Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu » Page 17

মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

আমাদের পরবর্তী আড্ডার দিন স্থির হয়ে গেছে। কাজলের বাড়িতে গঙ্গাপ্রসাদ এবং অনীক-তীর্ণা ও তাদের বন্ধুরা সুতরাং কাজলের বাড়ি বাদ হয়ে যায়। মালবিকাদির বাড়ি অনেক শরিক। নিজেদের অংশ ঠিকই আছে। কিন্তু পাঁচিল টাঁচিল নেই। তা ছাড়া বিকাশকান্তিবাবু অফিস থেকে ফিরবেন, তিনি তারপরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন নীরবতা চাই, সুতরাং এ বাড়িও বাদ। সুমিতাদের বাড়িতেও শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁরা খুবই মাই ডিয়ার তবু… তা ছাড়া সুমিতার মেয়েরা আছে, শুভমও তো বাড়ি আছে। সুবিধে হবে না। শিল্পী খুব ধরেছিল আড্ডা ওর বাড়িতে হোক, কিন্তু চন্দন একেকদিন বড্ড তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, বাতিল করে দিলাম। সব দিক বুঝেশুনে যাদু ঘোষের স্ট্রিটেই দ্বিতীয় অধিবেশনের ভেনু স্থির হয়। নিরুপম গড়াই গড়াতে গড়াতে রাত্তির আটটা সাড়ে আটটা করে ফেলেন। শান্তর এখনও হাত বাঁধা, কিন্তু বিকেলে সে ক্লাবে যেতে পারছে। নিজে না খেললে কী হবে, অন্যদের খেলা তার দেখা চাই-ই। তারপর সন্ধেয় বাড়ি ফিরে তার নতুন টিউটর হয়েছে প্রশান্তদা, সে এলেই শান্ত নিজের ঘরে চুপচাপ। প্রশান্তদা পড়াশোনাতেও সোনার চাঁদ, অ্যাথলেটিকসেও প্রচুর মেডেল। সুতরাং প্রশান্তদা এখন শান্তশীলের হিরো। সলমন খান-শাহরুখ খান না হয়ে প্রশান্তদা হিরো হওয়ায় আমরাও খুব নিশ্চিন্ত।

মালবিকাদি বলেছে মাংসের চপ নিয়ে আসবে, শিল্পীর অবদান ফিশ বলস ইন তো মিয়াম উইথ বেসিল লিভস, আবার শেফালি বলেছে মুড়ি বেগুনি সাপ্লাই দেবে যত লাগে, কাজল পাড়ার দোকান থেকে সরভাজা আনছে আর সুমিতা নাকি কুইন এলিজাবেথ যে চা খান সেই জিনিস পেয়েছে, তা-ই আনছে।

আমরা শনি রবিবারে আড্ডা দিই না। উইক ডে-তে দিই। আজও শুক্রবার।

শিল্পীই সবচেয়ে আগে এল। ওর বর ওকে পৌঁছে দিয়ে গেল। বিরাট এক হাণ্ডার মতো ক্যাসেরোল নামাল গাড়ি থেকে। এরই মধ্যে সেই ফিশ বলস ইন তো মিয়াম উইথ বেসিল লিভস।

চন্দনকেও ডাকলুম—‘আসুন না, একটু বসে যাবেন।’

‘আরে ম্যাডাম আমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছি, জার্মানি থেকে কোম্পানির গেস্ট আসছে রিসিভ করতে হবে।’

‘তা হলে ফেরবার সময়ে! কাজল থাকবে।’

‘আরে কাজলা তো আমায় বলেনি কিছু! বললে না হয় আগে থেকে এয়ারপোর্টে একটা ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা করা যেত।’

‘ও কাজলা বললে? আমরা বলছি সেটা কিছু না?’

‘আরে মশাই কলেজের প্রেম, এ ডাকের রোম্যান্সই আলাদা…’

বলেই চন্দন হুশ্‌শ্‌ করে বেরিয়ে গেল।

‘দেখলে? দেখলে’ শিল্পী আমায় বলল।

আমি বললাম, ‘নিরুপমদা কিন্তু বেরিয়ে গেছে আরও সকালে।’

‘কী হিংসুটি। কী হিংসুটি! আমি যেন জানি না নিরুপমদা কখন বেরোবে! কিন্তু শান্ত আর নিরুপমদার জন্যে তো মিয়াম আগে সরিয়ে রাখো, মালবিকাদির হাতে পড়লে এক ফোঁটাও থাকবে না।’

আমি ডাকলুম, ‘শেফালি!’

গৃহিণীপনায় আমি একেবারেই অচল অধম। শেফালি আর শিল্পী মিলে যা হয় করুক। শিল্পী শুধু তাই খাবারই আনেনি, খাবার সুন্দর সুন্দর কাচের তাই বাটিও এনেছে, বাটি, চামচ, প্লেট।

বললে, ‘তোমার তো কিচ্ছু নেই। হয়তো কাঁসার বাটি বার করে দেবে।’

যা খুশি বলুক—আমার আজকে খুব পুলক। কেননা, আপনারা বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না আমারও কিছু ভক্ত পাঠক আছে, তারা আজ সকালে আমাকে রাশি রাশি ফুল দিয়ে গেছে। নিউ মার্কেটে আরও কোথায় কোথায় এদের ফুলের দোকান আছে। ফুলের চাষ করে। শুনতে খুব খারাপ লাগে কিন্তু ওরা ফুলকে ‘মাল’ বলে। বর্ষার ফুল দিয়েছে প্রচুর ডবল জুঁই, মালতী, কেয়া, জুঁইগুলো মালা গাঁথা, দিয়েছে গোলাপও, ঈষৎ হলুদ আভাযুক্ত সাদা গোলাপ। বলে গেল, ‘মালটা এ ক্লাস দিদি। গন্ধে মাত করে দেবে।’

আমি বসবার ঘরটায় গোল একটা সাইড-টেবলের ওপর তোলা কাঁসার কানা উঁচু থালায় কাঁচা শালপাতা পেতে জুঁইয়ের মালা কয়েকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল করে রাখি। একটা কোণে একটা কেয়া রাখি কালো পাথরের গেলাসে। আর মাঝখানে বড় কার্পেটটা পেতে কাঁসার ডাবরে গোলাপগুলো গুচ্ছ করে রাখি। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিই। এর পরেও যথেষ্ট ফুল থেকে যায়। আমাদের প্রত্যেক শোবার ঘরে, পড়ার ঘরে কোনও না কোনও মহাপুরুষের ছবি আছে।

আমার ঘরে শ্রীচৈতন্য, নিরুপমের ঘরে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও সারদা মা, শান্তর ঘরে বিবেকানন্দ। সব ছবিতে আমি মালা পরিয়ে দিই। এ ছাড়াও আমার ঘরে রাখি কেয়া, নিরুপমের ঘরে গোলাপ, শান্তর ঘরে মালতী, আর শেফালির ঘরে শ্রীদেবীর একটা আর মা কালীর একটা ক্যালেন্ডার আছে, ওর উপাস্যা দেবী। এঁদের গলাতেও জুঁইয়ের মালা পরিয়ে দিই।

একটার সময়ে সরভাজার বাক্স নিয়ে কাজলা এসে যায়। হাতে একটা লম্বা থলে, কিছুতেই সেটা হাত ছাড়া করে না সে। দুটো বাজতে পনেরো মিনিটের মাথায় আসে মালবিকাদি গোটাগুটি একটি টিপিনকারি হাতে ঝুলিয়ে।

‘গজব থেকে কিনে আনোনি তো?’ কাজল জিজ্ঞেস করে।

‘হুঁহ! এ হচ্ছে ঘোষাল ফ্যামিলির ট্রেড সিক্রেট, কোনও গজবে এ জিনিস পাবি না।’

সুমিতা যে লেট লতিফ সেও কাঁটায় কাঁটায় দুটোয় এসে গেল। বললে, ‘শেফালি তোমাদের চায়ের পট গরম জল, আর ভিম দিয়ে ধোও, তোলা চায়ের সেট বার করো। গোরুর দুধ এনেছি, ফুটিয়ে চাপা দিয়ে রাখবে, তা সত্ত্বেও সর পড়ে গেলে তুলে দেবে, চিনি দুধ সব পটে রাখবে কাঁটায় কাঁটায় আড়াইটে বাজতে পাঁচ মিনিটে জল বসাবে, টগবগ করে ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে ঝটাপট পার কাপ এক চামচ করে পাতা পটে দিয়ে গ্যাস অফ করে দেবে। জলটা এক দফায় ঢালবে। ভাল ধার কাটে এমন সসপ্যান নিয়ো। তারপর এভরিথিং চায়ের পট, ছাঁকনি, দুধ চিনির পট সব সুদ্ধ আমাদের ওখানে দিয়ে এসো।’

কাপ-প্লেট চামচ ছাঁকনি সুমিতা নিজেই ট্রে-সুদ্ধু নিয়ে আড্ডা ঘরে ঢুকে গেল।

ঢুকেই সব্বাই বলল, ‘আ-হ, এ যে ফুলশয্যার ঘর সাজিয়েছিস রে রঞ্জু।’

সুমিতা বলল, ‘এ মা। সব মাটি করে দিলে।’ প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি!

‘আচ্ছা বেরসিক তো!’ শিল্পী কাজল সবাই তেড়ে উঠল। মালবিকাদি এই মারে তো সেই মারে।

‘মেয়েটা এক দিনের জন্যে নিজের মনোমত ফুল সাজিয়েছে, আর তুই তোর ইকেবানা ফলাতে এসেছিস?’

‘ইকেবানা নয়?’ কাঁদো-কাঁদো গলায় সুমিতা বলল, ‘এত ফুলের গন্ধের মধ্যে চুমু খাওয়া যায় কিন্তু রানির চা খাওয়া যায় না। রঞ্জু তুই প্লিজ অন্তত কেয়া আর জুঁইগুলো সরা।’

‘কী আশ্চর্য, আমি বলি— কেয়ার গন্ধ এখনও বেরোয়ইনি। রাতে বেরোবে।’

‘জুঁইয়েরটা বেরোচ্ছে, ভুরভুর করে বেরোচ্ছে, প্লিজ রঞ্জু, চা খাওয়া হয়ে গেলেই আমি আবার ঠিক জায়গায় রেখে দেব।’

কী আর করা! জুঁইয়ের মালা সুদ্ধু টেবিল আমি খাবার ঘরে রেখে আসি। কেয়াফুলের গেলাস খাবার টেবিলের ওপর শোভা পায় আপাতত।

আড়াইটে পর্যন্ত সাংঘাতিক টেনশনে কাটে আমাদের। রানির চা খাওয়ার বাসন, পরিবেশ, রানির চা তৈরি করার প্রক্রিয়া সবই এত সুকুমার যে আমরা ভেতরে ভেতরে নিজেদের গলিয়ে গলিয়ে নরম করে ফেলতে থাকি। চায়ের ডেলিকেটত্বর সঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করে যাই। শিল্পী আতর মেখে এসেছে টের পেয়ে তার শরীরের কোনও নিভৃত কোণ থেকে আতরভেজা তুলোর টুকরো সমিতা টেনে বার করে ফেলে দেয়। মালবিকাদিকে প্রথমে ডেটল সাবান তারপরে লিরিল দিয়ে হাত ধুয়ে আসতে বলে। মালবিকাদির হাত দিয়ে নাকি এখনও মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে। এ-ও সে মনে করিয়ে দেয় যে পান-জর্দার সঙ্গে রানির চা চলে না। একমাত্র কাজল তার ক্লোত্র পারফ্যুম-মাখা শাড়ি পরে নির্বিকার বসে থাকে। সুমিতা তাকে অনেক সাধাসাধি করে—‘যা না রঞ্জুদির একখানা পাটভাঙা শাড়ি পরে আয় না।’ কাজল বলে সে কোনও পারফ্যুমই মাখেনি। বড্ড গরম তাই একটু ঘেমেছে।

বললে ‘সত্যি তোরা একটা মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিস? শুনেছিলুম বটে পদ্মিনী নারীদের শরীরের নির্যাসে পদ্মগন্ধ থাকে। সে ক্ষেত্রে আমাকে সরে যেতে হয়, আমাকে বাদ দিয়েই তোরা রানির চা খা।’

তারই কাছে একমাত্র সুমিতা হেরে যায়। তবে সে বারে বারেই আমাদের দাস মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করে। —‘রানির চা আবার কী? দার্জিলিঙের চা। আমাদের ভারতবর্ষের, পশ্চিমবঙ্গের, দার্জিলিঙের চা। ইংল্যান্ডের রানি আমাদেরটা খান।’ অথচ ‘রানির চা’ কথাটা ও নিজেই বলেছিল।

শেষ পর্যন্ত আড়াইটে বেজে এক মিনিটে আমরা সেই দুর্ধর্ষ চা পান করি। দেখতে ন্যাতা-ধোয়া জলের মতো। খুশবু ভাল হলেও আহামরি কিছু নয়। মালবিকাদি তো কোনও গন্ধই পায় না। তারপর আবার জুঁইফুলের টেবিল আসে, কেয়াফুলের গেলাস আসে। এবং আমরা আমাদের গবেষণার ফলাফল এবং প্রমাণ সব বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

মালবিকাদির বিল মোট এগারোটা—সাবির, আমিনিয়া, গজব, সুতানুটি জংশন, ওয়ালডর্ফ, ব্লু ফক্স, এ্যামবাসি, পিটার ক্যাট, বালিগঞ্জ ধাবা, তাজবেঙ্গলের সোনার বাংলা এবং বাঙালির আদর্শ হোটেল। মোট সাড়ে চার হাজার টাকার বিল সিনেমা-থিয়েটার গানের আসর মিলিয়ে ন’ জোড়া টিকিট। মালবিকাদি খুব লজ্জিত গলায় বলে, “কিছু মনে করিসনি সুমিতা, আমিও যত খেতে পারি, তোর বরটাও তত খেতে পারে, আর চারটে মাস মোটে ছুটি বেচারির, তুই তোর সাইকোথেরাপি নিয়ে ব্যস্ত, ওকে তো থিয়েটার-সিনেমাগুলো দেখতে হবে।’

—‘আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?’ সুমিতা বলল।

মালবিকাদি বলল—‘তবে ছেলেটা সত্যি ছেলেমানুষ। সুমিতার ধারণার সঙ্গে আমার ইমপ্রেশান একবারে মিলে গেছে ‘মজাদার, আমুদে। আচ্ছা সুমিতা রাধেশ্যাম বলে ওর কোনও বন্ধু আছে?’

—‘সেই হতভাগার সঙ্গেও তোমার আলাপ করিয়ে দিয়েছে না কি?’

—‘না, তা নয়। আসলে ওর জাহাজি চাকরির মূলে ওই রাধেশ্যাম।’

—‘হ্যাঁ শুনেছি বটে, রাধেশ্যামের নাম ওর ঠিক আগে ছিল, রাধেশ্যাম না নিতে নাকি ও ম্যারিনে চান্স পায়।’

—‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মালবিকাদি বলে, ‘ওর মধ্যে একটা রোম্যান্টিক বিষণ্ণ দিক আছে সেটা সুমিতা লক্ষ করিসনি কেন জানি না। আসলে ও খুব দাগা পেয়েছিল। ওই রাধেশ্যামই ওর প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে ভিড়ে যায়। এ কথা ও কাউকেই কোনওদিন বলেনি। সুমিতা তুমিও কখনওই ওকে বলবে না যে আমি বলেছি। সুমিতাকে অনেকটা সেই মেয়েটির মতো দেখতে বলেই ও সুমিতার থেকে পালিয়ে বেড়ায়, আবার ছুটেও আসে।’

সুমিতা ওর ব্যাগ থেকে একটা শ্যানেল নংফাইভের মোড়ক বার করে দেয়। ওর মুখে কথা নেই।

সেকেন্ড গেল কাজলা। আটটা রেস্তোরাঁ, পাঁচটা নন্দন, রবীন্দ্রসদন। পরীক্ষা করে নিয়ে সুমিতা আর একটা মোড়ক বার করে।

‘তোমার কী বলবার আছে বলো।’

কাজলা বলে ‘আছে। কিন্তু শিল্পী যদি ভয় পেয়ে যায়।’

‘কেন? কী হয়েছে?’ শিল্পী আঁতকে ওঠে—‘আর একটা বিয়ে করেছে নাকি? বিগ্যামি? সে পক্ষেরও একটা ছেলে?’

‘আরে না না। নিমাই সন্ন্যাস।’

‘তার মানে?’

‘চন্দন হপ্তায় দু’দিন করে বেলুড় মঠ-দক্ষিণেশ্বরে যায় জানতিস?’

‘না তো!’

‘সন্ন্যাস নিতে চাইছে। স্বামীজিরা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না বলে আটকে আছে ব্যাপারটা। যেদিন হবেন সেদিনই ও তুলতুল, শিল্পী, বিশ হাজারি চাকরি, দেশভ্রমণ সমস্ত ছেড়ে চলে যাবে।’

শিল্পীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, সে বলল—‘সত্যি বলছ?’

‘মিথ্যে বলে আমার লাভ? নিজেও ভক্ত, বৈরাগ্য এসে গেছে এই সব ভাব-টাব করে ওর পেট থেকে কথা বার করেছি। অত কৃষ্ণমূর্তি পড়ে তখনই তোর বোঝা উচিত ছিল। ফিলসফিকাল বেন্ট’

শিল্পী পুতুলের মতো ওর ব্যাগ থেকে রেস্তোরাঁর বিলগুলো বার করে দিল। চারটে রেস্তোরাঁ, তিনটে দর্পণা, রবীন্দ্রসদন আর কলামন্দির।

ছলছলে চোখে বোজা গলায় বলল—‘রঞ্জুদি তোমাদের এত খরচ করিয়ে দিয়েছি বলেই বোধ হয় আমার এমন শাস্তি হল। তবে বিশ্বাস করো এর চেয়ে বেশি আমি নিরুমপদাকে রান্না করেই খাইয়েছি। সে তুলনায় তোমার বরের পকেট এমন কিছু ফাঁকা হয়নি।’

‘আমি কি তোকে কিছু বলেছি?’ আমি নরম গলায় বলি।

সুমিতার দেওয়া পারফ্যুমের শিশিটা যেমন কে তেমন পড়ে থাকে।

‘কিন্তু রঞ্জুদি একটা কথা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি’ শিল্পী বলল—‘নিরুপমদা তোমাকে যথেষ্ট ভালবাসে এবং মিস্ করে। আসলে তুমি ওর থেকে সুপিরিয়র এই একটা ওয়ারি, দুশ্চিন্তা সব সময়ে কাজ করে যাচ্ছে ওর ভেতর, তাই তোমার কাছে নিজেকে ওপ্‌ন করতে পারে না। আমি এটার আভাস পেয়েছি। সত্যিই বলছি, নিরুপমদার ওপর এখন আমার একটা রীতিমতো টান এসে গেছে। আমার দাদা নেই বউদি নেই, সত্যি যদি চন্দন আমাদের ছেড়ে চলে যায় রঞ্জুদি তোমরা আমাদের একটু দেখো।’—বলতে বলতে শিল্পী কেঁদে ফেলল।

আবহাওয়াটা ভারী হয়ে গেছে। তারই মধ্যে আমি সবেধন নীলমণি প্রিয়া রেস্তোরাঁর তিনটি বিল বার করি। যেন যাই ঘটুক না কেন এগুলো আমাদের স্বীকৃত দায়। বলি—‘আমি ভাই কোয়ালিফাই করিনি। সিনেমা কোথায় ওখানে? ওই তো ‘বিচিত্রা’য় যা হচ্ছিল ছোট বউ না বড় বউ না সখা-সখী ও সব আমি দেখতে যাব বলতে পারিনি। আমার পারফ্যুম চাই না।’

‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না রে?’ কাজলা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল। ‘যেখানে ভাল হল নেই, ভাল ছবি নেই সেখানে তোদের মতো রুচিশীল রুচিশীলারা কী-ই বা করতে পারে? তা শালবনে আমবনে তো বেড়িয়েছিস তাতেই হবে। সুমিতা ওকে ওর গিফ্‌টটা দিয়ে দে।’

সুমিতা আমার হাতের মধ্যে জোর করে জিনিসটা গুঁজে দিল।

‘তা সে যাক’, কাজল বলল, ‘সে কী বলে? সেও কি সন্নিসি হয়ে যাবে?’

‘তোর বর তো এক রকম সন্ন্যাসীই কাজল। সে কথা তুই নিজেই জানিস। পাঁকের মধ্যে পাঁকাল হয়ে বাস করবার সহজাত ক্ষমতা নিয়েই উনি জন্মেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যাকে কুটীচক বলতেন, যাঁকে তীর্থ যেতে হয় না, ঘরে বসেই তীর্থফল লাভ করেন, উনি তো তাই।’

‘খুব যে তেল মারছিস!’ বলে বটে, কিন্তু কাজলার মুখ জ্বলজ্বল করে।

‘সুমিতা, তোর কী হল?’—মালবিকাদি জিজ্ঞেস করে

‘কিছুই হল না’—রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সুমিতা বলল।

আমি বললুম—‘তুই হলুদ টাঙাইল পরে সোনালি পরীটি সেজে যাসনি?’

‘গিয়েছিলাম তো! হলুদ কী করে জানলি?’

‘আমি যে একটু-আধটু লিখি ভাই। তা প্রজেক্ট ফাইল বার করে কোয়েশ্চনেয়ার দিসনি?’

‘তা-ও দিয়েছিলাম। তোকে কে বলল?’

‘আমার মন। তারপর পার্কসার্কাস কনেক্টরের কাছে তোদের রাঁদেভু ঠিক হয়নি।’

‘তা-ও হয়েছিল। এটাও কি লিখিস-টিখিস বলেই জানতে পারলি?’

‘বলতে পারিস! তো তারপর?’

‘তারপর বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটিতে এক দিন, গ্র্যান্ডে এক দিন।’

‘তো সে বিল কোথায়? বললি যে জেরক্স করে দিবি?’

‘করা হয়নি, হারিয়ে গেছে, তোদের বিশ্বাস করবার দরকার নেই।’

‘সিনেমা, থিয়েটার, রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি, শিশির মঞ্চ, নজরুল মঞ্চ, মধুসূদন…’

‘কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। একটা সিটিং শুধু হয় সাইকোঅ্যানালিসিসের। তাতেই বুঝে গেলাম।’

‘কী বুঝলি?’

‘পার্ফেক্টলি নর্ম্যাল, সেনসিব্‌ল, সেন জেন্টলম্যান। আমি কোনও নতুন মাত্রা আবিষ্কার করতে পারিনি।’

মালবিকাদি নিপুণ কায়দায় ওর মুখে একটা মাংসের চপ ঠুসে দিতে দিতে বলতে থাকল ‘বলিনি? বলিনি? কাজপাগল, বেরসিক। জানিস তবুও আমার ভয় ছিল যদি কিছু কেলো করে। ফিফটির পর ছেলেরা একটু ইয়ে হয়ে যায় তসলিমা বলেছে।’

‘তা কী বলে খেতে নিয়ে গেলি?’

‘আরে তুমি তো জানোই তোমার উনি খাইয়ে বাড়ির ছেলে। আমি যেই সাজেস্ট করেছি কোথাও বসে একটু খেতে খেতে আমি কোয়েশ্চনেয়ারটা পড়ে যাব, আর উনি ইয়েস, নো গুলো বলে যাবেন, অমনি রাজি হয়ে গেলেন। এক দিনই মাত্র চেম্বারে অ্যানালিসিস করাতে নিয়ে যেতে পেরেছি।’

মহা উৎসাহে মাংসের চপ তুলে নিল মালবিকাদি।

কাজলা বলল—‘একটু মাস্টার্ড দে না রঞ্জু, শিল্পী মাস্টার্ড নিবি না?’ শিল্পী মাথা নাড়ল—‘না।’

কাজল বলল—‘নে না, মাস্টার্ড ছাড়া কি মাংসের কষা জমে? দ্যাখ শিল্পী, কথাটা বলে তোকে একটু সাবধান করে দিতে চাইলুম, আর কিছু না। তুই যে মনে করিস, খালি হরেক রকম সাজগোজ করলে আর গুচ্ছের রান্না করে খাওয়ালেই সবার মন পাওয়া যায়, এ ধারণাটা তোর ঠিক না। সন্ন্যাস-টন্ন্যাস কিছু না। কিন্তু এর যে আধ্যাত্মিক দিকে প্রবল ঝোঁক, এটা তুই জানতিস? এ সব কথা ও তোকে বলেওনি, কেন না ও তোকে ইমম্যাচিওর মনে করেছে। সেই ইমপ্রেশনই তুই ওকে দশ বছর ঘর করার পর দিয়েছিস। তুই মনে করছিস ওর ডেপ্‌থ্‌ নেই, ও মনে করছে তোর ডেপ্‌থ্‌ নেই। এখন তুই জানলি, এই জায়গায় তুই ওকে কম্প্যানি দে, ঠাট্টাতামাশা না করে, তো দেখবি তোর নিমাই ঘরেই আছে।’

শিল্পী বলল—‘সত্যি বলছ’—দু হাতে মুখ ঢাকল বেচারি। আঙুলের ফাঁক দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছে।

আমরা মহানন্দে মাংসের চপ শেষ করে চা খাই। সুমিতাটার যেমন বাড়াবাড়ি। অত সাজগোজ, ফাইল-টাইল, ফোর্ড ফাউন্ডেশন, পার্কসার্কাস কনেক্টর, সাইকো-অ্যানালিসিস। বাঃ বাঃ। আমরা কেউই এত সব করিনি। তবে যার যার অ্যাপ্রোচ তার তার। তেমন তেমন অ্যাপ্রোচ হলে রিপ্রোচও হবে।

‘তো মিয়ামটা এবার বার করি?’—শিল্পী মৃদু গলায় বলে। শেফালি দরজার কাছ থেকে বাণী দেয়—‘মুড়ি খেয়ে মুখ সোঁদা করে নাও সব। দাঁড়াও আমি বরফজল, সরভাজা সব রেডি করি।’

লাল টকটকে ঘন ঝোলের মধ্যে মাছের বলগুলো ভাসছে। ওপরে কিছু বড় বড় তুলসীপাতা ছড়ানো।

মালবিকাদি বললে—‘কি রে আমাদের পুজো করবি নাকি? নৈবিদ্যি উচ্ছুগগ্‌ করেছিস মনে হচ্ছে।’

শিল্পী বলল—‘যা দেবী সর্বভূতেষু কাজলদিরূপেণ সংস্থিতা’

সুমিতা বলল—‘যা দেবী সর্বভূতেষু মালবিকারূপেণ সংস্থিতা’

কাজল বলল—যা দেবী সর্বভূতেষু ঢাকাইরূপেণ সংস্থিতা, সী-গ্রিন ঢাকাইটা আমি সুমিতাকে দিচ্ছি, আমাদের মধ্যে দিয়েই ও বাজি জিতেছে বলে, আর আমার একটা ফোকটিয়া বালুচরি লাভ হয়েছে বলে…।

শেফালি কখন এক শাঁখ নিয়ে এসেছে ভগবান জানেন। হাততালি দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠে ‘নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমো।’ তারপরে শাঁখ বাজিয়ে দেয়।

তো মিয়ামের তাই-বাটিতে তাই-চামচ ডোবাই আমরা কোশার গঙ্গাজলে যেন কুশি ডোবাচ্ছি। তারপরেই ওরেব্বাপ্‌ চাঁদি পর্যন্ত জ্বলে যায়।

এইভাবেই হেসে, কেঁদে, কেশে, জ্বলে আমাদের আড্ডার দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress