Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রহস্যভেদী-কিরীটি রায় || Adrish Bardhan

রহস্যভেদী-কিরীটি রায় || Adrish Bardhan

রহস্যভেদী-কিরীটি রায়

নীহাররঞ্জন গুপ্ত-র গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
রহস্যভেদী। কিরীটি রায়

কিরীটি তখন পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র। ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে এম. এস. সি হতে চলেছে। থাকে শিয়ালদার কাছে অখ্যাতনামা বাণীভবন মেসের তিনতলায়। অন্ধকার খুপরি। মাসিক সাত টাকায় খাওয়া-পরা-থাকা।

শীতকাল। রবিবার। সন্ধ্যা।

কলেজ-বন্ধু সলিল সরকার এসে বলল, কিরীটি, আজ আমার মনটা ভালো নেই। একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে বাড়িতে। বাবার ঘরের সিন্দুকে একটা দলিল ছিল। কয়েকদিন ধরে হাইকোর্টে একটা মামলা চলছে, দলিলটা সেই মামলা সংক্রান্ত। গতকালও বাবা সকালের দিকে দলিলটা সিন্দুকেই দেখেছেন। আজ সকালবেলা সিন্দুক খুলে উকিলকে দলিল দিতে গিয়ে দেখলেন দলিল নেই। সিন্দুকের টাকাকড়ি, অন্যান্য জিনিসপত্র সবই ঠিক আছে, কেবল দলিলটাই নেই সিন্দুকে।

সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে?

বাবার কোমরে।

মামলাটা কার সঙ্গে হচ্ছে?

মামলাটার একটু ইতিহাস আছে। ২৪-২৫ বছর আগে সোনারপুরে একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যায়। বাগানবাড়িটা ছিল রাজা ত্রিদিবেশ্বর রায়ের। ওঁর পিতামহ যজ্ঞেশ্বর রায় ব্যবসা করে জমিদারি গড়ে তোলেন আর গভর্নমেন্টের কাছে রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। রাজা ত্রিদিবেশ্বর কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়েই পথে বসলেন। দেনার দায়ে শেষ বসতবাটি সোনারপুরের বাগানবাড়িটাও বিক্রি করতে হল। বাবা সাতহাজার টাকায় কিনে নিলেন বাগানবাড়ি। খানিকটা ঝোঁকের মাথায় কিনেছিলেন বলেই কোনও সংস্কার করেননি। বছরখানেক আগে অনিল চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক এসে কিনতে চাইলেন ভাঙা বাগানবাড়িটা উদ্দেশ্য, স্কুল স্থাপন করা। লেখাপড়া হবে, সব ঠিকঠাক, এমন সময়ে বাবা একটা বেনামি চিঠি পেলেন। চিঠিতে লেখা ছিল?

প্রিয় মধুসূদনবাবু,

লোক পরম্পরায় শুনলাম, রাজা ত্রিদিবেশ্বরের বাড়িটা নাকি আপনি বিক্রি করছেন। আমি জানি, ওই বাড়ির কোনও এক স্থানে ত্রিদিবেশ্বরের পিতামহ যজ্ঞেশ্বর রায়ের গোটা দশ-বারো দামি হিরে পোঁতা আছে। সে হিরের দাম সাত আট লক্ষ টাকা তো হবেই, আরও বেশি হতে পারে। যার কাছে আপনি বাড়িটা বিক্রি করছেন, সে সেকথা কোনও সূত্রে জানতে পেরেছে তাই কেনবার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছে; তা না হলে এতদিনকার ভাঙা বাড়ি, তাও কলকাতার বাইরে, কেউ কিনতে চায়? রাজা ত্রিদিবেশ্বর বা তাঁর পিতা রাজেশ্বরও সেকথা জানতেন না। হিরের কথা একমাত্র রাজা যজ্ঞেশ্বর ও তাঁর নায়েব কৈলাস চৌধুরীই জানতেন। কিন্তু হিরেগুলো যে সঠিক কোথায় পোঁতা আছে, সে কথা একমাত্র যজ্ঞেশ্বর ভিন্ন দ্বিতীয় প্রাণী কেউ জানত না। রাজা যজ্ঞেশ্বর হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে মারা যান। কাজেই মৃত্যুর সময়ে তাঁর লুকানো হিরেগুলোর কথা কাউকেই বলে যেতে পারেননি।

ইতি–
আপনার জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী।

চিঠিখানা পড়ে বাবার মত বদলে গেল। অনিল চৌধুরীকে স্পষ্ট বলে দিলেন, বাড়ি বিক্রি করবেন না। অনিলবাবু বিশহাজার টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলেন। তাতে বাবার সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হল। বাধ্য হয়ে অনিলবাবু ফিরে গেলেন।

মাসখানেক পরে বাবার কাছে এক উকিলের চিঠি এল। সোনারপুরের বাগানবাড়ি দেনার দায়ে ভুবন চৌধুরীর কাছে বন্ধক রেখেছিলেন রাজা ত্রিদিবেশ্বর। বন্ধকী জিনিস আইনত বিক্রি করা যায় না। তাছাড়া বাবাকে দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, বাড়িটা সত্যিই তিনি রাজা ত্রিদিবেশ্বরের কাছ থেকে কিনেছিলেন।

উকিলের চিঠি পেয়ে বাবা হাসলেন। কোনও জবাবই দিলেন না। কেননা, বাবার সিন্দুকে যে দলিল আছে, সেটাই তার প্রমাণ। অবশেষে কোর্টে মামলা উঠল। গতকাল কোর্টে দলিল পেশ করার দিন। এমন সময়ে অকস্মাৎ চুরি গেল দলিলটা।

কিরীটি বললে, এ যেন একটা রহস্য উপন্যাস। চেষ্টা করলে অবশ্য সুরাহা করা যেতে পারে।

পারবি তুই দলিলটা খুঁজে বের করে দিতে?
কিরীটি কোনও জবাব দিল না। শুধু হাসল।

.

এ কাহিনি যখনকার, তখন ঢাকুরিয়া অঞ্চলে আধুনিকতার হাওয়া লাগেনি। লেক তো দূরের কথা, সেখানে তখন ঘন বন-জঙ্গল আর ধানখেত। রেললাইনের ধার দিয়ে দুএকটা পাকা বাড়ি দেখা যেত মাত্র।

ঢাকুরিয়া স্টেশনের কাছেই মধুসূদন সরকারের প্রকাণ্ড চারমহলা বাড়ি। সোমবার ভোরবেলা সলিলের সঙ্গে কিরীটি ঢুকল বাগানে। মধুসূদনবাবু তখন গায়ে শাল জড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।

কিরীটি বললে, কাকাবাবু, সলিল কাল রাতে আমার কাছে ছিল। আপনার শরীর ভালো তো?

হ্যাঁ, বাবা। বুড়ো হাড়ে কোনওরকমে জোড়াতালি দিয়ে চলছে।

সলিল বলে উঠল, বাবা, কিরীটি বলছিল তোমার হারানো দলিল ও খুঁজে বের করে দেবে।

মধুসূদন পুত্রের কথায় চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটির দিকে তাকালেন।

কিরীটি ধীরভাবে বললে, চেষ্টা করব। কিন্তু আপনার সাহায্য সবার আগে দরকার, কাকাবাবু।

গুম হয়ে রইলেন মধুসূদনবাবু। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, সাহায্য! কীভাবে করতে পারি বল?

আমি যে দলিলটা খোঁজার ভার নিয়েছি, সে কথা এক আপনি আর সলিল ছাড়া ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারবে না।

বেশ, তাই হবে।

বাড়িটা চারমহলা। দোতলা। প্রথম মহলে ব্যবসার আপিস, দ্বিতীয় মহলে গুদোম, তৃতীয় মহলে দাসদাসীর আস্তানা, চতুর্থ মহলই প্রকৃতপক্ষে অন্দরমহল।

অন্দরমহলে ওপরের দক্ষিণের দুটো ঘরে মধুসূদনবাবু থাকেন–একটা তাঁর বসবার ঘর, অন্যটা শয়নকক্ষ। অন্য দুটির একটিতে থাকে সলিল, আর একটি পূজার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নীচের একটি ঘরে খাওয়াদাওয়া হয়, একটিতে পিসিমা সলিলের তিনটি বোনকে নিয়ে থাকেন, একটিতে সলিলের কাকা বিপিনবাবু, অন্যটিতে অতিথি অভ্যাগত এলে থাকে।

যে ঘরে সিন্দুক আছে, সেটি বেশ বড় আকারের ঘর। মধুসুদনবাবুর শোওয়ার ঘর। দক্ষিণ পুবে ভোলা। ব্যালকনির ঠিক পাশ দিয়ে একটা নারকেল গাছ উঠে গেছে। ব্যালকনি থেকে হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। ঘরটা বারান্দার একেবারে শেষপ্রান্তে। ওই ঘর দিয়েই ছাদে যাওয়ার দরজা।

খাটের পাশে আলমারি। আলমারির পাশে মানুষ প্রমাণ উঁচু মজবুত লোহার সিন্দুক। সিন্দুকের গায়ে বেশ বড় আকারের একটা জার্মান তালা ঝুলছে।

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো মুখোমুখি পুব-পশ্চিমে দুখানি বড় অয়েল পেন্টিং মধুসূদনের মা ও বাবার। বাবার ফটোটি ঠিক সিন্দুকের ওপরেই টাঙানো।

ছোটবেলায় কিরীটির ছবি আঁকার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছবি দুটিকে খুঁটিয়ে শিল্পীর মন নিয়ে দেখতে লাগল। বেশ কিছুদিন ঝাড়াপোঁছা হয়নি ছবি দুটি।

সলিল প্রশ্ন করে, অমন করে কী দেখছিস, কিরীটি?

বিলিতি ফ্রেম বলেই মনে হয়। তোর ঠাকুরদার ফটোটা ঠিক দেওয়ালের সঙ্গে সেট করা হয়নি।–একটু যেন বাঁয়ে হেলে আছে।

এমন সময়ে মধুসূদনবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন।

কী দেখছ?

আপনার বাবার অয়েল পেন্টিং।…বেশ সুন্দর। শিল্পীর হাত চমৎকার। তুলির প্রতিটি টানে প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়।

হ্যাঁ, একজন ইটালিয়ান শিল্পীর আঁকা। চল, চা খেতে-খেতে কথা বলা যাবে।

.

বসবার ঘরে চায়ের টেবিলে বসে মধুসূদনবাবু বললেন, বাড়িতে লোকজনের মধ্যে আমি, বিপিন, দিদি, সলিলের মা আর সলিলের তিন বোন। প্রতিদিন আমি বিকেল পাঁচটার মধ্যেই দোকান থেকে ফিরি। কিন্তু পরশু ফিরতে রাত প্রায় নটা হয়ে যায়। সকালবেলা সিন্দুক খুলে দেখেছিলাম দলিলটা রয়েছে।

রাত্রে একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে মনে হল। হঠাৎ একটা কাঁচ করে শব্দও হল। উঠে পড়লাম। ঘরের বাতি নিভোনো। ডায়নামো রাত এগারোটার পর বন্ধ হয়ে যায়। মোমবাতি জ্বেলে পাশের ঘরে গেলাম। কিন্তু ঘর খালি! বারান্দার দিকের দরজাটা হা-হা খোলা! অথচ শোওয়ার সময়ে নিজের হাতে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলাম। বারান্দার এলাম। চাঁদের আলোয় দেখলাম কে যেন তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। নীচে গিয়ে দেখলাম বাইরে যাওয়ার দরজা বন্ধ–তালা দেওয়া–রোজ তোমার কাকিমা নিজের হাতে তালা দিয়ে শুতে যায়–ভোরে উঠে তালা খোলে। নীচের তিনটে ঘরও বন্ধ–ঠেলে দেখলাম। সকাল নটায় দেখলাম, সিন্দুকে দলিল নেই।

কাল রাতে সাড়ে বারোটা নাগাদ শোওয়ার ঘরের ব্যালকনিতে অন্ধকারে বসে আছি চেয়ারে, হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ শুনলাম ব্যালকনির নীচ থেকে! ঝুঁকে তাকালাম কাউকে দেখতে পেলাম না। হাঁক দিয়ে দারোয়ানকে ডাকতেই কে যেন তীর বেগে পালিয়ে গেল–পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। দারোয়ান এল। টর্চের আলোয় দেখল, ব্যালকনির নীচে নতুন ফুলের চারার পাশে নরম মাটিতে জুতোর ছাপ। সত্যিই কেউ দাঁড়িয়েছিল।

গভীর মনোযোগে সব কথা শুনে কিরীটি বললে, দলিল বোধহয় পাওয়া যাবে। আপনি দিনরাত বাড়ির আশেপাশে পাহারার ব্যবস্থা করুন।

.

রাত দেড়টা।

চিলেকোঠার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে কিরীটি রায়। হঠাৎ ছাদের ওপর শোনা গেল পায়ের শব্দ।

মাথায় ঘোমটা দিয়ে কে যেন ঢুকল ঘরে। দেশলাই জ্বেলে জ্বালাল মোমবাতি। জ্বলন্ত মোমবাতি রাখল বাগানের দিকের জানলার।

আধঘণ্টা পরে হঠাৎ ঘরের ধুলোয় আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল আগন্তুক।

কিরীটি কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে ডাকল, পিসিমা।

কিরীটির দুহাত চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পিসিমা। লোকে জানে তার ছেলে শম্ভ মারা গেছে। কিন্তু সে মরেনি–গোল্লায় গেছে। রোগজীর্ণ কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কিছুদিন আগে এসেছিল। দেনায় ডুবে আছে। এক হাজার টাকা এখুনি একজন দেবে সিন্দুক থেকে একটা দলিল চুরি করে আনলে। নইলে জেলে যেতে হবে। পিসিমা বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেছেন। ছেলের জন্য কীভাবে চাবি চুরি করে সিন্দুক খুলে দলিল সরিয়েছেন, তা বলতে পারলেন না লজ্জায়।

কথা ছিল ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেবেন দলিলটা লুফে নেবে শম্ভু। কিন্তু পরপর দু-রাত ব্যর্থ হয়েছেন পিসিমা। আজ–

পিসিমাকে নীচে পাঠিয়ে সলিলকে ডাকল কিরীটি। ওর সামনেই হাত বাড়িয়ে মধুসূদনের বাবার ফটোর পেছন থেকে বার করে নিল খামসমেত দলিলটা।

পিসিমা কিন্তু বলেননি, দলিল কোথায় আছে। তবুও কিরীটি জানত। কী করে বলতে পারেন?

.

গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান

ছবিটা অনেকদিন ঝাড়পোঁছ হয়নি–অথচ বেঁকে ঝুলছিল। মধুসূদন উঠে পড়ায় পিসিমা দলিলটা ছবির আড়ালে রেখে তরতরিয়ে পালিয়েছিলাম নীচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *