Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ (১৯৯৪) || Humayun Ahmed » Page 2

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ (১৯৯৪) || Humayun Ahmed

অরুণের বিয়ে হচ্ছে

অরুণের বিয়ে হচ্ছে সোহাগ কম্যুনিটি সেন্টারে। অরুণ হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। বন্ধু বললে বাড়িয়ে বলা হয়–স্কুলে আমি ওর সঙ্গে পড়েছি। অরুণের ধারণা, আমি ওর জন্যে খুব ব্যস্ত। এবং আমাদের বন্ধুত্ব আরসিসি কনক্রিটের মতো। সে কদিন পরপরই অফিসে টেলিফোন করে আন্তরিক ধরনের একটা স্বর বের করে বলে–দোস্ত, তোর কোনো খোঁজ নাই, খবর নাই। ব্যাপারটা কী?

বাসায় যখন তখন আসে, ভাবি ভাবি বলে সরাসরি বেডরুমে ঢুকে যায়। তার বোধহয় ধারণা, আন্তরিকতা দেখানোর প্রধান শর্ত হলো বেডরুমের বিছানায় পা এলিয়ে বসে গল্প।

অরুণের ওস্তাদী ধরনের আলাপ আমার সব সময় অসহ্য বোধ হয়। উপায় নেই বলেই সহ্য করে নেই। অরুণটা গাধা ধরনের, আমি যে তাকে দু চোখে দেখতে পারি না এতা সে জানে না।

কম্যুনিটি সেন্টারে পৌঁছে দেখি, দুটা ব্যাচের খাওয়া হয়ে গেছে। তাবপরেও লোকজন যা আছে, মনে হচ্ছে আরো চার-পাঁচ ব্যাচ খাবে। অরুণ আমাকে বলল, তুই গাধার মতো এত দেরি করলি? আশ্চৰ্য, সামান্য সেন্সও তোর নেই? ছাগল কোথাকব! বউ আসে নি?

আমি কিছু বললাম না, হাসলাম।

অরুণ বলল, আবার ঝগড়া? আমার বিয়ের দিনটায় বেছে বেছে ঝগড়া করলি?

মাফ করে দে।

যা, খেতে বোস। তোর শ্বশুর এসেছেন, তোকে খুঁজছেন।

কেন?

কে জানে কেন। তুই খেতে বোস। সবাই যে হারে খাচ্ছে খাওয়া শর্ট পড়ে যাবে। দেরি করলে কিছুই পাবি না। ভিডিও হচ্ছে বুঝলি। মনে করে তোর ভাবির সঙ্গে ছবি তুলিস। একটা রেকর্ড থাকুক।

আমি খেতে বসে গেলাম। এতটা খিদে লেগেছে নিজেও বুঝি নি। রান্না ভালো হয়েছে। অনেকেই দেখি চেয়ে চেয়ে ডাবল বোস্ট নিচ্ছে। আমিও নিলাম। পোলাও বোধহয় নতুন করে বান্না হয়েছে। আগুন-গরম। খাসির বেজালা থেকে চমৎকার গন্ধ আসছে।

এই যে মিজান!

তাকিয়ে দেখি আমার শ্বশুর সাহেব। আমার শ্বশুর সাহেব বিয়ে করার পর হারে বুড়ো হতে শুরু করেছেন। রোজ অনেকখানি করে বুড়ো হন। বিয়ে উপলক্ষ্যে তিনি একটা কালো আচকান পরেছেন। সম্ভবত এই জিনিস যৌবনকালে বানিয়েছেন। আচকানও তাঁর মতো বুড়ো হয়েছে। বেচারাকে দেখাচ্ছে সার্কাসের লোম ওঠা ভালুকের মতো। আমি তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। উনি হৈ হৈ করে উঠলেন, দাঁড়াচ্ছ কেন? বোস বোস। রুবা বাসায় আছে এই খবরটা তোমাকে জানাতে বলল তোমার শাশুড়ি।

কে বাসায় ফিরেছে?

রুবা।

তোমার শাশুড়ি তোমার বাসায় টেলিফোন করেছিল। সে ধরল। সে নাকি বাসাতেই ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিল। তুমি তাকে রেখে চলে এসেছ, এই নিয়ে মন খারাপ করেছে।

আমি বুড়োর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। গাধাটা এইসব কী বলছে? বুড়ো ভালুকের মাথায় নাট বল্টু কি খুলে পড়ে গেছে? কোথায় না কোথায় রং নাম্বার করেছে… ..আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি হাত ধুচ্ছি, অরুণ ছুটে এসে বলল, ব্যাপার কিরে, খাওয়া শেষ?

হুঁ।

খাওয়া কেমন হয়েছে?

ভালো। খুব ভালো।

পোলাও শর্ট পড়ে গিয়েছিল। নতুন করে রাঁধতে হলো। অন্য মানুষদের বিয়েতে গোশত শর্ট পড়ে, রোস্ট থাকে না, রেজালা থাকে না–আমার বেলায় শর্ট পড়ল পোলাও। হাউ ষ্ট্রেঞ্জ।

দোস্ত যাই।

যাই মানে? হোয়াট ড়ু ইউ মীন বাই যাই? তোর ভাবির সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না।

যা, দেখা কর। ভিডিওওয়ালাকে বলে দিচ্ছি, ভিডিও করবে।

বাসায় যাওয়া দরকার, রুবার জন্যে চিন্তা লাগছে।

খামাখা চিন্তা করবি না। আয় তো আমার সঙ্গে, তোর ভাবির সাথে আলাপ করিয়ে দেই।

আজকালকার বৌরা আগের দিনের মতো না, জবুথবু হয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকে না। এরা হড়বড় করে কথা বলে, বিনা কারণেই হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হাসে। অরুণের বৌয়ের হাসি শোনার সময় এখন নেই। আমাকে বাসায় যেতে হবে। এমনভাবে যেতে হবে যেন কারো চোখে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা না পড়ে।

বাসায় ফিরলাম রাত দশটায়। আশ্চর্য কাণ্ড! শোবার ঘরে বাতি জ্বলছে। এর মানে কী? আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। ধ্বক করে বুকে একটা ধাক্কা লাগল। চাবি হাতে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ঘরের ভেতর চটি পায়ে কেউ একজন হাঁটছে। নিশ্চয়ই মনের ভুল। বাতিটাও কি মনের ভুল? হয়তো আমি ভুল করে বাতি জ্বলিয়েই এসেছি। পুরো ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। খুব ঠাণ্ডা মাথায়। বোঝাই যাচ্ছে আমার স্নায়ু উত্তেজিত। মাথায় হয়তো রক্ত উঠে গেছে। আমার শ্বশুর সাহেবই বা এটা কী বললেন? সব কিছুর একটা লজিকেল এক্সপ্ল্যানেশন থাকে। এরও নিশ্চয়ই আছে।

আমি দরজা না খুলে রাস্তার দিকে রওনা হলাম। মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। এক কাপ চা খাব। একটা সিগারেট খাব। পানও খাওয়া যেতে পারে। এই ফাকে চিন্তা করে বের করব।–হচ্ছেটা কী? ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। ছয়-এর সঙ্গে এক যোগ করলে তবেই সাত হয়–আপনা। আপনি সাত হয় না।

চা খেতে খেতে আমি ব্যাপারটা কী ঘটেছে তার একটা গ্ৰহণযোগ্য সিনারিও তৈরি করলাম।

আমার শাশুড়ি পিঠের ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছিলেন। তার হাতের কাছেই টেলিফোন। তিনি পিঠের ব্যথার জন্য কড়া ধরনের সিডেটিভ খান। কাজেই তাঁর আধোঘুম আধো-জাগরণ অবস্থা। এই অবস্থায় টেলিফোন বাজল। তিনি টেলিফোন ধরার জন্য হাত বাড়ালেন এবং টেলিফোন ধরার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রুবার সঙ্গে কথাবার্তার অংশটি তিনি স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নটা তাঁর অবচেতন মন তাকে দেখাল। স্বপ্ন ভাঙার পর স্বপ্নটাকেই তার সত্যি মনে হতে লাগল। আমার শ্বশুর সাহেব তখন বেরুচ্ছেন। তাকে তিনি রুবার কথাটা বলে দিলেন। সত্যি ভেবেই বললেন। এই হচ্ছে ব্যাপার।

একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো গেছে, এতেই আনন্দিত বোধ করছি। নিশ্চিন্ত বোধ করছি। একটা ব্যাখ্যা যখন দাঁড় করানো গেছে, আরো ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই দাঁড় করানো যাবে।

আমি পান মুখে দিয়ে ফিরে এলাম। তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। কেন জানি ইচ্ছা! করল। দরজাটা খোলা রাখতে। পর মুহুর্তে মনে হলো, এতো বড় বোকামি কখনোই করা ঠিক হবে না। দরজার দুটা ছিটিকিনিই বন্ধ কাবলাম। ডেডবডি সবাবার কাজ এখন শুরু করতে হবে। আমি শোবার ঘরে ঢুকলাম। রুবা ঠিক আগের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। শুধুশুধুই একটা আজে-বাজে ধরনের ভয়ে এতক্ষণ কুঁকড়ে ছিলাম।

ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়েছি বলেই বোধহয় ঘবটা গুমটি হয়ে আছে। ফ্যান ছাড়লাম। বাতাসে রুবার মাথার চুল উড়ছে। সেই চুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভয়াবহ ধরনের চমক খেলাম। রুবা তো এভাবে শুয়ে ছিল না। আমি তার মুখ দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে পাশ ফিরল কীভাবে? তার চোখও খোলা। চোখ তো বন্ধ ছিল। চোখ খোলা হলেও এই চোখ জীবিত মানুষের নয়। চোখে পলক পড়ছে না। রুবা পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। না না, মেঝের দিকে না। সে তো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু আগেই তো দেখেছি মেঝের দিকে তাকিয়েছিল। Something is wrong. Something is very very very wrong. গরম লাগছে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? মানুষেবা ভয় পাওয়ার একটা শেষ সীমা আছে। আমি কি সীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছি?

হে মানব সন্তান।
তুমি সীমা অতিক্রম করিও না।
সীমা অতিক্রমকারীকে আমি পছন্দ করি না।

এইগুলি কার কথা? কোরান শরীফের? কোন সূরায় আছে?

নিঃশ্বাস ফেলার মতো শব্দ হলো। কে নিঃশ্বাস ফেলল? রুবা? মৃত মানুষ কখনোই নিঃশ্বাস ফেলে না। আমি যা শুনছি তা আমার নিজেরই নিঃশ্বাসের শব্দ। কিংবা বাতাসের শব্দ। কিংবা…। আমি নিজের অজান্তেই ডাকলাম, রুবা!

সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন বলল, উঁ।

না না, রুবা এটা বলতেই পারে না। ঐ তো তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। জিহবা খানিকটা বের হয়ে আছে। পলকহীন চোখে সে তাকিয়ে আছে। মৃত মানুষ কথা বলে না। বাতাসের শব্দই আমার কাছে উ ধ্বনির মতো মনে হয়েছে। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমাকে যা করতে হবে তা হলো–এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হবে। স্নায়ু ঠাণ্ডা করতে হবে। কাবার্ডে ব্ৰান্ডি আছে। সামান্য ব্ৰান্ডি খাব, তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মাথাটা ধুয়ে ফেলব। আমার মস্তিষ্ক মনে হয় অক্সিজেন কম পাচ্ছে। অক্সিজেন কম পেলে মানুষ হেলুসিনেশন দেখতে শুরু করে।

ঘর থেকে বেরুবার আগে আরেকবার ভালোমতে রুবার দিকে তোকালাম। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। প্রচুর অক্সিজেন নিতে হবে। ব্রেইনের যেন অক্সিজেনের অভাব না হয়।

আমি বসার ঘরের দিকে রওনা হতেই স্পষ্ট শুনলাম, কেউ যেন পাশ ফিরল। খাট মট মট কবে উঠল। নিঃশ্বাস ফেলাব শব্দও যেন হলো।

কেউ কি থুথু ফেলেছে? একটু থু শব্দ যেন শুনলাম।

আমি বসার ঘরে চলে এলাম। চায়ের কাপোব আধিকাপ ব্ৰান্ডি একসঙ্গে গলায় ঢেলে দিলাম। তীব্র, ঝাধালো স্বাদ! মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত স্নায়ু পুড়িয়ে তরল আগুন নিচের দিকে নামছে। ভয়টা কমে গেছে। জিনিসটা আরো। আগেই খাওয়া উচিত ছিল। আমি জানি, এখন যদি শোবার ঘরে যাই, দেখব, সব স্বাভাবিক। রুবার মুখ দেয়ালের দিকে ফেব্যানো, চোখ বন্ধ। বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি ঢালিলাম। কাজটা বোকার মতো হয়ে গেল। আমার টনসিলাইটিসেব সমস্যা। ঠাণ্ড লেগে বিশ্ৰী ব্যাপার হবে।

টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন বাজছে শোবার ঘর থেকে। এর মানে কী? টেলিফোন বসার ঘরে ছিল। তার টেনে শোবার ঘরে কে নিয়ে গেছে? না না এত অস্থির হবার কিছু নেই, নিশ্চয়ই আমিই কোনো এক সময় টেলিফোন শোবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু বড় উত্তেজনার মধ্যে আছি–কিছুই মনে থাকছে না।

আমি টেলিফোন ধবলাম।

একবারও খাটের দিকে তাকালাম না। দবকার কী? টেলিফোন আসায় ভালো হয়েছে–মন কিছুটা হলেও কেন্দ্রীভূত হবে।

হ্যালো!

কে, মিজান ভাই? আমি লীনা–রুবা আপার ঘুম ভেঙেছে?

উঁ।

কী বললেন বুঝতে পারি নি।

একবার ভেঙেছিল, আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

আপনি কি কাজের মেয়ে দুটির কথা তাকে বলেছেন?

হ্যাঁ।

আপা কী বলল?

কিছু বলে নি। কথা শুনেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

কিছুই বলে নি?

না।

আপনাদের মধ্যে ঝগড়া চলছে না তো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, রুবা আপা ঘুমের ভান করে পড়ে আছে।

ভান-টান না। গভীর ঘুম।

হ্যালো মিজান ভাই! আমার ধারণা, আপনাদের মধ্যে সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছে। বলুন তো ঠিক বলছি কি-না?

আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম। অনেকক্ষণ ধরে যে বড় ধরনের বোকামি করছি তা ধরা পড়ল। কেন আমি বোকার মতো বলছি–রুবা ঘুমিয়ে আছে? আমার বলা উচিত, রুবা বাসায় নেই। পুলিশী ঝামেলা হতে পারে। পুলিশ আর কিছু পারুক না পারুক–দুনিয়ার মানুষকে প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করতে পাবে। লীনাকে খুঁজে বের করে তারা বলবে–আপনার নাম লীনা?

লীনা ভয়ে আধমরা হয়ে বলবে–জি।

ঘটনার দিন রাতে আপনি টেলিফোন কবেছিলেন। টেলিফোনে কী কী কথা হয়েছিল দয়া করে বলুন। কোনো পয়েন্ট বাদ দেবেন না। ভালো কথা, টেলিফোন কনভারসেসনের কোনো পর্যায়ে কি মিজান সাহেব বলেছেন যে, মিসেস রুবা বাসায় আছেন–ঘুমুচ্ছেন?

এ জাতীয় ঝামেলায় যাওয়াই যাবে না। কাজেই লীনাকে আমার বলে দেয়া উচিত যে, রুবা বাসায় নেই।

হ্যালো মিজান ভাই–আপনি চুপ করে আছেন, কিছু বলছেন না।

কী বলব?

রুবা আপার সঙ্গে কী আপনার ঝগড়া হয়েছে?

হুঁ।

উনি যথারীতি রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তাই না?

হ্যাঁ।

দেখলেন, আমি কেমন চট করে ধরে ফেললাম? প্রথম যখন আপনাকে টেলিফোন করলাম তখন আপনার গলা শুনেই বুঝে ফেলেছি যে আপনি সত্যি কথা বলছেন না। এখন দয়া করে সত্যি কথাটা বলুন।

ও রাগ করে সন্ধ্যার একটু আগে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। আমি খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়েছি।

শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করবেন না। রুবা আপার মার বাসায় খোঁজ করেছিলেন?

করেছিলাম, ওখানে নেই।

তার ছোট বোনের বাসায়?

ওখানে ফোন করি নি। আচ্ছা লীনা…তুমি কিছু মনে করো না, ইয়ে মানে, না থাক…

বলুন না কী বলবেন?

ওর কি কোনো…মানে ইয়ে…

না মানে, কোনো ছেলের সঙ্গে ইদানিং…

লীনা খুব হাসছে। মনে হলো দারুণ মজা পেয়েছে। হাসি থামিয়ে বলল, আচ্ছা! মিজান ভাই, বাড়ির বউদের আপনারা এমন হালকা ভাবেন কেন?

তুমি তোমার আপকে কিছু বলো না যেন। ও মনে কষ্ট পাবে।

কষ্ট তো অবশ্যই পাবে। আমি কিছু বলব না। শুনুন মিজান ভাই, আমি কিছু বলব না। আপনি বোধহয় উড়ো কথাবার্তা শুনেছেন— শুনেই আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়েছে।

উড়ো কথা কিছু আছে না-কি?

মনসুর সাহেবকে নিয়ে অনেকোব মধ্যে গুজগাজ ফিসফাস হয়। ঐসব কিছু না।

ও আচ্ছা, মনসুব সাহেবেব টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে?

হ্যাঁ, আছে। আপনি কি সেখানে টেলিফোন করবেন? খবরদার। না।

তুমি টেলিফোন নাম্বারটা দাও না।

দিচ্ছি। আপনি কিন্তু ভুলেও বলতে পাববেন না–কোথেকে টেলিফোন নাম্বার পেয়েছেন।

আচ্ছা, বলব না।

লীনা টেলিফোন নাম্বার দিল। আমি টেলিফোন নাম্বার লিখে রাখলাম, যদিও টেলিফোন নাম্বার লিখে বা খাব কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই নাম্বার আমি জানি। টেলিফোন বই-এ লেখা আছে।

যা কবার আটঘাট বেঁধে করতে হবে। কোনো রকম ফাঁক-ফোকর রাখা যাবে না। থানায় টেলিফোন করে বলে রাখতে হবে যে, রুবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। ওসি সাহেব খুব অবাক হবেন না, কারণ এব। আগেও কয়েকবার তাকে রুবার নিখোঁজ হবার খবর দিয়েছি। সবই হচ্ছে বড় পরিকল্পনার অংশ। পরিকল্পনা নিখুঁত করার জন্যে যা যা করণীয়, আমি সবই করেছি। শ্বশুরবাড়িতেও একবার টেলিফোন করা দরকার। আমার শাশুড়িকে জানানো দবকার যে, রুবা বাসায় নেই এবং রুবার সঙ্গে তার কোনো কথা হয় নি।

অনেকবার টেলিফোন করেও আমি শ্বশুর বাড়ির লাইন পেলাম না। রিং করলেই এনগেজড টোন আসে। থানায় টেলিফোন করলাম, সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন ধরল।

রোবট ধরনের গলায় শোনা গেল–ওসি রমনা। স্নামালিকুম।

আমি বললাম, ওসি সাহেব, মিজান বলছি।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। কী খরব? কী খ-ব-র?

ওসি সাহেবের খুব আন্তরিক গলা শোনা গেল। এই আন্তরিক গলা শোনার জন্যে আমাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি এই অবস্থা অনেক পরিকল্পনায় তৈরি করেছি। ওসি সাহেব হাসি হাসি গলায় বললেন, মিজান সাহেব, বলুন, খবর বলুন। ভাবি কি আবারো রাগ করে বাড়ি ছেড়ে গেছেন? হা হা হা।

ওসি সাহেবের এই বিমলানন্দের কারণ হচ্ছে, এর আগে তিনবার আমি থানায় টেলিফোন করে রুবার গৃহত্যাগের খবর দিয়েছি। একটা পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যেই এই খবর দেয়া। যাতে পুলিশ যখন রুবার মৃত্যু নিয়ে ফাইন্যাল রিপোর্ট তৈরি করবে, তখন সেই রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে–এই মহিলা প্রায়ই রাগারগি করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন।

প্রথমবার যখন রুবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার খবর দিলাম, তখন ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী চলে গেছেন, চব্বিশ ঘণ্টাও তো হয় নি, চব্বিশ ঘণ্টা পার না হলে মিসিং পারসন হয় না। ধৈর্য ধরুন। আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ করুন। আমি অত্যন্ত অনুগত গলায় বলেছি, জি আচ্ছা।

সকালের ভেতর খোঁজ না পেলে থানায় চলে আসবেন।

জি আচ্ছা।

আমি সকালবেলায় থানায় চলে গেলাম। ওসি সাহেবকে বললাম, আমার স্ত্রীকে পাওয়া গেছে। ও সকাল আটটার সময় বাসায় এসেছে।

ওসি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন–দেখলেন তো, আমার কথা। ফলে গেল। এও অল্পতে অস্থির হওয়া ঠিক না।

আর অস্থির হবো না। আমি আপনার জন্যে সামান্য গিফট এনেছি। আপনি কি নেবেন?

ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বলতেন, কী গিফট?

আমি খবরের কাগজে মোড়া এক কার্টুন বেনসন এন্ড হেজেস এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, আপনাকে গভীর রাতে টেলিফোন করেছি, এই জন্যে…

ওসি সাহেব খুশি খুশি গলায় কপট বিরক্তি মিশিয়ে বললেন, পুলিশকে গভীর রাতে বিরক্ত করবেন না তো কাকে বিরক্ত করবেন? এই জাতীয় সমস্যা হলে টেলিফোন করবেন। যত রাতই হোক, করবেন। আমরা পুলিশরা আছি কী জন্যে?

দ্বিতীয় দফায় আমি আবার রুবার গৃহত্যাগের খবর দিলাম এবং যথারীতি পরদিন ভোরে খবর দিলাম যে, আমার স্ত্রী ফিরে এসেছে। এবারো এক কার্টুন সিগারেট নিয়ে গেলাম।

ওসি সাহেবের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। ওসি সাহেব ধরে নিলেন, আমি নির্বোধ ধরনের ভালো মানুষ গোছের একজন মানুষ, যাকে তার স্ত্রী তেমন পছন্দ করে না বলে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

এ পর্যন্ত চার কার্টুন বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট আমি ওসি সাহেবকে দিয়েছি। এই চার কার্টুন সিগারেটের দাম দুই হাজার পাঁচশ টাকা। এই দুই হাজার পাঁচশ টাকায় আমি এখন যে উপকারটা পাব তার দাম দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা।

স্ত্রী খুন হলে প্রথম সন্দেহ এসে পড়ে স্বামীর ওপর। থানার ওসি গোড়াতেই ধরে নেন–স্বামী এই খুনটি করেছে। আমার বেলায় এটা হবে না। ওসি রমনা থানা আমাকে খুনী ভেবে নিয়ে তদন্ত শুরু করবেন না। তিনি ধরেই নেবেন আমি সাতেও নেই পাচেও নেই। একজন মানুষ। আমাকে ঝামেলা থেকে রক্ষা করা তখন তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়াবে।

মিজান সাহেব।

জি।

চুপ করে আছেন কেন, কথা বলুন, ভাবি কি আবার গৃহত্যাগী?

জি।

আপনি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়েছেন–রাত তো মাত্র এগারোটা পঁচিশ। সকাল পর্যন্ত ধৈৰ্য ধরে অপেক্ষা করুন এবং বেনসন এন্ড হেজেসের কার্টুন নিয়ে আমার এখানে চলে আসুন। ভাবির গৃহত্যাগ মানে তো আমার লাভ–হা-হা-হা।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করলাম। ওসি সাহেব বললেন, কী হলো?

আমি বললাম, কিছু না। মনটা খুব খারাপ।

আমার একটা উপদেশ শুনুন ভাই সাহেব, স্ত্রীকে কম ভালোবাসবেন। স্ত্রীকে যত কম ভালোবাসবেন ততই কম যন্ত্রণা পোহাতে হবে। ভালোবেসেছেন কি মরেছেন। সম্রাট শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, স্ত্রীকে ভালোবেসে কী বিপদে পড়েছে! সব টাকা পয়সা খরচ করে তাজমহল বানাতে হলো–হা-হা-হা। আপনার যা নেচার আমার তো মনে হয় আপনিও তাজমহল-টহল কিছু বানাবেন। মিজান সাহেব!

জি।

আজ। আপনাকে অন্যদিনের চেয়েও মনমরা মনে হচ্ছে। ব্যাপার কী বলুন তো? ঝগড়া কি চূড়ান্ত রকমের হয়েছে না-কি?

জি-না। আজ ওর কাছে লেখা একটা চিঠি হঠাৎ ড্রয়ারে পেয়ে মনটা খারাপ হয়েছে।

চিঠি? কার চিঠি?

বাদ দিন।

না, না। বাদ দেব কেন? আপনি আমার বন্ধু মানুষ। আপনার একটা সমস্যা হলে আমি দেখব না? কী পেয়েছেন বলুন। প্রেমপত্র?

হুঁ।

কে লিখেছে?

বাদ দিন।

নামটা বলুন। খোঁজ নেব। স্ট্রেইট লাইন বানিয়ে ছেড়ে দেব।

ওর নাম মনসুর। আমার ধারণা, রুবা এখন ওর বাসাতেই আছে। চক্ষুলজ্জায় পড়ে খোঁজ নিতে পারছি না।

আপনাকে কোনো খোঁজ নিতে হবে না। আপনি ডেলিকেট অবস্থায় পড়েছেন সেটা বুঝতে পারছি। খোঁজ-খবর আমিই করব। টেলিফোন নাম্বার আছে ঐ লোকের? থাকলে দিন। এক্ষুণি পাত্তা লাগাচ্ছি। তারপরেই আমি আপনাকে জানাব। মন খারাপ করবেন। না ভাই। বি হ্যাপি। লাইফে এরকম হয়।

আমি মনসুরের টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিলাম। এখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছি। মনটা হালকা লাগছে। আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমি এখন যা করব তা হলো…

পানির পিপাসা হচ্ছে। তীব্ৰ পানির পিপাসা। পোলাও খাবার জন্যে এটা হচ্ছে। পানির পিপাসার একটা ব্যাপার হচ্ছে এটা আস্তে আস্তে হয় না। হঠাৎ পিপাসা শুরু হয়। আমি ফ্রিজ খুলে পরপর দু গ্লাস পানি খেলাম। বাথরুম সেরে রাখার জন্যে বাথরুমে ঢুকলাম। দুগ্নাস পানি খেয়েছি, বাথরুম তো পাবেই। বাথরুমের দরজা বন্ধ করা মাত্ৰই হঠাৎ মনে হলো— এখন যদি দরজা আর খুলতে না পারি তাহলে কী হবে? এরকম একটা গল্প কোথায় যেন পড়েছিলাম— বন্ধু একা থাকে, তাকে সে খুন করল। খুনের পর পর তার খুব পিপাসা পেয়ে গেল। সে পুরো এক জগ পানি খেয়ে ফেলল। পানি খাওয়ার পর পর ঢুকাল বাথরুমে। দরজা বন্ধ করে বাথরুম সারল, তারপর আর বাথরুমের দরজা খুলতে পারে না। ছিটিকিনি শক্ত হয়ে এঁটে গেছে। প্রাণপণ শক্তি দিয়েও সে কিছুই করতে পারছে না। পরদিন পুলিশ এসে দরজা খুলে তাকে বের করল। অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপার এর মধ্যে ছিল না, পুরো ব্যাপারটাই ছিল সাধারণ একটা ব্যাপার। খুনীর শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মাংসপেশি হয়েছিল শিথিল। শিথিল মাংসপেশি নিয়ে সে ছিটিকিনি খুলতে পারছিল না। যতই সময় যাচ্ছিল ততই তার শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এর বেশি কিছু না।

আরেকটা গল্প শুনেছিলাম।–এক লোক গরু বিক্রি করে ফিরছে। পথে এশার নামাজের সময় হলো। সে নামাজ পড়তে ঢুকল এক গ্রামের মসজিদে। তাকে অনুসরণ করছিল এক চোর। সেও সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে ঢুকল। মুসল্পীরা নামাজ শেষ করে চলে গেছেন। সে একা একাই নামায়ে দাঁড়াল। তখন চোরটা তাকে জাপ্টে ধরল। টাকা নেবার জন্যে। দুজনে ধস্তাধস্তি হচ্ছে–চোরটা এক পর্যায়ে ছুরি বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। চোরটা গরু বিক্রির টাকাটা নিয়ে নিল। তারপরেই হলো সমস্যা। চোর সারা ছোটাছুটি করছে। দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাকুল হয়ে সে ঘুরছে আর চেঁচাচ্ছে–দরজা কই? দরজা কই?

পুরো সাইকোলজিক্যাল একটা ব্যাপার। এর মধ্যে অতিপ্রাকৃত কিছু নেই। ভূমিকম্পের সময়ও এরকম হয়। আতঙ্কগ্ৰস্ত মানুষ ঘরের ভেতর ছোটাছুটি করে দরজা খুঁজে পায় না। আগুন লাগলেও এমন হয়। আমার মেজো মামার বাড়িতে একবার আগুন লাগল। ঘুম ভেঙেই তিনি দেখেন–দাউ দাউ করছে আগুন। তিনি ছোটাছুটি করতে লাগলেন এবং চেঁচাতে লাগলেন, দরজা পাইতেছি না! দরজা!

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress