Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ম্যাকসাহেবের নাতনি (১৯৯৫) || Samaresh Majumdar » Page 2

ম্যাকসাহেবের নাতনি (১৯৯৫) || Samaresh Majumdar

সব শুনে মা বললেন, আহা, বিদেশ বিঁভুই থেকে এসেছে মেয়েটা, তাকে তুই না খাইয়ে রাখবি এ কেমন কথা? ওকে বরং আমাদের বাড়িতে নিয়ে আয়।

অর্জুন অবাক হল, আমাদের বাড়িতে? এখানে ও থাকতে পারবে?

কেন পারবে না? আমরা তো আছি।

ওহো, তুমি বুঝতে পারছ না, ওরা এরকম বাঙালি পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত নয়।

তুই সব জেনে বসে আছিস! সিস্টার নিবেদিতা থাকতেন না? অ্যানি বেসান্ত ছিলেন না? নেলি সেনগুপ্তের নাম শুনিসনি? তুই যা, মেয়েটাকে নিয়ে আয়। ও যেমন খেতে চায় তেমনই নাহয় আমি বানিয়ে দেব। মা আশ্বাস দিলেন।

অর্জুন নিজের বাড়ির দিকে তাকাল। মধ্যবিত্ত চেহারার এই বাড়িটি তার কাছে প্রিয় হলেও একজন বিদেশিনীর কাছে অনেক অসুবিধের কারণ হবেই। মা সেটা বুঝবেন না। তার চেয়ে মায়ের রান্না খাবার যদি ডরোথির কাছে সে পৌঁছে দেয়, তা হলে দুকুলই রক্ষে হবে। মাকে সে কোনও মতে এই ব্যবস্থায় রাজি করালো।

মোটর বাইকটা বিকেলের আগে তৈরি হবে না। ওটা থাকলে ঘোরাফেরা করা সহজ হত। স্নান সেরে মায়ের রান্না খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে নিয়ে রিকশায় চেপে তিস্তা ভবনের দিকে চলল সে। এখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষ কম। হঠাৎ তার খেয়াল হল ডরোথি আসছে ইংল্যান্ড থেকে। লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বাগডোগরায় নামাই তো স্বাভাবিক ছিল। তা না করে ও কলকাতা ঘুরে এল কেন? কলকাতায় কি ওর কোনও কাজ ছিল? ওর মতো একা মেয়ের কলকাতা শহরে কী কাজ থাকতে পারে, যখন জলপাইগুড়িতে আসার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে?

টিফিন ক্যারিয়ার দেখে খুব খুশি ডরোথি। যখন শুনল অর্জুনের মা নিজের হাতে রান্না করেছেন তখন আরও উচ্ছ্বসিত। বলল, লন্ডনে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে আমি একবার খেয়েছি। ফুড ওয়াজ গুড। কিন্তু ঠাকুরদার ডায়েরিতে বেঙ্গলি কারির কথা পড়েছি, সেটা কখনও খাইনি। আচ্ছা, খুব মশলা দেওয়া নয় তো?

অর্জুন বলল, খেয়ে দ্যাখো। তিস্তা ভবনের বেয়ারা এসে টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার সার্ভ করল প্লেটে। কাঁটা চামচের বদলে অর্জুনকে হাত দিয়ে খেতে দেখে ডরোথি উৎসাহিত হল। মায়ের হাতের রান্না অর্জুনের খু প্রিয়। আজ অবশ্য ইচ্ছে করেই মশলা কম দিয়েছেন, ঝাল তো নয়ই। অর্জুন ঠিক সেই স্বাদ না পেলেও ডরোথি খুব খুশি। বলল, তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করব। এইসব রান্নার রেসিপি চাই।

তুমি কতদিন আছ এখানে?

এটা নির্ভর করছে আমার কাজ কবে শেষ হচ্ছে তার ওপর। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে ডরোথি বলল, এভাবে হাত দিয়ে আমি কখনও খাইনি।

তুমি তো কখনওই ইন্ডিয়ায় আসোনি।

দ্যাট্‌স রাইট।

আচ্ছা, তুমি দিল্লি থেকে সরাসরি না এসে কলকাতা হয়ে এলে কেন?

ডরোথি মাথা নাড়ল, আমি জানতাম না দিল্লি হয়ে এখানে আসা যায়। আমার টিকিট কলকাতা পর্যন্ত করা ছিল।

ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে হল না অর্জুনের। জলপাইগুড়িতে পৌঁছবার জন্য বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নামতে হবে, তা লন্ডনের ট্রাভেল এজেন্টরা জানতে পারে। ব্যাগ থেকে একটা লম্বা ডায়েরি বের করে ডরোথি সোফায় বসল, যে তিনজনের নাম-ঠিকানা ঠাকুরদার ডায়েরিতে ছিল, তাদের তুমি আজই খুঁজে বের করতে পারবে?

অর্জুন হাসল, তাঁরা যদি জীবিত থাকেন এবং এই শহরে বাস করেন, তা হলে চেষ্টা করতে পারি। আচ্ছা, ঠিকানা যখন আছে বলছ তখন লন্ডন থেকে

ওঁদের চিঠি লিখলে না কেন? সেটা অনেক সহজ হত।

আমি নিজে ওঁদের সামনে যেতে চাই।

ওঃ। নামগুলো বলো।

কামালাকান্ত রয় বাবুপাড়া, জলপাইগুড়ি। ঠিক আছে?

কমলাকান্ত রায়। দ্বিতীয় নাম?

দেবদাস মিটার। ডরোথি মন দিয়ে পড়ছিল, হি ইজ ফ্রম রাইকটপাড়া। ডরোথি হাসল। নিজের নাম উচ্চারণ যে সঠিক হয়নি, তা বুঝতে পারছিল।

তিন নম্বর মানুষটির নাম তারিণী সেন। এর কোনও ঠিকানা নেই।

অর্জুন মাথা নাড়ল, কমলাকান্ত রায়ের নাম আমি শুনেছি। বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। কিন্তু তিনি মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে।

ওঃ। ওঁর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে?

তাঁরা থাকতে পারেন।

তা হলে তাঁদের সঙ্গেই দেখা করতে চাই।

অর্জুন ঘড়ি দেখল। এখন দুপুরবেলা। এই সময় এখানে সবাই খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নেয়। আমরা বরং বিকেলে যেতে পারি।

ডরোথির সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে অর্জুন যখন উঠে দাঁড়াল, তখন দুটো বেজে গেছে। ডরোথি বলল, তুমি চলে যাচ্ছ, আমার কিন্তু এখানে বসে থাকতে একটুও ভাল লাগছে না।

অর্জুন সেটা বুঝতে পারছিল। কিন্তু এই ভরদুপুরে মেয়েটাকে নিয়ে সে কোথায় ঘুরবে?

ডরোথি বলল, একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে পারি না?

তা পারি। কিন্তু সেটা বেশ এক্সপেন্সিভ হবে।

ডরোথি হাসল, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমাদের এক পাউন্ড মানে তোমাদের আটচল্লিশ টাকার সমান। ইন্ডিয়াতে এসে মনেই হয় না পয়সা খরচ হচ্ছে।

শুনতে মোটেই ভাল লাগল না, কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি; ইংল্যান্ড তার প্রায় সমস্ত কলোনি হারিয়েও যে অর্থনৈতিক কাঠামো ধরে রেখেছে, তার সঙ্গে কবে যে ভারতবর্ষ পাল্লা দিতে পারবে। বাংলো থেকে বেরিয়ে ডরোথিকে নিয়ে একটা রিকশাতে উঠল অর্জুন। খানিকটা যেতেই সে দেখল একটা কালো অ্যাম্বাসাডার তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেস্ট হাউসে তো অতিথিরা আসবেই।

রিকশায় বসে অর্জুনের মনে হল, জলপাইগুড়ি শহরে কাউকে দেখানোর মতো দ্রষ্টব্য জিনিস কিছু নেই। ওই জুবিলি পার্ক অথবা রাজবাড়ির দিঘি এখন এত হতশ্রী যে, বিদেশিনী দূরের কথা, কলকাতার মানুষও মুখ তুলে চাইবে না। অথচ তার নিজের কাছে পোস্ট অফিসের মোড়, করলা নদীর পাশ দিয়ে থানায় যাওয়ার রাস্তাকে কত মোলায়েম মনে হয়। জীবনদার বই-এর দোকানে সে পুরোটা দিন কাটিয়ে দিতে পারে। এ সবই নিজের জন্য। সে ডরোথিকে বলল, এই শহরটা খুবই সাধারণ।

আসলে সে আটপৌরে শব্দটা ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইংরেজিতে প্রতিশব্দ না জানা থাকায় সিম্পল বলতে বাধ্য হযেছিল। ডরোথি মাথা নাড়ল, হাঁ। আমার খুব অদ্ভুত লাগছে। বেঁচে থাকাটা কেমন অদ্ভুত ধরনের।

তোমার কাছে যতই অদ্ভুত লাগুক, আমরা ভাল আছি, মনে মনে বলল অর্জুন। সে লক্ষ করছিল, পথচারীরা বারংবার রিকশার দিকে তাকাচ্ছে। একজন বিদেশিনীকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছে সবাই। এই মফস্বল শহরে বিদেশিনীকে কেউ রিকশায় চেপে ঘুরতে দেখে না। তারা এই শহরে বড় একটা আসে না। কিন্তু এখন এইভাবে দেখতে চাওয়াটা প্রায় হ্যাংলামোর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তা এখানকার মানুষের খেয়ালে থাকে না।

গ্যারাজের সামনে পৌঁছে সুখবর পেল অর্জুন। তার বাইক ঠিক করে ফেলেছে মেকানিক। তৎক্ষণাৎ রিকশা ছেড়ে দিল সে। লাল বাইকটা বের করে ডরোথিকে বলল, উঠে বোসো।

এটা তোমার?

হ্যাঁ।

বাইকে বসতে ডরোথি অভ্যস্ত। তাকে নিয়ে গোটা শহরটাকে পাক দিয়ে তিস্তা বাঁধের ওপর পৌঁছল অর্জুন। ডরোথি বলল, এ কী রকম নদী, যাতে জল নেই?

বর্ষাকালে দেখলে ভয় পাবে। পাহাড়ি নদীর চেহারা ঋতু অনুযায়ী পালটায়।

নদীর ওপারে কী?

ড়ুয়ার্স।

হ্যাঁ, এই নামটা ঠাকুরদার ডায়েরিতে পড়েছি।

চারটে বেজে গিয়েছিল। ডরোথিকে নিয়ে বাবুপাড়ায় চলে এল অর্জুন। এই শহরের অনেকেই বিপ্লবী কমলাকান্ত রায়ের বাড়ি চেনে। পুরনো ধাঁচের বাড়ি, এমহল সে-মহল। কমলাকান্ত রায় বিত্তবান মানুষ ছিলেন। এখন সিমেন্টের গেট আছে, কিন্তু তাতে আগল নেই। ভেতরে ঢুকে বাইক বন্ধ করতেই একটি অল্পবয়সী ছেলে বেরিয়ে এল। সে যে অর্জুনকে চিনতে পেরেছে তা বোঝা যাচ্ছিল তার মুখের হাসি দেখে। কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি?

তুমি এখানে থাকো?

হ্যাঁ। আমাদের বাড়ি।

কমলাকান্ত রায় তোমার কে হন?

বুড়ো দাদু, মানে আমার বাবার ঠাকুরদা। আসুন না ভেতরে। ছেলেটি ওদের বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। কয়েকটা আসবাব, বেশ পুরনো ধাঁচের, জলপাইগুলির সাবেকি বাড়িগুলোয় যেমন দেখা যায়, এই বসার ঘরও তেমনই।

চেয়ারে বসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার বুড়ো দাদু কবে মারা গিয়েছেন?

অনেক আগে। আপনি ওঁর সম্পর্কে জানতে চান?

অর্জুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ছেলেটা ভেতরে চলে গেল। এতক্ষণ কথা হচ্ছিল বাংলায়। ডরোথি জিজ্ঞেস করল, কী বলল?

এই ছেলেটি কমলা রায়ের গ্রেট গ্র্যান্ডসন। কমলাকান্ত মারা গিয়েছেন। অনেকদিন আগে। অর্জুন হাসল, তুমি বড় দেরিতে এখানে এলে।

বেটার লেট দ্যান নেভার। ডরোথি কাঁধ নাচাল।

এই সময় ছেলেটি এক বৃদ্ধকে নিয়ে ফিরে এল। অর্জুন উঠে দাঁড়াল, দেখাদেখি ডরোথিও। নমস্কার জানিয়ে অর্জুন নিজের পরিচয় দিল। ছেলেটি বলল, আমার দাদু।

ভদ্রলোক ওদের বসতে বললেন। ফরসা, রোগা, কিন্তু অভিজাত চেহারা। বললেন, আমি আপনার নাম শুনেছি। কী দরকার বলুন?

অর্জুন ডরোথির পরিচয় দিল, ইনি ডরোথি। লন্ডন থেকে এসেছেন। ডরোথি, ইনি মিস্টার রায়, ওঁর বাবার নাম কমলাকান্ত রায়।

ডরোথি মাথা নাড়ল। বোঝা যাচ্ছিল সে একটু অস্বস্তিতে রয়েছে।

অর্জুন বলল, আমার সঙ্গে ওর পরিচয় আজকেই। ওর ঠাকুরদা এক সময় এই শহরে ছিলেন। বাকিটা আপনি ওর কাছেই শুনুন। ইচ্ছে করেই এই কথাগুলো সে ইংরেজিতে বলল, যাতে ডরোথি বুঝতে পারে।

ডরোথি বলল, মিস্টার রায়, ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর কিন্তু আমি আমার ঠাকুরদার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে এসেছি। আপনার বাবা এখন জীবিত নেই, তাই আপনার কাছে আমি তাঁর হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

বৃদ্ধ বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কেন ক্ষমা চাইতে এসেছেন? আপনার ঠাকুরদার নাম কী?

রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড।

আচ্ছা! অদ্ভুত ব্যাপার! বৃদ্ধ সোজা হয়ে বসলেন।

ডরোথি বলল, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের একজন দায়িত্বশীল কর্মচারী হিসেবে ঠাকুরদাকে অনেক কাজ করতে হত। আমি তাঁর ডায়েরিতে পড়েছি, আপনার বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁকে বিরত করতে উনি প্রচণ্ড অত্যাচার করেছিলেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল অল্প। পরে এ-নিয়ে তিনি খুব অনুশোচনা করতেন।

ম্যাকসাহেব অনুশোচনা করতেন? এটাও অদ্ভুত ব্যাপার। বৃদ্ধ বললেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি মিস্টার ম্যাকডোনাল্ড সম্পর্কে কিছু জানেন?

জানি। তখন আমি প্রায় যুবক। বিপ্লবীরা ওকে হায়েনার মতো ঘৃণা করত। বাগে পেলে উনি চোরকে ছেড়ে দিতেন, কিন্তু বিপ্লবীকে নয়। আমার বাবার ডান হাত আর ডান পা উনি চিরকালের মতো অকেজো করে দিয়েছিলেন।

ডরোথি মাথা নামাল। কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে। ওর কথা মনে রেখে।

বৃদ্ধ বললেন, উনিশশো চৌত্রিশে রায়কতপাড়ার নির্মল চক্রবর্তী পিস্তল সমেত গ্রেফতার হন। ওঁর সঙ্গে শচীন বোস আর শঙ্কর সান্যাল। এঁদের ওপর কী পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে, তা বলার নয়! ম্যাকসাহেবের অত্যাচার চলেছিল ঊনচল্লিশ পর্যন্ত। ওই বছরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস বসল জলপাইগুড়িতে। চারু সান্যাল, খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে পাণ্ডাপাড়ার সেই বিশাল অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতায় তিনি স্লোগান তুলেছিলেন, ইংরেজ ভারত ছাড়ো। ওই অধিবেশনের পরই ম্যাকসাহেব বদলি হলেন এখান থেকে। যা হোক, এ সব অনেক দিনের কথা। তোমার ঠাকুরদাকে আমরা ঘৃণা করতাম। কিন্তু সময় তো সব স্মৃতির ওপর পলিমাটি ফেলে। এখন শুধু খারাপ লাগাটা আছে, কিন্তু সেই জ্বালাটা নেই। ম্যাকসাহেবের তত বেঁচে থাকার কথা নয়!

ডরোথি বলল, না, উনি বেঁচে নেই।

তুমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছ?

হ্যাঁ। শেষ বয়সে ওঁর অনুশোচনা হয়েছিল।

আমি আব কী করতে পারি! এখন ক্ষমা করা আর না করার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। অতদূর থেকে এসে তুমি আমাকে কথাগুলো বললে, শুধু এর জন্যে ধন্যবাদ। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। এব্যাপারে আর কথা বলতে চাইছেন না, তা বুঝতে পারা গেল।

ডরোথি বলল, আমি আপনার সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারছি। আমার কোনও ব্যক্তিগত দায় ছিল না এখানে আসার, কিন্তু ঠাকুরদার ডায়েরি পড়ে আমি সেন্টিমেন্টাল কারণেই এত দূরে এসেছি। আচ্ছা, আমি কি মিস্টার রায় সম্পর্কে কিছু জানতে পারি না আপনার কাছে?

বৃদ্ধ তাকালেন। তাঁর মুখের চেহারা নরম হয়ে এল। নাতির দিকে তাকিয়ে বাংলায় বললেন, ভেতরে গিয়ে এঁদের জন্যে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে বলো।

অর্জুন বাধা দিল। আমরা খানিক আগে ভাত খেয়েছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না।

বৃদ্ধ ডরোথির দিকে তাকালেন, তুমি আমাদের পারিবারিক শত্রুর নাতনি হতে পারো, কিন্তু বাড়িতে যখন এসেছ তখন কিছু খেয়ে যেতে হবে। চা, কফি, না সরবত?

ডরোথি হাসল, টি উইদাউট মিল্ক অ্যান্ড সুগার।

ছেলেটি চলে গেল ভেতরে। বৃদ্ধ বললেন, আমার বাবা কমলাকান্ত রায় কংগ্রেস করতেন। শশিকুমার নিয়োগী, তারিণী প্রসাদ রায়রা উনিশশো সাত সালে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে আর্য নাট্য সমাজে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। সত্যেন বিশ্বাস, মহেন্দ্র ঘটক, হরেন ভৌমিকরা ছিলেন ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র। এঁরা পরে জলপাইগুড়িতে বিখ্যাত হন। বাবা কিছুদিন ওই বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর যজ্ঞেশ্বর সান্যাল যখন জাপান থেকে কাপড় বোনা শিখে এসে শিল্পসমিতি পাড়ায় বিলিতি বস্ত্রের পালটা দিশি বস্ত্র তৈরিতে নামলেন, তখন বাবা ওঁর সঙ্গে যোগ দেন। উনিশশো কুড়ি সাল থেকে বাবা গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বাবাকে প্রথম গ্রেফতার করা হল উনিশশো তিরিশে। তখন আইন অমান্য আন্দোলন চলছে, বিজয়া দশমীর দিন করলার দুপাশে মানুষের ভিড়। সবাই ভাসান দেখছে। প্রতিমা নিয়ে নৌকো চলছে। সঙ্গে আর-একটি নৌকো। সেই নৌকো থেকে স্লোগান উঠছিল, বিলিতি জিনিস বয়কট করো, মাদকদ্রব্য বর্জন করো। পুলিশ সেই ভাসানের নৌকোর ওপর আক্রমণ করল। বীরেন্দ্র দত্ত, চারু সান্যাল মশাইদের সঙ্গে বাবাও গ্রেফতার হলেন। বাবা ছাড়া পান গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর। এরপর ওই ম্যাকসাহেব এলেন জলপাইগুড়িতে। ওঁর কানে বন্দেমাতরম্ শব্দটা ঢুকলেই যেন পাগল হয়ে যেতেন। কোনও রকম প্ররোচনা ছাড়াই তিনি মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করতে বলতেন। পুলিশকে। তেমন তেমন বন্দি হলে এমন অত্যাচার করতেন, যাতে সে আদালতে যেতে না পারে। আর আদালত তো ব্রিটিশদেরই ছিল। তবু মাঝে-মাঝে বিচারকের চক্ষুলজ্জা হত। সেই কারণে ম্যাকসাহেব তাঁদের বিব্রত করতে চাইতেন না। পাটগ্রামের কেশব দত্তের নাম এক কালে সবাই জানত। সাধারণ মানুষের বন্ধু ছিলেন তিনি। পাটগ্রামের বাঁশকাটায় প্রতি বছর মেলা বসত। সেই মেলায় যে জুয়া খেলা হত তাতে নিঃস্ব হয়ে যেত মানুষ। কেশব দত্ত তা বন্ধ করতে চান। ফলে পুলিশ গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। একজন নিহত হন। বাবা এর প্রতিবাদে অনশন শুরু করলে ম্যাকসাহেব তাঁকে নিষেধ করেন। বাবা সেই নিষেধে কর্ণপাত না করায় এক মাঝরাত্রে পুলিশ বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন বাবার কোনও খোঁজ পাই না। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন কৃষক বাবাকে অর্ধমৃত অবস্থায় বার্নিশে নিয়ে আসে। সুস্থ হয়ে কথা বলতে ওঁর দু সপ্তাহ সময় লাগে। ওই তিনদিন তিস্তার ওপারে একটা পোড়ো বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল। রোজ রাত্রে ম্যাকসাহেব যেতেন তাঁর কাছে। যতরকমের অত্যাচার করা সম্ভব, তিনি তা করেছেন বাবার ওপরে। বাবা আর ভালভাবে হাঁটাচলা বাকি জীবনে করতে পারেননি। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন।

ডরোথি চুপচাপ শুনছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, ওই জায়গায় কি নৌকো করে যেতে হয়?

নৌকো?। তখন নৌকো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তিস্তার ওপর তখন ব্রিজ বানাবার কথা কেউ ভাবত না।

ওই পোড়ড়া বাড়িটা যেখানে ছিল, সেই জায়গাটার নাম কী?

দোহমনি। বার্নিশের কাছেই। কিন্তু এখন বাড়িটার কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। যা হোক, ম্যাকসাহেবের নাতনি হওয়া সত্ত্বেও তোমার মধ্যে যে মানবতাবোধ দেখতে পাচ্ছি তাতে আমি খুশি। আমার পরিবারের সবাইকে আমি তোমার কথা বলব।

অর্জুন উঠে পড়ল। দেখাদেখি ডরোথিও।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আপনি দেবদাস মিত্র নামে রায়কতপাড়ার কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীকে চেনেন?

নিশ্চয়ই। উনি বাবারই সহকর্মী।

উনি এখন–?

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, না। দেবদাসকাকু অনেকদিন আগে মারা গিয়েছেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর ভাইরা বিষয়সম্পত্তি ফ্লাডের পর বিক্রি করে দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন তা জানা নেই।

অর্জুন খুশি হল। তালিকা থেকে একটি নাম কাটা গেল।

বাইরে বেরিয়ে ডরোথি কথা বলেনি। ওর মুখ বেশ বিমর্ষ। অর্জুনের মনে হয়েছিল এটা খুবই স্বাভাবিক, নিজের পূর্বপুরুষের ওইরকম কীর্তির কথা শুনলে কারও মন ভাল থাকতে পারে না। বাইকে ওঠার পর খেয়াল হয়েছিল তৃতীয় নাম, তারিণী সেনের কথা জিজ্ঞেস করা হল না বৃদ্ধকে। তারিণী সেনের হদিস পেলে ডরোথির আর এখানে থাকার দরকার হত না।

এখন ছায়া ঘন হচ্ছে জলপাইগুড়ির রাস্তায়। রিকশার ভিড় বাড়ছে। তবু এখনও এই শহরে বুক ভরে নির্মল বাতাস নেওয়া যায়। পোস্ট অফিসের মোড় পেরিয়ে তিস্তা ভবনের দিকে যেতে-যেতে অর্জুনের মনে এল কথাটা। ডরোথিকে একা রাত্রে থাকতে হবে তিস্তা ভবনে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনও দুনাম নেই, তবু কোনও মেয়ের পক্ষে একা থাকা কি ঠিক! এক্ষেত্রে সে কী করতে পারে? তিস্তা ভবনে গিয়ে সে থাকতে পারে না। বরং ডরোথি যদি তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকে–।

তিস্তা ভবনে পৌঁছে অর্জুন ডরোথিকে তার ভাবনার কথা জানাল।

ডরোথি হাসল, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি লন্ডন থেকে একা তোমাদের দেশে এসেছি। আমি জানি কীভাবে নিজেকে নিরাপদে রাখতে হয়।

অর্জুন তাকাল। হ্যাঁ, ডরোথির স্বাস্থ্য ভাল। কিন্তু এতটা অহঙ্কার করা উচিত কি? খালি হাতে কজনের সঙ্গে মোকাবিলা করা সম্ভব? কিন্তু বলতে হবে, মেয়েটার সাহস আছে। সে জানল ডরোথি আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার খায় এবং ওই সময়ের মধ্যে ফিরে আসবে কথা দিয়ে বেরিয়ে এল।

জলপাইগুড়িতে সন্ধেব মুখে এখনও অনেক বাড়িতে শাঁখ বাজে। তার শব্দ শুনতে বেশ ভালই লাগে। এখন শঙ্খধ্বনি শুনতে-শুনতে সে বাইকে চেপে পাহাড়ি পাড়ায় সুধীর মৈত্রের বাড়িতে চলে এল। সুধীরবাবু অর্জুনকে দেখে খুশি হলেন। ভদ্রলোকের সামনে অনেক বই ছড়ানো। বললেন, এসো, এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম। এই রিচার্ডসাহেব তো বেশ কৃতী পুরুষ দেখছি।

অর্জুন বসল। চশমা খুললেন সুধীরবাবু। সমস্ত দেশের তুলনায় জলপাইগুড়িতে স্বাধীনতা আন্দোলন কিন্তু অনেক পরে শুরু হয়। এখানকার জেলা কংগ্রেসের জন্ম উনিশশো কুড়ি সালে। ওই সময়টা ধরলে মাত্র সাতাশ বছর পরে দেশ স্বাধীন হয়। তাই ইংরেজ সরকার প্রথম দিকে জলপাইগুড়ি নিয়ে আদৌ দুশ্চিন্তায় ছিলেন না। এখানে তাই দুদে ব্রিটিশ অফিসারকে পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেননি তাঁরা। উনিশশো বত্রিশ সাল থেকে এ-জেলায় আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। তখন যেসব ব্রিটিশ অফিসারকে আমি জেলা গেজেটিয়ারে পাই তাঁদের মধ্যে রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড আছেন। তাঁর কাজ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করা এবং তিনি সেটা করতে চেষ্টা করেছেন। তখন জেলার বেশির ভাগ চা-বাগানগুলোর ম্যানেজার সাদা চামড়ার মানুষ। রিচার্ডসাহেব এঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তিস্তা পেরিয়ে হানা দিতেন স্বদেশীদের আড্ডায়। একটা সময় লোকে তাঁকে ম্যাকসাহেব বলে ডাকতে লাগল। ম্যাকসাহেবের মুখে পড়া মানে হায়েনার গলায় হাত দেওয়া। লোকটার কিন্তু একটা গুণ ছিল। কাউকে প্রাণে মেরে ফেলত না, শুধু অকেজো করে দিত সারাজীবনের মতো। সুধীরবাবু আবার চশমা পরলেন, একটা তথ্য পেয়েছি এবং সেটা সামান্য অদ্ভুত। দিশি ঠাকুর-দেবতাদের সম্পর্কে অনেক বিদেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ম্যাকসাহেবের চরিত্র যা ছিল, তাতে তিনি কেন জল্পেশের মন্দির সম্পর্কে আগ্রহী হবেন বুঝতে পারছি না।

কীরকম আগ্রহী হয়েছিলেন?

এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে ভদ্রলোক প্রায়ই বার্নিশ, দোমহনি এবং জল্পেশ অঞ্চলে যাতায়াত করতেন। তখন তিস্তার ওপর ব্রিজ ছিল না। নৌকোয় গাড়ি নিয়ে নদী পার হওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু তাঁর উৎসাহ কম ছিল না। অথচ এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল থাকাকালীন তাঁর জল্পেশ সম্পর্কে কোনও উৎসাহ ছিল না, হল যাওয়ার আগে। কমলাকান্ত রায়ের ওপর তিনি অত্যাচার করেছিলেন ওই অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে। দেবদাস মিত্রকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পাওয়া যায় বার্নিশে। অথচ এ সবের কোনও কারণ ছিল না। ম্যাকসাহেব স্বচ্ছন্দে নিজের বাংলোতেই কর্মটি সারতে পারতেন।

দেবদাস মিত্র তো স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।

হ্যাঁ। ডেডিকেটেড মানুষ। প্রথমে মহাত্মা গান্ধী, পরে সুভাষচন্দ্রের অনুগামী হন। জেলার আধিয়ার আন্দোলনের শরিক ছিলেন একসময়। আর তখনই ম্যাকসাহেবের কুনজরে পড়েন। আধিয়ার কাদের বলে জানো?

অর্জুন মাথা নাড়ল, কৃষকদের।

সুধীরবাবু বললেন, উত্তরবঙ্গের গ্রামের মানুষদের অধিকাংশই জমির মালিক ছিল না। জোতদারের জমিতে চাষ করে উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক পেত তারা। এই কারণে তাদের আধিয়ার বলা হত। ওই অর্ধেক ফসলে তাদের সারা বছর চলত না। ফলে ধার করতে হত। তার ওপর নানা রকম কর দিতে হত গরিব মানুষগুলোকে। উনিশশো আটত্রিশ সালে জেলা কংগ্রেসের বামপন্থী মানসিকতার মানুষরা কৃষক সংগঠনী সমিতি গঠন করেন। দেবদাসবাবু ওই সংগঠনের পক্ষে কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। হাটে-হাটে লিফলেট বিলি করা হয় কৃষকদের একত্রিত করতে। এদের নেতৃত্বে আসেন কংগ্রেস কর্মী মাধব দত্ত। কৃষকদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ইংরেজরা মনে করল সমিতি কৃষকদের সংগঠিত করছে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। কিন্তু ওই আন্দোলন মূলত অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ ছিল। তবু ম্যাকসাহেব দেবদাসবাবুকে তুলে নিয়ে গেলেন এক রাত্রে। ওঁর ওপর অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়ে কৃষক সমিতিকে চরম শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন।

দেবদাসবাবু তো জীবিত নেই।

না। অনেকদিন হল চলে গেছেন। স্বাধীনতার পরেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।

আচ্ছা, আপনি তারিণী সেন নামে কাউকে জানেন?

সুধীর মৈত্র সোজাসুজি তাকালেন, কোন তারিণী সেন?

স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিক।

এই জেলায় ওই নামে কেউ ছিলেন বলে শুনিনি। অন্তত স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন নামের মানুষ কোনও উল্লেখযোগ্য কিছু করেননি। মাথা নাড়লেন সুধীরবাবু।

অর্জুন অস্বস্তিতে পড়ল। সে ভেবেছিল সুধীরবাবুব কাছে তারিণী সেনের খবর পাবে। সেই মানুষটি যদি বেঁচে না থাকেন তা হলে ডরোথির কাজ শেষ হয়ে যাবে, আর থাকলে কালই যাওয়া যেত।

সুধীরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তারিণী সেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামী, তা তোমাকে কে বলল?

কেউ বলেনি, আমি অনুমান করেছিলাম।

হঠাৎ এরকম অনুমান করার অর্থ?

অর্জুন বলল, ডরোথি, মানে ম্যাকডোনাল্ড সাহেবের নাতনি, ওর দাদুর ডায়েরিতে যে তিনজনের নাম পড়ে এখানে এসেছে, তাদের শেষজন হলেন এই তারিণী সেন। তাই আমি ভেবেছিলাম কমলাকান্ত রায় অথবা দেবদাস মিত্রের মতো তারিণী সেনও স্বাধীনতা সংগ্রামী।

সুধীরবাবু বললেন, যদি কোনও সাধারণ কর্মী থেকে থাকেন, তা হলে থাকতে পারেন। মুশকিল হল, এত বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবু কংগ্রেসের তরফ থেকে আন্দোলনের সম্পূর্ণ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি, কেউ ভাবছে বলে জানি না। আন্দোলনকারীদের জেলাভিত্তিক একটা তালিকাও তৈরি হয়নি। কিন্তু উত্তরবঙ্গে তারিণী সেন নামে একজন ছিল, যার সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও সম্পর্ক ছিল না।

কোন সময়ে? অর্জুন কৌতূহলী হল।

সুধীরবাবু উঠলেন। বইয়ের ভূপে হাত বোলাতে লাগলেন নিচু হয়ে। সখেদে বললেন, ঠিক প্রয়োজনের সময় বইগুলো আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আর… একটু পরে হতাশ হয়ে উঠে এলেন সামনে, খুঁজব। কোনও একটা বইয়ে ওর নাম পেয়েছিলাম। কোন সময় মনে নেই, তবে লোকটা একজন কুখ্যাত অপরাধী।

সে কী?

অবাক হচ্ছ কেন?

কুখ্যাত অপরাধীর নাম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে থাকবে কেন?

আরে সেই লোক এই লোক কি না তা আগে দ্যাখো। তুমি বিমল হোড় মশাইয়ের কাছে যাও। উনি প্রবীণ আইনজ্ঞ। ওঁর স্মরণে থাকতে পারে। এইসব অপরাধী কখনও না কখনও শান্তি পায়। সরকারি রেকর্ডেও নাম থাকা উচিত। সুধীরবাবু বইয়ের ভূপের দিকে তাকালেন, কাল বিকেল নাগাদ এসো। আমিও খোঁজ নিচ্ছি।

ঠিক আটটা পনেরোতে খাবার নিয়ে তিস্তা ভবনে পৌঁছে গেল অর্জুন। ডরোথি উপন্যাস পড়ছিল। অ্যালেস্টার ম্যাকলিনের থ্রিলার। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, একা সময় কাটছে না?

ডরোথি মাথা নাড়ল, মোটেই না, এই বইটায় জমে আছি।

তুমি বেড টি খাও?

না। একেবারে ব্রেকফাস্ট। তবে সেটা আমি এখানেই ম্যানেজ করে নিয়েছি। চৌকিদার বলেছে সে আমাকে টোস্ট আর ওমলেট বানিয়ে দেবে।

বাঃ, খুব ভাল। টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপর রেখে দুপুরেরটা নিয়ে নিল সঙ্গে। ডরোথি বলল, কাল আমরা তারিণী সেনের খোঁজ করব তো?

অর্জুন মাথা নাড়ল, আমি ইতিমধ্যেই সেটা শুরু করেছি। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। ওই নামে কোনও বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না।

সে কী! ওই নামে কোনও মানুষ ছিল না?

ছিল। কিন্তু লোকটা একজন কুখ্যাত অপরাধী।

চমকে তাকাল ডরোথি। তারপর মাথা নাড়ল, আমি বিশ্বাস করি না।

হয়তো ওই লোকটার কথা তোমার দাদু লেখেননি। আসলে ওর সম্পর্কে তিনি ঠিক কী কী লিখেছেন জানলে খোঁজ পেতে সুবিধে হত।

ডরোথি একটা নোটবই বের করল। বোঝা যাচ্ছে যে তার দাদুর ডায়েরি থেকে ওখানে নোট করেছে তথ্যগুলো। সে পড়ল, তারিণী সেন। যে লোকটা আমাকে প্রচন্ড সাহায্য করেছিল তাকে আমি শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারিনি। স্বাধীনতা এমন একটা স্বপ্নের নেশা যে-কোনও মানুষ তার লোভে পালটে যেতে পারে। আমি ওর ওপর যে অত্যাচার করেছি তার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তা না করে আমার উপায় ছিল না। এখন অনুশোচনা হচ্ছে। লোকটা হয়তো চিরকালই বিশ্বস্ত থাকত। ডরোথি তাকাল, ব্যস, এইটুকু।।

অর্জুন চোখ বন্ধ করে শুনছিল। এবার গম্ভীর মুখে বলল, লোকটা আর যেই হোক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল না। ওই সময়ে কোনও ভারতীয় ইংরেজ শাসককে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে তাকে নিশ্চয়ই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলা হত না।

হয়তো। তবে এই লোকটা তো সরকারের প্রতি অনুগত হতে পারেন, দাদু তাকে ভুল বুঝেছেন বলে পরে অনুশোচনা করেছেন।

অনুগত ছিলেন তাতে ভুল নেই। এ দেশে তো বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই।

আমি এব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।

তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। সুধীরবাবু বলেছেন ওই নামে একজন কুখ্যাত অপরাধী ছিল। আমরা কালকে জানতে পারব লোকটা তোমার দাদুর সময়ে ছিল কি না আর কোন অঞ্চলের মানুষ!

সুধীর মৈত্র কে?

একজন পন্ডিত মানুষ। জলপাইগুড়ির ইতিহাস ওঁর জানা। পাহাড়ি পাড়ায় থাকেন। উনি আগামিকাল আমাকে যেতে বলেছেন।

ডরোথি কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। অর্জুনের মনে হল, এটা স্বাভাবিক। একজন কুখ্যাত অপরাধীর সঙ্গে তার দাদুর সম্পর্ক ছিল, এটা ভাবতে নিশ্চয়ই ভাল লাগছে না তার। কিছুক্ষণ কথা বলে আগামীকাল আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে নীচে নেমে এল। চৌকিদারকে ডরোথির নিরাপত্তার কথা আর-একবার মনে করিয়ে দিয়ে সে বাইকে চড়ে বসল। এদেশের বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্য পেয়েছিল বলেই ইংরেজরা দুশো বছর ধরে রাজত্ব চালিয়ে যেতে পেরেছে। বোঝা যাচ্ছে ওই রকম একজন বিশ্বাসঘাতকের নাম তারিণী সেন। ওই লোকটা কুখ্যাত অপরাধী নাও হতে পারে। একজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কারও অনুশোচনা হতে পারে না। অন্যমনস্ক হয়ে বাইক চালাচ্ছিল অর্জুন। হঠাৎ একটা গাড়ির জোরালো আলো মুখে পড়ায় সে হকচকিয়ে রাস্তার একপাশে সরে এল। গাড়িটা পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর তার মনে হল অকারণে জোরে চালাচ্ছে ড্রাইভার।

এখন শহরের রাস্তায় রাত নটাতেও মানুষজন রিকশায় দেখা যায়। বছর পাঁচেক আগেও সাতটার পর রিকশা উধাও হয়ে যেত। নটার সময় রাস্তার অবস্থা শ্মশানের মতো। অর্জুনের মনে পড়ল বিমল হোড় মশাইয়ের কথা। সুধীরবাবু ওঁর কথা বলেছিলেন। বিমল হোড় এই শহরের প্রবীণ আইনজ্ঞ। নিশ্চয়ই বয়স হয়েছে। অর্জুন তাঁকে কয়েকবার দূর থেকে দেখেছে। ভদ্রলোক হয়তো এতক্ষণে শুয়ে পড়েছেন। এই সময় গেলে বিরক্ত করা হবে। তবু অর্জুন সমাজপাড়ার দিকে বাইক নিয়ে চলল। বিভীষণ অথবা মিরজাফরদের কাহিনী জানতে মানুষের চিরকাল কৌতূহল হয়। অর্জুনেরও হচ্ছিল।

বিমল হোড় মশাইয়ের বাড়িতে আলো জ্বলছিল। নীচের তলার ঘরটির সামনে দুজন লোক কথা বলছে। একটু ইতস্তত করে অর্জুন বাইক থামিয়ে গেট খুলল। লোক দুটো ফিরে তাকাতে সে এগিয়ে গেল, কিছু মনে করবেন। না, বিমলবাবু কি এখন দেখা করতে পারেন?

একজন জিজ্ঞেস করল, কী দরকার? বলেই তার খেয়াল হল, আরে! আপনি অর্জুন না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন। বাবা অবশ্য অনেক আগে ওপরে চলে যান। আজ ল কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হল বলে এখনও নীচে আছেন। আসুন।

ভদ্রলোক তাকে নিয়ে গেলেন যে ঘরে, সেটা আইনজ্ঞের ঘর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অর্জুন দেখল বিমলবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বেশ। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। ভদ্রলোক বললেন,বাবা, ইনি অর্জুন।

কোন অর্জুন?

ডিটেকটিভ।

শব্দটা নিয়ে অর্জুন আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বিমলবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে, এসো, এসো। বোসো। তোমার নাম শুনেছি এতকাল, চোখে দেখলাম এই প্রথম। তুমি বললাম বলে রাগ কোরো না।

না, না। অবশ্যই বলবেন।

বয়সের অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছি। বিমলবাবু বললেন, বোসো। বলল, কী দরকার। আমার কাছে কোর্ট-কাছাবির ব্যাপার না থাকলে তো কেউ সহজে আসে না!

পাহাড়ি পাড়ার সুধীর মৈত্র আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন।

সুধীর? সে তো পন্ডিত মানুষ। ব্যাপারটা কী?

আপনি তারিণী সেন নামে কাউকে চেনেন?

জলপাইগুড়িতে সেনবংশ ব্যাপক। কোন তারিণী সেনের কথা বলছ?

রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড নামে এক সাহেবের ডায়েরিতে নামটা পাওয়া গেছে।

কী সাহেব?

রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড।

নামটা শোনা-শোনা। ওহহা ম্যাকসাহেব! ভয়ঙ্কর লোক। আজকাল বয়সের দোষে সব সময় স্মরণশক্তি কাজ করতে চায় না। তা, ওঁর ডায়েরিতে নামটা পাওয়া গিয়েছে?

হ্যাঁ।

তারিণী সেন। চোখ বন্ধ করলেন বিমলবাবু। সম্ভবত স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য অর্জুন বলল, মনে হচ্ছে লোকটা বিশ্বাসঘাতক ছিল।

চোখ খুললেন বিমলবাবু, ইয়েস, মনে পড়েছে। লোকটা ছিল কুখ্যাত ডাকাত। ওই ময়নাগুড়ি অঞ্চলে ওর ভয়ে মানুষ শিউরে থাকত। লোকটাকে অ্যারেস্ট করা হয়, সেটা নাইনটিন থার্টি এইট, হ্যাঁ, ওই বছরই। তার পরের বছর খগেনদা, ধীরাজদা, শোদারা জলপাইগুড়িতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন করেন। সভাপতি ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু আর প্রধান অতিথি সুভাষচন্দ্র। ইংরেজ, ভারত ছাড়ো ধ্বনিটি ওখানেই ঘোষিত হয়। এর ঠিক আগের বছর তারিণীকে গ্রেফতার করে আনে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে চার্জ ছিল, খুন-ডাকাতি রাহাজানির। অন্তত গোটা দশেক খুন করেছিল লোকটা।

বিচারে কী শাস্তি হয়েছিল?

বিচার হয়নি।

তার মানে?

পুলিশ সাক্ষী দেওয়ার জন্যে একটা মানুষকেও জোগাড় করতে পারেনি। ওর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায়নি। বংশী বর্মণ নামে দোমহনির একজন শিক্ষক পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তিনি সাক্ষী দিতে চান। কিন্তু তার পরদিনই বংশীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর তারপর থেকে সমস্ত সাক্ষী উধাও। প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় তারিণী। শুনেছি, এ ব্যাপারে নাকি ম্যাকসাহেবের একটা বড় ভূমিকা ছিল।

তারিণী সেন তারপরেও ডাকাতি করত?

না। কিন্তু আমাদের সন্দেহ হত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খবর সে ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দিত। ময়নাগুড়ি থেকে দোমহনি পর্যন্ত যে এলাকা, সেটা যেন ওর সম্পত্তি ছিল। টাট্ট ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াত সে। কিন্তু মানুষ তার অন্যায়ের শাস্তি পাবেই। তারিণীও পেয়েছিল। তাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে আনা হয়েছিল প্রচন্ড আহত অবস্থায়। দুটো হাত কেউ কেটে নিয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড প্রাণশক্তি থাকায় রক্তপাত হলেও বেঁচে গিয়েছিল সে। কিন্তু পুলিশের কাছে শুনেছি কোনও জবানবন্দী দেয়নি।

কেন?

জানি না। তারপর লোকটার কোনও খবর জানি না।

তারিণী সেন নিশ্চয়ই বেঁচে নেই?

বেঁচে থাকলে আশির ওপর বয়স হবে।

আপনি বললেন ওর দুটো হাত কেটে ফেলা হয়েছিল!

হ্যাঁ। সুস্থ হলেও ওই অবস্থায় কতদিন বেঁচে থাকা যায়, জানি না। কিন্তু তুমি ওর সম্পর্কে এত ইন্টারেস্টেড কেন?

আমি নই। একজন বিদেশিনী লোকটার সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু মনে হচ্ছে ওর এতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা একটু অস্বাভাবিক।

বিমল হোড় বললেন, তুমি একটা কাজ করতে পারো। ময়নাগুড়িতে আমার এক পুরনো মক্কেল থাকেন। অবস্থাপন্ন পরিবার। ভদ্রলোকের নাম হরিদাস বর্মন। ময়নাগুড়ির মোড় থেকে নাটাগুড়ির দিকে যাওয়ার পথেই ওঁর বাড়ি। সবাই চেনে। ওঁর কাছে যেতে পারো। আমার নাম করলে হরিদাসবাবু তোমাকে সাহায্য করবেন। উনিই বলতে পারবেন, তারিণী সেন বেঁচে আছে কি না!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress