবা-মা যদি জানতে পারেন যে আমাদের বাড়িতে খেয়েছিস তাহলে তোকে আস্ত রাখবে না । গোবরজলে চান করাবে । ন্যাড়া করে টিকি রাখবে তোর ।
–তুমি আমার প্যান্টুল খুলে নাও জানতে পারলেও পিটুনি খাবো ।
–না না ককখনো বলিসনি কাউকে । আজকেই তোকে মাংস খাওয়াবো, অনেক ঝাল হয় কিন্তু ।
–আগে খাওয়াও ।
–তুই অপেক্ষা কর, এভাবেই দাঁড়িয়ে থাক, আমি এক্ষুনি আনছি ।
ছাগলদের খাবার দেবার সিমেন্টের ছোট্টো চৌবাচ্চার কিনারে বসে মাংস খাবার জন্য উৎসুক হয়ে বসেছিল রাহুল । ছাগলের বাচ্চাগুলো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় জানতে চাইছিল কেন ও ওদেরই মতন পোশাকহীন।
আপা অ্যালুমিনিয়ামের দোমড়ানো বাটি করে মাংস এনে রাহুলকে দিতে, রাহুল হাহ-হুহ করতে করতে খেয়ে নিয়েছিল ঝাল মাংস । আপা নিজের সবুজ চুন্নি দিয়ে পুঁছে দিয়েছিল রাহুলের হাত আর মুখ । বলেছিল, যাবার সময়ে রাস্তার মোড়ের কলে হাত আর মুখ ভালো করে ধুয়ে নিস ; মাংস খাবার গন্ধ মুখ থেকে বেরোলে আমিও বিপদে পড়ব । সেই প্রথম গোরুর মাংস খেয়েছিল রাহুল । আপার জড়িয়ে ধরার কাজ পুরো হয়ে গেলে নিজের জিভ দিয়েও পুঁছে দিয়েছিল রাহুলের ঠোঁট । রাহুল বলেছিল, তোমার গা কী গরম ; তুমি তো কুকুরদের মতন চেটে-চেটে পরিষ্কার করে দিলে । আপা বলেছিল, যখন বড়ো হবি তখন জানতে পারবি মানুষও নিজেদের এভাবেই পরিষ্কার করে ।
–বড়ো হবো না । বড়ো হলে তো তুমি আমার সঙ্গে আর খেলবে না, মাংস খাওয়াবে না ।
–তুই বড়ো হয়ে গেলেও খেলবো ; কিন্তু তুই তো আর খেলতে পারবি না । তোকে তখন আসতে দেবে না, আর আমার তো বিয়ে হয়ে যাবে । তুই হলি আমার নাজুক মজনু । তখন তো আর নাজুক থাকবি না ; নোংরা মরদ হয়ে যাবি, জাহিল হয়ে যাবি, কাফের, কুফ্র, কুফ্র, কুফ্র ।
শেষবার রাহুলের যৌনাঙ্গ নিয়ে আপা এত বেশি নিজেকে চেপে ধরছিলেন, বারবার, যে রাহুলের জ্বালা ধরে গিয়েছিল। ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীকে ছাড়া রাহুল কাউকে কখনও বলেনি জীবনের ওই ঘটনা, লজ্জা করেছে। রাণোকে বললেই বলত, তোমাকে রেপ করেছিল, মলেস্টেশান । বন্ধুদের বললেও নিশ্চয়ই ঠাট্টা করত যে ওকে রেপ করা হয়েছিল, ছি ছি।
কানপুরের বাড়ি থেকে দেশের বাড়ি, শ্যাওড়াফুলিতে, ঠাকুমাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রাহুলকে, ট্রেনে করে হাওড়া। ক্লাস নাইনের গণ্ডি সবে তখন পেরিয়েছে রাহুল । জীবনের ওই ঘটনা জানিয়ে নিজেকে হালকা করার এটাই সুযোগ ভেবে ঠাকুমাকে সব বলে ফেলেছিল । বলেনি ওর যৌনাঙ্গ ছড়ে যাওয়ার কথা, মাংস আর মুরগির ডিম খাওয়ার কথা । ঠাকুমা ট্রেনে বসে কেবল শুনেছিলেন, এমন মুখ করে যেন কিছুই হয়নি।
রাহুলের কানপুর ফিরে যাবার দিন উনি বলেছিলেন, যা করেছিস তা আর কখনও কাউকে বলিসনে, আমাকে বলার বলেছিস ; অমন লুকোনো পিরিতের খেলা তো ব্যাটাছেলেরা করে । এখেনে তুই হয়ে গেলি মেয়ে, আর ছুঁড়িটা হয়ে গেল ছেলে । বুড়ো মিনসেরা আগেকার দিনে কচি মেয়েদের বিয়ে করে বেধবা করে সগগে চলে গেলে সেসব বেধবারা তাদের দেওর, ভাসুরের ছেলে-টেলেদের দিয়ে অমন পিরিতের খেলা খেলত, বুঝলি । কচি খোকাদের সঙ্গে অমন পিরিত করলে তো আর পোয়াতি হবে না, আশও মিটবে । তোকে দিয়ে মোচরমান ছুঁড়িটা আশ মিটিয়ে নিলে । জীবনে ওসব কথা আর মুখে আনবি না । সবাকসুন্দরী দিয়েছিলেন নির্বাক থাকার আদেশ । আজকে, লিখতে বসে, রাহুলের মনে হল, এই চাপটা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলি সবাইকে জানিয়ে দিয়ে ।
মুখে নয়, তহমিনা আপাকে, ঘুমের ভেতরে নিয়ে আসে রাহুল ।
চোখ বুজলে রাহুল তহমিনা আপার ডিমপল অব ভিনাসও স্পষ্ট দেখতে পায় । ডিমপল অব ভিনাস, যা পাছার ওপরের বাঁকে থাকে কারোর কারোর, গ্রিক দেবীর মতন । সে-সময়ে যে খেলা খেলবার মতন শরীর ওর ছিল না বলে খেলতে পারেনি তা যৌবনে কতবার স্বপ্নের ভেতরে খেলেছে রাহুল ।
পঞ্চাশ বছর পর , রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ওই পাড়ায় গিয়ে তহমিনা আপাদের পোড়ো বাড়ির জায়গায় দেখেছিল পাকা বাড়ি উঠেছে । ফ্ল্যাটবাড়ি । কয়েকজন মহিলা বাড়ির ভেতর থেকে বোরখা পরে বেরিয়ে কোথাও গেল । আপার ভাই নাজিমের নাম করে পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জেনেছিল যে ওদের পরিবারের কেউ আর থাকে না শহরে । তহমিনা আপা বিয়ে হয়ে দুবাই চলে গেছে । আপার ভাইও চলে গেছে কোনো আরব দেশে ।
একসময় ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল যাতে আপার সংস্রব থেকে দূরে থাকা যায়, যাতে আর কেটে-ছড়ে না যায় কুঁচকির কাছে । পঞ্চাশ বছর পর আবার কেন দেখার ইচ্ছে হল । বুড়ি আপা প্রৌঢ় রাহুলকে দেখে কী বলতেন ? মনে করতেন কি ওনার সেই ঘেমো উত্তেজিত দুপুরগুলো ? “কাফের কহিঁকা, জাহিল কহিঁকা, বদজাত কহিঁকা, দিখা তেরা
মজনুকা দুম ।”
পাড়ায় এত চেঁচামেচি হতো যা পড়াশুনায় যাতে ব্যাঘাত না হয় তাই পড়ার সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনত রাহুল ; সুমিতাদির দেয়া ছোঁয়াচে রোগ । স্কুলের পর থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত । এমনই বদভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে এই বার্ধক্যে পৌঁছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সংবাদপত্র পড়ার সময়ে কোনো মৃদু সঙ্গীতের অভাব বোধ করত ও, তাই কেবল-টিভির কোনো গানের চ্যানেল বা এফ এম রেডিও চালিয়ে বই-পত্রিকা পড়ে । সংবাদপত্র আর পড়ে না, ভালো লাগে না অন্যের
ক্ষতগুলো নিজের চামড়ায় তুলে এনে ভুগতে । নিজেরই কত গোপন ক্ষত রয়ে গেছে যা কখনও সারবে বলে মনে হয় না।