মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 10
তা যদি বলো, কাজলের সঙ্গে তার ভূতপূর্ব সহপাঠী চন্দন বরাটের দেখা হয়ে যাওয়াটা একদম কাকতালীয়। ‘জীবনদীপ’ থেকে বেরিয়ে তার নেভি ব্লু এসটীম নিয়ে দক্ষিণের দিকে বাঁক নিয়েছে চন্দন— এমব্যাসি হোটেলের সামনে দেখে ট্যাকসি ট্যাকসি করে আলুথালু হয়ে চেঁচাচ্ছে, এক খুনখারাপি লাল মহিলা, ব্যাকগ্রাউন্ড কালো। কেমন চেনা-চেনা। কাজলরেখা না?
হুশ করে গাড়ি থামিয়ে চন্দন মুখ বাড়ায়, ‘কাজলীদিদি না? কোথায় যাচ্ছিলেন, মানে যেতে চাইছিলেন?’
‘দক্ষিণাপণ।’
‘আরে আমি তো ওদিকেই যাব। উঠে আসুন, উঠে আয়।’
উঠতে-উঠতে কাজল বলে— ‘এ যে দেখি কনেচন্নন? তা উঠে আসুন উঠে আয়টা, কী ব্যাপার?’
‘যেটা অ্যাকসেপ্টেড হয়, তোমাকে চয়েস দিলুম ভাই। এক সময়ে কলেজ সুদ্ধু ছ্যামড়া তোমার পেছনে লাগতুম, সেই দুঃখে তুমি নাকি আট দশ বছরের বড় এক মাস্টারমশাইয়ের গলায় মালা দিলে, কী তোমার অবস্থা, তুই-ফুই আর চলবে কি না— বোঝা তো যাচ্ছে না। আফট্রল গঙ্গাপ্রসাদ মাস্টারমশাইয়ের গঙ্গাপ্রসাদনী তো তুমি। গুরুপত্নীকে তুই বলা… ওহ্ কত দিন পর দেখা কাজল—!’ চন্দন আন্তরিকভাবে খুশি হয়ে বলে, ‘চল তোর দক্ষিণাপণ একটু পরে যাবি— আজ একটু চা খাওয়া যাক।’
মেঘ না চাইতেই জল! কাজলের মনটা ফুর্তিতে ডগোমগো। অন্যরা এখন স্ট্রাটেজি খুঁজছে—আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে বলে গলা ফাটিয়ে ফেলছে, আর তার কেস? জলবৎ তরলং। খুনখারাপি লালের ওপর মেডন হেয়ার ফার্নের মতো সরু সরু কালো কালো চেকের শাড়িটা সে ইচ্ছে করে পরেছিল, যাতে তার রঙের সঙ্গে কনট্রাস্টটা ভাল খোলে। কপালে একটা টিকার মতো টিপ। চুলগুলোকে সে গোছা করে একটা ক্লিপ দিয়ে নিয়েছিল, যাতে আলুথালু দেখায়। দেখলেই চোখে পড়ে। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ তার এক্কেবারে সঠিক।
‘তা হলে পার্ক স্ট্রিটে চল।’ যেতে যেতে কাজল বলে ‘তোর বউকে তুলে নিবি নাকি?’
‘তা হলে তো যোধপুর পার্ক অব্দি যেতে হয়। তা ছাড়া দুই পুরনো বন্ধুর দেখা— এর মধ্যে আবার বউ-ফউ কী? তা হলে তোর মাস্টারমশাইকেও নিয়ে যেতে হয়, আড্ডার দফারফা!’
ভাল করে গুছিয়ে বসে কাজল বলে, ‘ইস্স্ কী ভাল যে লাগছে। সেই কফি হাউসের দিনগুলো যেন ফিরে এল।’
‘ফিরিবে না ফিরিবে না, অস্ত গেছে সে গৌরব-শশী’— ছদ্ম বিষাদের সুর লাগে চন্দনের গলায়।
‘ফিরিবে না কেন? শশী এখন তোর উদরে বিরাজ করছে।’
‘খুব মোটা হয়ে গেছি, না? এ হে হে হে’—চন্দন তার ভুঁড়ি থাবড়ায়। ‘আর বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়স হল…’
কাজল বলে, এমন করে বলছিস যেন বির-আশি। এই তো সবে কলির সন্ধে তোদের। তোকে হঠাৎ দেখলে চিনতে পারতুম না। এই যা। সেই ন্যাংলা প্যাংলা কনেচন্দন যার বুশ শার্ট দুলতে আরম্ভ করলে কোথাও থামত না, সে এই রকম আগরওয়ালমার্কা হয়ে দাঁড়াবে এ কি ভাবা যায়? হ্যাঁরে নাকু কোথায়?’
‘নাকু? নাকু কে?’
‘মনে নেই টি. এস.-এর কাছে গিয়ে এক হল ছেলেমেয়ের সামনে জয়ন্তী জিজ্ঞেস করেছিল— ‘স্যার নাকু কত পেয়েছে? তোরাও তো ছিলি?’
‘ওহো সেই সর্বেশ? টেনিদার মতো নাক যার? তাকে তোরা নাকু বলতিস বুঝি?’
‘তবে? তোরা একাই নাম দিবি? আমার স্টকে অনেক আছে। নাকুর খবর বল।’
‘নাকু বোধ হয় ফুড কর্পোরেশনে আছে। আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। তা নাকুর খবরে তোর এত কী ইন্টারেস্ট কাজলা? ছিল নাকি কিছু?’
কাজল হাসি থামাতে পারে না।
‘নাকুর সঙ্গে আমার? ও তো জয়ন্তীকে প্রোপোজ করেছিল, সেই জন্যেই তো জয়ন্তী ওর ইকনমিক্সের মার্কস জিজ্ঞেস করে।’
‘জয়ন্তীকে সর্বেশ? ওহ্ গড। সর্বেশকে তো জয়ন্তী পিং পং বলের মতো লোফালুফি করতে পারে। ওকে তো আমরা জয়ন্ত বলতুম। কী লম্বা লম্বা পা ফেলে চলত বলত!’
‘অ্যাথলীট মেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলবে না তো কি তোর মতো খুরখুর করে হাঁটবে!’
‘আরে শিল্পী যে তোর মামার বাড়ির পাড়ার মেয়ে, তোদের অত ভাব তা তো জানতুম না। বিয়ের দিনে তোকে দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।’
‘কেন, ঘাবড়ালি কেন?’
‘আরে কত কীর্তি করেছি, বলে দিলে তো সারা জীবন বউয়ের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।’
চা খাওয়াটা হাই-টি গোছের হয়ে গেল। পে করে দেবার পর কাজল বলল— ‘বিলটা আমায় দিস তো!’
‘কেন? শোধ করবি নাকি?’
‘অত টক খায় না।’ কাজল বলল, ‘এক দিন ভারী খাইয়েছিস তার আবার শোধ। বেশ ভাল করে আর এক দিন খাওয়া তো। সিনেমা দেখা একটা।’
‘আজকাল আর সিনেমা কেউ দেখে?’
‘তবে “কথা অমৃত সমান”টা দেখা।’
‘ঠিক আছে, টিকিট কেটে বলব।’
‘বউ নয় কিন্তু। তুই আর আমি।’
নাটক দেখার ধৈর্য তোর শিল্পীর নেই।’
শিল্পী কদিন পর দুপুরবেলা ফোন করে বলল, ‘কাজলদি তৈরি থেকো, আজ টিকটিকি।’
‘মানে?’
‘সৌমিত্রর “টিকটিকি” গো, তোমার বন্ধু টিকিট কেটেছে। তোমাকে তুলে নেবে। আমায় জানিয়ে দিতে বলল।’
‘চালাক তো কম না?’ — কাজল বলল।
‘শুধু চালাক? রাম চালাক। ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দাও।’
তখন থেকেই কাজল কনেচন্ননকে ঘোল খাওয়াচ্ছে। হাওড়া স্টেশনে বন্ধুকে আর মেয়েকে আনতে হবে— চন্দন। ভাল ‘ছাতু’ মানে মাশরুম মাণিকতলার বাজারে পাওয়া যায়, কই মাছের সঙ্গে দারুণ জমে, কাজল কিনে রেখেছে, চন্দন অফিস থেকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে যাক। নিউ মার্কেট থেকে বাছা বাছা অ্যালফানসো দসেরী আর চৌসা কাজলের জন্মদিনে চন্দন নিয়ে আসে। কাজল তাকে রাত দশটা পর্যন্ত আটকে রেখে দেয়। তীর্ণা অনীক কাজল চন্দন মিলে কাজলের জন্মদিনের রান্না হয়। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঢুলতে ঢুলতে চন্দন বাড়ি ফেরে।
দক্ষিণাপণে বাজার করতে যাবে কাজল, চন্দন ছাড়া কে নিয়ে যাবে কাজলাকে? কত পেছনে লেগেছিস এক দিন চন্নন, সে কথা মনে করেও একটু প্রায়শ্চিত্ত কর। কাজলের একটা বালুচরি পছন্দ হয়, ঘিয়ে রং-এর ওপর আইসক্রিম পিংক হরিণের নকশা। কাজলের অত ট্যাঁকের জোর নেই বাবা। নিজের জন্য অত খরচ করা কাজল ভাবতেই পারে না। সে এসেছিল মেয়ের জন্য গুর্জরী ঘাঘরা কিনতে। তাতে কী আছে? চন্দন তার কলেজি-বন্ধু জন্মের মধ্যে কম্ম একটা বালুচরি কাজলাকে কিনে দিতে পারে না?
শাড়ির প্যাকেট হাতে— কাজলের দিকে তাকিয়ে চন্দন বলে—‘তোকে যা মানাবে না কাজলা? কলেজ ডেজ-এ ছিলি ফিঙে পাখির মতো। এখন তোর চেহারায় একটা ময়ূর ময়ুর জেল্লা এসেছে। তখন যদি জানতাম, এ রকম নীলময়ুরী দাঁড়াবি…’
‘কী করতিস তালে?’ ঝকঝকে হেসে কাজল জিজ্ঞেস করে।
‘কথাটা কী জানিস,’ চন্দন প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘খুনসুটির পেছনের সাইকলজি হল, মনোযোগ অ্যাট্রাক্ট করা। এখন বুঝি, ওগুলো ছিল ময়ূরের নাচ, বুঝলি তো? যৌবন জলতরঙ্গ…।’
‘আমিও কি জানতুম, এই ন্যাংলা প্যাংলা পটলডাঙার প্যালারাম এক জন বিশ হাজারি দাঁড়াবে?’
‘জানলে কী করতিস?’ চন্দন জিজ্ঞেস করে।
‘কী আর করতুম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ময়ূরের ন্যাজ-নাড়া দেখতুম।’
‘তুই শুধু টাকাটাই দেখলি কাজলা, মেয়েরা বড্ড অর্থপিশাচ! বউকেও দেখেছি, টাকা ছাড়া একটা পা চলে না। তুইও?’
‘তুই দুঃখু পেলি?’ কাজল চুক চুক করে তার দরদ জানায়, তারপরে বলে ‘শুধু বিশ হাজার কেন, এই যে এ রকম শশীকাপুরের ডুপ্লিকেট দাঁড়াবি তা-ও তো জানতুম না। শিল্পীর বিয়েতে গিয়ে তোকে দেখে তো আমি প্রায় মুচ্ছো যাই।’
‘বলছিস! বলছিস!’
‘তবে?’
‘এই শাড়িটা পরলেই তোর আমার কথা মনে পড়বে। এটাই লাভ।’ উদাস গলায় চন্দন বলে।
কাজলও কম যায় না বলে, ‘উপহার শুধু নিতে নেই, দিতেও হয় তা জানিস? তবে আমার তো তোর মতো টাকা নেই, দিল কিন্তু আছে। তুই তো স্যুট পরিস?’
‘হ্যাঁ শীতকালে তো পরিই।’
‘তোকে একটা পছন্দসই টাই কিনে দিই।’
‘দে।’ কাজলা উপহার দেবে, চন্দন উদার।
কাজল একটা চমৎকার টাই কেনে, তারপর একটা হ্যাট কেনে। ‘ধুর, হ্যাট কিনছিস কেন?’
‘চমৎকার হ্যাটটা, বিদেশে যখন যাবি, পরবি। তুই তো প্রায়ই যাস। কমপ্লিট স্যুট হয়ে গেল।’
ভোরবেলায় শিল্পী ফোন করল, ‘কাজলদি, বরকে ঘোল খাওয়াতে বলেছিলুম। তুমি একেবারে টুপি পরিয়ে দিলে?’
দুই বন্ধু হু হু করে হাসতে লাগল। শিল্পী বলল— ‘ও এখনও বোঝেনি জানো? এসে বলে ‘কাজলীকে একটা বালুচরি কিনে দিলুম— মনে রাখবে চন্দন বলে একটা বন্ধু ছিল, তোমার হিংসে হচ্ছে না তো?’
‘তুই কী বললি?’
আমি বললুম, ‘হিংসে? সেটা কী জিনিস গো? তখন আমাকে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে বললে— এই না হলে চন্নন বরাটের বউ? তা কাজলাও উপহার দিয়েছে, বলে খুলে দ্যাখাল। আমার তো পেট গুলিয়ে হাসি পাচ্ছে, হঠাৎ ভীষণ পেটব্যথা করছে বলে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজেছি। কী হল? কী হল? বলে প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি!’
‘তারপর?’
‘তারপর ডাক্তারকে ফোন করতে যায়! ডাক্তার অ্যান্টাসিড খেতে বলেন।’
‘খেলি?’
‘পা-গল। বললুম বাবাকে বলো, বাবা ভাল হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেন। বাবার কাছে দৌড়ল নীচে।’
‘ওষুধ আনল।’
‘আনল না আবার? গরম জলে ম্যাগ ফস।’
‘খেলি?’
‘তারিয়ে তারিয়ে খেলুম। ব্যথা ভ্যানিশ। বাবার গুণগান। হ্যানিম্যান সাহেবকে থ্যাংকস।’
‘তারপর?’
‘তার আর পর নেই কাজলদি?’ এই উত্তরটার জন্যেই শিল্পীকে আমরা ‘যার পর নাই বলি।
‘তারপর?
‘উফ, সমস্ত প্রাইভেট কথা তোমাকে জানতে হবে?’ বলে শিল্পী দুম করে ফোন রেখে দিল।