মুখে যাহাই বলুন
মুখে যাহাই বলুন, সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মির্জা দাউদের অন্তর হইতে দূর হইল না। তিনি ফিরিঙ্গীকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন—মূরমাত্রেই চিনিত। স্বদেশে বহু সংঘর্ষের ভিতর দিয়া এই পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইয়াছিল। তাহারা জানিত যে, ফিরিঙ্গী অতিশয় অর্থলিঙ্গু ও ভোগালুব্ধ। ইহাদের জন্মভূমি অর্থপ্ৰসূ নহে; তাই অন্নের জন্য ইহাদিগকে দৈহিক ও মানসিক কঠোরতার মধ্যে জীবনযাপন করিতে হয় বটে, কিন্তু এই জন্যই ইহারা অপেক্ষাকৃত ধনী মুসলমানদিগকে অত্যন্ত ঈষা করে। পরের উন্নতি ইহাদের চক্ষুশূল। কোথাও একবার ধনরত্ন-ঐশ্বর্যের সন্ধান পাইলে ইহাদের লালসা ও ক্ষুধা এত উগ্র, নির্মম হইয়া উঠে যে, কোনও মতে সেখানে প্রবেশ লাভ করিয়া নিজেকে একবার ভালরূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিলে শত্রুমিত্ৰনির্বিচারে সকলের উপর দুর্কিনীত বাহুবল, স্পধর্ম ও জুলুম প্রকাশ করিতে থাকে। ইহারা নিরতিশয় কলহপ্রিয় ও যুদ্ধনিপুণ। স্বার্থরক্ষার জন্য এমন কাজ নাই যাহা ইহারা পারে না এবং স্বজাতির স্বার্থবির্ধনের জন্য প্ৰাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করিতে ইহারা তিলমাত্র কুণ্ঠিত নহে।
পোর্তুগাল হইতে সমুদ্রপথে আফ্রিকা প্ৰদক্ষিণ করিয়া আজ পর্যন্ত কেহ ভারতবর্ষে আসে নাই, এ পথ। এতদিন অজ্ঞাত ছিল। ভাস্কো-ডা-গামা সেই পথ ইউরোপীয়দের জন্য উন্মুক্ত করিয়া দিয়া বহু নৃতন সম্ভাবনা ও দুভাবনার সৃষ্টি করিল। সম্প্রতি ভাস্কো-ডা-গামার উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ভাবে বুঝা যায় না। অথচ উদ্ধত ও কটুভাষী পেড্রোর কণ্ঠরোধ করিয়া সে যে একটা গূঢ় অভিপ্রায় গোপন করিয়া গেল, তাহাও বুঝিতে মির্জা দাউদের বিলম্ব হইল না। শঙ্কা ও সংশয়ের মেঘে তাঁহার মন আচ্ছন্ন হইয়া রহিল।
পোর্তুগীজগণ কালিকটে বাস করিতে লাগিল এবং দিন দিন নূতন পণ্যে তরণী পূর্ণ করিতে লাগিল। অতি অপদার্থ পণ্য দ্বিগুণ চতুগুণ মূল্য দিয়া কিনিতে লাগিল। ইহাতে নির্বোধ ব্যবসায়ীরা যতই উৎফুল্ল হউন না কেন, মির্জা দাউদের ন্যায় বহুদশী শ্রেষ্ঠীদের মনে সন্দেহ ততই ঘনীভূত হইয়া উঠিল। উচিত মূল্যের অধিক মূল্য দিয়া পণ্য ক্রয় করা ব্যবসায়ীর স্বভাব নহে, অথচ নবাগতরা অব্যবসায়ী বা নির্বোধ নহে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য ছলমাত্র, অন্য কোনও দুরভিসন্ধি তাহাদের অন্তরে প্রচ্ছন্ন আছে, ইহা অনুমান করিয়া বিচক্ষণ ব্যবসায়ীদের চিন্তা ও উৎকণ্ঠার অবধি রহিল না।
এইরূপে কিছুকাল বিগত হইল। কালিকটের জীবনপ্রবাহ পূর্ববৎ প্রশান্তভাবে চলিতে লাগিল।
একদিন শরৎকালে মেঘমার্জিত আকাশে শুভ্ৰ পাল উড়াইয়া দুইটি জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে নগরে রাষ্ট্র হইয়া গেল যে, বঙ্গদেশ হইতে প্রভাকর শ্রেষ্ঠীর নৌকা আসিতেছে। প্রভাকর শেঠ অতি প্ৰসিদ্ধ বণিক—প্রতি বৎসর এই সময় লক্ষাধিক মুদ্রার বস্ত্ৰাদি পণ্য বহন করিয়া তাহার তরণী কলিকটে উপস্থিত হয়। কাশ্মীরের শাল, বারাণসীর চেলি, কৌশেয় পট্ট, বাংলার মলমল কিনিবার জন্য কলিকটে সওদাগর সমাজে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যায়। এত সুন্দর এবং এত মূল্যবান বস্ত্ৰ কেহই আনিতে পারে না, সেজন্য প্রভাকরের এত খ্যাতি।
প্রভাকরের নৌকা ঘাটে লাগিবীর পূর্বেই নগরের বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঘাটে সমবেত হইয়াছিলেন। প্রভাকর নৌকার উপর দাঁড়াইয়া পরিচিত সকলকে নমস্কার-সম্ভাষণাদি করিতে লাগিল। সে অতিশয় বাকপটু ও রহস্যপ্রিয়, এজন্য সকলেই তাহাকে ভালবাসিত।
হিব্রু মুশা ইব্রাহিম তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘প্রভাকর, এবার তোমার দেরি দেখিয়া আমরা ভাবিয়ছিলাম, বুঝি আর আসিলে না—পথে তোমাদের সুন্দরবনের কুমীর তোমাকে পেটে পুরিয়াছে।’
প্রভাকর হাসিয়া বলিল, “মুশা সাহেব, পেটে পুরিলেও কুমীর আমাকে হজম করিতে পারিত না!—এই যে মির্জা সাহেব! আদাব আদাব—শরীর-গতিক সব ভালো তো? এবার আপনার ফরমাশী জিনিস সমস্ত আনিয়াছি, কত লইতে পারেন দেখিব। আপনার কোমরে তলোয়ারখানি নূতন দেখিতেছি, ডামাস্কাসের বুঝি? আমার কিন্তু এক জোড়া চাই—গৌড়েশ্বরের কাছে বাক্যদত্ত হইয়া আছি। ভালো কথা, পথে আসিতে শ্ৰীখণ্ডের নিকট আপনার যবদ্বীপ-যাত্রী জাহাজের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল—খবর সব ভালো। —হায়দর মুস্তফা যে, ইতিমধ্যে কয়টি সাদি করিলেন? এবার কিন্তু ইস্পাহানী আঙ্গুরের রস না খাওয়াইলে বড়ই অন্যায় হইবে। —জাম্বো, শাঁখালুর মতো দাঁত বাহির করিয়া হাসিস না—দড়িটা ধর।”
নৌকা বাঁধা হইলে প্রভাকর ঘাটে নামিয়া সকলের সহিত আলিঙ্গনাদি করিল। তখন মিজা দাউদ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘প্রভাকর, কি কি সওদা আনিলে?”
প্রভাকর বলিল, ‘এবার যে মলমল আনিয়াছি, মিজা সাহেব, তেমন মলমল আজ পর্যন্ত কখনও চোখে দেখেন নাই। মাকড়শার জালের চেয়েও নরম, কাশফুলের চেয়েও হালকা-মুঠির মধ্যে দেড়শ গজ কাপড় ধরা যায়। কিন্তু এক থান কাপড়ের দাম পাঁচ তোলা সোনা, তার কমে দিতে পারিব না। কোচিনে চার তোলা পর্যন্ত দিতে চাহিয়াছিল—আমি লই নাই! শেষে কি লোকসান দিয়া ঘরে ফিরিব। শেঠনী তাহা হইলে আমার মুখ দেখিবে না।’
মির্জা দাউদ হাসিয়া বলিলেন, “তা না দেখুক। তোমার মুখ না দেখিলেও শেঠনীর কোনও লোকসান হইবে না। —এখন তোমার সওদা দেখাও।”
প্রভাকর বলিল, “বলেন কি মিজা সাহেব, লোকসান হইবে না? শেঠনীর এখন যৌবনকাল, কাঁচা বয়স; এখন স্বামীর মুখদর্শন না করিলে জীবন-যৌবন সমস্তই লোকসান হইয়া যাইবে যে!—ভালো কথা, গতবারে শুনিয়াছিলাম, আপনার বিবি-সাহেবা নাকি অসুস্থ। তা কোনও শুভ সংবাদ আছে নাকি?”
মির্জা দাউদ বলিলেন, “খোদার দয়ায় একটি মেয়ে হইয়াছে।–”
প্রভাকর বলিল, “এত বড় আনন্দের সংবাদ এতক্ষণ চাপিয়া রাখিয়াছিলেন! আমাদের দেশে বলে, মেয়ে হইলে পিতার পরমায়ু বৃদ্ধি হয়। তাহা হইলে আজ রাত্রে আপনার দৌলতখানায় আমার নিমন্ত্রণ রহিল। দেশে কুকুটাদি ভোজনের সুবিধা হয় না—দুপ্রাপ্যও বটে, আর ব্ৰাহ্মণগুলো বড়ই গণ্ডগোল করে। —ও বাবা! এটি আবার কে, মিজা সাহেব? এ রকম পোশাক-পরিচ্ছদ তো কখনও দেখি নাই। ইহারা কোথা হইতে আসিল?”
মির্জা দাউদ ফিরিয়া দেখিলেন, ভাস্কো-ডা-গামা দুই জন সহচর সঙ্গে সেই দিকে আসিতেছে। ইতিমধ্যে কালিকটের পথে-ঘাটে দুই জনের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটিয়াছিল বটে, কিন্তু কোন পক্ষেই সৌহাদ্য বর্ধনের আগ্রহ দেখা যায় নাই। বরঞ্চ উভয়ে উভয়কে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিয়াছেন।
প্রভাকরের প্রশ্নের উত্তরে মির্জা দাউদ কহিলেন, “ইহারা পোর্তুগীজ। ক্রমে পরিচয় পাইবে।”
ইত্যবসরে প্রভাকরের নৌকা হইতে পণ্যসামগ্ৰী সকল পরিদর্শনের জন্য ঘাটে নামানো হইতেছিল। সওদাগরেরা ভিড় করিয়া তাহাঁই দেখিতেছিলেন। মির্জা দাউদও সেই সঙ্গে যোগ দিলেন। অন্য দিক হইতে ভাস্কো-ডা-গামাও আসিয়া মিলিত হইল।
মলমলের নমুনা দেখিয়া মির্জা দাউদ কহিলেন, “অতি উৎকৃষ্ট মলমল। প্রভাকর, এ জিনিস কত আনিয়াছ?”
প্রভাকর সগর্বে বলিল, “পুরা এক জাহাজ।”
দাউদ কহিলেন, “ভালো, আমি এক জাহাজই লইলাম। দর-দামের কথা আজ রাত্রে স্থির হইবে।”
ভাস্কো-ডা-গামা এরূপ অপূর্ব সূক্ষ্ম মলমল পূর্বে কখনও দেখে নাই। বস্তুত, এত মহার্ঘ মলমল পারস্য দেশ ভিন্ন অন্য কোথাও যাইত না। পোর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি পাশ্চাত্যদেশে যাহা যাইত, তাহা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট শ্রেণীর মলমল। ডা-গামার অন্তর লুব্ধ হইয়া উঠিল। পোপ এবং রাজা ইমানুয়েলকে নজর দিতে হইলে ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু আর কি আছে? সে বলিল, “এ মলমল আমি কিনিব।”
মির্জা দাউদ হাসিয়া বলিলেন, “আর উপায় নাই। এই মলমল আমি কিনিয়াছি।”
ডা-গামা প্রভাকরের দিকে ফিরিয়া বলিল, “আমি অধিক মূল্য দিব।”
মির্জা দাউদ কহিলেন, “অধিক মূল্য দিলেও পাইবে না—এ মলমল এখন আমার।”
ডা-গামা সেদিকে কৰ্ণপাত না করিয়া প্রভাকরকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আমি দ্বিগুণ মূল্য দিব।”
মির্জা দাউদ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “শতগুণ দিলেও আর পাইবে না।”
ডা-গামা বিদ্যুদবেগে মির্জা দাউদের দিকে ফিরিল। কৰ্কশকণ্ঠে কহিল, “মূর, চুপ করু—আমি মালের মালিকের সহিত কথা কহিতেছি।”
প্রভাকর বুদ্ধিমান, মির্জা দাউদ তাহার পুরাতন খরিদার, অথচ এই ব্যক্তিকে সে চেনেও না। সে বলিল, ‘উনিই এখন মালের মালিক, আমি কেহ নই। উনি যদি আপনাকে বিক্রয় করিতে ইচ্ছা করেন, করিতে পারেন।’
ডা-গামার অশিষ্ট কথায় কিন্তু মির্জা দাউদের মুখ ক্ৰোধে কৃষ্ণবর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি তিক্তকণ্ঠে কহিলেন, “ডা-গামা, পূর্বেও বুঝিয়ছিলাম, কিন্তু আজ তোর প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়িল। ব্যবসায় তোর ভান মাত্র, তুই তস্কর। নচেৎ অনুচিত মূল্য দিয়া বাণিজ্য নষ্ট করিবি কেন?”
আহত বাঘ্রের মতো গর্জন করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা নিজ কটি হইতে তরবারি বাহির করিল। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া ক্ৰোধকষায়িত নেত্ৰে কহিল, ‘স্পর্ধিত মূর, আজ তোর রক্তে তরবারির কলঙ্ক ধৌত করিব।’
মির্জা দাউদও তরবারি নিষ্কোষিত করিয়া কহিলেন, ‘বর্বর ফিরিঙ্গী, আজ তোকে জাহান্নমে পাঠাইব।’
মুহূৰ্তমধ্যে ব্যগ্ৰ জনতা চতুর্দিকে সরিয়া গিয়া মধ্যে বৃত্তাকৃতি স্থান যুযুৎসুদের জন্য ছাড়িয়া দিল। শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্ৰ হইলেও এরূপ ব্যাপার কালিকটে একান্ত বিরল নহে। কলহ যখন তরবারি পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তাহা ভঞ্জন করিবার প্রয়াস যে শুধু নিশ্বফল নহে, অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাহা কাহারও অবিদিত ছিল না। তাই সকলে সরিয়া দাঁড়াইয়া অস্ত্রদ্বারা উভয়পক্ষকে বিবাদের মীমাংসা করিবার সুবিধা করিয়া দিল।
ভাস্কো-ডা-গামা ও মির্জা দাউদ প্রথম দৃষ্টি-বিনিময়েই পরস্পরকে যে বিষদৃষ্টিতে দেখিয়াছিলেন, সেই বিষ উভয়ের অন্তরে সঞ্চিত হইয়া আজ সামান্য সূত্র ধরিয়া দুৰ্নিবার বিরোধরাপে আত্মপ্রকাশ করিল। এ কলহ যে একজন না মরিলে নিবৃত্ত হইবে না, তাহা উভয়েই মনে মনে বুঝিলেন।
নিস্তব্ধ জনতার কেন্দ্ৰস্থলে অসিধারী দুই জন দাঁড়াইলেন। ভাস্কো-ডা-গামা বিশালকায়, প্রস্তরের মতো কঠিন, হস্তীর মতো বলশালী। মির্জা দাউদ অপেক্ষাকৃত কৃশ ও খর্ব; কিন্তু বিষধর কালসৰ্পের মতো ক্ষিপ্র, তেজস্বী ও প্রাণসার। ভাস্কো-ডা-গামার তরবারি বেত্ৰবৎ ঋজু, তীক্ষাগ্র; মির্জা দাউদের তরবারি ঈষৎ বক্র ও ক্ষুরধার। নগ্ন কৃপাণহস্তে ক্ষণকালের জন্য দুই জন পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিয়া লইলেন। তারপর ঝড়ের মতো তরবারিকে অগ্রবর্তী করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা আক্রমণ করিল।
কিন্তু ডা-গামার তরবারি মির্জা দাউদের অঙ্গ স্পর্শ করিবার পূর্বেই তিনি ক্ষিপ্ৰহস্তে নিজ তরবারি দ্বারা তাহা অপসারিত করিয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং পরীক্ষণেই তাঁহার বক্র অসি বিদ্যুতের মতো একবার ডা-গামার জানু দংশন করিয়া ফিরিয়া আসিল। ডা-গামা পিছু হটিয়া আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। তাহার জানুর চর্মাবরণ ধীরে ধীরে রক্তে ভিজিয়া উঠিল।
ডা-গামা সেদিকে ভ্ৰক্ষেপ করিল না; কিন্তু সাবধান হইল। সংযত ও সতর্কভাবে অসিচালনা করিতে লাগিল। সে বুঝিল যে, বিপক্ষকে অবজ্ঞা করিলে চলিবে না। মির্জা দাউদের অসি-কৌশল অসাধারণ, তাঁহার সম্মুখে দ্বিতীয়বার ভুল করিলে আর তাহা সংশোধনের অবকাশ থাকিবে না।
এদিকে মির্জা দাউদও বুঝিলেন যে, ডা-গামা অসি-কৌশলে তাঁহার সমতুল্য, কিন্তু তাঁহার অপেক্ষা দ্বিগুণ বলশালী। আবার সে তাঁহার মতো ক্ষিপ্রগামী ও লঘুদেহ নয় বটে, কিন্তু তরবারি ঋজু এবং দীর্ঘ—মির্জা দাউদের তরবারি বক্র এবং খর্ব। তাঁহাদের যুদ্ধরীতিও সম্পূর্ণ পৃথক। এ ক্ষেত্রে, মির্জা দাউদ দেখিলেন, ডা-গামার জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। মির্জা দাউদ অত্যন্ত সাবধানে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।
সর্প ও নকুলের যুদ্ধে যেমন উভয়ে উভয়ের চক্ষুতে চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া পরস্পরকে প্ৰদক্ষিণ করিতে থাকে এবং সুযোগ পাইবামাত্র তীরবেগে আক্রমণ করিয়া আবার স্বস্থানে ফিরিয়া আসে, ডা-গামা ও মির্জা দাউদও সেইরূপে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। অস্ত্ৰে অস্ত্রে প্রতিরুদ্ধ হইয়া মুহুর্মুহুঃ ঝনৎকার উঠিতে লাগিল, চঞ্চল অসিফলকে সূর্যকিরণ পড়িয়া তড়িৎরেখার মতো জুলিয়া উঠিতে লাগিল। নিস্পন্দ জনৰ্বাহ সহস্ৰচক্ষু হইয়া এই অদ্ভুত যুদ্ধ দেখিতে লাগিল।
যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে মির্জা দাউদ বাক্যশূলে ডা-গামাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন, ‘ফিরিঙ্গী দাসুন্টু, চাহিয়া দেখ, তোর রক্ত মানুষের রক্তের মতো লাল নয়, শয়তানের মতো নীল! খ্রীস্টান কুত্তা, এখনও ক্ষমা প্রার্থনা কর—তোর প্রাণ ভিক্ষা দিব।”
ডা-গামা কোনও উত্তর না দিয়া নিঃশব্দে যুদ্ধ করিতে লাগিল। শ্লেষ করিয়া মির্জা দাউদ যে তাহার ধৈর্যচুতি ঘটাইবার চেষ্টা করিতেছেন, চতুর ডা-গামা তাহা বুঝিয়েছিল।
যুদ্ধ ক্ৰমে আরও প্রখর ও তীব্ৰ হইয়া উঠিল। দুই যোদ্ধারই ঘন ঘন শ্বাস বহিল। সবাঙ্গে ঘাম ঝরিতে লাগিল; কিন্তু উভয়েই যেন এক অদৃশ্য বর্মে আচ্ছাদিত। ডা-গামার তরবারি বার বার মির্জা দাউদের কণ্ঠের নিকট হইতে, বক্ষের নিকট হইতে ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া গেল, মিজা দাউদের অসি ডা-গামাকে ঘিরিয়া এক ঝাঁক ক্রুদ্ধ মৌমাছির মতো গুঞ্জন করিয়া ফিরিতে লাগিল, কিন্তু কোথাও হুল ফুটাইতে পারিল না।
সহসা এক সময় ডা-গামা সভয়ে দেখিল যে, সে ঘুরিতে ঘুরিতে একেবারে ঘাটের কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, আর এক পা পিছাইলেই সমুদ্রের জলে পড়িয়া যাইবে। মির্জা দাউদ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। বিদ্রুপ-বিষাক্ত কণ্ঠে কহিলেন, “ফিরিঙ্গী, আজ তোকে ঐ সমুদ্রের জলে চুবাইব। তারপর মরা ইদুরের মতো তোর রাজা ইম্যানুয়েলের কাছে তোকে বিকশিশ পাঠাইয়া দিব।”
এতক্ষণে মির্জা দাউদ যাহা চাহিতেছিলেন তাহাই হইল-ভাস্কো-ডা-গামা ধৈর্য হরাইল। উন্মত্ত বন্যামহিষের মতো গর্জন করিয়া অসি উর্ধের্ব উত্তোলন করিয়া সে মির্জা দাউদকে আক্রমণ করিল। ইচ্ছা করিলে মির্জা দাউদ অনায়াসে ডা-গামাকে বধ করিতে পারিতেন; কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি তরবারির উল্টা পিঠ দিয়া ডা-গামার দক্ষিণ মুষ্টিতে দারুণ আঘাত করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাহার তরবারি হস্তমুক্ত হইয়া উর্ধের্ব উৎক্ষিপ্ত হইয়া দূরে গিয়া পড়িল। অকস্মাৎ অস্ত্ৰহীন হইয়া ডা-গামা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
ডা-গামার দুই জন সহচর। এতক্ষণ সকলের সঙ্গে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ দেখিতেছিল। প্রভুর অপ্রত্যাশিত বিপৎপাতে তাহারা সাহায্য করিতে অগ্রসর হইল। কিন্তু দুই পদ অগ্রসর হইবার পূর্বেই, অতি বিশাল-কলেবর নিকষকৃষ্ণ হাবসী জাম্বো মাস্তুলের ন্যায় দুই হস্ত বাহির করিয়া তাহাদের কেশ ধরিয়া ফিরাইয়া আনিল এবং নিরতিশয় শুভ্ৰ দুইপাটি দন্ত বিনিফ্ৰান্ত করিয়া যাহা বলিল, তাহার একটি বর্ণও তাহারা বুঝিতে না পারিলেও জাম্বোর মনোগত অভিপ্ৰায় অনুধাবন করিতে তাহাদের বিন্দুমাত্র ক্লেশ হইল না।
মির্জা দাউদ তরবারির ধার ডা-গামার কণ্ঠে স্থাপন করিয়া কহিলেন, “ডা-গামা, নতজানু হ, নহিলে তোকে বধ করিব।”
ডা-গামা নতজানু হইল না—বাহুদ্বয়ে বক্ষ নিবদ্ধ করিয়া বিকৃতমুখে হাস্য করিয়া কহিল, “মূর, নিরস্ত্ৰকে হত্যা করা তোদের স্বভাব বটে।”
মির্জা দাউদ কিয়াৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “ভালো, তোকে ছাড়িয়া দিব—কিন্তু প্ৰতিজ্ঞা কর্–’
ডা-গামা কহিল, “আমি কোনও প্রতিজ্ঞা করিব না, তোর যাহা ইচ্ছা কর।”
মির্জা দাউদ বলিলেন, “শপথ করা যে, আজ হইতে সপ্তাহমধ্যে সদলবলে এ দেশ ছাড়িয়া যাইবি, আর কখনও ফিরিবি না।”
ডা-গামা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, কহিল, “মূর, তুই অতি নির্বোধ! আমি শপথ করিব না, আমাকে বধ কর। আমার রক্তে কলিকটের মাটি ভিজিলে হিন্দে ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজা সহজে রোপিত হইবে।”
মির্জা দাউদ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘এতদিনে নিজ মুখে নিজের অভিপ্ৰায় ব্যক্তি করিলি! কিন্তু তাহা হইতে দিব না। ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজ কালিকটে রোপিত হইবে না। কালিকট চিরদিন পৃথিবীর সমস্ত জাতির মিলনক্ষেত্ৰ হইয়া থাকিবে। প্রতিজ্ঞা কর, নচেৎ——
ডা-গামা ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, নচেৎ?
“নচেৎ পোর্তুগালে ফিরিয়া যাইতে একটি প্রাণীও জীবিত রাখিব না। তোদের জাহাজ পুড়াইয়া এই একশত ত্ৰিশ জন লোককে কাটিয়া সমুদ্রের জলে ভাসাইয়া দিব।”
ডা-গামা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কোনও উত্তর দিল না।
মির্জা দাউদ পুনশ্চ কহিলেন, “ডা-গামা, এখনও শপথ করা—তোর ধর্মের উপর বিশ্বাস করিয়া ছাড়িয়া দিব। —ভাবিয়া দেখ, তোরা মরিলে কে তোর দেশবাসী ভিক্ষুকদের পথ দেখাইয়া লইয়া আসিবে?”
ডা-গামা অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “শপথ করিতেছি—”
মির্জা দাউদ কহিলেন, “তোদের যেশুর জননী মেরীর নামে শপথ কর।”
ডা-গামা তখন কম্পিত ক্ৰোধ-জর্জরিত কণ্ঠে শপথ করিল যে, সপ্তাহমধ্যে এদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং আর কখনও ভারতভুমির উপর পদার্পণ করিবে না।
ডা-গামাকে ছাড়িয়া দিয়া মির্জা দাউদ ও আরও প্রধান প্রধান নাগরিকগণ সামরীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সমস্ত বিবরণ আদ্যোপান্ত শুনিয়া সামরী কহিলেন, “যত দিন উহারা আমার রাজ্যের কোনও প্রকাশ্য অনিষ্ট না করিতেছে, ততদিন শুধু সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি উহাদিগকে রাজ্য হইতে বিতাড়িত করিতে পারি না। তবে কেহ যদি তোমাদের ব্যক্তিগত অনিষ্ট করিয়া থাকে, তোমরা প্ৰতিশোধ লইতে পার, আমি বাধা দিব না।”
সকলে সামরীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন যে, ইহারা অত্যন্ত কূটবুদ্ধি ও যুদ্ধনিপুণ, তাহাদের কামান, বন্দুক, গোলাগুলি আছে; সুযোগ পাইলেই তাহারা বাহুবলে এই সোনার রাজ্য অপূর্ব অমরাবতী গ্ৰাস করিবে।
সামরী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমার সৈন্যবল নাই সত্য, কিন্তু সামরীবংশ পঞ্চদশ শতাব্দী ধরিয়া এই মসলিন্দে রাজত্ব করিতেছে—কেহ তাহাকে রাজ্যভ্ৰষ্ট করে নাই। আমার সিংহাসন সুশাসন ও জনপ্রিয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত। উহারা আমার কি করিতে পারে?”
সকলে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া গেলেন।
সপ্তাহ পরে স্বর্ণপত্রে লিখিত সামারীর সন্ধি লিপি মস্তকে ধারণা করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা অনুচরসহ জাহাজে উঠিল।
মির্জা দাউদ বন্দর হইতে ডাকিয়া বলিলেন, “ডা-গামা, শপথ স্মরণ রাখিও।”
একটা ক্রুর হাস্য ডা-গামার মুখের উপর খেলিয়া গেল, মির্জা দাউদের প্রতি স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া সে বলিল, “মির্জা দাউদ, আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।”
মির্জা দাউদ হাসিয়া উত্তর দিলেন, “সম্ভব নয়। আমি মুসলমান—বেহেস্তে যাইব।”
ডা-গামা দুই চক্ষুতে অগ্নিবর্ষণ করিয়া কহিল, “ইহজন্মেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।”
তারপর ধীরে ধীরে তাহার তিনটি জাহাজ বন্দরের বাহির হইয়া গেল।