Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

একদিন মধুসূদনকে সকলেই যেমন ভয় করত, শ্যামাসুন্দরীরও ভয় ছিল তেমনি। ভিতরে ভিতরে মধুসূদন তার দিকে কখনো কখনো যেন টলেছে, শ্যামাসুন্দরী তা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু কোন্ দিক দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে যে ওর কাছে যাওয়া যায় তা ঠাহর করতে পারত না। হাতড়ে হাতড়ে মাঝে মাঝে চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবার ফিরেছে ধাক্কা খেয়ে। মধুসূদন একনিষ্ঠ হয়ে ব্যাবসা গড়ে তুলছিল, কাঞ্চনের সাধনায় কামিনীকে সে অত্যন্তই তুচ্ছ করেছে, মেয়েরা সেইজন্যে ওকে অত্যন্তই ভয় করত। কিন্তু এই ভয়েরও একটা আকর্ষণ আছে। দুরু দুরু বক্ষ এবং সংকুচিত ব্যবহার নিয়েই শ্যামাসুন্দরী ঈষৎ একটা আবরণের আড়ালে মুগ্ধমনে মধুসূদনের কাছে কাছে ফিরেছে। এক-একবার যখন অসতর্ক অবস্থায় মধুসূদন ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিয়েছে সেই সময়েই যথার্থ ভয়ের কারণ ঘটেছে। তার অনতিপরেই কিছুদিন ধরে বিপরীত দিক থেকে মধুসূদন প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে ওর জীবনে মেয়েরা একেবারেই হেয়। তাই এতকাল শ্যামাসুন্দরী নিজেকে খুবই সংযত করে রেখেছিল।

মধুসূদনের বিয়ের পর থেকে সে আর থাকতে পারছিল না। কুমুকে মধুসূদন যদি অন্য সাধারণ মেয়ের মতোই অবজ্ঞা করত, তাহলে সেটা একরকম সহ্য হত। কিন্তু শ্যামা যখন দেখলে রাশ আলগা দিয়ে মধুসূদনও কোনো মেয়েকে নিয়ে অন্ধবেগে মেতে উঠতে পারে, তখন সংযম রক্ষা তার পক্ষে আর সহজ রইল না। এ-কয়দিন সাহস করে যখন-তখন একটু একটু এগিয়ে আসছিল, দেখেছিল এগিয়ে আসা চলে। মাঝে মাঝে অল্পসল্প বাধা পেয়েছে, কিন্তু সেও দেখলে কেটে যায়। মধুসূদনের দুর্বলতা ধরা পড়েছে, সেইজন্যেই শ্যামার নিজের মধ্যেও ধৈর্য বাঁধ মানতে আর পারে না। কুমু চলে আসবার আগের রাত্রে মধুসূদন শ্যামাকে যত কাছে টেনেছিল এমন তো আর কখনোই হয় নি। তার পরেই ওর ভয় হল পাছে উলটো ধাক্কাটা জোরে এসে লাগে। কিন্তু এটুকু শ্যামা বুঝে নিয়েছে যে, ভীরুতা যদি না করে তবে ভয়ের কারণ আপনি কেটে যাবে।

সকালেই মধুসূদন বেরিয়ে গিয়েছিল, বেলা একটা পেরিয়ে বাড়ি এসেছে। ইদানীং অনেক কাল ধরে ওর স্নানাহারের নিয়মের এমন ব্যতিক্রম ঘটে নি। আজ বড়োই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়িতে যেই এল, প্রথম কথাই মনে হল, কুমু তার দাদার ওখানে চলে গেছে এবং খুশি হয়েই চলে গেছে। এতকাল মধুসূদন আপনাতে আপনি খাড়া ছিল, কখন এক সময়ে ঢিল দিয়েছে, শরীরমনের আতুরতার সময় কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আশ্রয় করবার সুপ্ত ইচ্ছা ওর মনে উঠেছে জেগে, সেইজন্যেই অনায়াসে কুমুর চলে যাওয়াতে ওর এমন ধিক্‌কার লাগল। আজ ওর খাবার সময়ে শ্যামাসুন্দরী ইচ্ছে করেই কাছে এসে বসে নি; কী জানি কাল রাত্রে নিজেকে ধরা দেবার পরে মধুসূদন নিজের উপর পাছে বিরক্ত হয়ে থাকে। খাবার পর মধুসূদন শূন্য শোবার ঘরে এসে একটুখানি চুপ করে থাকল, তার পরে নিজেই শ্যামাকে ডেকে পাঠালে। শ্যামা লাল রঙের একটা বিলিতি শাল গায়ে দিয়ে যেন একটু সংকুচিতভাবে ঘরে ঢুকে এক ধারে নতনেত্রে দাঁড়িয়ে রইল। মধুসূদন ডাকলে, “এস, এইখানে এস, ব’সাে।”

শ্যামা শিয়রের কাছে বসে “তােমাকে যে বড়ো রোগা দেখাচ্ছে আজ” বলে একটু ঝুঁকে পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

মধুসূদন বললে, “আঃ, তােমার হাত বেশ ঠাণ্ডা।”

রাত্রে মধুসূদন যখন শুতে এল শ্যামসুন্দরী অনাহুত ঘরে ঢুকে বললে, “আহা, তুমি একলা।”

শ্যামাসুন্দরী একটু যেন স্পর্ধার সঙ্গেই কোনাে আর আবরণ রাখতে দিলে না। যেন অসংকোচে সবাইকে সাক্ষী রেখেই ও আপনার অধিকার, পাকা করে তুলতে চায়। সময় বেশি নেই, কবে আবার কুমু এসে পড়বে তার মধ্যে দখল সম্পূর্ণ হওয়া চাই। দখলটা প্রকাশ্য হলে তার জোর আছে, কোনােখানে লজ্জা রাখলে চলবে না। অবস্থাটা দেখতে দেখতে দাসীচাকরদের মধ্যেও জানাজানি হল। মধুসূদনের মনে বহুকালের প্রবৃত্তির আগুন যতবড়াে জোরে চাপা ছিল, ততবড়ো জোরেই তা অবারিত হল, কাউকে কেয়ার করলে না, মত্ততা খুব স্থূলভাবেই সংসারে প্রকাশ করে দিলে।

নবীন মােতির মা দুজনেই বুঝলে, এ-বান আর ঠেকানাে যাবে না।

“দিদিকে কি ডেকে আনবে না? আর কি দেরি করা ভালাে?”

“সেই কথাই তো ভাবছি। দাদার হুকুম নইলে তো উপায় নেই। দেখি চেষ্টা করে।”

যেদিন সকালে কৌশলে দাদার কাছে কথাটা পাড়বে বলে নবীন এল, দেখে যে দাদা বেরোবার জন্যে প্রস্তুত, দরজার কাছে গাড়ি তৈরি।

নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “কোথাও বেরোচ্ছ নাকি।”

মধুসূদন একটু সংকোচ কাটিয়ে বললে, “সেই গনৎকার বেঙ্কটস্বামীর কাছে।”

নবীনের কাছে দুর্বলতা চাপা রাখতেই চেয়েছিল। হঠাৎ মনে হল ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই সুবিধা হতে পারে। তাই বললে, “চলো আমার সঙ্গে।”

নবীন ভাবলে, সর্বনাশ। বললে, “দেখে আসি গে সে বাড়িতে আছে কি না। আমার তো বোধ হচ্ছে সে দেশে চলে গেছে, অন্তত সেইরকম তো কথা।”

মধুসূদন বললে, “তা বেশ তো, দেখে আসা যাক না।”

নবীন নিরুপায় হয়ে সঙ্গে চলল, কিন্তু মনে-মনে প্রমাদ গনলে।

গনৎকারের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই নবীন তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে একটু উঁকি মেরেই বললে, “বোধ হচ্ছে কেউ যেন বাড়িতে নেই।”

যেমন বলা, সেই মুহূর্তেই স্বয়ং বেঙ্কটস্বামী দাঁতন চিবোতে চিবোতে দরজার কাছে বেরিয়ে এল। নবীন দ্রুত তার গা ঘেঁষে প্রণাম করে বললে, “সাবধানে কথা কবেন।”

সেই এঁদো ঘরে তক্তপোশে সবাই বসল। নবীন বসল মধুসূদনের পিছনে। মধুসূদন কিছু বলবার আগেই নবীন বলে বসল, “মহারাজের সময় বড়ো খারাপ যাচ্ছে, কবে গ্রহশান্তি হবে বলে দাও শাস্ত্রীজি।”

মধুসূদন নবীনের এই ফাঁস-করে-দেওয়া প্রশ্নে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার উরুতে খুব একটা টিপনি দিলে।

বেঙ্কটস্বামী রাশিচক্র কেটে একেবারে স্পষ্টই দেখিয়ে দিলে মধুসূদনের ধনস্থানে শনির দৃষ্টি পড়েছে।

গ্রহের নাম জেনে মধুসূদনের কোনাে লাভ নেই, তার সঙ্গে বােঝাপড়া করা শক্ত। যে-যে মানুষ ওর সঙ্গে শত্রুতা করছে স্পষ্ট করে তাদেরই পরিচয় চাই, বর্ণমালার যে বর্গেই পড়ুক নাম বের করতে হবে। নবীনের মুশকিল এই যে, সে মধুসূদনের আপিসের ইতিবৃত্তান্ত কিছুই জানে না। ইশারাতেও সাহায্য খাটবে না। বেঙ্কটস্বামী মুগ্ধবােধের সূত্র আওড়ায় আর মধুসূদনের মুখের দিকে আড়ে আড়ে চায়। আজকের দিনের নামের বেলায় ভৃগুমুনি সম্পূর্ণ নীরব। হঠাৎ শাস্ত্রী বলে বসল, শত্রুতা করছে একজন স্ত্রীলােক।

নবীন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সেই স্ত্রীলােকটি যে শ্যামাসুন্দরী এইটে কোনােমতে খাড়া করতে পারলে আর ভাবনা নেই। মধুসূদন নাম চায়। শাস্ত্রী তখন বর্ণমালার বর্গ শুরু করলে। ‘ক’বর্গ শব্দটা বলে যেন অদৃশ্য ভৃগুমুনির দিকে কান পেতে রইল—কটাক্ষে দেখতে লাগল মধুসূদনের দিকে। ‘ক’বর্গ শুনেই মধুসূদনের মুখে ঈষৎ একটু চমক দিলে। ওদিকে পিছন থেকে ‘না’ সংকেত করে নবীন ডাইনে বাঁয়ে লাগাল ঘাড়-নাড়া। নবীনের জানাই নেই যে মাদ্রাজে এ-সংকেতের উলটো মানে। বেঙ্কটস্বামীর আর সন্দেহ রইল না—জোরগলায় বললে, ‘ক’বর্গ। মধুসূদনের মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিল ‘ক’বর্গের প্রথম বর্ণটাই। তাই কথাটাকে আরও একটু ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রী বললে, এই ‘ক’য়ের মধ্যেই মধুসূদনের সমস্ত কু।

এর পরে পুরাে নাম জানাবার জন্যে পীড়াপীড়ি না করে ব্যগ্র হয়ে মধুসুদন জিজ্ঞাসা করলে, “এর প্রতিকার?”

বেঙ্কটস্বামী গম্ভীরভাবে বলে দিলে, “কন্টকেনৈব কন্টকং—অর্থাৎ উদ্ধার করবে অন্য একজন স্ত্রীলোক।”

মধুসূদন চকিত হয়ে উঠল। বেঙ্কটস্বামী মানবচরিত্রবিদ্যার চর্চা করেছে।

নবীন অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, ঘোড়দৌড়ে মহারাজার ঘোড়াটা কি জিতেছে?”

বেঙ্কটস্বামী জানে অধিকাংশ ঘোড়াই জেতে না, একটু হিসাবের ভান করে বলে দিল, “লোকসান দেখতে পাচ্ছি।”

কিছুকাল আগেই মধুসূদনের ঘোড়া মস্ত জিত জিতেছে। মধুসূদনকে কোনো কথা বলার সময় না দিয়ে মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ করে নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, আমার কন্যাটার কী গতি হবে?” বলা বাহুল্য, নবীনেব কন্যা নেই।

বেঙ্কটমী নিশ্চয় ঠাওরালে পাত্র খুঁজছে। নবীনের চেহারা দেখেই বুঝলে, মেয়েটি অপ্সরা নয়। বলে দিলে, “পাত্র শীঘ্র মিলবে না, অনেক টাকা ব্যয় করতে হবে।”

মধুসূদনকে একটু অবসর না দিয়ে পরে পরে দশ-বারোটা অসংগত প্রশ্নের অদ্ভুত উত্তর বের করে নিয়ে নবীন বললে, “দাদা, আর কেন? এখন চলো।”

গাড়িতে উঠেই নবীন বলে উঠল, “দাদা, ওর সমস্ত চালাকি। ভণ্ড কোথাকার।”

“কিন্তু সেদিন যে—”

“সেদিন ও আগে থাকতে খবর নিয়েছিল।”

“কেমন করে জানলে যে আমি আসব?”

“আমারই বোকামি। ঘাট হয়েছে ওর কাছে তোমাকে এনেছিলুম।”

জ্যোতিষীর প্রতারণার প্রমাণ যতই পাক, ‘ক’বর্গের কু মধুসূদনের মনে বিঁধে রইল। ভেবে দেখলে যে, নক্ষত্র অনাদর ক’রে খুচরো প্রশ্নের যা-তা জবাব দেয়, কিন্তু আদত প্রশ্নের জবাবে ভুল হয় না। মধুসূদন যার প্রত্যাশাই করে নি সেই দুঃসময় ওর বিবাহের সঙ্গে সঙ্গেই এল। এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ কী হবে?

নবীন আস্তে আস্তে কথা পাড়ল, “দাদা, দুই সপ্তাহ তো কেটে গেল, এইবার বউরানীকে আনিয়ে নিই।”

“কেন, তাড়া কিসের? দেখো নবীন, তোমাকে বলে রাখলুম আর কখনোই এ-সব কথা আমার কাছে তুলবে না। যে দিন আমার খুশি আমি আনিয়ে নেব।”

নবীন দাদাকে চেনে, বুঝলে এ-কথাটা খতম হয়ে গেল।

তবু সাহস করে জিজ্ঞাসা করলে, “মেজোবউ যদি বউরানীকে দেখতে যায় তাহলে কি দোষ আছে?”

মধুসূদন অবজ্ঞা করে সংক্ষেপে বললে, “যাক না।”

ব্যস্তসমস্ত হয়ে একটা কেদারা দেখিয়ে দিয়ে বিপ্রদাস বললে, “আসুন নবীনবাবু, এইখানে বসুন।”

নবীন বললে, “আমার পরিচয়টা পান নি বোধ হচ্ছে। মনে করেছেন আমি রাজবাড়ির কোন্ আদুরে ছেলে। যিনি আপনার ছোটো বোন, আমি তাঁর অধম সেবক, আমাকে সম্মান করে আমায় আশীর্বাদটা ফাঁকি দেবেন না। কিন্তু করেছেন কী? আপনার অমন শরীরের কেবল ছায়াটি বাকি রেখেছেন!”

“শরীরটা সত্য নয়, ছায়া, মাঝে মাঝে সে-খবরটা পাওয়া ভালো। ওতে শেষের পাঠ এগিয়ে থাকে।”

কুমু ঘরে ঢুকেই বললে, “ঠাকুরপো, চলো কিছু খাবে।”

“খাব, কিন্তু একটা শর্ত আছে। যতক্ষণ পূরণ না হবে, ব্রাহ্মণ অতিথি অভুক্ত তোমার দ্বারে পড়ে থাকবে।”

“শর্তটা কী শুনি?”

“আমাদের বাড়িতে থাকতেই দরবার জানিয়ে রেখেছিলুম কিন্তু সেখানে জোর পাই নি। ভক্তকে একখানি ছবি তোমায় দিতে হবে। সেদিন বলেছিলে নেই, আজ তা বলবার জো নেই, তোমার দাদার ঘরের দেয়ালে ওই তো সামনেই ঝুলছে।”

ভালো ছবি দৈবাৎ হয়ে থাকে, কুমুর ওই ছবিটি তেমনি যেন দৈবের রচনা। কপালে যে-আলোটি পড়লে কুমুর মনের চেহারাটি মুখে প্রকাশ পায় সেই আলোটিই পড়েছিল। ললাটে নির্মল বুদ্ধির দীপ্তি, চোখে গভীর সারল্যের সকরুণতা। দাঁড়ানো ছবি। কুমুর সুন্দর ডান হাতটি একটা শূন্য চৌকির হাতার উপরে। মনে হয় যেন সামনে ও আপনারই একটা দূরকালের ছায়া দেখতে পেয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে।

নিজের এই ছবিটি কুমুর চোখে পড়ে নি। কলকাতা থেকে ছবিওআলা আনিয়ে বিবাহের কয়দিন আগে ওর দাদা এটি তুলিয়েছিল। তার পরে নিজের ঘরে ছবিটি টাঙিয়েছে, এইটেতে কুমুর হৃদয় আর্দ্র হয়ে গেল। ফটোগ্রাফের কপি আরও নিশ্চয় আছে, তাই দাদার মুখের দিকে চাইলো। নবীন বললে, “বুঝতে পারছেন, বিপ্রদাসবাবু, বউরানীর দয়া হয়েছে। দেখুন না ওঁর চোখের দিকে চেয়ে। অযোগ্য বলেই আমার প্রতি ওঁর একটু বিশেষ করুণা।”

বিপ্রদাস হেসে বললে, “কুমু, আমার ওই চামড়ার বাক্সয় আরও খানকয়েক ছবি আছে, তোর ভক্তকে বরদান করতে চাস যদি তো অভাব হবে না।”

কুমু নবীনকে খাওয়াতে নিয়ে গেলে পর কালু এল ঘরে। বললে, “আমি মেজোবাবুকে তার করেছি শীঘ্র চলে আসবার জন্যে।”

“আমার নামে?”

“হ্যাঁ, তোমারই নামে, দাদা। আমি জানি, তুমি শেষ পর্যন্ত হাঁ-না করবে, এদিকে সময় বড়ো কঠিন হয়ে আসছে। ডাক্তারের কাছে যা শোনা গেল, তোমার উপর এত চাপ সইবে না।”

ডাক্তার বলেছে হৃদ্‌যন্ত্রের বিকারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, শরীরমন শান্ত রাখা চাই। এক সময়ে বিপ্রদাসের যে অতিরিক্ত কুস্তির নেশা ছিল এটা তারই ফল, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে মনের উদ্বেগ।

সুবোধকে এ-রকম জোর-তলব করে ধরে আনা ভালো হবে কি না বিপ্রদাস বুঝতে পারলে না। চুপ করে ভাবতে লাগল। কালু বললে, “বড়োবাবু, মিথ্যা ভাবছ, বিষয়কর্মের একটা শেষ ব্যবস্থা এখনই করা চাই, আর এতে তাঁকে না হলে চলবে না। বারো পার্সেন্ট সুদে মাড়োয়ারির হাতে মাথা বিকিয়ে দিতে পারব না। তারা আবার দু-লাখ টাকা আগাম সুদ হিসেবে কেটে নেবে। তার উপর দালালি আছে।”

বিপ্রদাস বললে, “আচ্ছা, আসুক সুবোধ। কিন্তু আসবে তো?”

“যতবড়ো সাহেব হোক না, তোমার তার পেলে সে না এসে থাকতে পারবে না। সে তুমি নিশ্চিন্ত থাকে। কিন্তু দাদা, আর দেরি করা নয়, খুকীকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দাও।”

বিপ্রদাস খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, বললে, “মধুসূদন না ডেকে পাঠালে যাবার বাধা আছে।”

“কেন, খুকী কি মধুসূদনের পাটখাটা মজুর? নিজের ঘরে যাবে তার আবার হুকুম কিসের?”

আহার সেরে নবীন একলা এল বিপ্রদাসের ঘরে। বিপ্রদাস বললে, “কুমু তোমাকে স্নেহ করে।”

নবীন বললে, “তা করেন। বোধ করি আমি অযোগ্য বলেই ওঁর স্নেহ এত বেশি।”

“তাঁর সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলতে চাই, তুমি আমাকে কোনো কথা লুকিয়ো না।”

“কোনো কথা আমার নেই যা আপনাকে বলতে আমার বাধবে।”

“কুমু যে এখানে এসেছে আমার মনে হচ্ছে তার মধ্যে যেন বাঁকা কিছু আছে।”

“আপনি ঠিকই বুঝেছেন। যাঁর অনাদর কল্পনা করা যায় না সংসারে তাঁরও অনাদর ঘটে।”

“অনাদর ঘটেছে তবে?”

“সেই লজ্জায় এসেছি। আর তো কিছুই পারি নে, পায়ের ধুলো নিয়ে মনে মনে মাপ চাই।”

“কুমু যদি আজই স্বামীর ঘরে ফিরে যায় তাতে ক্ষতি আছে কি?”

“সত্যি কথা বলি, যেতে বলতে সাহস করি নে।”

ঠিক যে কী হয়েছে বিপ্রদাস সে-কথা নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে না। মনে করলে, জিজ্ঞাসা করা অন্যায় হবে। কুমুকেও প্রশ্ন করে কোনো কথা বের করতে বিপ্রদাসের অভিরুচি নেই। মনের মধ্যে ছটফট করতে লাগল। কালুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি তো ওদের বাড়িতে যাওয়া-আসা কর, মধুসূদনের সম্বন্ধে তুমি বোধ হয় কিছু জান।”

“কিছু আভাস পেয়েছি, কিন্তু সম্পূর্ণ না জেনে তোমার কাছে কিছু বলতে চাই নে। আর দুটো দিন সবুর করো, খবর তোমাকে দিতে পারব।”

আশঙ্কায় বিপ্রদাসের মন ব্যথিত হয়ে উঠল। প্রতিকার করবার কোনো রাস্তা তার হাতে নেই বলে দুশ্চিন্তাটা ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিতে লাগল।

কুমু অনেকদিন যেটা একান্ত ইচ্ছা করেছিল সে ওর পূর্ণ হল; সেই পরিচিত ঘরে, সেই ওর দাদার স্নেহের পরিবেষ্টনের মধ্যে এল ফিরে, কিন্তু দেখতে পেলে ওর সেই সহজ জায়গাটি নেই। এক-একবার অভিমানে ওর মনে হচ্ছে যাই ফিরে, কেননা ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে সবারই মনে প্রতিদিন এই প্রশ্নটি রয়েছে, ‘ও ফিরে যাচ্ছে না কেন, কী হয়েছে ওর?’ দাদার গভীর স্নেহের মধ্যে ওই একটা উৎকণ্ঠা, সেটা নিয়ে ওদের মধ্যে স্পষ্ট আলোচনা চলে না, তার বিষয় ও নিজে, অথচ ওর কাছে সেটা চাপা রইল।

বিকেল হয়ে আসছে, রোদ্দুর পড়ে এল। শোবারঘরের জানালার কাছে কুমু বসে। কাক গুলো ডাকাডাকি করছে, বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ আর লোকালয়ের নানা কলরব। নতুন বসন্তের হাওয়া শহরের ইঁটকাঠের উপর রঙ ধরাতে পারলে না। সামনের বাড়িটাকে অনেকখানি আড়াল করে একটা পাতবাদামের গাছ, অস্থির হাওয়া তারই ঘনসবুজ পাতায় দোল লাগিয়ে অপরাহ্ণের আলোটাকে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিতে লাগল। এইরকম সময়েই পোষা হরিণী তার অজানা বনের দিকে ছুটে যেতে চায়, যেদিন হাওয়ার মধ্যে বসন্তের ছোঁওয়া লাগে, মনে হয় পৃথিবী যেন উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে নীল আকাশের দূর পথের দিকে। যা-কিছু চার দিকে বেড়ে আছে সেইটেকেই মনে হয় মিথ্যে; আর যার ঠিকানা পাওয়া যায় নি, যার ছবি আঁকতে গেলে রঙ যায় আকাশে ছড়িয়ে, মূর্তি উঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় জলস্থলের নানা ইশারার মধ্যে মন তাকেই বলে সব চেয়ে সত্য। কুমুর মন হাঁপিয়ে উঠে আজ পালাই-পালাই করছে সব কিছু থেকে, আপনার কাছ থেকে। কিন্তু এ কী বেড়া। আজ এ-বাড়িতেও মুক্তি নেই। কল্পনায় মৃত্যুকেও মধুর করে তুললে। মনে মনে বললে, কালো যমুনার পারে, সেই কালোবরণ, চলেছি তারই অভিসারে, দিনের পর দিনে—কত দীর্ঘ পথ, কত দুঃখের পথ। মনে পড়ে গেল, দাদার অসুখ বেড়েছে—সেবা করতে এসে আমিই অসুখ বাড়িয়েছি, এখন আমি যা করতে যাব তাতেই উলটো হবে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে কুমু খুব খানিকটা কেঁদে নিলে। কান্নার বেগ থামলে স্থির করলে বাড়ি ফিরে যাবে, তা যা হয় তাই হবে—সব সহ্য করবে—শেষকালে তো আছে মুক্তি, শীতল গভীর মধুর। সেই মৃত্যুর কল্পনা মনের মধ্যে যতই স্পষ্ট করে আঁকড়ে ধরল ততই ওর বোধ হল জীবনের ভার একেবারে দুর্বহ হবে না, গুন গুন করে গাইতে লাগল—

পথপর রয়নি অঁধেরী,
কুঞ্জপর দীপ উজিয়ারা।

দুপুরবেলা কুমু দাদাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চলে এসেছিল, এতক্ষণে ওষুধ আর পথ্য খাওয়াবার সময় হয়েছে। ঘরে এসে দেখলে, বিপ্রদাস উঠে বসে পোর্টফোলিয়ো কোলে নিয়ে সুবোধকে ইংরেজিতে এক লম্বা চিঠি লিখছে। ভর্ৎ‌সনার সুরে কুমু তাকে বললে, “দাদা, আজ তুমি ভালো করে ঘুমোও নি।”

বিপ্রদাস বললে, “তুই ঠিক করে রেখেছিস ঘুমোলই বিশ্রাম হয়। মন যখন চিঠি লেখার দরকার বোধ করে তখন চিঠি লিখলেই বিশ্রাম।”

কুমু বুঝলে, দরকারটা ওকে নিয়েই। সমুদ্রের এপারে এক ভাইকে ব্যাকুল করেছে, সমুদ্রের ওপারে আর-এক ভাইকে ছটফটিয়ে দেবে, কী ভাগ্য নিয়েই জন্মেছিল তাদের এই বোন। দাদাকে চা খাওয়ানো হলে পর আস্তে আস্তে বললে, “অনেক দিন তো হয়ে গেল, এবার বাড়ি যাওয়া ঠিক করেছি।”

বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে কথাটা কী ভাবের। এতদিন দুই ভাইবোনের মধ্যে যে স্পষ্ট বোঝাপড়া ছিল আজ আর তা নেই, এখন মনের কথার জন্যে হাতড়ে বেড়াতে হয়। বিপ্রদাস লেখা বন্ধ করলে। কুমুকে পাশে বসিয়ে কিছু না বলে তার হাতের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কুমু তার ভাষা বুঝল। সংসারের গ্রন্থি কঠিন হয়েছে, কিন্তু ভালোবাসার একটুও অভাব হয় নি। চোখ দিয়ে জল পড়তে চাইল, জোর করে বন্ধ করে দিলে। কুমু মনে মনে বললে, এই ভালোবাসার উপর সে ভার চাপাবে না। তাই আবার বললে, “দাদা, আমি যাওয়া ঠিক করেছি।”

বিপ্রদাস কী জবাব দেবে ভেবে পেলে না, কেননা কুমুর যাওয়াটাই হয়তো ভালো, অন্তত সেটাই তো কর্তব্য। চুপ করে রইল। এমন সময় কুকুরটা ঘুম থেকে জেগে কুমুর কোলের উপর দুই পা তুলে বিপ্রদাসের প্রসাদ রুটির টুকরোর জন্যে কাকুতি জানালে।

রামস্বরূপ বেহারা এসে খবর দিলে মুখুজ্যেমশায় এসেছেন। কুমু উদ্বিগ্ন হয়ে বললে, “আজ দিনে তোমার ঘুম হয় নি, তার উপরে কালুদার সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমি বরঞ্চ যাই, কিছু যদি কথা থাকে শুনে নিই গে, তার পরে তোমাকে সময়মতো এসে জানাব।”

“ভারি ডাক্তার হয়েছিস তুই! একজনের কথা যদি আর-একজন শুনে নেয় তাতে রােগীর মন খুব সুস্থির হয় ভেবেছিস!”

“আচ্ছা, আমি শুনব না, কিন্তু আজ থাক্।”

“কুমু, ইংরেজ-কবি বলেছে, শ্রুত সংগীত মধুর, অশ্রুত সংগীত মধুরতর। তেমনি শ্রুত সংবাদ ক্লান্তিকর হতে পারে, কিন্তু অশ্রুত সংবাদ আরও অনেক ক্লান্তিকর, অতএব অবিলম্বে শুনে নেওয়াই ভালাে।”

“আমি কিন্তু পনেরাে মিনিট পরেই আসব, আর তখনো যদি তােমাদের কথাবার্তা না থামে তবে আমি তার মধ্যেই এসরাজ বাজাব—ভীমপলশ্রী।”

“আচ্ছ, তাতেই রাজি।”

আধঘণ্টা পরে এসরাজ হাতে কুমু ঘরে ঢুকল, কিন্তু বিপ্রদাসের মুখের ভাব দেখে তখনই এসরাজটা দেয়ালের কোণে ঠেকিয়ে রেখে দাদার পাশে বসে তার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে দাদা?”

কুমু এতদিন বিপ্রদাসের মধ্যে যে-অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিল তার মধ্যে একটা গভীর বিষাদ ছিল। বিপ্রদাসের জীবনে দুঃখ তাপ অনেক গেছে, কেউ তাকে সহজে বিচলিত হতে দেখে নি। বই পড়া, গানবাজনা করা, দূরবীন নিয়ে তারা দেখা, ঘােড়ায় চড়া, নানা জায়গা থেকে অজানা গাছপালা নিয়ে বাগান করা প্রভৃতি নানা বিষয়েই তার ঔৎসুক্য থাকাতে সে নিজের সম্বন্ধীয় দুঃখ কষ্টকে নিজের মধ্যে কখনাে জমতে দেয় নি। এবার রোগের দুর্বলতায় তাকে নিজের ছােটো গণ্ডির মধ্যে বড় বেশি করে বদ্ধ করেছে। এখন সে বাইরে থেকে সেবা ও সঙ্গ পাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে, চিঠিপত্র ঠিকমতাে না পেলে উদ্বিগ্ন হয়, ভাবনাগুলো দেখতে দেখতে কালাে হয়ে ওঠে। তাই দাদার ’পরে কুমুর স্নেহ আজ যেন মাতৃস্নেহের মতাে রূপ ধরেছে— তার অমন ধৈর্যগম্ভীর আত্মসমাহিত দাদার মধ্যে কোথা থেকে যেন বালকের ভাব এল, এত আবদার, এত চাঞ্চল্য, এত জেদ। আর সেই সঙ্গে এমন গভীর বিষাদ আর উৎকণ্ঠা।

কিন্তু কুমু এসে দেখলে তার দাদার সেই আবেশটা কেটে গিয়েছে। তার চোখে যে-আগুন জ্বলেছে সে যেন মহাদেবের তৃতীয় নেত্রের আগুনের মতো, নিজের কোনো বেদনার জন্যে নয়— সে তার দৃষ্টির সামনে বিশ্বের কোনো পাপকে দেখতে পাচ্ছে, তাকে দগ্ধ করা চাই। কুমুর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দেয়ালে অনিমেষ দৃষ্টি রেখে বিপ্রদাস চুপ করে বসে রইল।

কুমু আর খানিক বাদে আবার জিজ্ঞাসা করলে, “দাদা, কী হয়েছে বলো।”

বিপ্রদাস যেন এক দূর লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে বললে, “দুঃখ এড়াবার জন্যে চেষ্টা করলে দুঃখ পেয়ে বসে। ওকে জোরের সঙ্গে মানতে হবে।”

“তুমি উপদেশ দাও, আমি মানতে পারব দাদা।”

“আমি দেখতে পাচ্ছি, মেয়েদের যে অপমান সে আছে সমস্ত সমাজের ভিতরে, সে কোনো একজন মেয়ের নয়।”

কুমু ভালো করে তার দাদার কথার মানে বুঝতে পারলে না।

বিপ্রদাস বললে, “ব্যথাটাকে আমারই আপনার মনে করে এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলুম, আজ বুঝতে পারছি এর সঙ্গে লড়াই করতে হবে সকলের হয়ে।”

বিপ্রদাসের ফ্যাকাশে গৌরবর্ণ মুখের উপর লাল আভা এল। কোলের উপর রেশমের কাজ-করা একটা চৌকো বালিশ ছিল, সেটাকে ঠেলে হঠাৎ সরিয়ে ফেলে দিলে। বিছানা থেকে উঠে পাশের হাতাওআলা চৌকির উপর বসতে যাচ্ছিল, কুমু ওর হাত চেপে ধরে বললে, “শান্ত হও দাদা, উঠো না, তোমার অসুখ বাড়বে।” বলে একটু জোর করেই পিঠের দিকের উঁচু-করা বালিশের উপর বিপ্রদাসকে হেলিয়ে শুইয়ে দিলে।

বিপ্রদাস গায়ের কাপড়টাকে মুঠো দিয়ে চেপে ধরে বললে, “সহ্য করা ছাড়া মেয়েদের অন্য কোনো রাস্তা একেবারেই নেই বলেই তাদের উপর কেবলই মার এসে পড়ছে। বলবার দিন এসেছে যে সহ্য করব না। কুমু, এখানেই তোর ঘর মনে করে থাকতে পারবি? ও-বাড়িতে তোর যাওয়া চলবে না।”

কালুর কাছ থেকে বিপ্রদাস আজ অনেক কথা শুনেছে।

শ্যামাসুন্দরীব সঙ্গে মধুসূদনের যে-সম্বন্ধ ঘটেছে তার মধ্যে অপ্রকাশ্যতা আর ছিল না। ওরা দুই পক্ষই অকুণ্ঠিত। লোকে ওদেরকে অপরাধী মনে করছে মনে করেই ওরা স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। এই সম্বন্ধটার মধ্যে সূক্ষ্ম কাজ কিছুই ছিল না বলেই পরস্পরকে এবং লোকমতকে বাঁচিয়ে চলা ওদের পক্ষে ছিল অনাবশ্যক। শোনা গেছে শ্যামাসুন্দরীকে মধুসূদন কখনো কখনো মেরেওছে, শ্যামা যখন তারস্বরে কলহ করেছে তখন মধুসূদন তাকে সকলের সামনেই বলেছে, “দূর হয়ে যা বজ্জাত, বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।” কিন্তু এতেও কিছু আসে-যায় নি। শ্যামার সম্বন্ধে মধুসূদন আপন কতৃত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখেছে, ইচ্ছে ক’রে মধুসূদন নিজে তাকে যা দিয়েছে শ্যামা যখনই তার বেশি কিছুতে হাত দিতে গেছে অমনি খেয়েছে ধমক। শ্যামার ইচ্ছে ছিল, সংসারের কাজে মোতির মার জায়গাটা সে-ই দখল করে, কিন্তু তাতেও বাধা পেলে; মধুসূদন মোতির মাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, শ্যামাসুন্দরীকে বিশ্বাস করে না। শ্যামার সম্বন্ধে ওর কল্পনায় রঙ লাগে নি, অথচ খুব মোটা রকমের একটা আসক্তি জন্মেছে। যেন শীতকালের বহুব্যবহৃত ময়লা রেজাইটার মতো, তাতে কারুকাজের সম্পূর্ণ অভাব, বিশেষ যত্ন করবার জিনিস নয়, খাট থেকে ধূলোয় পড়ে গেলেও আসে-যায় না। কিন্তু ওতে আরাম আছে। শ্যামাকে সামলিয়ে চলবার একটুও দরকার নেই, তা ছাড়া শ্যামা সমস্ত মনপ্রাণের সঙ্গে ওকে যে বড়ো বলে মানে, ওর জন্যে সব সইতে সব করতে সে রাজি এটা নিঃসংশয়ে জানার দরুন মধুসূদনের আত্মমর্যাদা সুস্থ আছে। কুমু থাকতে প্রতিদিন ওর এই আত্মমর্যাদা বড়ো বেশি নাড়া খেয়েছিল।

মধুসূদনের এই আধুনিক ইতিহাসটা জানবার জন্যে কালুকে খুব বেশি সন্ধান করতে হয় নি। ওদের বাড়িতে লোকজনের মধ্যে এই নিয়ে যথেষ্ট বলাবলি চলেছিল, অবশেষে নিতান্ত অভ্যস্ত হওয়াতে বলাবলির পালাও একরকম শেষ হয়ে এসেছে।

খবরটা শোনামাত্র বিপ্রদাসকে যেন আগুনের তীর মারলে। মধুসূদন কিছু ঢাকবার চেষ্টামাত্রও করে নি, নিজের স্ত্রীকে প্রকাশ্যে অপমান করা এতই সহজ—স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার করতে বাহিরের বাধা এতই কম। স্ত্রীকে নিরুপায়ভাবে স্বামীর বাধ্য করতে সমাজে হাজার রকম যন্ত্র ও যন্ত্রণার সৃষ্টি করা হয়েছে, অথচ সেই শক্তিহীন স্ত্রীকে স্বামীর উপদ্রব থেকে বাঁচাবার জন্যে কোনো অবশ্যিক পন্থা রাখা হয় নি। এরই নিদারুণ দুঃখ ও অসম্মান ঘরে ঘরে যুগে যুগে কী রকম ব্যাপ্ত হয়ে আছে এক মুহূর্তে বিপ্রদাস তা যেন দেখতে পেলে। সতীত্বগরিমার ঘন প্রলেপ দিয়ে এই ব্যথা মারবার চেষ্টা, কিন্তু বেদনাকে অসম্ভব করবার একটুও চেষ্টা নেই। খ্রীলোক এত সস্তা, এত অকিঞ্চিৎকর।

বিপ্রদাস বললে, “কুমু, অপমান সহ্য করে যাওয়া শক্ত নয়, কিন্তু সহ্য করা অন্যায়। সমস্ত স্ত্রীলোকের হয়ে তোমাকে তোমার নিজের সম্মান দাবি করতে হবে, এতে সমাজ তোমাকে যত দুঃখ দিতে পারে দিক।”

কুমু বললে, “দাদা, তুমি কোন্ অপমানের কথা বলছ ঠিক বুঝতে পারছি নে।”

বিপ্রদাস বলে, “তুই কি তবে সব কথা জানিস নে?”

কুমু বললে, “না।”

বিপ্রদাস চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, “মেয়েদের অপমানের দুঃখ আমার বুকের মধ্যে জমা হয়ে রয়েছে। কেন তা জানিস?”

কুমু কিছু না বলে দাদার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক পরে বললে, “চিরজীবন মা যা দুঃখ পেয়েছিলেন আমি তা কোনােমতে ভুলতে পারি নে, আমাদের ধর্মবুদ্ধিহীন সমাজ সেজন্যে দায়ী।”

এইখানে ভাইবােনের মধ্যে প্রভেদ আছে। কুমু তার বাবাকে খুব বেশি ভালােবাসত, জানত তাঁর হৃদয় কত কোমল। সমস্ত অপরাধ কাটিয়েও তার বাবা ছিলেন খুব বড়ো এ-কথা না মনে করে সে থাকতে পারত না, এমনকি তার বাবার জীবনে যে শােচনীয় পরিণাম ঘটেছিল সেজন্যে সে তার মাকেই মনে মনে দোষ দিয়েছে।

বিপ্রদাস ও তার বাবাকে বড়ো বলেই ভক্তি করেছে। কিন্তু বারে বারে স্খলনের দ্বারা তার মাকে তিনি সকলের কাছে অসম্মানিত করতে বাধা পান নি এটা সে কোনােমতে ক্ষমা করতে পারলে না। তার মা ও ক্ষমা করেন নি বলে বিপ্রদাস মনের মধ্যে গৌরব বােধ করত।

বিপ্রদাস বললে, “আমার মা যে অপমান পেয়েছিলেন তাতে সমস্ত স্ত্রীজাতির অসম্মান। কুমু, তুই ব্যক্তিগতভাবে নিজের কথা ভুলে সেই অসম্মানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবি, কিছুতে হার মানবি নে।”

কুমু মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে বললে, “বাবা কিন্তু মাকে খুব ভালােবাসতেন সে-কথা ভুলাে না, দাদা। সেই ভালােবাসায় অনেক পাপের মার্জনা হয়।”

বিপ্রদাস বললে, “তা মানি, কিন্তু এত ভালােবাসা সত্ত্বেও তিনি এত সহজে মায়ের সম্মানহানি করতে পারতেন, সে পাপ সমাজের। সমাজকে সেজন্য ক্ষমা করতে পারব না, সমাজের ভালােবাসাই নেই, আছে কেবল বিধান।”

“দাদা, তুমি কি কিছু শুনেছ?”

“শুনেছি, সে-সব কথা তােকে আস্তে আস্তে পরে বলব।”

“সেই ভালাে। আমার ভয় হচ্ছে আজকেকার এই-সব কথাবার্তায় তােমার শরীর আরও দুর্বল হয়ে যাবে।”

“না কুমু,ঠিক তার উলটো। এত দুঃখের অবসাদে শরীরটা যেন এলিয়ে পড়ছিল। আজ যখন মন বলছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করতে হবে, আমার শরীরের ভিতর থেকে শক্তি আসছে।”

“কিসের লড়াই দাদা।”

“যে-সমাজ নারীকে তার মূল্য দিতে এত বেশি ফাঁকি দিয়েছে তার সঙ্গে লড়াই।”

“তুমি তার কি করতে পার দাদা?”

“আমি তাকে না মানতে পারি। তা ছাড়া আরও আরও কী করতে পারি সে আমাকে ভাবতে হবে; আজ থেকেই শুরু হল, কুমু। এই বাড়িতে তাের জায়গা আছে, সে সম্পূর্ণ তাের নিজের, আর-কারও সঙ্গে আপস করে নয়। এইখানেই তুই নিজের জোরে থাকবি।”

“আচ্ছা দাদা, সে হবে, কিন্তু আর তুমি কথা ক’য়ো না।”

এমন সময় খবর এল, মােতির মা এসেছে।

শোবার ঘরে কুমু মােতির মাকে নিয়ে বসল। কথা কইতে কইতে অন্ধকার হয়ে এল, বেহারা এল আলো জ্বলতে, কুমু নিষেধ করে দিলে।

কুমু সব কথাই শুনলে; চুপ ক’রে রইল।

মোতির মা বললে, “বাড়িকে ভূতে পেয়েছে-বউরানী। ওখানে টিঁঁকে থাকা দায়, তুমি কি যাবে না?”

“আমার কি ডাক পড়েছে?”

“না, ডাকবার কথা বোধ হয় মনেও নেই। কিন্তু তুমি না গেলে তো চলবেই না।” ঁ “আমার কী করবার আছে? আমি তো তাকে তৃপ্ত করতে পারব না। ভেবে দেখতে গেলে আমার জন্যেই সমস্ত কিছু হয়েছে, অথচ কোনো উপায় ছিল না। আমি যা দিতে পারতুম সে তিনি নিতে পারলেন না। আজ আমি শূন্য হাতে গিয়ে কী করব?”

“বল কী বউরানী, সংসার যে তোমারই, সে তো তোমার হাতছাড়া হলে চলবে না।”

“সংসার বলতে কী বোঝ ভাই? ঘরদুয়োর, জিনিসপত্র, লোকজন? লজ্জা করে এ-কথা বলতে যে, তাতে আমার অধিকার আছে। মহলে অধিকার খুইয়েছি, এখন কি ওই-সব বাইরের জিনিস নিয়ে লোভ করা চলে?”

কী বলছ ভাই, বউরানী? ঘরে কি তুমি একেবারেই ফিরবে না?”

“সব কথা ভালো করে বুঝতে পারছি নে। আর কিছুদিন আগে হলে ঠাকুরের কাছে সংকেত চাইতুম, দৈবজ্ঞের কাছে শুধোতে যেতুম। কিন্তু আমার সে-সব ভরসা ধুয়েমুছে গেছে। আরম্ভে সব লক্ষণই তো ভালো ছিল। শেষে কোনোটাই তো একটুও খাটল না। আজ কতবার বসে বলে ভেবেছি, দেবতার চেয়ে দাদার বিচারের উপর ভর করলে এত বিপদ ঘটত না। তবুও মনের মধ্যে যে দেবতাকে নিয়ে দ্বিধা উঠেছে, হৃদয়ের মধ্যে তাঁকে এড়াতে পারি নে। ফিরে ফিরে সেইখানে এসে লুটিয়ে পড়ি।”

“তোমার কথা শুনে যে ভয় লাগে। ঘরে কি যাবেই না?”

“কোনো কালেই যাব না সে-কথা ভাবা শক্ত, যাবই সে-কথা সহজ নয়।”

“আচ্ছা, তোমার দাদার কাছে একবার কথা বলে দেখব। দেখি তিনি কী বলেন। তাঁর দর্শন পাওয়া যাবে তো?”

“চলো না, এখনই নিয়ে যাচ্ছি।”

বিপ্রদাসের ঘরে ঢুকেই তার চেহারা দেখে মোতির মা থমকে দাঁড়াল, মনে হল যেন ভূমিকম্পের পরেকার আলো-নেবা চুড়ো-ভাঙা মন্দির ভিতরে একটা অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। প্রণাম করে পায়ের ধূলো নিয়ে মেজের উপর বসল।

বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে বললে, “এই যে চৌকি আছে।”

মোতির মা মাথা নেড়ে বললে, “না, এখানে বেশ আছি।”

ঘোমটার ভিতর থেকে তার চোখ ছলছল করতে লাগল। বুঝতে পারলে দাদার এই অবস্থায় কুমুকে ব্যথাই বাজছে।

কুমু প্রসঙ্গটা সহজ করে দেবার জন্যে বললে, “দাদা, ইনি বিশেষ করে, এসেছেন তোমার মত জিজ্ঞাসা করতে।”

মোতির মা বললে, “না না, মত জিজ্ঞাসা পরের কথা, আমি এসেছি ওঁর চরণ দর্শন করতে।”

কুমু বললে, “উনি জানতে চান, ওঁদের বাড়িতে আমাকে যেতে হবে কি না।”

বিপ্রদাস উঠে বসল; বললে, “সে তো পরের বাড়ি, সেখানে কুমু গিয়ে থাকবে কী করে?” যদি ক্রোধের সুরে বলত তাহলে কথাটার ভিতরকার আগুন এমন করে জ্বলে উঠত না। শান্ত কণ্ঠস্বর, মুখের মধ্যে উত্তেজনার লক্ষণ নেই।

মোতির মা ফিস ফিস করে কী বললে। তার অভিপ্রায় ছিল পাশে বসে কুমু তার কথাগুলো বিপ্রদাসের কানে পৌঁছিয়ে দেবে। কুমু সম্মত হল না, বললে, “তুমিই গলা ছেড়ে বলো।”

মোতির মা স্বর আর একটু স্পষ্ট করে বললে “যা ওঁর আপনারই, কেউ তাকে পরের করে দিতে পারে না, তা সে যেই হোক না।”

“সে-কথা ঠিক নয়। উনি আশ্রিত মাত্র। ওঁর নিজের অধিকারের জোর নেই। ওঁকে ঘরছাড়া করলে হয়তো নিন্দা করবে, বাধা দেবে না। যত শাস্তি সমস্তই কেবল ওঁর জন্যে। তবু অনুগ্রহের আশ্রয়ও সহ্য করা যেত যদি তা মহদাশ্রয় হত।”

এমন কথার কী জবাব দেবে মোতির মা ভেবে পেলে না। স্বামীর আশ্রয়ে বিঘ্ন ঘটলে মেয়ের পক্ষের লোকেরাই তো পায়ে-ধরাধরি করে, এ যে উলটো কাণ্ড।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “কিন্তু আপন সংসার না থাকলে মেয়েরা যে বাঁচে না; পুরুষেরা ভেসে বেড়াতে পারে, মেয়েদের কোথাও স্থিতি চাই তো।”

“স্থিতি কোথায়? অসম্মানের মধ্যে? আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি কুমুকে যিনি গড়েছেন তিনি আগাগোড়া পরম শ্রদ্ধা করে গড়েছেন। কুমুকে অবজ্ঞা করে এমন যোগ্যতা কারও নেই, চক্রবর্তী-সম্রাটেরও না।”

কুমুকে মোতির মা খুবই ভালোবাসে, ভক্তি করে, কিন্তু তবু কোনো মেয়ের এত মূল্য থাকতে পারে যে তার গৌরব স্বামীকে ছাপিয়ে যাবে এ-কথা মোতির মার কানে ঠিক লাগল না। সংসারে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি চলুক, স্ত্রীর ভাগ্যে অনাদর-অপমানও না-হয় যথেষ্ট ঘটল, এমনকি তার থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে স্ত্রী আফিম খেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরে সেও বোঝা যায়, কিন্তু তাই বলে স্বামীকে একেবারে বাদ দিয়ে স্ত্রী নিজের জোরে থাকবে এটাকে মোতির মা স্পর্ধা বলেই মনে করে। মেয়েজাতের এত গুমর কেন। মধুসুদন যত অযোগ্য হোক, যত অন্যায় করুক, তবু তো পুরুষমানুষ; এক জায়গায় সে তার স্ত্রীর চেয়ে আপনিই বড়, সেখানে কোনো বিচার খাটে না। বিধাতার সঙ্গে মামলা করে জিতবে কে?

মোতির মা বললে, “একদিন ওখানে যেতে তো হবেই, আর তো রাস্তা নেই।”

“যেতে হবেই এ-কথা ক্রীতদাস ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে খাটে না।”

“মন্ত্র পড়ে স্ত্রী যে কেনা হয়েই গেছে। সাত পাক যেদিন ঘোরা হল সেদিন সে যে দেহে মনে বাঁধা পড়ল, তার তো আর পালাবার জো রইল না। এ বাঁধন যে মরণের বাড়া। মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছি তখন এ-জন্মের মতো মেয়ের ভাগ্য তো আর কিছুতে উজিয়ে ফেরানো যায় না।”

বিপ্রদাস বুঝতে পারলে, মেয়ের সম্মান মেয়েদের কাছেই সবচেয়ে কম। তারা জানেও না যে, এইজন্যে মেয়েদের ভাগ্যে ঘরে ঘরে অপমানিত হওয়া এত সহজ। তারা আপনার আলো আপনি নিবিয়ে বসে আছে। তার পরে কেবলই মরছে ভয়ে, কেবলই মরছে ভাবনায়, অযোগ্য, লোকের হাতে কেবলই খাচ্ছে মার, আর মনে করছে সেইটে নীরবে সহ্য করাতেই স্ত্রী-জন্মের সর্বোচ্চ চরিতার্থতা। না, মানুষের এত লাঞ্ছনাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। সমাজ যাকে এতদুর নামিয়ে দিলে সমাজকেই সে প্রতিদিন নামিয়ে দিচ্ছে।

বিপ্রদাসের খাটের পাশেই মেজের উপর কুমু মুখ নিচু করে বসে ছিল। বিপ্রদাস মোতির মাকে কিছু না বলে কুমুর মাথায় হাত দিয়ে বললে, “একটা কথা তোকে বলি কুমু, বোঝবার চেষ্টা করিস। ক্ষমতা জিনিসটা যেখানে পড়ে-পাওয়া জিনিস, যার কোনো যাচাই নেই, অধিকার বজায় রাখবার জন্যে যাকে যোগ্যতার কোনাে প্রমাণ দিতে হয় না, সেখানে সংসারে সে কেবলই হীনতার সৃষ্টি করে। এ-কথা তােকে অনেকবার বলেছি, তাের সংস্কার তুই কাটাতে পারিস নি, কষ্ট পেয়েছিস। তুই যখন বিশেষ করে ব্রাহ্মণভোজন করাতিস, কোনোদিন বাধা দিই নি, কেবল বার বার বােঝাতে চেষ্টা করেছি, অবিচারে কোনাে মানুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করে নেওয়ার দ্বারা শুধু যে তারই অনিষ্ট তা নয়, তাতে করে সমাজের শ্রেষ্ঠতার আদর্শকেই খাটো করে। এ-রকম অন্ধ শ্রদ্ধার দ্বারা নিজেরই মনুষ্যত্বকে অশ্রদ্ধা করি এ-কথা কেউ ভাবে না কেন? তুই তাে ইংরেজি সাহিত্য কিছু কিছু পড়েছিস, বুঝতে পারছিস নে, এই রকম যত দলগড়া শাস্ত্রগড়া নির্বিকার ক্ষমতার বিরুদ্ধে সমস্ত জগতে আজ লড়াইয়ের হাওয়া উঠেছে। যত-সব ইচ্ছাকৃত অন্ধ দাসত্বকে বড়াে নাম দিয়ে মানুষ দীর্ঘকাল পােষণ করেছে, তারই বাসা ভাঙবার দিন এল।”

কুমু মাথা নিচু করেই বললে, “দাদা, তুমি কি বল স্ত্রী স্বামীকে অতিক্রম করবে?”

“অন্যায় অতিক্রম করা মাত্রকেই দোষ দিচ্ছি। স্বামীও স্ত্রীকে অতিক্রম করবে না—এই আমার মত।”

“যদি করে, স্ত্রী কি তাই ব’লে—”

কুমুর কথা শেষ না হতেই বিপ্রদাস বললে, “স্ত্রী যদি সেই অন্যায় মেনে নেয় তবে সকল স্ত্রীলােকের প্রতিই তাতে করে অন্যায় করা হবে। এমনি করে প্রত্যেকের দ্বারাই সকলের দুঃখ জমে উঠেছে। অত্যাচারের পথ পাকা হয়েছে।”

মোতির মা একটু অধৈর্যের স্বরেই বললে, “আমাদের বউরানী সতীলক্ষ্মী, অপমান করলে সে অপমান ওঁকে স্পর্শ করতেও পারে না।”

বিপ্রদাসের কণ্ঠ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল, “তােমরা সতীলক্ষ্মীর কথাই ভাবছ। আর যে-কাপুরুষ তাকে অবাধে অপমান করবার অধিকার পেয়ে সেটাকে প্রতিদিন খাটাচ্ছে তার দুর্গতির কথা ভাবছ না কেন?”

কুমু তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বিপ্রদাসের চুলের মধ্যে আঙুল বুলোতে বুলোতে বললে, “দাদা তুমি আর কথা কোয়ো না। তুমি যাকে মুক্তি বল, যা জ্ঞানের দ্বারা হয়, আমাদের রক্তের মধ্যে তার বাধা। আমরা মানুষকেও জড়িয়ে থাকি, বিশ্বাসকেও; কিছুতেই তার জট ছাড়াতে পারি নে। যতই ঘা খাই ঘুরেফিরে আটকা পড়ি। তোমরা অনেক জান তাতেই তোমাদের মন ছাড়া পায়, আমরা অনেক মানি তাতেই আমাদের জীবনের শূন্য ভরে। তুমি যখন বুঝিয়ে দাও তখন বুঝতে পারি হয়তো আমার ভুল আছে। কিন্তু ভুল বুঝতে পারা, আর ভুল ছাড়তে পারা কি একই? লতার আঁকড়ির মতো আমাদের মমত্ব সবকিছুকেই জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে, সেটা ভালোই হোক আর মন্দই হোক, তার পরে আর তাকে ছাড়তে পারি নে।”

বিপ্রদাস বললে, “সেইজন্যেই তো সংসারে কাপুরুষের পূজার পূজারিনীর অভাব হয় না। তারা জানবার বেলা অপবিত্রকে অপবিত্র বলেই জানে, কিন্তু মানবার বেলায় তাকে পবিত্রের মতো করেই মানে।”

কুমু বললে, “কী করব দাদা, সংসারকে দুই হাতে জড়িয়ে নিতে হবে বলেই আমাদের সৃষ্টি। তাই আমরা গাছকেও আঁকড়ে ধরি, শুকনো কুটোকেও। গুরুকে মানতে আমাদের যতক্ষণ লাগে, ভণ্ডকে মানতেও ততক্ষণ। জাল যে আমাদের নিজের ভিতরেই। দুঃখ থেকে আমাদেরকে বাঁচাবে কে? সেইজন্যেই ভাবি, দুঃখ যদি পেতেই হয়, তাকে মেনে নিয়েও তাকে ছাড়িয়ে ওঠবার উপায় করতে হবে। তাই তো মেয়েরা এত করে ধর্মকে আশ্রয় করে থাকে।”

বিপ্রদাস কিছুই বললে না, চুপ করে বসে রইল।

সেই ওর চুপ করে বসে থাকাটাও কুমুকে কষ্ট দিলে। কুমু জানে কথা বলার চেয়েও এর ভার অনেক বেশি।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মোতির মা কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “কী ঠিক করলে বউরানী?”

কুমু বললে, “যেতে পারব না। তা ছাড়া, আমাকে তো ফিরে যাবার অনুমতি দেন নি।”

মোতির মা মনে মনে কিছু বিরক্তই হল। শ্বশুরবাড়ির প্রতি ওর শ্রদ্ধা যে বেশি তা নয়, তবু শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে দীর্ঘকালের মমত্ববোধ ওর হৃদয়কে অধিকার করে আছে। সেখানকার কোনো বউ যে তাকে লঙ্ঘন করবে এটা তার কিছুতেই ভালো লাগল না। কুমুকে যা বললে তার ভাবটা এই, পুরুষমানুষের প্রকৃতিতে দরদ কম আর তার অসংযম বেশি, গোড়া থেকেই এটা তো ধরা কথা। সৃষ্টি তো আমাদের হাতে নেই, যা পেয়েছি তাকে নিয়েই ব্যবহার করতে হবে। “ওরা ওই রকমই” বলে মনটাকে তৈরি করে নিয়ে যেমন করে হোক সংসারটাকে চালানোই চাই। কেননা সংসারটাই মেয়েদের। স্বামী ভালোই হোক মন্দই হোক,সংসারটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। তা যদি একেবারে অসম্ভব হয় তাহলে মরণ ছাড়া আর গতিই নেই।

কুমু হেসে বললে, “না-হয় তাই হল। মরণের অপরাধ কী?”

মোতির মা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠল, “অমন কথা বোলো না।”

কুমু জানে না অল্পদিন হল ওদেরই পাড়াতে একটি সতেরো বছরের বউ কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার এম. এ. পাশ করা স্বামী—গবর্মেন্ট আপিসে বড়ো চাকরি করে। স্ত্রী খোঁপায় গোঁজবার একটা রুপোর চিরুনি হারিয়ে ফেলেছে, মার কাছ থেকে এই নালিশ শুনে লােকটা তাকে লাথি মেরেছিল। মােতির মার সেই কথা মনে প’ড়ে গায়ে কাঁটা দিলে।

এমন সময়ে নবীনের প্রবেশ। কুমু খুশি হয়ে উঠল। বললে, “জানতুম ঠাকুরপাের আসতে বেশি দেরি হবে না।”

নবীন হেসে বললে, “ন্যায়শাস্ত্রে বউরানীর দখল আছে, আগে দেখেছেন শ্রীমতী ধোঁয়াকে, তার থেকে শ্রীমান আগুনের আবির্ভাব হিসেব করতে শক্ত ঠেকে নি।”

মােতির মা বললে, “বউরানী, তুমিই ওকে নাই দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছ। ও বুঝে নিয়েছে ওকে দেখলে তুমি খুশি হও, সেই দেমাকে—”

“আমাকে দেখলেও খুশি হতে পারেন যিনি, তাঁর কি কম ক্ষমতা? যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিও নিজের হাতের কাজ দেখে অনুতাপ করেন, আর যিনি আমার পাণিগ্রহণ করেছেন তার মনের ভাব দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ।”

“ঠাকুরপাে, তােমরা দুজনে মিলে কথা-কাটাকাটি করো, তৃতীয় ব্যক্তি ছন্দোভঙ্গ করতে চায় না, আমি এখন চললুম।”

মােতির মা বললে, “সে কী কথা ভাই। এখানে তৃতীয় ব্যক্তিটা কে? তুমি না আমি? গাড়িভাড়া করে ও কি আমাকে দেখতে এসেছে ভেবেছ?”

“না, ওঁর জন্যে খাবার বলে দিই গে।” বলে কুমু চলে গেল।

মােতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “কিছু খবর আছে বুঝি?”

“আছে। দেরি করতে পারলুম না, তােমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলুম। তুমি তাে চলে এলে, তার পরে দাদা হঠাৎ আমার ঘরে এসে উপস্থিত। মেজাজটা খুবই খারাপ। সামান্য দামের একটা গিল্টি করা চুরোটের ছাইদান টেবিল থেকে অদৃশ্য হয়েছে। সম্প্রতি যাঁর অধিকারে সেটা এসেছে তিনি নিশ্চয়ই সেটাকে সোনা বলে ঠাউরেছেন, নইলে পরকাল খোয়াতে যাবেন কোন্ সাধে। জান তো তুচ্ছ একটা জিনিস নড়ে গেলে দাদার বিপুল সম্পত্তির ভিতটাতে যেন নাড়া লাগে, সে তিনি সইতে পারেন না। আজ সকালে আপিসে যাবার সময় আমাকে বলে গেলেন শ্যামকে দেশে পাঠাতে। আমি খুব উৎসাহের সঙ্গেই সেই পবিত্র কাজে লেগেছিলুম। ঠিক করেছিলুম তিনি আপিস থেকে ফেরবার আগেই কাজ সেরে রাখব। এমন সময়ে বেলা দেড়টার সময় হঠাৎ দাদা এক দমে আমার ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন; বললেন, ‘এখনকার মতো থাক্।’ যেই ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছেন, আমার ডেস্কের উপর বউরানীর সেই ছবিটি চোখে পড়ল। থমকে গেলেন। বুঝলুম আড়-চাহনিটাকে সিধে করে নিয়ে ছবিটিকে দেখতে দাদার লজ্জা বোধ হচ্ছে। বললুম, ‘দাদা, একটু ব’সো, একটা ঢাকাই কাপড় তোমাকে দেখাতে চাই। মোতির মার ছোটো ভাজের সাধ, তাই তাকে দিতে হবে। কিন্তু গণেশরাম দামে আমাকে ঠকাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। তোমাকে দিয়ে সেটা একবার দেখিয়ে নিতে চাই। আমার যতটা আন্দাজ তাতে মনে হয় না তো তেরো টাকা তার দাম হতে পারে। খুব বেশি হয় তো ন-টাকা সাড়ে ন-টাকার মধ্যেই হওয়া উচিত।

মোতির মা অবাক হয়ে বললে, “ও আবার তোমার মাথায় কোথা থেকে এল? আমার ছোটো ভাজের সাধ হবার কোনো উপায়ই নেই। তার কোলের ছেলেটির বয়স তো সবে দেড় মাস। বানিয়ে বলতে তোমার আজকাল দেখছি কিছুই বাধে না। এই তোমার নতুন বিদ্যে পেলে কোথায়?”

“যেখান থেকে কালিদাস তাঁর কবিত্ব পেয়েছেন, বাণী বীণাপাণির কাছ থেকে।”

“বীণাপাণি তোমাকে যতক্ষণ না ছাড়েন ততক্ষণ তোমাকে নিয়ে ঘর করা যে দায় হবে।”

“পণ করেছি, স্বর্গারোহণকালে নরকদর্শন করে যাব, বউরানীর চরণে এই আমার দান।”

“কিন্তু সাড়ে ন-টাকা দামের ঢাকাই কাপড় তখন-তখনই তোমার জুটল কোথায়?”

“কোথাও না। কুড়ি মিনিট পরে ফিরে এসে বললুম, ‘গণেশরাম সে-কাপড় আমাকে না বলেই ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।’ দাদার মুখ দেখে বুঝলুম, ইতিমধ্যে ছবিটা তাঁর মগজের মধ্যে ঢুকে স্বপ্নের রূপ ধরেছে। কী জানি কেন, পৃথিবীতে আমারই কাছে দাদার একটু আছে চক্ষুলজ্জা, আর কারও হলে ছবিটা ধাঁ করে তুলে নিতে তাঁর বাধত না।”

“তুমিও তো লোভী কম নয়। দাদাকে না-হয় সেটা দিতেই।”

“তা দিয়েছি, কিন্তু সহজ মনে দিই নি। বললেম, “দাদা, এই ছবিটা থেকে একটা অয়েলপেন্টিং করিয়ে নিয়ে তোমার শোবার ঘরে রেখে দিলে হয় না? দাদা যেন উদাসীনভাবে বললে, ‘আচ্ছা, দেখা যাবে।’ বলেই। ছবিটা নিয়ে উপরের ঘরে চলে গেল। তার পরে কী হল ঠিক জানি নে। বোধ করি আপিসে যাওয়া হয় নি, আর ওই ছবিটাও ফিরে পাবার আশা রাখি নে।”

“তোমার বউরানীর জন্যে স্বর্গটাই খোয়াতে যখন রাজি আছ, তখন না-হয় একখানা ছবিই বা খোয়ালে।”

“স্বর্গটা সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, ছবিটা সম্বন্ধে একটুও সন্দেহ ছিল না। এমন ছবি দৈবাৎ হয়। যে-দুর্লভ লগ্নে ওঁর মুখটিতে লক্ষ্মীর প্রসাদ সম্পূর্ণ নেমেছিল ঠিক সেই শুভযোগটি ওই ছবিতে ধরা পড়ে গেছে। একএকদিন রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে ওই ছবিটি দেখেছি। প্রদীপের আলোয় ওর ভিতরকার রূপটি যেন আরও বেশি করে দেখা যায়।”

“দেখো, আমার কাছে অত বাড়াবাড়ি করতে তোমার একটুও ভয় নেই?”

“ভয় যদি থাকত তাহলেই তোমার ভাবনার কথাও থাকত। ওঁকে দেখে আমার আশ্চর্য কিছুতে ভাঙে না। মনে করি আমাদের ভাগ্যে এটা সম্ভব হল কী করে? আমি যে ওঁকে বউরানী বলতে পারছি এ ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। আর উনি যে সামান্য নবীনের মতো মানুষকেও হাসিমুখে কাছে বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এও এত সহজ হল কী করে? আমাদের পরিবারের মধ্যে সব চেয়ে হতভাগ্য আমার দাদা। যাকে সহজে পেলেন তাকে কঠিন করে বাঁধতে গিয়েই হারালেন।”

“বাস্ রে, বউরানীর কথায় তোমার মুখ যখন খুলে যায় তখন থামতে চায় না।”

“মেজোবউ, জানি, তোমার মনে একটুখানি বাজে।”

“না, কক্‌খনো না।”

“হাঁ, অল্প একটু। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। নুরনগরে স্টেশনে প্রথম বউরানীর দাদাকে দেখে যে-সব কথা বলেছিলে চলতি ভাষায় তাকে ও বাড়াবাড়ি বলা চলে।”

“আচ্ছা আচ্ছ, ও-সব তর্ক থাক্, এখন কী বলতে চাচ্ছিলে বলো।”

“আমার বিশ্বাস, আজকালের মধ্যেই দাদা বউরানীকে ডেকে পাঠাবেন। বউরানী যে এত আগ্রহে বাপের বাড়ি চলে এলেন, আর তার পর থেকে এতদিন ফেরবার নাম নেই, এতে দাদার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে তা জানি। দাদা কিছুতেই বুঝতে পারেন না সোনার খাঁচাতে পাখির কেন লোভ নেই। নির্বোধ পাখি, অকৃতজ্ঞ পাখি।”

“তা ভালোই তো, বড়ঠাকুর ডেকেই পাঠান না। সেই কথাই তো ছিল।”

“আমার মনে হয়, ডাকবার আগেই বউরানী যদি যান ভালো হয়, দাদার ওইটুকু অভিমানের না-হয় জিত রইল। তা ছাড়া বিপ্রদাসবাবু তো চান বউরানী তাঁর সংসারে ফিরে যান, আমিই নিষেধ করেছিলুম।”

বিপ্রদাসের সঙ্গে এই নিয়ে আজ কী কথা হয়েছে মোতির মা তার কোনো আভাস দিলে না। বললে, “বিপ্রদাসবাবুর কাছে গিয়ে বলোই না।”

“তাই যাই, তিনি শুনলে খুশি হবেন।”

এমন সময় কুমু দরজার বাইরে থেকে বললে, “ঘরে ঢুকব কী?”

মোতির মা বললে, “তোমার ঠাকুরপো পথ চেয়ে আছেন।”

“জন্ম-জন্ম পথ চেয়ে ছিলুম, এইবার দর্শন পেলুম।”

“আঃ ঠাকুরপো, এত কথা তুমি বানিয়ে বলতে পার কী করে?”

“নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই, বুঝতে পারি নে।”

“আচ্ছা, চলো এখন খেতে যাবে।”

“খাবার আগে একবার তোমার দাদার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা কয়ে আসি গে।”

“না, সে হবে না।”

“কেন?”

“আজ দাদা অনেক কথা বলেছেন, আজ আর নয়।”

“ভালো খবর আছে।”

“তা হোক, কাল এসো বরঞ্চ। আজ কোনো কথা নয়।”

“কাল হয়তো ছুটি পাব না, হয়তো বাধা ঘটবে। দোহাই তোমার, আজ একবার কেবল পাঁচ মিনিটের জন্যে। তোমার দাদা খুশি হবেন, কোনো ক্ষতি হবে না-তাঁর।”

“আচ্ছা, আগে তুমি খেয়ে নাও, তার পরে হবে।”

খাওয়া হয়ে গেলে পর কুমু নবীনকে বিপ্রদাসের ঘরে নিয়ে এল। দেখলে দাদা তখনো ঘুমোয় নি। ঘর প্রায় অন্ধকার, আলোর শিখা ম্লান। খোলা জানলা দিয়ে তারা দেখা যায়। থেকে থেকে হু হু করে বইছে দক্ষিণের হাওয়া; ঘরের পর্দা, বিছানার ঝালর, আলনায় ঝোলানো বিপ্রদাসের কাপড় নানারকম ছায়া বিস্তার করে কেঁপে কেঁপে উঠছে, মেজের উপর খবরের কাগজের একটা পাতা যখন-তখন এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে। আধ-শোওয়া অবস্থায় বিপ্রদাস স্থির হয়ে বসে। এগোতে নবীনের পা সরে না। প্রদোষের ছায়া আর রোগের শীর্ণতা বিপ্রদাসকে একটা আবরণ দিয়েছে, মনে হচ্ছে ও যেন সংসার থেকে অনেক দূর, যেন অন্য লোকে। মনে হল ওর মতো এমনতরো একলা মানুষ আর জগতে নেই।

নবীন এসে বিপ্রদাসের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “বিশ্রামে ব্যাঘাত করতে চাই নে। একটি কথা বলে যাব। সময় হয়েছে, এইবার বউরানী ঘরে ফিরে আসবেন বলে আমরা চেয়ে আছি।”

বিপ্রদাস কোনো উত্তর করলে না, স্থির হয়ে বসে রইল।

খানিক পরে নবীন বললে, “আপনার অনুমতি পেলেই ওঁকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করি।”

ইতিমধ্যে কুমু ধীরে ধীরে দাদার পায়ের কাছে এসে বসেছে। বিপ্রদাস তার মুখের উপর দৃষ্টি রেখে বললে, “মনে যদি করিস তোর যাবার সময় হয়েছে তা হলে যা কুমু।” .

কুমু বললে, “না দাদা, যাব না।” বলে বিপ্রদাসের হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ল।

ঘর স্তব্ধ, কেবল থেকে থেকে দমকা বাতাসে একটা শিথিল জানলা খড়্ খড়্ করছে, আর বাইরে বাগানে গাছের পাতাগুলো মর্মরিয়ে উঠছে।

কুমু একটু পরে বিছানা থেকে উঠেই নবীনকে বললে, “চলো, আর দেরি নয়। দাদা, তুমি ঘুমোও।”

মোতির মা বাড়িতে ফিরে এসে বললে, “এতটা কিন্তু ভালো না।”

“অর্থাৎ চোখে খোঁচা দেওয়াটা যেমনি হোক না, চোখটা রাঙা হয়ে ওঠা একেবারেই ভালো নয়।”

“না গো না, ওটা ওঁদের দেমাক। সংসারে ওঁদের যোগ্য কিছুই মেলে না, ওঁরা সবার উপরে।”

“মেজোবউ, এতবড়ো দেমাক সবাইকে সাজে না, কিন্তু ওঁদের কথা আলাদা।”

“তাই বলে কি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করতে হবে?”

“আত্মীয়স্বজন বললেই আত্মীয়স্বজন হয় না। ওঁরা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক শ্রেণীর মানুষ। সম্পর্ক ধরে ওঁদের সঙ্গে ব্যবহার করতে আমার সংকোচ হয়।”

“যিনি যতবড়ো লোকই হোন না কেন, তবু সম্পর্কের জোর আছে এটা মনে রেখো।”

নবীন বুঝতে পারলে, এই আলোচনার মধ্যে কুমুর ’পরে মোতির মার একটুখানি ঈর্ষার ঝাঁজও আছে। তা ছাড়া এটাও সত্যি, পারিবারিক বাঁধনটার দাম মেয়েদের কাছে খুবই বেশি। তাই নবীন এ নিয়ে বৃথা তর্ক না করে বললে, “আর কিছুদিন দেখাই যাক না। দাদার আগ্রহটাও একটু বেড়ে উঠুক, তাতে ক্ষতি হবে না।”

মধুসূদনের সংসারে তার স্থানটা পাকা হয়েছে বলেই শ্যামাসুন্দরী প্রত্যাশা করতে পারত, কিন্তু সে-কথা অনুভব করতে পারছে না। বাড়ির চাকরবাকরদের ’পরে ওর কর্তৃত্বের দাবি জন্মেছে বলে প্রথমটা ও মনে করেছিল কিন্তু পদে পদে বুঝতে পারছে যে তারা ওকে মনে মনে প্রভুপদে বসাতে রাজি নয়। ওকে সাহস করে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখাতে পারলে তারা যেন বাঁচে এমনি অবস্থা। সেইজন্যেই শ্যামা তাদেরকে যখন তখন অনাবশ্যক ভর্ৎসনা ও অকারণে ফরমাশ করে, কেবলই তাদের দোষত্রুটি ধরে খিট্ খিট্ করে। বাপ-মা তুলে গাল দেয়। কিছুদিন পূর্বে এই বাড়িতেই শ্যামা নগণ্য ছিল, সেই স্মৃতিটাকে সংসার থেকে মুছে ফেলবার জন্যে খুব কড়াভাবে মাজাঘষার কাজ করতে গিয়ে দেখে যে সেটা সয় না। বাড়ির একজন পুরোনো চাকর শ্যামার তর্জন না সইতে পেরে কাজে ইস্তফা দিলে। তাই নিয়ে শ্যামাকে মাথা হেঁট করতে হল। তার কারণ, নিজের ধনভাগ্য সম্বন্ধে মধুসূদনের কতকগুলো অন্ধ সংস্কার আছে। যে-সব চাকর তার আর্থিক উন্নতির সমকালবত তাদের মৃত্যু বা পদত্যাগকে ও দুর্লক্ষণ মনে করে। অনুরূপ কারণেই সেই সময়কার একটা মসীচিহ্নিত অত্যন্ত পুরোনো ডেস্ক, অসংগতভাবে আপিস-ঘরে হাল আমলের দামি আসবাবের মাঝখানেই অসংকোচে প্রতিষ্ঠিত আছে, তার উপরে সেই সেদিনকারই দস্তার দোয়াত আর একটা সস্তা বিলিতি কাঠের কলম, যে-কলমে সে তার ব্যবসায়ের নবযুগে প্রথম বড়ো একটা দলিলে নাম-সই করেছিল। সেই সময়কার উড়ে চাকর দধি যখন কাজে জবাব দিলে মধুসূদন সেটা গ্রাহ্যই করলে না, উলটে সে-লোকটার ভাগ্যে বকশিশ জুটে গেল। শ্যামাসুন্দরী এই নিয়ে ঘোরতর অভিমান করতে গিয়ে দেখে হালে পানি পায় না। দধির হাসিমুখ তাকে দেখতে হল। শ্যামার মুশকিল এই, মধুসূদনকে সে সত্যিই ভালোবাসে, তাই মধুসূদনের মেজাজের উপর বেশি চাপ দিতে ওর সাহস হয় না, সোহাগ কোন্ সীমায় স্পর্ধায় এসে পৌঁছবে খুব ভয়ে ভয়ে তারই আন্দাজ করে চলে। মধুসূদনও নিশ্চিত জানে, শ্যামার সম্বন্ধে সময় বা ভাবনা নষ্ট করবার দরকার নেই। আদব-আবদার-ঘটিত অপব্যয়ের পরিমাণ সংকোচ করলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা অল্প। অথচ শ্যামাকে নিয়ে ওর একটা স্থূলরকম মোহ আছে, কিন্তু সেই মোহকে ষোলো আনা ভোগে লাগিয়েও তাকে অনায়াসে সামলিয়ে চলতে পারে এই আনন্দে মধুসূদন উৎসাহ পায়—এর ব্যতিক্রম হলে বন্ধন ছিঁড়ে যেত। কর্মের চেয়ে মধুসূদনের কাছে বড় কিছু নেই। সেই কর্মের জন্যে ওর সব চেয়ে দরকার অবিচলিত আত্মকতৃত্ব। তারই সীমার মধ্যে শ্যামার কর্তৃত্ব প্রবেশ করতে সাহস পায় না, অল্প একটু পা বাড়াতে গিয়ে উঁচোট খেয়ে ফিরে আসে। শ্যামা তাই কেবলই আপনাকে দানই করে, দাবি করতে গিয়ে ঠকে। টাকাকড়ি-সাজসরঞ্জামে শ্যামা চিরদিন বঞ্চিত-তার ’পরে ওর লোভের অন্ত নেই। এতেও তাকে পরিমাণ রক্ষা করে চলতে হয়। এতবড়ো ধনীর কাছে যা অনায়াসে প্রত্যাশা করতে পারত তাও ওর পক্ষে দুরাশা। মধুসূদন মাঝে মাঝে এক-একদিন খুশি হয়ে ওকে কাপড়চোপড় গহনাপত্র কিছু কিছু এনে দেয়, তাতে ওর সংগ্রহের ক্ষুধা মেটে না। ছোটোখাটো লোভের সামগ্রী আত্মসাৎ করবার জন্যে কেবলই হাত চঞ্চল হয়ে ওঠে। সেখানেও বাধা। এইরকমেরই একটা সামান্য উপলক্ষ্যে কিছুদিন আগে ওর নির্বাসনের ব্যবস্থা হয়; কিন্তু শ্যামার সঙ্গ ও সেবা মধুসূদনের অভ্যস্ত হয়ে এসেছিল—পানতামাকের অভ্যাসেরই মতো সস্তা অথচ প্রবল। সেটাতে ব্যাঘাত ঘটলে মধুসূদনের কাজেরই ব্যাঘাত ঘটবে আশঙ্কায়, এবারকার মতো শ্যামার দণ্ড রদ হল। কিন্তু দণ্ডের ভয় মাথার উপর ঝুলতে লাগল।

নিজের এইরকম দুর্বল অধিকারের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর মনে একটা আশঙ্কা লেগেই ছিল কবে আবার কুমু আপন সিংহাসনে ফিরে আসে। এই ঈর্ষার পীড়নে তার মনে একটুও শান্তি নেই। জানে কুমুর সঙ্গে ওর প্রতিঘােগিতা চলবেই না, ওরা এক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নেই। কুমু মধুসূদনের আয়ত্তের অতীত, সেইখানেই তার অসীম জোর; আর শ্যামা তার এত বেশি আয়ত্তের মধ্যে যে, তার ব্যবহার আছে মূল্য নেই। এই নিয়ে শ্যামা অনেক কান্নাই কেঁদেছে, কতবার মনে করেছে আমার মরণ হলেই বাঁচি। কপাল চাপড়ে বলেছে, এত বেশি সস্তা হলুম কেন? তার পরে ভেবেছে, সস্তা বলেই জায়গা পেলুম, যার দর বেশি তার আদর বেশি, যে সস্তা সে হয়তো সস্তা বলেই জেতে।

মধুসূদন যখন শ্যামাকে গ্রহণ করে নি, তখন শ্যামার এত অসহ্য দুঃখ ছিল না। সে আপন উপবাসী ভাগ্যকে একরকম করে মেনে নিয়েছিল। মাঝে মাঝে সামান্য খােরাককেই যথেষ্ট মনে হত। আজ অধিকার পাওয়া আর না-পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য কিছুতেই ঘটছে না। হারাই-হারাই ভয়ে মন আতঙ্কিত। ভাগ্যের রেল-লাইন এমন কাঁচা করে পাতা যে, ডিরেলের ভয় সর্বত্রই এবং প্রতি মুহূর্তেই। মােতির মার কাছে মন খােলাখুলি করে সান্ত্বনা পাবার জন্যে একবার চেষ্টা করেছিল। সে এমনি একটা ঝাঁজের সঙ্গে মাথা-ঝাঁকানি দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে যে, তার একটা কোনাে সাংঘাতিক শােধ তুলতে পারলে এখনই তুলত, কিন্তু জানে সংসার-ব্যবস্থায় মধুসূদনের কাছে মােতির মার দাম আছে, সেখানে একটুও নাড়া সইবে না। সেই অবধি দুজনের কথা বন্ধ, পারতপক্ষে মুখ-দেখাদেখি নেই। এমনি করে এ-বাড়িতে শ্যামার স্থান পূর্বের চেয়ে আরও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও তার একটুও স্বচ্ছন্দতা নেই।

এমন সময় একদিন সন্ধ্যেবেলায় শোবার ঘরে এসে দেখে, টেবিলের উপর দেয়ালে হেলানো কুমুর ফটোগ্রাফ। যে-বজ্র মাথায় পড়বে তারই বিদ্যুৎশিখা ওর চোখে এসে পড়ল। যে-মাছকে বঁড়শি বিঁধেছে তারই মত করে ওর বুকের ভিতরটা ধড়্‌ফড়্ ধড়্‌ফড়্‌ করতে লাগল। ইচ্ছা করে, ছবিটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, পারে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল, মুখ বিবর্ণ, দুই চোখে একটা দাহ, মুঠো দৃঢ় করে বন্ধ। একটা-কিছু ভাঙতে, একটা-কিছু ছিঁড়ে ফেলতে চায়। এ ঘরে থাকলে এখনই কিছু-একটা লোকসান করে ফেলবে এই ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আপনার ঘরে গিয়ে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে চাদরখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেললে।

রাত হয়ে এল। বাইরে থেকে বেহারা খবর দিলে, মহারাজ শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। বলবার শক্তি নেই যে যাব না। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে একটা বুটিদার ঢাকাই শাড়ি পরে গায়ে একটু গন্ধ মেখে গেল শোবার ঘরে। ছবিটা যাতে চোখে না পড়ে এই তার চেষ্টা। কিন্তু ঠিক সেই ছবিটার সামনেই বাতি— সমস্ত আলো যেন কারও দীপ্ত দৃষ্টির মতো ওই ছবিকে উদ্ভাসিত করে আছে। সমস্ত ঘরের মধ্যে ওই ছবিটিই সব চেয়ে দৃশ্যমান। শ্যামা নিয়মমতো পানের বাটা নিয়ে মধুসূদনকে পান দিলে, তার পরে পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যে-কোনো কারণেই হোক আজ মধুসূদন প্রসন্ন ছিল। বিলাতি দোকানের থেকে একটা রুপোর ফটোগ্রাফের ফ্রেম কিনে এনেছিল। গম্ভীরভাবে শ্যামাকে বললে, “এই নাও।” শ্যামাকে সমাদর করবার উপলক্ষ্যেও মধুসূদন মধুর রসের অবতারণায় যথেষ্ট কার্পণ্য করে। কেননা সে জানে ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিলেই ও আর মর্যাদা রাখতে পারে না। ব্রাউন কাগজে জিনিসটা মোড়া ছিল। আস্তে আস্তে কাগজের মোড়কটা খুলে ফেলে বললে, “কী হবে এটা?”

মধুসূদন বললে, “জান না, এতে ফটোগ্রাফ রাখতে হয়।”

শ্যামার বুকের ভিতরটাতে কে যেন চাবুক চালিয়ে দিলে, বললে, “কার ফটোগ্রাফ রাখবে?”

“তোমার নিজের। সেদিন যে ছবিটা তোলানো হয়েছে।”

“আমার এত সোহাগে কাজ নেই।” বলে সেই ফ্রেমটা ছুঁড়ে মেজের উপর ফেলে দিলে।

মধুসূদন আশ্চর্য হয়ে বললে, “এর মানে কী হল?”

“এর মানে কিছুই নেই।” বলে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠল, তার পরে বিছানা থেকে মেজের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল। মধুসূদন ভাবল, শ্যামার কম দামের জিনিস পছন্দ হয় নি, ওর বোধ করি ইচ্ছে ছিল একটা দামি গয়না পায়। সমস্ত দিন আপিসের কাজ সেরে এসে এই উপদ্রবটা একটুও ভালো লাগল না। এ-যে প্রায় হিস্‌টিরিয়া। হিস্‌টিরিয়ার ’পরে ওর বিষম অবজ্ঞা। খুব একটা ধমক দিয়ে বললে, “ওঠো বলছি, এখনই ওঠো!”

শ্যামা উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মধুসূদন বললে, “এ কিছুতেই চলবে না।”

মধুসূদন শ্যামাকে বিশেষ ভাবেই জানে। নিশ্চয় ঠাওরেছিল একটু পরেই ফিরে এসে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে মাপ চাইবে—সেই সময়ে খুব শক্ত করে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে হবে।

দশটা বাজল, শ্যামা এল না। আর-একবার শ্যামার ঘরের দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ এল, “মহারাজ বোলায়া।”

শ্যামা বললে, “মহারাজকে বলো আমার অসুখ করেছে।”

মধুসুদন ভাবলে, ‘আস্পর্ধা তো কম নয়, হুকুম করলে আসে না!’

মনে ঠিক করে রেখেছিল আরও খানিক বাদে আসবে। তাও এল না। এগারোটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি। বিছানা ছেড়ে মধুসূদন দ্রুতপদে শ্যামার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দেখলে ঘরে আলো নেই। অন্ধকারে বেশ দেখা গেল—শ্যামা মেজের উপর পড়ে আছে। মধুসূদন ভাবলে এ-সমস্ত কেবল আদর কাড়বার জন্যে।

গর্জন করে বললে, “উঠে এস বলছি, শীঘ্র উঠে এস। ন্যাকামি কোরো না।”

শ্যামা কিছু না বলে উঠে এল।

পরদিন আপিসে যাবার আগে খাবার পরে শোবার ঘরে বিশ্রাম করতে এসেই মধুসুদন দেখলে ছবিটি নেই। অন্য দিনের মতো আজ শ্যামা পান নিয়ে মধুসূদনের সেবার জন্যে আগে থাকতে প্রস্তুত ছিল না। সে অনুপস্থিত। তাকে ডেকে পাঠানো হল। বেশ বোঝা গেল একটু কুন্ঠিতভাবেই সে এল। মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “টেবিলের উপর ছবি ছিল, কী হল।”

শ্যামা অত্যন্ত বিস্ময়ের ভান করে বললে, “ছবি! কার ছবি?”

ভানের পরিমাণটা কিছু বেশি হয়ে পড়ল। সাধারণত পুরুষদের বুদ্ধিবৃত্তির পরে মেয়েদের অশ্রদ্ধা আছে বলেই এতটা সম্ভব হয়েছিল।

মধুসূদন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, “ছবিটা দেখ নি।”

শ্যামা নিতান্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললে, “না, দেখি নি তো।”

মধুসূদন গর্জন করে বলে উঠল, “মিথ্যে কথা বলছ।”

“মিথ্যে কথা কেন বলব, ছবি নিয়ে আমি করব কী।”

“কোথায় রেখেছ বের করে নিয়ে এস বলছি! নইলে ভালাে হবে না।”

“ওমা! কী আপদ! তােমার ছবি আমি কোথায় পাব যে বের করে আনব।”

বেহারাকে ডাক পড়ল। মধু তাকে বললে, “মেজোবাবুকে ডেকে আন্।”

নবীন এল। মধুসূদন বললে, “বড়ােবউকে আনিয়ে নাও।”

শ্যামা মুখ বাঁকিয়ে কাঠের পুতুলের মতাে চুপ করে বসে রইল।

নবীন খানিকক্ষণ পরে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, “দাদা, ওখানে একবার কি তােমার নিজে যাওয়া উচিত হবে না? তুমি আপনি গিয়ে যদি বল তা হলে বউরানী খুশি হবেন।”

মধুসূদন গম্ভীরভাবে খানিকক্ষণ গুড়্‌গুড়ি টেনে বললে, “আচ্ছা, কাল রবিবার আছে, কাল যাব।”

নবীন মােতির মার কাছে এসে বললে, “একটা কাজ করে ফেলেছি।”

“আমার পরামর্শ না নিয়েই।”

“পরামর্শ নেবার সময় ছিল না।”

“তাহলে তাে দেখছি তােমাকে পস্তাতে হবে।”

“অসম্ভব নয়। কুষ্টিতে আমার বুদ্ধিস্থানে আর কোনাে গ্রহ নেই, আছেন নিজের স্ত্রী। এইজন্য সর্বদা তােমাকে হাতের কাছে রেখেই চলি। ব্যাপারটা হচ্ছে এই—দাদা আজ হুকুম করলেন বউরানীকে আনানাে চাই। আমি ফস করে বলে বসলেম, তুমি নিজে গিয়ে যদি কথাটা তোল ভালাে হয়। দাদা কী মেজাজে ছিলেন রাজি হয়ে গেলেন। তার পর থেকেই ভাবছি এর ফলটা কী হবে।”

“ভালো হবে না। বিপ্রদাসবাবুর যে-রকম ভাবখানা দেখলুম কী বলতে কী বলবেন, শেষকালে কুরুক্ষেত্রের লড়াই বেধে যাবে। এমন কাজ করলে কেন?”

“প্রথম কারণ, বুদ্ধির কোঠা ঠিক সেই সময়টাতেই শূন্য ছিল, তুমি ছিলে অন্যত্র। দ্বিতীয় হচ্ছে, সেদিন বউরানী যখন বললেন, আমি যাব না, তার ভিতরকার মানেটা বুঝেছিলুম। তাঁর দাদা রুগ্ন শরীর নিয়ে কলকাতায় এলেন, তবু এক দিনের জন্যে মহারাজ দেখতে গেলেন না—এই অনাদরটা তাঁর মনে সব চেয়ে বেজেছিল।”

শুনেই মোতির মা একটু চমকে উঠল, কথাটা কেন যে আগে তার মনে পড়ে নি এইটেই তার আশ্চর্য লাগল। আসলে নিজের অগোচরেও শ্বশুরবাড়ির মাহাত্ম্য নিয়ে ওর একটা অহংকার আছে। অন্য সাধারণ লোকের মতো মহারাজ মধুসূদনেরও কুটুম্বিতার দায়িত্ব আছে এ-কথা তার মন বলে না।

সেদিনকার তর্কের অনুবৃত্তিস্বরূপে নবীন একটুখানি টিপ্পনী দিয়ে বললে, “নিজের বুদ্ধিতে কথাটা আমার হয়তো মনে আসত না, তুমিই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলে।”

“কী রকম শুনি?”

“ওই-যে সেদিন বললে, কুটুম্বিতার দায়িত্ব আত্মমর্যাদার দায়িত্বের চেয়েও বড়। তাই মনে করতে সাহস হল যে মহারাজার মতো অতবড় লোকের ও বিপ্রদাসবাবুকে দেখতে যাওয়া উচিত।”

মোতির মা হার মানতে রাজি নয়, কথাটাকে উড়িয়ে দিলে, “কাজের সময় এত বাজে কথাও বলতে পার! কী করা উচিত এখন সেই কথাটা ভাবো দেখি।”

“গোড়াতেই সকল কথার শেষ পর্যন্ত ভাবতে গেলে ঠকতে হয়। আশু ভাবা উচিত প্রথম কর্তব্যটা কী। সেটা হচ্ছে বিপ্রদাসবাবুকে দাদার দেখতে যাওয়া। দেখতে গিয়ে তার ফলে যা হতে পারে তার উপায় এখনই চিন্তা করতে বসলে তাতে চিন্তাশীলতার পরিচয় দেওয়া হবে, কিন্তু সেটা হবে অতিচিন্তাশীলতা।”

“কী জানি আমার বোধ হচ্ছে মুশকিল বাধবে।”
সেদিন সকালে অনেকক্ষণ ধরে কুমু তার দাদার ঘরে বসে গানবাজনা করেছে। সকালবেলাকার সুরে নিজের ব্যক্তিগত বেদনা বিশ্বের জিনিস হয়ে অসীমরূপে দেখা দেয়। তার বন্ধনমুক্তি ঘটে। সাপ গুলো যেন মহাদেবের জটায় প্রকাশ পায় ভূষণ হয়ে। ব্যথার নদীগুলি ব্যথার সমুদ্রে গিয়ে বৃহৎ বিরাম লাভ করে। তার রূপ বদলে যায়, চঞ্চলতা লুপ্ত হয় গভীরতায়। বিপ্রদাস নিশ্বাস ছেড়ে বললে, “সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয় কুমু, চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানে চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে, তাতেই মন মুক্তি পায়।”

এমন সময়ে খবর এল, “মহারাজ মধুসূদন এসেছেন।”

এক মুহূর্তে কুমুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল; তাই দেখে বিপ্রদাসের মনে বড়ো বাজল, বললে, “কুমু তুই বাড়ির ভিতরে যা। তোকে হয়তো দরকার হবে না।”

কুমু দ্রুতপদে চলে গেল। মধুসূদন ইচ্ছে করেই খবর না দিয়েই এসেছে। এ-পক্ষ আয়োজনের দৈন্য ঢাকা দেবার অবকাশ না পায় এটা তার সংকল্পের মধ্যে। বড়ো ঘরের লোক ব’লে বিপ্রদাসের মনের মধ্যে একটা বড়াই আছে ব’লে মধুসূদনের বিশ্বাস। সেই কল্পনাটা সে সইতে পারে না। তাই আজ সে এমনভাবে এল যেন দেখা করতে আসে নি, দেখা দিতে এসেছে।

মধুসূদনের সাজটা ছিল বিচিত্র, বাড়ির চাকর-দাসীরা অভিভূত হবে এমনতরো বেশ। ডোকাটা বিলিতি শার্টের উপর একটা রঙিন ফুলকাটা সিল্কের ওয়েস্ট্ কোট, কাঁধের উপর পাট-করা চাদর, যত্নেকোঁচানো কালাপেড়ে শান্তিপুরে ধুতি, বার্নিশ-করা কালো দরবারি জুতো, বড়ো বড়ো হীরেপান্না ওআলা আংটিতে আঙুল ঝলমল করছে। প্রশস্ত উদরের পরিধি বেষ্টন করে মোটা সোনার ঘড়ির শিকল, হাতে একটি শৌখিন লাঠি, তার সোনার হাতলটি হাতির মুণ্ডের আকারে নানা জহরতে খচিত। একটা অসমাপ্ত নমস্কারের দ্রুত আভাস দিয়ে খাটের পাশের একটা কেদারায় বসে বললে, “কেমন আছেন বিপ্রদাসবাবু, শরীরটা তো তেমন ভালো দেখাচ্ছে না।”

বিপ্রদাস তার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে, “তোমার শরীর ভালোই আছে দেখছি।”

“বিশেষ ভালো যে তা বলতে পারি নে— সন্ধ্যের দিকটা মাথা ধরে, আর খিদেও ভালো হয় না। খাওয়াদাওয়ার অল্প একটু অযত্ব হলেই সইতে পারি নে। আবার অনিদ্রাতেও মাঝে মাঝে ভুগি, ওইটেতে সব চেয়ে দুঃখ দেয়।”

শুশ্রূষার লোকের যে সর্বদা দরকার তারই ভুমিকা পাওয়া গেল।

বিপ্রদাস বললে, “বোধ করি আপিসের কাজ নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।”

“এমনিই কী! আপিসের কাজকর্ম আপনিই চলে যাচ্ছে, আমাকে বড়ো কিছু দেখতে হয় না। ম্যাক্‌নটন সাহেবের উপরেই বেশির ভাগ কাজের ভার, সার আর্থর পীবডিও আমাকে অনেকটা সাহায্য করেন।

গুড়গুড়ি এল, পানের বাটায় পান ও মসলা নিয়ে চাকর এসে দাঁড়াল, তার থেকে একটি ছোটো এলাচ নিয়ে মুখে পুরল, আর কিছু নিলে না। গুড়গুড়ির নল নিয়ে দুই-একবার মৃদু মৃদু টান দিলে। তার পরে গুড়গুড়ির নলটা বাঁ হাতে কোলের উপরেই ধরা রইল। আর তার ব্যবহার হল না। অন্তঃপুর থেকে খবর এল, জলখাবার প্রস্তুত। ব্যস্ত হয়ে বললে, “ওইটি তো পারব না। আগেই তো বলেছি, খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে খুব ধরকাট করেই চলতে হয়।”

বিপ্রদাস দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলে না। চাকরকে বললে, “পিসিমাকে বলে গে, ওঁর শরীর ভালো নেই, খেতে পারবেন না।”

বিপ্রদাস চুপ করে রইল। মধুসূদন আশা করেছিল, কুমুর কথা আপনিই উঠবে। এতদিন হয়ে গেল, এখন কুমুকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব বিপ্রদাস আপনিই উদ্বিগ্ন হয়ে করবে—কিন্তু কুমুর নামও করে না যে। ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে রাগ জন্মাতে লাগল। ভাবলে এসে ভুল করেছি। সমস্ত নবীনের কাণ্ড। এখনই গিয়ে তাকে খুব একটা কড়া শাস্তি দেবার জন্যে মনটা ছট্‌ফট্‌ করতে লাগল।

এমন সময় সাদাসিধে সরু কালাপেড়ে একখানি শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা টেনে কুমু ঘরে প্রবেশ করলে। বিপ্রদাস এটা আশা করে নি। সে আশ্চর্য হয়ে গেল। প্রথমে স্বামীর, পরে দাদার পায়ের ধুলো নিয়ে কুমু মধুসূদনকে বললে, “দাদার শরীর ক্লান্ত, ওঁকে বেশি কথা কওয়াতে ডাক্তারের মানা। তুমি এই পাশের ঘরে এস।”

মধুসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে পড়ল। কোল থেকে গুড়গুড়ির নলটা মাটিতে পড়ে গেল। বিপ্রদাসের মুখের দিকে না চেয়েই বললে, “আচ্ছা, তবে আসি।”

প্রথম ঝোঁকটা হল হন্ হন্ করে গাড়িতে উঠে বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু মন পড়েছে বাঁধা। অনেক দিন পরে আজ কুমুকে দেখেছে। ওকে অত্যন্ত সাদাসিধে আটপৌরে কাপড়ে এই প্রথম দেখলে। ওকে এত সুন্দর আর কখনাে দেখে নি। এমন সংযত, এত সহজ। মধুসূদনের বাড়িতে ও ছিল পােশাকি মেয়ে, যেন বাইরের মেয়ে, এখানে সে একেবারে ঘরের মেয়ে। আজ যেন ওকে অত্যন্ত কাছের থেকে দেখা গেল। কী স্নিগ্ধ মূর্তি। মধুসূদনের ইচ্ছে করতে লাগল, একটু দেরি না করে এখনই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ও আমার, ও আমারই, ও আমার ঘরের, আমার ঐশ্বর্যের, আমার সমস্ত দেহমনের, এই কথাটা উলটেপালটে বলতে ইচ্ছে করে।

পাশের ঘরে একটা সােফা দেখিয়ে কুমু যখন বসতে বললে তখন ওকে বসতেই হল। নিতান্ত যদি বাইরের ঘর না হত তা হলে কুমুকে ধরে সােফায় আপনার পাশে বসাত। কুমু না বসে একটা চৌকির পিছনে তার পিঠের উপর হাত রেখে দাঁড়াল। বললে, “আমাকে কিছু বলতে চাও?”

ঠিক এমন সুরে প্রশ্নটা মধুসূদনের ভালাে লাগল না, বললে, “যাবে না বাড়িতে?”

“না।”

মধুসূদন চমকে উঠল—বললে, “সে কী কথা!”

“আমাকে তােমার তাে দরকার নেই।”

মধুসূদন বুঝলে, শ্যামাসুন্দরীর খবরটা কানে এসেছে, এটা অভিমান। অভিমানটা ভালোই লাগল। বললে, “কী যে বল তার ঠিক নেই। দরকার নেই তাে কী। শূন্য ঘর কি ভালাে লাগে?”

এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি করতে কুমুর প্রবৃত্তি হল না। সংক্ষেপে আরএকবার বললে, “আমি যাব না।”

“মানে কী? বাড়ির বউ বাড়িতে যাবে না—?”

কুমু সংক্ষেপে বললে, “না।”

মধুসূদন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “কী! যাবে না! যেতেই হবে!”

কুমু কোনো জবাব করলে না। মধুসূদন বললে, “জান পুলিস ডেকে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি ঘাড়ে ধরে! ‘না’ বললেই হল?”

কুমু চুপ করে রইল। মধুসূদন গর্জন করে বললে, “দাদার স্কুলে নুরনগরি কায়দা শিক্ষা আবার আরম্ভ হয়েছে?”

কুমু দাদার ঘরের দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বললে, “চুপ করো, অমন চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না।”

“কেন? তোমার দাদাকে সামলে কথা কইতে হবে নাকি? জান এই মুহূর্তে ওকে পথে বার করতে পারি।”

পরক্ষণেই কুমু দেখে ওর দাদা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘকায়, শীর্ণদেহ, পাণ্ডুবর্ণ মুখ, বড়ো বড়ো চোখদুটো জ্বালাময়, একটা মোটা সাদা চাদর গা ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কুমুকে ডেকে বললে, “আয় কুমু, আয় আমার ঘরে।”

মধুসূদন চেঁচিয়ে উঠল, বললে, “মনে থাকবে তোমার এই আস্পর্ধা! তোমার নুরনগরের নুর মুড়িয়ে দেব তবে আমার নাম মধুসূদন।”

ঘরে গিয়েই বিপ্রদাস বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করলে, কিন্তু ঘুমে নয়, ক্লান্তিতে ও চিন্তায়। কুমু শিয়রের কাছে বসে পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। এমনি করে অনেকক্ষণ কাটলে পর ক্ষেমা পিসি এসে বললে, “আজ কি খেতে হবে না কুমু? বেলা যে অনেক হল।”

বিপ্রদাস চোখ খুলে বললে, “কুমু, যা খেতে যা। তোর কালুদাকে পাঠিয়ে দে।”

কুমু বললে, “দাদা, তোমার পায়ে পড়ি, এখন কালুদাকে না, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করে।”

বিপ্রদাস কিছু না বলে সুগভীর বেদনার দৃষ্টিতে কুমুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক বাদে নিশ্বাস ফেলে আবার চোখ বুজলে। কুমু ধীরে ধীরে বেরিয়ে গিয়ে দরজা দিল ভেজিয়ে।

একটু পরেই কালু খবর পাঠাল যে আসতে চায়। বিপ্রদাস উঠে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসল। কালু বললে, “জামাই এসে অল্পক্ষণ পরেই তো চলে গেল। কী হল বলো তো। কুমুকে ওদের ওখানে ফিরে নিয়ে যাবার কথা কিছু বললে কি?”

“হাঁ। বলেছিল। কুমু তার জবাব দিয়েছে, সে যাবে না।”

কালু বিষম ভীত হয়ে বললে, “বল কী দাদা! এ যে সর্বনেশে কথা!”

“সর্বনাশকে আমরা কোনোকালে ভয় করি নে, ভয় করি অসম্মানকে।”

“তা হলে তৈরি হও, আর দেরি নেই। রক্তে আছে, যাবে কোথায়। জানি যে, তোমার বাবা ম্যাজিস্ট্রেটকে তুচ্ছ করতে গিয়ে অন্তত দু-লাখ টাকা লোকসান করেছিলেন। বুক ফুলিয়ে নিজের বিপদ ঘটানো, ও তোমাদের পৈতৃক শখ। ওটা অন্তত আমার বংশে নেই, তাই তোমাদের সাংঘাতিক পাগলামিগুলো চুপ করে সইতে পারি নে। কিন্তু বাঁচব কী করে?”

বিপ্রদাস উঁচু বাঁ হাঁটুর উপর ডান পা তুলে দিয়ে তাকিয়ায় মাথা রেখে চোখ বুজে খানিকক্ষণ ভাবলে। অবশেষে চোখ খুলে বললে, “দলিলের শর্ত অনুসারে মধুসূদন ছ-মাস নোটিশ না দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা দাবি করতে পারে না। ইতিমধ্যে সুবোধ আষাঢ় মাসের মধ্যেই এসে পড়বে— তখন একটা উপায় হতে পারবে।

কালু একটু বিরক্ত হয়েই বললে, “উপায় হবে বইকি। বাতিগুলো এক দমকায় নিবত, সেইগুলো একে একে ভদ্ররকম করে নিববে।”

“বাতি তলার খোপটার মধ্যে এসে জ্বলছে, এখন যে-ফরাস এসে তাকে যে-রকম ফুঁ দিয়েই নেবাক না—তাতে বেশি হা-হুতাশ করবার কিছু নেই। ওই তলানির আলোটার তদ্বির করতে আর ভালো লাগে না, ওর চেয়ে পুরো অন্ধকারে সোয়াস্তি পাওয়া যায়।”

কালুর বুকে ব্যথা বাজল। সে বুঝলে, এটা অসুস্থ মানুষের কথা, বিপ্রদাস তো এ-রকম হালছাড়া প্রকৃতির লোক নয়; পরিণামটাকে ঠেকাবার জন্যে বিপ্রদাস এতদিন নানারকম প্ল্যান করছিল। তার বিশ্বাস ছিল কাটিয়ে উঠবে। আজ ভাবতেও পারে না—বিশ্বাস করবারও জোর নেই।

কালু স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে বিপ্রদাসের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না ভাই, যা করবার আমিই করব। যাই একবার দালাল-মহলে ঘুরে আসি গে।”

পরদিন বিপ্রদাদের কাছে এক ইংরেজি চিঠি এল। মধুসূদনের লেখা। ভাষাটা ওকালতি ছাঁদের—হয়তো বা অ্যাটর্নিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। নিশ্চিত করে জানতে চায় কুমু ওদের ওখানে ফিরে আসবে কি না, তার পরে যথাকর্ত‌ব্য করা হবে।

বিপ্রদাস কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “কুমু, ভালো করে সব ভেবে দেখেছিস?”

কুমু বললে, “ভাবনা সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছি, তাই আমার মন আজ খুব নিশ্চিন্ত। ঠিক মনে হচ্ছে, যেমন এখানে ছিলাম তেমনি আছি—মাঝে যা-কিছু ঘটেছে সমস্ত স্বপ্ন।”

“যদি তোকে জোর করে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়, তুই জোর করে সামলাতে পারবি?”

“তোমার উপর উৎপাত যদি না হয় তো খুব পারব।”

“এইজন্যে জিজ্ঞাসা করছি যে, যদি শেষকালে ফিরে যেতেই হয় তা হলে যত দেরি করে যাবি ততই সেটা বিশ্রী হয়ে উঠবে। ওদের সঙ্গে সম্বন্ধ সূত্র তোর মনকে কোথাও কিছুমাত্র জড়িয়েছে কি?”

“কিছুমাত্র না। কেবল আমি নবীনকে, মোতির মাকে, হাবলুকে ভালোবাসি। কিন্তু তারা ঠিক যেন অন্য বাড়ির লোক।”

“দেখ্ কুমু, ওরা উৎপাত করবে। সমাজের জোরে, আইনের জোরে উৎপাত করবার ক্ষমতা ওদের আছে। সেইজন্যেই সেটাকে অগ্রাহ্য করা চাই। করতে গেলেই লজ্জা সংকোচ ভয় সমস্ত বিসর্জন দিয়ে লোকসমাজের সামনে দাঁড়াতে হবে, ঘরে-বাইরে চারি দিকে নিন্দের তুফান উঠবে, তার মাঝখানে মাথা তুলে তোর ঠিক থাকা চাই।”

“দাদা, তাতে তোমার অনিষ্ট, তোমার অশান্তি হবে না?”

“অনিষ্ট অশান্তি কাকে তুই বলিস কুমু? তুই যদি অসম্মানের মধ্যে ডুবে থাকিস তার চেয়ে অনিষ্ট আমার আর কী হতে পারে? যদি জানি যে, যে-ঘরে তুই আছিস সে তোর ঘর হয়ে উঠল না, তোর উপর যার একান্ত অধিকার সে তোর একান্ত পর, তবে আমার পক্ষে তার চেয়ে অশান্তি ভাবতে পারি নে। বাবা তোকে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু তখনকার দিনে কর্তারা থাকতেন দূরে দূরে। তোর পক্ষে পড়াশুনোর দরকার আছে তা তিনি মনেই করতেন না। আমিই নিজে গোড়া থেকে তোকে শিখিয়েছি, তোকে মানুষ করে তুলেছি। তোর বাপ-মার চেয়ে আমি কোনো অংশে কম না। সেই মানুষ করে তোলার দায়িত্ব যে কী আজ তা বুঝতে পারছি। তুই যদি অন্য মেয়ের মতো হতিস তা হলে কোথাও তোর ঠেকত না। আজ যেখানে তোর স্বাতন্ত্র্যকে কেউ বুঝবে না, সম্মান করবে না, সেখানে যে তোর নরক। আমি কোন্ প্রাণে তোকে সেখানে নির্বাসিত করে থাকব? যদি আমার ছোটো ভাই হতিস তা হলে যেমন করে থাকতিস তেমনি করেই চিরদিন থাক্‌-না আমার কাছে।”

দাদার বুকের কাছে খাটের প্রান্তে মাথা রেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কুমু বললে, “কিন্তু আমি তোমদের তো ভার হয়ে থাকব না? ঠিক বলছ?”

কুমুর মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বিপ্রদাস বললে, “ভার কেন হবি বোন? তোকে খুব খাটিয়ে নেব। আমার সব কাজ দেব তোর হাতে। কোনো প্রাইভেট সেক্রেটারি এমন করে কাজ করতে পারবে না। আমাকে তোর বাজনা শোনাতে হবে, আমার ঘোড়া তোর জিম্মেয় থাকবে। তা ছাড়া জানিস আমি শেখাতে ভালোবাসি। তোর মতো ছাত্রী পাব কোথায় বল? এক কাজ করা যাবে, অনেক দিন থেকে পারসি পড়বার শখ আমার আছে। একলা পড়তে ভালো লাগে না। তোকে নিয়ে পড়ব, তুই নিশ্চয় আমার চেয়ে এগিয়ে যাবি, আমি একটুও হিংসে করব না দেখিস।”

শুনতে শুনতে কুমুর মন পুলকিত হয়ে উঠল, এর চেয়ে জীবনে সুখ আর কিছু হতে পারে না।

খানিক পরে বিপ্রদাস আবার বললে, “আরও একটা কথা তোকে বলে রাখি কুমু, খুব শীঘ্রই আমাদের কাল বদল হবে, আমাদের চালও বদলাবে। আমাদের থাকতে হবে গরিবের মতো। তখন তুই থাকবি আমাদের গরিবের ঐশ্বর্য হয়ে।”

কুমুর চোখে জল এল, বললে, “আমার এমন ভাগ্য যদি হয় তো বেঁচে যাই।”

বিপ্রদাস মধুসূদনের চিঠি হাতে রাখলে, উত্তর দিলে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress