Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নবদ্বীপে

নবদ্বীপে কামিনী বেশ জাঁকিয়া বসিল। স্বামীর আমল হইতে গোপন সঞ্চয় ছিল, তাহা হইতেই সে বাড়িঘর কিনিয়া আখড়া বাঁধিয়া বসিল। আখড়ার জাঁকজমকেরও অভাব ছিল না। বৈষ্ণব মহান্তদের নিমন্ত্রণ হয়, পরম যত্নে সাধু-সেবা হয়; সকাল-সন্ধ্যায় আখড়ায় নাম-গানের আসর। জমিয়া ওঠে।

বলাইদাস, সুবলচাঁদ ইহারা বয়সে তরুণ। সুবল তাহার উপর সুপুরুষ। সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া একটি পরম কমনীয় শ্ৰীতে শান্ত কোমল, মানায় বড় চমৎকার। কথাগুলিও স্নেহশান্ত, নাম। রসিকদাসের তাহাকে দেখিয়া আশ মেটে না। বাউল বৈরাগী তাহার সহিত সম্পর্কও পাতাইয়া বসিয়াছে। সুবল তাহার সখা—সুবল—সখা বলিয়া ডাকে।

কমলি সেই তেমনই আছে। সেই যেদিন তাহারা গ্রাম ছাড়িয়া নবদ্বীপে আসে, সেদিন হঠাৎ সে যতটুকু বড় হইয়া গিয়াছিল, ততটুকু বাড়িয়াই সে আর বাড়ে নাই।

অবসর সময়ে রসিকদাস কমলকে বলে, এ যে চাঁদের হাট বসিয়ে দিলে গো রাইকমল! আহা-হা-কী সুন্দর রূপ গো! গোরাচাঁদের দেশের রূপই আলাদা।

কমলিনী বলিল, তা হলে গঙ্গাতীরের রূপে তুমি মজেছ বল। এইবার ভাল দেখে একটি বোষ্ট্রমী করে ফেল বগ-বাবাজী।

বলিয়াই সে মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। কমলের পরিহাসে রস-পাগল রসিকের একটু লজ্জা হইল। সে সলজ্জভাবে হাসিয়া বলিল, রাধে রাধে! রাধারানীর জাত-কৃষ্ণ-পূজার ফুল-কী যে বল তুমি রাইকমল!

হাসিতে হাসিতে উচ্ছলভাবে কমলিনী বলিল, প্রসাদী মালা গলায় পরা চলে গো। পায়ে না। মাড়ালেই হল।

রসিক বলিল, আমি বাউল দরবেশ রাইকমল। বৃন্দে হল আমাদের গুরু। মালা আমাদের মাথায় থাকে গো। এখন তোমার কথা বল।

কি জিজ্ঞাসা করছ, বল?

নবদ্বীপ কেমন? রসিক একটু হাসিল। সে প্রত্যাশা করিয়াছিল, কমলের মুখে রক্তাভা দেখিবে।

কিন্তু কমলিনী মাথা নাড়িয়া সর্বদেহে অস্বীকারের ভঙ্গি ফুটাইয়া বলিল, এমন ভাল কি আর মহান্ত? মহান্ত সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কমলিনী আবার বলিল, তবে মাগঙ্গা ভাল।

প্রবল বিস্ময়ে রসিকদাস বলিল, এমন সোনার গোরায় তোমার মন উঠল না রাইকমল?

হাসিয়া কমলিনী বলিল, না, বগ-বাবাজী। তবে হ্যাঁ, ওই রূপের মানুষটি যদি পেতাম তা হলে পায়ে বিকতাম, তবে মন উঠত।

রসিক এবার ছাড়িল না, রহস্য করিয়া সে বলিল, বল কি? রাইকমল-রঞ্জনকে ভুলে, অ্যাঁ?

হাসিয়াই কমল উত্তর দিল, তা সোনার মোহর পেলে রুপোর আধুলি ভোলে না কে, বল?

তবে রাইকমল, আধুলি-টাকার তফাতের লোকও তো রয়েছে। টাকাটা নিয়ে আধুলিটা ভোল না কেন?

সাধে কি তোমাকে বগ-বাবাজী বলি! চুনোপুটির ওপরেও তোমার লোভ! দুটো আধুলিতে একটা টাকা। বত্ৰিশটা আধুলিতে একটা মোহরের দাম হয়, কিন্তু বত্ৰিশটা গালালেও রুপোতে সোনার রঙ ধরে না। ওটুকু তফাতে আমার মন ওঠে না। এত লোভ আমার নাই।

কামিনী বোধহয় নিকটেই কোথাও গোপনে বসিয়া কন্যার মনের কথা শুনিতেছিল। সে আর থাকিতে পারিল না, সম্মুখে আসিয়া বলিয়া উঠিল, তা বলে টাকা-আধুলির উলটো কদরও কেউ করে না মা! তোমার সবই আদিখ্যেতা, হ্যাঁ।

কমলিনী বাসর-ঘরের কনের মত ধরা পড়িয়া হাসিয়া সারা হইল। সে–হাসিতে মায়ের রাগ আরও বাড়িয়া গেল। কামিনী রাগ করিয়াই বলিয়া উঠিল, মরণ! এতে হাসির কি পেলি শুনি? হাসছিস যে শুধু?

কমলিনীর হাসি বাড়িয়াই চলিল। মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে হাসিতে সে বলিল, মরণ তোমার। আড়ি পেতে আবার মেয়ের মনের কথা শোনা হচ্ছিল! তারপর উচ্ছল হাস্যধারা সংবরণ করিয়া মৃদু শান্ত হাসি হাসিয়া সে বলিল, তা শুনেছিস যখন, তখন শোন। টেপাে-হাঁদা টাকার মালা না পরে যদি কেউ প্রমাণী৷ আধুলির মালাই গলায় দেয়, তাতে নিন্দের কি আছে? ওখানে দরের কথা চলে না বাহাতুরে বুড়ি-ও হল রুচির কথা।

অবাক হইয়া কামিনী মুখরা মেয়ের মুখপানে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর তাহার যেন চমক ভাঙিলী, বলিল, তবে তোর মনের কথাটাই শুনি?

কমলিনী বলিল, বললাম তো, আবার কি বলব?

মা বলিল, কতকাল আর আমার গলায় কঁটা হয়ে বিঁধে থাকবি তুই? বিয়ে তুই কেন করবি না?

তা আবার কখন বললাম আমি?

কেন তবে সুবলকে মোলাচন্দন করবি না?

দূর! কেমনধারা মেয়ের মতন কথা, মেয়েলি ঢঙ। দূর দূর! মুখে কাপড় দিয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

সেদিকে ভ্ৰক্ষেপ না করিয়া মা বলিল, বেশ, তবে বলাইদাস—

ঠোঁট উলটাইয়া কমল বলিয়া উঠিল, মর-মার! রুচিতে তোর ধন্যি যাই। ওই আমড়ার আঁটির মত রাঙা-রাঙা চোখ! ওকে বিয়ে করার চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়া ভাল।

রাগ করিয়া কামিনী উঠিয়া গেল। সমস্ত দিন সে আর মেয়ের সঙ্গে কথা কহিল না। কমলিনী সেটুকু বুঝিল। সন্ধ্যার সময়ে সে আসিয়া মায়ের গা ঘেষিয়া বসিতেই মা হাতদুই ছিটকাইয়া সরিয়া গেল। বলিল, কচি খুঁকির মত গা ঘেঁষে বাসা কেন আবার?

কমল কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিল। তারপর অনুপেক্ষণীয় গভীর স্বরে মাকে বলিল, দেহ দিয়ে গোবিন্দের পুজো করা হয় না মা?

মা চকিতভাবে কন্যার মুখের দিকে চাহিল। কমল অসঙ্কোচপূর্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, মালা কি মানুষের গলাতেই দিতে হবে?

ওদিকের দাওয়ার উপর ছিল রসিকদাস বসিয়া, সে বলিয়া উঠিল, তাই হয় গো রাইকমল, ভূইয়া মানুষের মধ্যে দিয়েই তাঁর পূজা করতে হয়। জান, সবার উপরে মানুহ সত্য তাহার

পরে নাই!’

কমল কঠিন স্বরে বলিল, মিছে কথা। ও হচ্ছে মানুষের নিজের ফন্দির কথা। ভগবানের পুজো চায় সে নিজে।

কামিনী বলিল, ও কথা থাক না কমল। কিন্তু মা, মা তো তোর অমর নয়—আর ভিখারির সম্বলও আর কিছু নাই যে তোকে দিয়ে যাব। যা ছিল, তাও ফুরল। কি করে তোর দিন চলবে?

হাসিয়া কমল বলিয়া উঠিল, হরি বলে। নেহাত বোকার মত কথাটা বললি মা! তোর যেমন করে দিন চলছে তেমনিই করে আমারও চলবে। হরি বলে পাঁচটা দোর ঘুরলেই একটা পেট চলে যাবে আমার!

মা বলিল, তুই তো জনিস না কমল পথের কথা। সাপকে এড়িয়ে পথ চলা যায় মা, কিন্তু পাপকে এড়িয়ে পথ চলা যায় না।

কমল উত্তর দিল, লখিন্দরকে বাসর-ঘরে-লোহার বাসর-ঘরে সাপে খেয়েছিল মা। পথে নয়। ও পথই বল আর ঘরই বল, পাপ এড়িয়ে কোথাও চলা যায় না। আমায় আর ওসব কথা বলিস না মা। সে উঠিয়া চলিয়া গেল।

কামিনী রসিকদাসকে বলিল, কি করি আমি মহান্ত?

রসিক আপন—মনে গান ভাজিতেছিল, কোনো উত্তর দিল না।

মানুষের নাকি আশার শেষ নাই। সংসারে চুনিয়া চুনিয়া সে শুধু সংগ্রহ করে আশাপ্ৰদ ঘটনাগুলি। বাকিগুলি ইচ্ছা করিয়া সে ভুলিতে চায়, ভুলিয়াও যায়। এমনই ঘটনার পর ঘটনা সাজাইয়া সে গড়িয়া তোলে কল্পনার আশা-দেউল। কামিনীর আশা নিঃশেষে শেষ হয় নাই।

সুবলকে লইয়া খানিকটা জটিলতা ঘনাইয়া আসিতেছিল। তাহা দেখিয়াই কমলের মায়ের একটা আশ্বাসপূর্ণ প্রত্যাশা জাগিয়াছিল। যতই নিন্দা সুবলের সে করুক, তাহাকে দেখিলে কমল প্রফুল্ল হইয়া ওঠে। আগ বাড়াইয়া হাসিমুখে তাহাকে সম্ভাষণ করে, সুবলসাঞাতী, শোন।

রসিক মুগ্ধভাবে বলিয়া ওঠে, সুবল—সখা, গোরারূপে তোমায় মানায় না ভাই। রঙটি তোমার কালো হলেই যেন ভাল হত।

সুবল লজ্জা পায়। সে মাথাটা নত করিয়া রাঙা হইয়া ওঠে। উত্তর দেয় কমল, সপ্রতিভ মেয়েটির মুখে কিছুই বাধে না। অবলীলাক্রমে ধারালো বাঁকা ছুরির মত উত্তর দেয়, সমাজে খেতে বসে নিজের যে জিনিসটার ওপর লোভ হয়, লোকে সেই জিনিসটা পাশের পাতে দিতে সুপারিশ করে। কালো রূপটা তোমার হলেই ভাল হত বগ-বাবাজী। রাইকমলকে পাশে মানাত ভাল।

সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্দাম হাসির তরঙ্গে সে নিজেই যেন মুখরিত হইয়া ওঠে। তরুণ অবয়বের প্রতি অঙ্গটি তাহার সুপ্ৰত্যক্ষ কম্পনে কাঁপে, মনে হয় প্রতিটি অঙ্গ যেন নাচিতেছে।

রসিকদাস লজ্জিত হইয়া বলে, রাধে রাধে! আমরা হলাম। বাউল রাইকমল। ব্রজের শুক আমরা। লীলার গান গাওয়াই আমাদের কাজ গো।

কমল হাসিতে হাসিতে বলে, আমি না হয় শারিই হতাম শুকের।

রসিকদাস পলাইয়া যায়। বলে, রণে ভঙ্গ দিলাম আমি। পিঠে বাণ মারা ধর্মকাজ হবে না। রাইকমল।

মাও কাজের অজুহাতে সরিয়া যায়। হাসি গল্প গান করিয়া সুবল চলিয়া যায়। পথে পিছন হইতে কে তাহাকে ডাকে, শোন শোন, ওহে সুবল—সখা!

সুবল পিছন ফিরিয়া দেখে, রসিকদাস। রসিক নিকটে আসিয়া বলে, কি বললে রাইকমল?

সুবল সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে, কি আবার বলবে? কিসের কি?

রসিক বলিয়া ওঠে, কমল ঠিক বলে, মেয়ে গড়তে গড়তে বিধাতা তোমাকে ভুলে পুরুষ গড়ে ফেলেছে। মালা-মালা-বলি, কমল-মালা গলায় উঠবে তোমার? কিছু বুঝতে পােরছ?

সুবল লজ্জায় রাঙা হইয়া ওঠে, মাথা নিচু করিয়া চুপ করিয়া থাকে।

রসিক যেন রুষ্ট হয়। বলে, কি তুমি হে?

লজ্জিত সুবলকে দেখিয়া আবার মায়াও হয়। কিছুক্ষণ পর সান্ত্বনা দিয়া বলে, খেয়ে তো ফেলবে না। রাইকমল তোমাকে। সে তো আর বাঘ-ভালুক নয়। তার মতটা জান না একদিন।

মৃদুস্বরে সুবল বলে, কাল জানব।

রসিক খুশি হইয়া বলে, মালা-চন্দনের দিন তোমার মালা আমি গাঁথব কিন্তু।

হাসিয়া সুবল বলে, বেশ!

পরদিন ঠিক সেই স্থানটিতে রসিক অপেক্ষা করিয়া থাকে। সুবল আসিতেই হাসিতে হাসিতে বলে, মালা গাঁথি সুবল—সখা?

সুবল নীরব। রসিকদাস বলে, কথা কও না যে হে? কি হল?

সুবল বলে, কমলের মা ছিল। ওদিকের ঘরে—

রসিক বলে, কি বিপদ! তোমার জন্যে সে কি বনে যাবে? তোমার কোনো ভয় নাই, কামিনী নিজে আমায় তোমাকে বলতে বলে দিয়েছে। সে নিজে দিনে দশ বার করে মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছে যে, কেন তুই সুবলকে বিয়ে করবি না? কাল কিন্তু এর শেষ করতে হবে। বুঝলে?

সুবল ঘাড় নাড়িয়া জানায়, সে বুঝিয়াছে।

পরদিন কামিনীও কোথায় গিয়াছিল। কমলিনী একা বসিয়া কি যেন ভাবিতেছিল। সুবল আসিয়া চারিদিক চাহিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। সে সাহস সঞ্চয় করিয়া রসিকতা করিয়া বলিয়া ফেলিল, রাইকমলিনী বিমলিনী কেন গো?

কমল ধীরে ধীরে মুখ তুলিয়া মৃদু হাসির সহিত বলিল, গোষ্ঠের বেলা যায় যে সখী! তাই ভাবছি, সুন্দর সুবল—সখা আমার বাছনি বুকে এল না কেন? শ্যামের কাছে আমি যাব কেমন করে?

তরুণ সুবলের মনে মোহ ছিল। তাহার উপর রসিকদাসের গতকালের উৎসাহ সে-মোহের মূলে ভরসার জলসিঞ্চন করিয়াছে। কমলের কথাগুলির অর্থের মধ্যেও সে তাই অনুকূল ইঙ্গিত অনুভব করিল। যে মোহ এতদিন তাহার মনের কুঁড়ির ভিতরের গন্ধের মত সুপ্ত ছিল, আজ সে— মোহ বিকশিত পুষ্পের গন্ধের মত তাহার সর্বাঙ্গ ভরিয়া যেন প্রকাশিত হইয়া পড়িল। স্বপ্নভরা চোখে কমলের দিকে অকুণ্ঠিত দৃষ্টিতে চাহিয়া সে আবিষ্টের মা? কমলিনীর হাতখনি ধরিতে হাত বাড়াইল। সে-হাত তাহার থারথার করিয়া কাঁপিতেছিল।

মৃণালের মত লীলায়িত ভঙ্গিতে দেহখানি বাঁকাইয়া সরিয়া আসিয়া কমলিনী বলিল, ছি! এই কি সুবল—সখার কাণ্ড! তোমার মনে পাপ!

অকল্পিত আকস্মিক আঘাত সুবলের কাছে। রসিকদাসের কথা সে ধ্রুব বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছিল। মুহূর্তে দারুণ লজ্জায় শান্ত লাজুক বৈষ্ণবটির সর্বাঙ্গ যেন অবশ হইয়া গেল। মুখ হইয়া গেল বিবৰ্ণ পাশু।

বিচিত্র চরিত্র এই চঞ্চলা কিশোরীটির। এইবার সে নিজেই সুবলের হাত ধরিয়া বলিল, এস। সখা, বোসো। দাঁড়াও, একটা কিছু নিয়ে আসি পাতিবার জন্য।

কমলিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেই সুবল পলাইয়া আসিয়া বীচিল। লজ্জার ধিক্কারের আর তাহার সীমা ছিল না। কিন্তু তাহাতেও নিস্কৃতি নাই। পিছন হইতে কমলিনী ডাকিল, যে চলে যায়, সে আমার মাথা খায়-মাথা খায়।

সুবলকে ফিরিতে হইল। চটুলা চঞ্চলা মেয়েটি তখনই হাসিয়া অনুযোগ করিল, চলে যােচ্ছ যে?

সুবল মাথা নিচু করিয়া দীড়াইয়া রহিল। তাহার হাত দুইটি ধরিয়া কমলিনী বলিল, তুমি আমার সত্যি সুবল—সখা-বেশ!

এবার কণ্ঠস্বরে ছিল সকরুণ একটি আন্তরিকতা, আত্মীয়তা।

সুবল এতক্ষণে মুখ তুলিয়া অকুণ্ঠিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, বেশ। কিন্তু তোমার চোখ ছলছল করছে কেন রাইকমল?

সাদা হাসিটি হাসিয়া কমলিনী বলিল, এই হাসছি আমি ভাই।

সেদিন ফিরিবার পথে সুবল রসিকদাসকে বলিল, ও কথা আমাকে বলবেন না।

রসিক বিক্ষিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

সুবল বলিল, মানুষে ওর মন ওঠে না মহান্ত।

কামিনী সমস্ত শুনিয়া আজ আবার বলিয়া বসিল, আমি কি করব মহান্ত?

রসিক অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়াও উত্তর খুঁজিয়া পাইল না, বরং মনে তাহার গান গুঞ্জন করিয়া উঠিল–

কাঞ্চন-বরনী, কে বটে। সে ধনী, ধীরে ধীরে চলি যায়।
হাসির ঠমকে, চপলা চমকে নীল শাড়ি শোভে গায়।
… … … … …
চণ্ডীদাস কহে, ভেবো না ভেবো না, ওহে শ্যাম গুণমণি।
তুমি সে তাহার সরবস ধন তোমারি সে আছে ধনী।।

কামিনী কিন্তু অনেক ভাবিয়া সত্ত্বনা আবিষ্কার করে। তাহার কমল এখনও ফোটে নাই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress