Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রক্তের দাগ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 7

রক্তের দাগ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

হাওড়া স্টেশনের কাজ সারিয়া যখন ফিরিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। সদর দরজা ভেজানো ছিল‌, প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ঊষাপতিবাবু চলিয়া গিয়াছেন‌, ছায়াচ্ছন্ন ঘরের অপর প্রান্তে জানালার সামনে চেয়ার টানিয়া সত্যবতী ও ব্যোমকেশ ঘেঁষাঘেঁধি বসিয়া আছে। জানালা দিয়া ফুরফুরে দক্ষিণা বাতাস আসিতেছে। আমাকে দেখিয়া সত্যবতী একটু সরিয়া বসিল।

আমি কাছে আসিয়া বলিলাম‌, ‘বেশ তো কপোত-কপোতীর মত বসে মলয় মারুত সেবন করছ।–খোকা কোথায়?’

সত্যবতী একটু লজ্জিত হইয়া বলিল‌, ‘পুঁটিরাম খোকাকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দেখ অজিত‌, কবিদের কথা মিছে নয়। তাঁরা যে বসন্তঋতুর সমাগমে ক্ষেপে ওঠেন‌, তার যথেষ্ট কারণ আছে। মলয় মারুতে যুবক যুবতীরাই বেশি ঘায়েল হয় বটে কিন্তু বয়স্থ ব্যক্তিরাও বাদ পড়েন না। আমার বিশ্বাস‌, এটা যদি বসন্তকাল না হত তাহলে ঊষাপতিবাবু সত্যকামকে খুন করতেন কিনা সন্দেহ।’

বলিলাম‌, ‘বল কি! বসন্তকালের এমন মারাত্মক শক্তির কথা কবিরা তো কিছু লেখেননি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পষ্ট না লিখলেও ইশারায় বলেছেন। শক্তিমাত্রেই মারাত্মক; যে আগুন আলো দেয় সেই আগুনই পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে।–কিন্তু যাক‌, কাশ্মীরের খবর কী বল।’

বলিলাম‌, ‘কাশ্মীরে লড়াই বেধেছে‌, সাধারণ লোককে যেতে দিচ্ছে না। যেতে হলে ভারত সরকারের পারমিট চাই।’

আমি একটা চেয়ার আনিয়া ব্যোমকেশের অন্য পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পারমিট যোগাড় করা শক্ত হবে না। ভারত সরকারের সঙ্গে এখন আমার গভীর প্রণয়‌, অন্তত যতদিন বল্লভভাই প্যাটেল বেঁচে আছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে‌, সবাই মিলে কাশ্মীর যাওয়া কি ঠিক হবে? খোকা সবেমাত্র স্কুলে ঢুকেছে‌, গরমের ছুটিরও দেরি আছে। ওকে স্কুল কামাই করিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার উচিত মনে হচ্ছে না।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘খোকা যাবে কেন? খোকা বাড়িতে থাকবে। ঠাকুরপো‌, তুমি খোকার দেখাশুনা করতে পারবে না?

আমি কিছুক্ষণ সত্যবতীর পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলাম‌, ‘ও—এই মতলব। তোমরা দু’টিতে হংস-মিথুনের মত কাশ্মীরে উড়ে যাবে‌, আর আমি খোকাকে নিয়ে বাসায় পড়ে–থাকব। ভাই ব্যোমকেশ‌, তুমি ঠিক বলেছ‌, বসন্তঋতু বড় মারাত্মক ঋতু। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। যাও তোমরা টো টো করে বেড়াও গে‌, আমি খোকাকে নিয়ে মনের আনন্দে থাকব। সত্যি কথা বলতে কি‌, কাশ্মীর যাবার ইচ্ছে আমার একটুও ছিল না। বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বৰ্গ-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ বলিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া ফেলিলাম।

সত্যবতী ঠোঁটের উপর আঁচল চাপা দিয়া হাসি গোপন করিল। ব্যোমকেশ মৃদু গুঞ্জনে কবিতা আবৃত্তি করিল‌, ‘যৌবন মধুর কাল‌, আও বিনাশিবে কাল‌, কালে পিও প্ৰেম-মধু করিয়া যতন। —একটা সিগারেট দাও।’

সিগারেট দিয়া বলিলাম‌, ‘কবিতা পড়ে পড়ে তোমার চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু ও-কথা এখন থাক‌, ঊষাপতি যে নিজের চরিতামৃত শুনিয়ে গেলেন তা বলতে বাধা আছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছুমাত্র না। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম। তোমাদের দু’জনকেই শোনাতে চাই। বড় মর্মান্তিক কাহিনী।’

সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল—

‘সত্যকাম আমার কাছে এসেছিল এক আশ্চর্য প্রস্তাব নিয়ে—আমার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয় আপনি অনুসন্ধান করবেন। সে জানত কে তাকে খুন করতে চায়‌, কিন্তু তার নাম আমাকে বলল না। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জাগল–নাম বলতে চায় না কেন? এখন জানতে পেরেছি‌, নাম না বলার গুরুতর কারণ ছিল‌, পারিবারিক কেচ্ছা বেরিয়ে পড়ত। সে যে জারজ‌, তার মা যে কলঙ্কিনী‌, এ-কথা সে প্রকাশ করতে পারেনি; নিজের মুখে নিজের কলঙ্ক-কথা কটা লোক প্রকাশ করতে পারে? সবাই তো আর সত্যযুগের সত্যকাম নয়।

‘তবু একটা ইঙ্গিত সে আমাকে দিয়ে গিয়েছিল—তার জন্ম-তারিখ। কিন্তু এমনভাবে দিয়েছিল যে‌, একবারও সন্দেহ হয়নি তার জন্ম-তারিখের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু-রহস্যের চাবি আছে। সে জানত‌, আমি যদি অনুসন্ধান আরম্ভ করি তাহলে জন্ম-তারিখটা আমার কাজে লাগবে। সত্যকাম বিবেকহীন লম্পট ছিল‌, কিন্তু তার বুদ্ধির অভাব ছিল না।

‘এবার গোড়া থেকে গল্পটা বলি। সত্যকমের জন্মের আগে থেকে সে-গল্পের সূত্রপাত। ঊষাপতিবাবুর মুখেই এ-গল্পের বেশির ভাগ শুনেছি‌, তবু গল্পটা যে সত্যি তাতে সন্দেহ নেই। তিনি নিজেকে রেয়াত করেননি‌, নিজের দোষ দুর্বলতা অকপটে ব্যক্ত করেছেন।

‘বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রমাকান্ত চৌধুরী সুচিত্রা এম্পেরিয়মের প্রতিষ্ঠা করেন। রমাকান্ত চৌধুরীর একমাত্র মেয়ের নাম সুচিত্রা‌, মেয়ের নামেই দোকানের নাম। চৌধুরী মশায় ভারী চতুর ব্যবসাদার ছিলেন‌, দু-চার বছরের মধ্যেই তাঁর দোকান ফেঁপে উঠল। ধর্মতলায় নতুন বাড়ি তৈরি হল‌, জমজমাট ব্যাপার। চৌধুরী মশায়ের সুচিত্রা এম্পেরিয়ম বিলাতি দোকানের সঙ্গে টেক্কা দিতে লাগল।

‘ঊষাপতি দাস ১৯২৫ সনে সামান্য শপ-অ্যাসিসট্যান্টের চাকরি নিয়ে সুচিত্রা এম্পেরিয়মে ঢোকেন। তখন তাঁর বয়স একুশ বাইশ; গরীবের ঘরের বাপ-মা-মরা ছেলে‌, লেখাপড়া বেশি শেখেননি। কিন্তু চেহারা ভাল‌, বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। দু-চার দিনের মধ্যেই তিনি দোকানের মাল বিক্রি করার কায়দাকানুন শিখে নিলেন‌, খদ্দেরকে কী করে খুশি রাখতে হয় তার কৌশল আয়ত্ত করে ফেললেন। সহকর্মীদের মধ্যে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। ক্রমে স্বয়ং কর্তার সুনজর পড়ল তাঁর ওপর। দু-চার টাকা করে মাইনে বাড়তে লাগল।

‘দু-বছর কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন ঊষাপতিবাবুর চরম ভাগ্যোদয় হল। রমাকান্ত চৌধুরী তাঁকে নিজের অফিস-ঘরে ডেকে বললেন‌, ‘তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই।’ এ-প্রস্তাব ঊষাপতির কল্পনার অতীত‌, তিনি যেন চাঁদ হাতে পেলেন। সেই যে রূপকথা আছে‌, পথের ভিখিরির সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ে‌, এ যেন তাই। সুচিত্রাকে ঊষাপতি আগে অনেকবার দেখেছেন‌, সুচিত্রা প্রায়ই দোকানে আসতেন। ভারী মিষ্টি নরম চেহারা। ঊষাপতির মন রোমান্সের গন্ধে ভরে উঠল।

‘মাসখানেকের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। খুব ধুমধাম হল। ঊষাপতির সহকর্মীরা প্ৰীতি-উপহার ছেপে বন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন। ঊষাপতিবাবু এতদিন তাঁর বিবাহিতা বোনের বাড়িতে থাকতেন‌, এখন শ্বশুরবাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ি। রমাকান্ত চৌধুরী বড়মানুষ‌, তায় বিপত্নীক; তিনি মেয়েকে কাছ-ছাড়া করতে চান না।

‘টোপের মধ্যে বঁড়শি আছে। ঊষাপতি তা টের পেলেন ফুলশয্যার রাত্রে। রূপকথার স্বপ্ন-ইমারত ভেঙে পড়ল; বুঝতে পারলেন সুচিত্রা এম্পেরিয়মের কর্তা কেন দীনদরিদ্র কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফুলের বিছানায় শয়ন করা হল না‌, ঊষাপতিবাবু সারা রাত্রি একটা চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলেন। সকালবেলা শ্বশুরকে গিয়ে বললেন-আপনার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে‌, এবার আমাকে বিদায় দিন।

‘রম্যাকান্ত চৌধুরী ঘাড়েল ব্যবসাদার‌, তিনি বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন; মোলায়েম সুরে জামাইকে বোঝাতে আরম্ভ করলেন-সুচিত্রা ছেলেমানুষ‌, মা-মরা মেয়ে; তার ওপর আজকাল দেশে যে হাওয়া বইতে শুরু করেছে তাতে মেয়েদের সামলে রাখাই দায়। সুচিত্রা খুবই ভাল মেয়ে‌, কেবল বর্তমান আবহাওয়ার দোষে একটু ভুল করে ফেলেছে। আজকাল ঘরে ঘরে এই ব্যাপার হচ্ছে‌, ঠগ বাছতে গাঁ উজোড়‌, কিন্তু বাইরের লোক কি জানতে পারে? সবাই বৌ নিয়ে মনের সুখ ঘরকন্না করে। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে নিজের মুখেই চুন-কালি পড়বে। অতএব—

‘ঊষাপতি কিন্তু কথায় ভুললেন না‌, বললেন‌, ‘আমায় মাপ করুন‌, আমি গরীব বটে। কিন্তু সদ্‌বংশের ছেলে। আমি পারব না।’

‘কথায় চিড়ে ভিজল না দেখে রমাকান্ত চৌধুরী ব্বহ্মাস্ত্র ছাড়লেন। দেরাজ থেকে ইস্টাম্বরি কাগজে লেখা দলিল বার করে বললেন‌, ‘আজ থেকে সুচিত্রা এম্পেরিয়মের তুমি আট আনা অংশীদার। এই দেখ দলিল। আমি মরে গেলে আমার যা কিছু সব তোমরাই পাবে‌, আমার তো আর কেউ নেই। কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার পার্টনার হলে। দোকানে আমার হুকুম যেমন চলে তোমার হুকুমও তেমনি চলবে।’

‘ঊষাপতির মাথা ঘুরে গেল। রাজকন্যাটি দাগী বটে। কিন্তু হাতে হাতে অর্ধেক রাজত্ব। মোট কথা ঊষাপতি শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেলেন‌, সদ্য সদ্য অত টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকতে রাজী হলেন। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক রইল না। সেই যে ফুলশয্যার রাত্রে দু-চারটে কথা হয়েছিল‌, তারপর থেকে কথা বন্ধ; শোবার ব্যবস্থাও আলাদা। বাইরের লোকে অবশ্য কিছু জানল না‌, ধোঁকার টাটি বজায় রইল।

‘রমাকান্ত যে বলেছিলেন সুচিত্রা ভাল মেয়ে‌, সে-কথা নেহাত মিথ্যে নয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাঁধন ভাঙার একটা ঢেউ এসেছিল‌, উচ্চবিত্ত সমাজের অবাধ মেলা-মেশা সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুচিত্ৰা আলোর নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে একটু বেশি মাতামতি করেছিলেন। অভিভাবিকার অভাবে গণ্ডীর বাইরে যে পা দিচ্ছেন তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে তাঁর হুঁশ হল। বিয়ের পর তিনি বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন‌, শান্ত সংযতভাবে বাড়িতে রইলেন। রমাকান্তের বাড়িতে লোক কম‌, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই‌, কেবল রমাকান্ত‌, সুচিত্রা আর ঊষাপতি। স্থায়ী চাকরের মধ্যে সহদেব‌, আর বাকী বিপ্ন-চাকর শুকো। সহদেব চাকরিটার বুদ্ধিসুদ্ধি বেশি নেই‌, কিন্তু অটল তার প্রভু-পরিবারের প্রতি ভক্তি। তাই ঘরের কথা বাইরে চাউর হতে পেল না।

‘বিয়ের মাস দেড়েক পরে রমাকান্ত মেয়েকে নিয়ে বিলেত গেলেন। ওজুহাত দেখালেন‌, মেয়ের শরীর খারাপ‌, তাই চিকিৎসার জন্যে বিলেতে নিয়ে যাচ্ছেন। ঊষাপতি দোকানের সর্বময় কর্তা হয়ে কাজ চালাতে লাগলেন।

‘প্রায় এক বছর পরে রমাকান্ত বিলেত থেকে ফিরলেন। সুচিত্রার কোলে ছেলে। ছেলে দেখে বোঝা যায় না। তার বয়স দু-মাস কি পাঁচ মাস…

‘তারপর আমহার্স্ট স্ত্রীটের বাড়িতে ঊষাপতিবাবুর নীরস প্রাণহীন জীবনযাত্রা আরম্ভ হল। স্ত্রীর সঙ্গে সম্বন্ধ নেই‌, শ্বশুরের সঙ্গে কাজের সম্বন্ধ। দোকানটিকে ঊষাপতি প্ৰাণ দিয়ে ভালবাসলেন। তবু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? অন্তরের মধ্যে ক্ষুধিত যৌবন হাহাকার করতে লাগল। ওদিকে সুচিত্রা সঙ্কুচিত হয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে সংহরণ করে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে ঊষাপতি তাঁকে দেখতে পান‌, মনে হয় সুচিত্রা যেন কঠোর তপস্বিনী। তাঁর মনটা কোমল হয়ে আসে‌, তিনি জোর করে নিজেকে শক্ত রাখেন।

‘একটি একটি করে বছর কাটতে থাকে। সত্যকাম বড় হয়ে উঠতে লাগল। লম্পট বাপের উচ্ছৃঙ্খল রক্ত তার শরীরে‌, তার যত বয়স বাড়তে লাগল রক্তের দাগও তত ফুটে উঠতে লাগল। সব রকম রক্তের দাগ মুছে যায়‌, এ-রক্তের দাগ কখনও মোছে না। সত্যকাম কারুর শাসন মানে না‌, নিজের যা ইচ্ছে তাই করে; কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত সে‌, কুটিল তার বুদ্ধি। দাদামশায়কে সে এমন বশ করেছে যে সব জেনেশুনেও তিনি কিছু বলতে পারেন না। সুচিত্রা শাসন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ঊষাপতি সত্যকমের কোনও কথায় থাকেন না‌, সব সময় নিজেকে আলাদা করে রাখেন…স্ত্রীর কানীন পুত্রকে কোনও পুরুষই স্নেহের চক্ষে দেখতে পারে না। সত্যকামের স্বভাব চরিত্র যদি ভাল হত তাহলে ঊষাপতি হয়তো তাকে সহ্য করতে পারতেন‌, কিন্তু এখন তাঁর মন একেবারে বিষিয়ে গেল। সুচিত্রার সঙ্গে ঊষাপতির একটা ব্যবহারিকশ সংযোগের যদি বা কোনও সম্ভাবনা থাকত তা একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। ঊষাপতি আর সুচিত্রার মাঝখানে সত্যকাম ফণি-মনসার কাঁটা-বেড়ার মত দাঁড়িয়ে রইল।

‘সত্যকামের যখন উনিশ বছর বয়স‌, তখন রমাকান্ত মারা গেলেন‌, সত্যকামকে নিজের অংশ উইল করে দিয়ে গেলেন। এই সময় সত্যকাম নিজের জন্ম-রহস্য জানতে পারল। বিলেতে তার জন্ম হয়েছিল‌, সুতরাং বার্থ-সার্টিফিকেট ছিল। দাদামশায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সেই বাৰ্থ-সার্টিফিকেট বোধহয় সে পেয়েছিল‌, তারপর পারিবারিক পরিস্থিতি দেখে আসল ব্যাপার বুঝে নিয়েছিল। সে বাইরে ভারী কেতাদুরস্ত ছেলে‌, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ কুটিল আর হিংসুক। ঊষাপতি আর সুচিত্রার প্রতি তার ব্যবহার হিংস্র হয়ে উঠল। একদিন সে নিজের মাকে স্পষ্টই বলল‌, ‘তুমি আমাকে শাসন করতে আস কোন লজ্জায়! আমি সব জানি।’ ঊষাপতিকে বলল‌, ‘আপনি আমার বাপ নন‌, আপনাকে খাতির করব কিসের জন্যে?’

‘বাড়িতে ঊষাপতি আর সুচিত্রার জীবন দুৰ্বহ হয়ে উঠল। ওদিকে দোকানে গিয়ে সত্যকাম আর-একরকম খেলা দেখাতে আরম্ভ করল। সে এখন দোকানের অংশীদার‌, ঊষাপতির সঙ্গে তার অধিকার সমান। সে নিজের অধিকার পুরোদস্তুর জারি করতে শুরু করল। সুচিত্রার মত শৌখিন দোকানে পুরুষের চেয়ে মেয়ে খদ্দেরেরই ভিড় বেশি; সত্যকাম তাদের মধ্যে থেকে কমবয়সী সুন্দর মেয়ে বেছে নিত, তাদের সঙ্গে ভাব করত, দোকানের দামী জিনিস সস্তায় তাদের বিক্রি করত‌, হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়াত। দোকানের তহবিল থেকে যখন যত টাকা ইচ্ছে বার করে দু-হাতে ওড়াত। মদ‌, ঘোড়দৌড়‌, বড় বড় ক্লাবে গিয়ে জুয়া খেলা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবসা হয়ে উঠল।

‘রমাকান্তর মৃত্যুর পর বছরখানেক যেতে না যেতেই দেখা গেল দোকানের অবস্থা খারাপ হয়ে আসছে‌, আর বেশি দিন এভাবে চলবে না। ঊষাপতিবাবু বাধা দিতে গেলে সত্যকাম বলে‌, ‘আমার টাকা আমি ওড়াচ্ছি‌, আপনার কী?’ উপরন্তু দোকানের একটা বদনাম রটে গেল‌, মেয়েদের ও-দোকানে যাওয়া নিরাপদ নয়। খদ্দের কমে যেতে লাগল। বিভ্রান্ত ঊষাপতিবাবু কী করবেন ভেবে পেলেন না।

‘পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে‌, তখন একটি ব্যাপার ঘটল। একদিন সন্ধ্যার পর কী একটা কাজে ঊষাপতি বাড়িতে এসেছেন‌, ওপরে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেলেন পাশের ঘর থেকে একটা অবরুদ্ধ কাতরানি আসছে। পাশের ঘরটা তাঁর স্ত্রীর ঘর। পা টিপে টিপে ঊষাপতি দোরের কাছে গেলেন। দেখলেন‌, তাঁর স্ত্রী একলা মেঝেয় মাথা কুটছেন। আর বলছেন‌, ‘এখনো কি আমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়নি? আর যে আমি পারি না?’

‘ঊষাপতি চুপি চুপি নীচে নেমে গেলেন। সহদেবকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন‌, সন্ধ্যার আগে পাড়ার একটি বর্ষীয়সী ভদ্রমহিলা এসেছিলেন‌, তিনি সুচিত্রাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে গেছেন। মহিলাটির মেয়েকে নাকি সত্যকাম সিনেমা দেখাচ্ছে আর বিলিতি হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াচ্ছে।

‘সেই দিন ঊষাপতি সংকল্প করলেন‌, সত্যকামকে সরাতে হবে। তাকে খুন না করলে কোনও দিক দিয়েই নিস্তার নেই। এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

‘ঊষাপতি তৈরি হলেন। তাঁর একটা সুবিধে ছিল‌, সত্যকাম যদি খুন হয় তাঁকে কেউ সন্দেহ করবে না। বাইরে সবাই জানে সত্যকাম তাঁর ছেলে‌, বাপ ছেলেকে খুন করেছে। এ-কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সত্যকমের অনেক শত্ৰু‌, সন্দেহটা তাদের উপর পড়বে। তবু এমনভাবে কাজ করা দরকার‌, যাতে কোনও মতেই তাঁর পানে দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়।

‘ঊষাপতি একটি চমৎকার মতলব বার করলেন। একজন চেনা গুণ্ডার কাছ থেকে একটি রিভলভার যোগাড় করলেন। ছেলেবেলায় কিছুদিন তিনি সস্ত্ৰাসবাদীদের দলে মিশেছিলেন‌, রিভলভার চালানোর অভ্যাস ছিল; তিনি কয়েকবার বেলঘরিয়ার একটা আম-বাগানে গিয়ে অভ্যাসটা ঝালিয়ে নিলেন। তারপর সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

‘সত্যকাম ঝানু ছেলে‌, সে ঊষাপতির মতলব বুঝতে পারল; কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার কোনও উপায় খুঁজে পেল না। পুলিসের কাছে গেলে নিজের জন্ম-রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে হতাশ হয়ে আমার কাছে এসেছিল। ঊষাপতিবাবু অবশ্য সে-খবর জানতেন না।

‘যে-রাত্রে সত্যকাম খুন হয়‌, সে-রাত্রিটা ছিল শনিবার। শনিবারে সত্যকাম অন্য রাত্রির চেয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে‌, সুতরাং শনিবারই প্রশস্ত। ঊষাপতিবাবু একটি রাংতার চাকতি তৈরি করে রেখেছিলেন; রাত্রি সাড়ে দশটার সময় যখন সহদেব রান্নাঘরে খেতে গিয়েছে‌, তখন তিনি চুপি চুপি নেমে এসে সেটি দরজার কপাটে জুড়ে দিয়ে আবার নিঃশব্দে উপরে উঠে গেলেন। সদর দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি বন্ধ রইল‌, বাহিরে যে রাংতার চাকতি সাঁটা হয়েছে তা কেউ জানতে পারল না। শুকো ঝি আর রাঁধুনি তার অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে।

‘সহদেব খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খিড়কির দরজায় তালা লাগাল‌, তারপর সদর বারান্দায় গিয়ে বিছানা পেতে শুল। ওপরে ঊষাপতিবাবু নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে অপেক্ষা করে রইলেন, সামনের দিকের ব্যালকনির দরজা খুলে রাখলেন।

‘দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ফটকের কাছে শব্দ হল‌, সত্যকাম আসছে। ঊষাপতি ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে ঘাপটি মেরে রইলেন। ফটিক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত রাস্তা অন্ধকার‌, সত্যকাম টর্চ জ্বেলে দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছে। সদর দরজায় টোকা মেরে হঠাৎ তার নজরে পড়ল দরজার নীচের দিকে টাকার মত একটা চাকতি টর্চের আলোয় চকচক করছে। সে সামনের দিকে ঝুকে সেটা দেখতে গেল। অমনি ঊষাপতিবাবু ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে গুলি করলেন। রিভলভারের গুলি সত্যকামের পিঠ ফুটো করে বুকের হাড়ে গিয়ে আটকাল। সত্যকাম সেইখানেই মুখ থুবড়ে পড়ল‌, হাতের জ্বলন্ত টর্চটা জ্বলতেই রইল।

‘এই হল সত্যকমের মৃত্যুর প্রকৃত ইতিহাস। ঊষাপতিবাবু এমন কৌশল করেছিলেন যে‌, লাশ পরীক্ষা করে মনে হবে পিছন দিক থেকে কেউ তাকে গুলি করেছে‌, ওপর দিক থেকে গুলি করা হয়েছে তা কিছুতেই বোঝা যাবে না। রাংতার চাকতিটা যদি না থাকত আমিও বুঝতে পারতাম না।’

ব্যোমকেশ চুপ করিল। আমরাও অনেকক্ষণ নীরব রহিলাম। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সত্যবতী বলিল‌, ‘তুমি প্রথম কখন ঊষাপতিবাবুকে সন্দেহ করলে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল‌, বাড়ির লোকের কাজ। যদি বাইরের লোকের কাজ হবে‌, তাহলে সত্যকাম হত্যাকারীর নাম বলবে না কেন? তখনই আমার মনে হয়েছিল। এই সংকল্পিত হত্যার পিছনে এক অতি গুহ্য পারিবারিক কলঙ্ক-কাহিনী লুকিয়ে আছে।

‘তারপর জানতে পারলাম, ঊষাপতি আর সুচিত্রার দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক নয়। দীর্ঘকাল ধরে তাঁদের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ‌, শোবার ঘরও আলাদা। মনে খটকা লাগল। খাজাঞ্চি মশায়ের সঙ্গে আলাপ জমালাম। লোকটি ঊষাপতিবাবুর দরদী বন্ধু; তিনিই একুশ বছর আগে বন্ধুর বিয়েতে প্রীতি-উপহার লিখেছিলেন। প্ৰীতি-উপহারটি খাজাঞ্চি মশাই খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন‌, কারণ এটি তাঁর প্রথম এবং একমাত্র কবি-কীর্তি। আমি যখন প্রীতি-উপহারটি হাতে পেলাম‌, তখন আর কোনও সংশয় রইল না। সত্যকমের জন্ম-তারিখ মনে ছিল-৭ই জুলাই‌, ১৯২৭)। আর বিয়ের তারিখ ১৩ই ফেব্রুয়ারি‌, ১৯২৭। অর্থাৎ বিয়ের পর পাঁচ পাস পূর্ণ হবার আগেই ছেলে হয়েছে। ধূর্ত রমাকান্ত কেন দরিদ্র কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বুঝতে কষ্ট হয় না।

‘সত্যকাম ঊষাপতির ছেলে নয়‌, সুতরাং তাকে খুন করার পক্ষে ঊষাপতির কোনও বাধা নেই। কিন্তু তিনি খুন করলেন কী করে? যখন জানতে পারলাম মৃত্যুকালে সত্যকামের হাতে জ্বলন্ত টর্চ ছিল‌, তখন এক মুহুর্তে রাংতার চাকতির উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল। সত্যকমের টর্চের আলো দোরের ওপর পড়েছিল‌, রাংতার চাকতিটা চকমক করে উঠেছিল‌, সত্যকাম সামনে ঝুঁকে দেখতে গিয়েছিল ওটা কি চকমক করছে। ব্যস—!’

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। আমি ব্যোমকেশকে সিগারেট দিয়া নিজে একটা লইলাম‌, দু’জনে টানিতে লাগিলাম। ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে‌, দখিনা বাতাস চুপি চুপি আমাদের ঘিরিয়া খেলা করিতেছে।

হঠাৎ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ ঊষাপতিবাবু যাবার সময় আমার হাত ধরে বললেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমি আর আমার স্ত্রী জীবনে বড় দুঃখ পেয়েছি‌, একুশ বছর ধরে শ্মশানে বাস করেছি। আজ আমরা অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে চাই‌, একটু সুখী হতে চাই। আপনি আর জল ঘোলা করবেন না।’ আমি ঊষাপতিবাবুকে কথা দিয়েছি‌, জল ঘোলা করব না। কাজটা হয়তো আইনসঙ্গত হচ্ছে না। কিন্তু আইনের চেয়েও বড় জিনিস আছে–ন্যায়ধর্ম। তোমাদের কী মনে হয়? আমি অন্যায় করেছি?’

সত্যবতী ও আমি সমস্বরে বলিলাম‌, ‘না।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress