সংগ্রামসিংহ
রানা কুম্ভ অনেক লড়াই করেছিলেন, অনেক দেশও জয় করে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, কিন্তু ঝুনঝুনের লড়াই যেমন, তেমন আর কোনো লড়াই হল না। আর লড়াই ফতে হবার পর নাচ-তামাশা, গান-বাজনা, আতসবাজি, আলো যেমন হতে হয়। একমাস ধরে চিতোর শহর রাতে দিন হয়ে গেল। কিন্তু একটি কাণ্ড ঘটল। লড়াই জিতে আসবার পরদিন থেকে কুম্ভ হাতের তলোয়ার তিনবার মাথার উপর ঘুরিয়ে ফারসি না আরবিতে কী জানি কী সাপের মন্তর না ব্যাঙের মন্তর আউড়ে তবে নিজের সিংহাসনে বসতে লাগলেন। শুধু এক আধ দিন নয়, এই কাণ্ড বরাবর চলল। রানা বুড়িয়ে গেলেন তবু তলোয়ার ঘোরানো আর মন্তর পড়া একটি দিন কামাই গেল না। রানার কাণ্ড দেখে সভাসুদ্ধ অবাক হয়ে যেত, কিন্তু কেন যে রানা এমন করেন সে কথা জানতে কেউ চেষ্টাও করত না। একবার রানার বড়ো ছেলে সভার মাঝে রানাকে শুধিয়েছিলেন— মাথার উপরে তিনবার তলোয়ারখানা ঘোরাবার কারণটা কী? আর ওই সাপের মন্তরগুলোরই বা মানে কী? সেইদিন রানা কুম্ভ জবাব দিলেন, ‘বারো ঘণ্টার মধ্যে চিতোর ছেড়ে চলে যাও, বাপ কী করেন, সে খোঁজ ছেলের রাখবার কিংবা জানবার দরকার নেই।’ তারপর তিনবার করে ঠিক নিয়মিত রানার তলোয়ার মাথার উপরে ফিরতে লাগল কিন্তু হুকুম আর ফিরল না। রানার বড়ো ছেলে রায়মল নির্বাসনে গেলেন, রইলেন কেবল ছোটো ছেলে সুরজমল আর মেজ ছেলে— তার নাম রাজস্থানে কেউ এখনো করে না— ‘ঘাতীরাও’ হাতিয়ারো’ এমনি নানা নামে সে লোকটাকে ডাকে। এই ‘ঘাতীরাও’ বিষ খাইয়ে বুড়ো রানা কুম্ভকে মেরে চিতোরের সিংহাসনে বসল। রাজপুত প্রজারা এই বিষম ঘটনায় একেবারে খাপ্পা হয়ে খুনের শোধ খুনই ঠিক বলে স্থির করে রায়মলকে আবার সিংহাসনে দেবার ফন্দি করলে। দিল্লীতে তখন প্রথম পাঠান সুলতান বহলোল লোদী। তার সঙ্গে ‘ঘাতীরাও’ কুটুম্বিতা করে, নিজের মেয়ের সঙ্গে সুলতানের বিয়ে দেবার ফন্দি করে, খুব শক্ত হয়ে চিতোরের সিংহাসনে বসে থাকার মতলব করছে, এমন সময় ইদর রাজ্য থেকে রায়মলকে রাজপুত সর্দারেরা খুঁজে বার করলেন। ‘ঘাতীরাও’ বড়ো-বড়ো সর্দারদের বড়ো-বড়ো জমিদারির লোভ দিয়েও নিজের দলে টানতে পারলে না! যে নিজের বাপকে খুন করতে পারে, রাজপুতের মেয়েকে পাঠানের বেগম করে দিতে চায়, তার দলে কোন রাজপুত থাকতে পারে? ‘ঘাতীরাও’ কাজেই গতিক খারাপ দেখে একদিন রাতারাতি সুলতানের দরবারে গিয়ে মেয়ের বিয়ের সব পাকা করে চুপি-চুপি আবার চিতোরে এসে বসবার মতলবে ঘোড়া ছুটিয়ে একা আসছে, এমন সময় পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে তার মৃত্যু হল।
এই অবসরে রায়মল চিতোর দখল করে বসলেন।
সুলতান বহলোক চিতোরের রাজকুমারীকে বিয়ে করতে এসে দেখলেন বাহান্ন হাজার সওয়ার আগে, এগারো হাজার পাইক সঙ্গে, রায়-বাঘের মতো রায়মল তাঁকে ধরবার জন্যে পাহাড়ের উপর বসে আছেন। পাঠান সুলতান বিয়ে করতে এসেছিলেন বর সেজে, কিংখাবের লুঙ্গি কোমরে জড়িয়ে, জরির লপেটা ফেলে চম্পট দিলেন যেখান থেকে এসেছিলেন সেই দিল্লীতে!
রায়মল, তাঁর তিন ছেলে সঙ্গ, পৃথ্বিীরাজ, জয়মল আর একটি মাত্র ছোটো ভাই সুরজমল এই চারজনকে নিয়ে চিতোরে বসে রাজত্ব করতে থাকেন, সেই সময়ে একদিন তখন রানা হয়েছেন বুড়ো, ছেলেরা হয়েছে বড়ো, দেশে রয়েছে শান্তি, আর সুখে রয়েছে রাজাপ্রজা সবাই— তখন প্রচণ্ড গরমকালে দুপুরবেলায় বাইরে আগুন হাওয়া, বুড়ো রানাজী ভীম তালাওয়ের মাঝখানে জলের উপরে শ্বেতপাথরের তাওখানায় আরাম করছেন। রাজকুমার তিনজন ছোটো-খুড়ো সুরজমলের বাগান-বাড়িতে আড্ডা করছেন আর তাশ, দাবা, গোলাপজলে ভিজানো খসখসের পাখা এমনি সব নানা কুড়েমি ও আয়েসির সাজ-সরঞ্জামের মাঝে বসে এ-গল্প সে-গল্প চলছে, কিন্তু বাইরে বইছে গরম বাতাস এমন গরম যে পাহাড়গুলো পর্যন্ত ফেটে তো গেছেই, ঘরের মধ্যেকার দেওয়ালগুলো থেকেও তাপ উঠছে। কাজেই ঘরের মধ্যে রাজকুমারেরা ঠাণ্ডা হতে চাইলেও বেশিক্ষণ ঠাণ্ডা রইলেন না।
এ-কথায় সে-কথায় কজনের মধ্যে কে কেমন বীর, কোন লড়াই কে ফতে করে কোন-কোন পরগণা দখল করেছেন, প্রজারা কার নামে কী বলে, এমনি নানা খুটিনাটি খিটিমিটি থেকে রাজসিংহাসন উচিত মতো কে পেলে প্রজারাও সুখী হয়, দেশেরও ভালো হয়— এই তর্ক উঠল। রানার মেজছেলে পৃথ্বীরাজ যেমন সুপুরুষ তেমনি সাহসী; বড়োছেলে সঙ্গ দেখতে মোটেই রাজপুত্রের মতো নন— শাদাসিদে ছোটোখাটো মানুষটি ধীর-গম্ভীর বড়ো-বড়ো টানা চোখ; ছোটোছেলে জয়মল কাটখোট্টা, মোটা-সোটা যেন চোয়াড় গোছের, আর রানার ভাই সুরজমল খুব সুপুরুষ নন খুব কদাকারও নন— অনেকটা বুড়ো রানারই মতো নাক চোখ! তিন ভায়ে বিষম তর্ক বাধল সিংহাসন নিয়ে।
পৃথ্বীরাজ বললেন, ‘প্রজাদের হাতে যদি রাজা বেছে নেবার ভার পড়ে তো দেখে নিও আমাকেই রাজপুতেরা রাজা করবে!’ জয়মল বলে উঠলেন, ‘ওসব বুঝিনে। দেখছ এই হাতখানা। জোর যার মুলুক তার!’ সঙ্গ, তিনি সবার বড়ো একটুখানি হেসে বললেন, ‘ভবানীমাতা যাকে সিংহাসন দেবার দিয়ে বসে আছেন, বিশ্বাস না হয়, চল চারণীদেবীর মন্দিরে গুনিয়ে দেখি কার অদৃষ্টে সিংহাসন লেখা রয়েছে।’ সুরজমল তিনজনকে ধমকে বললেন, ‘আঃ, এ সব কী কথা হচ্ছে? দাদা শুনলে রক্ষে থাকবে না। হয়তো তোমাদের সঙ্গে আমাকেও দেশছাড়া করবেন। সিংহাসন নিয়ে নাড়াচাড়া কেন বাপু। একি সতরঞ্চ না দাবা খেলা পেলে, যে এখনি রাজা উজির মারছ? নাও, একটু গোলাপ-জল মাথায় দাও, ঠাণ্ডা হও; থাক ওসব কথা।’ কিন্তু বাইরের গরম তখন রাজকুমারদের মগজে চড়েছে, ঠাণ্ডা হবে কে? সবাই উঠে বললেন, ‘চলো খুড়ো, থাক এখন ঠাণ্ডা হওয়া; চারণীর কাছে গুনিয়ে আজ ঠিক করব সিংহাসনটি কার পাওনা।’ বুদ্ধিমান সুরজমল দেখেন বিপদ— গেলে রাগেন দাদা, না গেলে রাগেন দাদার তিন পুত্তুর, তার মধ্যে একজন গুণ্ডা আর একজন বেজায় সাহসী; কাজেই সুরজমল চললেন বলতে-বলতে, ‘শেষে দেখছি রাজত্বটা আমারই হবে, তোমরা তিন ভাই হয় দেশছাড়া হবে কালই দাদার হুকুমে, নয়তো দুদিন পরে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি করে মরবে; বাকি থাকব আমি রাজ্যের ভোগ ভুগতে।’
পৃথ্বীরাজ বলে উঠলেন, ‘সেই জন্যে তোমাকেও সঙ্গে নিচ্ছি; তোমারও কপালে কী আছে দেখা চাই তো?’
সুরজমল নিজের আর তিন ভায়ের কপালে এক-একবার টোকা মেরে বললেন, ‘গুনে দেখার প্রয়োজন নেই, আওয়াজেই বুঝছি সব ফোঁপরা।’
উদয়পুর থেকে পাঁচ ক্রোশ হবে নাহরামুংরা। সেইখানে এক পাহাড় তাকে বলে ব্যাঘ্রমেরু; তারই উপরে থাকেন চারণীমন্দিরের সিদ্ধিকরী যোগিনী। পাহাড়ের অন্ধকার গুহার মধ্যে দেবীর দেউল। রাজপুত্রেরা দুরন্ত গরমে ঘোড়া ছুটিয়ে যখন মন্দিরে উপস্থিত হলেন তখন সন্ধ্যাপূজার যোগাড় করতে সিদ্ধিকরী বাইরে গেছেন; মন্দির খালি; তারই মধ্যে অন্ধকারে কালো পাথরের চারণীদেবীর ফটিকের তিনটে চোখ মাত্র দেখা যাচ্ছে, আর সামনে মস্ত একটা পাথরের চাতালে সন্ধ্যাবেলার আলো পড়েছে— রক্ত যেন ঢেলে দিয়েছে। সিদ্ধিকরীকে মন্দিরে না দেখে সুরজমল বলে উঠলেন, ‘কেমন, বলেছিলাম তো কপাল ফোঁপরা। মন্দির খালি, এখন দেবীকে একটি করে প্রণাম দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে চলো।’ পৃথ্বীরাজ ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘তা হবে না, এইখানে বসতে হবে, আরতির পর হাত গুনিয়ে তবে ছুটি!’ একদিকে একটা বাঘের ছাল পাতা ছিল আর একদিকে সিদ্ধি করার খাটিয়া, তার উপরে ছেঁড়া কাঁথা পৃথ্বীরাজ তাড়াতাড়ি গিয়ে খাটিয়াতে বসলেন, দেখাদেখি জয়মলও উঁচুতে খাটিয়ায় বসল। বাঁশের খাটিয়া একবার মচাৎ করে শব্দ করেই চুপ করল। সঙ্গে গিয়ে বসলেন বাঘছালের উপর মাটিতে, আর সুরজমল বসলেন একটা হাঁটু বাঘছালে রেখে একেবারে আগুনের মতো তপ্ত পাথরের মেঝেয়।
ভর সন্ধ্যায় গুহার মধ্যে অন্ধকার বেশ একটু ঘনিয়ে এসেছে, সেই সময় প্রদীপ হাতে সিদ্ধিকরী গুহাতে ঢুকেই দেখেন চার মূর্তি। সঙ্গ উঠে, সিদ্ধিকরীকে নমস্কার করে বসলেন। সুরজমলকে আর উঠতে হল না— তিনি যে মাটিতে বসেছিলেন সেই মাটিতেই সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করলেন। পৃথ্বীরাজ খাটিয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘাড়টা নোয়ালেন, হাত দুটো কপালের দিকে উঠেই আবার নেমে গেল; আর জয়জমলটা উঠলও না, নমস্কারও দিলে না, বসে-বসেই বললে, ‘মাতাজী গণনা করে বলুন তো আমাদের মধ্যে কার কপালে চিতোরের সিংহাসনটা রয়েছে’ সিদ্ধিকরী কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল নিজের কপালে হাত বোলাতে লাগলেন আর গেরুয়াকাপড়ের খুঁটে মুখ মুছতে থাকলেন দেখে পৃথ্বীরাজ বলে উঠলেন— ‘ভাবেন কী? বড়ো জরুরি কথা। বেশ করে ভেবে-চিন্তে গণনা করে উত্তর দেবেন।’ সঙ্গ বললেন, আগে চারণীর পুজোটা ওঁকে সেরে নিতে দাও, পরে ওসব কয়ো।’
‘সেই ভালো।’ বলে সিদ্ধিকরী পুজোয় বসলেন।
তারপর চারণীর সামনে একবার পিদিম নেড়ে ঘণ্টাটা বাজিয়ে গোটাকতক প্রসাদী গাঁদাফুল চারপুত্রের পাগড়িতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘রাজকুমারেরা, একটা ইতিহাস বলি শোনো— পূর্বকালে উজ্জয়িনীনগরে একদিন মহারাজা বিক্রমাদিত্য রাজসভা ছেড়ে অন্দরে গিয়ে জলযোগ করতে বসবেন এমন সময় লক্ষ্মী সরস্বতী বিবাদ করতে করতে সেখানে উপস্থিত। মহারাজা তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠে বললেন, ‘দেবী আপনাদের কী প্রয়োজনে আগমন, দাসকে বলুন!’ দুজনেই রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বৎস বিক্রমাদিত্য, তুমি তো রাজা, বিচার করো দেখি আমাদের দুইজনের মধ্যে কে বড়ো!’ বীণা হস্তে সরস্বতী ঝংকার দিয়ে বললেন, ‘এই আমি, না ওই ওটা, কে বড়ো?’ রাজা দেখেন বড়ো গোলযোগ— ‘এঁকে বড়ো করলে উনি চটেন, ওঁকে খাটো করলে তিনি চটেন। রাজা দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছেন দেখে বিক্রমাদিত্যের ছোটো রানী বলে উঠলেন— ‘ঠাকুরুনরা রাজাকে কিছু খেয়ে নিতে দিন, সারাদিন বিচার করে ওঁর এখন মাথার ঠিক নেই, সুবিচার করেন কেমন করে? আজকের রাতটা ওঁকে ভেবে ঠিক করতে দিন, কাল রাজসভায় ঠিক বিচার হয়ে যাবে দেখবেন।’ রাজা বললেন, ‘এ পরামর্শ মন্দ নয়, কঠিন সমস্যা, একটু সময় পেলে ভালো হয়।’ দেবীরা ‘তথাস্তু’ বলে বিদায় হলেন। রাজা জলযোগে বসে ছোটোরানীকে বললেন, ‘দেবীদের আজকের মতো তো বিদায় করলে কিন্তু কালকের বিচারটা কী হবে কিছু ঠাউরেছ কি?’ রানী ভিরকুটি করে বললেন, ‘বিচারের আমি কী জানি! তোমার সভায় নবরত্নের মধ্যে কেউ পণ্ডিত, কেউ কবি, কেউ মন্ত্রী; তাঁদের শুধোও না।’ রাজা মাথা চুলকে সভায় প্রস্থান করলেন। সভার মধ্যে নবরত্ন হাজির— ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, কালিদাস, বরাহমিহির, বররুচি। রাজার প্রশ্ন শুনে ন’জনেই মাতা চুলকোতে আরম্ভ করলেন; রাত্রি দুই প্রহর বাজল কিছুই মীমাংসা হলো না, দুই দেবীর বিচার কী হিসাবে করা যায়? সরস্বতীকে বড়ো বললে চটের লক্ষ্মী, রাজ্যপাট সব যায়, নবরত্নের মাসহারাও বন্ধ হয়। আবার যদি বলা যায় সরস্বতী ছোটো, লক্ষ্মীই বড়ো, তবে বিদ্যে পালায়, বুদ্ধি পালায়, কালিদাসের কবিতা লেখা বন্ধ, ধন্বন্তরির চরকসংহিতা, বরাহমিহিরের পাঁজি পুঁথি খনার বচন সবই মাটি। রাজাই বা কী বুদ্ধি নিয়ে রাজ্য চালান, হিসেব দেখেন, বিচার করেন? বিক্রমাদিত্য বিষম ভাবিত হয়ে অন্দরে এসে বিছানা নিলেন। রানী দেখেন রাজার নিদ্রা নেই, কেবল এপাশ-ওপাশ করছেন; যেন শয্যাকণ্টকী হয়েছে।
তারপর— ’
এমন সময় পৃথ্বীরাজ বলে উঠলেন— ‘ও-গল্প তো আমরা জানি। দুই দেবীর একজন এসে বসেছিলেন স্বর্ণ-সিংহাসনে, অন্যে বসেছিলেন রুপোর খাটে; ছোটো-বড়ো বিচার আপনি হয়েছিল। গল্প থাক, এখন দেখুন দেখি বিচার করে আমাদের মধ্যে রাজ হবে কে?’
সিদ্ধিকরী একবার চারজনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘রাজকুমার, তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিচার শেষ করে বসে আছ! সঙ্গ— যিনি বসে আছেন বাঘছালে বীরাসনে, উনি ঠিক রাজার উপযুক্ত জায়গায় রয়েছেন— রাজ্যেশ্বর! সুরজচমল রয়েছেন মাটিতে— সঙ্গের কাছেই মাটিতে, কাজেই দেখা যাচ্ছে জমিতে ওঁর দখল, সিংহাসনের কাছাকাছি উনি থাকবেন— হয় মন্ত্রী, নয় সর্দার, নয় জমিদার। আর পৃথ্বীরাজ, জয়মল, তোমরা বসেছ সন্ন্যাসিনী যে আমি, আমার আসনে ছেঁড়া কাঁথায়, কাজেই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজ্যের স্বপ্ন দেখা ছাড়া তোমাদের অদৃষ্টে আর কিছুই নেই!’ এই কথা বলেই সিদ্ধিকরী গুহার অন্ধকারের মধ্যে চলে গেলেন; চার রাজকুমারের চোখ বাঘের মতো কটমট করে এর ওর দিকে চাইতে থাকল।
সর্ব-প্রথম সুরজমল কথা বললেন, ‘তাহলে?’
‘তাহলে সিংহাসন কার এখানেই স্থির হয়ে থাক আজই!’ বলেই পৃথ্বীরাজ তলোয়ার খুলে সঙ্গকে আক্রমণ করলেন। সঙ্গ ছুটে গুহার বাইরে যাবেন, তলোয়ারের চোট পড়ল তাঁর একটি চোখের উপরে। চারণীদেবীর সামনে ভায়ের হাতে ভায়ের রক্তপাত ঘটল। সঙ্গ প্রাণভয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একদিকে গেলেন সুরজমল; পৃথ্বীরাজ, জয়মল গেলেন আর একদিকে— এঁর পেছনে উনি তাঁর পিছনে তিনি; অন্ধকার ঢেকে নিলে চারজনকেই।
চারণীমন্দির থেকে প্রায় এক রাতের পথ রাঠোরসর্দার ‘বিদা’র কেল্লার বুরুজের ধরনের কাঁচামাটির দেওয়ালঘেরা খামার বাড়ি। ভোর হয়ে আসছে কিন্তু মেঘে-ঢাকা আকাশে তখনো আলোর টান একটিও পড়েনি। উঠোনের মাঝে মস্ত তেঁতুল গাছটার আগায় পোসা ময়ূরটা ডানায় মুখ গুঁজে চুপ করে আছে। গাছের তলায় হালের গরু দুটো মাটিতে পড়ে আরামে ঝিমচ্ছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই; কেবল সর্দারের ঘোড়া নিয়ে দরজার কাছে একটা ছোকরা-রাজপুত দাঁড়িয়ে আছে; সেই ঘোড়া এক-একবার ঘাড় নাড়ছে আর তারই মুখের লাগামে পরানো লোহার আংটা আর কড়াগুলো এক-একবার আওয়াজ দিচ্ছে— টিংটিং ঝিনঝিন। বিদা দূরগ্রামে পুজো দিতে যাবেন, তাই ভোর না হতেই প্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বার হবেন, এমন সময় দূরে অন্ধকারের মধ্যে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল— কে যেন তেজে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। দেখতে-দেখতে রক্তমাখা রাজকুমার সঙ্গ ‘রক্ষা করো’ বলে বিদার দরজায় এসে ধাক্কা দিলেন। তাঁর একটা চোখের উপরে তলোয়ারের চোট পড়েছে, শরীরও অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত। বিদা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে রাজপুত্রকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘একি! এমন দশা আপনার কে করলে?’ সঙ্গ দুকথায় তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন প্রাণ সংশয়, পৃথ্বীরাজ আর সুরজমল দুজনেই অজ্ঞান হয়ে রাস্তার মাঝে পড়েছেন কিন্তু জয়মল এখনো পিছনে তাড়া করে আসছেন তাঁকে মারতে। বিদা সঙ্গকে তাঁর নিজের ঘোড়া দিয়ে বললেন, ‘রাজকুমার, ভিতরে গিয়ে বিশ্রাম করুন, পরে নতুন ঘোড়ায় অন্য গ্রামে রওনা হবেন।’ ওদিকে জয়মল আসছেন, একটা ঝড়ের মতো— মাঠের উপর দিয়ে। সঙ্গের ইচ্ছা তখনই তিনি পলায়ন করেন, কিন্তু রাজভক্ত বিদা কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে চায় না কিছু না খাইয়ে-দাইয়ে। ওদিকে বিপদ ক্রমে এগিয়ে আসছে। সঙ্গ ইতস্তত করছেন দেখে বিদা বললেন, ‘কোনো ভয় নেই, আপনি ভিতরে যান। নিশ্চিন্ত হয়ে একটু বিশ্রাম করে যতক্ষণ না আপনি খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ততক্ষণ জয়মলকে এই দরজার চৌকাঠ পার হতে হবে না, আমি তাকে ঠেকিয়ে রাখব।’ তাই হলো। সঙ্গের নতুন ঘোড়া সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে পুবমুখে অনেক দূরে ছোটো একটা কালো ফোঁটার মতো আস্তে-আস্তে দূর মাঠের একেবারে শেষে বনের আড়ালে মিলিয়ে গেছে, সেই সময় তিনঘণ্টা ধস্তাধস্তির পর বিদাকে মেরে তবে জয়মল বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেখলেন সঙ্গ চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর অকর্মণ্য ক্ষতবিক্ষত ঘোড়াটা উঠোনের মাঝে তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে খানিক শুকনো ঘাস চিবুচ্ছে আরামে। জয়মল রাজভক্ত রাজপুত বীরের রক্তে রাঙা হাতখানি দিয়ে নিজের কপাল চাপড়ে হতাশ মনে প্রাণশূন্য বিদার দিকে খানিক চেয়ে রইলেন— তারপর ঘাড় নিচু করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে সকাল হয়ে গেল, কোন অজানা গাঁয়ের কিষানরা সকালে খেতে যেতে-যেতে পথের ধারে দেখলে রক্তমাখা দুই রাজকুমার সুরজমল আর পৃথ্বীরাজ। সবাই মিলে ধরাধরি করে রাজপুত্রদের ডুলিতে তুলে গাঁয়ে নিয়ে রাখলে। এদিকে মহারানারও লোকজন— তারাও বেরিয়েছে সন্ধানে ঘোড়া পাল্কি সব নিয়ে, রাজকুমারদের ফেরাতে, কিন্তু কেবল পৃথ্বীরাজ সুরজমল দুজনকে তারা সন্ধান করে ফিরে পেলে, আর দুজন যে কোথায় তার খবরই হল না।
পৃথ্বীরাজ রানীদের যত্নে আস্তে-আস্তে সেরে উঠলেন, সুরজমলের চোট বেশি, অনেক তদ্বিরে তিনি সুস্থ হলেন।
মহারানা চার কুমারের ব্যাপার শুনে একদিন পৃথ্বীরাজকে ডেকে বললেন, ‘এই যে ঘটনা ঘটেছে, এর জন্যে তুমিই দায়ী। সঙ্গ একেবারে নির্দোষ। সে কোথায় আছে, কি নেই, কিছুই জানা যাচ্ছে না; বেঁচে থাকে তো তোমারই ভয়ে সে কোথায় লুকিয়ে আছে। মনে কোরো না তোমাকে আমি চিতোরে বেশ আরামে বসিয়ে রাখব, আর আমি চোখ বুজলেই আস্তে-আস্তে সিংহাসনে তুমি উঠে বসবে। আজই তুমি ঘোড়া অস্ত্র যা তোমার ইচ্ছে হয় নিয়ে বিদায় হও! লড়তেই চাও তো বড়ো-ভায়ের সঙ্গে না লড়ে পারো তো রাজ্যের শত্রুদের জব্দ করোগে, তবে বুঝব তুমি বীর— যাও!’
ছেলের উপর এই হুকুম দিয়ে সুরজমলকে রানা ডেকে বললেন, ‘তুমি সঙ্গকে বাঁচাতে চেয়েছিলে সেই জন্যে তোমাকে শাস্তি দেব না, আজ থেকে তুমি আমার আত্মীয় সারংদেবের ওখানে গিয়ে থাকো, চিতোরমুখো হয়ো না।’
সুরজমল তো নির্বাসনে যান।
এখন পৃথ্বীরাজ বার হলেন চিতোর ছেড়ে দিক্বিজয়ে। তিনি জানতেন মহারানার কাছে যদি কখনো ক্ষমা পান তো সে বীরত্ব দেখিয়ে, মেবারের শত্রুদের শাসন করে তবে। রানা রাগলেও, প্রজারা পৃথ্বীরাজকে সত্যিই ভালোবাসত, কাজেই তাঁকে একেবারে একলা পড়তে হল না। দু-একজন করে ক্রমে একটি ছোটোখাটো দল তার সঙ্গে জুটল, যাদের কাজই হল এখানে-ওখানে লড়াই করে বেড়ানো। এমনি এদেশে সেদেশে দল নিয়ে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে পৃথ্বীরাজের যা-কিছু টাকাকড়ি সম্বল ছিল গেল ফুলিয়ে। শেষে এমন দিন এল যে দিনের খোরাক, তাও জোটানো ভার!
এখন একটা ছোটো-খাটো রাজ্য জয় করে না বসতে পারলে আর উপায় নেই। এই অবস্থায় পৃথ্বীরাজ একদিন নিজের হাতের একটা মানিকের আংটি গদাওয়ারের উঝা নামে এক জহুরীর কাছে বাঁধা দিয়ে কিছু টাকা আনতে পাঠালেন। এই উঝাই একদিন ঐ আংটিটা পৃথ্বীরাজকে অনেক টাকায় বেচেছিল; আংটি দেখেই জহুরী তাড়াতাড়ি টাকাকড়ি নিয়ে যেখানে পৃথ্বীরাজ ছদ্মবেশে সামান্য লোকের মতো একটা সরাইখানায় দিন কাটাচ্ছিলেন সেখানে উপস্থিত হয়ে বললে, ‘এ কী দেখছি রাজকুমার! টাকার দরকার ছিল তা একটু লিখে পাঠালে হত, আংটিটা বাঁধা দিয়ে বাজারে কেন বদনাম কিনছেন?’ পৃথ্বীরাজ উঝাকে চুপিচুপি বুঝিয়ে বললেন, ‘ওই আংটি ছাড়া আমার এমন কোনো সম্বল নেই যে তোমার টাকা দেব, তাছাড়া আংটি তো একদিন না একদিন পেটের দায়ে বেচতেই হবে। আমার কতগুলি সঙ্গী দেখছ তো! এদের শুকনো মুখে আধপেটা তো রাখতে পারিনে!’ পৃথ্বীরাজের দুঃখের কাহিনী শুনে উঝার চোখে জল এল। সে দুই হাত জোড়া করে বললে, ‘কুমার, এই নিন টাকা! আমি আংটি চাইনে! আমি আপনার প্রজা, মহারানার নুন চিরকাল খাচ্ছি।’ পৃথ্বীরাজ উঝাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘ভাই, আজ যেন তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে, কিন্তু এরপরে কী হবে?’ উঝা পৃথ্বীরাজকে চুপিচুপি বললে, ‘দেখুন মীনা-সর্দারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এই দেশটা আপনি দখল করে বসুন। রাজ্যের একটা শত্রুও নাশ হবে, আপনারও মান বাড়বে।’
পৃথ্বীরাজ ছদ্মবেশে সেই দিনই গিয়ে মীনা-সর্দারের কাজে দলবল নিয়ে ভর্তি হলেন। রাজস্থানের মীনারা জংলী, দুর্দান্ত জাত; লুটপাট করাই তাদের কাজ। এদেরই রাজা মীনারায় নাম নিয়ে সমস্ত গদাওয়ার শাসন করছে। মহারানাকেও সে তুচ্ছ করে; নদালা বলে একটা গ্রামে তার আড্ডা। পৃথ্বীরাজ তাঁর পাঁচটি সঙ্গী— যশ, সিন্ধিয়া, সঙ্গমদৈবী, অভয় আর জহ্নুকে নিয়ে এই দুর্দান্ত মীনাকে জব্দ করার মতলব করলেন। আহেরিয়া রাজস্থানের একটা মস্ত আনন্দের দিন। সেইদিন চাকর-মনিব সব এক হয়ে শিকার, বনভোজন— এমনি নানা আমোদে দিনরাত মত্ত থাকে। সেই আনন্দের দিনে মীনারায় বড়ো-বড়ো মীনাকে নিয়ে বনের মধ্যে যখন তাড়ি খেয়ে আনন্দ করছে, সেই সময় নিজের দলবলসমেত পৃথ্বীরাজ তাকে আক্রমণ করে তাদের ঘর দুয়ার জ্বালিয়ে ছারখার করে দিলেন। রাজা কাটা পড়ল। মীনারা যারা বাকি রইল, বন-জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করলে। উঝাকে পৃথ্বীরাজ গদাওয়ারের শাসনকর্তা করে নিজের ধার শুধে আবার দিক্বিজয়ে বার হলেন— রীতিমতো ফৌজ আর রসদ সঙ্গে।
এদিকে জয়মল, তিনি ঘুরতে-ঘুরতে, বেদনোরে গিয়ে হাজির। সে সময় বেদনোরে টোডার রাজা রায় শূরতান সিং পাঠানদের উৎপাতে রাজ্য-সম্পদ সব হারিয়ে নিজের একমাত্র কন্যা পরমা সুন্দরী তারাবাইকে নিয়ে মহারানার আশ্রয়ে বাস করছিলেন। তারাবাই যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী, গুণবতী, তেজস্বিনী! কত রাজপুত্র তাঁকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু তাঁর প্রতিজ্ঞা পাঠানদের হাত থেকে যে বাপের সিংহাসন উদ্ধার করবে, তাকেই বিয়ে করবেন। জয়মল বেদনোরে এসে এই খবর শুনলেন; একদিন তারাবাইকেও দেখলেন— ঘোড়ায় চড়ে ধনুর্বান হাতে শিকারে চলেছেন— যেন দেবী দুর্গা! জয়মল টোডা রাজ্য উদ্ধার করে দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা-পত্র লিখে শূরতানের কাছে ঘটক পাঠালেন! শূরতান সিং জয়মলকে খুব খাতির করে নিজের বাড়িতে স্থান দিলেন। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, মাসের পর মাস, জয়মল পাঠানদের সঙ্গে লড়তে যাবার নামও করেন না; উল্টে বরং হঠাৎ রাতারাতি শূরতানকে মেরে তারাবাইকে বন্দী করে নিয়ে পালাবার মতলবে রইলেন। শেষে অন্ধকার রাতে একদিন জয়মল হাতিয়ার হাতে চুপিচুপি শূরতানের অন্দর-মহলের দিকে অগ্রসর হলেন— ভূতের মতো মুখে কালিঝুলি মেখে। বেশিদূর যেতে হল না, অন্দরের দরজাতেই ধরা পড়ে গেলেন। কিন্তু জয়মল দুর্দান্ত গুণ্ডা; তাঁকে ধরে রাখা প্রহরীদের সাধ্য হলো না। তিনি তলোয়ার খুলে তারাবাইকে তাঁর শয়ন-ঘর থেকে একেবারে হাতে ধরে টেনে বাইরে আনার চেষ্টা করলেন। তারাবাই সামান্য মেয়ে তো ছিলেন না! এক ঝাপটায় জয়মলকে দশহাত দূরে ফেলে দিয়ে একেবারে বাঘিনীর মতো তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটি ছুরির ঘায়ে, তার সব আস্পর্ধা শেষ করে দিলেন। শূরতান সিংহ ছুটে এসে জয়মলের মাথাটা সঙ্গে-সঙ্গে কাঁধ থেকে ভূঁয়ে নামিয়ে মিথ্যাবাদীর শাস্তি দিলেন রীতিমতো। জয়মল মহারাজার ছেলে; আর শূরতান রাজা হলেও এখন মহারানার আশ্রিত; কাজেই চিতোরে যখন এই খবর পৌঁছল, তখন সবাই ভাবলে এইবার শূরতান গেলেন! কিন্তু মহারানা সমস্ত ব্যাপার শুনে দূতদের বললেন, ‘জয়মল শুধু যে আশ্রিত রাজার অপমান করেছে তা নয়, সে মিথ্যাবাদী, চোর, নির্বোধ, গোঁয়ার। কোন বাপ তার নিজের কন্যার অপমান সইতে পারে? শূরতান তার উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছেন। এমন অপদার্থ ছেলে গেছে, ভালোই হয়েছে। আমার কোনো আক্ষেপ নেই। যাও শূরতানকে বলো গিয়ে আজ থেকে বেদনোর রাজ্য তাঁকে দিলেম।’
পৃথ্বীরাজ যখন শুনলেন ছোটোভায়ের কাণ্ড, তখন রাগে লজ্জায় তাঁর মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। তিনি সেইদিনই বেদনোরের দিকে রওনা হলেন। রাজপুত্র পৃথ্বীরাজ, রাজকুমারী তারাবাই— দুজনেই সমান সুন্দর। সমানে-সমানে মিলল! ইনি দেখলেন ওঁকে, উনি দেখলেন এঁকে। ভালোবাসলেন দুজনেই দুজনকে; কিন্তু প্রতিজ্ঞা রয়েছে, সেটা না পূর্ণ করতে পারলে বিয়ে হবার উপায় নেই! পৃথ্বীরাজ নিজের তলোয়ার ছুঁয়ে শপথ করলেন টোডারাজ্য তিনি উদ্ধার করবেনই; আর সেইদিন তারাবাইকে সঙ্গে নিয়ে আজমীরের দিকে ছদ্মবেশে রওনা হলেন। সঙ্গে গেল পৃথ্বীরাজের সেই পাঁচ সঙ্গী আর অনেক পিছনে চললেন শূরতান অসংখ্য রাজপুত সেপাই নিয়ে। তখন আশ্বিন মাস, মহরমের দিন! টোডাশহরের মোগল-বাজারের প্রকাণ্ড চক— নিশান আর ঘোড়া আর নানাবর্ণের কাগজের তাজিয়া, দুলদুল, পাঞ্জা, লাঠি-সড়কি, ঢাল-তলোয়ার আর লোকে-লোকে গিসগিস করছে। স্বয়ং সুলতান জুম্মা মসজিদের ছাদে উঠে তামাশা দেখছেন, এমন সময় মস্ত একটা তাজিয়ার সঙ্গে হাসান-হোসেন করতে-করতে একদল লোক ঠিক সুলতান যেখানে রয়েছেন সেখানে গিয়ে থামল। সুলতান ঝরকা থেকে মুখ ঝুকিয়ে দেখলেন দুজন ফকির সেই তাজিয়ার সঙ্গে! আর বেশি কিছু সুলতানকে দেখতে হল না; ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা তীর এসে সুলতানের বুকের মাঝ থেকে প্রাণটি শুষে নিয়ে সোঁ করে বেরিয়ে গেল— আকাশের দিকে! টোডার সুলতান উল্টে পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত ফৌজ এসে শহরে হানা দিলে। রাজপুত যারা, তারা গিয়ে পৃথ্বীরাজ আর তারাবাইকে ঘিরে লড়তে লাগল— মুসলমানদের সঙ্গে। সেই অবসরে সুলতানের যত আমীর-ওমরা লুঙি ছেড়ে, দাড়ি ফেলে, বিবি আর মুরগির খাঁচা লুকিয়ে নিয়ে, রাতারাতি শহর ছেড়ে আজমীরের দিকে চম্পট দিল। সকালবেলা পৃথ্বীরাজ টোডা দখল করে নিলেন।
পৃথ্বীরাজ আর তারাবাইয়ের বীরত্বের কথা মহারানার কাছে পৌঁছল। এইবার বাপের প্রাণ গলল। জয়মল নেই, সঙ্গ কোথায় তা কেউ জানে না, একমাত্র রয়েছেন পৃথ্বীরাজ— ছেলের মতো ছেলে, মহারানা পৃথ্বীরাজের সঙ্গে তারাবাইয়ের বিয়ে দিয়ে কমলমীর কেল্লায় দুজনকে থাকবার হুকুম দিলেন। মেবারের একেবারে শেষ সীমায় কমলমীর। এ সেই কেল্লা যেখানে লছমীরানী এতটুকু হাম্বিরকে নিয়ে বাস করতেন। কতদিন কেটে গেছে, কেল্লা শূন্য পড়েছিল; আর আজ আবার কত পুরুষ পরে পৃথ্বীরাজ-তারাবাই— বর আর বৌ— হাসি বাঁশি গান দিয়ে সেই পুরোনো কেল্লার শূন্য ঘরগুলি পূর্ণ করে দেখা দিলেন। এই বাপেতে-ছেলেতে বরেতে বধূতে মিলন আর আনন্দের দিনে একসময় চিতোরে পৃথ্বীরাজ মহারানার সভায় বসে আছেন, সভা প্রায় ভঙ্গ হয়, মহারানা উঠি উঠি করছেন— এমন সময় মালোয়া থেকে দূত এসে খবর পাঠালে, এখনি মহারানার সঙ্গে দেখা করতে চাই! একসময় ছিল, যখন চিতোরের মহারানার সঙ্গে দেখা করতে হলে দিল্লীর বাদশার দূতকেও অন্তত পনেরো দিন মহারানার সুবিধার জন্য অপেক্ষা করতে হত, কিন্তু আজ মালোয়ার দূত এসেই বুক-ফুলিয়ে, কোনো হুকুমের অপেক্ষা না রেখে মহারানার দরবারে ঢুকল। শুধু তাই নয়, লোকটা একেবারে মহারানার গা-ঘেঁষে বসে যেন সমানে-সমানে কথাবার্তা শুরু করে দিলে। দূতের এই আস্পর্ধা দেখে পৃথ্বীরাজ একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। খুব খানিক বাজে বকে দূত বিদায় হবার পর পৃথ্বীরাজ ঐ মালোয়ার দূতকে এত ভয় আর খাতির করবার কারণটা মহারানাকে শুধোলেন। বুড়ো রানা পৃথ্বীরাজের পিঠে হাত বুলিয়ে জবাব দিলেন, বুঝলে না, আমি বুড়ো হয়েছি, তাই দন্তহীন সিংহের মতো গাদাও আমাকে লাথি মারতে চাচ্ছে। তোমরা নিজেদের মধ্যেই ভায়ে-ভায়ে লড়তে ব্যস্ত রয়েছ, তাই আমাকে সবদিক ঠাণ্ডা রেখে খুশি রেখে কোনো রকমে শান্তিতে নিজের আর প্রজাদের জমিজমা জরু-গরু সামলে চলতে হচ্ছে— আজ ক’বছর ধরে।’ পৃথ্বীরাজ বাপের কথার কোনো জবাব দিলেন না কিন্তু বাপের কত যে দুঃখ, তা বুঝতে আজ তাঁর দেরি হল না। তিনি লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে সভা থেকে বেরিয়ে একেবারে নিজের দলবল নিয়ে সোজা মালোয়া রাজার রাজ্যে গিয়ে হাঁক দিলেন ‘যুদ্ধং দেহি!’
দুই দলে লড়াই বাধল। মাঠের মাঝে দুই দলের তাঁবু পড়েছে। যুদ্ধের আগের রাতে মালোয়ারাজ নিজের শিবিরে মখমলের গদিতে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে মহা ধুমধামে নাচ দেখছেন, এমন সময় ঝড়ের মতো পৃথ্বীরাজ এসে রাজাকে একেবারে ধরাধরি করে তুলে নিলে নিজের কোটে এনে বন্ধ করলেন। মজলিস ভেঙ্গে গেল— ঝাড়লণ্ঠনগুলোর সঙ্গে চুরমার হয়ে! নাচনী, গাইয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল— পৃথ্বীরাজের অদ্ভুত সাহস দেখে।
রাজার সেনাপতি তাড়াতাড়ি সৈন্য সাজাচ্ছেন এমন সময় পৃথ্বীরাজ মালোয়ারাজেরই লিখন সেনাপতির কাছে গিয়ে পাঠালেন, ‘আমি চিতোর চললেম বন্দী হয়ে। কিন্তু খবরদার আমাকে ছাড়বার চেষ্টাও কোনো না। তাহলেই আমার প্রাণ যাবে, এখনি এসে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো, যুদ্ধ বন্ধ করে দাও।’
রাজা-রাজড়ার কথা— সেনাপতি সমস্ত সৈন্য ফিরিয়ে শুকনো-মুখে একা পৃথ্বীরাজের শিবিরে হাজির হলেন। পৃথ্বীরাজ তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘রাজার প্রাণের জন্যে কোনো ভয় নেই; আমি ওঁকে চিতোরে নিয়ে যাচ্ছি, খুব যত্নেই রাখব আর সুস্থ শরীরেই ফিরিয়ে দেব; তোমাদের রাজার সেই হামবড়া দূতটাকেও ফিরে পাবে। মহারানা দূতকেও চান না, বন্দীকেও নয়, কেবল মালোয়ার কাছ থেকে যে নমস্কারটা তাঁর প্রাপ্য তাই তিনি আমাকে আনতে হুকুম দিয়েছেন। তাই তোমাদের রাজার একবার সশরীরে চিতোর যাওয়া দরকার। কিন্তু এখান থেকে কিংবা পথের থেকে যদি রাজাকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করো, তবে ওঁর ধড়টিই শুধু ফিরে পাবে, মাথাটি গিয়ে পড়ে থাকবে চিতোরের মহারানার সিংহাসনের নিচেই— পা রাখবার পিঁড়িখানির ঠিক সামনেই!’
মহারানা সভায় বসে আছেন, পৃথ্বীরাজ মালোয়াকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে উপস্থিত। সবাই দেখে অবাক হয়ে গেল! সেই সময় একজন পৃথ্বীরাজের চর দূতের ঘাড় ধরে এনে বললে, ‘শিখে নাও মহারানার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয়— তোমার নিজের দেশের রাজার কাছে।’ দূত থরহরি কাঁপতে লাগল; তার কপাল বেয়ে কালঘাম ছুটল। মহারানা ব্যাপার বুঝে খুব খাতির করে মালোয়াকে নিজের কাছে বসালেন, তারপর কিছুদিন চিতোরে আরামে থাকার পর মালোয়ার রাজা আর রাজদূত দুজনেই ছুটি পেয়ে দেশে গেলেন।
এই ঘটনার কিছুদিন পর রানার আত্মীয় সারংদেব আর সুরজমল দুজনে মিলে হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। পৃথ্বীরাজ তখন অনেক দূরে— কমলমীরে, সওয়ার খবর নিয়ে সেদিকে ছুটল— মহারানা দলবল নিয়ে চটপট লড়াইয়ে বেরিয়ে গেলেন। সদ্রী, বাটেরা, নায়ি আর নিমচ; এর মধ্যে যত পরগণা সমস্ত দখল করে চিতোরের খুব কাছে গাভিরী-নদীর ওপারে সুরজমল এসে দেখা দিলেন প্রকাণ্ড ফৌজ নিয়ে। সেইখানে ভীষণ যুদ্ধ বাধল। রানার ফৌজ ক্রমেই হঠতে লাগল। সন্ধ্যা প্রায় হয়, বাইশটা অস্তরের ঘা খেয়ে মহারানা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, সুরজমলের সৈন্যরা নদীর এপারটাও দখল করেছে, বিদ্রোহীদের আর ঠেকিয়ে রাখা চলে না, এমন সময় এক হাজার রাজপুত নিয়ে পৃথ্বীরাজ এসে পড়লেন; যুদ্ধ সেইদিনের মতো স্থগিত রইল। দুই দলের লড়াই বন্ধ রেখে যে যার তাঁবুতে বিশ্রাম করছে, মাঠের দিকে-দিকে মশাল আর ধুনি জ্বলছে, সারাদিনের পর সুরজমল অনেকগুলো অস্ত্রের চোট খেয়ে নাপিত ডেকে কাটা ঘাগুলো ধুয়ে-পুঁছে পার্টি-বেঁধে একটু বিশ্রামের চেষ্টায় আছেন, এমন সময় হঠাৎ সামনে পৃথ্বীরাজকে দেখে সুরজমল খাটিয়া ছেড়ে এমন বেগে দাঁড়িয়ে উঠলেন যে, তাঁর বুকে বাঁধা কাপড়ের পার্টিটা ছিঁড়ে ঘা দিয়ে রক্ত ছুটল। পৃথ্বীরাজ তাড়াতাড়ি খুড়োকে ধরে খাটিয়াতে শুইয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই, কেমন আছ তাই জানতে এলেম।’ সুরজমল একটু হেসে বললেন, ‘হঠাৎ তুমি এসে পড়ায় একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম! যা হোক অনেকদিন পরে তোমাকে দেখে খুশি হলেম। মহারানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করোনি?’ পৃথ্বীরাজও হেসে বললেন, ‘কমলমীরে তোমার খবর পেয়েই ছুটে এসেছি, বাবার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি।’ এই সময় এক দাসী সোনার থালায় খাবার নিয়ে হাজির হল। সুরজমল বললেন, আরে দেখচিসনে কে এসেছে। যা দৌড়ে আর এক থালা নিয়ে আয়।’ দাসী একদিক-ওদিক চাইতে দেখে সুরজমল বললেন, ‘বুঝেছি সারংদেব এই একথালা বই আর কিছু পাঠায়নি; খুড়োভাইপোতে আজ এক থালেই খাব।’ শুনেই পৃথ্বীরাজ একটা মিষ্টি তুলে মুখে দিলেন। দিনের বেলার শত্রুতা গল্প-হাসি খাওয়া-দাওয়ার চোটে কোথায় পালিয়ে গেল! বিদায়ের সময় পৃথ্বীরাজ খুড়োকে বললেন, ‘আমাদের পুরোনো ঝগড়াটা তাহলে আজ তোলা থাক, কাল সকালেই শেষ করা যাবে, কী বলো?’ সুরজমল হেসে বললেন, ‘বেশ, আজকের মতো একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক্! কিন্তু কাল খুব সকালেই আমি তৈরি থাকব জেনো।’
তার পরদিনের লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের পৃথ্বীরাজ হারিয়ে দিলেন। সুরজমল সারংদেবকে নিয়ে পালিয়ে চললেন। পৃথ্বীরাজও তাঁদের পিছনে তাড়িয়ে চললেন— একটার পরে একটা পরগণা বিদ্রোহীদের হাত থেকে আবার জয় করতে-করতে। শেষে সুরজমলের একটু দাঁড়াবারও স্থান রইল না। সারংদেবের রাজ্যটা পর্যন্ত পৃথ্বীরাজ দখল করে নিলেন! দুই বিদ্রোহী তখন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে নিমচের জঙ্গলে বড়ো-বড়ো গাছের গুঁড়ি আর ডালপালা দিয়ে খুব মজবুত-রকম বরোজ বানিয়ে মধ্যে লুকিয়ে রইলেন। একদিন সুরজমল নিশ্চিন্ত মনে বসে গল্পগুজব করছেন— দুপুরবেলা বাইরে বনের মধ্যেটা শন্শান, কোনখানে ঘনপাতার আড়ালে বসে দুটো নীল পায়রা কেবলি বকম-বকম করছে— এমন সময় বাঘ যেমন চুপিসাড়ে এসে হঠাৎ শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি পৃথ্বীরাজ ঘরের বেড়া ডিঙিয়ে একেবারে সুরজমলকে চেপে ধরলেন। দুজনে ধস্তাধস্তি চলল। পৃথ্বীরাজ খুড়োকে কাবু করেছেন, এমন সময় সারংদেব দুজনের মাঝে পড়ে পৃথ্বীরাজকে ঠাণ্ডা করে বললেন, ‘কারো কী! দেখছ না তোমার খুড়োর অবস্থা? কী রকম কাহিল, এক চড়ে উল্টে পড়েন! দাও, ছেড়ে দাও বেচারাকে!’ সারংদেবের মোড়লি সুরজমলের মোটেই ভালো লাগল না, তিনি বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘দেখো সারংদেব, যে চাপড়টার কথা বললেন সে চাপড়টা এখন আমার এই ভাইপোর হাত থেকে এলে আমি কাবু হব বটে কিন্তু তোমাদের কারু হাত থেকে এলে এই কাহিল শরীরও শক্ত হয়ে দাঁড়াবে, আর এক চাপড়ের বদলে তোমার নাকে দশটা ঘুঁসি বসিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। সরে দাঁড়াও, লড়তে হয় আমরা খুড়ো-ভাইপোতে লড়ব; মিটমাট করতে হয় তো আমরাই করব— বুঝেচ?’ সুরজমলের তেজ দেখে পৃথ্বীরাজ অবাক হলেন, সারংদেব রেগে কটমট করে চাইতে-চাইতে বেরিয়ে গেলেন; ঝনাৎ করে সুরজমল নিজের তলোয়ার খাপে বন্ধ করে বললেন, ‘দেখো পৃথ্বীরাজ, তোমাতে আমাতে লড়াই— এতে আমি যদি মরি তোমার হাতে, তাতে কোনো দুঃখও নেই, ক্ষতিও নেই— ছেলে দুটো আমার উপযুক্ত হয়েছে, কিছু না জোটে তো মহারানার ফৌজে গিয়ে ভর্তি হবে, তবু তোমাদের বিরুদ্ধে আমার মতো তারা অস্ত্র ধরবে না। কিন্তু তুমি যদি আমার হাতে মরো তবে শুধু যে আমার লজ্জার উপর লজ্জা, দুঃখের উপর দুঃখ পেতে হবে, তা নয়; দাদার পরে তুমি না থাকলে চিতোরের দশাটা কী হবে ভেবেছ কি? আমি লড়ব না। ইচ্ছা হয় তুমি আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু বন্দী করে যে আমায় নিয়ে যাবে তা হবে না।’ সুরজমল যে চিতোরের সঙ্গে প্রাণে-প্রাণে এক, তা বুঝতে পৃথ্বীরাজের দেরি হল না। তলোয়ার বন্ধ করে তিনি খুড়োকে প্রণাম করলেন। সুরজমল ভাইপোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এতদিনে আমার অদৃষ্টের লিখন একটু ফলল— তোমার হৃদয়সিংহাসনের খুব কাছে আমি এলেম; এখন বাকি শুধু যে মাটিতে জন্মেছি সেই মাটির এক টুকরোতে মাথা রেখে মরার ব্যবস্থা করে নেয়া।’ পৃথ্বীরাজ খুড়োর পাশে বসে সেই আগেকার মতো আবার হাসিমুখে শুধোলেন, ‘আমি আসবার আগে তুমি কী করছিলে খুড়ো?’ ‘ছেলেদের রাজস্থানের ইতিহাস আর গল্প শুনিয়ে খানিক বাজে সময় কাটাচ্ছিলেম’— বলে খুড়ো হাসলেন।
পৃথ্বীরাজ অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি তাড়া করে আসতে পারি জেনেও সেজন্য সতর্ক না থেকে বেশ আরামে শুয়ে গল্প করছিলে?’
সুরজমল হেসে বললেন, ‘লড়াই করা কি পালানো— এ দুটোই করবার পথ তুমি বন্ধ করেছ, কাজেই ছেলেদের নিয়ে খোশগল্প করে সময় কাটানো ছাড়া করবার আর কী আছে বলো?
পৃথ্বীরাজ শুনে বললেন, ‘কেন, আমার সঙ্গে বাবার কাছে গিয়ে মাথা গোঁজবার জায়গাটা করে নেবার চেষ্টা করো না কেন!’
সুরজমল খানিক গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আগে হলে যেতেন কিন্তু এই বিদ্রোহের পরে মাথা-গোঁজবার জায়গা চিতোরের বাইরে করে নেওয়াই ঠিক; আর তা হলেই ধড় এবং মাথা— দুটো নিয়ে কিছুদিন আরাম করা যেতে পারবে।’ পৃথ্বীরাজ খানিক ভেবে বললেন, ‘তা যেন হল, কিন্তু মহারানাকে একটা মাথা না হাজির করে দিতে পারলে আমার যে মাথা হেঁট হবে, কাটাও যাবে— তার কী বল!’
সুরজমল পৃথ্বীরাজের কানে-কানে বললেন, ‘সারংদেবের মাথাটা যদি কাজে লাগে তো নিয়ে যাও; ওর মাথার সঙ্গে ওর রাজ্যটাও হাতে আসবে, আমার মাথার সঙ্গে এই ছেঁড়া পাগড়িটা ছাড়া আর তো কিছুই পাচ্ছ না! বেশি সুখ্যাতি পাবে ওই মাথাটা নিলে।’
পৃথ্বীরাজ প্রস্তুত হয়ে উঠলেন, কিন্তু বরোজের মধ্যে সারংদেবকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি চোখ-রাঙিয়ে খুড়োকে বললেন, ‘আমাকে ফাঁকি দিতে চাচ্ছ?’
সুরজমল খানিক ভেবে বললেন, ‘এস আমার সঙ্গে বাইরে, বড়ো মাথা না পাও, ছোটো মাথাই নিও।’ বনের মধ্যে খানিক এগিয়ে গিয়ে সুরজমল একটা ভাঙা মন্দির দেখিয়ে বললে, ‘দেখেছ মন্দিরটা, এখানে এক সময় নরবলি হত! বহুদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে; দেবীও মানুষের কাঁচা মাথা অনেককাল পুজো পাননি, ওইখানে সারংদেব আমাকে পুজো করতে যেতে আজ ডেকে গেছে, কিন্তু আমার হয়ে ওখানে যেতে তোমার সাহস হবে কি?’
‘খুব হবে!’— বলেই পৃথ্বীরাজ সুরজমলকে নিজের পাগড়ি দিয়ে কষে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে মন্দিরে ঢুকলেন। বেশি দেরি হল না, সারংদেবের কাঁচা মাথাটা কেটে নিয়ে খুড়োর বাঁধন খুলে দিয়ে পৃথ্বীরাজ যুদ্ধ বন্ধ করে চিতোরে চলে গেলেন। যে-সব পরগণা জয় করতে-করতে সুরজমল ফৌজের পায়ের তলায় প্রজার সুখ শান্তি চূর্ণ করে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন সেই নায়ি, বাটেরা, নিমচের রাস্তা ধরেই হেরে ফিরতে হল— তাঁকে ঘাড় হেঁট করে। তিনটে বড়ো-বড়ো রাজত্ব তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল, রইল কেবল একটুখানি সদ্রিপরগণা! কিন্তু সেটুকুও বেশিদিন থাকবে কি না সুরজমল ভাবছেন— এমন সময়ে একদিন দেখলেন গাঁয়ের ধারে মন্দিরের সামনে একটি ডালকুত্তো ছোটো একটি ছাগলছানা শিকার করবার চেষ্টা করতেই একটা রামছাগল তাকে ঢুঁ মেরে তাড়িয়ে ছানাটাসুদ্ধ মন্দিরে গিয়ে সেঁধাল। কুকুরটা মন্দিরের সামনে ঘেউঘেউ করে চেঁচাতে লাগল— কিন্তু ভিতরে ঢোকবার সাহস করলে না।
সুরজমল ঠিক করলেন, এইখানেই নিরাপদে থাকা যাবে— এই মন্দির হবে আমার ঘর, কেল্লা, সমস্তই। সেইদিন সুরজমল সদ্রি থেকে কারিগর ডাকিয়ে সেই মন্দির ঘিরে ছোটো এক কেল্লা তুললেন, তারা চারিদিকে বাজার হাট বসালেন; সব শেষ ‘দেওলা’ গ্রাম মায় সমস্ত সদ্রিপরগণা আর কন্থল পাহাড়ের উপর তাঁর কেল্লাটি পর্যন্ত দেবতার নামে উৎসর্গ করে সমস্তটার নাম রাখলেন দেউলগড়। দেবতার কেল্লা তার উপর চড়াও হতে রানারও সাধ্য নেই, ষাট হাজার বছর নরকের ভয় আছে! সব রাজার রাজ্যের সীমানার বাইরে এই দেউলগড়ে, সুরজমল নির্ভয়ে রইলেন, নিশ্চন্ত হয়ে মরবার সময় পেলেন; তাঁর কপালের লিখন এমনি করে ফলল।
জয়মল, সুরজমল, দুইজনেই চিতোরের সিংহাসন আর পৃথ্বীরাজের মাঝ থেকে সরে পড়লেন; রইলেন কেবল সঙ্গ। একদিন কমলমীরে পৃথ্বীরাজের চর এসে খবর দিলে— সঙ্গ বেঁচে আছেন; শ্রীনগরের রাজার মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ের উদ্যোগ হচ্ছে। পৃথ্বীরাজ তখনি নিজের দলবল নিয়ে সঙ্গকে জালে বাঁধার পরামর্শ করতে বসলেন; কিন্তু পৃথ্বীরাজের অদৃষ্টও বসে ছিল না, সে দিনে-রাতে আলোতে-অন্ধকারে সুখে-দুঃখে মিলিয়ে যে বেড়াজাল পৃথ্বীরাজকে ধরবার জন্য বুনে চলেছিল, এতদিনে সেটা শেষ হল। সকালে পৃথ্বীরাজ সেজেগুজে সঙ্গকে ধরবার জন্যে বার হবেন, এমন সময় শিরোহী থেকে পৃথ্বীরাজের ছোটোবোন এক পত্র পাঠালেন। সে অনেক দুঃখের কাহিনী। বিয়ে হয়ে অবধি তাঁর স্বামী তাঁকে অপমান করছে, লাথি মারছে, ঘরের বার করে দিতে চাইছে। সে নেশাখোর, দুষ্ট এবং একেবারে নির্দয়। বাবা বুড়ো হয়েছেন, এখন দাদা এসে এই অপমানের প্রতিশোধ না দিলে তাঁর ছোটোবোন মারা যাবে। ছোটোবোনের কান্না ভরা সেই চিঠি পড়ে, পৃথ্বীরাজ চলেছিলেন শ্রীনগরে, বাইরের দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে— কিন্তু যাওয়া হলো না, পৃথ্বীরাজের ঘোড়া ফিরল শিরোহীর মুখে— বোনকে রক্ষা করতে। অদৃষ্ট টেনে নিয়ে চলল পৃথ্বীরাজকে সঙ্গের দিকে থেকে ঠিক উল্টো মুখে— অনেক দূরে!
রাতের অন্ধকারে শয়নঘরের মেঝেয় পড়ে রানার মেয়ে কেবলই চোখের জল ফেলছেন, রানার দেওয়া সোনার খাটে শিরোহীর রাজা ভরপুর নেশায় নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, হঠাৎ সেই সময় পৃথ্বীরাজ ঘরে ঢুকে এক লাথিতে শিরোহীর রাজাটাকে ভূঁয়ে ফেলে দাড়ি চেপে ধরলেন। রানার মেয়ে পৃথ্বীরাজের তলোয়ার চেপে ধরলেন, ‘দাদা থামো, প্রাণে মেরো না।’
পৃথ্বীরাজ রেগে বললেন, ‘এত বড়ো ওর সাহস, তোর গায়ে হাত তোলে। জানে না তুই মহারানার মেয়ে। ওকে কুকুরের মতো চাবুক মেরে সিধে করতে হয়।’
শিরোহীর তখন নেশা ছুটে গেছে, সে পৃথ্বীরাজের পা জড়িয়ে বললে, ‘এমন কাজ আর হবে না, ক্ষমা করো।’
পৃথ্বীরাজ তার ঘাড় দরে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘নে, আমার বোনের জুতোজোড়া মাথায় করে ওর কাছে ক্ষমা চা— তবে রক্ষে পাবি।’
‘একথা আগে বললেই হত’, বলে তাড়াতাড়ি জুতোজোড়া তুলে নেয় রেখে রানী বললেন, ‘থাক এবার এই পর্যন্ত। যাও এখন দাদাকে জলটল খাইয়ে ঠাণ্ডা করোগে, আমায় একটু ঘুমুতে দাও।’
রানার জামাই খুব খাতির করে পৃথ্বীরাজকে বাইরে নিয়ে বসিয়ে সোনার রেকাবিতে শিরোহীর খাসা নাড়ু– গুটিকতক জল খেতে দিলেন। শিরোহীর খাসা-নাড়ু— অমন নাড়ু কোথাও হয় না, পৃথ্বীরাজ তাই গোটা চার-পাঁচ মুখে ফেলে এক ঘটি জল খেয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে কমলমীরে আপনার দলবলের সঙ্গে মিলতে চললেন। কমলমীরে আর তাঁর পৌঁছতে হল না; শিরোহীর মতিচুর সেঁকোবিষ আর হীরেচুয়ে মেখে তাঁর ভগ্নিপতি খেতে দিয়েছিল— জুতো-তোলার শোধ নিতে!
তখন রাত কেটে সবে সকাল হচ্ছে, দূর থেকে কমলমীর অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেই সময় পৃথ্বীরাজ ঘোড়া থেকে ঘুরে পড়লেন— রাস্তার ধুলোয়। কমলমীর— যেখানে তাঁর তারারানী একা রয়েছেন, সেইদিকে চেয়ে তাঁর প্রাণ হঠাৎ বেরিয়ে গেল— দূরে— দূরে— কতদূরে সকালের আগুনবরণ আলোর মাঝে নীল আকাশের শুকতারার অস্তপথ ধরে। আর ঠিক সেই সময় সঙ্গের অদৃষ্ট শ্রীনগরের নহবৎ-খানায় বসে আশা-রাগিণীর সুর বাজিয়ে দিলে— ‘ভোর ভয়ি, ভোর ভয়ি।’