দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বিবাহ-বিভ্ৰাট
রঘুনাথ বিস্মিত হইল। সে মনে করিয়াছিল, তারা সহজে কখনই তাহার সহিত যাইতে সম্মত হইবে না। সে কত অনুনয়-বিনয়, কত কাকুতি-মিনতি, কত কান্নাকাটি করিবে। রঘুনাথের প্রস্তাবমা — এক কথায় সে, সে তাহার সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইবে, এ কথা রঘুনাথের পক্ষে কল্পনার অতীত। রঘুনাথ বলিল, “এতক্ষণে তুমি তোমার যথার্থ অবস্থা বুঝতে পেরেছ—এতক্ষণে তোমার জ্ঞান হয়েছে, না তারা?“
তারা। আমি এখন তোমার হাতে পড়েছি, কপালে যা আছে, তাই হবে। ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে কি করব?
রঘুনাথ। এমন কথা বলো না, তারা! বাস্তবিক আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।
ঘৃণাব্যঞ্জকস্বরে তারা বলিল, “তুমি আমায় ভালবাস? আমি তোমায় ঘৃণা করি।”
রঘুনাথ। তারা! অকারণ আমায় গাল দিচ্ছ। সত্য বলছি, আমার সঙ্গে তোমার বিবাহ হ’লে তুমি সুখিনী হবে। তুমি দেখতে পাবে, আমি তোমার উপযুক্ত স্বামী।
তারা আর সহ্য করিতে পারিল না। ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া কঠোর স্বরে বলিল, তোমার সঙ্গে বিবাহ হ’লে আমার সুখ হবে? ছি! ছি! ধিক্-ধিক্—এ কথা আর দ্বিতীয়বার মুখে উচ্চারণ ক’রো না। তোমার দেহ রাশি রাশি পাপে পূর্ণ, যদি ছোরাছুরি, গোলাগুলি, বন্দুক-ধনুক সব ছেড়ে দিয়ে নৃশংসতা ভুলে যেতে পার, অন্তরের অন্তস্থলের কলঙ্ক কালিমা নিজের রক্তে যদি ধুয়ে ফেলতে পার, তবেই তুমি আমার পতি হ’বার যোগ্য ব’লে পরিচয় দিতে পারবে; নইলে যা’ বছ সবই মিথ্যা।”
রঘুনাথ কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া উত্তর করিল, “না তারা! তুমি বড় বাড়িয়ে তুলে। তোমার এ সব বিষ-মাখান কথা আমার হাড়ে হাড়ে বিঁধে যাচ্ছে। মিছামিছি তুমি আমায় রাগিয়ে দিচ্ছ। তুমি এখনও বুঝছ না, যাক তুমি এইসব কথায় গাল দিচ্ছ, যার উপর তোমার এত ঘৃণা, আর আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে তার যথারীতি শাস্ত্রসম্মত পরিণীতা ভার্য্যা হ’তে হবে। এখন ভাল চাও ত, বিনাবাক্যব্যয়ে আমার সঙ্গে চলে এস।”
তারা তাহাই করিল। অসীমসাহসে সে তাহার বুক বাঁধিয়াছে, সর্ব্বশেষে সে কি করিবে, তাহা স্থির করিয়াছে। আর তাহার মনে ভয়-ভাবনা বা কোন কামনা নাই। সে আপনার পথ আপনি ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। অনেকবার তারা শুনিয়াছে, শুনিয়া বুঝিয়াছে, দস্যুদলের মধ্যে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য এক বলবান্ সহায় আছে। বারে বারে সে নিরাশায় উৎসাহিত হইয়াছে। এবার সে শেষ মুহূৰ্ত্ত পর্যন্ত দেখিবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ। যদি বলবানের সহায়তার বিপদে নিষ্কৃতি প্রাপ্ত না হয়, তাহা হইলে মরিতে সে বিন্দুমাত্র ভীত বা সঙ্কুচিত হইবে না—ইহাই তাহার কল্পনা! তবে আর কিসের ভয়! রঘুনাথের পরিণীতা ভার্য্যা হওয়া অপেক্ষা সে সহজে এবং স্বচ্ছন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে প্রস্তুত।
সেই ক্ষুদ্র তাঁবুর ভিতর হইতে রঘুনাথের সহিত তারা বহির্গত হইল। কিছুদূরে একটি বৃহৎ বৃক্ষতলে যে কয়েকজন লোক দণ্ডায়মান ছিল, তাহাদের দিকে তাহার চক্ষু পড়িল। বিবাহ উপযোগী উপকরণাদি তথায় সজ্জিত। পুরোহিতবেশী একজন লোকও একটি আসনে উপবিষ্ট।
তারা এই সকল দেখিতে দেখিতে ধীরে ধীরে রঘুনাথের সঙ্গে সেই বৃক্ষতলে উপস্থিত হইবামাত্র দস্যুদলের মধ্যে একজন মুখভঙ্গী ও হস্তের ইঙ্গিত করিয়া তারাকে জানাইল, “কোন ভয় নাই।”
রঘুনাথ তারার হস্তধারণ করিল। অবলা রাজপুতবালার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইল। তারপর উভয়ে পুরোহিতের সমীপস্থ হইবামাত্র তিনি তাহাদিগকে ভিন্ন আসনে বসাইয়া একেবারে মন্ত্র উচ্চারণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
সহসা একজন লোক পুরোহিতের সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “খবরদার! এ বিবাহ কখনই হ’তে পারে না।”
আগন্তুকের মুখপানে চাহিয়াই রঘুনাথের সমস্ত রক্ত জল হইয়া গেল। কারণ এই বিবাহে বাধা দিবার জন্য যে সাহসী আগন্তুক তাহার সম্মুখে বীরদর্পে অকুতোভয়ে দণ্ডায়মান, তিনি আর কেহই নহেন—সেই প্রতাপ। যে প্রতাপ রঘুনাথের ষড়যন্ত্রে প্রাণত্যাগ করিয়াছে, সে প্রতাপ কোথা হইতে কেমন করিয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল? প্রতাপের প্রেতাত্মা কি প্রতিশোধ লইতে আসিয়াছে? কিন্তু সম্মুখে প্রতাপের হস্তে উদ্যত পিস্তল দেখিয়া রঘুনাথের সে ভ্রম তৎক্ষণাৎ দূর হইল।
পুরোহিতবেশী সেই লোকটী উদ্ধতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি? এ শুভ কার্য্যে কেন বাধা দাও?”
প্রতাপ সেই পুরোহিতের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া একটী পিস্তল উদ্যত করিলেন। সদম্ভে তিনি উত্তর করিলেন, “আমি যেই হই না কেন, তোমার কোন দরকার নাই। ফের যদি এক পা এগোবে, কি একটি কথা কইবে, তা হ’লেই জানবে তোমার আয়ু শেষ হয়েছে।”
রঘুনাথ সেই সময় অঙ্গরাখার ভিতর হইতে পিস্তল বাহির করিবার উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময়ে সে দেখিল, দুস্যবেশী অন্য একজন তাহার মুখ লক্ষ্য করিয়া একটি পিস্তল খাড়া করিয়া রহিয়াছে। রঘুনাথ অবাক্ হইয়া গেল। বিস্মিত ও চকিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, যাহাদিগকে স্বপ্নেও শত্রু বলিয়া কল্পনা করে নাই, সেই সকল অনুচর প্রতাপ আসিয়া দাঁড়াইবামাত্র বিরুদ্ধভাব অবলম্বন করিয়াছে। অনেকেরই হাতে এক-একটি পিস্তল। অবশ্যই রঘুনাথ বুঝিল, “জালে মাছি পড়িয়াছে।” সে বুঝিল, যাহাদিগকে সে আপন অনুচর বলিয়া ভাবিত, তাহারা প্রায় সকলেই এক মন্ত্রে দীক্ষিত, এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এত দিনে রঘুনাথের আশা, ভরসা, উৎসাহ সকলই গেল। তাহার উদ্যম ভঙ্গ হইল। প্রাণে আশায় তথাপি একবার তাহার শেষ চেষ্টা করিবার ইচ্ছা হইল। একজন দস্যু বলিয়া উঠিল, “খবরদার! এক চুল, ন’ড়ো না।”
রঘুনাথ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, সে যাহাকে বিশ্বাস করিয়া প্রতাপকে হত্যা করিবার ভার দিয়াছিল, সে সেই ব্যক্তি। তাহাকে সেইরূপ পিস্তল উদ্যত করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াই রঘুনাথ বুঝিতে পারিল, প্রতাপ নিহত হয় নাই, এই প্রতাপই—সেই প্ৰতাপ।
প্রতাপ বলিলেন, “রঘু সর্দ্দার? আর কেন বৃথা চেষ্টা করছ? তোমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, তা’ কি বুঝতে পারছ না?
দেখিতে দেখিতে কোথা হইতে পঁচিশ-ত্রিশজন সশস্ত্র প্রহরী আসিয়া উপস্থিত হইল। নিরাশ হইয়া ভগ্নকণ্ঠে রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করিল, “এর মানে কি? তোমরা সকলেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ? তোমরা সকলেই আমার শত্রু?’
প্রতাপ রঘুর কাতরোক্তিপূর্ণ প্রশ্নের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কহিলেন, “যে এক চুল নড়বে তার প্রাণ যাবে। যে সহজে আত্মসমর্পণ করবে, তারই মঙ্গল। যে বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করবে, তারই জীবনলীলা সাঙ্গ হবে। খবরদার! সাবধান! যার কাছে যে অস্ত্র আছে, সব মাটিতে রেখে আমার সামনে দাঁড়াও।”
প্রতাপের ইঙ্গিতে প্রহরিগণ একে একে দস্যুদিগের হাতে হাতকড়া দিতে লাগিল।
রঘুনাথ মরিয়ার ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “কি বিনা বাধায়, বিনা চেষ্টায়, বিনা বল প্রকাশে মেষপালের ন্যায় আমরা ধরা দেব? না—তা’ কখনই হবে না।”
প্রতাপ বলিলেন, “পরের জন্য তোমার আর ভাবতে হবে না। তোমার নিজের চরকায় তেল দাও। তোমার কি হবে, তাই ভাব। নিজেকে কেমন করে বাঁচাবে, এখন তারই উপায় দেখ।”
বিনা বাধায় সকলে ধরা দিল। সকলের হাতেই হাতকড়ি পড়িল, কেহ একটিও কথা কহিতে সাহস করিল না। প্রতাপ তখন রঘুনাথের সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “রঘুনাথ! তুমি অনেকবার চেষ্টা ক’রে আমায় খুঁজে বার করতে পার নি, তাই আমি নিজে তোমার কাছে এসেছি।”
রঘুনাথ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি?”
প্রতাপ। গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল বা রায়মল্ল সাহেব, যা’ বললে তুমি সন্তুষ্ট হও।
রায়মল্ল। নাম শুনিয়া দস্যুগণ ভয়ে বিহ্বল হইয়া উঠিল।
রায়মল্ল গোয়েন্দা অনেক সময় অনেক কাজ করিয়াছেন, অনেক আশ্চর্য্য ঘটনা তাঁহার দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে। কোম্পানী বাহাদুর তন্নিবন্ধন তাঁহার সাহসিকতার শত শত প্রশংসা করিয়া থাকেন, আজ রায়মল্ল গোয়েন্দা যে কাৰ্য্য সম্পন্ন করিলেন, তাহা অন্য লোকের স্বপ্নের অগোচর কল্পনার সীমা বহির্ভূত। একজন নয়, দুইজন নয়, একেবারে দলকে দল বন্দী করা একটা কম আশ্চর্যের বিষয় নয়, কম শ্লাঘা বা কম বাহাদুরী নয়! যাহারা মৃত্যুর ভয় করে না, কথায় কথায় মানুষ খুন করা যাহাদের অভ্যাস, শত শত বিপত্তি যাহারা অবাধে অতিক্রম করে, সহস্র-প্রহরী পরিবেষ্টিত নগরের মধ্য হইতে যাহারা অবাধে ধনরত্ন লুণ্ঠন করে, মরণকে অম্লানবদনে যাহারা আলিঙ্গন করে, হাসতে হাসতে যাহারা যমরাজের সম্মুখীন হয়, একসঙ্গে তাহাদের সকলকে তর্জ্জনী হেলনে অবহেলায় বন্দী করা রায়মল্ল গোয়েন্দা ব্যতীত আর কাহার ক্ষমতা?