ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – দুঃসংবাদ
রঘুনাথ একজন ভদ্র পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া কিছু কিছু শিক্ষা করিয়াছিল। বুঁদিগ্রামে তাঁহার পৈতৃক ভবন। বাল্যকালে সে তারার সহিত একসঙ্গে খেলা করিত। তাহার পর পিতৃমাতৃহীন হইলে রঘুনাথের চরিত্র অপবিত্র ও কলঙ্কিত হইয়া যায়। অসৎসঙ্গে মিশিয়া ক্রমশই সে নররাক্ষস ভীষণ পিশাচবৎ হইয়া উঠে, এই সময়ে জগৎসিংহের সহিত তারার আলাপ হয়। জগৎসিংহ তারাকে বৰ্দ্ধমানে পাঠাইয়া এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিল। তৎপরে অজয় সিংহ যখন তারার স্বত্ব প্রমাণ করিবার জন্য আদালতে উপস্থিত হন, সেই সময়ে তারা কেমন করিয়া বর্দ্ধমান হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, তাহা জানিবার অভিলাষে জগৎসিংহ রঘু ডাকতকে নিযুক্ত করে। রঘুনাথ তৎপূর্ব্ব হইতেই তারাকে জানিত। তারা তাহার বাল্যকালের সাথী—অজয় সিংহের কন্যা, এই পর্যন্ত তাহার জানা ছিল। এই কথা কিন্তু রঘু ডাকাত জগৎসিংহকে একবারও বলে নাই।
জগৎসিংহ রঘু ডাকাতকে বিশ্বাস করিয়া সমস্ত গুপ্ত কাহিনী বিদিত করিয়াছিল। রঘু ডাকাতের সেই অবধি তারাকে হস্তগত করিবার লোভ জন্মে। তারাকে বিবাহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিতে পারিলে, সে যে সেই অতুল সম্পত্তির অধিকারী হইতে পারিবে, সে আশা কি সে সহজে বিসৰ্জ্জন দিতে পারে? তাই রঘুনাথ তারাকে বিবাহ করিতে এত ব্যগ্র হইয়াছিল।
লোভে পড়িয়া রঘুনাথ, জগৎসিংহের নিকট হইতে তাহার স্বত্ব প্রমাণার্থ যে সকল দলিল পত্র ছিল, তাহা নানাপ্রকার কলা-কৌশলে হস্তগত করিয়া লয়। জগৎসিংহও রঘুনাথের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝিতে না পারিয়া তাহার হস্তে সেই সকল কাগজ-পত্র রাখিতে কোন প্রকার সন্দেহ করে নাই। বরং সে ভাবিয়াছিল, যদি কোন দিন তারার স্বত্ব-সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া কোন প্রকার দলিল পাওয়া যায় কি না, দেখিবার জন্য কোম্পানীর লোকে তাহার বাড়ীতে খানা-তল্লাসী করে, তাহা হইলেই সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িবে। সুতরাং সে সকল দলিল-দস্তাবেজ হস্তান্তর করিয়া রাখিলে আর কোন ভয়ের কারণ থাকিবে না। এই ভাবিয়া সে রঘুনাথকে উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য পাত্রবোধে তাহার কাছেই সে সকল কাগজ-পত্র রাখিয়াছিল।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, রঘুনাথ যৎসামান্য লেখাপড়া জানিত। সে উক্ত কাগজ-পত্র পড়িয়া বুঝিয়াছিল, সেই সকল অকাট্য নিদর্শন বিচার-মন্দিরে একবার দেখাইতে পারিলেই তারা তাহার অপহৃত বিষয় সম্পত্তি সমস্তই পুনঃপ্রাপ্ত হইবে। তাই সে কন্টকে কন্টক উদ্ধার করিবার কল্পনা করিয়া সেই সকল দলিল-দস্তাবেজ এমন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল যে, অন্যলোকে অন্তর্যামী না হইলে আর তাহা বাহির করিবার সম্ভাবনা ছিল না। এক কথায় রঘুনাথ জগৎসিংহের অর্থ উদরসাৎ করিয়া তাহারই অনিষ্টসাধন করিতেছিল। একদিকে জগৎসিংহ তারাকে হস্তগত করিবার জন্য নানা উপায় উদ্ভাবন করিতেছিল, অন্যদিকে দস্যু-সর্দ্দার রঘুনাথ তারাকে পাইবার জন্য জাল বিস্তার করিয়া রাখিয়াছিল।
রায়মল্ল সাহেব তারাকে রাজেশ্বরী উপত্যকায় দস্যুকবল হইতে উদ্ধার করিয়া আনিয়া প্ৰথমে কোতোয়ালীর নিকটে একটি নির্জ্জন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন; তাহার পর অজয় সিংহকে বুঁদিগ্রাম হইতে আনাইয়া তিনি একটি ছোট-খাট বাড়ী ভাড়া করেন।
সে বাড়ীটির চতুর্দ্দিকে উদ্যান। লোকালয় হইতে কিছুদূরে ইহা অবস্থিত। রায়মল্ল সাহেব প্রথমে মনে করিয়াছিলেন, কেহ এতদূর অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করিতে পারিবে না।
তিনি এই বাটীতে অজয় সিংহ, তারা ও মঙ্গলকে পুলিশের লোকের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত করেন। প্রতিদিন একবার কি দুইবার করিয়া তিনি তাহাদিগকে দেখিতে আসিতেন; কিন্তু বড় আশা করিয়াছিলেন যে, অতি শীঘ্রই অভাগিনী তারার সমস্ত অপহৃত অর্থ পুনরায় সে প্রাপ্ত হইবে; কিন্তু তিনি তথায় যাইয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার হৃদয় বড় বিচলিত হইল। তিনি দেখিলেন, বাড়ীর দরজার সম্মুখেই সিঁড়ীর নীচে মুখ-হাত-পা বাঁধা পুলিশের লোক— তাঁহারই ছদ্মবেশী অনুচরদ্বয় অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের বন্ধনমোচন করিয়া মুখে জল দিলেন। তাহাদের জ্ঞান হইলে তিনি আর কোন কথা না কহিয়াই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, একটি ঘরে মেঝের উপরে অচেতন অবস্থায় অজয় সিংহ পড়িয়া রহিয়াছেন।
ধীরে ধীরে তাহার জ্ঞান সঞ্চার হইতেছে দেখিয়া তিনি কথঞ্চিৎ শান্ত হইলেন। তাঁহার অনুচরদ্বয় তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?”
একজন উত্তর দিল, “আমরা যেমন প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি, সেই রকমই দাঁড়িয়ে ছিলাম। সর্দ্দার খেতে গিয়েছিল। আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখের দুটো-একটা কথা কইছি, এমন সময়ে হঠাৎ কে যেন পিছন দিক্ থেকে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরলে। সেই কাপড়ে একটা চড়া গন্ধ ছিল। সেই গন্ধে অজ্ঞান হ’য়ে পড়লেন। তার পর কি হ’ল কিছুই জানি না।”
রায়মল্ল সাহেব অপর অনুচরকে জিজ্ঞাসা করিলে সে-ও তাহাই বলিল। সুতরাং তিনি স্থির করিয়া লইলেন যে, অন্ততঃ দুইজন লোক দুইজনকে এক সময়ে আক্রমণ করিয়াছিল এবং অজ্ঞানকার আরক দ্বারা এক সময়ের মধ্যে দুইজনকেই অচৈতন্য করিয়া ফেলিয়াছিল।