Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যেটুকু টুনটুনি সেটুকু ছোটাচ্চু || Muhammad Zafar Iqbal » Page 3

যেটুকু টুনটুনি সেটুকু ছোটাচ্চু || Muhammad Zafar Iqbal

টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে অন্যমনস্কভাবে স্কুলের মাঠের দিকে তাকিয়ে ছেলেমেয়েদের চিৎকার চেঁচামেচি করে খেলতে দেখছিল। তাই প্রথমে লক্ষ করেনি একটা মেয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বয়সে তার থেকে তিন চার বছর ছোট হবে, নার্ভাসভাবে তার জামার একটা অংশ হাতে পেচাচ্ছে আবার খুলে ফেলছে। মেয়েটা মনে হয় তাকে কিছু একটা বলতে এসেছে কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। টুনি কাজটা সহজ করার জন্য নিজেই কথা বলতে শুরু করল। জিজ্ঞেস করল, “কী খবর তোমার? তুমি কোন ক্লাসে পড়?”

মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্লাস ফোর।”

মেয়েটা ঠিক চোখের দিকে তাকিয়েও কথার উত্তর দিচ্ছে না। তাকে আরেকটু সহজ করে দেওয়ার জন্য টুনি মুখটা হাসিহাসি করে বলল, “আমরা যখন ক্লাশ ফোরে পড়তাম তখন উঁচু ক্লাশের ছেলেমেয়েরা আমাদের বলতো

ক্লাশ ফোর জুতা চোর! তোমাদেরকে বলে না?”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, “নাহ্।”

“তাহলে কী বলে?”

“কিছুই বলে না। জানেই না আমরা কোন ক্লাশে পড়ি!”

টুনি হাসার মতো ভঙ্গী করল, বলল, “সেটা হতে পারে। নিজের ক্লাশের ছাড়া অন্য কাউকে চিনে না।”

মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলছেও না আবার চলেও যাচ্ছে না তাই টুনি আবার চেষ্টা করল। বলল, “তোমার নাম কী?”

মেয়েটা হঠাৎ করে মাথা তুলে দুই পাশে দেখল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মিশু।”

টুনি বলল, “ইন্টারেস্টিং! এই নামটা ছেলেদেরও হয় মেয়েদেরও হয়। আমি একটা ছেলেকে জানি যার নাম মিশু।”

মেয়েটা হঠাৎ চাপা গলায় বলল, “আমার ক্লাশের ছেলেমেয়েরা আমাকে মিশু ডাকে না।”

“কী ডাকে?”

“মোষ।”

টুনি চমকে উঠল, “কেন?”

“আমি নাকি মোষের মতো কালো আর মোটা।” মিশু নামের মেয়েটা তার হাত দিয়ে চোখ মুছল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। টুনি হঠাৎ করে বুঝতে পারল মেয়েটা কেন তার কাছে এসেছে। কাজেই এক মুহূর্তে তুমি থেকে সে তুইয়ে নেমে এলো। নরম গলায় বলল, “আয়। আমার কাছে এসে বস।”

বলে তার হাত ধরে টেনে তাকে কাছে বসাল। বলল, “চোখ মুছে ফেল। তোর ক্লাশের ছেলেমেয়েরা যদি বোকা হয়, তারা যদি না জানে একটা মানুষ মোটা না চিকন, কালো না সাদা, লম্বা না বেঁটে তাতে কিছু আসে যায় না তাহলে সেটা কী তোর দোষ? তোর চোখে কেন পানি আসবে বোকা মেয়ে?”

টুনির নরম গলার স্বর শুনে মেয়েটা এবারে সত্যি সত্যি ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের ক্লাশের সব ছেলেমেয়ে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, খারাপ কথা বলে– আমি আর ক্লাশে আসতে চাই না।’

টুনি মেশিনের মতো চিন্তা করতে থাকে, এরকম একটা ব্যাপার হলে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়? তার মাথায় কিছু এলো না। তাই এরকম সময়ে যা বলতে হয় তাই বলল, “মিশু, তুই এক্ষুণি কান্না বন্ধ কর না হলে আমিও কেঁদে ফেলব কিন্তু।”

মিশু চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। টুনি নিচু গলায় বলল, “তুই আমার উপর ছেড়ে দে। তোদের ক্লাশের যেসব ছেলেমেয়েরা তোর সাথে এরকম ব্যবহার করে তাদের আমি টাইট করে ছেড়ে দেব। তুই আমাকে চিনিস নাই।”

মিশু নিজেকে শান্ত করে বলল, “চিনেছি আপু, সেই জন্যেই তো তোমার কাছে এসেছি। তুমি কীভাবে টাইট করবে আপু?”

টুনি কীভাবে একটা ক্লাশের সব ছেলেমেয়েকে টাইট করবে সেটা সে নিজেও জানে না, আসলেই সেটা সম্ভব কিনা সেটাও সে জানে না কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। আপাতত মেয়েটাকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে দেওয়া জরুরি। টুনি গম্ভীর গলায় বলল, “অনেকগুলো উপায় আছে, তোদের ক্লাশে কোনটা করতে হবে সেটা দেখতে হবে। তুই কি বলবি, তোর ক্লাশের ছেলেমেয়েরা কেমন করে তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাকি সেটা বলতে গিয়ে আবার কেঁদে ফেলবি?”

“মনে হয় কেঁদে ফেলব।”

“তাহলে বলার দরকার নাই। আমি জিজ্ঞেস করি তুই হুঁ হা করে উত্তর দে।”

“হুঁ হা করে?” বলে মিশু একটু হেসে ফেলল।

“হ্যাঁ, হুঁ হা করে।” টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারা কী তোর গায়ে হাত দেয়? তোকে মারার চেষ্টা করে?”

“মাঝে মাঝে। পিছন থেকে চুল ধরে টানে। মাথার মাঝে মাথায় চাটি মারে।”

“তুই তখন কী করিস?”

“কী করব? কিছু করি না। সরে যাই। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলি।”

টুনি হতাশভাবে মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোকে কি গালাগাল করে?”

“করে। আমাকে নিয়ে কবিতা বলে।

“কী কবিতা?”

“কালা মোটা মোষ

করে ফোঁস ফোঁস।”

“তখন তুই কী করিস?”

মিশু প্রায় কেঁদেই ফেলছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, “কী করব? কিছু করি না। সরে যাই। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলি ৷”

টুনি আবার মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক বড় ভুল করিস। অনেক বড় ভুল। অনেক অনেক বড় ভুল!”

মিশু ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কোনটা বড় ভুল?”

“ঐ যে তুই কেঁদে ফেলিস, সেইটা অনেক বড় ভুল। রেগে যাওয়া ঠিক আছে, কিন্তু কেঁদে যাওয়া ঠিক নাই। তুই যেহেতু কেঁদে ফেলিস তাই সবাই মজা পেয়ে গেছে। তারা তোকে কাঁদিয়ে আনন্দ পায়

“তাহলে আমি কী করব?”

“আর যাই করিস কাঁদতে পারবি না। তোর মন খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে দিবি না যে তোর মন খারাপ হয়েছে। তাছাড়া–”

“তাছাড়া কী?”

“তাছাড়া তোর মন খারাপ হওয়ার কী আছে? তোর বন্ধুরা যদি ছাগল হয় তাহলে তোর কেন মন খারাপ হবে? তুই যখন দেখিস রাস্তায় একটা ছাগল কলার ছিলকা খাচ্ছে তোর কী তখন মন খারাপ হয়?”

মিশু মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“তোর একটু মায়া হতে পারে, বেচারা ছাগলটা ময়লা একটা কলার ছিলকা খাচ্ছে, ভালো কিছু খেতে পারছে না! আহা বেচারা ছাগল!”

মিশু খানিকক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “তাহলে আমি কী করব?”

“ওদের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকা করে হাসতে পারিস!”

মিশু অবাক হয়ে বলল, “হাসব?”

“নরমাল হাসি না। এবনরমাল হাসি। বাঁকা হাসি ৷ সিনেমায় ভিলেনরা যেভাবে হাসে।

“সেটা কী রকম?”

“এই যে এই রকম–” বলে টুনি বাঁকা হাসি কীভাবে হাসতে হয় সেটা দেখিয়ে দিল। মুখের এক পাশ দিয়ে ঠোঁট দুটো একটু উপরে তুলে ভয়ংকর এক ধরনের হাসি।

মিশু কয়েকবার চেষ্টা করল এবং টুনি তাকে ঠিক করে দিতে লাগল। মিশু বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো একটা বাঁকা হাসি দেওয়া শিখে ফেলল। টুনি মাথা নেড়ে বলল, “বাসায় গিয়ে আয়নার সামনে প্র্যাকটিস করবি তাহলে আরো ভালো হবে। এরপর থেকে যখনই কেউ তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে তুই তার দিকে তাকিয়ে এমন একটা বাঁকা হাসি দিবি যেন তার পেটের ভাত চাউল হয়ে যায়!”

‘পেটের ভাত চাউল হয়ে যায়’ কথাটা মিশুর খুব পছন্দ হলো, সে এটা শুনে হি হি করে একটু হাসল।

টুনি বলল, “ঠিক আছে, আজকে তাহলে এই পর্যন্ত। কালকে আবার আলোচনা হবে। টিফিনের ছুটিতে এখানে চলে আসবি।’

“ঠিক আছে।”

“এখনও কী তোর মন খারাপ লাগছে?”

“না আপু, মনটা অনেক ভালো হয়েছে।”

“গুড। রেগে যাওয়া ঠিক আছে, মন খারাপ করা ঠিক নাই টুনি তারপর হাত উপরে তুলে বলল, “হাই ফাইভ!”

মিশু সেই হাতে থাবা দিয়ে বলল, “হাই ফাইভ!”

টুনি যখনই এরকম জটিল একটা সমস্যায় পড়ে তখনই সে সেটা নিয়ে সবার সাথে কথা বলে। সাধারণত সে শুরু করে ঝুমু খালাকে দিয়ে। তার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ভালো কোনো সমাধান আসেনি, কিন্তু ঝুমু খালা সবসময়েই কোনো-না-কোনো সমাধান দিয়েছে। যত আজগুবিই হোক একটা সমাধান তাতে সন্দেহ নাই।

আজকেও বাসায় ফিরে ঝুমু খালাকে খুঁজে বের করল, ঝুমু খালা ছাদে টবে পানি দিচ্ছিল। টুনিকে দেখে হুংকার দিয়ে বলল, “তোমরা পাইছটা কী?”

টুনি থতমত খেয়ে বলল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?

“এই যে টবে এতোগুলা গাছ, কোনো টবে কোনো পানি নাই। পাতাগুলা শুকায়া দড়ি দড়ি হইছে, মাটি শুকাইয়া পাখর। গাছে যে বদদোয়া দেয় সেইটা জান? বাড়িতে গাছ লাগাইবা কিন্তু পানি দিবা না সেইটা কোন দেশি কাম?”

দোষটা যে টুনির তা নয়, কিন্তু ঝুমু খালার সাথে এসব বিষয়ে তর্ক করা খুব বিপজ্জনক। টুনি দোষটা মেনে নিয়ে বলল, “সরি ঝুমু খালা। এখন থেকে দিব। একটা রুটিন করে ফেলব কে কোনদিন পানি দেবে।”

ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “গাছে পানি দিতে যদি রুটিং করতে হয় তা হইলে তো বিপদ। উপরে উইঠা যেই দেখব টব শুকনা সেই পানি দিব, তা হইলেই তো সমস্যা সমাধান!”

শব্দটা যে ‘রুটিং’ না, শব্দটা ‘রুটিন’ সেটা ঝুমু খালাকে জানানো ঠিক হবে কিনা টুনি বুঝতে পারল না। এখন যেহেতু মেজাজ গরম তাই না জানানোই ভালো। টুনি কাজের কথায় চলে এল, বলল, “ঝুমু খালা আমি তোমার কাছে আরেকটা সমস্যা নিয়ে এসেছি, তুমি সমাধান দিতে পারবে?”

ঝুমু খালা টবে পানি দেওয়া বন্ধ করে গম্ভীর মুখে বলল, “কী সমস্যা?”

“আমাদের স্কুলে একটা মেয়ে আছে, ক্লাশের সব ছেলেমেয়ে তাকে জ্বালায়। তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। সেইটা নিয়ে মেয়েটার মনে খুব দুঃখ। এখন এই মেয়েটা কী করবে?”

‘দোষ কার? এই মেয়ের নাকি কেলাশের ছেলেমেয়ের?’

“মেয়ের কোনো দোষ নাই। ক্লাশের ছেলেমেয়েদের দোষ আছে সেইটা কেমন করে বলব? ক্লাশ ফোরের ছোট ছেলেমেয়ে–এরা না বুঝে অনেক কিছু

করে ফেলে।

ঝুমু খালা ঠোঁট সূঁচালো করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, “জটিল কেইস। বড় অসুখ সমাধান হতে পারে।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “বড় অসুখ? কার বড় অসুখ?”

“এই মেয়ের।”

“এই মেয়ের বড় অসুখ তুমি কেমন করে জান? “

“না, না, এই মেয়ের যদি বড় অসুখ হয় তাহলে সব সমস্যার সমাধান। কারো অসুখ হইলেই তার জন্য মায়া হয়, তখন আর কেউ খারাপ ব্যবহার করে না।“

“কিন্তু তার বড় অসুখ বানাবে কেমন করে?”

“অপেক্ষা কর। এসকিডেন্ট হলেও হয়। বড় এসকিডেন্ট। হাত পা ঘাড় ভেঙে গেল– “

শব্দটা ‘এসকিডেন্ট’ না শব্দটা ‘এক্সিডেন্ট’। এটাও মনে হয় এখানে বলা ঠিক হবে না। টুনি শিউরে উঠল, “না ঝুমু খালা, এক্সিডেন্টের দরকার নাই ৷”

“তাহলে অপেক্ষা কর। গরমের সময় ডেঙ্গু না হয় চিকুনগুনিয়া হতে পারে। সইন্ধ্যার সময় কালা কাপড় পরে বারান্দায় বসলেই মশা আইসা কামড়াইব ৷”

টুনি বলল, “অসুখের বুদ্ধি বাদ দাও। অন্য কোনো বুদ্ধি থাকলে বল।”

“তুমি তো আবার জরিনি বেওয়ার তাবিজে বিশ্বাস কর না, তাহলে বলতাম তার একটা তাবিজ নিতে–”

টুনি বুঝল ঝুমু খালাকে দিয়ে হবে না, তখন সে রওনা দিল ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলতে। মাঝখানে তার টুম্পার সাথে দেখা হলো। টুম্পা ছোট মানুষ তার সাথে এরকম জটিল কথা বলে লাভ নাই তবু ভাবল একটু কথা বলে দেখা যাক। টুনি বলল, “টুম্পা তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? “

“কর।”

“তোদের ক্লাশে কি এরকম কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে আছে যাকে ক্লাশের কোনো ছেলেমেয়ে দেখতে পারে না?”

টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “আছে।”

“আছে? সত্যি?”

“টুম্পা মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “চিনিস তাকে তুই?”

“চিনব না কেন? আমিই তো সেই মানুষ। “

টুনি প্রায় চিৎকার করে বলল, “তোকে তোদের ক্লাশের কেউ দুই চোখে দেখতে পারে না?”

টুম্পা মাথা নাড়ল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”

“আমাকে নিয়ে কবিতা বানায়, সেইটা বলে সবাই মিলে।”

“তোকে নিয়ে কী কবিতা বানিয়েছে?”

টুম্পা মুখটা শক্ত করে বলল, “অনেকগুলা আছে। একটা হচ্ছে এরকম,

খাসি না দুম্বা
টুম্বা রে টুম্বা।”

“কবিতা মিলে নাই। তোর নাম তো টুম্বা না, তোর নাম তো টুম্পা!”

“কবিতা না মিললে কী আছে! এইটাই বলে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তখন তুই কী করিস?”

টুম্পা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “কী করিস?”

“সেইদিন একটা ঘুষি মেরেছি। ঠিক নাকের উপরে। ঢিসুম করে।”

“তারপরে?”

“তখন নাক ধরে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিয়েছে।”

“তারপর?”

টুম্পা কথা না বলে ঘাড় নাড়াল।

টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?” টুম্পা বলল, “ঐ তো!”

“ঐ তো মানে কী?”

“ঐ তো মানে ম্যাডামকে নালিশ দিয়েছে।”

“তারপরে? “

“তারপরে ম্যাডাম ঝাড়ি দিয়েছে।”

“শুধু তোকে না দুইজনকেই?”

“দুইজনকেই। আমাকে বেশি

“তারপর?”

“এখন কবিতা বলা কমেছে।”

টুনি মাথা নাড়ল। একটু পর জিজ্ঞেস করে, “তোকে যে সবাই মিলে জ্বালায় সেইজন্য তোর কী মন খারাপ হয়?”

“নাহ্! মন খারাপ হবে কেন?” টুম্পার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। বলল, “আমার মজা লাগে–সবগুলোকে আমি সাইজ করতে পারি! সবাই আমাকে ভয় পায়!”

টুনি কোনো উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইল! মিশুর সমস্যা আর টুম্পার সমস্যার এক না, ক্লাশের সবাই যদি একজনকে জ্বালায় এবং কেউ যদি সেটা থেকে মজা পায় তাহলে তার কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না, সমস্যাটা মনে হয় অন্যদের!

টুনি তারপর গেল ছোটাচ্চুর কাছে। ছোটাচ্চু বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে, বইটার নাম ‘ইউরেনিয়ামের খাঁচায় যকৃতের রস’-নিশ্চয়ই কবিতার বই, সেই জন্যে এরকম নাম। ছোটাচ্চু কবিতার বইটা পড়ে খুব আনন্দ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পেট কামড়াচ্ছে। টুনিকে দেখে ছোটাচ্চু বইটা পেটের উপর রেখে টুনির দিকে তাকাল, টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু এই বইটা কি ডাক্তারি বই?”

ছোটাচ্চু থমথমে গলায় বলল, “এইটা জিজ্ঞেস করতে এসেছিস?”

“না না। বইটার নাম দেখে মনে হলো। অন্যকিছু জিজ্ঞেস করতে এসেছি।”

“কী জিজ্ঞেস করবি?”

“আমাদের স্কুলের ক্লাশ ফোরের একটা মেয়েকে তার ক্লাশের কেউ দেখতে পারে না। সবাই মিলে মেয়েটাকে নানাভাবে জ্বালায়, মেয়েটার খুবই মন খারাপ।“

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “বুলিং।”

“বুলিং?”

“হ্যাঁ। এটাকে বলে বুলিং। সব জায়গাতেই আছে। অস্ট্রেলিয়ার একটা ছোট বাচ্চাকে সবাই মিলে বুলিং করেছে সেটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ হয়েছে। বাচ্চাটা খাটো ছিল, পুরো ক্লাশ সেটা নিয়ে তার সাথে টিটকারি করত।”

“বুলিং করলে কী করতে হয়?”

ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “কয়দিন আগে পত্রিকায় বুলিং নিয়ে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল, সেখানে কয়েকটা জিনিস লেখা হয়েছিল।

“কী লেখা হয়েছিল মনে আছে?”

ছোটাচ্চু বলল, “এইতো, কমন সেন্স। যাদেরকে বুলিং করে তারা

যেরকম ঝামেলায় পড়ে যারা করে তারা তার থেকে বড় ঝামেলায় পড়ে ৷ বড় হয়ে রীতিমতো ডাকাত হয়–ড্রাগস খায়, গুন্ডামি করে।”

টুনি মাথা নাড়ল, নতুন একটা জিনিস শিখল, যারা জ্বালাতন করে

তারাও মানুষ হয় না, গুণ্ডা হয়।

টুনি এর পরে গেল শাহানা আপুর কাছে। শাহানা আপু দুই পা ছড়িয়ে দুই হাত কোমরে রেখে ডানে বামে বাঁকা হচ্ছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী কর শাহানাপু?”

“ব্যায়াম।”

“তুমি কি প্রত্যেক দিন ব্যায়াম কর?”

“মাথা খারাপ? অনেকক্ষণ বসেছিলাম তাই একটু শরীরটা নাড়াচাড়া করছি। তোর কী খবর?”

“আমার কোনো খবর নাই। কিন্তু তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি।”

“কী জিনিস?”

“তুমি কি বুলিং কী সেটা জান?”

শাহানা তার ব্যায়াম বন্ধ করে টুনির দিকে তাকাল। বলল, “হঠাৎ করে বুলিং কী জানতে চাচ্ছিস কেন? কেউ কি কাউকে বুলিং করছে?”

“হ্যাঁ।” টুনি মাথা নাড়ল, “আমার কাছে একটা মেয়ে এসে কান্নাকাটি করেছে। তার ক্লাশের সবাই তাকে জ্বালাতন করে, টিটকারি করে

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “খাঁটি বুলিং। বেচারি। কোন ক্লাশের মেয়ে?”

“ক্লাশ ফোর।”

“একটু বেশি আগে শুরু হয়েছে মনে হচ্ছে। যতদূর জানি এগারো

বারোতে শুরু হয়।

“কাউকে যদি অন্যরা বুলিং করে তাহলে তার কী করতে হয়?”

শাহানাপু বলল, “আমি কি আর জানি? যাকে বুলিং করে দেখা গেছে সে খুব নিরীহ হয়, তাকে জ্বালাতন করা সোজা! সেজন্য তাকে বেছে নেওয়া হয়। তাছাড়া–”

“তাছাড়া কী?”

“তাছাড়া সবাই তো আর বুলিং করে না এক দুইজন করে, অন্যরা হয়তো সেটা দেখেও চুপ করে থাকে।”

টুনি বলল, “ক্লাশ ফোরের বাচ্চা, কতোটুকুই আর বুঝে।”

শাহানা আপু বলল, “উল্টোটাও হতে পারে।”

“উল্টোটা কী?”

“যে বাচ্চাগুলো বুলিং করছে তাদের হয়তো নিজেদেরই সমস্যা আছে। বাসায় প্রবলেম। বাবা-মা হয়তো বাচ্চাগুলোকে মারে, অত্যাচার করে, সেটা নিয়ে নিজেদের ভেতরে রাগ অশান্তিকে বলবে?”

টুনি আরো কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর নিজের বাসায় গেল। মোটামুটি সবার সাথে কথা বলা হয়েছে, বাকি আছে আম্মু। তার সাথে কথা বললে শেষ হয়। তাই ঘুমানোর আগে সে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি? “

“আবার কী সমস্যা? এবারে কার কী হয়েছে? কে এসেছে তোর কাছে?”

টুনি হেসে ফেলল, বলল, “তুমি কেমন করে বুঝেছ আমার কাছে কেউ এসেছে?”

“না বোঝার কী আছে! সব সময়েই তো দেখছি কেউ না কেউ কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে তোর কাছে আসছে।

“তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ।” টুনি তারপর আম্মুকে মিশুর ব্যাপারটার সব কিছু খুলে বলল। আম্মু সবকিছু শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “সারা দুনিয়ায় সব সময় এই প্রবলেম। তোর এগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা না। তোদের স্কুলের টিচারদের চোখ-কান খোলা রাখা দরকার, দেখা দরকার কারো ওপর বুলিং হচ্ছে কিনা–তাদের মাথা ঘামানো দরকার।”

টুনি একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আম্মু তুমি জানো না স্কুলে কত আজব আজব টিচার আছে! আমাদের একজন টিচার আছে যে হিন্দু ছেলেমেয়েদের দেখতে পারে না, তাদেরকে নিয়ে টিটকারি দেয়, পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়–”

আম্মু হতাশভাবে মাথা নাড়লেন। বললেন, “কবে যে সবকিছু ঠিক হবে!”

“এখন মিশুকে নিয়ে কী করব বল?”

“তুই যা করছিস ঠিকই আছে। মেয়েটার পাশে থাক। এরকম কিছু হলে বাচ্চাগুলো নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে সেটা ফিরিয়ে আনতে পারিস কিনা দেখ। যে বাচ্চাগুলো এরকম করছে টিচারদের দিয়ে তাদের একটু শাসন করাতে পারলে অনেক সময় কাজ হয়।“

টুনি আরো কিছুক্ষণ তার আম্মুর সাথে কথা বলল, তারপর শুতে গেল। শুয়ে শুয়েও সে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে সেটা দিয়ে চেষ্টা করতে পারে, দেখা যাক কাজ করে কিনা। সেটা করতে চাইলে আগে অবশ্য ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলতে হবে। স্কুলে যাওয়ার আগে ছোটাচ্চু ঘুম থেকে উঠবে কিনা কে জানে। ছোটাচ্চু যদি না ওঠে তাহলে তাকে ঘুম থেকে তুলেই কথা বলতে হবে। ছোটাচ্চুর মনে হয় একটু মেজাজ খারাপ হবে, কিছু করার নেই।

সবকিছু চিন্তা করতে করতে টুনি এক সময় ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন টিফিনের ছুটিতে টুনি স্কুলের বারান্দায় গিয়ে দেখে সেখানে মিশু বসে আছে। টুনিকে দেখে মিশু তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “তুমি এসেছ?”

“হ্যাঁ। একটু দেরি হয়ে গেছে। তুই কতক্ষণ থেকে বসে আছিস?”

“অনেকক্ষণ! আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ভুলেই গেছ আমার কথা।

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না ভুলব কেন? তোর জন্য একটা কাজ করতেই তো দেরি হয়ে গেল!”

“কী কাজ করেছ আমার জন্য? “

টুনির হাতে একটা প্যাকেট, সুন্দর রঙিন কাগজে মোড়ানো। সেটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোর জন্য এই প্যাকেটটা বানাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”

মিশুর চোখ চকচক করে উঠে। জিজ্ঞেস করল, “আমার জন্য?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি?”

টুনি হাসল। বলল, “হ্যাঁ। সত্যি।”

মিশু খুব আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা হাতে নিল, উল্টেপাল্টে দেখে বলল, “কী আছে ভিতরে?”

“খুললেই দেখবি ৷ কিন্তু এখন খুলতে পারবি না। “

“তাহলে কখন খুলব?”

“তুই তোর ক্লাশ রুমে খুলবি, যখন স্যার ম্যাডাম নাই কিন্তু অন্য ছেলেমেয়েরা আছে তখন। যারা তোকে জ্বালায় তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খুলবি।”

“ঠিক আছে।”

“ভিতরে একটা চিঠিও আছে। সেটা পড়বি।”

“চিঠি? কে লিখেছে?”

টুনি বলল, “কে আবার লিখবে? আমি লিখেছি।”

মিশু অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাকে চিঠি লিখেছ?”

“হ্যাঁ!”

“কেন? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলতে পার।”

টুনি বলল, “কিন্তু আমি যে কথাটা বলতে চাই সেটা আমি তোকে লিখে জানাতে চাই। তুই যখন সেটা পড়বি তখন তোর ক্লাশের সবাই দেখবে, মনে হয় জানতে চাইবে চিঠিতে কী লেখা আছে–“

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। এরা সব সময় আমার ব্যাগ খুলে দেখে, ব্যাগে কী আছে। আমার হোমওয়ার্কে যেগুলো ভুল হয় সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে। আমি যদি চিঠি পড়ি তাহলে সবাই উঁকি দিয়ে দেখবে চিঠিতে কী লেখা আছে। সেইটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।”

“গুড। আমিও সেইটা চাই। দরকার হলে তুই তাদের চিঠিটা পড়তেও দিতে পারিস!“

মিশু হাতের প্যাকেটটা নেড়ে চেড়ে বোঝার চেষ্টা করে ভিতরে কী আছে। মনে হচ্ছে একটা বই, কিসের বই? কে জানে।

মিশু সাধারণত ক্লাশের ঘণ্টা বাজার পর ক্লাশে এসে ঢুকে। তাকে দেখলেই ছেলেমেয়েরা তাকে জ্বালাতন শুরু করে দেয়, তাই যত দেরি করে সম্ভব সে ক্লাশে ফিরে আসে। আজকে সে একটু আগেই ক্লাশে ঢুকল, তাকে দেখেই ফুটফুটে একটা মেয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলল, “এসেছে! এসেছে! মটু এসেছে!”

আরেকজন বলল, “মটু মোষ! মটু মোষ! কতো মোটা মোষ!”

ফুটফুটে মেয়েটা বলল, “দেখো, দেখো, মটু মোষের হাতে গিফট!” ছোটখাটো একটা ছেলে বলল, “কে তোমাকে গিফট দিয়েছে? কিসের গিফট? জন্মদিনের?”

ফুটফুটে মেয়েটা বলল, “জন্মদিনের না! এটা বিয়ের গিফট!”

সবাই তখন আনন্দে চিৎকার করতে থাকে, “বিয়ের গিফট! বিয়ের গিফট! মটু মোষের বিয়ে!”

মিশু সবার দিকে তাকিয়ে তার গতকালকে শেখা বাঁকা হাসিটা হেসে নিজের সিটে বসল। হাতের প্যাকেটের রঙিন কাগজটা ছিঁড়ে সে ভিতরের গিফট বের করল। খুব সুন্দর একটা নোট বই আর চমৎকার একটা কলম। মিশু কলমটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল তারপর সেটা টেবিলের উপর রেখে নোট বইটা খুলল। সেখানে ভাঁজ করা একটা কাগজ, নিশ্চয়ই টুনি আপুর চিঠি। মিশু চিঠিটা খুলল, সাথে সাথে কয়েকটা বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “চিঠি! চিঠি! মোষের কাছে চিঠি লিখেছে! মটু মোষের কাছে চিঠি!”

মিশু কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে চিঠি পড়তে থাকে, কয়েকজন তার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে চিঠিটা পড়তে চেষ্টা করে। মিশু চিঠিটা লুকানোর চেষ্টা করল না, টুনি আপু বলেছে সে চায় অন্যরা চিঠিটা পড়ুক! চিঠিতে লেখা :

প্রিয় মিশু

তুমি আমাকে বলেছ তোমাকে নাকি তোমাদের ক্লাশের কিছু ছেলেমেয়ে অনেক জ্বালায়। কে জানে এখনো জ্বালাচ্ছে কিনা। হয়তো তোমার ঘাড়ের উপর দিয়ে কেউ কেউ চিঠিটা পড়ছে! পড়ছে পড়ুক।

যে ছেলেমেয়েরা তোমাকে জ্বালাচ্ছে তাদের ওপর তুমি বেশি রাগ হয়ো না, কারণ এটা তাদের দোষ না। খোঁজ নিয়ে দেখো তাদের বাসায় নিশ্চয়ই সবাই তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, গালিগালাজ করে, মারধোর করে। তাই তারা মনে করে অন্যদের সাথেও বুঝি তাদের খারাপ ব্যবহার করতে হবে, গালিগালাজ করতে হবে। তারা যদি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে না যায় তাহলে তারা এভাবেই বড় হবে, কেউ গুন্ডা হবে, কেউ ইয়াবা খাবে, কেউ বড় হয়ে তাদের বউকে পিটাবে।

যাই হোক আমার মাথায় একটা খুব ভালো আইডিয়া এসেছে, সেই জন্য তোমাকে এই চিঠিটা লিখেছি। তোমাকে যেটা করা হয় সেটার নাম বুলিং, সারা পৃথিবীর সব জায়গাতেই বুলিং হয়। কেমন করে বুলিং করা হয় সেটা সবাই জানতে চায় সেইটা নিয়ে গবেষণা করে। তোমার ওপরে যে বুলিং করা হয় তুমি কি সেই ঘটনাগুলো লিখে রাখতে পারবে? কবে কে করেছে তাদের নামধামসহ? পারলে ছবিসহ? যদি তুমি এই রকম বেশ কয়েকটা ঘটনা লিখে রাখতে পার তাহলে সেটা বই মেলার সময় বই হিসেবে ছাপানো যাবে। তোমার বইটা হবে একজন খুব কম বয়সী বাচ্চার লেখা খুবই ইম্পরট্যান্ট একটা বই। সবাই এইটা পড়ে দেখতে চাইবে।

তোমার মনে হতে পারে, তুমি এতো ছোট তাই কেউ তোমার ব‍ই ছাপাবে না। এই ব্যাপারে আমি আমার ছোট চাচা বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ারের সাথে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন যে তিনি বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। শুধু তাই না, বিখ্যাত গায়ক মাহী কাঞ্চনকে দিয়ে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করিয়ে দেবেন।

সেজন্য আমি তোমাকে এই ডাইরি এবং কলমটি দিয়েছি। তোমার সাথে যারা খারাপ ব্যবহার করছে তুমি তাদের নাম রোল নম্বরসহ ঘটনাটি সুন্দর করে গুছিয়ে লিখে ফেল। এখন থেকে যখনই কেউ তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, তোমাকে গালাগাল দেবে তুমি সাথে সাথে সেটা তোমার ডাইরিতে লিখে ফেলবে। সবসময় ডাইরিটা নিজের কাছে রাখবে। কেউ গালাগাল দিলে কিংবা খারাপ ব্যবহার করলে তুমি এখন থেকে আর মন খারাপ করবে না। সেটা লিখ এবং সেটা থেকে একটা বই প্রকাশিত হবে।

বইটির কী নাম দেওয়া যায় এবং কে এর প্রচ্ছদ আঁকবে সেটা পরে ঠিক করব। আমাদের হেড মিস্ট্রেসের সাথে আমার খাতির আছে। আমি তাকে অনুরোধ করলে তিনি নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা লিখে দেবেন।

আমার সাথে যোগাযোগ রেখো।

টুনি, সপ্তম শ্রেণী।

চিঠি পড়া শেষ করে মিশু পিছন দিকে তাকালো, বেশ কয়েকজন শুকনো মুখে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মনে হয় পুরোটা পড়া হয় নাই। মিশু জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী চিঠিটা পড়তে চাও?”

ছেলেমেয়েগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। ফুটফুটে মেয়েটা দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। মিশু চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, “পড়া শেষ হলে আমাকে দিয়ে দিও, প্লিজ।“

পড়া শেষ হতে অনেকক্ষণ লাগল, কারণ ফুটফুটে মেয়েটা পড়া শেষ হওয়ার পর, খাটো ছেলেটা পড়ল, খাটো ছেলেটার পর চশমা পরা ছেলেটা পড়ল, চশমা পরা ছেলেটার পর, ন্যাড়া মাথা ছেলেটা পড়ল, ন্যাড়া মাথার পর আরেকজন, তারপর আরেকজন এভাবে সবাই পড়তে লাগল।

মিশু এর আগে নিজে থেকে কারো সাথে কথা বলেনি, আজকে বলল! ফুটফুটে মেয়েটাকে বলল, “তোমার একটা ছবি আমাকে দেবে প্লিজ?”

মেয়েটা বলল, “ছবি? অ্যাঁ ছবি? আ-আ-আমার ছবি?”

“না দিলেও ঠিক আছে। আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে তুমি ‘সবার জন্যে ভালোবাসা’ নিয়ে একটা খুব সুন্দর কবিতা লিখেছিলে না? সেইখানে তোমার একটা সুন্দর ছবি ছিল। সেই ছবিটা কেটে নিব।”

ফুটফুটে মেয়েটা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে মাঠে সবাইকে ছোটাছুটি করতে দেখছে, তাকে কয়েকবার ডেকে গেছে, সেও মাঠে যাবে কিনা চিন্তা করছে। ঠিক তখন মিশু এসে হাজির হলো। সে একা নয় তার সাথে একটি ফুটফুটে মেয়ে ৷

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী রে মিশু, তোর বই লেখার কতদূর?”

মিশু মাথা চুলকে বলল, “সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছি।”

“কী কথা, বলে ফেল।”

“মনে হয় বই লেখা হবে না।”

টুনি বলল, “লেখা হবে না? সে কী? আমি ছোটাচ্চুকে বলে রেখেছি, পাবলিশার রেডি।”

মিশুর পাশে দাঁড়ানো ফুটফুটে মেয়েটি বলল, “আমরা মিশুকে অন্য কিছু নিয়ে লিখতে বলেছি। যেমন মনে করো ভূতের গল্প।“

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? চিনতে পারলাম না তো?”

“আমি মিশুর বন্ধু। একসাথে পড়ি।”

“ও!”

মিশু জিজ্ঞেস করল, “ভূতের গল্প কী হবে? না হলে ডিটেকটিভ?” ফুটফুটে মেয়েটি বলল, “আমরা দুইজনে মিলে কবিতাও লিখতে পারি।”

মিশু বলল, “শোয়েব বলেছে সে ছবি এঁকে দেবে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে।”

টুনি জানতে চাইল, “শোয়েব কে?”

ফুটফুটে মেয়েটি বলল, “আমাদের ক্লাশের আরেকজন ছেলে ঐ যে চোখে চশমা—”

টুনি বলল, “ও! আচ্ছা।”

মিশু বলল, “অন্য কিছু নিয়ে কী লেখব আমরা?”

“ঠিক আছে। লিখতে থাকো। দেখি কেমন হয়।”

মিশু আর ফুটফুটে মেয়েটি উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে চলে গেল।

টুনি সেদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। নিশানা ভালো।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *