মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 01
যাক, এত ঝড়, এত বৃষ্টি! কালকের দিনটা ঠাণ্ডা হবে। কালকের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আড্ডার সুযোগ তো চট করে আসে না আজকাল!
তা সেই আড্ডাতেই আমাদের উপন্যাসের কথা উঠেছিল। অপরাধের মধ্যে বলেছিলুম—‘তোরা কেউ একটা ভাল প্লট দে না রে, একটা উপন্যাসের চেষ্টা দেখি।’
‘তুই লিখবি উপন্যাস?’ সুমিতা হেসে উঠল। ‘তুই তো অস্থির, চঞ্চল, খ্যাপা।’
‘কেন? ছোটগল্প লিখতে পারছি, রম্যরচনা লিখতে পারছি, উপন্যাস পারব না কেন?’
মালবিকাদি বলল, ‘দ্যাখ, রম্যরচনা তাকেই বলে যার কোনও গম্য নেই। সেটা তোকে সুট করে। আর ছোটগল্প? বাগদা চিংড়িও চিংড়ি, গলদা চিংড়িও চিংড়ি আবার ঘেসো ধেনো চিংড়িও চিংড়ি। সমুদ্রে যে তিমি-খাদ্য ক্রিল ভাসে তাকেও চিংড়িই বলছে।
‘মানে?’
‘বিমল করের বিশ পাতার ত্রিশ পাতার গল্পও ছোটগল্প আবার বনফুলের দেড় পাতার গল্পও ছোটগল্প। তুই এর মধ্যে যেখানে ইচ্ছে নিজেকে ফিট করে নিতে পারিস। ধর ভাত বসিয়েছিস। ওথলাল, উঠে ঢাকাটা নামিয়ে দিলি। এ বার ঝট করে তোর গপ্পো শেষ করতে হবে বুঝে গেলি। ফ্যান গালবার সময়ে তোর গপ্পো শেষ। সেনটেন্স শেষ না হলেও কিচ্ছু এসে যাবে না।
এই সব অবোধ যাকে বলে নাদান বালিকাদের আর ছোটগল্পের আর্ট কী বোঝাব!
শিল্পী আমাদের কোমরের বয়সী পাকা মেয়েটা কটকট করে বলল—‘এক্সপিরিয়েন্স চাই রঞ্জনাদি, এক্সপেরিয়েন্স। পৃথিবীটা দেখতে হবে, পাঁচটা দেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, সবটাই আবার সোজাসুজি। ভায়া মিডিয়া নয়। ছোটগল্প তুমি আশপাশ থেকে পিক আপ করতে পারো, আর রম্যরচনা তো খানিকটা এলোমেলো এলেবেলে লিখে গেলেই হল। যেমন আমরা পরীক্ষার সময়ে ‘এসে’ লিখতাম। কিন্তু উপন্যাসে ফাঁকি চলে না—একখানা ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ই বলো, কি একখানা ‘ওয়র অ্যান্ড পীস’ই বললা, কি একখানা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ই বলো।
গম্ভীর মুখে কাজলের দিকে চেয়ে বললুম—‘কী রে, কাজল? তুই কিছু জ্ঞান দিবি না? বাদ যাচ্ছিস কেন?’
‘থাকলে তো দেব?’ —ভ্রূভঙ্গি করে কাজল বলল— ‘আমার বর যদি সব জ্ঞানের গোঁসাই হয়ে বসে থাকে তা হলে আমার ভাঁড়ে মা ভবানী ছাড়া আর কী থাকবে বল?’
এই সময়ে শেফালি লম্বা ডাঁটির গেলাসে বরফ দেওয়া জিরাপানি নিয়ে ঢুকছিল।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। ছেলেদের আড্ডায় শুনি খবরের কাগজে মুড়ি-পেঁয়াজ মাখা ঢালা থাকে, কাঁচালংকা, বেগুনি এ সবও। আর গোদা গোদা কাপে রাম-কড়া ঘন দুধ দেওয়া চা, কিংবা হাতে হাতে মুঠো মুঠো ছোলাসেদ্ধ উঠে যায়, বোতল বোতল দেশি বিদেশি থাকে। টং হয়ে সব আড্ডা দ্যান। এগুলো মেয়েদের সাহায্য না থাকলে। কারও বাড়ির বৈঠকখানায় বা লিভিংরুমে আড্ডা হলে অবশ্য আলাদা কথা, সেখানে গৃহিণীরা ককটেল থেকে কাঁকরোল ভাজা পর্যন্ত সবই দরকার মতো জোগান। তাকে স্ব-নির্ভর আড্ডা বলা যায় না। আমাদের আড্ডা কিন্তু স্ব-নির্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাবারদাবার বা পানীয়র কোয়ালিটি খুব ভাল থাকে। যে কোনও সময়ে আমরা চা-বেগুনি খাই না। শরবতের সময়ে শরবত, চায়ের সময়ে চা। বেগুনির সময়ে বেগুনি, বিরিয়ানির সময়ে বিরিয়ানি।
আপনারা বলবেন আমরাও তো স্ব-নির্ভর নই, শেফালি-নির্ভর। স্বয়ংসম্পূর্ণ নই শেফালি দ্বারা পূর্ণ। কিন্তু আপনাদের জানা দরকার ওই জিরাপানির জিরা মাপ মতো আমিই গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে এসেছি, শেফালিকে বহু চেষ্টায় শিখিয়েছি— মিষ্টি না দিয়েও শরবত হয়। তা ছাড়া শেফালিও আমাদের আড্ডার মেম্বার। এক জন রবাহুত মেম্বার অবশ্য। কিন্তু মেম্বার ঠিকই। তার কথাতেই এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
গ্লাসসুদ্ধ ট্রেটা আমাদের মাঝখানে নামিয়ে রেখে কোমরে হাত দিয়ে, নাকছাবি ঝিকিয়ে সে বলল—‘জ্ঞান গোঁসাইয়ের গান তো গত পরশুই টিভিতে হচ্ছিল। “দীনতারিণী দুখহারিণী ভবানী মা,” বাপ নাকি সুরে সে কী চিৎকার! ভবানী মা পেইলে যাবে।’
মালবিকাদির। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার-কাম-সাক্ষরতা-অভিযান-কাম-অপসংস্কৃতি-নিপাত যাক—সত্তা জেগে উঠল। সে বলল— ‘তুই জানিস জ্ঞান গোঁসাই কে? কী? স্বয়ং রাধিকা গোস্বামীর ভাইপো আবার শিষ্য। তাঁর সম্পর্কে তুই…।’
‘মেয়েছেলের শিষ্য হলেই তাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে?’—শেফালি উবাচ—‘গোঁসাইয়ের ব্যাটা গোঁসাই কিষ্ণর ব্রজলীলের গান গাইতে পারত। কালী মা কাঁচা খেকো মেয়েমানুষ বাবা…তা ছাড়া যাই বলো আর তাই বললা ঠাকুরদেব্তার গান আমার ভাল লাগেনাক’। বুড়ো হলে শুনব অখন। বয়সকালে কি আর ও সব প্যানপ্যানানি মনে ধরে? আমার বাবা সাফ কথা।’
‘যা এখান থেকে পালা,’ আমি বিরক্ত হয়ে বলি। মালবিকাদিকে বলি—‘প্লীজ, ওকে রিফর্ম করবার চেষ্টা কোরো না।’ মালবিকাদি তবু ছাড়ে না—‘কী তা হলে তার বয়সকালের গান? কী ভাল লাগে? তুমি আমার আর আমি তোমার?’
‘ধক ধক ধক ধক’—শেফালি চোখ বড় বড় করে বলে, তারপর পালিয়ে যায়।
কেন না আমি চাঁটা তুলেছি।
‘নিজের স্বার্থে একটা গরিবের মেয়ের পরকাল ঝরঝরে করে দিচ্ছিস রঞ্জু!’ মালবিকাদি আমায় ধিক্কার দেয়।
কিন্তু শেফালি কপাটের আড়ালে তার সবুজ ডুরে শাড়ি কোমরে জড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল—‘বউদির কী দোষ! সে মানুষ আমাকে খাওয়াচ্ছে, মাখাচ্ছে কত কী নতুন নতুন ঘোঁত ঘাঁত শেখাচ্ছে যাতে আমি পরে আরও বেশি মাইনেয় বড়লোকের বাড়ি কাজ পাই। আমার এহকাল পরকাল ঝরঝরে করেছে যে মিনসে সে তো এখন ভাঁটাচোখো, কুপো-গতর, মিস্তিরি মাগির সঙ্গে দিব্যি স্বগ্গো বাস করছে গো। মেয়েছেলেদের জন্যে এত মিটিন অ্যাতো মিটিন করছ দিদি। এই সাত চাখুনি-মিনসেগুলোর একটা হিল্লে করতে পারো না?’
‘কী রকম হিল্লে তুই চাস?’
‘কী রকম আবার? শূলে দেবে। জ্যান্তে শূলদণ্ড। পেছন দিয়ে ঢুকবে, মুণ্ডু কুঁড়ে উঠবে।’ বলাবাহুল শেফালি ‘পেছন’ শব্দটা ব্যবহার করেনি। তবে এবার সে সত্যিই পালায়।
কারণ, আমি উঠে দাঁড়িয়েছি, হাতে উদ্যত চাঁটা। সুমিতা মিটমিটে হেসে বলল—‘এই আনকাট ডায়মন্ডটিকে কোথা থেকে জোগাড় করলি রে? “ভাঁটা-চোখো” “কুপো-গতর” “সাত-চাখুনি” এ তো একেবারে গোলকোণ্ডা রে! তোর ডায়লগ লিখতে কাজে দেবে। ভাল ভাল…এর ওপর আবার টি.ভিটাও ওর হাতে ছেড়ে দিয়েছিস! এ রোগ তোমার হাজার অ্যান্টিবায়োটিকেও বাগ মানবে না মালবিকাদি।’
আমি কাঁচুমাচু মুখে বলি, ‘কী করি বল। ও যদি খুশি হয়ে কাজগুলো না করে আমার লেখাপড়া হয় না। ভাত বসিয়ে লিখতে শুরু করলে ভাত পুড়ে যায়, দুধ বসালে ভুলে যাই, দুধ উথলে যায়।’
কাজল কায়দা করে আজকে প্লেন করে একটা হাতিপাড় শাড়ি পরেছে। ঝনাত করে চাবির গোছা পিঠে মেলে বলল—‘তুই না লিখলে বোধ হয় বঙ্গ-সাহিত্য কানা হয়ে যাবে!’
‘যা বলেছিস কাজল, স্রেফ নিজের ছাই-ভস্ম স্বার্থের জন্যে তুই একটা আনপড় মেয়েকে করাপ্ট করছিস রঞ্জনা। অথচ আমরা চাইছি একেবারে গ্রাসরুট লেভেল থেকে মেয়েরা মার্জিত হোক, শিক্ষিত হোক।’ মালবিকাদি উৎসাহিত হয়ে বলে, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর, লেখা ছেড়ে দে। লিখে তো তোর কাগজের দামও বোধ হয় উশুল হয় না। টু এক্সপেনসিভ এ হবি। তোর লেখা তোর বরেরও একটা এক্সট্রা লায়েবিলিটি। তুই এই শেফালিকে লেখাপড়া শেখা। আমি সমিতি থেকে তোকে বইপত্তর, গাইডলাইন সব দেব এখন। সে বাবদে তোকে খরচা করতে হবে না। তা ছাড়াও তোর এক বছরের চাঁদা মাফ। কেন না একটা কাজ ইকোয়ালস হাজার টাকা চাঁদা।’
আমি বেশ কোণঠাসা হয়ে গেছি। সবাই আমার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি এক্ষুণি চাপে পড়ে না-লেখার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলব, আর ওরা চিয়ার্স দেবে। কিন্তু বেড়ালও কোণঠাসা হয়ে গেল ফোঁস করে, তো আমি তো মানুষ! আমি বলি—‘ঠিক আছে। মেনে নিচ্ছি আমি লেখা বন্ধ করে দিলে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। লিখব না। প্লটও চাইব না তোমাদের কাছ থেকে, কিন্তু আমারও কিছু দাবি-দাওয়া আছে।’
‘দাবি-দাওয়া? তুই কি শিল্পীর মেয়ের সঙ্গে তোর ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করছিস?’
‘বা, বা মালবিকাদি,’ আমি হাততালি দিয়ে উঠি, বিদ্রূপাত্মক হাততালি। ‘নারীকল্যাণের জগদ্ধাত্রী মা জননী দাবি-দাওয়া শুনেই অমনি পণের রেফারেন্স টেনে আনলে!’
মালবিকাদি একটু অপ্রস্তুত হয়েছে। বলল—‘স্যরি। ও সব কী জানিস? কান আর মুখের বদভ্যাস! যাবে কোথায়! জন্মের আগে থেকে শুনছি কি না, ওই জঘন্য ফাইভ-লেটার ওয়ার্ডটা! তা বল তোর কী দাবি?’
আমি ভালমানুষের মতো মুখ করে বললুম—‘পানটা তুমি ছেড়ে দাও। জর্দা-পান-পানপরাগ।’
আমি ভালমানুষের মতো মুখ করে বললুম—‘পানটা তুমি ছেড়ে দাও। জর্দা-পান-পানপরাগ।’
‘বলিস কী রে? কত দিনের অভ্যেস তা জানিস? তা ছাড়া মোষের মতো খাটি। বাড়িতে সাত শরিকের কারও না কারও বাড়িতে একটা বিয়ে, কি ছেরাদ্দ কি অন্নপ্রাশন লেগেই আছে—আমার ছেলেপিলে নেই, আমাকেই সবাই খাটায়। তার ওপরে আছে মহিলা সমিতি। মেয়েগুলোর ঘরে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধেই আছে। তখন সে সব শায়েস্তা করতে সমাধান করতে অসুরের মতো শক্তি লাগে, জানিস?’
‘পান, পানপরাগ কিন্তু খুব খারাপ! জর্দা তো আরও। তামাক থাকে।’
‘ক্যান্সারের জমি তৈরি করছ।’
‘সে দ্যাখ তোদের বিকাশদা চেন-স্মোক করে, ঘরের মধ্যে সব সময়ে আমার প্যাসিভ স্মোকিং হয়ে যাচ্ছে। আজকাল তো ডাক্তারেরা বলছে প্যাসিভ স্মোকিংয়ে ক্যান্সারের বেশি চান্স।’
আমি বলি, ‘ডাক্তারের কথা ছাড়ো। ডাক্তারে কী না বলে, মোক্তারে কী না খায়! কিন্তু তুমি নিজে সামান্য নেশার জন্যে ক্যান্সার আহ্বান করবে।’
‘সে দ্যাখ তোদের বিকাশদার যদি হয়, তা হলে আমি তার চিত্তবৃত্ত্যনুসারিণী স্ত্রী আমার ক্যান্সার না হওয়াটা কি ভাল দেখায়?’
আমি হাঁ হয়ে যাই— ক্যান্সার নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে এই মহিলা? বলি— ‘সব কিছু লাইটলি নেবার একটা সীমা আছে মালবিকাদি। ওই ভয়াবহ রোগ নিয়ে তামাশা করছো? এর পরে বোধ হয় এডস নিয়েও তামাশা করবে? কী-ই বা শিখবে তোমার সমিতির মহিলারা তোমার কাছ থেকে? চোখের সামনে দেখবে তাদের পতিতোদ্ধারিণী দিদিমণি চবৎ চবৎ করে পান চিবোচ্ছেন। তো তারাও চিবোবে। তারা নিশ্চয়ই তোমার চেয়েও বেশি খাটে। তাদের নেশার জরুরত্ নিশ্চয় তোমার চেয়েও অনেক বেশি! লাইফও তাদের অনেক দুঃসহ। তোমার ঘরে বর শুধু স্মোক করে, শরিকেরা খাটায়…’
‘ঝগড়াও করে।’ মালবিকাদি তাড়াতাড়ি বলে—‘কোঁদল যাবে বলে।’
‘আচ্ছা ঝগড়াও করে, কিন্তু তোমার মহিলাদের তো বরেরা পেটায়, ছেলেরা পেটায়। বিড়ির গন্ধ, বাংলুর গন্ধ তার ওপর জুতো সেলাই থেকে…’
‘বুঝেছি বাবা বুঝেছি। সামান্য দুটো পান খাই, তার জন্যে এত কথা শোনাচ্ছিস।’
‘ছাড়বে না তা হলে?’
‘না।’
কাজলকে বললুম— ‘কি রে কাজলা চৈত সেলে কখানা শাড়ি কিনলি?’
কাজল সোৎসাহে এগিয়ে বসে— ‘সেল ফেল নয়, প্রভাদির কাছ থেকে ইনস্টলমেন্টে পাই বলেই কেনা। বড্ড জোর করে। ধর দুখানা জে পি কোটা, তাঁত প্রিন্ট তিনটে— সব ফুলিয়ার ওপর। বেনারস নেট কিনেছি একখানা, রং একেবারে লাইট পীচ, আসল বাংলাদেশি ঢাকাই মোটে একখানা। হাল্কা সী-গ্রিন তার ওপরে সাদার কাজ নো জরি। শাড়িটা দেখলে তোদের মাথা ঘুরে যাবে।’
‘মোট সাতখানা হল তা হলে! তা পরবি কোথায়? সিনেমা যেতে?’
‘দূর, সিনেমা আবার ভদ্দল্লোকে যায়? আমি যা দেখার বাড়ি বসে দেখি। ‘গন উইথ দা উইন্ড’, ‘সাউথ প্যাসিফিক’ সব পুরনো দিনের ছবি, ইদানীং-এর ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘জুরাসিক পার্ক’ সব বাড়িতে দেখেছি।’
‘তবে? পরবি কোথায়?’ আমি পুনরাবৃত্তি করি।
বিমর্ষ মুখে কাজল বলল— ‘সত্যি রে বোশেখ জষ্টির বিয়েতে মুখে বড্ড পাউডার ফুটে ওঠে, টিপও খসে যায়, নতুন শাড়ি পরাও এক যন্ত্রণা, আষাঢ় শ্রাবণে তো দামি শাড়ি পরা হেভি রিসকি। এ বার বছরটা ধু ধু করছে, ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক তো একেবারে মরুভূমি। একটা ভাত-বাড়ি কি একটা শ্রাদ্ধ বাড়িও যদি হয়— নেটটা কি ঢাকাইটা ট্রাই করা যেত!’
‘বা বা বা!’ মালবিকাদি চেঁচিয়ে ওঠে— ‘রঞ্জু, তোর বন্ধুগুলো তো সব দেখছি তোরই মতো। ভরতের আত্মীয় যত সকলি ভরতের মতো। বা বা, শাড়ি ভাঙবার জন্যে ওনার শ্রাদ্ধ চাই!’
‘আমার শ্রাদ্ধ নয়’, কাজল শুধরে দেয়। ‘অন্য লোকের শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধ একটা নেসেসারি ইভ্ল মালবিকাদি, বি প্র্যাকটিক্যাল। যতই দুঃখু করো মানুষ মরবেই। মরলে শ্রাদ্ধ হবেই। শ্রাদ্ধ হলে ব্রাহ্মণ ভোজন, নিয়মভঙ্গ হবেই, আর ব্রাহ্মণ ভোজনে তাঁত প্রিন্ট, নিয়মভঙ্গে নেট। শ্রাদ্ধ বাসরের জন্যে কালা পাড়ের লাল পাড়ের কিছু দশ হাজার বুটি আমার তোলাই থাকে।’
মালবিকাদি কী যেন বলতে যাচ্ছিল, আমি আর কথা বাড়াতে না দিয়ে বলি— ‘কিনিস না।’
‘কিনিস না?’ কাজল ক্যাঁক ক্যাঁক করে ওঠে, ‘আমার নিজের পয়সায় কিনছি তোর ‘ইয়ে’র কী?’
‘তোর কী করে নিজের পয়সা থাকে কাজল, গঙ্গাপ্রসাদবাবু কি তোকে ঝি রেখেছেন? মাসান্তে মাইনে দ্যান?’ —কাজলকে রাগাবার জন্যেই আমি কথাগুলোকে শানিয়ে নিই।
‘আজ্ঞে না, তিনি আমায় ঝি রাখেননি, আমিই তাঁকে বাজার সরকার রেখেছি। বলতে পারো’ —রাগের মাথায় এ হেন কথা স্বামী গরবে গরবিনী কাজলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই আমরা সবাই হায় হায় হায় হায় রব দিতে থাকি। কাজল অবশ্য অত সহজে এল. বি. ডব্লু হবার পাত্র নয়। ক্রিকেট খেললে সুব্রত পোড়েল থেকে ডিকি বার্ড পর্যন্ত সব্বাইকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিত। সে বলে উঠল— ‘ঝি-এর পরিপ্রেক্ষিতে যে চাকর বলিনি এর জন্যেই তোরা আমার শালীনতা জ্ঞানকে অভিনন্দন জানা। আমি রঞ্জুর মতো ভালগার নই, আসল কথা আমার সংসারে আমিই লক্ষ্মী, আমিই নায়েব, আমিই কেশিয়ার— উনি হলেন শিবের ট্রেজারার কুবের। মানে ক্ষমতায় নয়া স্টেটাসে। সবাই পেয়ে গেল পে-কমিশনের এরিয়ার, জ্যোৎস্নাবাবু পেলেন, পালিতবাবু পেলেন, গঙ্গাবাবু আর পান না। শেষে জেরা করে শুনি সেভেনটি ফাইভ পার্সেন্ট পেয়েছে, আমাকে না জানিয়ে গুচ্ছের ডিকশনারি আর কৃষ্ণমূর্তি কিনেছে। বাকি টোয়েন্টি ফাইভের জন্যে মুচলেকা দিইয়ে নিয়েছি।’
‘তোর কর্তা আবার কৃষ্ণভক্ত হল কবে থেকে?’ শ্ৰী মালবিকা উবাচ, ‘কটা মূর্তি? ব্রঞ্জ না পেতল?’
‘আমার কর্তা চিরকালই কৃষ্ণভক্ত ভাই,’ কাজল এক টিপ ভাজা মৌরি মুখে ফেলল, ‘তবে এ কৃষ্ণ কদমতলায় বাঁশি হাতে-দাঁড়ানো সেই বাঁকা শ্যাম নয়। শিল্পী সুযোগ বুঝে ইন নেয়, অহঙ্কারী গলায় বলে— ‘কাজলদি জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তির কথা বলছে মালবিকাদি, নাম শোনোনি?’
‘জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি? কৃষ্ণমূর্তি…রামমূর্তি…সাউথ ইন্ডিয়ান লাগে যেন?’
—‘অ্যানি বেসান্টের দত্তক পুত্র গো, কী সুন্দর চেহারা, ছবি দেখোনি?’
‘সুন্দর চেহারার রাইটার? বলিস কী? তবে তো দেখতেই হচ্ছে!’
—মালবিকাদি এগিয়ে বসে।
শিল্পী গর্ব-গর্ব মুখ করে বলে, ‘রাইটার না কি শুধু? ফিলসফার, লেখায় দাঁত ফোটাতে পারবে না। পারেন এক গঙ্গাপ্রসাদ জামাইবাবু আর পারে আমার বর।’
‘তোর বর? মানে চন্নন? ও তো কমার্শিয়াল ট্রাভলার? ও আবার পড়বেই বা কী আর বুঝবেই বা কখন?’
বরের প্রতি কটাক্ষটা শিল্পী উপেক্ষা করে।
—‘ম্যারিকায় কৃষ্ণমূর্তি এখন লেটেস্ট ক্রেজ তা জানো? প্রভুপাদ আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছেন। জগদ্বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট ডেভিড বমকে…’
‘ব্যোমকে দিয়েছিলেন, না কি?’
‘দ্যাখো মালবিকাদি তেমার এই ইররেভারেনশ্যাল সুপারসিলিয়াস অ্যাটিটিউড আমার ভাল লাগে না—’ শিল্পী সোফায় উঠে বসতে বসতে বলল, ‘রঞ্জুদির হলেও সহ্য করতাম কেন না সে পাঁড় কমিউনিস্টের বউ।’
‘কিন্তু আমি যে কমিউনিস্টের চাকরের বউ?’ মালবিকাদির স্বামী বিকাশকান্তি সরকারি অফিসার।’ শিল্পীও হেসে ফেলল।
‘তা ম্যারিকায় যা যা ক্রেজ হবে সে গণেশ মূর্তিই হোক, আর ফাস্ট ফুডই হোক, আর চাইল্ড-অ্যাবিউজই হোক— সব আমাদের নিতে হবে? মানে তোকে আর তোর বর বরাটকে নিতে হবে?’
আমি দেখলুম আলোচনা আমার অভীষ্ট লক্ষ্যের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আড্ডার ওলডেস্ট আর ইয়ংগেস্ট-এর মধ্যে একটা গজ-কচ্ছপ লেগে যেতে দেরি নেই। তাই তাড়াতাড়ি বললুম— ‘কাজলের শাড়ি কেনা নিয়ে কথা হচ্ছিল কিন্তু। তোমরা প্রসঙ্গে ফিরে এসো। আমি বলছিলুম কি কাজলার এত শাড়ি কেনার দরকার কী? এগজিকিউটিভের বউ হত শিল্পীর মতো তো ঘন ঘন পার্টিতে যেতে দরকার হত। চাকরি করতে বেরোত তো মডারেট দামের অনেক শাড়ির দরকার হত, সুমিতার যেমন হয়। কিন্তু তুই ঘরের বউ, মেয়েটাও শাড়ি পরে না, তুই কেন শাড়িতে অত খরচ করবি?’
কাজল বলল— ‘তোর যুক্তি হল আমার বর মাস্টার তাই তাকে কেউ সামাজিক কাজ-কর্মে সস্ত্রীক ডাকে না। ভাল। তো আমার কি গামছা পরে থাকা উচিত? ডবল গামছা— পরশুরামের সেই ভুষুণ্ডি মাঠের শাঁখচুন্নির মতো পেতনির মতো? ভাল, না মরতেই শাঁখচুন্নি বানাচ্ছিস মরলে আমার বন্ধু আমায় কী বানায় তোমরা সাক্ষী রইলে লক্ষ রেখো।’
আমি দেখি কাজলের যেটা স্বভাব, সুবিধেমতো সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে ‘আহা কালো মেয়ে’ করে করে জিতে যাওয়া— সেটাই চেষ্টা করছে।
তাই তাড়াতাড়ি বলি— ‘ভাই, গামছা-টামছা অত কিছুই বলিনি, বলতে চাইছি অত শাড়ি তোমার না কিনলেও চলে। আমিই তো দু একখানা ভাল শাড়ি কিনে রেখেছি মাত্তর। দিদির মেয়ের বিয়েতে যে পাটোলাটা পরলুম বিধুভূষণ বাবুর মেয়ের বিয়েতেও সেই একই পাটোলা, তারপর যখন বিধুভূষণ বাবু তাঁর প্রকাশনা-সংস্থার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব করলেন বই মেলায়, তখনও সেই একই পাটোলা…
‘শাড়ির ব্যাপারে যদি খোঁটা দিস তা হলে তোকে আর কখনওই শাড়ি ধার দোব না। আর তা ছাড়া শাড়ি ইজ মাই এগ্জিসটেন্স, মাই ফাস্ট অ্যান্ড লাস্ট ল্যভ। রুরুর কাছে যেমন প্রমদ্বরা, লায়লার কাছে মজনু, শেখরের কাছে ববি— এ বচপন নহি, এ মহব্বৎ। মরে যেতে বল না আমাকে তার চেয়ে, মরে যেতে বল।’
আমি বললাম— ‘ঠিক আছে, জানা রইল শাড়িতে তোতে অচিন্ত্য ভেদাভেদ। একে গেলে যায় আর। মেনে নিচ্ছি। আচ্ছা শিল্পী…’
‘আমায় আবার কী বলবে? পেপার-ওয়েটটা কি পছন্দ হচ্ছে না? তা হলে সুমিতাদির মুখোশটা তুমি নাও—’
‘কী ফাস্ট। বাপরে বাপ! হুড়োহুড়ি করে করমণ্ডল চলে গেল!’
‘পেপার ওয়েটের নিকুচি করেছে। মুখোশ গোল্লায় যাক। আমি অন্য কথা বলছি।’
‘কী কথা? ব্যাঙের মাথা?’
‘আমি তোর মেয়ের কথা বলছি। মেয়েটা যে তোদের সঙ্গে সঙ্গে এই এক বার হংকং, এক বার সিঙ্গাপুর, এক বার মেক্সিকো করে বেড়াচ্ছে। ওর লেখাপড়া তো মাথায় উঠছে রে! আমার কাছে রেখে দে না!’
‘ওরে বাবা, আমার একমাত্র সন্তান, একমাত্র মেয়ে, একমাত্র বরের ঔরসে হয়েছে। ওকে আমি কাছছাড়া করতে পারব না। ও-ই বা ওর মাম্কে ছাড়বে কেন? আর তোমার বাড়িতে? তোমার নিজের সংসারেই তো ভাত ধরে যায়। দুধ উথলে যায়। তুমি চাইছ আমার মেয়েকে রাখতে?’
সবাই হি-হি করে হাসে।
মালবিকাদি বলে— ‘আপনি পায় না শংকরাকে ডাকে।’
‘তোমার ছেলের কথাও ভাবো’, শিল্পী আবার স্পিড দেয়। ‘যতই শান্তশীল নাম দাও শান্ত তো সে মোটেই নয়, আমার মেয়েটাকে মেরে ধামসে দেবে।’
‘কোনওটাই হবে না শিল্পী। আমার শেফালি আছে। সব দিক সামলাবে।’
শেফালি ঠিক এই সময়ে থালা ভরতি বেগুনি ফুলুরি পেঁয়াজি নিয়ে ঢুকছিল। এই ভাজাগুলো ও খুব ভাল করে। আমার মুখে, ‘সব দিক শেফালি সামলাবে’ শুনে একেবারে গদগদ হয়ে উবু গেড়ে বসল। আবদেরে গলায় বলল— ‘দাও না গো শিল্পীদিদি তুলতুলিকে আমাদের বাড়ি রেখে। একটা মেয়ে না হলে বাড়ি মানায়? কেমন ঝালর ঝালর ফ্রক শুকোবে, ফিঁতে, ক্লিপ-পুঁতুল, আমি ওর স-ব করে দোব। আর শান্তদাদা? একটু দুষ্টু আছে বটে, কিন্তু মেয়েছেলেদের কিছু বলে না।’
শিল্পী বলল, ‘তা না হয় হল, কিন্তু যদি প্রেম হয়ে যায়?’
সুমিতা বলল, ‘ঠিক, বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে। তবে শিল্পী, ওই উপন্যাসেরই নজির ধরলে তোর মেয়ে শান্তটাকে ডোবাবে, নিজে ডুববে না, ডুবে ডুবে জল খাবে।’
আমি খুব বিরক্ত হই। ‘দিনকাল কি এক জায়গায় থেমে আছে নাকি! যদি প্রেম হয়েই যায়, হবে না, তবু যদি হয়েই যায় আমার শান্ত কি খারাপ পাত্র? আমি কি খারাপ শাশুড়ি? আমার বর কি খারাপ শ্বশুর?’
‘সে কিছু বলা যায় না আগে থেকে রঞ্জুদি, শাশুড়ি যতক্ষণ না হচ্ছ, ততক্ষণ বোঝা যাবে না তুমি কী শাশুড়ি হয়ে দেখা দেবে। তখন আমাদের রিলেশন স্ট্রেইন্ড্ হয়ে যাবে, এমন আড্ডা আর জমবে না।’
সুমিতা একটা পেঁয়াজি মুখে ফেলে বলল, ‘এক যে ছিল সওদাগর।’
মালবিকাদিও কামড় দিল ফুলুরিতে,—‘তার ছিল এক বউ।’
‘তাদের কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না,’ আমি জোগান দিই।
কাজল বলে— ‘একদিন খুব ঝড়ে সওদাগরের বাগানের একটা গাছ পড়ে গেল। সওদাগরের বউয়ের কান্না তাইতে আর থামে না।’
শিল্পী বলল, ‘আহা, এ গল্প কে না জানে। যদি তার ছেলে থাকত, সে যদি ঝড়ের সময়ে গাছের তলা দিয়ে যেত, তা হলে গাছ চাপা পড়ে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হত সেই মনে করে…’
মালবিকাদি বললে, ‘নে একখানা ফুলুরি নে। জানিস তা হলে? তোর কথার ধারা দেখে মনে হচ্ছিল জানিস না। আরও মনে হচ্ছিল ওই সওদাগরের বউ তোর মাসতুত বোন।’
শিল্পী বোকার মতো হেসে বলল—‘কেন? কেন?’
আমরা আবার ‘হায় হায়’ করতে থাকি। আর শেফালি হেসে কুটিপাটি হয়ে তাকে জ্ঞান দেয়— ‘বুঝলে না শিল্পীদিদি, যদি তুলতুল আমাদের এখানে থাকে, যদি শান্তদাদার সঙ্গে তার মহব্বৎ হি মহব্বৎ হয়ে যায়, যদি আমাদের বউদি, বউ-কাঁটকি হয় তবে তোমাদের আড্ডা…’
শিল্পী রেগে বলল— ‘যা যা, কোথাকার জ্ঞানী এলেন রে, যাও তো মিস সক্রেটিস ঘরে যাও। অ্যাভোক্যাডো এনেছি এবার ওদের জন্যে। ছুরি টুরি বার করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এসো…’
‘বাপের জন্মেও আমি সক্রেটি ছিলুম না’— শেফালি ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ‘বাপের পদবি ছিল করাতি। নাম উল্টো-পাল্টা বললে বেড়াল কুকুরেও ফ্যাঁচ করে। তবে আমরা তো বেড়াল কুকুরেরও অধম’— ফোঁস ফোঁস করছে, কাঁদবে না কি?
আমি দুখানা ফুলুরি ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলি— ‘বড়দের পাকা পাকা কথার মধ্যে থাকিস কেন বাবা। ঝিঁকুটি হয়ে যাবি যে।’
‘দ্যাখো বউদি। পেটে সে সন্তান দ্যায়নি তাই। দিলে পরে পাঁচি পাঁচ ছাগলের মা হয়ে যেত।’ —শেফালি তাড়াতাড়ি চলে যায়।
শিল্পী বললে— ‘স্যরি রঞ্জুদি, তোমার একখানা গ্রহশান্তি করাতে হবে মনে হচ্ছে।’
সুমিতা বলল— ‘ঠিকই। সন্তানকামনা যদি ওর খুব উদগ্র হয়ে ওঠে তা হলে ও সন্তানের সম্ভাব্য পিতার খোঁজে ঘুড়ির মতো কেটে যাবে। এটা আটকানোর জন্যেও তুই তুলতুলকে কদিনের জন্যে ধার দে।’
‘ছাড়িব না, ছাড়িব না’— শিল্পী বুকে কাল্পনিক তুলতুলকে চেপে ধরে গান গায়।
আমি দুম করে বলি— ‘তা হলে সুমিতা, তুই তোর ওই লিভ-টুগেদারের পার্টনারটা ছাড়।’
‘মানে? তুলতুলের বদলে শুভম? তুই শুভমকে শেফালির জন্যে চাইছিস? আমার নিজস্ব সাত-পাঁকে-বাঁধাকে তুই লিভ-টুগেদারের পার্টনার বলছিস? শুভম, শুভম, তুমি কোথায়?’
‘আহা হা শুভমকে আমি কারও জন্যেই চাইনি। শেফালির তো প্রশ্নই ওঠে না। স্রেফ ছাড়তে বলেছি। বছরে ছ মাস তো ছেড়েই থাকিস— তুই ডাঙায় চরিস, সে জলে ভাসে— একে লিভ-টুগেদার বলে না তো কী?’
মালবিকাদি ফুলুরিতে এক কামড় মেরে বলল— ‘দেশে দেশে মোর বউ আছে আমি সেই বউ মরি খুঁজিয়া।’
‘ভাল হচ্ছে না কিন্তু’— সুমিতা খুব রেগে যায়। ওর বর মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করে বলে বিরহে মিলনে ওরা বেশ মজে থাকে। দুজনেরই খুব ফ্রিডম— ফলে অটুট বাঁধন— সুমিতার ধারণা।
কাজল বলল— ‘পেঁয়াজিটা দারুণ করেছে কিন্তু শেফালি। আমার হাতে কিছুতেই এমন হয় না কেন বল তো?’
মালবিকাদি বলল, ‘তুই কি পেঁয়াজি গড়তে গড়তে নাক খুঁটিস।’
‘এ মা ছি ছি,’ হাতের পেঁয়াজিটা কাজলা মালবিকাদির মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। মালবিকাদি মাথাটা ঝট করে সরিয়ে নিতে সেটা ল্যান্ড করল শিল্পীর ঠোঁটে।
যেন আরশুলা বসেছে এমন ভয়ে শিল্পী লাফিয়ে উঠে পেঁয়াজিটাকে চটি দিয়ে থেঁতলে দিল তারপরে নাকি সুরে বলল—‘আমি পেঁয়াজি খাঁব না।’
‘তবে ফুলুরিটা খা, একগাল মুড়ি দিয়ে,’ একটা ফুলুরি তুলে নিয়ে মালবিকাদি সাধতে লাগল ওকে— ‘ফুলুরিটা ও খুব শুদ্ধভাবে করে। খুব পবিত্র ফুলুরি, না রে রঞ্জনা?’
আমি রেগে বলি— ‘খাওয়াটা শুধু শুধু মাটি করে দিলে মালবিকাদি, এই জন্যে তোমাকে আমি ডাকতে চাই না। স্রেফ মহিলা সমিতির বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি টেবল ক্লথ, টেবলম্যাট আর কাঁথাগুলোকে বেশি দামে গছাবার জন্যে শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়ে আছ।’
‘আহা, কী আমার বাছুর রে।’ মালবিকাদি আমার থুতনির কাছে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল, ‘রঙিন রঙিন কাপড় পরলেই বয়ঃ থেমে থাকে, না? জানিস তোদের বয়সে আমার ঠাকুমা নাতি-নাতনি পরিবৃত হয়ে স্বর্গে গেছিলেন? বা-ছুর!’
বেগতিক দেখে কাজল মধ্যস্থ মানে বলে— ‘এই দ্যাখ পেঁয়াজি ফুলুরি দুটোই আমি খাচ্ছি, অ্যানট্যাসিড রেডি। তুই শান্ত হ শান্তশীলের মা। মালবিকাদির কেচ্ছা করা স্বভাব। আমি বিশ্বাস করিনি। প্রথমটা রি-অ্যাক্ট করেছিলুম ঠিকই। কে-ই বা না করবে একমাত্র আমার ডিকশনারি-পাগল বর ছাড়া? তা ছাড়া কথা হচ্ছিল রঞ্জুর উপন্যাসের প্লট নিয়ে। মালবিকাদি এর মধ্যে তোমার ঠাকুমা, তাঁর নাতি-নাতনি, স্বর্গ বাছুর এ সব আসে কী করে? আমরা সবাই মিলে রঞ্জুকে লেখাটা ছেড়ে দিতে বলেছিলুম এই তো কথা!’
আমি বলি— ‘ছাড়িব না, ছাড়িব না,’ শিল্পীর মতো সুর করেই বলি, ‘মালবিকা সান্ডেল যদি পান-জর্দা না ছাড়ে, কাজলরেখা মিত্তির যদি শাড়ি কেনা না ছাড়ে, আমিও তা হলে লেখা ছাড়ব না।’
সুমিতা বলল ‘আমার ধারণা ছিল তুই একজন সৎ-লেখক। মানে ইনটেনশনের দিক দিয়ে সৎ। কিন্তু ছিঃ! লেখাটা তোর একটা নেশা একটা শখ, পান-জর্দার মতো? শাড়ির মতো!’
‘লেখা আমার সন্তানও। শিল্পী কি তার তুলতুলকে দুদিনের জন্যেও ছাড়তে পারছে? লেখা আমার প্রিয়তমও। তুই কি তোর শুভমকে ছাড়বার কথা ভাবতে পারছিস?’
এতক্ষণে আমার ফেলা জাল গুটোনো হয়। বিজয়ীর দৃষ্টিতে আমি সবার দিকে তাকাই।
সুমিতা বলল— ‘লেখার সঙ্গে বাচ্চার তুলনা, বরের তুলনা এগুলো টু মাচ রে রঞ্জুদি, টু মাচ।’
‘টু মাচ! আমি তো মনে করি কম বললুম। প্রেমিকদের প্রেমের মধ্যে সেই প্রেরণাদায়ী শক্তি তো ক’বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। থাকে বড় জোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আর সন্তান? সে তো শ্যাম শুক পাখি, আঠারো-উনিশ কি কুড়ি, তার পরেই শিকলি কেটে উড়ে যাবে তোমায় দিয়ে ফাঁকি। এদিকে লেখা! সে হল…’
মালবিকাদি কি কোনও কথা শেষ করতে দেয়? বলে উঠল— ‘শাশ্বত, ফেইথফুল, তার প্রেমে তার ভক্তিতে ভাঁটা পড়ে না, কখনই সে ব্রজধাম ত্যেজে মথুরা যায় না। তুই লিখে যা রঞ্জু, লিখে যা। খালি প্লট চেয়ে আমাদের লজ্জা দিস না।’
মালবিকাদি জোড়া পান মুখে পুরল। শেফালিও বিশাল এক পট চা দিয়ে গেল।
‘লিখবে তাতে লজ্জার কী আছে? কথায় বলে লেখা পড়া করে যে-ই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে-ই। আমাদের বউদি তো তাই-ই করছে—’ শেফালি উবাচ।
‘লিখে তো আমি যাবই’— আমি বলি— ‘আমার ফীলিং আমার কাছে। কিন্তু কথা হচ্ছিল আমি নাকি অস্থির, আমি নাকি খ্যাপা। আমাকে দিয়ে সেই জন্যে নাকি উপন্যাস হবে না। কেন? ঠিক আছে অস্থির। তা অস্থিরতার সঙ্গে খ্যাপামির সঙ্গে উপন্যাসের ঝগড়া কোথায়?’
‘উপন্যাস একটা বিশাল বিরাট সাগরের মতো ব্যাপার। সেটা ধারণ করতে একটা শা-ন্ত ধীর মস্তিষ্কের দরকার হয়। যেমন ধর ‘বাডেনব্রুকস’, ‘ব্রাদার্স কারমোজোভ’, ‘ডক্টর জিভাগো’—কি ধর এই তো ঘরের কাছেই ‘ইছামতী’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ — মালবিকাদি বলে।
‘অদ্ভুত অদ্ভুত নতুন নতুন এক্সপিরিয়েন্সও দরকার হয় রঞ্জুদি’— শিল্পীটা আবার ফুট কাটল— ‘এই ধরো আমরা যে সে বার টোকিও গেলাম। হোটেলের এক দিকটা দেখি একেবারে খোলা। নীল সমুদ্র। তাতে বোট ভাসছে। ভাবলুম সুন্দর তো ঠিকই। অপূর্ব। কিন্তু এমন অদ্ভুত প্ল্যান কেন ওদের মাথায় এল, একটু ভাবতেই বুঝলুম এটা ওদের জাতীয় প্রথার কথা মনে করে করা হয়েছে। হারাকিরির জাত তো জাপানিরা, তাই আত্মহত্যার সুবিধে করে রেখেছে। যে কোনও ফ্লোর থেকে ঝাঁপ খেলেই হল। ওমা। পরে শুনি কাচ। হোটেলের এক দিকটা পুরো কাচের। এই যে তাইল্যান্ডে গেছিলাম, একটা জায়গার নাম অযোধ্যা— ধরো সেইটেই যদি আসল অযোধ্যা হয়! তাই-রা ইংরেজি ভাষাটার পরোয়াই করে না। নিজেদের ভাষাতেই সব কাজ চালায়, ওদের বেশির ভাগ ফ্ল্যাটেই রান্নাঘর নেই। বাইরে খাওয়াটাই রীতি। তুলসীপাতা দিয়ে মাংস রাঁধে, কখনও শুনেছ? অত কথা কী! আমাদের দেশেই কত অদ্ভুত অদ্ভুত কাস্টম আছে। আমরা যেমন সোফা-কৌচ কি চৌকিতে বসি, গুজরাতে তেমন গেস্ট এলে দোলনায় বসায়। তাকে বলে হিঁচকো। ওরা মিষ্টি দিয়ে খাওয়া শুরু করে তেতো দিয়ে শেষ। ওদের বাড়ির মেয়েরা বসে থাকতে জানে না। যত বড়লোকই হোক খেটেই যাবে, খেটেই যা…’
‘তুই থামবি শিল্পী?’ কাজল বলল— ‘রঞ্জু কি তাইদের নিয়ে উপন্যাস ফাঁদবে? না গুজরাতিদের বিষয়ে এসে লিখবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকস-এর জন্যে? ওপর থেকে দেখে ফিকশন লেখা যায় না। আমার বর বলে কনর্যাড আর মম্ দুজনেই মালয় নিয়ে গাদাগুচ্ছের লিখেছিলেন। আঁতেলদের কাছে কনর্যাডের খাতির বেশি। কিন্তু মম্ ক্লেইম করতেন কনর্যাড জাহাজ থেকে মালয়কে দেখেছেন ওঁর মালয় কল্পনার মালয়, এদিকে মম্ চলে গেছেন ভেতরে, বাস করেছেন অন্ততপক্ষে ব্রিটিশ সরকারি অফিসার কি প্লানটেশনের মালিকদের সঙ্গে।’
‘তুই থাম কাজলদি?’ সুমিতা কাজলকে থামায়— ‘আসল হল— মন, মানুষের মন, মনকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ইনসাইড আউট আবার পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো পরতে পরতে জানতে হবে। সাইকলজি। দোমিনিক লাপিয়েরও তো পিলখানার বস্তিতে বাস করেছিলেন শুনতে পাই। কিন্তু কলকাতার মনের ভেতর কি ডুব দিতে পেরেছেন? মনের ব্যাপারটা সায়েন্টিফিক্যালি জানতে পারলে, ফিলসফিক্যালি ফীল করতে পারলে, আর আর্টিসটিক্যালি পুট করতে পারলে একটা কাফকা হয়, একটা কামু হয়, একটা রবীন্দ্রনাথ হয়, একটা মানিক হয়…’
মালবিকাদি আরেক জোড়া পান মুখে পুরে বলল— ‘আর একটা সুমিতা হয়।’
সবাই হেসে উঠল। সুমিতা গোমড়া মুখে বলল— ‘আমি তো এক বারও ক্লেইম করিনি আমি সবজান্তা, কি আমি সব পড়েছি, কি আমি একটা পোটেনশিয়্যাল লেখক… কি আমি…’
‘থাম থাম’— আমি হাত তুলে সবাইকে থামাই— ‘তা হলে তোমরা সবাই স্বীকার করছ এই যে সব বিভিন্ন লেখক এবং তাঁদের লেখার কথা তোমরা উল্লেখ করলে, সবাই ঔপন্যাসিক, লেখাগুলোও সব উপন্যাস?’
‘অত শত জানি না ভাই, সেই বি-এ ক্লাসে পড়েছিলুম ‘কপালকুণ্ডলা উপন্যাস না রোম্যান্স, নারায়ণ গাঙ্গুলি আবার বলতেন রমন্যাস, আর এখন নিত্যদিন আমার বর কচকচ করে মার্কেজ, মার্কেজ, মিরেন্দা না কুরেন্দা, আর ‘মাল্যবান’ আর ‘কারুবাসনা’? তাই কটা নাম জানতে বাধ্য হয়েছি। উপন্যাস হবে একখানা জমজমাট গপ্পো। এক দিনে শেষ হবে না, অনেক দিন ধরে পড়তে হবে, পড়তে পড়তে কেঁদে কেঁদে উঠবো যেমন ‘রাত্রির তপস্যা’ রেগে রেগে উঠব যেমন ‘হাজার-চুরাশির মা’, দীর্ঘশ্বাস ফেলব যেমন ‘গৃহদাহ’, যেমন ‘বীজ’ তবে না?’
‘তা ‘বীজ’-এ সে সেনস-এ তেমন গল্প কোথায়? সবটাই তো একটা নিষ্ফল প্রতীক্ষা? ‘বীজ’ যেমন ‘হাজার চুরাশির মা-ও তেমন কয়েক ঘণ্টায় পড়া হয়ে যায়, ‘কাস্ল’-এ তো কোনও গল্পই নেই, পাতলাও তার ওপর। এদিকে ‘সোয়ানস ওয়ে’ এত বড় বড় ভল্যুম, ‘ওয়র অ্যান্ড পীস’ দু খণ্ড, ‘ফরসিথ (চালর্স নিউটনের উচ্চারণে) সাগা’ তিন খণ্ড—’
—‘আমি ভাই পড়িনি। আমার বর পড়ে থাকতে পারে, এ বার ক্ষ্যামা দাও। আমার বিদ্যেয় আর ঘা দিয়ো না। সত্যি কথা বলতে কি আমার বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, আশাপূর্ণা দেবী, প্রবোধ সান্যাল, আর ইদানীং-এর মধ্যে বুদ্ধদেব গুহ আর শীর্ষেন্দু এই ভাল লাগে। আর সমরেশ মজুমদার। দীপাবলীকে কী সুন্দর শেষমেষ বরের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন।’
‘তা তোমার এই শীর্ষেন্দুই তো সুদ্ধ ডায়লগ দিয়ে একটা উপন্যাস দাঁড় করিয়ে দ্যান। বুদ্ধদেব গুহ লিখলেন বাচ্চা বাচ্চা চরিত্র নিয়ে কিন্তু লেখাটা একেবারে অ্যাডাল্ট। শরৎচন্দ্রের সব ভাল কিন্তু সব্বাই ওঁর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অভয়া। আর উনি তাদের কাটিয়ে কাটিয়ে বেরিয়ে আসছেন। তোমার ভাল লাগার ভিত্তিটা ব্যাখ্যা করো। আমি তো কোনও মিল পাচ্ছি না।’ —আমি বলি।
‘অত যদি ব্যাখ্যা করতে পারব তো গঙ্গাপ্রসাদ না হয়ে আমিই তো সিটি কলেজে লেকচার দিতে যেতে পারতুম।’
শিল্পী বলল—‘তোমার মানিক ভাল লাগে না? সতীনাথ ভাল লাগে না।
‘মানিক ভাল্লাগবে না কেন?’ কাজলের উত্তর রেডি— ‘‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল দিব্যি লাগে। আর ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ তো যত বার দেখাবি দেখে যাব, এক সিটিং-এ। ভূতেদের নামা, আর ভূতের রাজার বর, আর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ওস্তাদি গান গাইতে গাইতে রোগা রোগা ওস্তাদ আর ‘ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি’… আর ‘ভাই রে।’ আর চেঁচাইছিলি ক্যানে?” কাজল প্রায় প্রত্যেকটা অ্যাকশান করে করে দেখাল ছুটি ছুটি’টা ছাড়া!
তারপর বলল— ‘সতীনাথও আমার খুব প্রিয়। আমাদের ছেলেবেলাকার গান সব। ‘বালুকাবেলায় কুড়াই ঝিনুক…।’ ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ —এ সব কি ভোলবার? একটু চাপা চাপা ছিল গলাটা ডি. ভি. পালুসকরের মতো, যেন বিরহের ভারে চেপে গেছে, কিন্তু কী দরদ, সত্যি রে, তখন আমাদের ধারণা ছিল সতীনাথের বিয়ের পরেই নতুন বউ মারা গেছেন।’
‘আর হাসাস নি কাজলা’ —মালবিকাদি পেট চেপে বলল।
‘তুমি সতীনাথের “না যেও না”টা ভাবো মালবিকাদি, তুলনা আছে? লতার “না যেও না”-ও ভাল, কিন্তু সতীনাথের পাশে ফক্কিকারি। রবীন্দ্রনাথের “না যেও না”টা অবশ্য আলাদা জাতের। তবু আমার মতে সতীনাথ ফাস্ট, রবীন্দ্রনাথ সেকেন্ড। রবীন্দ্রনাথ বলে কি ছেড়ে দেব নাকি? আমার কাছে বায়াস পাবে না।’
কাজলাটাকে নিয়ে আর পারি না! গীতিকার গায়ক লেখক সব লণ্ডভণ্ড করে ছেড়ে দিচ্ছে সে-কথা বলতে কাজল চিবুক ঘুরিয়ে বলল—‘পস্ট কথা বলব বন্ধুদের কাছে এর মধ্যে আবার ঢাক-ঢাক গুড়গুড়-এর কী আছে? আসত আমার বরের জ্ঞান গোঁসাই বন্ধুরা নানা রকম ভান ভনিতা করতে হত। “সুটেবল বয়”, “সুটেবল গার্ল”, হারমোনিয়মের বেলো, সল বেলো, হেনরি মিলার নাদিন গর্ডিমার— এই সব সম্পর্কে তাঁরা আলোচনা করতেন আর আমাকে এক বার বাঁ দিকে হেসে একবার ডান দিকে হেসে সন্তুষ্ট করতে হত। এখন তো বলছি তোদের কাছে, যা যা বেস্ট লাগে বলে দিলুম বাস।’
আমি বললুম— ‘আসল কথা যে যাই বলো, উপন্যাসের কোনও…’
‘মা-বাপ নেই’ মালবিকাদি পান চিবোতে চিবোতে বলল,
—‘মোটেই আমি তা বলতে চাই না, তোমরা বড় গুলিয়ে দাও,’ আমি ভীষণ বিরক্ত।
‘দুঃখিত রে, আমি ভাবলুম তুই একটা বড় লেকচার দিবি কাজলার মতো, মুডে আছিস তো, তাই একটু শর্ট করে দিচ্ছিলুম।’
শেফালি আর এক রাউন্ড চা আর চেতল মাছের বড়া নিয়ে ঢুকল।
“আমি বলতে চাই— উপন্যাস ইতিহাস, উপন্যাস রোম্যান্স, উপন্যাস বেলুন ফোলানো ছোটগল্প, উপন্যাস ছোট ছোট গল্পের সমাহার, উপন্যাস নাটক, উপন্যাস বক্তৃতা, উপন্যাস কবিতা,… উপন্যাস যা খুশি হতে পারে, যত খুশি। ধরো লরেন্স স্টার্ন, জেমস জয়েস, গোগোল, এঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন উপন্যাস কত রকম হতে পারে। ধরো ‘প্রথম আলো’ যে-অর্থে উপন্যাস ‘মুক্ত পুরুষ’ কি সেই অর্থে উপন্যাস? ‘দিবারাত্রির কাব্য’ যে অর্থে উপন্যাস ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ কি সেই অর্থে উপন্যাস? ‘দেবযান’, ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ দুটোই ফ্যানটাসি-ভিত্তিক, অথচ কত আলাদা!”
‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাক একটি উপন্যাস’ সুমিতা মাথা নেড়ে নেড়ে কুট কুট করে বলে উঠল।
‘মতটা দিলি তা হলে? তোদের অনুমতি? আমার উপন্যাস হয়তো তোদের মতে ওপন্যাস হবে, তবু তা আমি লিখে ফেলব। ফেলবই ফেলব। তোরা শুধু আমায় প্লট দে।’
শিল্পী আর মালবিকাদি এক মনে চেতল মাছের বড়া সাঁটাচ্ছিল, শিল্পী বলে উঠল ‘অন্ন দে মা অন্ন দে’ বলে চেঁচালে তবু অন্ন পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ‘প্লট দে রে প্লট দে’ বলে চেঁচালেই কি আর প্লট দেওয়া যায়। প্লট কি আর আমাদের নেই?—তবে সে সব বড্ড পেরাইভেট।’
‘তুই প্লটলেস লেখ বরং’—মালবিকাদি উপদেশ দেয়।
‘হেবভি গান “অন্ন দে” শেফালি মন্তব্য করে, তবে “পেলট দেরে” বলে।’ কোনও গান আমি বাপের জন্মে শুনিনি। আর পেলট তো তোমাদের থাকবেই গো শিল্পীদিদি। এক কাটা দেড় কাটা হলেও তো লোকে কিনে রাখছে। ও-ই দু দশ বছর পরে দশ ডবল দামে বিকোবে। লোকে তো আজকাল এই করেই টাকা করছে। থাকে যদি তো বউদিকে একটা দাওই না কেউ। নেয্য দাম দেবে। আমাদেরই কপাল!’ বলে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে শেফালি চলে গেল।
মালবিকাদি বলল—‘যাক এখনকার মতো ফাঁড়া কাটল। তা রঞ্জু তুই সুমিতার পার্ট-টাইম বরকে নিয়ে লেখ না! অমন একটা চিরবিরহের জীবন। তার ওপরে কালারফুল!’ এখনও ও সুমিতার পেছনে পড়ে আছে।
সুমিতা বলল—‘কে কালারফুল, কে নয়, সেটা তিনের একের এ যাদু ঘোষের লেনে বসে তো বলা যাবে না। মাঠে নামতে হবে। তোমার বরকে নিয়েও তো লিখতে পারে?
—‘আমার বর?’—মালবিকাদি হেসে কুটিপাটি হয়ে গেল। বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই, পার্ফেক্ট ভুঁড়ো শেয়ালের মতো চেহারা। চুলগুলো যেন কাঁটালের ভূতি মেখেছে। হাসালি!’
‘আই চ্যালেঞ্জ’—সুমিতা হাঁটু চাপড়ে বলল।
‘কীসের চ্যালেঞ্জ বোনটি?’
সুমিতা বলল—‘বরেদের তোমরাই আলু-পটল-কুমড়োর জগতে, রাতে-নাক-ডাকা দিনে-আপিস আর টিফিন-কৌটোয়—আলুমরিচের চার দেওয়ালে বন্দি করে রেখেছ। তোমাদের অ্যাটিটিউড হল সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল, রোম্যান্সের চেয়ে সিকিওরিটি ভাল, ওদের তোমরা আড্ডা মারতে দাও না, তাস-দাবা খেলতে দাও না। একলা কি অন্য কারও সঙ্গে সিনেমা-থিয়েটার-নাচ-গান যেতে দাও না। ফুচকা খেতে দাও না। অন্য মেয়ের সঙ্গে মিশতে দাও না, পাছে বর তার প্রেমে পড়ে যায়, মানে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই নিজের ওপর, নিজের জীবনসঙ্গীর ওপর।’
‘প্রশ্নই ওঠে না, প্রশ্নই ওঠে না’—মালবিকাদি বললে—‘তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে এখন আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কী?’
কাজলা বলল—‘আমি ভাই আমার বরকে বেঁধে রাখিনি। সে নিজেই গোঠের গোরু টাইপের।’
শিল্পী বলল—‘আমি সব সময়ে শর্মিলা-সঞ্জীবের ‘গৃহপ্রবেশটা মনে রাখি। নিজের লাইফের সিক্রেটটা তোমাদের বলে দিচ্ছি। ড্রেস আমার আছে হাজার রকম। চুল ভগবান অনেকটা দিয়েছেন। হেয়ার-স্টাইলও আমার বহু রকম। তোমরা নিজেরাই তো বলো রন্ধনে আমি দ্রৌপদী। তুলতুলকে যতটা মনোযোগ দিই চন্দনকে তার কম দিই এ কথা শত্রুতেও অর্থাৎ শাশুড়িতেও বলতে পারবে না। আবার সব সময়ে যে সেঁটে থাকি তা-ও বলতে পারবে না কেউ। এই তো ঈজিপ্ট গেল আমি যাইনি, ম্যানিলা গেল আমি যাইনি।’
আমি বলি—‘তা হলে তুই বাহ্যাড়ম্বরে বিশ্বাস করিস? তোর ড্রেস আর চুলের স্টাইল আর রান্নার তরিবত এই দিয়ে তুই চন্দনকে ভুলিয়ে রাখতে চাস?’
‘বাহ্যাড়ম্বর কেন হবে?’ শিল্পী বলল—‘ভেতরে ল্যভ তো আছেই। বাইরের ব্যাপারগুলোকেও আমি উপেক্ষা করি না। রিস্ক নিয়ে কী লাভ? কেন সেই “প্যাভিলিয়ন অফ উইমেন”-এ পড়োনি, চিনা বাড়ির সুন্দরী গিন্নি মাদাম উ তাঁর মেজ বউ মেজ ছেলের মধ্যে গোলমাল দেখে শেষ পর্যন্ত মেজ বউকে ডেকে বিশেষ একটা পারফ্যুম মাখতে পরামর্শ দিলেন, আরও কী কী সব শেখালেন,—এগুলো প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার কেউ বলে কেউ বলে না।’
‘তা হলে তো দেখা যাচ্ছে নিরুপম গড়াই ভীষণ ভালনারেবল।’ আমি চিন্তিত হয়ে বলি ‘রান্নায় আমি মা, সংসার দেখে শেফালি, শান্তর বাবার চেয়ে শান্তর প্রতিই আমার বেশি মনোযোগ। অর্ধেক দিন চুল বাঁধতে ভুলে যাই। বাড়ির শাড়ি একটা না ছিঁড়লে আর একটা বার করি না…’
শিল্পী বলল ‘নট নেসেসারিলি। তোমার অত ঘাবড়াবার কিছু নেই। তবে নিরুপমদা তো পলিটিক্স নিয়ে মেতে আছেন, নইলে তোমাকে চুল বাঁধতেই হত, একটা দুটো ভাল-মন্দ রাঁধতেও হত।’
সুমিতা বলল—‘আমার মধ্যে আমার শুভমের মধ্যে কোনও অভাববোধ, কোনও অবিশ্বাস, কোনও হিংসুটিপনা নেই। এখন “কালারফুল” কথার মানে কী? সেটা আমাকে এক্সপ্লেইন করো।’
আমি বলি—‘বহুমুখী ব্যক্তিত্ব, লাইভলি, জলি।’
‘তাই যদি হয় তো ঠিক আছে, কিন্তু মালবিকাদি একটা কোনও নিজস্ব বাজে অর্থে কালারফুল কথাটা ব্যবহার করেছে।’
‘না, না, মোটেই না’—মালবিকাদি হাঁ হাঁ করে ওঠে, রঞ্জু যা বলেছে ঠিক বলেছে। আমি তার চেয়ে এক চুল বেশি বা কম বলিনি। আফটার অল, রঞ্জু লেখে-টেখে, শব্দ নিয়ে ওর কারবার। ও যতটা গুছিয়ে বলতে পারবে আমরা তো ততটা…।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’—সুমিতা বলে, ‘কতটা কালারফুল আমার শুভম তুমি পরীক্ষা করো না, আমি মাঠ ফাঁকা করে দিচ্ছি। শুভম পরশুর পরের দিন পৌঁছচ্ছে। ওই সপ্তাহটা হয়তো আমাদের নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকবে। তারপর আমারও কলেজ, রিসার্চ, মেয়েদেরও স্কুল, পরীক্ষা, বলছি তো ফাঁকা মাঠ।’
আমি একটা প্লটের আঁচ পেয়ে যাই, বলি ‘তা শিল্পী তুইও দেখ না নিরুপমদাকে বেশ রসিক করে তুলতে পারিস কি না। তার মধ্যে অভাববোধ আছে কি না। নাকি তার রংচং আমি আমার ধূসর দিয়ে ঢেকে রেখেছি।’
শিল্পী বলল—‘তা হলে সবাই নেমে পড়ুক। কাজলদির সঙ্গে তো চন্দন স্কটিশ চার্চে পড়ত। ঝালিয়ে নিক পুরনো ভাবটা।’
কাজল গোঁয়ারের মতো বলল ‘আমি এ সবের মধ্যে নেই ভাই। আমার বর সিরিয়াস ধরনের মানুষ। টের পেলে রেগে গুম হয়ে যাবে। চন্দনের সঙ্গে ভাব ঝালিয়ে নেওয়াটা কোনও ব্যাপার না, সে আসুক, যাক, যেমন আমার ছেলের বন্ধুরা, বরের বন্ধুরা আসে যায়…কিন্তু…’
মালবিকাদি বলল ‘তা হলে তো প্রমাণই হয়ে গেল তুই গঙ্গাকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিস, ঠিক যা যা সুমিতা বলছিল। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ। তা হলে তুই মেনে নে তুই হেরে গেছিস। ম্যাচ ছেড়ে দেবার মতো আর কী! ওয়াক ওভার দিয়ে দে। হেরে যাবার চিহ্নস্বরূপ তুই তোর সী-গ্রিন ঢাকাইটা রঞ্জুকে দিয়ে দে। একখানা পাটোলা ছাড়া বেচারির আর কিছু নেই..’
‘ঠিক আছে।’ কাজলা বলল, ‘ঢাকাইয়ের চেয়ে বরং রঞ্জু আমার বরটাকেই নিয়ে নিক।’
‘আমি এর মধ্যে নেই।’ আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি। ‘নেওয়া-নেওয়ি আবার কী?’
‘নেওয়া-নেওয়ি নয়, আবিষ্কার করা’ সুমিতা বলল, ‘নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করা পুরনো পৃথিবীতে…’
উপন্যাসটা মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সুমিতাই লিখবে। ‘কিন্তু কীভাবে জানা যাবে যে আমরা সব কলাম্বাস, আমেরিগো ভেস্পুচি, আমুন্ডসেন?’—শিল্পী জিজ্ঞেস করল ‘স্টাডি করে তো বলতেই পারি নিরুপমদা আসলে ভীষণ ভীষণ দুঃখী। মানুষটা বাপ-মায়ের কাছেও তেমন স্নেহ-ভালবাসা পায়নি, রঞ্জুদিও যত্ন আত্তি করে না। দুঃখের চোটেই ও নেতা হয়ে গেছে। কিংবা রঞ্জুদিও তত বলতে পারে গঙ্গা জামাইবাবু ডিকশনারিবাজ নয় আসলে ধড়িবাজ, শান্তিনিকেতনে অত ঘড়ি-ঘড়ি যান কেন? না রিয়্যাল এস্টেট প্রমোট করতে। বেনামিতে…’
কাজল একটা কুশন তুলে নিয়ে শিল্পীকে, ধমাদ্দম পিটতে লাগল। ‘আমার সেইন্টলি বরকে তুই ধড়িবাজ বললি?’
‘যাক বাবা, আমি ধড়িবাজ বলেছিলুম বলে তো তুমি সেইন্টলি বলে স্বীকার করলে।’
হাসতে হাসতে আমাদের সব চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে।
যাই হোক, ঠিক হল, কারও মুখের কথায় শুধু বিশ্বাস করা হবে না। সঙ্গে খান তিনেক সই করা রেস্তোরাঁর বিল চাই, অন্তত একটি সিনেমা বা থিয়েটার বা যে কোনও অনুষ্ঠানের টিকিট। সুমিতা নাকি সব্বাইকে মানে যে যে লস্ট কন্টিনেন্ট আবিষ্কার করতে পারবে তাকে তাকে একখানা করে শ্যানেল নং-ফাইভ দেবে। সুমিতা যদি পারে তবে সুমিতাকে আমরা সবাই মিলে একটা ঢাকাই প্রেজেন্ট করব। কেন না সুমিতার জেতা তো ডবল জেতা। ব্যক্তিগতভাবে জেতা, আবার সাধারণভাবে ও যে সব অভিযোগ করেছে সে-সব মিলে যাওয়ায় জেতা।
আমি চুপচাপ বসেছিলুম। সুমিতা বললে ‘কী রে নাভার্স লাগছে?’
‘লাগবে না?’ আমি বলি—‘তুই তো সাইকলজির লোক। মনের অতল থেকে তো ভূতও বেরোতে পারে ভগবানও বেরোতে পারে। মনুষ্য চরিত্র প্রহেলিকা আছে…তা-ইই থাকত, না হয়।’
‘সাইকলজি বলে মনের অতল থেকে ভূতই বেরোয়। ভগবান ঘোরাফেরা করে আর একটু সারফেসে। তবে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? অতলের ভূতকে চট করে কেউ আলমারি খুলে দেখায় না। এক যদি পড়ে আমার হাতে সাইকো অ্যানালিসিস করে ভূত বার করব তারপর থেরাপি করে ভূত ভাগিয়ে দেব।’
‘রেজাল্ট যাই হোক কেউ কিন্তু মন কষাকষি করতে পারবে না’—সুমিতা চেঁচিয়ে বলল।
‘মন কষাকষিটা মন থেকে আসে সুমিতা, ইচ্ছা থেকে নয়। সাইকলজির লোক হয়ে কী করে এমন একটা অর্ডিন্যান্স জারি করছিস জানি না’, আমি বলি, ‘আগুন নিয়ে খেলতে যাচ্ছিস। সাবধান করে দিচ্ছি।’
কেউ আমার কথা শুনল না। স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে লাগল। শুভম মালবিকাদিকে চেনে না। মালবিকাদিও শুভমকে চেনে না। ছবি দেখে চিনবে। অ্যাডভান্টেজ মালবিকা। মালবিকাদির স্বামী বিকাশকান্তিকেও আমরা কেউই দেখিনি। তিনিও আমাদের না। অ্যাডভান্টেজ সুমিতা। আমার স্বামী নিরুপম শিল্পীকে এক ঝলক দেখে থাকতে পারে। ডিউস। কিন্তু কাজল চন্দনের ক্লাস ফেলো। উভয়েই উভয়কে চেনে। গঙ্গাপ্রসাদবাবুকেও আমি কাজলার বিয়ে হয়ে অবধি চিনে আসছি। মানুষটি লাজুক, চুপচাপ, তাই তেমন আলাপ নেই। তা হলে এই দুটো কেস কী হবে? সুমিতা বলল অ্যাডভান্টেজ চন্দন আর গঙ্গাপ্রসাদ। আমাদের অর্থাৎ আমাকে আর কাজলকে প্রাণপণে খেলতে হবে।
সুমিতা অবশ্য বলেছিল—‘রঞ্জুদি বিকাশকান্তিবাবুকে দেখুক, আমি গঙ্গাজামাইবাবুর ভার নিচ্ছি। গঙ্গাজামাইবাবুকে আমার ব্যাপক লাগে।’
কাজল বলল—‘না না। না না। সুমিতা না।’
‘কী আশ্চর্য’, সুমিতা বলল—‘আমরা কি তোমার বরকে সিডিউস করতে যাচ্ছি নাকি?’
‘কী জানি ভাই কী করতে চাচ্ছ। খেলাটা আমি ভাল বুঝতে পারিনি। আমি শুধু জানি আমায় চন্দনের ঘাড় ভেঙে খেতে হবে আর সিনেমা দেখতে হবে।’
‘ফাইন্ডিংসও বলতে হবে,’ সুমিতা হবে।
‘ফাইন্ডিংস আবার কী?’
‘তুমি তাকে কী বুঝেছ, তোমার ভার্শন কী? সেটা শিল্পীর সঙ্গে মিলছে কি না। আলাদা ডাইমেনশন বেরোয় কি না।’
আমি বললুম, ‘তা হলে আগে থেকে রেকর্ড করে রাখো কে নিজের অর্ধাঙ্গর সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করছে। সুমিতা কাগজ কলম নিয়ে রেডি হ।’
কাজলা আবার বাদ সাধল—‘নিজের বরকে কে কী ভাবে সে আবার সব বলা যায় না কি? আমি এখন যদি ভাবি সে গাধা তো সেটা সবাইকে বলব?’
শিল্পী বলল—‘একটু আগেই তো গোরু বললে। আবার সেইন্টলি বলেছ, এখন বলছ গাধা…’
‘উটমুখো, পাগল ছাগল এ সবও আকচার বলে থাকে’—আমি জানাই।
‘দাঁড়া দাঁড়া’—সাইকলজির লোক সুমিতা মাঠে নামে—‘আমি বলছি, কাজলদি বলতে চায় গঙ্গাজামাইবাবু এত ভাল যে লোকে বোকা বলতে পারে, এত ভুলো যে লোকে পাগল বলতে পারে, এত্ত ডিসিপ্লিনড যে লোকে গোঠের গোরু বলতে পারে। আপন খেয়ালে থাকেন, ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামান না। ঠিক!’
কাজল বলে—‘ওই এক রকম হল।’
‘মালবিকাদি। তুমিও কি বিকাশদা সম্পর্কে ওই একই কথা বলতে চাও?’
‘সেইন্টলি? না ভাই। বড় জোর অনেস্ট। ভোলেভালাও যাকে বলে তা নয়। দাড়ি কামাতে ভোলে না, পালিশ ছাড়া জুতো পরে না, সিগারেট চায়ের কাপে ফেলে না, তবে গোঠের গোরু যদি বলো তো আপত্তি করব না। তবে কাজ পাগলা, আর ভীষণ কাঠখোট্টা, খাদ্য ছাড়া আর কিছুতে রস পায় না। খাদ্য আর থ্রিলার।’
শিল্পী বলল—‘চন্দন বরাট আমুদে, দিলখোলা, পরোপকারী ধরনের লোক, এ কথা আমি একা কেন সবাই বলবে। ডেপথ কম আমি নিজেই বলছি ভাই। তবে খুব লাভিং, কেয়ারিং। খাও, হাসসা গাও, নির্দোষ স্ফূর্তি করা, দু-এক পেগ খাও, বাস।’
সুমিতা বলল,—‘শুভম-এর গ্রেটেস্ট চার্ম হল ও খুব ছেলেমানুষ। খুব চমৎকার বন্ধু হতে পারে। তবে ওই, ম্যাচিওরিটি একটু কম। একেক সময় আমার মনে হয় ছোট্ট ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করছি। তবে সেটা আমার নালিশ নয়। আমি মানিয়ে নিয়েছি। কোনও জটিলতার মধ্যে ও নেই। সরল ধরনের।’
ওরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আমি কী বলব? সত্যি কথা বলবো?’
‘কী রে?’—কাজলা ঠ্যালা মারল—‘আমরা যেন তোদের বাসরে আড়ি পেতেছি মনে হচ্ছে?’
‘যা বলেছিস’—মালবিকাদি বলল—‘ন্যাকামিতে গলে গলে পড়ছে।’
‘আমাকে তুলে নিলে কিছু হবে না।’—আমি বললুম।
‘মানে?’
‘খু-উব নির্লিপ্ত। আমি কোথায় আছি, কেমন আছি, কী খাচ্ছি কী পরছি নিরুপমের কোনও খেয়ালই নেই। আমি যে আছি তাতে ওর কিছু এসে যায় না। না থাকলেও নেই নেই। ওর ওয়ার্ড, ওর কাউন্সিলরগিরি, ওর পার্টি, ওর ইজম, ওর ক্যাডার—এই নিয়ে থাকে। গান-গণসঙ্গীত ছাড়া শোনে না। নাচকে বলে রাবিশ। নাটক, সিনেমা মাড়ায় না। শোনে শুধু ভাষণ, সরোজিনী নাইডু, পদ্মজা নাইডু, রাধাকৃষ্ণন, তারও আগে সুরেন বাঁড়ুজ্জে, বিপিন পাল, ইদানীং-এর মধ্যে হরিপদ ভারতী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, সোমনাথ চাটুজ্জে। এঁরা ওর হিরো। ভাষণ যদি ভাল হল তো যাদের ওপর হাড়ে-চটা তাদের সভাতেও গিয়ে দাঁড়াবে।’
‘পাগলা’—মালবিকাদি সস্নেহে বলল।
‘ভাষণ পাগল’—সুমিতা বলল, ‘সেই জন্যেই কি তুই লেখা ধইচছিস?’
মালবিকাদি বলল ‘রঞ্জু লেখা ধইচ্ছে বলে নিরুপম ভাষণ ধইচ্ছে কি না দ্যাখ। ডিম আগে না মুরগি আগে—গাছ আগে না বীজ আগে…’
‘দ্যাখো’—আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলি—‘আমার লেখা তোমাদের ভাল না লাগে তোমরা পড়ো না, কিন্তু বার বার খোঁটা দিয়ো না, লিখতে লিখতে আমি বড় হয়েছি, লেখাই আমার জীবন…’
‘লেখায় তোর জন্মগত অধিকার বলছিস?’ মালবিকাদি টিপ্পনী কাটে।
‘লিখতে লিখতেই জন্ম যেন লিখতে লিখতেই মরি’—সুমিতা।
‘লোকে যেমন দুধ খেতে খেতে বড় হয় তেমনি তুমি লিখতে লিখতে বড় হয়েছ রঞ্জুদি?’—শিল্পী।
কাজলকে বললুম—‘কী রে তুই এ বার সাঁতলে তোল, এরা তো নানান রকম দিল।’
কাজল বলল ‘আমার বলে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল! আমি এখন অন্যের কড়ায় সম্বরা দিই আর কি!’
এই ভাবেই আমাদের প্রথম অধিবেশন সমাপ্ত হয়।