Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যাওয়া-আসা || Buddhadeb Guha

যাওয়া-আসা || Buddhadeb Guha

কমলা সবুজকে একটা প্লাস্টিকের ওয়াড্রোব কিনে দিয়েছিল।

এটা যে, কমলাই কিনে দিয়েছিল এ-কথাটা সবুজ সাহস করে হাসিকে বলতে পারেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ঠেকে শিখেছে যে, নিজের ভালোর জন্যে, সংসারের শান্তির জন্যে কিছু কিছু মিথ্যেকথা বলা ভালো। মানে, শুধু ভালোই নয়, তা না বললে, সমূহ বিপদ।

আজ অফিস থেকে ফিরে, নোনা-ধরা দেওয়ালে ঝুলতে-থাকা ওয়াড্রোবটা খুলে, তা থেকে। হ্যাঁঙার বের করে হাওয়াইন শার্টটা যত্ন করে তুলে রাখল ও। প্যান্টটাও।

এই প্লাস্টিকের হ্যাঁঙারগুলোও ওয়াড্রোবের সঙ্গেই কিনে দিয়েছিল কমলা। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হয়েছে। সারাদিন বড়োভ্যাপসা গুমোট গরম গেছে। বাড়ির আলসের ওপর, কাঁচের জানলায়, গলির ও-পাশের তেলেভাজার দোকানের টিনের ছাদের ওপর বৃষ্টির টিপটিপানি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গরম পিচের পথে প্রথম বৃষ্টি পড়ায় একটা গন্ধ বেরোচ্ছে।

সবুজ তার জামা-প্যান্ট খুলে, উদলা-গায়ে শুধু আণ্ডারওয়্যার পরে, ঘরের বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। এই সময়টুকুতে তার অফিসের, তার একঘেয়ে জীবনের, তার সংসারের সমস্তরকম দাবি থেকে ও, নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে ও একেবারে নিজের, একেবারে একার-ই হয়ে গিয়ে ওদের বাসার সামনের বৃষ্টি-ভেজা গলিটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

হাসি হঠাৎ এসে ঘরে ঢুকল। অনুযোগের গলায় বলল ওকে, চান করে নাও-না। কী-যে সারাদিন পর, বাড়ি ফিরে এসে অন্ধকার ঘরে বসে থাকো, বুঝতে পারি না। বলেই সবুজের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার যেমনভাবে এসেছিল, তেমনভাবেই ফিরে গেল রান্নাঘরের দিকে।

তবুও সবুজ তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল, আরও অনেকক্ষণ। তারপর একসময় লুঙ্গি গামছা কাঁধে নিয়ে বাথরুমের দিকে গেল।

খোকা ক্লাস থ্রি-তে উঠেছে। পড়াশোনায় ভালো হয়নি ও। সবুজ ভালো ছিল। হাসিও ছিল। হাসি মুরলীধর গার্লস কলেজ থেকে স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষায় ফাস্ট-ডিভিশনে পাশ করেছিল। হাসি নিজেই খোকার দেখাশোনা করে। খোকাটা বড়ো মা-ন্যাওটা। সব সময় হাসির গায়ে গায়ে থাকে। সবুজকে ভয় পায়। খুব একটা কাছেই আসে না। ওই সময়, হাসির সামনে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে থোকা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্কুলের পড়া করছিল।

হাসি এক্ষুনি মসুরির ডালে কাঁচালঙ্কা-কালোজিরে সম্বার দিল। তার মিষ্টিঝাঁঝ রান্নাঘর ছাপিয়ে বাথরুমে এসে সবুজের নাকে লাগল! সবুজ ঝুপ-ঝাঁপ করে মগ-মগ জল ঢেলে চান করল। তারপর আবার ঘরে এসে হাতল-ভাঙা ইজিচেয়ারটায় বসে গলির দিকে চেয়ে থাকল।

প্রত্যেক দিন, এই সময়টা, সপ্তাহের পাঁচদিন শুধু এই সময়টাতেই ও একেবারে একা থাকে। এই সময়টাতে মনের মধ্যে অনেক অনেক কথা আসে, যায়। তার মনে অনেকানেক বোধ কাজ করে তখন।

পাশের বাড়ির ট্রানজিস্টরে সরকারি পরিকল্পনার সাফল্যের কথা গাঁক-গাঁক করে, সস্তা রেডিয়োতে ঠিকরোয়। কানে লাগে। ভালো লাগে না সবুজের। অন্ধকার ঘরে বসে সবুজ বাইরের স্বল্পালোকিত পথের প্রবহমান জনস্রোতের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে থাকে।

অল্পবয়সি চাকর যদু অন্ধকারেই ইজিচেয়ারের হাতলের ওপর চায়ের কাপটা ঠকাস করে নামিয়ে রেখে যায়। আগে-আগে হাসি এইসময় চায়ের সঙ্গে একটু কিছু খাবার করে দিত। দুটো নিমকি কী অন্যকিছু। এখন যা বাজার পড়েছে। এরজন্যে সবুজের কিছু বলার নেই। ওর আয় আরও বেশি হলে হয়তো এতটা কষ্ট পেতে হত না।

চায়ে চুমুক দিয়েই কিন্তু সবুজের মুখটা বিস্বাদ হয়ে যায়। বিরক্তিতে মন ভরে যায়।চা-টা যে, শুধু ঠাণ্ডা, তাই-ই নয়, চিনি এতবেশি খাওয়াই যায় না। রোজ রোজ সবুজ বলেছে যে, ওর চায়ে কম চিনি দিতে। কিন্তু সে-কথা মনে থাকে না হাসির। হাসির কিছুই মনে থাকে না। সবুজের কেমন মনে হয় যে, আজকাল হাসি ইচ্ছে করেই, ওর সঙ্গে এমন ব্যবহার করে। ওদের দুজনের মধ্যের সম্পর্কটা যেন কেমন হয়ে গেছে। কতদিন যে, সবুজ হাসিকে আদর করে না, তা ভালো করে মনেও পড়ে না ওর! ও-ব্যাপারে হাসির ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা শুধোবার মতো ঔৎসুক্য অবশিষ্ট নেই সবুজের। বেঁচে থেকেও ও যেন, কেমন মরে গেছে।

হাসি যখন সব কাজ সেরে ঘরে এসে, দরজা বন্ধ করে প্রতিদিন রাতে, তখন হাসির সারা শরীর দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরোয়। হাসির ঘামের গন্ধটা সবুজের ভালো লাগে না। সবুজ দূরে সরে শুয়ে থাকে।

পাখাটা ঝুল পড়ে কালো হয়ে গেছে। ওটা কটকট আওয়াজ করে ঘোরে। একটা নীল বৈদ্যুতিক আভা সমানে ঝিলিক মারে পাখার ভেতর থেকে। গলির ল্যাম্পপোস্টটার আলো, তালি-দেওয়া মশারির ওপর এসে পড়ে। সবুজের ক্লান্তিভরা চোখের সামনে, আর ঠিক তখন কমলার হাসি-হাসি মুখটা ভেসে ওঠে। নিজের ঘরে, নিজের স্ত্রীর পাশে শুয়ে, ঘামের গন্ধের মধ্যে, অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে তার সমস্ত অসহায়তার মধ্যে, দূরের, বহু দূরের এক সুন্দর শব্দ স্পর্শ-গন্ধের উচ্ছল কল্পনায় বিভোর হয়ে সবুজ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে থাকে। যতক্ষণ না, তাদের গলির কলকাতা বিভিন্ন লোকের গলাখাঁকারির শব্দে, রিকশার ঠুনঠুনে, বাচ্চার কান্নায় আবার জেগে ওঠে।

.

০২.

অফিস পৌঁছোতে সেদিন দেরি হয়ে গিয়েছিল। সরকারি অফিস। এখানে কাজের ক্লান্তির চেয়ে, অফিস যাওয়া-আসার ক্লান্তি, অফিসে বসে-থাকার ক্লান্তিটাই ওকে বেশি করে পীড়িত করে। অফিসে ঢোকার পর প্রথম প্রথম, কাজ করতে চেয়েছিল ও। চেয়েছিল নিজের কাছে। নিজে সৎ থাকবে। ভেবেছিল, সরকার বেশি টাকা মাইনে না দিলেও, যা টাকা দেন তার বদলেও ওর কিছুটা কাজ করা উচিত। ওর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেকেই বে সরকারি অফিসে কাজ করে। ও জানে, তাদের কতখানি খাটতে হয়; যদিও তাদের কাছে একথা ও স্বীকার করে না। তবু সেইসব অনভিজ্ঞ দিনে ও কাজকে ভালোবাসত, অফিস যে, কাজ করার-ই জায়গা, এটা যে, আড্ডাখানা নয়, বন্ধু-বান্ধবের দেখাশোনার বা বসবার ঘর নয়, এ-কথা ও স্বীকার করতে চাইত না। কিন্তু আজ করে।

কাজ করতে গিয়ে দেখেছে যে, ওদের সেকশনে ওকে একাই সব কাজ করতে হয়, অন্যরা কিছুই করে না। তদুপরি ‘গুড বয়’, তেল-দেওয়া কর্মচারী’, ক্যারিয়ারিস্ট’ এসব কথাও সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনতে হয়। এখন ওর ‘বিবেক’ বলে কোনো পদার্থ নেই। প্রতিদিন যে, বহু-সংখ্যক লোক তাদের সরকারি অফিসে নানারকম উমেদারি ও তদবির করতে আসে, কোনো কাজ, কিছু কাজ-ই যে, উমেদারি ছাড়া হয় না এখানে, এটাকে এখন আর লজ্জাকর বলে মনে হয় না ওর। পাবলিক সার্ভেন্ট নয় ওরা। পাবলিক-ই এখন ওদের সার্ভেন্ট। এই স্বাধীন ভারতবর্ষে এ-কথাটা চাপে পড়ে, দায়ে পড়ে, নিজের স্বার্থে, নিজেকে সহকর্মীদের সন্দেহ, ঘৃণা, রোষ থেকে বাঁচবার জন্যে ও আজ মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়ে দশ-জনের একজন হয়েছে ও।

সুবজ যখন পৌঁছোল, তখনও দু-একজন ছাড়া কেউই আসেনি। পৌনে এগারোটা বাজে এখন। ও পাখার নীচে বসে ঘাম শুকোল। জল ভরে নিয়ে এল নিজের জন্য একগ্লাস। তারপর ড্রয়ারটা খুলে, পেপারওয়েট, কলম-পেনসিল সব বের করে টেবিলে রেখে, একটা সিগারেট ধরিয়ে, ওদের অফিসের বহুতলা বাড়ির জানলা দিয়ে, ও-পাশের বহুতলা বাড়ির নীলরঙা পর্দা লাগানো জানলাগুলোরদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়ে রইল।

সিগারেটটা পুড়তে থাকল, পাখার হাওয়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে। সবুজ অনুভব করতে পারল যে, ও-ও পুড়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নিজের মধ্যে, নিজের বুকের মধ্যে প্রতিদিন। ঘুস ঘাস, অকর্মণ্যতা, অযোগ্যতা ও বিবেকহীনতার পরিবেশ এবং সর্বোপরি কিছুই না-করার গ্লানিটা, করার মতো কিছুই-না-করে দিনগুলো একে একে পুড়িয়ে ফেলার অসহায় বোধটা, ওকে এক দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত।

সবুজ বড়ো একা। ওর খুব জানতে ইচ্ছে করে, ওর চারদিকের অনেকানেক লোকের মধ্যে আর কেউ ওর মতো একা আছে কি না। মানে সব থেকেও, ঘরে-বাইরে থাকার মতো মোটামুটি সবকিছু থেকেও, প্রতিদিন বহুক্ষণ বহুলোকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও যারা একা থাকে, তেমন লোক আরও আছে কি না, ওর খুব জানতে ইচ্ছে করে। ওর মতোই সেইসব লোকগুলোও অফিস করে, সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা মারে, চা-সিগারেট খায়, ওপরওয়ালার শ্রাদ্ধ করে, লোককে হয়রান আর বিরক্ত করে, করে দিনে দশটা-বিশটা টাকা উপরি কামায়। এরাও শনিবারে সিনেমায় যায়, স্ত্রীর সঙ্গে শোয়, তাকে আদর করে, ছেলেমেয়েকে চুমু খায়; সমাজের এই বাঘ-বন্দির ঘরে গুরুজন-লঘুজন সবার প্রতি, যথাযথ সাধ্যমতো কর্তব্য করে।

সবুজের মতো মানুষেরা এ-সংসারে একজন-দুজন ছাড়া কারও সঙ্গেই একাত্ম হতে পারে; ‘একাত্ম হওয়ার মতো লোকের বড়ো অভাব, এ-সংসারে বোকষ্ট। এদের কেউ বোঝে । এরা নিজেদেরও বোঝে না নিজেরা। এরা সুখী করতে গিয়ে দুঃখ দেয় অন্যকে। নিজে সুখী হতে গিয়েও তাই-ই। সবুজ ভাবে, ও একটা হতভাগা। এমনিই, একা একা নানারকম শব্দ, চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে বসে, এসব কথা ভাবতে ভাবতে ওর চোখের কোনা জ্বালা করে ওঠে। চশমাটা খুলে ফেলে একবার মুছে নেয়।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এমন সময় মদন বেয়ারা এসে বলল, সবুজবাবু, সাহেব ডাকছে।

চমকে উঠল ও। ঘোর ভাঙল। জুতোটা খুলে রেখে বসেছিল। ধীরে-সুস্থে কাবলি জুতোটা পায়ে গলিয়ে সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে, দরজা খুলে ঢুকল।

সাহেব ডাইরেক্ট রিক্রুট অফিসার। একেবারে ছেলেমানুষ। চকরা-বকরা জামা পরে অফিসে আসে, জমিয়ে আড্ডা মারে, কাজ কিছু বোঝে না আপাতত, বোঝার চেষ্টাও করে না। কিন্তু লোক ভালো। কারও পেছনে লাগে না, হাকিমতা নেই একেবারে, লিভ অ্যাণ্ড লেট লিভ’ দর্শনে বিশ্বাস করে। এখনও সৎ আছে। মনে হয় আরও বছর পাঁচেক সৎ থেকেও যাবে। যদি না… যদি না তাঁরও জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়।

সবুজ ঘরে ঢুকতেই সাহেব যেন, হাতে চাঁদ পেলেন। বললেন, আরে আপনি এসে গেছেন। এক্ষুনি বড়োসাহেব ডেকেছিলেন। দিল্লি থেকে টেলেক্স এসেছে, সেই রিপোর্টটা সম্বন্ধে। আমাকে বড়ো গালাগালি করলেন, বুঝলেন। ওটা কি এখনও তৈরি হয়নি?

সবুজ বুঝতে পারল না, সাহেব কোন রিপোর্টটার কথা বলছেন। দিল্লির সাহেবদের কাজ ই তো কথায় কথায় রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো। এই অকাজের কাজ করেই সকলের দিন যায়–তো কাজের কাজ করবে কখন?

মুখে বলল, কোন রিপোর্টটার কথা স্যার?

সাহেব ডানহাতের আঙুল নেড়ে, যেন তানপুরা ছাড়ছেন এমনভাবে বললেন, আরে সেই যে, মোষের রিপোর্ট। যে-করে-হোক, আজকে বেলা একটার মধ্যে রিপোের্টটা তৈরি করে দিন সবুজবাবু। মনে আছে তো? সেভেন্টি-ওয়ান, সেভেন্টি-টু-তে কোন কোন কনট্রাক্টরের মোষ ছিল। এবং ক-টা করে মোষ ছিল এবং আমার চার্জে সবসুন্ধু কতগুলো মোষ ছিল?

–আচ্ছা স্যার। বলল সবুজ। তারপর ফিরে এল সেকশানে।

পুরো ব্যাপারটাই, সরকারি অফিসের কাজকর্ম ওর কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়। পার্লামেন্টে বোধ হয় কেউ কোনো প্রশ্ন তুলে থাকবে কোনো কনট্রাক্টরের মোষ সম্বন্ধে। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে এত্তেলা পাঠানো হল, ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে-কাঁড়া-বয়েলের হিসেব চেয়ে।

ঘরে ঢুকেই সবুজ দেখল হারাধন এসে গেছে।

সবুজ বলল, হারাধন! ভাই মোষের রিপোর্টটা এখনও দিলি না, দেখ তো কী মুশকিল। আজ-ই একটার মধ্যে দিতে হবে।

হারাধন পুলিনের সঙ্গে মনোযোগ সহকারে ডিম্পল-কাঁপাডিয়ার নতুন ছবি নিয়ে আলোচনা করছিল।

হারাধন বলল, বোসো তো সবুজদা। বোসো। সকাল-সকাল দিলে মেজাজটা খারাপ করে। কোথায় ডিম্পল, কোথায় মোষ।

সবুজ নার্ভাস হয়ে গিয়ে বলল, আরে ব্যাপারটার গুরুত্ব তুই বুঝছিস না। গালাগালি খেতে হবে যে।

হারাধন বলল, খুব-ই বুঝেছি। বড়সাহেব দিল্লি থেকে গালাগাল খেলে, মেজোসাহেবকে ডেকে গালাগাল করেন, মেজোসাহেব ছোটোসাহেবকে, ছোটোসাহেব আপনাকে এবং আপনি এই সবেধন হারাধনকে। গালাগালি স্নেহের মতোই নিম্নগামী। কাজ যতটুকু করার তা, এই হারাধনকেই করতে হয়, ছড়ি ঘোরাবার বেলায় আপনারা, লাইন লাগানো সাহেবরা।

তারপর হারাধন একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি ঘাবড়িয়ো না। এক্ষুনি এলাম। এক কাপ চা খাই। তারপর তোমার রিপোর্ট তোমার সামনে বসেই করে দিচ্ছি।

সবুজ নিজের জায়গায় গিয়েই বসল। ভাবতে লাগল, হারাধন একটা ফাইলও দেখেনি আজপর্যন্ত। ইনডেক্স রেজিস্টারে সমস্ত ফাইলের হিসেব আছে। দেখে দেখে তৈরি করতে হবে রিপোর্টটা। কী করে যে করবে,ওই জানে। ঠিকমতো করতে হলে তিন-চার দিনের কাজ।

এমন সময় ফোনটা বাজল। সেকশানের ফোনটা সবুজের টেবিলেই থাকে।

ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে কমলা বলল, তুমি?

হুঁ! বলল সবুজ।

কেন জানে না, কানে এতবার এত নারীর কণ্ঠস্বর বাজল, সবুজ এত গায়িকার গান শুনল জীবনে, তবু কমলার গলার স্বরের মতো কিছুই এ-পর্যন্ত ও শুনল না। কমলার রিনরিনে গলার স্বরে, ওর সমস্ত নরম মেয়েলি মিষ্টিস্বভাব যেন গলে পড়ে। মস্তিষ্কের মধ্যে সে-স্বর যেন, সমস্ত অন্ধকার কোণগুলিকে আলোকিত করে তোলে। এত ভালো লাগে সবুজের; এত ভালো লাগে। এই চারিদিকে ভালো-না-লাগার মধ্যে কমলা তার একমাত্র ভালো-লাগা; চাপ-চাপ অন্ধকারে একমাত্র ‘আলো’।

কমলা বলল, এ্যাই! আমাদের সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?

–কোথায়?

–হাজারিবাগ।–

-হঠাৎ?

–সবুজ শুধোল।

–হঠাৎ আবার কী? তোমার-আমার জীবনে, যা-কিছু ঘটেছে সব-ই তো হঠাৎ।

তারপর একটু থেমে আবার বলল, কি, যাবে তো?

–আর কে যাবে?

–আর আবার কে? আমি আর তুমি!

–ইস বড়ো যে-সাহস!

সবুজ বলল।

–সাহস আমার সব সময়েই আছে। তুমিই ভীতু।

তারপরই বলল, কুমুদও যাবে।

এমন সময় হারাধন চা খেয়ে এসে সবুজের টেবিলে বসল।

বলল, বের করুন আপনার রিপোর্ট।

সবুজ কমলাকে বলল, আমি একটু পরে তোমাকে ফোন করছি।

কমলা অবুঝ গলায় বলল, না। এখন-ই কথা বলল। শুধোল, তোমাদের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে?

–এই শুরু হল।

–আমাদের এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।

সবুজ আবার বলল, আমি এখন ছাড়ছি। পরে করব।

কমলা বলল, না। আমি ছাড়ব না। আমার এখন কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

হারাধন সবুজের মুখের দিকে, দু-চোখ স্থির রেখে তাকিয়ে ছিল।

সবুজ তাড়াতাড়ি বলল, ছাড়ছি কিন্তু এখন।

বলেই, কমলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখল খট করে।

হারাধন হাসল। বলল, বাঃ সবুজদা। আপনি গুরুদেব লোক। বেড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু।

সবুজ ধমকের গলায় বলল, কী ইয়ার্কি করছ?

হারাধন বলল, বাঃ, আমার ঘাড়ে রিপোর্ট চাপিয়ে, নিজে দিব্যি মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলছেন।

সবুজ বলল, কী যে যা-তা বলো, আমার কাজিন।

হারাধন বলল, কেন ঝাড়ছেন দাদা? আপনার চোখ-ই বলছে কাজিন নয়। এতে লজ্জার কী? আপনার তো গর্ব হওয়ার কথা। পেরেম-ফেরেম কি সকলের কপালে জোটে? শোওয়া শুয়ির ব্যাপার আলাদা–ওতে কোনো বাহাদুরি নেই। কড়ি ফেললেই শোয়া যায়।–কিন্তু পেরেম! একটা অন্য হাইটে পৌঁছে দেয় লোককে।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি? দেয় না। শালা তিরিশ বছর বয়স হতে চলল, একজন মেয়েও বলল না যে, আমাকে ভালোবাসে! কত চকোলেট খাওয়ালাম, কত আইসক্রিম। সিনেমা দেখিয়ে-দেখিয়ে ট্যাঁক গড়ের মাঠ হয়ে গেল–তবু শালা একটা সিরিয়াস-টাইপের মেয়ে দেখলাম না, যার সঙ্গে প্রেম করা যায়। সব একেবারে জাত চ্যাংড়া, জাত জকবাজ।

সবুজ ধরা পড়ে গিয়েছিল। ওর কানের লতি গরম হয়ে এল।

ও মুখ নীচু করে ড্রয়ার হাতড়ে রিপোর্টটা বের করল। ছাপানো দশ-এগারো পাতার রিপোর্ট। রিপোর্টটা টেবিলে রাখল।

হারাধন বাঁ-হাতে সিগারেট ধরে, ডানহাতে কলম নিয়ে পাতার পর পাতা খুলে প্রত্যেক কলামে ‘নিল’ লিখে যেতে লাগল।

সবুজ হাঁ-হাঁ করে উঠল।

বলল, করো কী? ফাইলগুলো একবার দেখলে না পর্যন্ত?

হারাধন বলল, সব দেখা আছে। দেখলে কি আর রিপোর্ট অন্য কিছু হত? কোন কোম্পানির ব্যালান্স-শিটে মোষ থাকে দাদা? দু-একজন ফরেস্ট কনট্রাক্টর-ফনট্রাক্টরের ফাইলে থাকলেও থাকতে পারে। থাকলেই বা কী? কার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হত তাতে?

দেখতে দেখতে পুরো রিপোর্টটা শূন্যে শূন্যে ভরে গেল।

রিপোর্টটা ভরে দিয়ে হারাধন বলল, যান, এবার এখানকার মোষেদের দিয়ে সাইন করিয়ে দিয়ে দিল্লির ধেড়ে-মোষেদের কাছে পাঠিয়ে দিন। বলেই ছন্দ করে আবৃত্তি করল–

ঝাঁপর ঝাঁই, খাঁপর খাঁই
কাঁড়া-ভহিস, বয়েল গাই,
ঝাচা-মাচা, ঝাচা-মাচা।।

সবুজ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, এ আবার কী?

হারাধন নিজের টেবিলে যেতে যেতে বলল, কাল পড়লাম; তা-ই মনে আছে।

–কোথায় পড়লে?

সবুজ শুধোল।

-–সুনির্মল বসু-র ‘জীবন-খাতার কয়েক-পাতা’তে। পড়েননি?

সবুজ বলল, না।

রিপোর্টটা নিয়ে সাহেবের ঘরে পৌঁছোল সবুজ!

সাহেব একজন বন্ধুর সঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি ও। ডিক্টেটরশিপের মধ্যে কী তফাত, তা নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করছিলেন।

আলোচনা থামিয়ে বললেন, বাঁচালেন সবুজবাবু। দিন। কোথায় সই করতে হবে, বলুন।

সবুজ দেখিয়ে দিল কোথায় সই করতে হবে।

সাহেব সই করে দিয়ে বললেন, বড়োসাহেবের পি-এর কাছে এক্ষুনি দিয়ে আসুন। ওঁরা দিল্লি পাঠাবার বন্দোবস্ত করবেন।

রিপোর্টটা নিয়ে যেতে-যেতে সবুজ ভাবছিল যে, এই শূন্যতায় ভরা রিপোর্ট আরও হাজার হাজার শূন্যতাভরা রিপোর্টের সঙ্গে মিশে দিল্লির দরবারে যে, কী মহাশূন্যতার সৃষ্টি করবে তা অনুমান করাও মুশকিল। সারাভারতে হাজার-হাজার, বড়ো-ছোটো সরকারি কর্মচারীদের, যে-পরিমাণ সময় ও যে-পরিমাণ কাগজ দিল্লির কর্তারা এই মোষ-খোঁজার ব্যাপারে নষ্ট করালেন, তা এই বাজারে ক্ষমার অযোগ্য।

গতকাল খোকার স্কুলের কাজের জন্যে এক্সারসাইজ বুক কিনতে গিয়ে কাগজের দাম জেনেছে ও। শুনেছে, দেখে কাগজের অভাবে স্কুলের পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে না।

পুরো ব্যাপারটাই সবুজের কাছে পয়েন্টলেস বলে মনে হচ্ছিল। তার অবসাদ, তার উৎপাদনহীন-কর্মজনিত অবসন্নতা তাকে আরও বেশি করে পেয়ে বসেছিল। কিন্তু ওর করার কী আছে? ও একজন সামান্য আপার-ডিভিশন ক্লার্ক। মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনের একমাত্র গন্তব্য যাও সেখানে পৌঁছেছে। এই দেশজোড়া সরকারি দক্ষযজ্ঞের মধ্যে ও একচিলতে কাঠমাত্র। ওর কিছুই করার নেই এ ব্যাপারে।

ও ভাবল, তার চেয়ে ফিরে গিয়ে কমলাকে ফোন করলে অনেক ভালো লাগবে।

ফিরে গিয়ে নিজের টেবিলে বসতে না বসতেই ফোনটা আবার বাজল।

ওপাশ থেকে কমলা বলল, কী? কাজ দেখাচ্ছিলে বুঝি? আমরা বুঝি আর কাজ করি না? যারা অফিস যায় তারাই শুধু কাজ করে?

সবুজ ওকে বুঝিয়ে বলে, রাগ কোরো না–একটা মোষ-সংক্রান্ত রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

কমলা খিলখিল করে হাসল। বলল, সত্যিই?

সবুজ বলল, সত্যি।

-–যাকগে মোষের কথা। তুমি যাবে তো?

–কবে?

সবুজ শুধোল।

–আগামী বৃহস্পতিবার। সেকেণ্ড স্যাটারডের ছুটি আছে শনিবার। বৃহস্পতিবার বেরোবে। শুক্র, শনি ও রবি থেকে রবিবার রাতে আবার রওনা হয়ে সোমবার ফিরে আসব। কুমুদের এক বন্ধুর বাড়ি আছে–ক্যানারি হিল রোডে–মালি রান্নাবান্না করবে। খুব মজা হবে।

সবুজ বলল, ছুটি পাওনা নেই আমার। দেখি, ক্যাজুয়াল লিভ নিতে পারি কি না শুক্রবার।

–দেখি-টেখি না। যেতেই হবে। তুমি না গেলে আমি কিন্তু যাব না। আমাকে কালকের মধ্যে জানাবে।

-বেশ।

–আর কী খবর বলো?

–কোনো খবর নেই। তুমি কেমন আছ?

–ভালো। সব সময়েই ভালো থাকি আমি। তুমি?

–আমি সব সময়েই খারাপ থাকি। জানো তো তুমি

–জানিই তো! তাই-তো আমার সঙ্গে ঘনঘন দেখা হওয়া দরকার।

–বুঝি, স্বীকারও করি।

সবুজ বলল!

–করো তাহলে? জেনে ভালো লাগল।

তারপরেই কমলা বলল, আজ অফিস থেকে কখন বেরোচ্ছ?

–ঠিক নেই। সাহেব যখন বেরোবেন। সাহেব সাধারণত চারটের পর থাকেন না। চারটের আগে বেরোতে পারব না।

তারপর শুধোল, কেন?

–আজ আমাদের বাড়ি আসবে? মাংসের শিঙাড়া খাওয়াব। পুর করে ফেলেছি। বিকেলে তুমি এলে গরম গরম ভেজে দেব।

–কুমুদ কখন বাড়ি ফিরবে?

–কেন? কুমুদ না থাকলে তুমি আসতে পারো না? কার দাম তোমার কাছে বেশি? আমার না কুমুদের?

–তুমি জান-না?

সবুজ নরম করে বলল।

জানি বলেই জানতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। কুমুদ আজ দেরি করে ফিরবে। অফিসের পর ওর একটা পার্টি আছে। কি? আসবে তো?

সবুজ বলল, আসব।

বলে ফেলেই, ওর লজ্জা লাগল। কুমুদ না থাকলে যে, ওর ভালো লাগে, অনেক বেশি ভালো লাগে, এ-কথাটা যে, ওর গলার স্বরে ধরা পড়ে গেল, এই ব্যাপারটা ওর নিজের লজ্জাকর মনে হল।

কমলা বলল, তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু।

সবুজ বলল, আচ্ছা!

ফোন ছেড়ে কিছুক্ষণ, অনেকক্ষণ সবুজ একটা ভালোলাগার ঘোরের মধ্যে ডুবে রইল। ওর চারপাশের সহকর্মীদের উচ্চস্বরের কথা, নানারকম আওয়াজ, গোলমাল, কোনো কিছুই ওর কানে আসছিল না। ওর কানের মধ্যে রেলগাড়ির চাকার আওয়াজ বাজছিল, নাকে আসছিল জঙ্গলের গন্ধ, আর বুকের মধ্যে একটা দারুণ চাপা, ভালো-লাগার বোধ। বড়োকষ্ট; বড়োকষ্ট সবুজের। চাপা-যন্ত্রণার মতো চাপা-আনন্দর কষ্টও ভারি কষ্ট। টাকা পয়সার টানাটানি, সংসারের অশান্তি, ছেলে-বউয়ের জোয়াল-টানা ক্লান্ত কেরানির অনেক কষ্ট। কিন্তু–এই কমলাজনিত কষ্টের আনন্দে অথবা আনন্দের কষ্ট সবুজের একার-ই-তার একান্ত। এইখানে, একমাত্র এই একফালি সবুজ জমিটুকুতে অন্য সমস্ত মোষেদের থেকে সে আলাদা–এইখানে শিং উঁচিয়ে–কান নাড়িয়ে সে, পটাপট করে নরম কচিকলাপাতা-সবুজ ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে ও নিজের সুখে চরা-বরা করে। এই ফুল-ফল-ফালিটুকু তার জীবনের একমাত্র পালিয়ে-থাকার জায়গা।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress