রক্তের টান
প্রতিমা ও পরিতোষ দুই ভাই বোন। প্রতিমা নামে যেমন রূপেও তেমন। বিধাতা পুরুষ যেন তার অবসর সময় ওকে তৈরি করেছেন । পরিতোষ বড়, প্রতিমা ছোট। বাবা প্রসূন একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মা অপলা খুব যত্ন করে বাচ্চাদের তৈরি করছেন।
প্রতিমা লেখাপড়ায় একদম ভালো না। পরিতোষ খুব ভালো ছিল। সংসারের টানাটানি থাকলেও তা প্রসূন ও অপলা সন্তানদের বুঝতে দিতেন না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভাই বোনের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হতে থাকে।
পরিতোষ বোনকে খুব ভালোবাসতো। ওদের বাবার বয়স হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ধকল তিনি আর নিতে পারছিলেন না। পরিতোষ খুব চেষ্টা করত একটা চাকরির। পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশন করে নিজের পড়াশুনা ও বোনের সব রকম চাহিদা মেটাবার চেষ্টা করত। প্রতিমা লেখাপড়ায় ভালো না হলেও গানটা খুব ভালো গাইত। সে দুই একটা গানের টিউশনি করে মায়ের চাহিদা ও দাদার পছন্দের জিনিস উপহার দেওয়ার চেষ্টা করত। মোটামুটি বলা যায় পারিবারিক বন্ধন খুব অটুট ছিল চরম অর্থাভাবের মধ্যেও।
কোন এক গানের বাড়িতে টিউশন করতে গিয়ে ছাত্রীর কাকার প্রেমে পড়ল প্রতিমা। ওই বাড়ির অবস্থাও বেশ। পাত্র অঞ্জন একটা সরকারি চাকরিও করে। মোটামুটি ভাবে বলা যায় যে পাত্র সুপাত্র । কিন্তু অঞ্জনের পারিবারিক ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়, এটা প্রতিমা জানতো। এটাও জানতো ওদের বাড়িতে জানাজানি হলে কেউ এটা মেনে নেবে না।তা সত্ত্বেও ওরা সম্পর্কে জড়ায়। এক সময় ওরা সিদ্ধান্ত নেয় যে পালিয়ে বিয়ে করবে, করেও তাই।
প্রতিমার এই সিদ্ধান্ত ওদের পরিবারে এক বিরাট ধাক্কা দেয়। ওর বাবার স্ট্রোক করে যায়, ওর মা একদম ভেঙ্গে পড়েন। পরিতোষ অতি কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিতে থাকে। সে নিজেও মুখ বুজে একা গুমড়ে কাঁদতে থাকে, বোনকে যে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো।
এদিকে প্রতিমার জীবনও খুব সুখেই কাটছিল। কিন্তু যখন তার পরিবারের কথা মনে পড়তো তখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যেত। অঞ্জন চেষ্টা করতে স্ত্রীকে ভালো রাখার। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রতিমার সন্তান হল । তখনো প্রতিমার পরিবার থেকে তেমন কোনো সাড়া পায়নি ওরা। এদিকে পরিতোষও একটি সরকারি চাকরি পেল, বিয়ে করল। তখনো পরিবার প্রতিমাকে কাছে টানেনি। একসময় ওদের বাবা গত হলেন। খবর পেতেই প্রতিমা ছুটে এল। ওদের মা প্রতিমাকে কোনরকম দোষারোপও করলেন না আবার কাছেও টেনে নিলেন না।
এরপর মা গত হলেন। প্রতিমা শেষ সুত্রটাও হারিয়ে ফেলল। পরিতোষ কিন্তু মনে মনে বোনকে ভীষণ চাইতো। পরিতোষের বিয়ে হল,একটা ছেলে হল প্রতিমাকে ছাড়াই।পরিতোষ কিন্তু কোনদিন ভাগনার প্রতি কর্তব্যের অভাব রাখেনি, যদিও তার বউ এটা মেনে নিতে পারত না। ওদিকে প্রতিমাও ভাইপোর প্রতি কর্তব্য করতে চাইলে বৌদি মানছে না দেখে সে লুকিয়ে সব কর্তব্য করত। এই ভাবেই ভাই বোনের দিন কাটছিল।
সময়ের ধারা আপন গতিপথে চলছে। ভাইবোনও জীবনের মধ্য গগনে। তাদের যে গভীর ভালোবাসা সেটা কিন্তু অনেকেই বুঝতো।
একবার পরিতোষের দুর্ঘটনা ঘটলো। প্রচুর রক্তক্ষরণ হল। রক্তের প্রয়োজন। সেই সময় আবার জুনিয়র ডাক্তারদের স্ট্রাইক চলছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় অচল। খবর শোনা মাত্র প্রতিমা ছুটে এলো হাসপাতালে। ব্লাড টেস্ট হলো। দুই ভাই বোনেরই গ্রুপ এক। দাদাকে বাঁচাতে রক্ত দিল প্রতিমা।
বাড়িতে ফিরে এসে শুধু দাদার কথাই ভাবছিল। হঠাৎ কি হল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল স্বামী ও সন্তান। ততক্ষণে প্রতিমা শেষ। পরিতোষের কানে আসে সে কথা। ডাক্তাররা তাকে উঠতে বারণ করেন। সব বারণ অগ্রাহ্য করে ছুটে আসে বোনের নিথর দেহটার কাছে। সে জানত কয়েকদিন আগে বোন রক্ত দিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বোনের নিথর দেহটাকে ধরে ঝাঁকাতে থাকে পরিতোষ। এক সময় তার কান্নাও থেমে যায়। পরিকে সামলাবার জন্য ওর পরিবারে এগিয়ে আসে। দেখে পরির দেহও নিথর। ওঠাতে গেলে দেখা যায় পরি ওর বোনের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। পাশ থেকে পাড়ার এক বয়স্ক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন,” তোরা ভাই বোন যেখানেই থাকিস এই ভাবে হাত ধরে থাকিস। এই বেইমান পৃথিবীতে তোদের ভাই-বোনকে এক হতে দিল না রে…”