মেঘে ঢাকা তারা : 05
গুপির নিপুণ ডিরেকশানে এবং দলবলের সহযোগিতায় খাওয়াদাওয়া অতিথিসৎকার আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হয় না। নীতাও তদারক করছে। ভাঁড়ারীর কাছে জিনিসের হিসাব করে এগিয়ে দেয়। গুপির হাঁকডাক শোনা যায়, মাধববাবুকে দেখে সিগারেট একটু লুকিয়ে বলে ওঠে—আপনি শুধু দেখে যান স্যার, কোনও শম্মাকে টুটি করতে হবে না। নবোদয় সঙ্ঘের মেম্বাররা থাকতে তিলমাত্র অসুবিধা হতে দেব না কারোও।
চিৎকার করে ওঠে পরক্ষণেই—অ্যাই মদন, ফার্স্ট ব্যাচ হয়ে গেল সেকেন্ড ব্যাচে মেয়েদের বসিয়ে দে! যে যে স্টেশনে যাবে তাদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে বল হেরম্বরকে। ন-টা বাহান্নতে ট্রেন। কুইক মার্চ।
ক্রমশ ভিড় হইচই কমে আসে। রাত্রি নামছে কলোনির মাঠে, গাছ-গাছালির মাথায়, ফাঁকা প্রান্তরে।
কেমন কুয়াশা জড়ানো আবছা ওই অন্ধকার।
একজনকে খুঁজছে সনৎ অনেক আগে থেকেই। এত ভিড়ে দু’চোখের চাহনি মেলেও তাকে দেখতে পায় না। একনজর দেখেছিল তাকে, বিয়ের সময় টোপরের ফাঁক দিয়ে একবার দেখেছিল তাকে। মেয়েদের সঙ্গে বেশ জোর করে উলু দেয় নীতাও। পরনে সেই আধময়লা একখানা শাড়ি, ক্লান্ত খোঁপাটা ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের উপর, শ্রান্ত ঘামঝরা চেহারা। তবু চোখের তারায় হাসির ছন্দ ওঠে। ফেটে পড়েছে আনন্দে।
সনৎ সেদিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু যে নীতাকে এতদিন দেখেছিল কত সন্ধ্যা সকালের আঁধার-আলোয়, সুখদুঃখের স্মৃতিস্বপ্নে এ সেই কর্মঠ মেয়েটি নয়। সেই দৃষ্টিতে আর প্রীতি সমবেদনার বিন্দুমাত্র ছায়া নেই। অপরিচিত একটি মেয়ে—সনৎকে সেও বোধ হয় আর চেনে না।
এই গীতাকেও সনৎ দেখে অবাক হয়ে যায়। মেয়েরা এমনিই হয় বোধহয়। পুরুষের চোখে ফুটে ওঠে তার মনের আলোর প্রতিবিম্ব। চঞ্চল মেয়েটি আজ গম্ভীর হয়ে গেছে। ফুটে উঠেছে রূপ আর রূপের পসরা। বেনারসী শাড়ি, হাতে কঙ্কণ, চুড়ি, গলায় নতুন গড়ানো হারটা, পাওয়ার আনন্দে গীতা যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে বিস্মিত দৃষ্টিতে।
বাসরঘরে জমেছে, আত্মীয়দের ভিড়। নীতা হাতমুখ ধুয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে সেখানে হাজির হয়। বলে ওঠে—কই রে, গানটান হোক, অ্যাই বাসন্তী? সব চুপ-চাপ যে!
বাসন্তী পাড়াগায়ের মেয়ে ছিল, উৎখাতের পর তার বাবা-মা বাধ্য হয়ে শহরতলির দিকে এসে ঘর বেঁধেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এখনও শহরে হয়ে ওঠে নি। বাসন্তী জবাব দেয়—জানি না। শিখতাছি।
—ধুৎ! গান না হলে বাসরঘর মানায়! কি বলো গো?
—তা ঠিক কথা।
ওরা নীতার অতর্কিত আবির্ভাবে, এই হইচই-এ একটু অবাক হয়ে গেছে। নীতা তার মনের সমস্ত দুর্বলতা সুরের ঝড়ে উড়িয়ে দিতে চায়।
হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে বেলো করতে থাকে। কি ভেবে গীতাকেই বলে ওঠে—কই রে গীতা, তুই না হয় একখানা গা। তাতে দোষ নেই। আজকাল কনেরাও গান গায় বাসরে।
গীতা ওর কথায় জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে তার দিকে। নীতা যেন আমূল বদলে গেছে। গান প্রায়ই গাইত না। আজ গান গাইছে সে—আর যে গীতার ঠোঁটের গানের কলি ফুটে উঠত সেই গীতা যেন গান ভুলে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে নীরবে।
নীতা গান গাইছে—শঙ্করের কাছে শোনা গানটা :
যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে,
জানি নাইকো তুমি এলে আমার ঘরে।
সব যে হয়ে কালো
নিভে গেল দীপের আলো
আকাশপানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে।
নীতার সারা মনে কোন্ দুরাগত ঝড়ের সংক্রমণ…হঠাৎ চমকে ওঠে—সেই সন্ধ্যার মত দুর থেকে মনের গাছগাছালি কাঁপিয়ে যেন উদার একটা চাঞ্চল্যের সুর জেগেছে—এগিয়ে আসছে সুরটা ঝড়ো হাওয়ায় ভর করে—কার উদ্দেশ্যে। আকাশে আকাশে তারই অন্বেষণ।
থেমে গেল নীতা। নিজের অবচেতন মনের অতল জেগে ওঠা ঝড় তখনও স্তব্ধ হয় নি। প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ হবার চেষ্টা করে। উঠে পড়ল নীতা, এখান থেকে বের হয়ে সে মুক্ত আকাশের নীচে যেতে পারলে যেন সুখী হবে, শান্তি পাবে সে।
ওরা বিয়ের পরই কোন্ দূরে চলে যাচ্ছে বেড়াতে। সনৎ কথাটা শোনায়—শিলং বা অন্য কোথাও যাব ভাবছি। একমাস ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়ব।
—গীতার ভাগ্যি ভাল। দেশ-বিদেশ ঘুরে আসবে! ন-দিদি বলে ওঠে।
নীতা জবাব দেয় না। এই স্বপ্ন সেও দেখেছিল। কোন্ দূর পাহাড়ের মাথা-সূর্যের আলো পড়েছে, সবুজ টিলার পর টিলা আলোর ঝরনাধারায় শুচিস্নাত। পাখিডাকা স্তব্ধ নির্জনতা। পাইন-বনে শনশনানি হাওয়ার মাতন ওঠে।
হেসে ফেলে নীতা।…ব্যর্থ স্বপ্ন।
উঠে দাঁড়াল। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। বলে ওঠে—বসুন সনৎবাবু, এ সময়ে আপনাদের ডিস্টার্ব করব না। ধারালো হাসি ফুটে ওঠে নীতার ঠোঁটে।
সনৎ শিউরে ওঠে মনে মনে। ওর মনের খবর সে জানে, নিজেকে অত্যন্ত অসহায় দুর্বল বোধ করে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে।
বের হয়ে গেল নীতা। গীতার মুখ থেকে বের হয় শব্দটা। ঘৃণাজড়ানো কণ্ঠস্বর—বেহায়া!
সনৎ ওর দিকে একবার বেদনাহত দৃষ্টিতে চাইল মাত্র। কোন জবাব দিল না, সমর্থন করে না। সমর্থন করে নীরব চাহনিতে বাসরের উপস্থিত মেয়েরা, কেউ কেউ একটু হাসল মুখ নিচু করে।
যেন বলে—বড় থাকতে ছোটরই ভাল ঘর-বরে হলে বড় বোনের অমন একটু হবে বৈকি। হাজার হোক মেয়েমানুষের মন তো।
সমর্থন করে ন-দিদি—সত্যি কথা দিদি। আমাদের নসুর দিদি—চাপাকণ্ঠে বলে ওঠে বাসন্তী—অ্যাই শুরু হল ভাগবত কথা
সনৎ চুপ করে কি ভাবছে। মনে মনে আজ প্রশ্ন জাগে। রূপসী গীতার দিকে তাকিয়ে থাকে চুপ করে। নীতার মনে আজ কোনো বেদনার ছায়াই সে দেখে নি। সহজ ভাবেই এত বড় সবহারানোর দুঃখকে সে জয় করে নিয়েছে। তবে কি সে কোনোদিনই ভালবাসে নি সনৎকে? নীতার ভালবাসার যোগ্য করে তুলতে পারেনি নিজেকে! ভীরু সে। তার অগ্নিশুদ্ধ প্রেমের যোগ্য করে তুলতে সাধনার দরকার, সনৎ সেই পথ থেকে যেদিন ভ্রষ্ট হয়েছে, নীতাও সরে গেছে সেই দিন তার কাছ হতে। নিজেকে অক্ষম মনে করে সনৎ।
এই অক্ষমতাই আজ সনতের মনে কাঁটার মত বাজে নীরব ব্যথায়। এতদিন নীতা নীরবে কৃপা করে এসেছিল আজ সেই কৃপা রূপান্তরিত হয়েছে পুঞ্জীভূত অবজ্ঞা আর অবহেলায়।
বাসর জাগানো শখ ওদের মিটে আসছে, একে একে সকলে বের হয়ে যায়।
অসীম অন্তহীন স্তব্ধরাত্রির নির্জনে দু’জনে মুখোমুখি বসে আছে গীতা আর সনৎ। যেন কেউ কাউকে চেনে না। এই প্রথম দেখা। কথা কইবারও কিছু নেই। সব স্তব্ধ হয়ে গেল। সব কথা যেন ফুরিয়ে গেছে ওদের।
সংসারের খরচ বেশ কিছু কমল। গীতার পেছনের খরচটা বন্ধ হয়ে আসায় সংসারের অবস্থা একটু গুছিয়ে নিতে পারবে নীতা। মন্টুও কিছু বেশি মাইনে পাচ্ছে। সে যদি আরও কিছু বেশি করে দেয়—বাড়তি টাকা কিছু এলে বাড়িটাও নতুন করে গড়ে তুলতে পারবে বছরখানেকের মধ্যে। মাধববাবুর চিকিৎসা আরও ভাল করে করতে পারবে তারা।
কাদম্বিনী মনের কথাগুলো বলে চলেছে। অনেকদিনের আশা ওসব।
মাধববাবু কথাগুলো শুনে যান। চুপ করে বসে থাকেন। কাদম্বিনী নিশ্চিন্ত হয়েছে, মেয়ের বিয়ে দেওয়া নয়—আপদ উদ্ধার হওয়া। আগুনের মত রূপ আর ওই হইচই করা মেয়েটাকে নিয়ে দিনরাত স্বস্তি ছিল না; মেয়ে পার হয়েছে—না গলার কাঁটা নেমেছে। স্বামীর কাছে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। আবার শান্তি নেমেছে সংসারে—পীরগঞ্জের প্রাচুর্যের দিনগুলো ফিরে এসেছে। সবুজ শান্তিমাখা পরিবেশ।
হাসেন মাধববাবু–সেদিন আর ফেরে না বড় বউ।
—কেন?
—এ জীবনের জটিলতা অনেক বেশি। দুর্গম এ পথ। শান্তিতে চলবার উপায় এখানে নেই। শান্তির স্বপ্ন আজকের মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।
একটি ঘটনাকে বহু চেষ্টা করেও তিনি ভুলতে পারেননি। সনতের ওই গোত্রান্তর। মাধববাবু কত আশা-ভরসা ছিল তার উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেরা ছাত্র হবে সে। খ্যাতিমান কীর্তিমান হবে।
কিন্তু! সব আশা তাঁর ব্যর্থ হয়ে গেল।
সনৎ জীবনের ক্ষেত্রে নির্মম পরাজয় বরণ করে সামান্য পাওয়াকেই চরম বলে মেনে নিয়েছে। মনের সব দিক থেকে সে কাঙাল হয়ে উঠেছে। লোভী, বিশ্বাসহন্তা। এমনকি নীতার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে ও প্রতারক।
বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি নীতা। তাই মাধববাবু সনৎকে মনে মনে ক্ষমা করতে পারেননি।
কাদম্বিনীকে দেখেছেন, পীরগঞ্জের বাড়িতে সে ছিল প্রাচুর্যের মধ্যে গৃহলক্ষ্মী। আজ জীবনের কঠিন সংগ্রামের কালো ছায়া তার মুখে-চোখে। বাঁচবার জন্যই নিষ্ঠুর হতে নিষ্ঠুরতর হয়ে উঠেছে। সেই লক্ষ্মী-শ্রী মুছে গেছে ওর মুখ থেকে, চারিদিকের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্য অহরহ চেষ্টা করে চলেছে। নীচতা-শঠতাকেও মেনে নিয়েছে।
সনৎও গোত্র বদলেছে। সবাই এর আগে এমন কি ছিল? না! তবে? এই নির্মম পরিণতির জন্য দায়ী তিনি কাউকে করতে পারেন না; দায়ী যদি কেউ থাকে তা এই যুগ—এই সমাজ, এই সামগ্রিক বিপর্যয়।
এর মধ্যে মানুষের ধর্ম তবুও টিকে আছে। চারিদিকের তমসার মাঝে তবু জ্বলে আলোকশিখা; নইলে সবই অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেত, ভালমন্দে কোনো পার্থক্য থাকত না। অবলুপ্তি ঘটত সব কিছুর।
বড় বউ-এর দিকে তাকিয়ে হাসেন মাধববাবু। ওরা স্বপ্ন দেখে,—আরও ভালভাবে বাঁচবার স্বপ্ন। বাড়ি উঠবে—আরও কত কি পাবে তারা। কিন্তু জানে না—পানপাত্র আর ঠোঁটের মধ্যে ব্যবধান অনেক। দুরন্ত বাধা আর হাজারো অন্তরায় রয়েছে ছড়ানো, সব কটি মানুষের মনের অতলে। সুর এক হয়ে মেলে না আর কোনোখানেই। সবই বেপর্দা-বেসুরো।
মন্টুই বাগড়া দেয় প্রথম। কাদম্বিনী একটু রুষ্ট হয়ে ওঠে ওর কথায়, কিন্তু কড়া কথা বলতে বাধে তার। চিরকালই মুখ বুজে এসেছে ছেলেদের ক্ষেত্রে; অন্ধ স্নেহ তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। এইটুকু সেই মন্টু, আজ সুন্দর একটি তরুণ। বলিষ্ঠ সুন্দর চেহারা—পোশাক-আশাকে মানায় চমৎকার, ওকে সুন্দর দেখেই আনন্দ। তাই সন্তর্পণে ওদের আগলে রাখতে চায় কাদম্বিনী সংসারে থেকে।
মন্টুর মাইনে বাড়ারা সঙ্গে সঙ্গে খরচাও বেড়েছে অনেক। দামি পোশাক, জুতো পরে। ট্যাক্সি হাঁকিয়ে বাড়ি আসে মাঝে মাঝে। ভুল ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে শুরু করেছে। এত দূর থেকে চাকরি করতে যেতে অসুবিধে হয় তার। সেই সকালে ডিউটি, সন্ধ্যায় ফুটবল ক্লাব থেকে বের হয়ে ফিরতেও রাত হয়,–নোংরা পরিবেশে সে আর থাকতে রাজি নয়। বন্ধুবান্ধব আসে এ বাড়িতে, তারা কি ভাবে কে জানে!
টিনের ছাউনি আর পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনির একচালা ঘর—কলোনির এই পরিবেশে অনেক বন্ধুবান্ধবদের আনতেও অসুবিধা হয়। চারিপাশে রাংচিত্তিরের বেড়া, কলাগাছের ঝোপ—দু-একটা পেঁপে আর লাউকুমড়োর লতার আবেষ্টনী। এই জগতে তার মতো অতি আধুনিক কোনো তরুণের থাকা অসম্ভব। তারপর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও মনে লাগে না। দুধ-ডিমও ঠিক মত জোটে না। তাই এখান থেকে চলে যাবার কথাই ভেবেছে।
নীতা মন্টুর কথাগুলো শুনে বলে—এখন যদি চলে যাস তবে সংসারের অবস্থা সেই তেমনিই হয়ে যাবে। দুটো পয়সা দিস—তাই চলছে।
মন্টু বলে ওঠে—কিন্তু রিয়েলি আই ফিল আনহ্যাপি। এখানে প্লেয়ারের বাঁচা চলবে না। নেভার।
—বলিস না হয় খাওয়া-দাওয়ায় একটু ভাল ব্যবস্থা করে দিই। বুঝছি অসুবিধা হচ্ছে! নীতা অনুরোধ করে ব্যাকুল কণ্ঠে।
মন্টু বলে ওঠে—না—না, দ্যাট ইজ সেলড্। আমি বরং কোম্পানির মেসেই থাকব ঠিক করেছি। এভরিথিং অ্যারেঞ্জড্।
কাদম্বিনী ইংরাজি বোঝে না। তবু বুঝতে পারে ব্যাপারটা। সে ভাবে সত্যিই। ছেলেরও যখন অমত-তা ছাড়া অসুবিধা হচ্ছে, তার দিকে চাওয়া উচিত।
মন্টু সান্ত্বনা দেয় দিদিকে—অফ কোর্স বাড়িতে টাকা আমি ঠিকই দোব মাসে মাসে।
হাসে নীতা, চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল। চোখে সব দেখেশুনেও দিতে চায় না সে, বাইরে গেলে এ বাড়ির সঙ্গে কতটুকু সম্বন্ধ রাখবে তা ভালোই জানে।
তবু বলে ওঠে নীতা—টাকাটাই বড় নয় মন্টু; এক জায়গায় থাকবি বা মা ভাই-বোনের মধ্যে, এতে সম্পর্কটা মধুর হয়, বিপদে সান্ত্বনা থাকে। পরস্পরের জন্য মমতাবোধ জন্মায়। সুন্দর কিছু গড়ে ওঠে সকলের সমবেত চেষ্টায়।
মন্টু জবাব দেয়—উঁহু এতে তিক্ততা বাড়ে বই কমে না, দূরে দূরে থাকাই ভালো। তাতে সম্বন্ধটা বজায় থাকে। খিচড়ে যায় না সবকিছু।
নীতা কথা বলে না। চমকে উঠেছে ওর কথায়। এতটুকু ছেলে, এই কদিনেই এত সব শিখে ফেলেছে।
কাদম্বিনী বলে ওঠে—তা ও যেতে চাইছে যখন তুই বাধা দিস কেন বাপু? যাক না।
নীতা একটু কঠিন সুরেই বলে ওঠে—একা যে সংসার টানতে আর পারছি না মা! কেউ যদি না দেখে, দায়িত্ব কি একা আমার?
কাদম্বিনী বলে ওঠে—সংসারে মানুষ তুই একা নোস। কেন ওই বুড়ো মিনসে দিনরাত হা হা করছে, তাকে এই কথাটা শোনাতে পারিস না? মন্টু দুধের ছেলে তাকে এই সব কথা বলা কেন? ওর অসুবিধা হয় মেসেই থাকবে।
নীতা কোনো কথা বললো না। শঙ্করের প্রতি এখনই হাজারো বাণ নিক্ষেপ করা শুরু হবে। বাবাকে বের হয়ে আসতে দেখে সে থেমে গেল। মাধববাবু হাসছেন কাদম্বিনীর দিকে চেয়ে।
—ছোটবাবু চলে গেল? তোমার ছোট কুমার, প্রিন্স!
কাদম্বিনী কথা বলে না।
মাধববাবু বলেন—ওরা যাবেই বড় বউ। রাখতে তুমি পারবে না। বললাম না—আজকের এখানের পথ বড় জটিল। সুর এখানে মেলে না কারো সঙ্গে। সব বেসুরো বেপর্দা বাজে।
ওঁর কথায় কান না দিয়ে কাদম্বিনী বের হয়ে গেল। মাধববাবু নীতার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।
ওঁর হাসি—ব্যর্থতার দুঃখমাখা হাসিও—স্তব্ধ হয়ে যায় ওর সামনে
বাবা প্রশ্ন করেন—কোথা যাচ্ছিস নীতা?
নীতা ফিরে দাঁড়াল—মিত্তিরবাড়িতে নতুন টিউশনির কথা বলেছিল, দেখে আসি একবার।
মাধববাবুর এগিয়ে আসেন, শীর্ণ কোটরগত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে নিষ্ফল ব্যর্থতায়। বলে ওঠেন—দু-চার জন ছেলেকে বল না বাড়িতে এসে পড়ে যাবে। কম টাকায় পড়াব; যে যা দেয়!
—বাবা! নীতা বাবার আর্তিভরা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠেছে। মাধবমাস্টার আজ যেন ভিখারির মত আবেদন জানাচ্ছেন। যেন কেউ তাঁর নেই। একা অসহায় একটি প্রাণী—বাঁচবার জন্য অন্তিম চেষ্টা করছেন প্রাণপণে!
বলে ওঠে নীতা—এখনও আমি আছি, বাবা!
—জানি মা, জানি! তবু মাঝে মাঝে মনে হয়—আমার মত পাপী আর কেউ নেই; নইলে এতও দেখছি বাজপড়া বটগাছের মত শূন্য মাঠের বুকে দাঁড়িয়ে।
হাঁপাচ্ছেন মাধববাবু। নীতা কি ভাবছে।
দুটি ব্যর্থ মন কোথায় এক সুরে অনুরণন তোলে।
মাধববাবু বার বার ভেবে দেখেছেন, তাঁর কথাগুলো নীতার ক্ষেত্রে নিদারুণ নিষ্করুণভাবে সত্য। একটা মেয়েকে সেই যুগে টুটি টিপে বিয়ের নামে গঙ্গাযাত্রী বুড়োর সঙ্গে বেঁধে দিত, বছরখানেক পরই বিধবা হয়ে নিজের সব সাধ কামনা চুকিয়ে দিয়ে সংসারের ঘানি টানত, বইত কঠিন ব্যর্থ জীবনের বোঝা।
একালেও প্রগতির নাম করে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বয়ে নিজের জীবনের সব আশা ভবিষ্যৎ নষ্ট করার মধ্যেও সেই দিনের ব্যর্থতার সঙ্গে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। নীতা এই যুগের একটি বলি মাত্র—একা নীতা নয়—আরও অনেককে দেখেছেন তিনি।
মাধববাবু ক্লান্ত, হতাশা-জড়ানো স্বরে বলেন—ওকে যেতে দে নীতা। জোটে যদি একবেলাই খাবো। তবু হয়তো নিশ্চিন্তে থাকতে পারবি। ছোটবাবু যেতে চায়, যাক।
—তোমার বইটা কতদূর হল বাবা? নীতা বাবাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে ফেরাতে চায়।
—বই!
—হ্যাঁ তোমার সেই টেক্সট বুক। কথাবার্তা বলে এসেছি।
নীতা বাবার কাছে এসে দাঁড়াল।
চুপ করে কি ভাবছেন মাধববাবু। মেয়ের দিকে চাইলেন।
একটু ক্ষীণ আশার আলো জাগে মনের কোণে। তাঁর বই বাজারে বেরুবে, জনপ্রিয় হেডমাস্টার মাধব সান্যালের বই, বহু স্কুলে চলবে। কত ছেলের নিবিড় সাহচর্যে ভরে উঠবে মন। তাঁর বই হবে বাজারের সেরা বই।
নীতা বাবার স্তিমিত মুখের ক্রমবর্ধমান ক্ষীণ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। …একটা পথ যেন পেয়েছে বাবার ছাইচাপা কর্মোদ্যমকে জাগাতে—মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
মাধববাবু বলেন—বই তো প্রায় শেষ করেছি মা, কিন্তু কে ছাপবে?
—ছাপবে বাবা। এমন বই যে কোনো প্রকাশকই নেবে।
—নেবে?
মন জড়তা কেটে যায় মাধববাবু নীতা বলে ক্ষেত্রে নিদারুণ নিষ্করুণভাবে সত্য। একটা মনের জড়তা কেটে যায় মাধববাবুর। নীতা বলে ওঠে—এখনই আমি দু-এক জায়গায় কথা বলেছি। তুমি শেষ করে ফেল বাবা। তাঁরা ছাপতে রাজি হয়েছেন।
—বলেছিস?
কাদম্বিনীর ডাকে চমক ভাঙে—কই রে নীতা, আপিস যাবি না? বেলা হয়ে গেল। চান-টান কর।
তার আর মিত্তির মশায়ের বাড়ি এবেলা যাওয়া হল না। দেরি হয়ে গেছে।
চমকে ওঠে নীতা—যাই মা!
—হ্যাঁ ওঠ তুই। যাবার বেলা মাধববাবু আবার বলে ওঠেন।
—তাহলে বাকিটুকু শেষ করি? কি বলিস?
—নিশ্চয়ই!
নীতা বাথরুমের চটঘেরা ঠাঁইটুকুর দিকে ছুটল, ওদিকে বেলা বেড়ে উঠেছে অনেক।
নীতা আপিসের ছুটির পর কি খেয়ালবশেই বই-এর দোকান অঞ্চলের দিকে যায়। দোকানে দোকানে কত বই। ঝকঝকে মলাট। অনেক দোকানের স্বল্প পরিসরের মধ্যে খ্যাতনামা বহু সাহিত্যিক ঘরোয়া হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। জমাট আড্ডা। স্বাভাবিক সাধারণ মানুষ, অথচ নিজের জগতে এঁরা ভিন্ন সত্তার লোক—শিল্পীসত্তা।
এই অচেনা পরিবেশে কেমন যেন নিজেকে বেশ অসহায় বোধহয়। দু-চারটা দোকানের সামনে ঘুরে শেষকালে একটা দোকানেই ঢুকল, স্কুল-কলেজের বই-এর নামকরা প্রকাশক-প্রতিষ্ঠান। অজানা-আশা আর আতঙ্কে দুরু দুরু কাঁপছে নীতার বুক। তবু এগিয়ে গিয়ে দোকানে ঢুকল। ভীরু শঙ্কিত মনে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কী ভাবতে থাকে। একটি সেল্সম্যান এগিয়ে আসে।
—কি চাই আপনার?
নীতার বুকে কাঁপন ধরে; মনে করে, বের হয়েই চলে আসবে নাকি! পরমুহূর্তেই নিজেকে শক্ত করে বলে ওঠে— আপনাদের মালিকের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
সেলস্ম্যান ছোকরাটি একবার ওর দিকে আপাদমস্তক দেখে কি ভেবে কাউন্টারের একটা পাটাতন একটু তুলে পথটা দেখিয়ে বলে—আসুন
সরু দরজাটার ফাঁক দিয়ে বই-এর দোকানের মধ্যে ঢুকে চলেছে সে লোকটির পিছু পিছু। দেওয়ালের গায়ে থরে থরে সাজানো আলমারি-র্যাক ভর্তি বই। তারই একপাশে একটি বড় বনাতমোড়া টেবিলের সামনে একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখিয়ে দেয় কর্মচারীটি—ওই যে উনি
নীতা দুর্জয় সাহসে ভর করে এগিয়ে যায়, নিজের কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নেয়, কি ভাবে কথাটা পাড়বে, বলবে সবকিছু। মনের মধ্যে একটা ভরসা পায়। ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখে ভারী গলায় বলে ওঠেন—বসুন, কি দরকার?
নীতা বলে চলেছে কথাগুলো, এ যেন অন্য কারোও কণ্ঠস্বর। কার্যকালে এমনি নির্ভয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে তার বক্তব্যটা পেশ করতে পারবে ভাবেনি নীতা। বাবার জীর্ণ পাণ্ডুর মুখখানি, সেই হতাশা-ভরা চাহনি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে নীতা, কপালে ফুটে উঠেছে দু-এক বিন্দু ঘাম। যেন ফাঁসির আসামি হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থন ঠিকমতো করতে না পারলেই ধরে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে। তাই মরিয়া হয়ে বলে চলেছে সে। ভদ্রলোক ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন—পীরগঞ্জের হেডমাস্টার ছিলেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। এখানে এসে চাকরি করেছেন। এখন রিটায়ার্ড।
কি ভেবে ভদ্রলোক বলে ওঠেন—কপিটা যদি একবার দেখতে দেন তাহলে দেখে-শুনে কথা বলতে পারি।
চমকে ওঠে নীতা। মনের কোণে দপ্ করে আনন্দের আভা জেগে ওঠে। হয়তো ব্যর্থ হবে না। আবার নতুন উদ্যমে বাঁচতে পারবেন বাবা, কাজের আনন্দে সৃষ্টির আনন্দে তিনি বাঁচবেন।
জবাব দেয়—আজ্ঞে হ্যাঁ, এনে দোব। কাল এই সময়? আচ্ছা নমস্কার।
—নমস্কার।
নীতা বের হয়ে এসে ট্রাম লাইনের দিকে এগোতে থাকে। আলোজ্বলা রাজপথ, কর্মব্যস্ত জনতা। এই মহাজীবনের স্রোতে সেও এগিয়ে চলে। মনটা খুশিতে ভরে রয়েছে। চারিদিকে অনেক বাধা—হোক! তবু বাধা সে উত্তীর্ণ হবে, হতেই হবে। বাবাকে কথাটা জানাবার জন্য ছটফট করছে মন। কপি দেখলে ওদের পছন্দ হবে, প্রকাশক ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হল বাবার নাম জানেন। বেশ খুশি মনেই বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে নীতা।
অগাধ জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের অবস্থার মতো, একটা রুদ্ধ দম বন্ধ-হওয়া অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সনৎ। একদিন স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে মুক্ত অবাধ গতিতে বিচরণ করেছে। সেই প্রাণোচ্ছল পরিবেশ, হাসি-গানের সুরভরা রৌদ্রজ্জ্বল জীবন থেকে গুমোট এই চার-দেয়ালে ঘেরা আপিসের সীমায় বন্দি হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। যেমন কাজ তেমনই লোকজন আর তেমনই পরিবেশ! দম বন্ধ হয়ে আসে সনতের। এখানে সাহেব বড়সাহেব ছাড়া কথা নেই।
আপিসের প্রবোধবাবু মাঝে মাঝে রাজনীতির তর্ক করে। সাবেক কালের গ্র্যাজুয়েট—সেই মর্যাদাটুকু নিয়েই এক ছত্রাধিপত্য করেছিল এতদিন—প্রথম দিনই সনৎকে দেখেই একটু অসন্তুষ্ট হয় সে। বড়বাবু হেঁকে বলে—একজন এম-এ পাশ এলেন হে প্ৰবোধ!
প্রবোধ একটু চমকে ওঠে। এ ঘরের মধ্যে শিক্ষার দিক থেকে সেই ছিল সবার উপরে। সেই সম্মানটুকু নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওই সনৎ যেন এসে পড়েছে। টেবিল থেকে মাথা তুলে প্ৰশ্ন করে প্রবোধ—কোন ক্লাস?
বড়বাবু একজন কেরানির ডিবে থেকে ভিজে-ন্যাকড়া-জড়ানো পানটা মুখে পুরে চাট্টি দিলীপের জর্দা হাঁ-এর মধ্যে ছিটিয়ে দিয়ে একটু সামলে জবাব দেয়—
—অতশত জানি না বাবা। নিজে ফোর্থ কেলাস পর্যন্ত, প্যারিচরণ সরকারের ঘোড়াপাতা অবধি বিদ্যে, তাই জানি। এত কেলাস জানলে এখানে কি আসতাম। কি বল সুহাস।
সুহাস তৈরি ছিল। বলে ওঠে—তা সত্যি, কিন্তু ওই বিদ্যে নিয়ে তো কত সাহেবের ড্রাফটের তো ভোল বদলে দিলেন। সব এক্সপিরিয়েন্স, পাশটাশ এখানে বাজে কথা স্যার। চাই প্রতিভা।
বড়বাবু খুশি হয়েছে। হোঁদলকুতকুতের মতো ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসতে থাকে। –কি যে বল! তবে চিনত বটে কাথবার্ট সাহেব। বলেছিল, ইংল্যান্ডে জন্মালে তুমি ইঞ্চকেপ হতে পারতে হে, —বিজনেস ম্যাগনেট হয়ে যেতে।
প্রবোধবাবু তখনও আগন্তুক সনতের কথাটা ভোলেনি। বেশ একটু বিরক্তই হয়েছে মনে মনে। পেন্সিল-এর শিষ বাড়াতে বাড়াতে বলে ওঠে—ওসব থার্ডক্লাস এম-এ। অন্য কিছু হলে স্কুল কলেজে ভালো মাস্টারি, প্রফেসারি পেত, না হয় রিসার্চ করত। আজকাল ওই লাইনে ভালো পয়সা। আমারই ছোট ভাই—বুঝলেন কিনা—সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হল, লুফে নিয়ে গেল দুধোরিয়া কলেজ। ওরা না হোমে না যজ্ঞিতে লাগা এম-এ পাশ। ওই তিন নম্বর এম-এর দল।
দূর থেকে কথাটা শোনে সনৎ। হাতের কলম নামিয়ে রেখে কি ভাবছে। দিন দিন এই পরিবেশে বিষিয়ে ওঠে তার মন। এমন জানলে এই পথে আসত না। কিন্তু ফেরবার পথও যেন বন্ধ। কি ভুল করেই আটকে ফেলেছে নিজেকে, একটা দায়িত্ব নিয়ে!
নীতা হয়তো জানত সনৎকে—তার প্রকৃতিকে। তাই উৎসাহ দিয়েছিল অন্য পথে এগিয়ে যাবার জন্য। পড়াশোনা করা, অধ্যাপনাই তার স্বভাবসিদ্ধ পথ ছিল। কি যেন মোহে হঠাৎ একটা ভুল করে বসেছে—যার জন্য আদম-ইভের মতো অভিশাপগ্রস্ত হয়ে এই নির্মম জগতে ছিটকে এসে পড়েছে!
টিফিন করছে দু-একজন বাবু। চা আর মুড়ি। বড়ো জোর তার সঙ্গে একটা সস্তা দরের কলা। তাই পরম তৃপ্তি ভরে খায় তারা খুঁটে-খুঁটে।
সনৎ ক্রমশ যেন তাদের দলে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। তিনশো টাকায় তার সীমানা,তারই মধ্যে সবকিছু। গীতার খরচ, বাড়ির-ঝিয়ের মাইনে, টুকিটাকি অনেক কিছু। শেষতক ঠেলতে ঠেলতে এসে মাত্র টিফিনের উপরই টান পড়ে। একমাত্র ওইটাই দৃশ্য বাজে-খরচ পর্যায়ে পড়ে। তাই ওটাকে সবাই ওই মুড়ির খাতেই এনে ফেলেছে।
হঠাৎ বড়বাবুর হাঁক-ডাকে সকলে চমকে ওঠে। প্রবোধবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে।
–কি হল?
বড়বাবুর টাক ঘামছে। যেন চাকরি যাবারই উপক্রম। হুঙ্কার ছাড়ে।
—ও মশাই সনৎবাবু, আরে চাকরি যে নট হয়ে যাবে মশাই! আপনার তো হবেই, সেই সঙ্গে আমারও। কি লিখেছেন মশাই? কাস্টমারকে এমনি কড়া চিঠি লিখলে কোম্পানির ব্যবসা লাটে উঠবে। তখন কি চার-হাত বের করে খাবেন?
—কী হয়েছে?
সনৎ একটু ঘাবড়ে যায়। ঘরের সব বাবুরাই উঠে পড়েছে, সকলেই তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। প্রবোধবাবুর মুখে হাসির আভা—আরে মশাই, একালের এম-এ পাশ তখনকার দিনের এনট্রান্সের সমান। আমাদের কালে বি. এ. পর্যন্ত উঠতে নাক দম হয়ে যেত। ইংরাজি? ইংরাজিতে ডুবে থাকতাম; স্বপ্ন দেখতাম।
কথা বলে না সনৎ! বড়বাবুই তড়পে চলেছে।
—আসুন মশাই, লিখুন যা বলি। ছিঃ ছিঃ এই লেখাপড়া শিখেছেন আপনারা এত খরচা করে?
ড্রাফটের পাতাটা আগাগোড়া কেটে ফেলে। চমকে ওঠে সনৎ। তার গালে অতর্কিতে কে যেন প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়েছে। প্রবোধবাবুর মুখে বিজ্ঞের হাসি। আরও দু-চারজন রেশ উপভোগ করছে দৃশ্যটা।
জীবনে এতবড় অপমানিত বোধ করেনি কখনও সনৎ। অভাবের মধ্যেই জীবন কেটেছে তবু সেখানে এতবড় অবমাননার কোনো আয়োজনই ছিল না। এখানে মাত্র ওই কটি টাকার বিনিময়ে সে তার সব কিছু বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে। এত অসহায় হয়ে পড়েছে সে।
—লিখুন মহাশয়।
সনৎ ঘোড়ার পাতামার্কা ইংরাজি বিদ্যাধারী বড়বাবু দেবতার ডিকটেশন লিখছে। উইথ রেফারেন্স টু…
—ঠিক করে লিখুন মশায়। বানান-টানান যেন ভুল না হয়।
সনতকে ধরে ওরা যেন এক পোঁচ কালি মাখাচ্ছে গা-মাথা ভরে; হাত-পা বেঁধে রেখেছে তার; ওরা সকলে ধরেছে—পোঁচড়া টানছে ওই কিম্ভূতকিমাকার লোকটা।
তার ইকনমিকসের বিদ্যা কোনো কাজেই লাগবে না এখানে। ছকবাঁধা কাজ, ফরম ভর্তি করা, মালের জায়মত হিসাব রাখা, যোগ দিয়ে দর ফেলে খদ্দেরকে জানানো। তাতেই বড়বাবুর এত হাঁক-ডাক।
একজনের কথা মনে পড়ে বারবার-পি-এইচ. ডি. হতে পারলে সম্মানজনক চাকরির অভাব হবে না। তুমি পারবেই চেষ্টা করলে।
টিকিওয়ালা জরদগব বড়বাবু মাথা নাড়ছে—লিখুন—লিখুন—নাও, মার্কেট প্রাইজ ইজ রাইজিং টু দি স্কাই।
সনৎ জবাব দিয়ে ওঠে—আমার দ্বারা ঠিক হচ্ছে না বড়বাবু, ওটা প্রবোধবাবুকেই দিন ঠিক হবে। না হয় আপনি দয়া করে—
বড়বাবুর গর্বে বুক ফুলে ওঠে—
—তাই বলুন মশায়। শিখুন, দেখে শিখুন—ঠেকে শিখুন। সব ঠিক করে দিচ্ছি। সারানডারই যখন করলেন। ওহে প্রবোধ।
চোখ-কান ঝাঁঝাঁ করছে সনতের। মনে হয়, স্বেচ্ছায় কি নেশার ঘোরে মেতে উঠে এই দুঃসহ অপমানের মধ্যে এসে পড়েছে সে তার প্রকৃত পথ ছেড়ে। ফেলে আসা জীবনে সেই দুঃসহ কষ্টের মধ্যেও সান্ত্বনা ছিল, ছিল মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবার উদ্যম, কল্পনা। কার স্নিগ্ধ ডাগর চোখের মনছোঁয়া চাউনি অন্ধকারের মাঝে আলোর নিশানা আনত।
আজ সেই জীবন কোথায় হারিয়ে ফেলেছে—হারিয়ে ফেলেছে সেই পথ। তবু ফিরে যেতে মন চায় বারবার।
গীতার মনে এসেছে স্তিমিত ভাটার টান। উদ্দাম জোয়ারে ভরা নদীর মতো মাতাল ছন্দে এগিয়ে এসেছিল সে কুলের সন্ধানে। সমস্ত প্রাণশক্তি সেই উত্তেজনার আবেগে যেন নিঃশেষিত প্রায়। আজ মনে মনে সে ক্লান্ত; নীতার উপর রাগ করেই গীতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসেছিল সনৎ।
অনায়াসেই জয়লাভ করে গীতার মনেও সেই নেশার আকর্ষণ কমে গেছে। গতিহীন স্তিমিত জীবন। বিয়ের আগেকার দিনগুলো বারবার গীতার মনে জাগে। কলোনির দিনগুলো, গুপিদার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা, গান-গাওয়া। কত মনের সামনে রঙিন প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে উড়ে বেড়াত সে। সেদিনের গীতা আজ কোথায় এসে থেমে গেছে। সেই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী আজ পথ হারিয়ে কোন রুদ্ধপুরীতে বন্দি হয়ে বসে আছে। সনতকে পেয়ে ভেবেছিল এই তার জীবন। আজ ক-মাসেই ক্লান্তি এসেছে তার, মনে মনে একটা চাপা বিক্ষোভ জাগছে তিলে তিলে। যা আশা করেছিল তা হয়নি। সনতের মনেও একটা শূন্যতা রয়ে গেছে, সেইখানে গীতার কোনো ঠাঁই নেই এটাও সে বুঝেছে।
আজ মায়ের উপরও ক্ষোভ হয় গীতার; সনতকে পেয়ে তার ঘাড়ে চাপিয়ে পাপ বিদায় করেছিল। কিন্তু সনৎ ঠিক যেন কোন্খানে তাকে মেনে নিতে পারেনি। সমস্ত দিতে গিয়েও কোথায় বাধা ঠেকে সনতের, তার মনের কোণে আজও নীতার নিঃশব্দ সঞ্চরণ।
গীতার সেইখানে কোনো ঠাই নেই—সে অবাঞ্ছিতা।
সনৎ সেদিন আপিস থেকে ফিরতে দেরি করছে দেখে বিরক্ত হয়ে ওঠে গীতা। স্নান প্রসাধন সেরে অপেক্ষা করছে, কোথায় সিনেমা দেখতে বেরোবে। কিন্তু সনতের কোনোদিকে খেয়াল নেই, সেও এড়িয়ে যেতেই চায় গীতার সঙ্গ। আবছা অন্ধকারে মনের ভিতর একটা অহেতুক আতঙ্ক জাগে।
মনে পড়ে অতীতের কথাগুলো। নীতার সঙ্গে ওর দশ বছরের ঘনিষ্ঠতা বহুবার দেখেছে, নীতা তাকে পড়ার খরচ জুগিয়েছে, বই কিনে দিয়েছে নিজের টিউশানির ও জল-পানির টাকায়। তার এই অপব্যয়ের জন্য নীতা বাড়িতে কথা শুনেছে কিন্তু কোনোদিনই প্রকাশ করেনি। এতদিনে গীতা বেশ বুঝেছে নীতা আর সনতের মাঝে ছিল কতখানি নিবিড় সম্পর্ক। সেটা টের পাওয়ার পর থেকেই মনে মনে জ্বলে উঠেছে নীরবে।
ঘড়ির কাঁটা চলেছে একটানা ছন্দে। সিনেমার সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল, তখনও দেখা নেই সনতের। টিকিট দুটো টেবিলের উপর উড়ছে হাওয়ায়। গীতার মনে আলগা চিন্তার ঝড় -একটা চাপা-রাগ উঠছে ক্রমে ক্রমে। সনতের এই অবজ্ঞা-অবহেলা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে।
রাত হয়েছে। সাতটা বেজে গেছে। শীতের সন্ধ্যা, এরই মধ্যে নিবিড় আঁধার নেমেছে। ছোট গলিটা গ্যাসের আলোয় থমথমে; কেমন অলস সন্ধ্যা মনের সব আলোকে ঘিরেছে তমসায়— হতাশা জড়ানো তমসা ওর চারিদিকে!
হঠাৎ সনতকে ঢুকতে দেখে ফিরে তাকাল, বেশ ঝাঁঝালো স্বরে গীতা প্রশ্ন করে—এতক্ষণ ছিলে কোথায়? টিকিট দুটো—
সনৎ ওর দিকে তাকাল। গীতাও অবাক হয়ে গেছে। মুখ-চোখ ওর থমথমে, বগলে একগাদা বই-খাতা।
সনৎ বলে ওঠে—বইগুলো আনলাম, দোকানে গিয়েছিলাম।
বিদ্রূপ করে গীতা—বুড়ো বয়সে আবার সুমতি হয়েছে দেখছি!
সনৎ ওর কথার সুরে একটু আহতই হয়; ধীর কণ্ঠে জবাব দেয়—আবার পড়াশোনা করব ভাবছি। দেখি যদি থিসিস সাবমিট করতে পারি। ও চাকরি ঠিক আমার পোষাবে না।
সনৎ হতাশ সুরে কথাগুলো বলে, গীতা শিউরে ওঠে মনে মনে। হঠাৎ পড়াশোনার আগ্রহ জেগে উঠতে দেখে একটু চিন্তায় পড়েছে, একটু আতঙ্ক মেশানো চিন্তা! তবে কি আবার যোগাযোগ গড়ে উঠেছে নীতার সঙ্গে, তার পরামর্শেই আবার চলেছে সে।
—চাকরি ছেড়ে দিয়ে কী করবে শুনি?
—ছাড়িনি এখনো, তবে—ছাড়তে পারলেই ভাল হত!
—সে কম্ম করে এলেই পারতে! ঝাঁঝ ফুটে উঠে গীতার কথার সুরে; জিভে যতটুকু গরল ছড়ানো সম্ভব ছিটিয়ে বলে ওঠে—আবার মন্ত্রণাদাতা জুটেছে বোধহয়?
কথাটা শুনে ফিরে চাইল সনৎ। গীতার দিকে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে ঘোষণা করে সনৎ—মন্ত্ৰণাদাতা যে ঠিক কথাই বলত এটা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
একটি মুহূর্তে গীতার মনে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের স্তূপে যেন অগ্নিসংযোগ ঘটেছে; ফেটে পড়তে গিয়েও কোনরকম সামলে নিয়ে সরে গেল! মাথা ঝিমঝিম করছে অসহ্য রাগে—এত বড় কথাটা সনৎ তাহলে চেপেছিল তার কাছে!
চোখের সামনে গীতা দেখতে পায় এ বাড়িতে তার ঠাঁই কতখানি—তার তুলনায় নীতা আজও সনতের নিকটতমা
ভালোভাবেই অনুভব করে গীতা। সে জেতেনি, জিতে রয়েছে নীতাই অনেক আগে থেকে।
মাধববাবু নতুন উৎসাহে আবার কাজে লেগেছেন, বইখানা শেষ হয়ে গেছে। নীতাই ঘোরাঘুরি করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। মাধববাবুর কুঞ্চিত বয়সজীর্ণ মুখে আবার আশার আলো ফুটে উঠেছে। এক-একটি ছেলে ওই পদের। মন্টু দু-পয়সা রোজগার করার পর থেকেই সরে গেছে সংসার থেকে। বড় ছেলে শঙ্কর—সেও সংসারের বোঝা। ইদানীং আবার সেও কোথায় বাইরে গেছে। বেপাত্তা বোধহয়। থেকেও না থাকা। মাধববাবু দুঃখ করেন।
—তুই আমার সব নীতা। বুড়ো বাপের প্রতি ছেলেদের যে একটা কর্তব্য আছে, সেটুকুও তারা স্বীকার করে না।
নীতা চুপ করে থাকে। এ বাড়ির জীবনযাত্রায় একটা স্তিমিত চাঞ্চল্যহীন ভাব এসেছে। সে যার জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। কেবল তার নিজেরই কোনো পথ নেই—মতও নেই। বিরাট জগদ্দলের সঙ্গে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। নড়াচড়ার পথ নেই।
চাকাটা ঘুরে চলেছে তবু। নীল স্তব্ধ আকাশ আর ছায়াঢাকা কলোনির পরিবেশ। শূন্য লাগে কেমন তার। বিকালের সোনারোদ জেগে ওঠে আবার ফিকে হয়ে যায়। পাখি ডাকে, জলার বুকে কচুরিপানার হালকা বেগুনি রঙের ফুলগুলো হাওয়ায় কাঁপে। পথ দিয়ে আনমনে যায় দু-চার জন। আশেপাশে খেতে পাটগাছের আবছা সবুজ আভা জাগে ছোট খালের ধারে। দু-একটা কলাগাছ বাতাসে মাথা নাড়ছে।
কেমন উদাস হয়ে ওঠে মন। নীতার দিনগুলো কেটে চলেছে। জীর্ণ পাতার মতো ঝরছে একটা দুটো করে। বৈচিত্র্যহীন স্বাভাবিক গতিতে। কাদম্বিনী একটা কাঁটার মতো খচখচ করে ওঠে মাঝে মাঝে এই স্তব্ধ জীবনযাত্রায়। গীতা একবার এসেছিল কদিন আগে; নীতা আপিসে বের হবার সময়।
ওকে দেখে নীতাই একটু থামল।
মা ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়ের তদারকে। দেখছে মেয়েকে, কেমন যেন গীতার মুখে একটা কালো ছায়া।
কেমন আছিস? নীতা প্রশ্ন করে।
—ভালোই! জবাব দেয় গীতা। কোনোরকমে সামনের থেকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। ওর দিকে তাকাল নীতা, কোথায় যেন কি একটা গোলমাল বেধেছে। কিন্তু ওদিকে তার আপিসের দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ে।
আসল খবরটা জানতে পারে নীতা বাড়ি ফিরে সেই সন্ধ্যাবেলায়।
কাদম্বিনী মুখ-ভার করে আছে।
গীতা বিকালেই ফিরে গেছে কলকাতায়। গজগজ করছিল কাদম্বিনী। সোজা কথায় কোনো কিছু বলা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। টেরা-বাঁকা কথায় ফোড়ন কাটে, ঠিক বুঝতে পারে না নীতা তবে এটা বেশ বোঝে—তারই উদ্দেশে এই চোখা বাক্যবাণ ছাড়া হচ্ছে।
মা গজগজ করে চলেছে।
—লজ্জা বলে বস্তু আমাদেরও ছিল। এই এতখানি ঘোমটা। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলব, হাসব কি? ছিঃ লজ্জা করে না! তা হলই বা আগেকার চেনা।
নীতা একবার দাঁড়াল মাত্র, কোনো কথাই বলে না।
কাদম্বিনী যেন ক্রুদ্ধ বিড়ালের মতো পা-দিয়ে মাটি ছিটোচ্ছে। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী পেলেই হয়, একটু ছুঁতোয়-নাতায় কথা উঠলেই ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। ধারালো নখ দাঁত বিস্তার করে ছিঁড়ে ফেলবে টুকরো করে। মাকে চেনে, তাই চুপ করে সরে গেল নীতা, তবু শব্দভেদী বাণ ঠিক লক্ষ্যভেদ করছে।
বাবার ঘরে কি কাজ করছিল নীতা, বাবা ওর দিকে তাকাল।
মাধববাবু বলে ওঠেন—সনৎ নাকি চাকরি করতে চায় না! শুনলাম আবার পড়াশুনা করবে। চমকে ওঠে নীতা—তা কি করে হয়?
যে পথ পিছনে ফেলে গেছে সনৎ সেখানে ফেরা আর অসম্ভব। এখন দায়িত্ব বেড়েছে তার। অনেক দায়িত্ব।
মাধববাবু বললেন—তাই তো গীতা বলছিল।
মৌকা পেয়ে কাদম্বিনী ঘরে ঢোকে কি অছিলায়। মাকে দেখে নীতা বের হয়ে গেল। মাধববাবুকে বলে ওঠে কাদম্বিনী—হবে না? কানে যে মন্তর পড়েছে। ফুসমন্তর। ছিঃ ছিঃ, কালামুখী কি ঘর না জ্বালিয়ে ছাড়বে না। গীতার বরাতে শেষকালে কিনা—
মাধববাবু থামিয়ে দেন—চুপ করো বড়বউ! ওকে আর দগ্ধে মেরো না।
—চুপ করেই তো আছি। বলে না—
কথা কইবো কোন ছলে
কথা কইতে গা জ্বলে।
নীতা মায়ের কথাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। সনতের এই মত পরিবর্তন কত বড় বিপর্যয় আনবে তা জানে। বাধাই সে দেবে সনৎকে। তবে মনে হয় এতখানি সবল দৃঢ়মনা নয় সনৎ, তাহলে তাদের জীবন আজ অন্যপথে চলত। ওমনি সহজে তারা পথ হারাত না। এটাও সনতের মনে ক্ষণিকের চাঞ্চল্য মাত্র।
রাত্রির অন্ধকার ছেয়ে আসে ঘরে-বাইরে। হঠাৎ কেমন ঝড় ওঠে পশ্চিম আকাশে। সৰ্বনাশা ঝড়। সব শান্তি উড়ে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, সব যেন তালগোল পাকিয়ে যায় নীতার মনে। একটা কালো মেঘ আকাশের কোল থেকে ঘূর্ণির সঙ্কেত নিয়ে এগিয়ে আসে; সংসারের জীর্ণ নৌকাখানা পাল ছিঁড়ে হাল ভেঙে অতলে তলিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
আশেপাশে কেউ নেই। শঙ্কর বাইরে। একা নীতা হিমশিম খেয়ে যায়—কোনোদিকে কূল-কিনারা পায় না। কাদম্বিনী বুক চাপড়ে কাঁদে।
—হেই ভগবান! এ কি করলে তুমি? এই ছিল তোমার মনে।
নির্বাক হয়ে গেছে বাজপড়া বটগাছ, বাতাসের মৃদু স্পর্শটুকুও স্তব্ধ হয়ে গেছে ওর পত্রহীন অর্ধমৃত শাখা কাণ্ডে। মাধবমাস্টার চুপ করে বসে আছেন—মনে ওই দুরন্ত ঝড়ের পূর্বাভাস ফুটে ওঠে ঠোঁটের নীরব কাঁপুনিতে। অসহায়—ক্লান্ত-হতাশ একটি মানুষ
চোখের সামনে দেখছিলেন দিনগুলো কেমন বদলাচ্ছে। প্রাচুর্য থেকে এল অভাবের দিন, ক্রমশ সেই জঘন্য পরিবেশে বাস করবার জন্য শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই ওদের স্বভাব বদলাল, সংস্কারও বদলে গেছে। আজ সব যেন চোর বাটপাড় হয়ে উঠেছে। মা তার স্নেহ ভুলতে বসেছে! ভাই ভুলেছে তার কর্তব্য। এই ছোট্ট সংসারের মাঝেই সেই বিরাট সামাজিক সর্বনাশের সামান্য প্রতিবিম্বও দেখেছেন মাধববাবু।
এমনি তালগোল পাকিয়ে যদি সবকিছু চলত তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ এর মধ্যে রয়ে গেছে। তারাই আজও এই পরিবর্তনের স্রোতের-মুখে দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করে—আঁধারে পথ খোঁজে। তারাই দুঃখ পায় বেশি, কষ্ট পায়—তবু মাথা নোয়ায় না।
এই চরম বিপদেও নীতা আজ তাই উঠেপড়ে লেগেছে।
ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গিয়ে কেমন করে মেশিনে মন্টুর একটা পা-আটকে যায়। ফোরম্যান ওর কাছেই ছিল, তক্ষুণি মেশিন বন্ধ করে টেনে বের করেছে। মন্টু প্রাণে-বেঁচে আছে মাত্ৰ। অজ্ঞান হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। অবশ্য কোম্পানি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে, এই দুর্ঘটনার জন্য। সব ব্যবস্থাও করছে তারা।
নীতা খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটেছে।
এ এক অন্য জগৎ। এখানে কে কার কড়ি ধারে। নার্স ডাক্তাররা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে—বন্ধুবিহীন জগৎ। তারই মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে নীতা। বিশাল বিশ্বে সে যেন হারিয়ে গেছে দুঃখের তমসায়।
মন্টুর জ্ঞান অল্প অল্প ফিরেছে। ডাক্তার নির্দেশ দেন—আজই ব্লাড চাই।
—ব্লাড!
—হ্যাঁ, ব্লাডব্যাঙ্কে টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে যান। দাম দিলে হয়তো ব্লাড মিলবে।
দাঁড়াবার সময় নেই নীতার। তাড়াতাড়ি বের হয়ে এল। মেডিক্যাল কলেজের বড় বাড়িটার দিকে পা বাড়ায় সে।
কর্মব্যস্ত মহানগরী। তারই স্রোতে খড়কুটোর মতো এ-ঘাটে ও-ঘাটে ভেসে ফিরছে একটি মেয়ে। সারাটা দিন কেটে গেছে তার নানা ঝামেলায়। রক্ত আনতে কখনও ছুটেছে, কখনও ছুটেছে ইনজেকশন ওষুধ কিনতে। সব ঝামেলা চুকিয়ে যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তখন হাসপাতালের ঘন সারিবদ্ধ দেওদার গাছের মাথায় পড়ন্ত দুপুরের অভ্ররোদ গেরুয়া হয়ে আসে। ঘামে-নেয়ে উঠেছে। সারা দিন নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। একটু জিরিয়ে বিকালে মন্টুকে দেখে বাসায় ফিরবে সন্ধ্যা নাগাদ।
কি ভেবে আমহার্স্ট স্ট্রিটে গীতার বাসার দিকে চলতে থাকে নীতা। এ সময়ে সনতের সঙ্গে দেখা হওয়ার দরকার। নিজেকে অত্যন্ত অসহায় মনে করে। এ অবস্থায় সনৎ যেন তাকে ভরসা দিতে পারবে—আর ভরসা পেত শঙ্কর থাকলে। কিন্তু সেও বাইরে চলে গেছে—অনেক দূরে। একা দাঁড়াতে হবে তাকে বিপদের মাঝে—সামলাতে হবে সবকিছু।
একাই চলবে সে! কেমন যেন মনের মধ্যে একটা সুর বেজে ওঠে। নিজেকে যখনই একক সত্তা হিসেবে দেখেছে তখনই মনে হয় ঝড়ের কি সুর বাজে তার মনে। ওই উদাস হাওয়া আনে তার মনে অদম্য ক্ষমতা—প্রেরণা। মহাজীবনের বিচিত্র প্রকাশ। দুঃখ-জয়ের সাধনা! ছোট্ট রুমালটা দিয়ে ঘাম মুছে এগিয়ে চলে। দুপুরের শহর আবার ধীরে জেগে উঠেছে!