মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 06
‘রঞ্জুমাসি আপনি তো লেখেন টেখেন, কত শব্দ ব্যবহার করেন, বলুন তো?’
‘কত শব্দ? কেন, বাংলায় যত শব্দ আছে ধরুন সবই ব্যবহার করি।’
একটা বিজয়ীর হাসি ফুটে ওঠে গঙ্গাপ্রসাদের গোলগাল বড়সড় মুখে। বলেন ‘বাংলায় তেমন কোনও পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু ইংরাজিতে ইয়েস পার্সেন সাহেব বলছেন— সেক্সপিয়রই সবচেয়ে বেশি শব্দ ব্যবহার করেছেন। পঁচিশ হাজার। তার পরে মিল্টন আট হাজার।’
আমি গর্বের সঙ্গে বলি ‘সংখ্যা বলতে পারব না। কিন্তু চলিত সব শব্দই তো ব্যবহার করি। ধরুন প্রাতিস্বিক, প্রতিভাস, পরিগ্রাহী।’
‘—আচ্ছা বেশ। আপনি “নাড়া” শব্দটা ব্যবহার করেছেন?’
‘নাড়া? হ্যাঁ! লেজ নাড়া কথাটা তো আমি প্রায়ই ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে ন্যাজ নাড়াও বলি। কনভার্সেশনে অবশ্য, বাড়িতে, লেখাতে ব্যবহার? নিশ্চয়ই করেছি— ভূতের খাট নাড়ানো, গাধার কান নাড়ানো। জানেন আমার হাজব্যান্ড না কান নাড়াতে পারেন।’
গঙ্গাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বলেন, ব্যাক্তিগত না, ব্যক্তিগত আনবেন না। আর “নাড়া” আমি বিশেষ্য হিসেবে বলছি। জীবনানন্দ মনে করুন,…’
‘ওহ্, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বলি আঞ্চলিক শব্দ, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বরিশালি, ঢাকাই, ফরিদপুরি, সিলেটি— এ সব ভ্যারাইটি আমার আয়ত্তে নেই। তা যদি বলেন জীবনানন্দের অভীক্ষ্নও আমি ব্যবহার করিনি। করবও না। ও রকম দুরুচ্চার্য শব্দ ব্যবহার করলে আমার লেখা যে কজন পড়ে, সে কজনও আর পড়বে না। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা টার্গেট অডিয়েন্স তো আছে।’ বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে আমি বলে ফেলি।
‘আচ্ছা, আচ্ছা আপনার টার্গেট অডিয়েন্স যাই হোক, যারাই হোক, সে প্রসঙ্গে এখন আমি যাচ্ছি না। আপনি কাইন্ডলি আলোচনাটাকে দিগ্ভ্রান্ত করবেন না। আমি যেটা বলতে চাই— আমরা অনেক শব্দ জানি, কিন্তু ব্যবহার করি না। যেমন “পরাজিত”টা বেশি লিখি “পরাভূত”টা অত লিখি না। ধরুন ঠ্যাং, ঠ্যাং কি লেখেন?’
‘কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং— লিখে থাকতে পারি’—আমি কবুল করি ‘কিন্তু অন্যত্র ঠ্যাং ব্যবহার করতে গেলেই লোকে বলবে জীবনানন্দ থেকে চুরি করেছি।’
‘আঃহা, আপনি চুরি চামারির দিকে যাচ্ছেন কেন রঞ্জুমাসি।’
‘দেখুন,’ আমি রাগতভাবে বলি—‘আপনি সমানে আমাকে রঞ্জুমাসি রঞ্জুমাসি করলে আমি এখান থেকে চলে যাব।’
‘কী আশ্চর্য! আমি কি সত্যি আপনাকে আমার মাসি বলেছি। আপনি আমার মাসি সম্পর্ক হন না আমি বেশ জানি। তিনুর মাসি তো সেই হিসেবে…’
‘আপনি কি কাজলকে “তিনুর মা” বলে ডাকাডাকি করেন? আসল কথা আপনি ভীষণ পুরনো কালের, মধ্যযুগীয় মনোভাবের, সেফ-সাইডে থাকার জন্যে রঞ্জুমাসি রঞ্জুমাসি করছেন।’
‘কীসের সেফ সাইড?’ গঙ্গাপ্রসাদ অবাক হয়ে বলেন।
‘মানে আপনি সমাজকে ভয় পান, একটি মহিলাকে রঞ্জু বা রঞ্জনা বলে ডাকলে যদি কেউ কিছু মনে করে! কেউ আর কে? তীর্ণা খুব মড। কাজলকেই আপনি ভয় পান।’
‘কাজলকে আমি একেবারেই ভয় পাই না। কাজলকে আমি পরোয়া করি না। কাজল কী ভাবলো না ভাবল আমার বয়েই গেল। কেন না সেও আমাকে পরোয়া করে না, আমি কী ভাবলুম না ভাবলুম তাতে তারও বয়েই যায়! জানেন এক দিন লোডশেডিং-এর রাতে বাড়ি ফিরে হুলো বেড়ালের আঁচড় খেয়েছিলুম তাতেও সে আসেনি, দিদিমাসির বাড়ি ছিল সারা রাত। জানেন আমাকে ইস্ত্রিতে দুধ গরম করে, ডিমের পোচ করে কাঁচা পাঁউরুটি দিয়ে খেতে হয়েছিল!’
ঘা খেয়ে গঙ্গাপ্রসাদের যাবতীয় অন্তর্নিহিত শিকায়েত বেরিয়ে আসতে থাকে।
লাল মাটির পথ দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কথা হচ্ছিল। গ্রীষ্মের ফুলের একটা মৃদু সুবাস সন্ধের হাওয়ায়। ফাদার জেনকিন্স বাড়িতে ক্যাসেট চালিয়ে চালিয়ে নিজের উচ্চারণ ঠিক করছেন। তীর্ণা গেছে কোনও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আমিই গঙ্গাপ্রসাদবাবুকে টেনে বার করেছি। গঙ্গাপ্রসাদ সহজেই রাজি হয়ে গেছেন। কেন না সন্ধেবেলাটুকুও যদি তিনি বাবা জেনকিন্সের হাত থেকে রেহাই না পান, তাঁর অবস্থা খুবই সঙ্গীন হবে।
‘আচ্ছা ধরুন কাজলের বদলে আর কেউ আপনার বেড়ালের আঁচড়ে মলম লাগিয়ে দিল। আর কেউ আপনাকে ভাল দেখে একটা সায়মাশ বেঁধে দিল।’
‘কী বললেন? সায়মাশ? ডিনার? এটা ডিকশনারিতে কাজে লাগাতে হবে। আচ্ছা রঞ্জনাদেবী আপনি তো অনেক শব্দই ব্যবহার করে থাকেন দেখছি। তখন বললেন দুরুচ্চাৰ্য, এখন বলছেন সায়মাশ, নাঃ আপনার হবে, হবে।’
‘আমি কিন্তু আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম গঙ্গাপ্রসাদ দেব।’
‘দেব তো আমি নই, আমি মিত্তির।’
‘আমি রঞ্জনা গড়াই যদি দেবী হতে পারি, আপনি গঙ্গাপ্রসাদ মিত্তির তবে অবশ্যই দেব। না কি আপনার দেবত্বে সন্দেহ প্রকাশ করছেন?’
এ বার গোল মুখ ভরে খুব হাসলেন গঙ্গাপ্রসাদ।
‘দেখুন, মহিলাদের নাম ধরে ডাকা আমার অভ্যাস নেই, এ কথা সত্যি তাতে মধ্যযুগীয় বলেন তো আমি মধ্যযুগীয়।’
‘শ্যালিকাকে কী বলেন?’
‘শালী যে আমার নেই?’
তবে আমিই আপনার এক জন শালী। স্ত্রীর বন্ধুরা তো শালীই হয়।’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব। কী যেন প্রশ্নটা করছিলেন?’
‘আমি আমার প্রশ্নটা আবারও করি, জিজ্ঞেস করি সে ক্ষেত্রে উনি কী করবেন? অর্থাৎ কেউ যদি ওঁকে আহত বিক্ষত অবস্থায় ফাস্ট এইড দেয়, এবং অসহায় অবস্থায় ভাল করে ডিনার সার্ভ করে তো উনি কী করবেন?
‘এ রকম ঘটার কোনও আশাই নেই মিসেস রঞ্জনা গড়াই। আপনি আমার ছেলে-মেয়েকে চেনেন না। রাত দশটার আগে তারা বাড়ি ফেরে না। পর পর পর পর ডিপ্লোমা নিয়ে যাচ্ছে, কম্পিউটার, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ইনটিরিয়র ডেকোরেশন, গজল, মডার্ন ডান্স, মূকাভিনয়, পার্সন্যালিটি ডেভেলপমেন্ট, ফ্রেঞ্চ, বার্মিজ রেইকি… যেটা লেগে যায়, বুঝলেন না? ওদের বাড়িতে পাওয়া দুষ্কর।’
‘তা হলে ধরুন নেবার্স। প্রতিবেশীরা!’
‘প্রতিবেশী? আপনি হাসালেন মিসেস গড়াই। একমাত্র কলেজের ভর্তির সিজনে এবং টেস্টের ফলাফল বেরুবার সিজনে সেই মহাত্মাদের দেখা পাই। সেই সময়ে তাঁরা ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, ফলফুলুরি ইত্যাদি নিয়ে ঢুঁ মারেন। কিন্তু রাত্তির বেলায়, লোডশেডিং-এ, হুলো বেড়ালের বাড়িতে? নৈব নৈব চ।’
‘কিন্তু প্রতিবেশী তো তাকেই বলে গঙ্গাদা, যে নাকি বিপদে সাহায্য করে। যিশু তো তাই বলে গিয়েছেন!’
আমার গঙ্গাদা শুনে গঙ্গাপ্রসাদ ভুঁড়ি পর্যন্ত চমকে উঠলেন। তার পরে সামলেসুমলে বললেন—‘সে রকম প্রতিবেশী নেই আর এ যুগে। নেই।’
‘আচ্ছা ধরুন আমি। আমি যদি করি। আমি তো বাড়ি-বসা মানুষ। এটুকু উপকার কারও করতে আমার কোনওই অসুবিধে নেই।’
‘আপনি?’—আমার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন গঙ্গাপ্রসাদ। দৃষ্টিতে একটা সন্দেহ একটা না বোঝার ভাব।
আমি বলি— ‘কী আশ্চর্য! এই সামান্য ব্যাপারে আপনি এত ভয় খেয়ে খাচ্ছেন কেন? আপনি অধ্যাপক তারপর ডিকশনারিবাজ, আমি লেখার লাইনের লোক, আমি তো আপনার বাড়িতে নিজের প্রয়োজনেই যেতে পারি। পারি না? কাজল থাকলে সে আড্ডা দেবে কিংবা শাড়ি দেখাতে শুরু করবে। সুতরাং ; কাজল যেদিন বাড়িতে থাকবে না, সে দিনই আমার যাওয়া ভাল। আর সেই সময়ে যদি বেড়াল বা ইঁদুর আপনাকে আঁচড়ে দেয়, কিংবা আপনার যদি খাবারদাবার না থাকে আমি সে সবের ব্যবস্থা করতে পারি।’ শেষ কথাটা অবশ্য আমি খুবই মনমরা হয়ে বললাম।
‘কিন্তু লোডশেডিং হলে?’ গঙ্গাপ্রসাদ খুব সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে আড়ে আড়ে চান।
‘লোডশেডিং হলে টর্চ আছে, মোমবাতি আছে, সব সময়ে আমার ব্যাগে থাকে। তা ছাড়া লোডশেডিং হলে তো আরও ভাল।’
‘কেন? কেন?’ গঙ্গাপ্রসাদ এত ভয় পেয়েছেন যেন এখুনি হুড়মুড় করে পড়ে যাবেন।
আমি দূরের দিকে তাকিয়ে বলি—
‘আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত-রাত্রিটিরে ভাল,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার ;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ ;—অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, —মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা ; অশত্থের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক ;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক ;…’
গঙ্গাপ্রসাদ যেন নাভির অতল থেকে এক পেলব ব্যারিটোন স্বর টেনে তুললেন। বললেন—
‘মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে।
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে ;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙক্ষায় নেমে আসে ;’
অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম আমরা। শালবনের ছায়ার আঁধারে এসে বসলাম। চতুর্দশীর চাঁদ বৈশাখের মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে নেমেছে। আলো ছায়া ছায়া-ছায়া আলো..এইভাবে আমাদের ওপর দিয়ে প্রকৃতি ভেসে যাচ্ছে।
শেষে গঙ্গাপ্রসাদই বললেন— ‘ভালবেসেছি।’
আমি চমকে উঠেছি একেবারে। গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— ‘এটাকে উনি উল্টে নিলেন হয়ে গেল ‘বেসেছি ভাল।’ এ বার এই দুটো অংশের মধ্যে উনি পুরো কর্মটাকে ক্রিয়া বিশেষণটাকে কর্তার অংশবিশেষকে ঢুকিয়ে দিলেন— ‘যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে।’ যে লাইনটা তৈরি হল তাই আমাদের মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝলেন রঞ্জনা!’
‘চিল উড়ছে, ওপরে উঠে যাচ্ছে, আরও উপরে, ক্রমশ বিন্দু হয়ে যাচ্ছে কেন বলুন তো? মেঘের মিনারে সেই ম্যাজিক কেসমেন্ট, সেইখান থেকে ঐন্দ্রজালী ডাক এসে পৌঁছচ্ছে যে।’
আমি বলি— ‘নদী আর তীর যেন জল আর আটা। খুব নরম করে দুধে-মাখা, রুমালি রুটির ময়দার মতো মাখা হচ্ছে।’
‘কিন্তু গন্ধ, মাখাটা হচ্ছে গন্ধ দিয়ে, জল দিয়ে নয়।’
‘অর্থাৎ আরও সূক্ষ্ম, আরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ আরও অমোঘ।’
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— ‘এবং জ্যোৎস্নার উঠান, ঝিঁঝির শব্দ নয় গন্ধ, প্রান্তরের সবুজ বাতাস, নীলাভ নোনা। রসের জন্যই তো আমাদের আকাঙক্ষা কিন্তু রস নিজেই আকাঙক্ষায় গাঢ় হয়ে নেমে আসছে। …জীবনের এই সব নিভৃত কুহক তা হলে আপনি বোঝেন?’
আমি জবাব দিই না। অন্ধকারটা বড্ডই গাঢ় হয়ে যাচ্ছে। চাঁদ এখন মেঘের আড়াল থেকে বিকিরিত হচ্ছে। জ্যোৎস্নার শালবন। নাকি অন্ধকারের শালবন। একটু একটু ভয় করতে থাকে।
‘তা হলে বলি— “আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আপনার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি..রঞ্জনা।’ গঙ্গাপ্রসাদ অপূর্ব বিহ্বল স্বরে বললেন— ‘শুনেছেন শম্ভু মিত্র তৃপ্তিমিত্র-র সেই রেডিয়ো নাটক!’
‘শুনেছি বই কী’, আমি গাঢ় গলায় বলি, ‘আর তৃপ্তি মিত্র-র ‘খোলো খোলো হে আকাশ স্তব্ধ তব নীল যবনিকা?” আর শম্ভু মিত্র-র সেই উচ্চারণ গ্যালিলেও বেশে— “হতভাগ্য সেই দেশ। যে দেশের শুধু বীরপুরুষই দরকার হয়!’ শুনেছেন শম্ভু মিত্র-র “ফকির”—আর একটা রেডিয়ো-প্লে। বিভূতিভূষণের রচনা! উহুহুহু অমন হার্ট-রেন্ডিং ভালমানুষির অভিনয় আর শুনব না।’
বলতে বলতেই আমার কানে ভেসে ওঠে ফকিরের সেই আজান ধ্বনি। আসহাদ আল্লাই লাহা’ ইল্লাহ…আন্না মুহম্মদ…। রসুলুল্লাহ আল্লা হু আকবর… লা ইল্লাহ লাহ! আমার চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে। ‘ব্লেসেড আর দা মীক ফর দেয়ার্স ইজ দা কিংডম অফ হেভন’ যিশুর এই বাণীর এমন হৃদয়মন্থী উদাহরণ তো আর নেই! দুজনেই চুপ করে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছুক্ষণ পর গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, দশটা বাজতে আর তেমন দেরি নেই। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। উঠুন রঞ্জনা। শেষকালে জ্বরটর বাধালে আবার তিনু, কাজল, নিরুপমবাবু সবাই আমাকে বকাঝকা করবেন।’
‘ফাদারও নিশ্চয়ই আপনার জন্যে উতলা হয়েছেন।’ বলেই দুজনে অল্প হেসে উঠি! পরদিনই আমরা প্রিয়া রেস্তোরাঁয় সেখানকার বিখ্যাত পরোটা…আর মাংস খেলুম। বাবা জেনকিন্স আর তীর্ণা এক দিকে বসে ছিল। আমি আর গঙ্গাপ্রসাদ এক দিকে।
‘এই রকম পরোটা আপনি করতে পারেন?’ খেতে খেতে গঙ্গাপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমার রান্না-বান্নার গুণাগুণ আমি শেফালিতে সমর্পণ করেছি।’ আমি মৃদু হেসে বলি—
‘শেফালি মানে কি শরতের শিউলি?’
‘না, গঙ্গাদা শেফালি আমার কাজের মেয়ে, এই রকম পরোটার দশ ভাগের এক ভাগও আমি করতে পারি না’—আমি অকপটে স্বীকার করি— ‘আমি বরঞ্চ দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাপ আঁকতে পারব, তার টিকির সঙ্গে উত্তর আমেরিকাকে জুড়ে দিতেও পারব। কিন্তু তিনকোনা পরোটা বেলা আমার দ্বারা হবে না।
‘কেউ বেলে দিলে?’
‘ভাজা? লেস ডিফিকাল্ট। কিন্তু আমি সেঁকে সেঁকে তাকে শক্ত চামড়া মতো করে ফেলি।’
এ বার গঙ্গাপ্রসাদ সব বদমাইসি ধরে ফেলার হাসি হাসেন।
‘বেশি সেঁকলে যে পরোটা চামড়া মতো হয়ে যায় এ তথ্য আপনার জানা আছে, তবু আপনি সেঁকতে থাকেন? রঞ্জনা, ব্যাপারখানা কী বলুন তো?’ আমি খুবই কাঁচুমাচু হয়ে যাই ধরা পড়ে। সত্যি কথা স্বীকার করাই ভাল। বলি— ‘আপনার নিরুপমবাবু খেতে এত ভালবাসেন যে এক বার ভাল রাঁধতে পারলে আর রক্ষা নেই।’
‘বুঝলুম। কিন্তু শুনতে পাই যে মেয়েরা উদরের মধ্যে দিয়ে মানে রসনার মাধ্যমে তাদের স্বামীদের হৃদয়ে পৌঁছতে চায়।’
‘পৌঁছতে চায় নয় দাদা, বড়ই দুঃখের কথা, এ ভাবেই পৌঁছতে হয়। মানে তারা বাধ্য হয়।’
‘আপনি তা হলে এই সাদা-সিধে রুট দিয়ে পৌঁছতে চান না?’ আমি হাসতে থাকি। কে জানত এই নোদল-গোদল ভালমানুষ আপনভোলা বা ব্যোমভোলা অধ্যাপকটির পেটে পেটে এত উইট, এত পর্যবেক্ষণ, এত আবেগ!
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— ‘কদিনের কথাবার্তায় যা বুঝলুম আপনি গোলক ধাঁধার পথ একটি হৃদয়ে তৈরি করে রেখেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে রঞ্জনা নিরুপমবাবু কি আদৌ সেই গোলকধাঁধার প্রবেশদ্বারে পা বাড়াচ্ছেন? খুব ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নটা তবু জিজ্ঞেস করছি এই সাহসে যে আপনিও শীতের অপরূপ রাতকে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা বলে চিনতে পারেন। ইচু ফকিরের আজানের শব্দস্মৃতিতে আপনার চোখ দিয়েও জল পড়ে।’
আমি কিছুক্ষণ নীরবে পরোটা চিবোই। মুখের ভেতরটাও গভীর আহ্লাদে ভরে যেতে থাকে। হঠাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় এমন একযোগে আমাকে এত দিতে শুরু করল কেন ভেবে অবাক হই।
তারপর সত্যি কথাই বলি— ‘নিরুপমবাবু বা অন্য কেউ গোলকধাঁধার প্রবেশদ্বারটা দেখতে না পেলেও আমার ক্ষতি নেই। মানে ক্ষতি আছে কিন্তু সে ক্ষতিকে পাত্তা না দিতে আমি শিখেছি। কারণ ত্রৈলোক্যনাথ থেকে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়- আবুল বাশার পর্যন্ত গদ্য, রবীন্দ্রনাথ থেকে জয়দেব বসু -নিভা দে পর্যন্ত পদ্য আমায় ভালবাসে। ওই গোলকধাঁধা পার হয়ে যায়। গিয়ে আমার হৃদয়ের কেন্দ্রে কোনও মিনোটর নয়, মেঘের মিনারের জানলার দিকে উড়তে থাকা যে সোনালি চিলনি আছে তারই কাছে পৌঁছে যায়।’
গঙ্গাপ্রসাদের খাওয়া থেমে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ আবিষ্ট দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বললেন— ‘এমন প্রতিধ্বনি কোনওদিন শুনতে পেতে পারি আমার কল্পনাতেও ছিল না। কাজলরেখাও সারা জীবন ওই গোলকধাঁধাটাকে উপেক্ষা করে কাটিয়ে দিল। আমারও তাতে কিছু এসে গেল না। কেন এমন হয়, বলুন তো?’
‘সংসারটাকে তো চলতে হবে! ভিন্নতার মধ্যে দিয়েই সংসারের চলা।’
‘হবে বোধ হয়,’ গঙ্গাপ্রসাদ ভাবুক গলায় বললেন।
তিন দিন রেস্তোরাঁয় খাওয়া হল। ফাদার জেনকিন্স খাওয়ালেন তাঁর নুতুন গার্ল ফ্রেন্ড তীর্ণাকে। আর গঙ্গাপ্রসাদ খাওয়ালেন আমাকে। কিন্তু সিনেমার কথা আমি তাঁকে কিছুতেই বলতে পারলাম না। দু-একটা সিনেমা হল যা হাতের কাছে আছে তাতে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব ছবি হচ্ছে। কী করে বলি? দেখবই বা কী করে? তা ছাড়া প্রথম বৈশাখের এই প্রথম আকাশ’ এই গন্ধরাজদের ফুটে ওঠা, দোলনচাঁপার মৃদু গন্ধ রাস্তার মাটিটিরে মাখে! কত গাছ, গাছ আর গাছ, আর গাছ। এটাই এমন একটা ছবি যা আমরা রোজ ভোরে শিশির মেখে গঙ্গাফড়িংদের সঙ্গে দেখি, সন্ধেবেলায় দেখি ঘরে ফেরা বিহঙ্গকুলের সঙ্গে। কোনও কোনওদিন তীর্ণা আমাদের সঙ্গে আসে, কোনও কোনওদিন ফাদার জেনকিন্স। আর দিনে-রাতে, সকালে বিকেলে, গ্রীষ্মের গুমোটে কোকিল ডেকে যায়, ডেকে যায়, ডেকে যায়। এত ডাকে যে এক দিন আমার ঈষৎ ভাঙা গলায় আমি —‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার/ তোর ওই কুহু তান ভাল লাগে না আর’— কত দিনের বিস্মৃত বাণী কোনারের গলায় গাওয়া এই গান অনায়াসে গেয়ে দিই।
তারপর ফিরতি ট্রেন ধরি। আমি আর তীর্ণা।