রামায়ণ : আদিকাণ্ড – শ্রীরামের গঙ্গাস্নান ও গুহকের মুক্তি এবং উভয়ে মিতালি ও ভরদ্বাজ মুনির গৃহে রামের অক্ষয় ধনুর্ব্বাণ প্রাপ্ত হওন
একদিন দশরথ পুণ্য তিথি পেয়ে।
গঙ্গাস্নানে যান রাজা চারি পুত্র লয়ে।।
হইবেক অমাবস্যা তিথিতে গ্রহণ।
রামের কল্যাণে রাজা দিবেন কাঞ্চন।।
তুরঙ্গ মাতঙ্গ চলে সঙ্গে শত শত।
চারি পুত্র সহ রাজা চাপিলেন রথ।।
চলিল কটক সব নাহি দিশপাশ।
কটকের শব্দে পূর্ণ হইল আকাশ।।
চলিছেন দশরথ চড়ি দিব্য রথে।
নারদ মুনির সঙ্গে দেখ হয় পথে।।
মুনি বলে কোথা রাজা করিছ পয়ান।
ভূপতি কহেন গিয়া করি গঙ্গাস্নান।।
মুনি কহে দশরথ তুমি ত অজ্ঞান।
রামমুখ দেখিলে কে করে গঙ্গাস্নান।।
পতিতপাবনী গঙ্গা পৃথিবী মণ্ডলে।
সেই গঙ্গা জন্মিলেন যাঁর পদতলে।।
সেই দান সেই পুণ্য সেই গঙ্গাস্নান।
পুত্রভাবে দেখ তুমি প্রভু ভগবান।।
এত যদি নৃপতিরে কহিলেন মুনি।
রাজা বলে, চল ঘরে রাম রঘুমণি।।
বাপের বচন শুনি বলেন শ্রীরাম।
অনেক পাষণ্ড আছে ধর্ম্মপথে বাম।।
গঙ্গার মহিমা আমি কি বলিতে জানি।
না শুনিও মহারাজ নারদের বাণী।।
এত যদি বলিলেন কৌশল্যা-কুমার।
চলিলেন রাজা দশরথ আরবার।।
চলিছে রাজার সৈন্য আনন্দিত হৈয়া।
গুহক চণ্ডাল আছে পথ আগুলিয়া।।
তিন কোটি চণ্ডালেতে গুহক বেষ্টিত।
হুড়াহুড়ি বাধে দশরথের সহিত।।
গুহক চণ্ডাল বলে শুন দশরথ।
ভাঙ্গিয়া আমার দেশ করিলে কি পথ।।
বারে বারে যাহ তুমি এই পথ দিয়া।
সৈন্যেতে আমার বাজ্য ফেলিল ভাঙ্গিয়া।।
গঙ্গাস্নান করিতে তোমার থাকে মন।
আর পথ দিয়া তুমি করহ গমন।।
যদি ইচ্ছা থাকে হে যাইবা এই পথে।
দেখাও তোমার আগে পুত্র রঘুণাথে।।
রাম রাম বলিয়া যে গুহক ডাকিল।
রথমধ্যে রামেরে ভূপতি লুকাইল।।
নিল দশরথ রাজা ধনুর্ব্বাণ হাতে।
রথের দ্বারেতে রাজা লাগিল ভাবিতে।।
চণ্ডালেরে মারি কিবা হইবেক যশ।
নীচ জনে জিনিলে কি হইবে পৌরুষ।।
যদি পরাজয় হই চণ্ডালের বাণে।
অপযশ ঘুষিবেক এ তিন ভুবনে।।
আমি যদি ছাড়ি নাহি ছাড়িবে চণ্ডাল।
কি করিবি পথে এক বাধিল জঞ্জাল।।
দুই জনে বাণবৃষ্টি করে মহাকোপে।
উভয়ের বাণেতে দোঁহার প্রাণ কাঁপে।।
এইমত বাণবৃষ্টি হইল বিস্তর।
উভয়ের সংগ্রাম হইল বহুতর।।
দশরথ রাজা এড়ে পাশুপত শর।
হাতে গলে গুহকে বান্ধিল নরেশ্বর।।
গুহকে বান্ধিয়া রাজা তুলিলেন রথে।
বন্ধনে পড়িয়া গুহ লাগিল ভাবিতে।।
যাঁহার লাগিয়া আমি আগুলিনু পথ।
দেখিতে না পাইলাম সে রাম কি মত।।
এতেক ভাবিয়া গুহ করে অনুমান।
পায়েতে ধনুক টানে পায়ে এড়ে বাণ।।
ভরত কহিল গিয়া রামের গোচরে।
এমন অপূর্ব্ব শিক্ষা নাহি চরাচরে।।
পায়েতে ধনুক টানে পায়ে এড়ে বাণ।
দেখিতে কৌতুক রাম গেলেন সে স্থান।।
যেইমাত্র গুহক দেখিল রঘুনাথে।
দণ্ডবৎ হইয়া রহিল যোড়হাতে।।
শ্রীরাম বলেন, ধনু টানহ কেমন।
গুহ বলে তোমারে কহিব সে কারণ।।
প্রাক্তন জন্মের কথা শুন নারায়ণ।
যে পাপে হইল মোর চণ্ডাল জনম।।
অপুত্রক ছিলেন যখন দশরথ।
অন্ধক মুনির পুত্র করিলেন হত।।
মুনিহত্যা করিয়া আসিয়া তপোবনে।
লোটাইয়া ধরিলেন আমার চরণে।।
বশিষ্ঠের পুত্র আমি বামদেব নাম।
তিনবার রাজারে বলানু রামনাম।।
শুনিয়া বশিষ্ঠ শাপ দিলেন বিশাল।
যাহ বামদেব পুত্র হওগে চণ্ডাল।।
এক রামনামে কোটি ব্রহ্মহত্যা হরে।
তিনবার রামনাম বলালি রাজারে।।
লোটায়ে ধরিনু আমি পিতার চরণে।
চণ্ডাল হইতে মুক্ত কাহার দর্শনে।।
পিতা বলিলেন যবে শ্রীরাম দর্শন।
তবেত হইবে মুক্ত চণ্ডাল-জনম।।
সেই রাম জন্মিয়াছ দশরথ-ঘরে।
চরণ পরশ দিয়া মুক্ত কর মোরে।।
অনাথের নাথ তুমি ভকতবৎসল।
করুণাসাগর হরি তুমি সে কেবল।।
চণ্ডাল বলিয়া যদি ঘৃণা কর মনে।
পতিতপাবন নাম তবে কি কারণে।।
এতেক বলিয়া গুহ লাগিল কাঁদিতে।
গুহের ক্রন্দনে কান্দেন শ্রীরাম রথে।।
করপুটে দাণ্ডাইয়া পিতার সাক্ষাৎ।
ভিক্ষা দেহ গুহকে বলেন রঘুনাথ।।
রাজা বলে প্রাণ চাহ প্রাণ পারি দিতে।
চণ্ডালে তোমাকে দিব বাধা নাহি ইথে।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা কৌশল্যা-নন্দন।
খসালেন নিজ হস্তে গুহের বন্ধন।।
শ্রীরাম বলেন অগ্নি জ্বালহ লক্ষ্মণ।
গুহকের সহ করি মিত্রতা এখন।।
লক্ষ্মণ জ্বালেন অগ্নি রামের সাক্ষাৎ।
গুহ সহ মিত্রতা করেন রঘুনাথ।।
যেই তুমি সেই আমি বলেন শ্রীরাম।
গুহ বলে ঘুচাইতে নারি নিজ নাম।।
শ্রীরামের জগতে হইল ঠাকুরালি।
প্রথমে করেন রাম চণ্ডালে মিতালি।।
বিদায় করিয়া রামে গুহ গেল ঘরে।
পুত্র লয়ে দশরথ গেল গঙ্গাতীরে।।
অপূর্ব্ব অনন্ত ফল ভাস্কর-গ্রহণ।
স্নান করি রাজা দান করিল কাঞ্চন।।
ধেনু দান শিলা দান কৈল শত শত।
রজত কাঞ্চন তার নাম লব কত।।
দান ধর্ম্ম করিতে হইল বেলা ক্ষয়।
প্রদোষে গেলেন ভরদ্বাজের আলয়।।
বসিয়া আছেন মুনি আপনার ঘরে।
চারিপুত্র সহ রাজা নমস্কার করে।।
যোড়হাতে বলে রাজা মুনির গোচর।
আনিয়াছি চারি পুত্র দেখি মুনিবর।।
আশীর্ব্বাদ কর চারি পুত্রে তপোধন।
বড় ভাগ্যে দেখিলাম তোমার চরণ।।
দেখিয়া রামেরে ভাবে ভরদ্বাজ মুনি।
বৈকুণ্ঠ হইতে বিষ্ণু আইলা আপনি।।
মুনি বলে রাজা তব সফল জীবিতা।
রাম তব পুত্র, কিন্তু জগতের পিতা।।
ভরদ্বাজ এইকাল দেখে চমৎকার।
দূর্ব্বাদল শ্যামতনু পরম আকার।।
ধ্বজ-বজ্র অঙ্কুশে শোভিত পদাম্বুজ।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী চতুর্ভুজ।।
শঙ্কর বিরিঞ্চি আদি যত দেবগণ।
রামের শরীরে আরো দেখেন ভুবন।।
সমুচিত আতিথ্য করেন ভরদ্বাজ।
সুখে রহিলেন সৈন্য সহ মহারাজ।।
রামেরে লইয়া মুনি অন্তঃপুরে গিয়া।
শয়ন করেন দোঁহে একত্র হইয়া।।
যখন হইল রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর।
শিয়রে রাখেন দেবরাজ ধনুঃশর।।
স্বপ্নে উপদেশ এই কহেন মুনিরে।
অক্ষয় ধনুক তূণ দেহ শ্রীরামেরে।।
এত বলি করিলেন বাসব পয়াণ।
প্রাতে রাম শিয়রে দেখেন ধনুর্ব্বাণ।।
কহিলেন শ্রীরামেরে মুনি ভরদ্বাজ।
তোমারে দিলেন ধনুর্ব্বাণ দেবরাজ।।
মুনির চরণে রাম করি প্রণিপাত।
আনিলেন সেই ধনু পিতার সাক্ষাৎ।।
শুনি রাজা দশরথ সানন্দ হইয়া।
আইলেন দেশে চারি কুমার লইয়া।।
কৃত্তিবাস করে আশ, পাই পরিত্রাণ।
আদিকাণ্ড গাইল রামের গঙ্গাস্নান।।