মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 15
কিন্তু সেই স্বপ্নটা? স্বপ্নটা আমাকে বড্ড ভাবাচ্ছে। সুমিতার সাহায্য চাই। ও তো একবারে বে-পাত্তা হয়ে আছে। মহানায়ককে আমি হঠাৎ স্বপ্নে দেখতে গেলাম কেন? এ তো এক ধরনের ‘স্বপ্নদোষ’। এগারো-বারো বছর বয়স যখন, তখন স্বভাবতই আমি ‘স্বপ্নদোষ’ মানে জানতুম না। আরও অনেক বড় বয়সেই কি জেনেছি? তখন ‘স্টেটসম্যান’ তার ‘ভয়েসেজ’ বার করেনি। নতুন কথা, শব্দ, প্রয়োগ না করতে পারলেও শান্তি পাচ্ছি না। আমাদের ছোটবেলায় তো টি.ভি ছিল না। বড্ড শো-বাজ ছিলুম। আট-ন বছর বয়সে দাদা-দিদিদের ইনটেলেকচুয়াল আসরে—অইউং ঋণক হযবরট্ লঙ্…” বলতে বলতে ঢুকে গিয়েছিলুম। ওরা অত কী আলোচনা করে, আমাকে পাত্তা দেয় না, আচ্ছা আমিও দেখাব, এই ভেবে দিদির টেবিলে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ছিল, তার থেকে কিছু মুখস্থ করে নেমে গিয়েছিলাম। তা, সেইরকমই মাকে একদিন বললাম—‘মা, আমার রোজ রোজ স্বপ্নদোষ হচ্ছে।’ যা ব্বাবা মা খেপে লাল। কোথায় মেয়ের ম্যাচুওরিটি দেখে মুগ্ধ এবং নিশ্চিন্ত হবে!
‘ধেড়ে মেয়ে, কখন কী বলতে হয় জানো না।’
মায়েদের সুবিধামতো মেয়েরা একই বয়সে কখনও ‘তেলপটকা’ কখনও ‘ধেড়ে’ হয় এ কথা নিশ্চয় সবাই জানেন।
মায়ের কথায় এবং এই মারে তো সেই মারে মূর্তি দেখে মিইয়ে যাই বলি—‘বা রে মাকে বলব না তো কাকে বলব!’
‘কী হয়েছেটা কী বলো।’ —খানিকটা সামলে নিয়ে মা বলেন, ‘রোজ দেখছি একটা কে যেন আমার বুকের ওপর বসে, গলা টিপে ধরছে, আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারপর আঁ আঁ করে জেগে উঠি, আর দিদি আমাকে ঠাঁই ঠাঁই করে মারে।’
মা গম্ভীরভাবে বলেন—‘ক’দিন আমার পাশে শোও। পাশ ফিরে শোবে হাত বুকের ওপর রাখবে না, ঠিক হয়ে যাবে। ওকে “স্বপ্নদোষ” বলে না।’
‘তা হলে কাকে বলে সেটা বলবে তো?’
মা মুখ ফিরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। অর্থাৎ বলবেন না। ঠিক যেভাবে প্রফুল্ল মাস্টারমশাইকে ‘হস্তমৈথুন’ মানে জিজ্ঞেস করাতে তড়িঘড়ি অঙ্কের খাতা কালির শিশি সব উলটে চলে গিয়েছিলেন। দরজার কাছ থেকে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করেন সেবার, ‘কোথায় পেয়েছ?’
আমি বলি—‘পাঁজিতে।’
‘পড়ো না।’
বা রে বা! পড়ব না? তিলতত্ত্বটা অত ইমপর্ট্যান্ট। বাঁ পায়ে তিল থাকলে দেশভ্রমণ হয় কোত্থেকে জেনেছি? পাঁজি থেকেই তো? তারপরেই তো মুরাড্ডি চাণ্ডিল সব ঘুরে এলাম! বাঁ ঠোঁটের ওপর তিল থাকলে প্রেমজ বিবাহ হয়, রীণাদির বিয়েতে অত সমালোচনা হল মাস্টারমশাইকে বিয়ে করেছে বলে, তার পর পরই তো আমাদের দুলালদাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বুড়ো মাস্টারমশাই প্রফুল্লবাবুকে রাখা হল, তো রীণাদিরও তো বাঁ ঠোঁটে তিল ছিল। পাঁজি আবার পড়ব না!
তা সে যাই হোক প্রফুল্ল মাস্টারমশাই কোনও কোনও প্রশ্নের বেশ সন্তোষজনক উত্তরই দিতেন।
‘মাস্টারমশাই, বারবনিতা মানে কী?’
‘অ্যাঁ?’ মাস্টারমশাই চমকে উঠলেন, তারপর বললেন—‘বার মানে কী?’
‘বাইরে।’
‘আর বনিতা মানে?’
‘মেয়ে।’
‘তবে?’
‘বাইরের মেয়ে।’
‘এই তো বুঝেছ।’
ঠিক সেই সময়ে দিদি ঢুকছিল। আমি বললাম, মাস্টারমশাই, বারবনিতা এল।’
প্রফুল্ল মাস্টারমশাই এ বার এমন চমকে উঠলেন যেন ভূত দেখেছেন। দিদি গম্ভীর মুখে ভেতরে ঢুকে গেল।
মাস্টারমশাই চলে যেতে ভেতরে ডাক পড়ল। দিদির পড়ার ঘরে। ‘কান ধরে এক পায়ে দাঁড়াও।’
‘কেন?’
‘খারাপ কথা শিখেছ, সেইটা বলছ আমাকে?’
বুঝতে পারি কোথাও একটা খুব ভুল হয়ে গেছে।
‘বেশ্যা’র বেলায় আর ভুল করিনি।
এ মানেটাও মাস্টারমশাইকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।
উনি বলেন—‘যে বেশ করে, অর্থাৎ খুব সাজগোজ করে সেই বেশ্যা।’
‘যেমন মিতাদি?’—উদাহরণ সহযোগে ছাড়া আমি কিছুই বুঝতে রাজি নই।
‘মিতাদি কে?’
‘এই তো আমাদের পাশের বাড়ি থাকে। কাজলের জাঠতুতো দিদি। লিপস্টিক রুজ পাউডার মেখে বেরোয়। খুব ঝলমলে শাড়ি পরে..খুব গয়না…’
বাধা দিয়ে মাস্টারমশাই বললেন—‘কথাটা নিন্দার্থে ব্যবহার হয়।’
‘নিন্দেই তো করে সবাই মিতাদিকে। ময়দার বস্তা বলে, রং মাখা সং বলে।’
‘তা বলুক, বেশ্যা বলতে হলে মিতাদিকে আরও অনেক অনেক সাজ করতে হবে, সে কত সাজ তুমি ধারণাই করতে পারবে না। কথাটা বলো না। তা খুকু—কথাগুলো তুমি কোথায় কোথায় পাও? এগুলোও কি পাঁজিতে আছে?’
‘না তো সার, পুরনো প্রবাসী ঘেঁটে ঘেঁটে পড়ি তো!’
‘তা প্রবাসী ঘেঁটে কি এই সব শব্দ ছাড়া আর কিছু পাও না? অভিধান দেখা অভ্যেস করো, অভিধান দেখো।’
‘দেখি তো সার’—আমি বলি—‘পনস মানে কাঁটাল, প্রোষিতভর্তৃকা মানে যার স্বামী দূরে থাকেন, পটল মানে আলু-পটলের পটল নয়—অনেক, রোদসী মানে ছিঁচ কাঁদুনি নয়, পৃথিবী, রশনা মানে জিভ নয়, কোমরে পরার গয়না, এ সব তো আমি অভিধান দেখে দেখেই জেনেছি, কিন্তু এগুলো তো বুঝতে পারি না—বারবনিতা মানে দেওয়া আছে বেশ্যা, বেশ্যা মানে বারবনিতা, হস্তমৈথুন মানে হস্তদ্বারা মৈথুন, মৈথুন মানে মিথুনক্রিয়া, কী করে বুঝব?’
তা সে যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই আমার খুব কৌতূহল। মা বাবা দাদা দিদি মাস্টারমশাইদের জ্বালিয়েছি কম না। এখন প্রয়োগটা অনেক সংযত হয়ে গেছে, কিন্তু কৌতূহল? কাউকেও আমি ছেড়ে কথা কই না। নিজেকেও না।
সুমিতাদের ফোনটা ট্রাই করি। নাঃ এখনও ঠিক হয়নি। তখন অগত্যা আরও দুটো ফোন করতে হয়। একটা শিল্পীকে।
‘শিল্পী, আজ এগারোটার সময়ে তুলতুলকে নিয়ে চলে আয় আমার বাড়ি।’
‘আড্ডা বসবে?’
‘আজ্ঞে না, শান্ত খুব শিল্পীমাসি শিল্পীমাসি করছে।’
‘আর শান্তর বাবা?’
‘সে-ও করছে, “মনে মনে”—“মনে মনে”-টুকু আমি সুর করে বলি, “কাবুলিওয়ালা” ছবির মিনির ঢঙে।
‘যাঃ,’ শিল্পীর রি-অ্যাকশন।
‘যাঃ মানেই হ্যাঁঃ,’ আমি পরশুরাম কোট করি।
‘আমি থাকব না। কোস্ট ক্লিয়ার’—শিল্পীকে প্রলোভিত করি।
‘তুমি আবার শান্তিনিকেতনে যাবে?’ শিল্পী যেন মার-মার করে ওঠে। নিজের বেলা আঁটিসুঁটি পরের বেলা দাঁত কপাটি।
‘যাব, তবে শান্তিনিকেতন নয়, গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে, যাদবপুর ছাড়িয়ে’…
‘সুমিতাদির কলেজ?’
‘এই তো ঠিক ধরেছিস! মাথার গোবর একটুখানি রিপ্লেস্ড হয়েছে মনে হচ্ছে? বাই ঘি!’
শিল্পী এ সব বক্রোক্তি পাত্তা দিল না, বলল—‘সুমিতাদির ব্যাপারটা তা হলে ভাল এগিয়েছে বলো? আমরা ফ্রেঞ্চ পারফিউম পাচ্ছি?’
‘তুমি এসে শান্তকে আগলাও, তার হাত ভেঙেছে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার।’
‘বলো কী? কবে, আগে বলোনি তো!’
‘নিজের হ্যাঁপা আমি সাধারণত নিজেই সামলাই।’
‘যাচ্ছি। তবে তোমার হলেও-হতে-পারে বউমাকে নিচ্ছি না।’
‘কেন? বাল্যপ্রেমের ভয়ে?’
‘স্কুল থেকে ফিরবেই তো সাড়ে দশটা, তারপর অত ধকল সয়? ওকে বাবা-মার কাছে রেখে যাচ্ছি।’
শিল্পীর আসাটা নিশ্চিত করে, কাজলকে ডাকাডাকি করি।
কাজল তো এক পায়ে খাড়া।
সুতরাং এগারোটা নাগাদ আমরা সুমিতার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।
যাত্রাপথের কথা আর কী বলব? সহযাত্রিণী যেখানে কাজলরেখা মিত্তির সেখানে যাত্রা ঘটনাসঙ্কুল হবে বই কী!
এক মাড়বার গৃহিণীকে কনুইয়ের গোঁত্তা দিয়ে আর-এক পঞ্জাবিনীর পা মাড়িয়ে দিয়ে কন্ডাক্টরের ব্যাগের স্ট্র্যাপ ধরে কাজল বাসে উঠল। এক রোগা বাঙালিনীর প্রায় কোলে বসল, পাশে আর এক তামিলনীকে ঠেলে সরিয়ে এক চিলতে জায়গা করে একগাল হেসে বলল—আয় রঞ্জু, বোস, কুলিয়ে যাবে। বাঙালিনী ও তামিলনী নিজ নিজ ভাষায় প্রবল প্রতিবাদ করলে বলল—‘ইনি কে জানেন? ‘সিঁথির সিঁদুরে সিঁদ’ সিনেমার লেখিকা, ‘আয়নাতদন্ত’ বলে যে নতুন ছবিটা আসছে সেটাও এঁর লেখা।’ টেনে বসিয়ে দিল আমাকে কাজল। এক একবার ড্রাইভার ব্রেক কষছে আর দু’ দিকের চাপে আমি উঠে উঠে পড়ছি। শেষকালে অতিষ্ঠ হয়ে যেই বলেছি—‘আমি আর পারছি না উঠে দাঁড়াচ্ছি।’ তখন কাজল কী বলল জানেন?
‘ওঠ না ওঠ—সুড়সুড়ি টুসটুড়ি কি খোঁচা মোচা খেলে আমায় বলতে আসিস না। সার সার সব ঝুঁকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।’
এ কথায় বাসে তীব্র প্রতিবাদ হয়। প্রথমটা সকলেই হকচকিয়ে যায়। কিন্তু তারপর এক ভদ্রলোক মরিয়ার মতো বলে ফেলেন—‘ভদ্রলোককে যা-তা বলছেন, আপনার লজ্জা পাওয়া উচিত।’
‘কাকে বলেছি?’ কাজল সঙ্গে সঙ্গে রেডি।
‘আমাদের সব্বাইকে বলেছেন, সব্বাই শুনেছে।’
‘শুনেছে সবাই, কিন্তু বলছেন আপনি। ঠাকুরঘরে কে না আমি তো…’
‘বাজে কথা বলবেন না, কী দাদা, আপনারা শোনেননি?’
আর-এক জন বললেন—‘যেতে দিন দাদা যেতে দিন। মেয়েছেলের কথা গায়ে মাখলে চলে না।’
ভদ্রলোক বললেন—‘আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।’
‘আমার লজ্জা আমি বুঝব। কিন্তু আপনাদেরও লজ্জা হওয়া উচিত।’
‘আশ্চর্য, আমরা কেন লজ্জা পেতে যাব?’
‘পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছেন।’
‘আপনি ঠেস দিয়ে কথা বলেছেন, তাই প্রতিবাদ করেছি।’
‘তা যদি বলেন, তো হাটের মধ্যে হাঁড়ি ভাঙতে আমাদের বাধ্য করেছেন বলেই আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’
‘আশ্চর্য তো! কিছু করিনি অথচ লজ্জা পেতে হবে?’
‘জাতভাইদের জন্যে লজ্জা পেতে হবে বই কী!’
‘আশ্চর্য তো?’
‘বারবার আশ্চর্য হচ্ছেন কেন? বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন তারপর আশ্চর্য হবেন।’
‘আচ্ছা মেয়েছেলে যা হোক বাবা!’
‘মেয়েছেলে মেয়েছেলে’ করছেন কেন তখন থেকে? ভদ্রতাও কি আপনাদের বাসের ভেতর স্কুল বসিয়ে শেখাতে হবে?’
এক জন বলে উঠল—‘মহা মুশকিল, মেয়েছেলেকে মেয়েছেলে বলব না তো কি ব্যাটাছেলে বলব?’
এই কথায় বাসের মধ্যে একটা হাসির হররা উঠল। হররা একটু থামলে মাড়োয়ারিনী হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন—‘লেকেন উও যো বোলী সহি বাত বোলী, আপকো সব শরমিন্দা হোনা চাইয়ে। লাজ্জা করুন। তোখন থেকে আট্টা কি তরহ হমাকে ঠেসিয়ে যাচ্ছেন ঠেসিয়ে যাচ্ছেন।’
এক ছোকরা সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল—‘বাত তো সহি মৌসী, লেকেন উও সব ঝুলতী আট্টা আপকো থৈলা পে ঘুসা লিজিয়ে না।’
আবার হাসির হররা।
এই জায়গায় কাজলা ভদ্রমহিলার পক্ষ নেয়। উনি ওকে সমর্থন করেছেন, ও-ও সুতরাং ওঁকে মদত দেবে। খুব ভাল, প্রিন্সিপল হিসাবে, কিন্তু এর ফলে ধুন্ধুমার কাণ্ড হতে লাগল।
কাজল বলল—‘উনি ওঁর বাড়ির ভাত খেয়ে মোটা হয়েছেন তাতে আপনার কী?’
মারোয়াড়িনী—‘খুদ কো চাবল খায়া, ঔর কোই কো তো নহী। হাঁ-আ।
বাসের লোক—‘বাড়ির গাড়িটাও তো চড়লে পারেন, তিন জন লোকের জায়গা নিয়ে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
কাজল—‘উনি বাড়ির গাড়ি চড়বেন কি না উনি বুঝবেন। বাসটা তো পাবলিক বাস, কারও তো কেনা নয়।’
মারোয়াড়িনী—‘কোই তো খরিদ কিয়া নেই। হাঁ হাঁ।’
আমি—‘কাজল এবার ক্ষান্ত দে।’
ও পাশের রোগা বাঙালিনী এই সময়ে উৎসাহ পেয়ে বলে উঠলেন, ‘যা বলেছেন। ইনি তো এমন করে বসলেন যেন সিটটা এঁর কেনা। তখন থেকে সিঁটিয়ে বসে বসে আমার সটকা লেগে যাচ্ছে।’
কাজল হাঁ হাঁ করে উঠল—‘আপনি নারী হয়ে নারীর বিরুদ্ধে বলছেন? না হয় একটু বসেইছি। আচ্ছা বাবা, উঠে দাঁড়াচ্ছি। রঞ্জু তুই ভাল করে বস, আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি।’
সামনের লোকেরা বলল—‘ওরে ব্বাবা, আপনাকে উঠতে হবে না বউদি, আপনি বসেই যা শট দিচ্ছেন, দাঁড়ালে আর দেখতে হবে না।’
কিন্তু কে কার কথা শোনে। কাজলের অভিমান হয়েছে পাশের মহিলার ওপর। সে সব সইতে পারে, বিশ্বাসঘাতকতা সইতে পারে না। সে উঠে দাঁড়ায় এবং তার রেখে যাওয়া শূন্য স্থানটিতে মাড়োয়ারিনী নিজের বিশাল বপু নামিয়ে দ্যান। ‘শুক্রিয়া বহুজী, বহোত বহোত মেহেরবানি আপকী’—মারোয়াড়িনী বলেন এবং বাঙালিনী ফ্যাঁসফেঁসে গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন—‘উঃ বাবাগো!’
নিষ্পাপ চোখে তাঁর দিকে তাকায় কাজল—‘কী হল ভাই, আমি তো উঠলাম আপনার লাগল?’
ঠোঁটের কোণে পানের পিকের মতো চুটকিভরা হাসি লেগে রয়েছে কাজলের। ওদিকের সিট থেকে এক ছোকরা হাঁকে—‘আমি নামছি, বউদি আপনি এখানে বসুন, আর কষ্ট করবেন না।’
একটা হ্যান্ডেলের পর আর-এক হ্যান্ডেল হনুমতীর মতো অবলীলায় হাতাতে হাতাতে উলটো দিকের সিটে কাজল জমিয়ে বসে। ‘থ্যাং-কস ভাই।’ আমরা চিড়ে চ্যাপটা হতে থাকি। পরের স্টপেই বাঙালিনী হুড়মুড় করে নেমে যান। সামনের ঝুঁকে-পড়াদের মন্তব্য—‘নেপোয় মারে দই।’
‘নেপোই বটে’—আর এক জন বলে—‘একেবারে নেপোলিয়ন’। —‘হাঁ হাঁ নেপোলিয়ান’ মারোয়াড়িনী বলেন। বাসসুদ্ধ লোক হই হই করে হেসে ওঠে। ইনক্লুডিং কাজল। মারোয়াড়িনী নিজেকে বিস্তৃততর করবার আগেই আমি একটু আলগা হই।
কাজল ওদিক থেকে বলে—‘রঞ্জু গুছিয়ে বসেছিস তো? একটু অ্যাডজাস্ট করে নে।’
—‘আপনি যা ব্যবস্থা করলেন, বউদি দিদি তো গুছিয়ে বসবেনই!’—এক ছোকরা বলে। অ্যাডজাস্ট হবে বই কী! অ্যাডজাস্টের বাপ হবে!’
কাজলের গম্ভীর গলা শুনতে পাই—‘বেশি ফক্কুড়ি করবেন না।’
এই ভাবেই যখন সুমিতাদের কলেজে পৌঁছই তখন আমাদের দুই বন্ধুর মধ্যে বাক্যালাপ নেই। কাজল অবশ্য প্রচুর সাধাসাধি করছে।
‘এই রঞ্জু রাগ করছিস কেন?’
‘বাসের মধ্যে আমাকে নাম ধরে ধরে ডাকছিলে কেন? একটা প্রাইভেসি নেই?’ উত্তরে কাজলা বলল—‘যবে থেকে আমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে, তার পেছনে রোমিও লাগতে শুরু করেছে তবে থেকেই ভাই আমার ইনহিবিশন চলে গেছে। অত প্রাইভেসি-টেসি মনে থাকে না। আরে তোদের এক যুগ আগে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, মনে রাখিস আমি ভেতরে ভেতরে তোদের থেকে অনেক সিনিয়র, রাস্তার লোক বাসের লোক এদের আমার মনে হয় হাতে তেলোর মতো। কাউকে কমান্ড করতে ভয় পাই না বুঝলি?’
‘ঠিক আছে, তুমি কমান্ডান্ট থাকো। আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমাকে রেহাই দাও।’
আমরা দু’জনে ছাড়া ছাড়া ভাবে চলতে চলতে একটু আগে পিছে সুমিতাদের কলেজে ঢুকলাম।
কাজল গড়গড় করে এগিয়ে দিয়ে অফিসঘর পেরিয়ে, আরও কী কী সব পেরিয়ে, স্টাফরুমে ঢুকে পড়ল। আমি গতিটা একটু মন্থর করে দিই ইচ্ছে করে। কাজলের জোট বাঁধবার বাসনা আমার এই মুহূর্তে নেই।
শুনতে পাই বলছে—‘সুমিতা আজ এসেছে না ডুব মেরেছে?’
আমি তাড়াতাড়ি উঠে ওকে পার হয়ে যাই, খুব ভদ্র, মোলায়েম গলায় বলি—‘সাইকোলজির সুমিতা সরকার এসেছেন?’ —বলতে বলতে কাজলের দিকে আড়চোখে কটমট করে তাকাই।
জনা দশেক মহিলা ও মেয়ে ঘরটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন।
খুক খুক করে একটা হাসি চাপার আওয়াজ পেলাম।
এক মহিলা টেবিলের ওপর বিরাট একটা কাগজ ছড়িয়ে নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন, চশমার ওপর দিয়ে বাকি মহিলাদের ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, এই নিয়ে পাঁচ হল।
‘অ্যাঁ? পাঁচ পাঁচ জন সুমিতাকে খুঁজতে এসেছে!’ কাজল ঢুকতে ঢুকতে চেঁচায়। কোনও ইনহিবিশন নেই।
খুক খুক আওয়াজটা এবার ছড়িয়ে যায়।
একটি মেয়ে মুখ তুলে স্মিত মুখে বলে, ‘আপনারা বসুন। বর্ণাদি রুটিন করছেন। আমাকে ক্লাসের কথা বলছেন, আপনাদের নয়।’
‘সুমিতা ক্লাসে গেছে,’ আর এক জন বললেন।
আমি বসি কাজলের খুব কাছ ঘেঁষে, ফিসফিস করে বলি—‘সুমিতা এলেই যেন আবার বিকাশকান্তিবাবুর কদ্দূর টদ্দূর বলে বসো না। তোমার তো মেয়ে বড় হয়ে গেছে, ইনহিবিশন নেই।’
কাজল ফিসফিস করে বলে—‘তুই কথা না বললে এগজ্যাক্টলি এটাই বলব এঁচে রেখেছিলুম। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতেই হয়!’
এক জন আমার দিকে চেয়ে বলে উঠলেন—আচ্ছা আপনার মুখটা খুব চেনা-চেনা লাগছে। আপনার কি শান্তিনিকেতনে বাড়ি আছে? আপনাকে আর আপনার হাজব্যান্ডকে ক’দিনই যেন কোথায় বেড়াতে দেখলাম ওখানে!’
কাজল অমনি ঝামরে উঠল—‘কালো করে? মোটা করে তো? উনি আমার হাজব্যান্ড, ওঁর নয়।’
কেমন একটা অপ্রস্তুত নীরবতার মধ্যে আমরা বসে রইলাম। ঢং। ঘণ্টা পড়ল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো কুড়ি। এ আবার কোন দেশি ঘণ্টা বাবা, হয় দুটোর পড় নয়তো দুটো পনেরোয় পড় আর নয়তো একেবারে আড়াইটেয় পড়িস। তারও দশ মিনিট পরে সুমিতা ছাত্রীদের লেজ পেছনে নিয়ে ঢুকলেন। হাতমুখ নেড়ে কী সব বোঝাতে বোঝাতে ঢুকছে। এ সবই কায়দা ওর। লাস্ট মোমেন্টে হয়তো এমন কিছু বলেছে যাতে ছাত্রীদের মনে হয়েছে—ইস্স্, এটা না জানলেই নয়, পরীক্ষায় নির্ঘাৎ আসছে। আর তাই পেছন নিয়েছে। এ সব সুমিতা দারুণ বোঝে। সাইকোলজির লোক তো!
—‘আরে ব্যাপক ব্যাপার। তোরা?’ সুমিতা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল।
কাছে আসতে আমি বললাম—‘ব্যাপার ব্যাপক নয়, ব্যাপিকা। আমার পাশেই বসে রয়েছে। ভাল চাও তো বিদায় করো।’
‘—সে তো করবই, তার আগে শিঙাড়া-টিঙাড়া খা। কখন বেরিয়েছিস? চাও-মিন বলব? না শিঙাড়াতেই হবে? না কি এগ রোল?’
—‘কী ব্যাপার? কলেজের মধ্যে রেস্তোরাঁ খুলেছিস না কি?’
—‘আরে দূর। মেয়েরা আসতে চায় না, তাই প্রিন্সিপ্যাল নতুন চপ কাটলেটের ক্যানটিন খুলেছেন।’
ঘরের মধ্যে আবার খুকখুক।
—‘ভাল করে প্রাণ খুলেই হাসো না বাবা,’ সুমিতা কলীগদের দিকে ফিরে বলল।
—‘আমার ক্লাস শেষ। চল ক্যান্টিনেই যাই।’
—‘ক্যানটিনে তো আবার তোদের প্রিন্সিপ্যাল বসেন, ওখানে কথা বলা যাবে?’
এ বার স্টাফরুমের সবাই সত্যিই প্রাণ খুলে হাসতে লাগল। বর্ণাদির পর্যন্ত মনোযোগ আকৃষ্ট হল, তিনি স্মিত মুখে হাসিতে দুলতে লাগলেন।
সুমিতা বলল—‘এটা বীভৎস দিলি তো!’
কাজল কিন্তু হাসছেও না, কথাও বলছে না। ওর অত ফোলাফাঁপা উচ্ছ্বাস যেন হঠাৎ স্যাঁতায় রাখা মুড়ির মতো মিইয়ে গেছে। আমি পরামর্শ দিই, ক্লাস যখন হয়েই গেছে, তখন আর কলেজ-ক্যানটিনে গিয়ে কাজ নেই, বেরোই, অন্য কোনও জায়গায় বসলেই হবে। আসলে আমার ভয় করছে কাজল কখন না বার্স্ট করে। ওর তো আবার ইনহিবিশন নেই।
রাসবিহারীর একটি রেস্তোরাঁর দোতলায় আমরা অভীষ্ট নির্জনতা পেলাম। কাজল বার্স্ট করল—‘রঞ্জু তোকে বিশ্বাস করেছিলাম, তোকে বাইরের লোকেই আমার বরের সঙ্গে ঘুরতে দেখেছে। এবার কী বলবি বল!’
আমি বলি—‘সেটাই তো প্রমাণ।’
‘কীসের?’
‘আমার বিশ্বস্ততার। আবার কীসের? গোপনে গোপনে করিনি তো কিছু? সবার সামনে ঘুরেছি, সবার সামনে কথা বলেছি। তোদের রেস্তোরাঁর বিল দেওয়ার ছিল, ঘাড় ভেঙেছি তোর বরের, সিনেমা তো এখনও হয়ইনি। আমি হয়তো ফ্রেঞ্চ পারফিউম পাবই না। তা ছাড়া কাজলা তুই যদি তোর নিজের বরকে এত সন্দেহের চোখে দেখিস তো এ খেলায় আদৌ নামলি কেন?’ কাঁদো কাঁদো গলায় কাজলা বলল—‘দ্যাখ আমি কালো মেয়ে বলে আমার বিয়ে হচ্ছিল না, ঠাকুমা বলতেন কালো ঘর আলো, তা সে কথা তো সবাই বলবে না। বড়দের ডিসিশন হল অল্প বয়স থাকতে থাকতে বিয়ে দাও দাও, অল্প বয়সের একটা আলাদা শ্ৰী আছে। তা শুভদৃষ্টির সময়ে দেখে আশ্বস্ত হলুম ওর কাছে আমিও ফরসা। খুব গদগদও ছিল। সে গদগদভাব ভাই অনেক দিন কেটে গেছে। নিশ্চিন্ত ছিলাম গণ্ডারের মতো বর কেউ চাইবে না। গণ্ডার হোক ভুণ্ডিল হোক—লোকটা আমারই। তো এখন দেখছি—টেম্পারামেন্টের দিক দিয়ে রঞ্জুর সঙ্গেই ওর বেশি মিল। দু’জনেই সাহিত্য-টাহিত্য করে। রঞ্জু আমার মতো ওকে খেপিয়ে লাটও করে দেয় না। এখন মনটা যদি সত্যিই ফিরে যায়! আমার দাম্পত্য-জীবন চৌপাট। ছেলে এখনও চাকরি পায়নি, মেয়ের পড়া শেষ হয়নি…’
সুমিতা বলল, ‘সত্যি রঞ্জুদি, এত সিরিয়াস?’
‘ধ্যাত’—আমি উড়িয়ে দিই।
‘তা হলে তুই আজই চ—ও বাড়ি ফিরলে দু’জনকে দিয়ে কবুল করে নিই যে, তোদের দু’জনের মধ্যে কিছু নেই।’
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি—‘কাজলা এমন ভুল কদাপি করিস না, এ সব সাজেস্ট করতে নেই। করলেই মনের মধ্যে সেঁটে যায়। সুমিতাকে জিজ্ঞেস কর ও তো সাইকোলজির লোক।’
সুমিতা বোদ্ধার মতো ঘাড় নাড়ল।
‘তোর কদ্দূর?’
‘বহু দূর বহু দূর বাকি। এখন সাইকোঅ্যানালিসিস করব। শিগগির সিটিং। ভদ্রলোক ইন্টারেস্টিং। ফাইন্ডিংস তোদের পরে বলব। রেস্তোরাঁর বিল মানে গ্র্যান্ডের বিলটা যদি চাস, এখুনি দিয়ে দিতে পারি, জেরক্স করে রেখেছি, ওঁরটা ফিরিয়ে দিতে হয়েছে তো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে লাগে।’
‘তোর তা হলে পুরো সায়েন্টিফিক অ্যাপ্রোচ?’
‘একেবারে।’
‘আর তোর শুভম?’
‘ওটার কথা আর বলিসনি, টুপি নিয়েই জন্মেছে। মালবিকাদিকে তো বাড়িতে এনে তুলেছে!’
‘সে কী রে?’
‘আর বলিসনি। একদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখি মালবিকাদি আমাদের বেডরুমে জাঁকিয়ে বসে আছে আমার দুটো ছানা ওর কোলে-পিঠে শাশুড়ি ঠাকরুণ গান গাইছেন আর শুভম তবলায় ঠেকা দিচ্ছে পাজামা পাঞ্জাবি পরে। আমাকে দেখে শাশুড়ি ঘোমটা দিয়ে জিভ কাটলেন।’
‘এ কী সুমিতা তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরলে?
আমি বলি, ‘বেশ তো “আমিও একাকী তুমিও একাকী” হচ্ছিল, থামলেন কেন?’
‘তোর শাশুড়ি বুঝি গান গাইতে পারেন?’
‘রীতিমতো। এদিক ওদিক থেকে সুর ভেসে আসে শুনি, ছবি বাঁড়ুজ্জের মতো গলা। আমি এলেই চুপ, যেন আমিই ওঁর শাশুড়ি।’
‘ও তো আজকালকার দিনে তো রোল উলটেই দিয়েছিস তোরা।’
‘বাজে বকিসনি। তো শুভম কী বললে জানিস?’
‘কী?’
‘বললে, “তা হলেই বোঝো তুমি কতটা বেরসিক।” আমার ছানাদুটো হেসে উঠল। আমি বললুম—“তা এ মহিলাটি কে?” ছানারা সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল—“মালবিকাদি মালবিকাদি।”
‘—মালবিকাদি? মাসি বলতে পারো না? আমি বলেছি। ‘আয় আয়, রাগ করছিস কেন?’ উনি বললেন, ‘আমি ইউনিভার্সাল মালবিকাদি। তোরও, তোর বরেরও, তোর মেয়েদেরও, এমন কি মাসিমাও আমাকে মালবিকাদি বলছেন।’ শুভম বলল—‘আরে, তোমরা কি পরস্পরকে চেনো না কি?’
‘ইডিয়ট একটা,’ কাজলার বক্তব্য।
মালবিকাদি বলল—‘কফি হাউসে শুভমের সঙ্গে আলাপ, সে একেবারে জমজমাট বুঝলি সুমিতা। তখন তো বুঝতে পারিনি তোর বর, তাই প্রচুর ঘাড় ভেঙেছি। তা আজ এই বাড়িতে ধরে নিয়ে এল। মতিলাল নেহরু রোড, সাত নম্বর দেখেই তো বুঝেছি তোর বাড়ি। তারপর এই কুচিদুটোকে দেখে সন্দেহ একেবারে ঘুচে গেল। দুটো ছোট্ট ছোট্ট সুমিতা। তখন থেকে তোর জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছি। কিছু ভাঙিনি। শুভম নিরাশ গলায় বললে—পৃথিবীর সবার সঙ্গে কি তোমার চেনা? কোথায় ভাবলুম একটা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ দেব!’
‘প্লেজেন্ট কি আনপ্লেজেন্ট আবার দ্যাখ’—মালবিকাদি শাশুড়িকে পান দিল, শুভমকে পান দিল, নিজে পান মুখে পুরল। শাশুড়ি বললেন—খুব প্লেজেন্ট, খুব প্লেজেন্ট, বলে “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে” ধরে ফেললেন, মেয়ে দুটোর এ নাচটা জবর তোলা ছিল, ওরা অমনি তাধিন তাধিন আরম্ভ করে দিল, শুভমের সে কী তবলাবাদন, কাঁধদুটো উঠছে নামছে-উঠছে নামছে। ফলে আমাকেও দু-চারটে ফিগার দিতে হল, মালবিকাদি দেখি পায়ে তাল দিচ্ছে, শেষ হলে বলল—কেয়াবাত, কেয়াবাত, আমি বললুম এটা কত্থক নয়, কেয়াবাত বলে না। এটা ওড়িশি। তখন কী বলল জানিস?’
‘কী?’
‘উত্তম-অ হউচি।’
ব্যস। এই কথায় ফট করে আমার স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বললুম, ‘এই সুমিতা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি তার কিনারা করে দে তো।’
‘ওঃ, তুই আবার স্বপ্নের পুঁটলি খুলবি?
‘কেন, তোর বোর লাগে?’
‘না, তা নয়। কদিন অ্যানালিসিসটা একটু অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে তো?’
‘সেটা করছিস নিজের ঢাকাই শাড়ির স্বার্থে। আর এটা একটা বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক ব্যাপার।’
‘তো বল।’
বললাম।
চকচকে চোখে ‘সাইকোলজির লোক’ বললেন—‘একটু ভাবি, পরে বলব। একটা দিন অন্তত সময় দে।’
ফেরবার সময়ে কাজলের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও আমরা একটা ট্যাকসি নিই। কাজলাকে নিয়ে বাসে ওঠার ঝুঁকি আর নিচ্ছি না। সুমিতা অভিভাবকের মতো বলল—‘দিদিদের ভাল করে পৌঁছে দেবেন সদারজি।”
‘জরুর জরুর।’
‘টাইম কেতনা লাগে গা!’
‘এক ঘণ্টা, ঔর কেতনা!’
ট্যাকসিতেও কাজল ঝঞ্ঝাট বাঁধাল।
ট্যাসসি ড্রাইভারের নাম জিজ্ঞেস করল—নাম ভগৎ সিং। তখন কাজল জানতে চাইল বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর ইনি কেউ হন কি না, নাতি কি, পুতি কি কিছু। সর্দারজি বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের নাম শোনেননি। তখন কাজল একদিক থেকে বলদেও সিং, জৈল সিং, বুটা সিং, মিলখা সিং, বিষেণ সিং বেদী, নভজোত সিং সিধু হয়ে রিল্যাক সিং-এ এসে থামল। এঁদের সকলকেই সর্দারজি চেনেন খবরের কাগজের পাতায় যেমন আমরাও চিনি। খালি রিল্যাক সিংকে সর্দারজি কিছুতেই চিনতে পারলেন না। এক হাত স্টিয়ারিংয়ে এক হাত নুন মরিচ দাড়িতে—‘রিল্যাক সিং? ইয়ে শুভনাম তো ম্যায়নে কভ্ভি শুনা নহী থা।’ সর্দারজি—ঘাড় নাড়তে থাকেন। তখন কাজল সেই বহুশ্রুত গল্পটি সর্দারজিকে বলে—‘জানেন তো সর্দারজি, মিলখা সিং এক বার দৌড়ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন, এক জন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন—আ ইউ রিল্যাক সিং? তাতে মিলখা সিং জবাব দিলেন—নো আ অ্যাম মিলখা সিং।’ সর্দারজি গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে বললেন—তো উনহোনে তো ঠিকই কিয়া বহেনজি! উও তো মিলখা সিং-ই থা, রিল্যাক সিংজি কোই দুসরা খিলাড়ি হোগা, ঠিক ইয়া নহী?’
কাজল বলল—‘হাঁ হাঁ ঠিক ঠিক। বিলকুল ঠিক বাত।’ আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। এ বার ও বলদেও সিং-এর সেই বিখ্যাত গল্পগুলো ঝুলি থেকে ঝাড়বে না কি? ইনহিবিশন তো নেই-ই ওর দেখা যাচ্ছে কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। কিন্তু না, কাজল এ বার ইনিয়ে বিনিয়ে যশজিৎ সিং-এর কথা জিজ্ঞেস করে।
‘ভবানীপুরমে উসকো রোটি তরকাকা দুকান হ্যাঁয়। পহচানতা হ্যাঁয় আপ?’
‘জরুর জরুর। দুকান তো উসকো পিতাজিকা হ্যায়। বহোৎ বড়া ধাবা বহেনজি।’ এ বার কাজল সোৎসাহে বলল ‘উসকো এক বংগালি গার্ল ফ্রেন্ড হ্যায়, রাংতা। পহেচানতা আপ?’ বাস বোম ফেটে গেল গাড়ির ভেতর।
‘মনজিৎ সিংজিকা আওলাদ যশজিৎ লড়কি ঘুমাতা? আপ নে খুদকো আঁখ সে দেখা?’
কাজল চুপ। সর্দারজি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন।
আস্তে আস্তে। আমি অনেকবার বললাম। কোনও কাজ হল না। রিয়ারভিউ আয়নার মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু ঝলসে উঠছে, দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখ, ফুলে-ওঠা কাঁচাপাকা দাড়ি, টেপা ঠোঁট।
প্রাণ হাতে করে বাড়ি ফিরে এলাম পাক্কা পঁচিশ মিনিটের মধ্যে। গড়িয়াহাট টু যাদু ঘোষের লেন। দু’জনে একসঙ্গে উঠেছি, একসঙ্গে নামব। মরতে হলে দু’জনে একসঙ্গে মরব। আমার বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে সর্দারজিকে দশটা টাকা বেশি দিলাম। গম্ভীর মুখে দশ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলেন সর্দারজি।
আমি বললাম—‘কাজল, একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যা।’
‘এক কাপ চা খেতাম।’ কাজল বলল। ‘বাড়িতে চা নেই।’ আমার মুখ দেখে কাজল আর কিছু বলবার সাহস পেল না। নিতাই রিকশাওয়ালা আমাদের খুব চেনা, তাকে ডেকে কাজলকে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ি ঢুকে গেলাম।
ভয়ে আর রাগে ভুলেই গিয়েছিলাম বাড়িতে শিল্পীকে বসিয়ে গেছি।
ভুরভুর করে খুব সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে রান্নার। অচেনা-অচেনা বিদেশি-বিদেশি গন্ধ। শিল্পী আমার একটা হাউজকোট পরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
‘তুমি এর মধ্যে?’
‘অসুবিধা হল?’ আমি গম্ভীর।
‘বা রে নিরুপমদা তো এখনও আসেইনি। কত কষ্ট করে তাই রান্না করছি।’
‘আমি থাকলে কি খাওয়াটাও নিরাপদে হবে না, আমি কি বেরিয়ে যাব?’
‘বাব্বা ফায়ার ব্রিগেড হয়ে আছ যে! হলটা কী?’
‘প্রাণটা আজকে যেতে বসেছিল, মান তো গেছেই, তোমাদের কাজলদিকে নিয়ে আমি আর কখনও বেরোচ্ছি না।’
‘সে তো আমরা অনেক দিনই জানি। গঙ্গা জামাইবাবুর একটা গাড়ি কেনা উচিত। ট্রামে-বাসে ট্রাভল করার পক্ষে কাজলদি নিরাপদ নয়। আমাকে নিলেই পারতে।’
‘এটা তো আগেও সাজেস্ট করতে পারতে। তখন তো আমি থাকব না, আমার অনুপস্থিতিতে এ বাড়ি আসতে পাবে শুনেই নেচে উঠলে।’
যাও যাও বিশ্রাম করো গে যাও,’ শিল্পী বলল, ‘মেজাজ ঠাণ্ডা হলে নেমো। আমি বাবা রান্নাটা শেষ করি গে।’
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটার সময়ে সুমিতা ফোন করল।
‘কি রে রঞ্জুদি, পৌঁছেছিস?’
‘আমার চোদ্দো পুরুষের ভাগ্য ভাই যে নিজসদনে পৌঁছেছি। যমসদনেই যাবার কথা ছিল।’
‘সে কী? অ্যাকসিডেন্ট?’
‘নাঃ, তার চেয়েও খারাপ। কাজল!’
‘কাজল? কা-জল? ওঃ কাজল! আবার গণ্ডগোল করেছে?’
‘আবার?’ ‘যাক বেঁচে আছিস তা হলে। তোর স্বপ্নটার অ্যানালিসিস দেবার জন্যে ফোন করলুম। চেম্বার থেকে করছি।’
‘এর মধ্যে হয়ে গেল? বললি যে দু একদিন সময় দিতে?’
‘আরে তক্ষুণি হয়ে গেছিল। কাজলদির সামনে বলতে চাইনি।’
‘কেন?’
‘আরে এমনিতেই যা শেকি হয়ে আছে।’
‘ওর সঙ্গে আমার স্বপ্নের কী সম্পর্ক?’
‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভাই। উত্তমকুমারটা উত্তমকুমার নয়।’
‘উত্তমকুমার উত্তমকুমার নয়? এ কি হেঁয়ালি না ধাঁধা?’
‘আরে বাবা ওটা গঙ্গাপ্রসাদ মিত্তির।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘শোন, সম্প্রতি তুই কোনও পুং দ্বারা আলোড়িত প্রভাবিত হয়েছিস। এখন তার সঙ্গে তুই কথা বলতে চাস, সম্পর্ক পাতাতে চাস, কিন্তু তোর বিবেক, আমাদের ভাষায় তোর সুপারইগো তোকে ধমকাচ্ছে, তাই তুই মানে তোর অবচেতন একটা প্রতীক বেছে নিয়েছে, একটা কমন সিম্বল। উত্তমকুমার সেই সিম্বল।’
‘মানে বলছিস গঙ্গাপ্রসাদে উত্তমকুমারে অভেদ।’
‘এগজ্যাক্টলি।’
‘গঙ্গাদা এই অভেদে খুশি হলেও হতে পারেন। কিন্তু উত্তমকুমার বড্ড রাগ করবেন।’
‘আরে তিনি তো আর রাগ-ঝাল করবার জন্য বেঁচে নেই!’
‘তা তোর এই বিশ্লেষণ কি অভ্রান্ত?’
‘মোস্ট প্ৰব্যাবলি। মন খারাপ করিসনি রঞ্জুদি, মনের অগোচরে তো পাপ নেই।’
কিন্তু আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আসল কথা মনের গোচর থাকলেই আমি স্বস্তি পেতাম। মনের অগোচর মানেই তো, আরও গভীরে। মনের গোচরে, মানে সজ্ঞানে তো আমি গঙ্গাপ্রসাদকে পছন্দ করছিই। তাঁর অত সুন্দর কণ্ঠস্বর, অত ভাল আবৃত্তি করেন, জীবনানন্দ আমারও প্যাশন, সেই জীবনানন্দ উনি অমন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছেনে ছেনে ব্যাখ্যা করেন। তারপর আমার নাম নিয়ে উনি অমন সুন্দর রোম্যান্টিক কবিতা পড়েন। খুবই বোদ্ধা এবং রসিক মানুষ। পছন্দ করেছি বলেই ওঁকে আমি গঙ্গাদা বলে ডেকেছি। কাজল ওঁকে গণ্ডার বললেও আমি তাঁকে আরও শিল্পিত করেছি, ওঁর মধ্যে এক শান্ত স্বভাব অথচ গতিময় বাইসনকে দেখেছি, গুহাচিত্রের মতো ঠিক। উনি এমনিই আসুন না, গল্প করুন না, সাহিত্য নিয়ে যেই কথাবার্তা শুরু হবে কাজল তো দু-একটা টিপ্পনী কেটে শেফালির সঙ্গে আড্ডা দিতে উঠে যাবেই। নিরুপম যখন দেখবে দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে গঙ্গাপ্রসাদ ওয়াকিবহাল নয়, তখন মুখে এক গোপন পাতি বুর্জোয়াপ্রাণিত গেরেম্ভারি শ্লেষের হাসি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় মনোনিবেশ করবেই। সে সময়ে গঙ্গাপ্রসাদ ‘মাল্যবান’ প্রসঙ্গে আসুন না, রবীন্দ্রনাথের ছবি আর জীবনানন্দের উপন্যাস যে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানে একই, সেই তুলনা করুন না, আমি শুনি, আমার অল্পস্বল্প যা বিদ্যে বা বোধ আছে তাকে কাজ করতে দিই। এই সব। এই সব আমি চিনি। কিন্তু মনের অগোচরে মহানায়কের ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে বসে থাকা গঙ্গাপ্রসাদকে তো আমি চিনি না! চাই না!