মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 03
রঞ্জনা শান্তিনিকেতন যাবার দিন দুই পরে কাজল সুমিতার ফোন পায়।
‘রঞ্জুদিকে কোথায় হাপিস করেছিস রে কাজলদি?’
রঞ্জু ট্রেকিং-এ গেছে শান্তিনিকেতনে।’
‘রঞ্জু ট্রেকিং-এ? শান্তি…ইয়ার্কি মারছিস!’
‘ইয়ার্কি কী আছে। তোর সঙ্গে যে সে দিন বাজি হল, তা সেই ফরাসি পার্ফুমের জন্যে আমরা সব দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়েছি, না?’
‘তাই বল, গঙ্গাপ্রসাদদাও শান্তিনিকেতনে।’
‘এবং আমিও শান্তিনিকেতনে।’
‘মানে?’
‘মানে আর কি, আমিও অগাধ শান্তি উপভোগ করছি। আমার বাড়িটি শান্তির আধার। তুই ইচ্ছে করলেই আসতে পারিস।’
‘ডুবে ডুবে জল খাস কাজলাদি। দিব্যি বরকে সরিয়ে দিয়েছিস যাতে বরাটের আসার পথে কোনও কাঁটা না থাকে। বা বা।’
কাজল বলল ‘যা ব্বা বা। নিজেই বললি বরেদের সব আবিষ্কার করতে হবে নিজেই এখন পথের কাঁটা-টাঁটা বলছিস। তা ছাড়া কাজল কখনও ডুবে ডুবে জল খায় না, ভেসে ভেসেই খায়। তোরা কি কোনও নির্দিষ্ট প্রসিডিওর ঠিক করেছিলিস? বলেছিলিস কি যে এই কলকাতাকেই আমাদের গবেষণাগার করতে হবে?’
‘না তা অবশ্য করিনি, সরি।’
‘তা সে যাই হোক রঞ্জুকে এত খুঁজছিস কেন?’
‘একটা দারুণ ডিসকভারি করেছি।’
‘ডিসকভারি? তো সেটা আমাকে বলা যায় না? না হয় একটা সী-গ্রিন ঢাকাই-ই কিনেছি। যে ঢাকাই কেনে সে কি আঁতেল হয় না? মাসে চার পাঁচটা শাড়ি কিনলেই সে ডিসকোয়ালিফাই করে গেল?’
‘উফ কাজলাদি চুপ করবি? তো শোন বিকাশকান্তিবাবুর মোটেই ভুঁড়ো শেয়ালের মতো চেহারা না। অন্তত ছ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা, পেটা চেহারা একেবারে ; মুখের মাস্ল একটাও আলগা হয়নি।’
‘রং?’ কাজল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার…’ সুমিতা গান গেয়ে ওঠে।
‘চুল?’
‘ওইখানেই তো আসল মজা রে কাজলা। মালবিকাদিটা একটা ডাহা ধাপ্পাবাজ।’
‘সে আমি আগেই জানি।’
‘তুই তো সব জানিস। তা শোন না। চুলগুলো সব একেবারে সাদা।’
‘কাঁটালের ভুতি টুতি কী সব বলছিল না মালবিকাদি, আসলে চকচকে সাদা একটু কোঁকড়া চুলগুলো কী রকম অদ্ভুত ফুলে থাকে। দুর্ধর্ষ!’
‘কোন বিউটি-সেলুনে যান? ড্রয়ার-ব্লোন বোধ হয়।’
‘এটা তো আমার অকার করেনি রে! তা সে যাই হোক, ওতে কিছু আসে যায় না। ব্যাপক লেগেছে আমার।’
‘কালো? তা সেই যতই কালো হোক, দেখেছি তার সাদা চুলের ক্লোক।’ কাজল মাউথ-পিসের মধ্যে গেয়ে দিল।
‘ভাল বলেছিস। বীভৎস একেবারে।’
‘তা সে যেন হল, কিন্তু মালবিকাদির বর সুন্দর বলে তোর অত আনন্দ কেন?’
‘মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে থেকে থেকে তুইও যে ব্যাকডেটেড হয়ে গেলি রে কাজলা। সুন্দর-টুন্দর অ্যাডজেকটিভ এখানে লাগে না, একে বলে বীভৎস।’
‘ঠিক আছে, মালবিকাদির বর বীভৎস বলে তোর পুলক কেন?’
‘আরে বুঝলি না, প্রোব করবার মতো অবজেক্ট চাই না? তেইশ ইঞ্চি বুকের খাঁচা। রগের কাছ থেকে মাথা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দিনে চব্বিশ বার অ্যান্টাসিড চিবোচ্ছে, এ রকম কেউ হলে চেষ্টা করবার চেষ্টা আসে? একটা খোঁচা দিলেই তো প্রোব শেষ! আ’অ্যাম একসাইটেড, ইন্সপায়ার্ড।’
‘কী করে দেখলি? মালবিকাদির বাড়ি গিসলি?’
‘পা-গল! চলে গেলাম সোজা সল্ট লেক। সেক্টর থ্রি, অফিসে ঢুকে পড়লাম। নিজের কার্ড পাঠিয়ে দিলাম।’
‘তোর আবার কার্ড আছে না কি?’
‘তবে? ল্যামিনেটেড কার্ড।’
‘বাস! ডেকে পাঠালেন?’
‘লেকচারার দ্য সাইকলজি আবার সাইকো-অ্যানালিস্ট, ডাকবে না মানে?’
‘কী পরেছিলি?’
‘ছাপা শাড়ি।’
‘এঃ। আমার থেকে একটা ধার নিতে পারতিস!’
‘এ ছাপা সে ছাপা নয় দেবী, এ হল বুটিক ছাপ, ডিজাইনার, লাখে একটি। অফ-হোয়াইট বেসের ওপর লাল কালো হলুদ কটকটে সবুজ দিয়ে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম, সুভদ্রা জগন্নাথ বলরাম…’
‘উরি স্ সাবাশ্, তো সার তোর শাড়ি লক্ষ করলেন? এনি কমেন্ট?’
‘আজ্ঞে না ম্যাডাম, সার তো আর তাঁতি নয়। ছেলেরা শাড়ি-ফাড়ি বোঝে না। দ্যাখে টোট্যাল এফেক্ট।’
‘টোট্যাল এফেক্ট সম্পর্কে তোকে উপদেশ দিতে যাওয়া মানে মায়ের কাছে মাসির গল্প। তবু জিজ্ঞেস করি তুই কি তোর গোছা গোছা পুঁতির গয়না পরে গিয়েছিলি?’
‘আজ্ঞে না, সুমিতা সরকার অত বোকা নয়। রুদ্রাক্ষের অল্পঝোলা দুল, গলায় সরু তুলসী বীজের মালা, হাতে ব্রাউন রুলি।’
‘তোর কী করে ধারণা হল ভৈরবী-বোষ্টুমির কমবিনেশনটা ধরবে?’
‘দ্যাখ কাজলদি, ধরবে নয়, খাবে। কোনটা খায় কোনটা খায় না, সে সম্বন্ধে আমার কিছু টেকনিক্যাল কিছু ইনটুইটিভ জ্ঞানগম্যি আছে। কিন্তু এখন আমি সে সব ভাঙব না। তোর অ্যাপ্রোচ তোর, আমার অ্যাপ্রোচ আমার’
‘তাই? তো তারপর?’
‘তার তো অনেক পর আছে। আমার চড়চড় করে বিল উঠছে, আমি রাখি তুই বরং তারপর ডায়াল কর।’
কাজল বলল— ‘ইল্লি আর কি! তারপর তুই এক ঘণ্টা ধরে বকবক কর আর আমার বরের বিল উঠুক। তোর শুভম আমার গঙ্গার তিন ডবল মাইনে পায়, খাই-খরচ নেই। তুই নিজে চার হাতে রোজগার করছিস, ইয়ার্কি পেয়েছিস! বরং আবার কাল ফোন করে ডেভেলপমেন্ট জানাস।’