চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – আবার বিপদ
অজয় সিংহ চক্ষু চাহিয়াও সকল কথা যেন ঠিক বুঝিতে পারিতেছিলেন না। অবাক্ হইয়া চারিদিকে চাহিয়াছিলেন। তখনও যেন তাঁহার চারিদিক্ অন্ধকার, সব ধোঁয়ার ন্যায় বোধ হইতেছিল। তখনও তাঁহার নিজের অবস্থা ও পূর্ব্বাপর ঘটনা কিছুই স্মরণ হইতেছিল না;সহসা তাঁহার সে ঘোর কাটিয়া গেল। তিনি রায়মল্ল সাহেব ও তাঁহার অনুচরবর্গের কথা বুঝিতে পারিলেন। একে একে সমস্ত পূর্ব্বাপর ঘটনা স্মরণপথে উদিত হইল। তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন! কাঁদিতে কাঁদিতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “রায়মল্ল! তুমি এসেছ? আমার সর্বনাশ হয়েছে। তারাকে নিয়ে গেছে!”
রায়মল্ল সাহেব তাহা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে নিয়ে গেল?” অজয়। তা’ কি জানি, কিছুই বলতে পারি না। তাহারা কে, তাও জানি না। কোথায় কিছুই নাই, একেবারে ঘরের ভিতর দশ-বারজন লোক এসে ঢুকলো। সকলেই গুণ্ডা—ভয়ানক চেহারা! তুমি বারণ করেছিলে ব’লে আমি ত এখানে এসে অবধি একদিনও বাড়ীর বাহির হই নি। তাহারা ঘরের ভিতরে এসেই প্রথমে তারাকে জাপটে ধরলে, তারা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আমি বাধা দেবার জন্য যেমন উঠে দাঁড়িয়েছি, এমনই একজন একখানা কি বিশ্রী চড়া গন্ধওয়ালা রুমাল আমার নাকের উপরে চেপে ধরলে। আমি টানাটানি করতে করতে সেই গন্ধে অজ্ঞান হ’য়ে পড়লেম;বড় নিদ্রাকর্ষণ হ’লে যে রকম শরীর অবসন্ন হয়, সেই রকম যেন ঘুমের ঘোরে আধা সচেতন, অধা অচেতন অবস্থায় আমি যেন অনুভব করলেম, অভাগিনী তারাকে তাহারা টানা-হেঁচড়া ক’রে নিয়ে চলে গেল। হায় হায়! কি হ’ল। আমার সর্বনাশ হ’ল! এত করে আমার তারা শেষে আবার দস্যুদের হাতে পড়ল। এতক্ষণ কি তাহারা তাকে জীবিত রেখেছে?
রায়মল্ল সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চলিয়া যাইতে যাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল কোথায়?” অজয়। কি জানি, মঙ্গল কোথায়? সে সন্ধ্যার পরে আমাদের জন্য খাবার কিনতে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। তারও কি হ’ল, কিছুই জানি না।
অজয় সিংহের কথা শেষ হইতে না হইতেই কোথা হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে মঙ্গল দৌড়িয়া আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল, “এই যে রায়মল্ল সাহেব, এই যে—আমাদের সর্বনাশ হয়েছে, তারাকে আবার ডাকাতে নিয়ে গেছে! আহা! বাছাকে এইবার কেটে ফেলবে গো! কেটে ফেলবে! বাবা রায়মল্ল সাহেব! কি হবে বাবা, কি হবে?”
বৃদ্ধ মঙ্গল হাঁপাইতে হাঁপাইতে, কাঁদিতে কাঁদিতে এই কয়টি কথা বলিয়া কম্পিত কলেবরে সেইখানে বসিয়া পড়িল।
রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিল, “আর আমার একটিও কথা কহিবার সময় নাই। আমাকে এখনই যেতে হবে। দস্যুরা তারাকে কোথায় নিয়ে গেছে, তাও আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি প্রাণ দিয়ে ও তারাকে উদ্ধার করে আনব! আপনারা এখানে থাকুন।”
এই পর্য্যন্ত বলিয়াই রায়মল্ল সাহেব উন্মত্তের ন্যায় ছুটিলেন। তাঁহার জীবনের যত ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে একদিনের জন্যও তিনি এরূপ উন্মত্তভাবে কোন কার্য্য করেন নাই। দৌড়িতে দৌড়িতে তিনি আপনার একজন অনুচরকে তাঁহার পশ্চাদগামী হইতে দেখিয়া বলিলেন, “কোন ভয় নাই, আমার জন্য কোন চিন্তা নাই, আমার সঙ্গে আসতে হবে না। যখন আমি মরিয়া হয়েছি, একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভয় করি না। তুমি এখনই কোতোয়ালীতে গিয়ে আমার নাম ক’রে আরও দশজন অস্ত্রধারী লোক নিয়ে আজ রাত্রিকার মত এ বাড়ীতে পাহারা দাও।”
দ্রুতপদবিক্ষেপে রায়মল্ল সাহেব প্রস্থান করিলেন। সকলে তাঁহার সেই ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল। অনেকক্ষণ কেহ কোন কথা কহিতে পারিল না। শেষে অজয় সিংহ মঙ্গলের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল! তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
মঙ্গল তখন কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল। সে ধীরে ধীরে উত্তর করিল “আমি আপনার খাবার আব্বার জন্য দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এমন সময়ে একজন লোক এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলে, তোমার নাম মঙ্গল? তুমি অজয় সিংহের বাড়ীতে থাক?” আমি বললেম, “হাঁ।” সে লোকটা বললে, “তবে তুমি শীগগীর এস।’ আমি তার কথা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘ব্যাপার কি বল।’ সে আমায় বলে, সে কথা বলার সময় নাই। রায়মল্ল সাহেব এই কাছেই একটা বাড়ীতে মর-মর অবস্থায় পড়ে আছেন। দেরী করলে তাঁকে জীবিত দেখতে পাবে না। তিনি তোমার হাতে তারার বিষয় আশয় সম্বন্ধে কি কাগজ-পত্র দিয়ে কতকগুলি কথা ব’লে যেতে চান্। তুমি আর দেরী ক’রো না, দৌড়ে এসে ঐ গাড়ীখানায় চড়ে ব’স। রায়মল্ল সাহেব মৃত-প্রায়—এই কথা শুনে আমি আর কিছুই ভাববার সময় পেলেম না। তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়ীতে চড়লেম। সে লোকটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীতে উঠে বস্ল। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে গাড়ী ছুটল। পথের মাঝখানে আর দু’জন লোক ছুটে এসে গাড়ীর দু’ধারে পা-দানীর উপরে উঠে দু’দিকের দরজা বন্ধ ক’রে দিলে। অমনই তৎক্ষণাৎ ভিতরে যে লোকটা ছিল, সে একখানা বড় চক্চকে ছুরি বার ক’রে আমায় দেখিয়ে বলে, ‘আমার নাম রঘু ডাকাত! কথা কইবি, কি চেঁচাবি ত, তোকে এখনই খুন ক’রে ফেলব।’ আমি কাজেকাজেই হতভম্বের মত ব’সে রইলেম।”
অজয় সিংহ বিস্মিত হইয়া ভীতচকিত নেত্রে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর! তার পর?”
মঙ্গল। তার পর সহর ছাড়িয়ে একটা পাড়াগাঁর মত জায়গায় আমায় নিয়ে গিয়ে একটা বাগান-বাড়ীতে তুলে।
অজয়। তার পর?
মঙ্গল। সেই বাড়ীতে একটা ঘরে আমায় পুরে চাবি দিয়ে তা’রা সবাই চলে গেল। প্রায় একঘণ্টা চেষ্টা ক’রে একটা জানালার গরাদ ভেঙে পালিয়ে আছি, এমন সময়ে পথে দেখলেম যে, লোকগুলো সেই গাড়ীতেই সেই রকম আবার কাকে নিয়ে তীরবেগে ছুট্ছে। তখনই আমার মনে কেমন সন্দেহ হ’ল। গাড়ীর পিছনে পিছনে আমিও ছুটলেম। বুড়ো মানুষ, পারব কেন? গাড়ীখানা অনেকটা এগিয়ে গেল, তবু আমি ছুট্তে ছাড়লেম না। খানিকদূর গিয়েই দেখি, সেই গাড়ীখানা একটা মস্ত বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খানিক বাদে দেখলেম, তা’রা একটি মেয়ে-মানুষকে ধরাধরি করে গাড়ী থেকে নামিয়ে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেল। আমার ঠিক যেন বোধ হ’ল, সে আর কেউ নয়, আমাদের তারাকেই তা’রা ঐ রকম করে, নিয়ে যাচ্ছে। একে আমি বুড়ো মানুষ, তাতে আবার তা’রা পালওয়ান গুণ্ডা, তাদের সঙ্গে কি করব? কিছু করতে গেলেই হয় ত তা’রা আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে। কাজেকাজেই আর ভরসা হ’ল না। রায়মল্ল সাহেবের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, এ বিপদে তিনি ভিন্ন আর কেউ রক্ষা করতে পারবেন না। যেমন এই কথা মনে উদয় হওয়া, অমনই কোতোয়ালীর দিকে দৌড়ালেম। সেখানে গিয়ে রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে না পেয়ে বরাবর এইখানে আছি। হায় হায়!—আমি যা ভেবেছি, তাই হ’ল! আমাদের তারাকে এতদিন পরে ডাকাতে খুন করলে—
বৃদ্ধ মঙ্গল এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া আর কোন কথা কহিতে পারিল না। অশ্রুধারায় তাহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইতে লাগিল।