Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রঘু ডাকাত : সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে (প্ৰথম খণ্ড) || Panchkari Dey » Page 5

রঘু ডাকাত : সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে (প্ৰথম খণ্ড) || Panchkari Dey

তারা কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইল। কে যেন তারার কানে কানে বলিয়া দিল, “তারা, তোমার কোন ভয় নাই।” “ভয় নাই, আমার উদ্ধার হবে, আমি নির্ভয়ে থাকি,” এই কথা কয়টী যেন তাহার হৃদয়যন্ত্রের প্রতি তারে ধ্বনিত হইতে লাগিল। এতক্ষণে তারা বুঝিল, সময় হইলেই রায়মল্ল সাহেবের চেষ্টায় তাহার মুক্তি হইবে। তৎসঙ্গে তিনি দস্যুদলেরও উচ্ছেদ সাধন করিবেন। কল্পনাময় দৃশ্য তারা অত্যাশ্চর্য্য বলিয়া বোধ করিতে লাগিল। যাহার অনুসন্ধানে মুমূর্ষু পিতাকে একা রাখিয়া হিতাহিত-বোধ-পরিশূন্য হইয়া সে পার্বত্য প্রদেশে যাইতেছিল; তাহাকে এরূপভাবে দস্যুবৃন্দের ভিতরে হঠাৎ দেখিতে পাইবে, তারা এরূপ অভাবনীয় অচিন্তনীয় কল্পনা কখনই করে নাই। যদি ঘটনাচক্রের আবর্তনে রঘুনাথ কর্তৃক তারা আক্রান্ত না হইত, তাহা হইলে রায়মল্ল সাহেবকে সে হয় ত কখনই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিত না। হিতে বিপরীত হইত। যাহা মন্দ ভাবিয়াছিল, তাহা হইতে ভাল হইবে, এরূপ আশা তারার মনে একবারও স্থান পায় নাই। চক্রীর চক্রে, অভাগিনীর অদৃষ্টে এরূপ অভাবনীয় ঘটনা ঘটিবে, তাহা কি তারার অনুভবে আসিতে পারে?

তারা যখন এইরূপ আত্মচিন্তায় ব্যাকুল, দস্যুগণ তখন আপনাদের বিপদের কথা লইয়াই ব্যস্ত। যাঁহার নাম শুনিলে সে-সময় দুরাত্মামাত্রেরই আপাদমস্তক ভয়ে কম্পিত হইত, যাঁহার নামে রাজপুতনার অধিকাংশ দস্যুই দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছিল, রঘু ডাকাতের দলও যে তাহার নাম শুনিয়া বিত্ৰস্ত হইবে, তাহা অসম্ভব কি? তারা স্থির হইয়া একমনে দস্যুদলের পরামর্শ শুনিতে লাগিল।

আগন্তুক কহিতে লাগিল, “তা তোমরা যতই আস্ফালন কর না কেন, আমার বিশ্বাস, রায়মল্ল সাহেব যখন আমাদের পিছু নিয়েছে, তখন যা’ হয়, একটা হেস্ত নেস্ত না করে আর ছাড়ছে না। যতক্ষণ সে বেঁচে আছে, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ্ নহি।”

রঘুনাথ বলিল, “এ সময়ে আমার সমস্ত লোক ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। যদি আমরা সবাই একত্র থাকতেম, তা’হলে আমার তত ভাবনা হত না। তবু বার-তেরজন এখানে এখন আমরা আছি। রায়মল্ল সাহেব একা এসে বড় কিছু করতে পারছে না।”

একজন দস্যু মাঝখান হইতে বলিয়া উঠিল, “কিছু বলা যায় না। তার যে কত বুদ্ধি, তা’ কেউ ঠিক বলতে পারে না। ভূতের মত সে আশে-পাশে থাকে তাকে কেউ দেখতে পায় না—সে কিন্তু সব জানে। তার নাম মনে হ’লে আমার বুক গুর্ গুর্ করে।”

রঘু। কেন, সে তোমায় একবার জেলে পাঠিয়েছিল ব’লে? আমি দেখছি, তার কথা পড়লেই তোমার পিলে চমকে উঠে। তোমার মত ভীতু লোক আর দুটো-চারটে আমার দলে থাকলেই ত আমায় আরাবল্লী পর্ব্বত ছেড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যেতে হবে দেখছি।

আগন্তুক। কি সর্দ্দার, তোমার মুখে আর ও কথা শোভা পায় না। তুমি গাছের গুঁড়িতে ছোরা বিধৃতে পার, বাতাসের সঙ্গে লড়াই করতে পার, আপনার দলের ভিতরে বসে আস্ফালন করতে পার; কিন্তু রায়মল্ল সাহেব তোমার যম, সে কথা যেন মনে থাকে। মনে পড়ে, একবার তুমি তার হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছ?

রঘু। সেবার আমি একা পড়েছিলেম, আর দৈবাৎ আমার কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, তাই আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন সদাই আমার কাছে পিস্তল, ছোরা থাকে। এখন যদি একবার দেখা হয়, ত বুঝতে পারি, সে কেমন গোয়েন্দা—

সহসা কোথা হইতে কে বলিল, “শীগগির দেখা হবে, প্রস্তুত হ’য়ে থাক।”

রঘুনাথ চীৎকার করিয়া উঠিল, “কে কথা কইলে? কে এ কথা বলে?”

কেহই উত্তর দিল না। প্রজ্বলিত অগ্নির তেজ তখন অনেকটা নিবিয়া আসিয়াছিল। সকলের মুখ তখন স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল না। ক্রোধভরে রঘুনাথ চারিদিকে চাহিল—কেহ কোন উত্তর দিল না। আবার অতি কঠোরস্বরে ক্রোধোন্মাদে রঘুনাথ বলিল, “তবে হয় আমাদের দলের মধ্যে কেউ নেমকহারাম আছে, নয় রায়মল্ল সাহেবের চর কেউ এখানে ঘুরছে।”

আগন্তুক কহিল, “যাক্, ও কথা ছেড়ে দাও। কেহ হয় ত ঠাট্টা করে তোমায় রাগাবার জন্য এ কথা বলেছে। এখন তুমি রেগেছ, আর কি কেউ স্বীকার করবে? এখন বল দেখি, উপায় কি! রাগারাগী করে ত কোন ফল হবে না। ভাল রকম বিবেচনা করে এখন হ’তে সাবধান হ’য়ে চলা দরকার নয়? যতক্ষণ না রায়মল্ল সাহেবকে খুন করতে পারছ, ততক্ষণ আমাদের আর নিস্তার নাই।”

তারা যাহার দিকে চাহিয়াছিল, তাহাকে ছাড়িয়া অন্যদিকে কাহারও পানে অধিকক্ষণ চাহিয়া থাকে নাই। তাহার মনে স্থির বিশ্বাস হইয়াছিল, সেই ব্যক্তিই রায়মল্ল সাহেব। তারার বিশ্বাস, “শীঘ্র দেখা হবে—তুমি প্রস্তুত হ’য়ে থাক,” এ কথা সেই রায়মল্ল সাহেব ভিন্ন আর কেহ বলে নাই। ঠিক সেই সময়ে তাহার দিকে দৃষ্টি ছিল না বটে, কিন্তু এ-কথা যে অন্যে বলে নাই, তাহা তারার দৃঢ় ধারণা।

তারা ভাবিতে লাগিল, কেমন করিয়া সে রায়মল্ল সাহেবের সঙ্গে কথা কহিবে, কেমন করিয়া তাঁহাকে জানাইবে, তারার মুমুর্ষু পিতার মৃত্যুশযার পার্শ্বদেশে রায়মল্ল সাহেবের উপস্থিতি একান্ত প্রার্থনীয়। নিজের বিপদের জন্য তারা বিন্দুমাত্র ভীত নহে; কিন্তু রায়মল্ল সাহেবকে কিরূপে বুঁদীতে আপন পিতার নিকট একবার যাইতে বলিবে, এই চিন্তাই তাহার হৃদয়ে অতি প্রবল ভাব ধারণ করিল। প্রত্যুৎপন্নমতি তারার মনে অতি অল্পক্ষণের মধ্যে একটি উপায় স্থিরীকৃত হইল। সে একেবারে রঘুনাথের সম্মুখে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “রঘুনাথ! তোমরা রায়মল্ল গোয়েন্দার কথা বল্‌ছ?”

বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে রঘুনাথ তাহার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ, তুমি তার কি জান? তারা উত্তর দিল, “আমি ত তাঁকেই খুঁজতে যাচ্ছিলেম, পথে তোমরা বাধা দিলে।”

তারা এই কথা বলিয়াই সেই আশ্বাসদাতার দিকে অপাঙ্গ নিক্ষেপ করিল। সেই ব্যক্তি প্রকৃত রায়মল্ল সাহেব কি না, এইবার চাহিয়াই তারা তাহা বুঝিতে পারিল। তারা রায়মল্লের নাম উচ্চারণ করিবামাত্র সেই ব্যক্তি আশ্চর্যান্বিত হইয়া তারার মুখের দিকে চাহিয়াছিলেন—তাঁহার চক্ষুদ্বয় হইতে এক অপূৰ্ব্ব দীপ্তি প্রকাশিত হইতেছিল।

তারা ভুল বুঝে নাই—তিনিই ছদ্মবেশে স্বয়ং গোয়েন্দা—সর্দ্দার রায়মল্ল সাহেব।

ভোজসিংহ নামে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি রায়মল্ল সাহেবের কাছে যাচ্ছিলে?”

তারা। হাঁ।

দস্যুগণ সকলেই আশ্চর্য হইয়া তারার মুখপানে চাহিয়া রহিল।

নারায়ণরাম তারার দিকে ফিরিয়া বলিল, “দেখেছ ব্যাপার? জানি, এখানকার লোকে এখন আমাদিগকে ধরিয়ে দেবার জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। এই বালিকাকে দিয়ে নিশ্চয় কোন সংবাদ পাঠাচ্ছিল।”

রঘুনাথ বলিল, “সে কি, তারা! তুমি রায়মল্ল সাহেবের কাছে কেন যাচ্ছিলে?”

প্রত্যুৎপন্নমতি তারা তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “আমি রায়মল্ল গোয়েন্দার কাছে একটা খবর নিয়ে যাচ্ছিলেম।”

ভোজসিংহ লাফাইয়া উঠিয়া একেবারে বালিকার সম্মুখে গিয়া বলিল, “কি? তুমি রায়মল্ল গোয়েন্দার কাছে সংবাদ নিয়ে যাচ্ছিলে? তবে সে কি সংবাদ বলতে হ’বে, নইলে মুখ চিরে কথা বার করে নেব।”

যেমন ভোজসিংহ ঐরূপভাবে ভীষণাকৃতিতে বালিকার নিকট উপস্থিত হইল, অমনই কোথা হইতে অলক্ষ্যভাবে ঠিক সময়ে রায়মল্ল সাহেবও তাহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তারা বুঝিল, পাছে ভোজসিংহ তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করে, এইজন্য তিনি ভোজসিংহের পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়াছেন।

সাহসে নির্ভর করিয়া তারা বলিল, “আমায় ভয় দেখাচ্ছ কেন, আমি আপনিই ত বলছি। শোন—অনেক দিন পূর্ব্বে আমার পিতার সহিত রায়মল্ল সাহেবের পিতার বন্ধুত্ব ছিল। আমার পিতা একবার ঐ বন্ধুর (রায়মল্লের পিতার) জীবন রক্ষা করেছিলেন। বাবা যদিও রায়মল্ল সাহেবকে কখনও দেখেন নাই; কিন্তু তিনি বিবেচনা করেন, রায়মল্ল সাহেব কখনই তাঁহার অহিতৈষী হবেন না।”

ভোজসিংহ বলিল, “আরে রাখ তোর হিতৈষী আর অহিতৈষী! এখন কি খবর নিয়ে যাচ্ছিলি, তাই আগে বল্।”

তারা যেন কিছু ভীত হইয়া বলিল, “বাবা এখন মুমূর্ষু। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি রায়মল্ল গোয়েন্দাকে একটি আশ্চর্য গুপ্তকথা ব’লে যেতে চান্। বাবা কা’র কাছে শুনেছিলেন, রায়মল্ল গোয়েন্দা এখন লালপাহাড়ে আছেন। তাই তিনি আমাকে দিয়ে এই কথা ব’লে পাঠাচ্ছিলেন যে, বুঁদীগ্রামে বাবার সঙ্গে একবার রায়মল্ল সাহেবের দেখা হওয়া বিশেষ দরকার। আমি এই সংবাদ দিতেই রায়মল্ল সাহেবের অনুসন্ধানে লালপাহাড়ে যাচ্ছিলেম।”

তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না তারা এইরূপ কৌশলে আপনার জ্ঞাতব্য বিষয় ছদ্মবেশী রায়মল্লকে জানাইয়া সংক্ষেপে আপনার বাসস্থানের ঠিকানাও বলিয়া নিশ্চিন্ত হইল। তারা যে কি খেলা খেলিল, দস্যুগণ কেহই তাহার কিছুই বুঝিতে পারিল না। অথচ অতি সহজে তাহার কার্য্যসিদ্ধি হইল।

ভোজসিংহ বলল, “বাঃ! বেশ চমৎকার মজার কথা বললে, যা হ’ক, এতে আমাদের আর কি উপকার হবে?”

রঘুনাথ বলিল, “চমৎকার! আমার এমন ইচ্ছে হচ্ছে যে, তারাকে আর একবার ছেড়ে দিই। ও রায়মল্ল গোয়েন্দার সঙ্গে দেখা করুক্।”

আর একজন দস্যু জিজ্ঞাসা করিল, “তাতে আর কি ফল হবে?”

রাক্ষসবৎ উৎকট হাসিয়া কঠোরস্বরে রঘুনাথ বলিল, “তাতে এই ফল হবে যে, রায়মল্ল একা রুদীগ্রামে তারার বাবার কাছে অসহায় অবস্থায় যাবে, আর আমরা সকলে মিলে তাকে আক্রমণ করব।”

ঠিক এই সময়ে আর একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিল। কে কোথা হইতে বলিল, “আজ রাত্রেই রায়মল্ল তারার বাপের কাছে যাবে। কারও সাধ্য থাকে— সেখানে যেয়ো।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress