১.
একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু।
নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়ালে।
এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু। নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়ালে।
তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালে।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। আপনি কে?দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে নাসিরুদ্দিন।
আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
ভেতরে আসুন, বললে নাসিরুদ্দিন, খাবার তৈরিই আছে।
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্লাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?
হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর, বললে নাসিরুদ্দিন।
.২.
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখে সারি সারি খাঁচায় ময়না বিক্রি হচ্ছে, সেগুলির দাম একেকটা পঞ্চাশ টাকা।
পরদিন সে তার ধাড়ি মুরগিটাকে নিয়ে বাজারে হাজির, ভাবছে সেটাকে বিক্রি করে মোটা টাকা পাবে।
যখন দেখল যে পাঁচ টাকার বেশি দাম দিতে চায় না কেউ, তখন সে তম্বি শুরু করলে। তাই দেখে একজন লোক এসে তাকে বললে, মোল্লাসাহেব, কালকের পাখিগুলো যে কথা বলতে পারে, তাই এত দাম। তোমার মুরগি কথা বলে কি?
নাসিরুদ্দিন চোখ রাঙিয়ে বললে, পুঁচকে পাখি বকবক করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলে তার হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকা দাম, আর আমার এতবড় মুরগি নিজের ভাবনা নিয়ে চুপচাপ থাকে বলে তার কদর নেই? যতসব ইয়ে।
.৩.
নাসিরুদ্দিন বাজার থেকে খাবার আনে, আর তার গিন্নি সেগুলো লুকিয়ে এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়।
ব্যাপার কী বলো তো? একদিন মোল্লা বললে–খাবারগুলো যায় কোথায়?
বেড়ালে চুরি করে, বললেন গিন্নি।
কথাটা শুনেই নাসিরুদ্দিন তার সাধের কুড়ুলটা এনে আলমারির ভিতর লুকিয়ে ফেললে।
ওটা কী হল? জিজ্ঞেস করলেন গিন্নি।
বেড়াল যদি দশ পয়সার খাবার চুরি করতে পারে বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দশ টাকার কুড়ুলটা বাইরে ফেলে রাখি কোন ভরসায়?
.৪.
এক সন্ধ্যায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নাসিরুদ্দিন কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গুনলে। নির্ঘাত এরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শাহেন শা-র ফৌজে ভর্তি করে দেবে।
রাস্তার পাশেই গোরস্থান; নাসিরুদ্দিন এক দৌড়ে তাতে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইল।
ঘোড়সওয়াররা কৌতূহলী হয়ে গোরস্থানে ঢুকে দেখে নাসিরুদ্দিন একটা কবরের ধারে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। এখানে কী হচ্ছে মোল্লাসাহেব? তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে।
নাসিরুদ্দিন বুঝলে তার আঁচে গলতি হয়েছে। সে বললে, সব প্রশ্নের তো আর সহজ উত্তর হয় না। যদি বলি যে তোমাদের জন্যই আমার এখানে আসা, আর আমার জন্যই তোমাদের এখানে আসা, তা হলে কিছু বুঝবে?
.৫.
নাসিরুদ্দিন তার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, বন্ধু, চলো পাড়া বেড়িয়ে আসি।
লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না, বললে জামাল সাহেব। নাসিরুদ্দিন তাকে একটি বাহারের পোশাক ধার দিলে।
প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন গৃহকর্তাকে বললে, ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব। এঁর পোশাটা আসলে আমার।
দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার কেমনতরো আক্কেল হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?
পরের বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, জামাল সাহেব আমার পুরনো বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।
জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল তোমায়?
কেন? বললে নাসিরুদ্দিন, তুমি যেমন চাইলে তেমনই তো বললাম।
না, বললেন জামালসাহেব, পোশাকের কথাটা না বললেই ভাল।
তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, আমার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভাল।
৬.
নাসিরুদ্দিন নাকি বলে বেড়াচ্ছে যারা নিজেদের বিজ্ঞ বলে তারা আসলে কিচ্ছু জানে না। এই খবর শুনে সাতজন সেরা বিজ্ঞ নাসিরুদ্দিনকে রাজার কাছে ধরে এনে বললে, শাহেন শা, এই ব্যক্তি অতি দুর্জন। ইনি আমাদের বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। এর শাস্তির ব্যবস্থা হোক।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কিছু বলার আছে?
আগে কাগজ কলম আনা হোক, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কাগজ কলম এল।
এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।
তাও হল।
এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল-রুটির অর্থ কী?
সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে গেলেন।
পয়লা নম্বর লিখেছেন রুটি একপ্রকার খাদ্য।
দুই নম্বর–ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।
তিন নম্বর–রুটি ঈশ্বরের দান।
চার নম্বর–একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।
পাঁচ নম্বর–রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।
ছয় নম্বর–রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে।
সাত নম্বর–রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর শুনে নাসিরুদ্দিন বললে, জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনও চোখেই দেখেননি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিলেন।
.৭.
নাসিরুদ্দিনের দজ্জাল গিন্নি ফুটন্ত সুরুয়া এনে কর্তার সামনে রাখল তার জিভ পুড়িয়ে তাকে জব্দ করবে বলে, কিন্তু ভুলে সে নিজেই দিয়ে ফেলেছে তাতে চুমুক। ফলে তার চোখে জল এসে গেছে।
নাসিরুদ্দিন তাই দেখে বলে, হল কী? কাঁদছ নাকি?
গিন্নি বললেন, মা মারা যাবার ঠিক আগে সুরুয়া খেয়েছিলেন, আহা! সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
এবার নাসিরুদ্দিনও সুরুয়ায় চুমুক দিয়েছে, আর তার ফলে তারও চোখ ফেটে জল।
সে কী, তুমিও কাঁদছ নাকি? শুধোলেন গিন্নি।
নাসিরুদ্দিন বললে, তোমায় জ্যান্ত রেখে তোমার মা মারা গেলেন, এটা কি খুব সুখের কথা?
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (২)
১.
রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির।
একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?
বেগুনের জবাব নেই, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা হুকুম দিলেন, এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।
তারপর পাঁচদিন দুবেলা বেগুন খেয়ে ছদিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।
বেগুন অখাদ্য, সায় দিয়ে বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!
আমি তো আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, বেগুনের তো নই।
.২.
নাসিরুদ্দিন সরাইখানায় ঢুকে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলে, সুর্যের চেয়ে চাঁদের উপকারিতা অনেক বেশি।
কেন মোল্লাসাহেব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে সবাই।
চাঁদ আলো দেয় রাত্তিরে, বললে নাসিরুদ্দিন, দিনে আলোর দরকারটা কী শুনি?
.৩.
নাসিরুদ্দিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকেছে দুধ খাবে বলে। পয়সার অভাব, তাই এক গেলাস দুধ দুজন আধাআধি করে খাবে।
বন্ধু বললে, তুমি আগে খেয়ে নাও তোমার অর্ধেক। বাকিটা আমি পরে চিনি দিয়ে খাব।
চিনিটা আগেই দাও না ভাই, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দুজনেরই দুধ মিষ্টি হবে।
বন্ধু মাথা নাড়লে। আধ গেলাসের মতো চিনি আছে আমার সঙ্গে, আর নেই।
নাসিরুদ্দিন সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করে খানিকটা নুন নিয়ে এল। ঠিক আছে, সে বললে বন্ধুকে, এই নুন ঢাললাম দুধে। আমি অর্ধেক নোনতা খাব, বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেও তুমি।
.৪.
মোল্লা এক ছোঁকরাকে মাটির কলসি দিয়ে পাঠালে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতে। দেখিস, কলসিটা ভাঙিসনি যেন, বলে একটা থাপ্পড় মারলে ছোঁকরার গালে।
এক পথচারী ব্যাপারটা দেখে বললে, কলসি না ভাঙতেই চড়টা মারলেন কেন মোল্লাসাহেব?
তোমার যা বুদ্ধি,বললে নাসিরুদ্দিন, ভাঙার পরে চড় মারলে কি আর কলসি জোড়া লেগে যাবে?
.৫.
নাসিরুদ্দিন একটা মনিহারী দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এখানে পেরেক পাওয়া যায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললে দোকানদার।
আর চামড়া?
আজ্ঞে হ্যাঁ, যায়।
আর সুতো?
যায়, আজ্ঞে।
আর রঙ?
তাও যায়।
তা হলে তুমি বসে না থেকে একটা জুতো তৈরি করে ফেলো না বাপু!
.৬.
নাসিরুদ্দিন এক পড়শির কাছে গিয়ে হাত পাতলে। এক গরিব তার দেনা শোধ করতে পারছে না। তার সাহায্যে যদি কিছু দেন।
পড়শির মনটা দরাজ, সে খুশি হয়ে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললে, আহা বেচারি! এই ঋণগ্রস্ত অভাগাটি কে, মোল্লাসাহেব?
আমি, বলে নাসিরুদ্দিন হাওয়া।
কিছুদিন পরে নাসিরুদ্দিন আবার সেই পড়শির কাছে এসে হাত পেতেছে। পড়শি একবার ঠকে সেয়ানা হয়ে গেছে। বললে, বুঝেছি। দেনাদারটি এবারও তুমিই তো?
আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। এবার সত্যিই আমি না।
পড়শির আবার মন ভিজল। নাসিরুদ্দিনের হাতে টাকা দিয়ে বললে, এবার কার দুঃখ দূর করতে যাচ্ছ মোল্লাসাহেব?
আজ্ঞে, আমার।
কীরকম?
আজ্ঞে এই অধম এবার পাওনাদার।
.৭.
সুসংবাদ দিলে বকশিশ পায় জেনে একজন লোক নাসিরুদ্দিনকে গিয়ে বললে, তোমার জন্য খুব ভাল খবর আছে, মোল্লাসাহেব।
কী খবর?
তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
তাতে আমার কী?
তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।
তাতে তোমার কী?
.৮.
নাসিরুদ্দিন নদীর ধারে বসে আছে, এমন সময় দেখে নজন অন্ধ নদী পেরোবার তোড়জোড় করছে।
নাসিরুদ্দিন তাদের কাছে প্রস্তাব করলে যে, জনপিছু এক পয়সা করে নিয়ে সে নজনকে পর পর কাঁধে করে পার করে দেবে। অন্ধরা রাজি হয়ে গেল।
নাসিরুদ্দিন আটজনকে পার করে ননম্বরের বেলায় মাঝনদীতে হোঁচট খেতে পিঠের অন্ধ জলে। তলিয়ে গেল।
বাকি আটজন দেরি দেখে ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হল মোল্লাসাহেব?
এক পয়সা বাঁচল তোমাদের, বললে নাসিরুদ্দিন।
.৯.
নাসিরুদ্দিন আর তার গিন্নি একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নি তো রেগে আগুন। বললে, এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি, তাই এই দশা।
পড়শিরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, জানলাগুলোও তো ভাল করে বন্ধ করোনি দেখছি।
আরেকজন বললে, চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।
আরেকজন বললে, দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
কী আপদ! বললে নাসিরুদ্দিন, তোমরা দেখছি শুধু আমার পিছনেই লাগতে শুরু করলে!
দোষ তো তোমারই মোল্লাসাহেব, পড়শিরা বললে।
বটে? বললে নাসিরুদ্দিন, আর চোরের বুঝি দোষ নেই?
.১০.
নাসিরুদ্দিনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাশ দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, আল্লা করেন তো এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।
নাসিরুদ্দিন এক সপ্তাহ কোনওরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।
একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আল্লা করেন তো কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।
পরদিন গিয়েও হতাশ। মাফ করবেন মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন তো কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।
নাসিরুদ্দিন এবার বললে, আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?
.১১.
এক প্রবীণ দার্শনিক সরাইখানায় বসে বিলাপ করছেন, বিচিত্র জীব এই মানুষ। কোনও কিছুতেই তৃপ্তি নেই। শীতকালে বলে ঠাণ্ডায় মলাম, গ্রীষ্মে বলে গরমে প্রাণ আইঢাই।
সবাই তার কথায় সায় দিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
বসন্তের বিরুদ্ধে যার নালিশ আছে সে হাত তোলো, বললে নাসিরুদ্দিন।
.১২.
নাসিরুদ্দিনের গানবাজনা শেখার শখ হয়েছে। এক জবরদস্ত ওস্তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাদ্যযন্ত্র শেখাতে কত নেন?
প্রথম মাসে তিন রৌপ্যমুদ্রা, তারপর থেকে প্রতি মাসে এক রৌপ্যমুদ্রা।
বেশ, তা হলে দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করব আমি, বললে নাসিরুদ্দিন।
.১৩.
এক চোর নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে ঢুকে তার প্রায় সর্বস্ব চুরি করে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।
নাসিরুদ্দিন রাস্তা থেকে সব দেখে একটি কম্বল কাঁধে নিয়ে চোরের পিছু ধাওয়া করে তার বাড়িতে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
কে হে তুমি? চোর জিজ্ঞেস করলে, আমার বাড়িতে কেন?
আমার জিনিস যখন সবই এখানে, বললে নাসিরুদ্দিন, এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি নয় কি?
.১৪.
সরাইখানায় কজন সৈনিকের আগমন হয়েছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের বড়াই করছে। একজন বললে, খোলা তলোয়ার হাতে এমন তেজের সঙ্গে ছুটলাম আমি দুশমনের দিকে যে-তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমায় রেখে কার সাধ্য!
সবাই একথা শুনে সমস্বরে বাহবা দিলে। নাসিরুদ্দিনও এককালে যুদ্ধ করেছে। সে বললে, তোমার কথা শুনে আমার নিজের একটা যুদ্ধের ঘটনা মনে পড়ছে। এক শত্রুর পা কেটে ফেলেছিলাম তলোয়ারের এক কোপে।
তাই শুনে এক প্রবীণ যোদ্ধা বললে, ওইখানেই তো ভুল। কাটা উচিত ছিল মুণ্ডুটা।
মুণ্ডুটা না থাকলে আর মুণ্ডু কাটব কোত্থেকে? বললে নাসিরুদ্দিন।
.১৫.
এক পড়শি মোল্লাসাহেবের কাছে একগাছ দড়ি ধার চাইতে এসেছে।
পাবে না বলে নাসিরুদ্দিন।
কেন মোল্লাসাহেব?
দড়ি কাজে লাগছে।
ওটা তো মাটিতে পড়ে আছে আজ কদিন থেকে মোল্লাসাহেব।
ওটাই কাজ।
পড়শি তবু আশা ছাড়ে না। বললে, কদিন চলবে কাজ মোল্লাসাহেব?
যদ্দিন না ওটা ধার দেওয়া দরকার বলে মনে করি বললে নাসিরুদ্দিন।
.১৬.
নাসিরুদ্দিন হামামে গেছে গোসল করতে। পরিচারক তার ছেঁড়া পোশাক দেখে আধখানা সাবান আর একটা ময়লা তোয়ালে ছুঁড়ে দিলে তার দিকে।
নাসিরুদ্দিন কিন্তু যাবার সময় তাকে ভালরকম বকশিশ দিয়ে গেল। পরিচারক ভাবলে, এ কেমন হল? খাতির না করেই যদি এত পাওয়া যায় তা হলে খাতির করলে না জানি কত মিলবে!
পরের সপ্তাহে নাসিরুদ্দিন আবার গেছে হামামে। এবার তাকে দেখেই পরিচারক একেবারে বাদশার হালে তার তোষামোদ করেছে। আচ্ছা রকম দলাই-মালাই করে, গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে, কাজের শেষে হাত পাততেই নাসিরুদ্দিন তাকে একটি তামার পয়সা দিয়ে বললে, গতবারের জন্য এই বকশিশ। এবারেরটা তো আগেই দেওয়া আছে।
১৭.
নাসিরুদ্দিন এক আমীরের বাড়ি গেছে দুর্ভিক্ষের চাঁদা তুলতে। দরোয়ানকে বললে, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল মোল্লাসাহেব চাঁদা নিতে এসেছেন।
দরোয়ান ভিতরে গিয়ে মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বললে, আজ্ঞে, মনিব একটু বাইরে গেছেন।
তা হলে তোমায় একটা কথা বলে যাই,বললে নাসিরুদ্দিন, তোমার মনিব এলে তাঁকে বোলো যে, বেরোবার সময় তাঁর মুণ্ডুটা যেন জানলার ধারে রেখে না যান। কখন চোর আসে বলা কি যায়!