মেঘে ঢাকা তারা : 02
গভীর রাতে নীতা চুপ করে বসে আছে। আলোটা জ্বালেনি, কেমন মাঝে মাঝে এই আবহাওয়াটা অসহ্য ঠেকে। পালাতে ইচ্ছে করে এই পরিবেশ থেকে। এড়িয়ে গিয়ে বাঁচাতে চায়।
বাবাকে দেখেছে কোনো কিছুতে যেন হুঁশ নেই। এ কান দিয়ে মায়ের কথা শোনে, ও-কান দিয়ে বের হয়ে যায়। মন তাঁর অন্য চিন্তায় ব্যস্ত বই কাগজপত্র না অতীতের গল্প-স্মৃতিতেই মন ভরপুর! এই জগতে বাঁচার পথ করে নিয়েছেন। হয় একে এড়িয়ে ভুলে গিয়ে বাঁচার না হয় একে জয় করার চেষ্টা করবে সে। এই দুঃখের অভাবের কালো ছায়া থেকে—আলোর দিকে নিয়ে যেতে হবে সবাইকে। কল্পনা করে একটি সংসারের; দাদা রোজগার করছে, মন্টুও বড় হয়ে চাকরি করবে। সার্থক একটি সংসারের কল্পনা।
…কার পায়ের শব্দ! মাধববাবু এগিয়ে আসেন অন্ধকারে।—শুয়ে আছিস নীতা? শরীর খারাপ?
নীতা বিছানায় উঠে বসে—না, এমনিই।
বাবা কি যেন বলতে গিয়ে ইতস্তত করছেন।
—যা, উঠে গিয়ে পড়াশোনা করগে’ সামনে পরীক্ষা।
…সংযত স্বল্পবাক ওই আত্মাভোলা লোকটির মনেও নীতার জন্য ব্যথা বেজেছে।
স্ত্রীর সম্বন্ধেও কিছু বলতে চান না তিনি। বলে ওঠেন—পীরগঞ্জের দিনগুলো ভালোই ছিল নারে?
নীতার মনে পড়ে, বাবার সম্মান, প্রাচুর্য সেখানে ছিল। মাধববাবুই বলে চলেন—সে সব আর ভেবে কী হবে বল?
মুহূর্তের সেই অতীত সত্তার সমস্ত চিন্তাটুকুও দূর করে ফেলতে চান তিনি।
—যা, পড়তে বসগে। আমিও খাতাগুলো দেখে নিই। আজ খালধার থেকে টাটকা পুঁটি কিনে এনেছি, খেয়েছিলি তো? এখানে পুঁটিগুলোও যেন শুকিয়ে গেছে!
কাদম্বিনী নিজেও বুঝতে পারে নিজের পরিবর্তনটা। ক্রমশ বদলাচ্ছে সে। পীরগঞ্জের সেই লক্ষ্মী-শ্রী হারিয়ে—আজ একটা ধ্বংস-স্তূপের মতো বসে আছে অতীতের স্মৃতি-শ্মশানে। নইলে একদিন কিছু হয়তো খরচ করে এসেছে নীতা ভাইবোনদের জন্য, এমনি ভাবে তাকে কথা না শোনালেও পারত।
মাঝে মাঝে জ্বলে পুড়ে মনটাও বিষিয়ে ওঠে, এই ছাই-এর অতল থেকে সেই চির জাগর মাতৃহৃদয় ঠেলে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু অসহায় সে, দৈনন্দিন বাঁচবার চেষ্টা তাকে সব ভুলিয়ে অন্য মানুষ, অমানুষ করে তুলেছে।
রাত নেমেছে নীরব কলোনিতে, ঘুমের আবেশে মগ্ন চারিদিক। আবছা চাঁদের আলোয় জোনাকজ্বলা আমবাগানের আঁধারে হাওয়া ছোটে—হু হু হাওয়া, জেগে আছে কাদম্বিনী। সমস্ত ভাবনা তার মাথায় চেপেছে।
শঙ্কর তো সংসারের একটা বাড়তি খরচ। আয়ের বেলায় নেই, দিনরাত নিজের খেয়াল নিয়েই আছে। ওই গান আর গান। মাধববাবুর বয়স হচ্ছে, স্কুল থেকে রিটায়ার করতে হবে। ভরসা নিজের দু-চারটে টিউশানি আর নীতার চাকরি। গীতাকে দিয়ে কি হবে জানেন না।
এখন থেকেই ও মেয়ে মাথাঠাড়ো, একবগ্গা। কারও কথা শুনবে না। সে নিজের বেশবাস আর প্রসাধন, কলোনি বেড়ানো নিয়েই মত্ত। মন্টু, সেও ছোট!
কাদম্বিনীর চোখের সামনে যেন জমাট অন্ধকার, আতঙ্কের অন্ধকার। তার মাঝেই পথ হারিয়ে সব স্নেহ-ভালবাসা বিসর্জন দিতে বসেছে সে।
তারাগুলো চিকিমিক করছে আকাশে। নীতার ঘুম আসছিল মাত্র। হঠাৎ কার স্পর্শে চমকে ওঠে। অবাক হয়ে যায়—মা!
ডাকতে গিয়ে থেমে গেল নীতা। মাকে এইভাবে দেখে খুশি হয়, ভালো লাগে। মা মাথার দিককার জানলাটা খুলে দিয়ে বালিশটাকে ঠিক করে মাথাটা তুলে দিচ্ছে তার। একটু শ্যাম স্নেহস্পর্শ মায়ের! নীতা ওই দুর্বলতাটুকু যেন টেরই পায়নি। চুপ করেই থাকে নীতা।
নিজের মনেই বলে চলেছে কাদম্বিনী—সারাদিন ভূতের খাটুনি খেটে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা।
আলো নিভিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে চলে যায় মা।
নীতা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে খুশি মনে; জানলার বাইরে চাঁদের আলো ঢাকা সবুজ নির্জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু সুর উঠছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে সুরটা; মধুর একটা অনুভূতি!
শঙ্কর রেওয়াজ করছে; নীতা উঠে বসে বিছানায়।
পথ হারানো একটি ভ্রমর খুঁজে নিয়েছে পথ। অসীম শূন্যে জাগে তার ক্লান্ত পাখার গুঞ্জরণ! বাতাসে জাগে রজনীগন্ধার সৌরভ। সনতের মুখখানা মনে পড়ে। হাসিমাখা সুন্দর একটি মুখ। ওই সুরে মিশিয়ে আছে বসন্তের পুষ্পসৌরভ, আশার আলো আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গ্লানির মাঝেও মানুষের অন্তরের মাধুর্য সন্ধান।
মুগ্ধ হয়ে যায় .নীতা। শঙ্কর জানে না তার সুরের পরিধি, সীমানা। নিজে এর ওর কাছে হাত পাতে; দুঃখ সহ্য-করে ও জানে না কতজনের দুঃখ জয়ের সাধনায় ওর সুর জোগায় অনুপ্রেরণা। কস্তুরীমৃগ সৌরভের সন্ধান জানে না—উৎস খুঁজে পাগল হয়ে বনে বনে ফেরে।
….রাতের হাওয়া বইছে। …শন শন, একটা শব্দ। দূরাগত আশা আর আনন্দের বাণী। শরীরের কোষে কোষে রোমাঞ্চ জাগে। মনে আসে দুর্বার সাহস, শান্তির স্তিমিত গাঢ়তা!
ঘুম ছেয়ে আসে দু’চোখে। নিবিড় ঘুম।
বিনিদ্র রজনীর মাঝে একক জেগে আছে শঙ্করের এই সুর—নিটোল মধুর একটি সুর। দরবারি রেওয়াজ করছে শঙ্কর। রাত্রির মধ্যযাম ঘনিয়ে আসে।
মাধববাবুর রিটায়ার করবার আদেশ হয়ে গেছে। স্কুল থেকে একদিন সমারোহ করে মিটিং ডাকা হয়েছে বিদায়-সংবর্ধনা জানাবার জন্য। অবসর গ্রহণ, মাস্টারের অবসর গ্রহণ মানে—শেষ জীবনের দিন কটা অনিশ্চিত উপবাসের মধ্যে কাটানোর প্রস্তুতি!
নবীন মুদি বাকি বকেয়া সব মিটিয়ে নিতে এসেছে। হাসেন মাধববাবু — পালাচ্ছি না নবীন! তোমার টাকা তুমি সবই পাবে।
নবীন আমতা আমতা করে—না না, সিডা কি কন? কইতে আছিলাম এমনিই। তলাস নিতে এলাম কেমন আছেন।
প্রাইভেট ছাত্ররাও কেমন যেন কমছে। হাসেন মাধববাবু।
—ওরা স্কুলের মাস্টার মশায় না হলে পড়বে না; প্রমোশনের জন্য হেডমাস্টার মশায়কে রেকমেন্ড করবে, পরীক্ষায় কোশ্চেন দাগ মেরে দেবে—এই না হলে মাস্টার? কি-রে মদনা?
মদনের দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। বার কয়েক ফেল করার পর সে এখন কলোনির নবারুণ সংঘের সেক্রেটারিগিরি করছে আর প্রাইভেটে স্কুলফাইনাল পরীক্ষা দেবার চেষ্টা করছে।
মদনের এসব বালাই নেই, সেই বলে ওঠে,
—ওদের কথা ছাড়ান দেন স্যার। পরীক্ষায় পাশ করাডাই কি বড়? দম নিয়ে শুরু করে মদন বিজ্ঞের মতো—আসল ব্যাপারটা হইতে আছে শিক্ষার কথা, জ্ঞানের কথা, কন তাই কিনা?
মাধববাবু হাসতে থাকেন।
মনে মনে তবু মানতে পারেন না। কোথায় নিদারুণভাবে পরাজিত হয়েছেন তিনি। চলমান জীবনের ভিড় থেকে তিনি সরে এলেন বাতিলের দলে। তবু শক্ত হবার চেষ্টা করেন তিনি, ছেলেদের ভরসা দেন-তোদের ভাবনা নেই। ইংরাজি অঙ্কে আটকাবে না।
আসবি, যা বলি করে যা তোরা। স্কুলে কী হয় বল?
পরক্ষণেই সামলে নেন—এত ছেলের মাঝে কতটুকুই পড়াবার সময় পেতাম ক্লাসে?
মাধববাবু যেন নিজেই সান্ত্বনা খুঁজছেন।
—ভাবছি এবার ইংরাজি নোট, টেক্সট বুক লিখব।
বৃদ্ধ বয়সে নতুন করে জীবন শুরু করতে চান তিনি, অদম্য উৎসাহে।
নীতা সংসারের অবস্থা বুঝতে পেরেছে। বাবার চেহারা কদিনেই যেন অনেক খারাপ হয়ে গেছে একটি দুশ্চিন্তায়। নীতাই অভয় দেয়।
—এত কি ভাবো বাবা? যেমন করে হোক দিন চলে যাবেই। একটা ভালো টিউশানি পেয়েছি। সপ্তাহে দুদিন বাংলা পড়াতে হবে এক ভাটিয়া ভদ্রমহিলাকে। মাসে পঞ্চাশ টাকা মাইনে।
মাধববাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন; তখনকার দিনে ছিল মেয়ের স্বামী ভাগ্য, স্বামীর ঘর-সংসার সম্পদ শ্রী। এইছিল তাদের গর্বের বস্তু। এখন, চাকরি, না হয় টিউশানি। দু’মুঠো খেয়ে পেরে শুধু বেঁচে থাকবার প্রচেষ্টায় ক্ষণিক সার্থকতা। তাই নিয়ে ওরা খুশি থাকে। চাকরির স্বপ্ন দেখে।
দিন বদলেছে। নীতা বলে চলেছে—পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ইনটারভিউ আসবে বাবা। বি-এটা দিয়ে নিই এর মধ্যে।
কাদম্বিনী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, একমাত্র আশা-ভরসা ওই মেয়ে। নীতা টিউশানি আর মাস্টারির টাকা মায়ের হাতেই পুরো তুলে দেয়। গত মাসের সেই কথাগুলো ভোলেনি। তাই বোধহয় এই রকম করেছে সে।
কাদম্বিনী বলে ওঠে—তোর জন্য রাখ কিছু। নিজের খরচ তো আছে।
সেই ঘটনার পর থেকে মেয়ের সঙ্গে সে যেন ভালো করে কথা বলতে পারেনি। কোথায় একটা সঙ্কোচে বাধতো। ওই টাকা থেকে দু’খানা দশ টাকার নোট মেয়ের হাতে তুলে দেয় সে।
—নে রাখ এগুলো।
চুপ করে ওটা নিল নীতা। কাদম্বিনী মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। দরদ-ভরা কণ্ঠে বলে কাদম্বিনী—খেটে খেটে হাড়কণ্ঠা সার হয়েছে নীতা, তার উপর সংসারের কাজকর্ম! তুই বাপু গীতাকে বুঝিয়ে বল ঘর-সংসারের কাজ একটু করুক। তুই কোন দিক সামলাবি? পড়া—চাকরি! কি দশা হয়েছে শরীরের দেখেছিস আয়নায়?
নীতা হাসে—দেখবার সময় কই? তাছাড়া বেশই আছি, তুমি ভেবো না।
কাদম্বিনীর বুক দীর্ণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কত স্বপ্ন দেখেছিল সে, ভালো ঘরে ভালো বরে বিয়ে দেবে মেয়ের। বড় মেয়ে তার, সাধ-আহ্লাদ ছিল। কিন্তু!
সব সবুজ আজ রোদপোড়া তামাটে প্রান্তরের নিঃস্বতায় হারিয়ে গেছে রূপ! পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তায় মেয়েটাও কেমন শুকিয়ে গেছে। ও যেন ব্যর্থ যৌবনের বেসুরো বীণা–ওতে সুর ফোটে না। ঝরাফুল-রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ সবই যেন হারিয়ে গেছে। গীতা বৈকালে বেড়াতে বেরুবে—মায়ের কথায় থামল। একরাশ এঁটো বাসনপত্র রয়েছে, নীতা টিউশানি সেরে ফিরে এসে তাই নিয়ে মাজতে বসে। ঝি-রাখবার ক্ষমতা নেই।
কাদম্বিনী বলে ওঠে গীতাকে –ঢলানি করতে যাওয়া হচ্ছে কোথায়? সাজবেশ ছেড়ে বাসনকোশনগুলো মেজে দাও।
গীতার আজ স্কুলে থিয়েটারের রিহার্সাল আছে। রেলপারের গুপিদা আসবে। মিত্তিরবাড়ির গুপিদা, আধুনিক গান যা গায়, গীতার মনে সেই সুরের রেশ। কেমন ভালো লাগে ছেলেটাকে। স্মার্ট, রঙিন পোশাক পরে। মায়ের কথায় ওর সুর যেন ছিঁড়ে যায়।
আমতা আমতা করে গীতা।
—একটু কাজ ছিল যে মা। জরুরি কাজ।
—কাজ তো ওই পেখম মেলে বেড়ানো। সব দেখাচ্ছি!
গীতা বলে ওঠে—আর কেউ করুক আজ আমার সময় নেই।
চটে ওঠে মা—কথা শোনো, বাপ যে দাসী-বাঁদী পাঁচটা রেখেছে?
শঙ্কর বাড়ি ঢুকেই মাকে বকতে দেখে এগিয়ে আসে—খাম্বাজ রাগিণী ভাঁজছো না তো? দপ করে জ্বলে ওঠে কাদম্বিনী-লজ্জা লাগে না তোর! এতবড় মরদ বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস? দুধের মেয়ে একটা দিনরাত খেটে তোর জামাকাপড় হাতখরচা জোগাচ্ছে; তোর কি কোনো কাজই নেই, তুই কেবল তা-না-না করবি?
হাসে শঙ্কর—ফর মানি মাদার। দেখবে টাকা আমিও রোজগার করব। এখনই পারি, কেবল ওস্তাদ বাধা দেন। দুটি বছর কোথাও ফাংশন করবে না। একেবারে তৈরি হয়ে বেরোবে।
কাদম্বিনী সঙ্কটে পড়েছে শঙ্করকে নিয়ে
গীতা ফাঁকা খুঁজছিল, পথ পেয়ে সটান সরে পড়ে সে।
মা ছেলের জবাবে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ওর বয়সি কত ছেলে সংসারের হাল ধরেছে। রোজগারপাতি করছে ভালোই। মিত্তিরদের গুপি গান গেয়ে থিয়েটার করেও কেমন চালাচ্ছে। নৃপেন দোকান দিয়েছে, নটবর চাকরি করে। আর তার ছেলে বেকার? নির্লজ্জ-বেহায়া গণ্ডমূর্খ! কাদম্বিনী কথাটা ভাবছে আর মনে মনে জ্বলে-পুড়ে উঠেছে। আজ অসহায় রাগ কোনরকমে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে।
—তোর ওস্তাদের দাড়ি নেই; দাড়ি?
শঙ্কর সহজ ভাবেই জবাব দেয়—হ্যাঁ! এই বড় মেহেদি রং-করা সুন্দর দাড়ি আছে।
দপ্ করে জ্বলে ওঠে কাদম্বিনী—তবে সেই দাড়ি ধরেই দু’বছর ঝুলে থাক্গে? এখানে কেন?
ফেটে পড়ে কাদম্বিনী—মেয়েরও অধম তুই। আশপাশে দেখ সোমত্ত ছেলেকে বাড়িতে কে পুষছে? কোনো কাজকর্ম না পাস ভিক্ষে করগে বাইরে! হাত পাতগে—
—মা! শঙ্করের মনে একটু নরম জায়গায় হাত পড়তেই চমকে ওঠে সে। এতদিন এত কথা সহ্য করেছে, আজ বোঝে মা সত্যই দেখতে পারে না তাকে। এত দিনরাত্রির সাধনা সিদ্ধির দ্বারে এসে থেমে যাবে! তবুও সে এতবড় আঘাত আর সইবে না, রাগ বস্তুটা তার এমনিতেই কম কিন্তু মান-অপমান বোধ আর মুছে যায়নি মন থেকে।
নীতা পড়ছিল ঘরে, মায়ের কথাগুলো শুনে বের হয়ে আসে। নিজের উপরই লজ্জা আসে তার। মা যেন কেমন খেপে উঠেছে, চারিদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে খেপে ওঠা বিড়ালের মতো, শেষ আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে নখ দাঁত বের করে রুখে দাঁড়িয়েছে। রাতের সেই ক্ষণিকজাগা স্নেহময়ী মা সংসারের চাপে হারিয়ে গেছে।
ঘর থেকে নীতা বের হয়ে দেখে, শঙ্কর সদর দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে।
—দাদা! চিৎকার করে ডাকে নীতা।
শঙ্কর ফিরে দাঁড়াল। কাদম্বিনী কথাটা বলে ফেলে অপ্রস্তুত হয়ে গছে। বাসনের গোছাটা নিয়ে নিজেই খিড়কির ঘাটে গিয়ে বসেছে। শঙ্কর ফিরে দাঁড়াল নীতার দিকে তাকিয়ে।
—কোথায় যাচ্ছো?
—একটা কাজকর্মের চেষ্টাই দেখব নীতা, এখানে আর চলে না। কিছু না পাই একটা ফিরিওলা তো হতে পারি। ট্রেনে ট্রেনে দাঁতের মাজন, হাতকাটা তেল—বেশ সাধা গলায় হেঁকে হেঁকে ফিরি করব।
অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠে নীতা। সেই রাত্রে দেখেছে পরেশকে। ফিরিওয়ালার জীবন—এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে মৃত্যুকে পরিহাস করে যাওয়া তার প্রাত্যহিক ঘটনা। দাদার মতো একটা শিল্পী নিছক বাঁচবার জন্য এমনি করে দিনাতিপাত করবে এ যেন ভাবতেই পারে না সে। সারা মন অজানা ব্যথায় ভরে ওঠে তার!
—কেন? নীতার কণ্ঠে বেদনার সুর।
দাদার প্রতিভার উপর আস্থা আছে তার। এ সাধনা বৃথা যাবে না। সেই রাত্রের সুরটি মনে পড়ে; বিচিত্র একটি অনুভূতি, অন্য কোনো মধুময় জগতের অনুসন্ধান! অপরকে এগিয়ে দেবার অনুপ্রেরণা তার সুরে—অথচ জীবনের সেই মাধুরিমার সন্ধান নিজেই সে জানে না। শঙ্কর বলে চলেছে—
—তুই নাকি মাকে বলেছিস, আমি জোর করে তোর কাছ থেকে হাতখরচের টাকা আদায় করি। বাড়িতে ভাত ধ্বংস করছি!
—মায়ের কথায় কান দিস্ না দাদা! একদিনের কথায় নিজের এতদিনের কঠিন সাধনা, ভবিষ্যৎ নষ্ট করবি? ব্যর্থ করে দিবি সবকিছু! তোর ওপর আমার কত আশা-ভরসা। দাদা!
নীতার কণ্ঠে আবেগ ফুটে ওঠে।
শঙ্কর মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। ওর আন্তরিকতা শঙ্করের হৃদয় স্পর্শ করেছে। কেমন যেন ভরসা পায়। নীতাই বলে,
—না-না! তুমি শিল্পী, তুমি গান গাইবে, কেউ তোমায় বাধা দেবে না।
— সত্যি!
—হ্যাঁ, দুটো বছর তুমি চালিয়ে যাও দাদা। এ কষ্ট কিছুটা সইতে হবে। নাহলে সুর বের হবে কেন?
হাসছে শঙ্কর—ঠিক বলেছিস নীতা। নইলে সুর বেরোবে কেন?
আজ তার কাছে গোটাকতক টাকা ছিল, তাই তুলে দেয় নীতা আড়ালে ওর হাতে।
—আর নেই আপাতত, থাকলে দিতাম। এই নাও এ মাসে।
শঙ্কর বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ বাড়িতে অন্তত একজন আছে যে তার সাধনায় সাহচর্য করেছে। এই সমর্থন তাকে সব দুঃখ-কষ্ট সইবার অনুপ্রেরণা জোগায়, শক্তি দেয়।
নীতার মনে খুশির হাওয়া। চার দেওয়ালের বেষ্টনীর বাইরে মুক্ত উদার আকাশে ডানা মেলে উধাও হতে চায় মন। সনৎ এসেছে দেখা করতে মাধববাবুর সঙ্গে।
মাধববাবু একগাদা খাতা বই নিয়ে ব্যস্ত। সনৎকে দেখে হঠাৎ বিস্মৃতির বোঝা ঠেলে ওঠেন। আরে সনৎ? এসো এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম। দেখো, যেসব নোট আজকাল বাজারে চলে তাতে ছাত্রদের পরকালই নষ্ট হয়! তাই ভাবলাম একটা নোট লেখা যাক। কি বলো? এই যে, লিখেও ফেললাম প্রায়। ক্লজ ফ্রেজ-ইডিয়মস্ তারপর ধর রেফারেন্সও এক আধটু দিচ্ছি। অন্তত তারা জানবার চেষ্টা করুক। বসো বসো।
মাধববাবু খুশিই হয়েছেন অনেকদিন পর এক পুরনো ছাত্রকে দেখে। হ্যাঁ, তারপর কী করছ? পড়াশোনা?
সনৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল—এম.এ. পাশ করলাম স্যার। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি।
নীতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এক মুহূর্ত! মাধববাবুর মুখে একটা বিষাদের ছায়া খেলে যায়। আবছা—অস্পষ্ট! নিজের জীবনের ব্যর্থতার কথা মনে পড়ে। দারিদ্র্য আর অভাবের চাপে তিনি বেশিদূর পড়তে পারেননি। তখনকার এফ.এ. পাশ করেই থামতে হয়েছিল। সেই ডিগ্রি-হীনতার ক্ষতি দুঃখ সারা জীবন তার দশগুণ পড়াশোনা করেও ভুলতে পারেননি। ছাত্ররা তাঁরই হাতে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে এক একে। কেউ প্রফেসার, কেউ বড় অফিসার, ব্যবসাদার হয়েছে। কিন্তু? এক মুহূর্তেই সেই চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলেন। জীবনের শেষ সীমায় এসে এখনও মনে হিংসা!
হাসছেন মাধববাবু, নিজের মনের এই নীচতা দেখেই হাসছেন বোধহয়। বলেন। –বাঃ! ওগো শুনেছ, সনৎ ভালোভাবে পাশ করেছে। করবে না? কার ছাত্র দেখতে হবে তো!
কাদম্বিনীও এসে দাঁড়িয়েছে; সনতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন ভাবছে সে মনে মনে। একটা ক্ষীণ আশার সুর জাগে কাদম্বিনীর মনে।
—তা এবার কি করবে ভাবছো? চাকরি-বাকরি? প্রশ্ন করে কাদম্বিনী।
—কিছু ঠিক করিনি। সনৎ জবাব দেয়।
—ঠিক করার কী আছে? চেষ্টা করো, রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে যাবে। তারপর পি-এইচ- ডি.! বুঝলে। বুড়ো মাস্টারকে সেদিন ভুলো না কিন্তু। আমি মানুষ চিনি। কার দ্বারা কি হয় তাও জানি। সেই দিনেই জানতাম—ইউ স্যাল সাইন।
নীতার দু’চোখে হাসির আভা। সে আজ খুশি হয়েছে।
কাদম্বিনীও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
গীতা গুন গুন করে গান গাইছে ওঘরে আপনমনে, আধুনিক গানের একটা বিশ্রী আবেদনময় কলি। নীতারই যেন লজ্জা আসে।
কাদম্বিনী কি ভেবে ওঘর থেকে বেরিয়ে এসে গীতাকে ডাক দেয়—গীতা শোন!
গীতা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সনতকে দেখে দাঁড়াল।
কাদম্বিনী বলে,
—চল বাবা, তোমরা গল্পগুজব করগে বাছা। এই গীতা, তোর সনৎদা এসেছে রে। বুঝলে বাবা, ও তো তোমার নাম প্রায়ই করে। আমি চা-টা নিয়ে আসছি। কই গো তুমি খাতাগুলো শেষ করো! রান্নাঘরে একটু হাত লাগাবি চল নীতা, অনেকদিন পর সনৎ এসেছে!
নীতা মায়ের কথায় একটু অবাক হয়ে ওর সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
মাধবমাস্টার একাই বসে আছেন ঘরে। কাজে মন বসে না। চুপ করে তামাক টানছেন, ছিটে বেড়ার দেওয়ালে একটা চালকুমড়ো লতা জড়িয়ে রয়েছে সবুজ বেষ্টনিতে। আজ জীবনের প্রান্তে এসে বেহিসেবি মন ভাঙা হিসেবের টুকরো জোড়াবার বৃথা স্বপ্ন দেখে। সারা জীবনটাই অপচয় করে এসেছেন, কাটিয়েছেন পরের ছেলেকে মানুষ করে। কিন্তু বুকই পুড়েছে প্রদীপের, চারিদিকে আলো বিকীর্ণ করে, নিজের জড়-দেহটার পা বেয়ে গড়িয়ে পড়েনি প্রদীপের তেল—পিলসুজের নিচের মতো অন্ধকার কোনদিনই ঘোচেনি।
শঙ্কর পড়া ছেড়ে দিল, মন্টুও পড়বে কতদূর কে জানে? খেলা নিয়েই ব্যস্ত। গীতাও কেমন এক অন্য ধরনের। ওদের পরিণতি কি তা ভেবেও শিউরে ওঠেন তিনি। রাস্তাঘাটে ট্রেনে, ওই ধরনের মেয়েদের দেখেছেন। নির্লজ্জ ভঙ্গিতে চলেছে তারা! বেপরোয়া। সভ্যতার নাম যে এই তা ভাবতে পারেন না তিনি।
দিন কাল কি হল দেখতে দেখতে। পীরগঞ্জের সবুজ ছায়াঘেরা দিগন্তসীমা, মধুমতীর তীর আজ স্বপ্নে পর্যবসিত হয়েছে, নিঃশেষে হারিয়ে গেছে।
জীবনের সবই বাজে খরচের খাতে বয়ে গেছে। জমা? জমারঘরে যেন একটা শূন্যতা! কোনো আঁচড়ই তাতে নেই।
হুঁকোর আগুনটাও নিভে গেছে। আবছা অন্ধকারে গুম হয়ে বসে আছে মাধবমাস্টার। সংসারের বাতিল একটি প্রাণী মাত্র।
কাদম্বিনী আশা হারায় নি। সনতের উপর তার হঠাৎ আজ যেন নতুন আশার উদয় হয়েছে। অন্য আশা। সংসারের আবশ্যকীয় প্রাণী আজ নীতা। সংসার তাকে ছাড়তে পারে না। জীবিকার সংস্থান করে সে। রূপ! রূপের দিক থেকেও সে দেউলিয়া, সনতের মতো এমন ছেলের সঙ্গে যদি গীতার সম্বন্ধ হয় কাদম্বিনী একটা মহা দায় থেকে উদ্ধার পাবে।
কি যেন ভাবছে কাদম্বিনী।
গীতা সাজগোজ করে বেরোবার জোগাড় করছে, কি এক অন্য জগতের নেশা তার মনে। সদ্যচেনা সেই জগৎ, গানের সুর আর মুক্ত সবুজ দিগন্তের বুকচেরা পথ ধরে ছুটে যাওয়া, একটু হাসি, স্পর্শ! গীতার সদ্যজাগর বুভুক্ষু মনে আদিম তৃষ্ণা এনেছে
তাই ছুটে চলেছে গীতা, জল না মরীচিকা জানে না। তবু ছুটছে নেশার ঘোরে। গলায় ঘাড়ের নিচে পাউডারের পাফটা বোলাতে বোলাতে মায়ের ডাকে জবাব দেয়—আঃ যাচ্ছি! কোনো কাজ করতে পারব না বলে দিচ্ছি কিন্তু।
মা রান্নাঘরে নীতাকে নিয়ে বসেছে। লুচি বেলছে নীতা, মা ভাজছে।
গীতাকে ঢুকতে দেখে কাদম্বিনী তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। রূপ এমনিতেই আছে গীতার, সামান্য প্রসাধনেই তা প্রকাশ পেয়েছে, ওর নিপুণ প্রসাধনের দিকে তাকিয়ে একটু আশ্বস্ত হয় মা।
—খাবারগুলো ওঘরে দিয়ে আয়, সনৎ কখন থেকে একা একা বসে আছে।
—তা আমি করব কী? আমার বলে গানের রিহার্সাল শুরু হবে। জানো না বাবার ফেয়ারওয়েলে ধুমধাম হবে স্কুলে?
কাদম্বিনীর মুখে বিতৃষ্ণা আর অবজ্ঞার ভাব ফুটে ওঠে, ঠোঁট উলটে বলে—হুঁ!
অর্থাৎ একজনের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার মতো নীচতাকে ওরা ফুলমালা পরিয়ে একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করণীয় মহৎ কাজ বলে ঘোষণা করতে চায়।
—নিয়ে যা খাবারগুলো। চা পরে নিয়ে যাবি।
ওর হাত দিয়ে চা-খাবার পাঠিয়ে কাদম্বিনী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। নীতা চুপ করে বসে থাকে। মা যেন কী একটা কাজে ব্যস্ত।
জানলার ফাঁক দিয়ে কাদম্বিনী তাকিয়ে আছে নির্লজ্জের মতো ঘরের দিকে; সনতের চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন ফুটে ওঠে কিনা তাই দেখছে বোধহয়।
গীতার সময় নেই। কোন রকমে চা-খাবারগুলো নামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে—গানের ক্লাস আছে, চলি সনৎদা!
সনৎ পড়ন্ত বেলার মিঠে রোদে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে; ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল মেয়ে। কাদম্বিনী গজগজ করতে থাকে।
কাজ সেরে নীতা ঘরে ঢুকছে। কদিন নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সে।
সনৎ তাকিয়ে আছে নীতার দিকে। বেশবাসের কোনো চাকচিক্য নেই। পরনে একটা আটপৌরে শাড়ি, এলো চুলে ঘাড়ের কাছে খোঁপায় বাঁধা; কালো চোখের তারায় হাসির মিষ্টি আভা।
বৈকালের সোনারোদ ম্লান হয়ে আসে।
সনৎ প্রশ্ন করে—পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
নীতা এতদিন শখের জন্যই পড়ছিল বোধহয়। এবার সে প্রাণের দায়ে যেন পড়ছে। বি. এ. পাশ করতেই হবে তাকে। অনার্স পাবে কিনা সন্দেহ। তবু চেষ্টা করে চলেছে সে।
সনতের কথায় ম্লানভাবে হাসে। মিষ্টি, বেদনামধুর একটু হাসি।
—হচ্ছে একরকম। সময় পাচ্ছি কই?
—চলো, দিনরাতই তো পড়ছ, একটু বেড়িয়ে আসবে স্টেশনের ওদিকে।
কি ভেবে উঠে দাঁড়াল নীতা। আধময়লা শাড়িখানাই ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে উশকো-খুশকো চুলগুলোতে চিরুনি বুলিয়ে শিপারটা খুঁজতে থাকে।
এই তার সাধারণ পোশাক, তবু সনতের মনে হয় কালো মেয়েটিকে এই সাধারণ রূপেই সুন্দর দেখায় সবচেয়ে বেশি।
—একটু আসছি মা।
কাদম্বিনী নীতার কথায় জবাব দিল না, গীতা আগেই বের হয়ে গেছে। কাদম্বিনী মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। সনৎ যাবার মুখে বলে যায় :—চলি মাসিমা!
কোনরকমে ভদ্রতাটুকু রাখবার চেষ্টা করে কাদম্বিনী—এসো আবার
এগিয়ে আসে দরজা পর্যন্ত। ওরা বের হয়ে যেতেই চুপ করে দাঁড়াল, কার উপর রাগ করবে জানে না। গীতার উপর না নীতার উপর ঠিক বুঝতে পারে না কাদম্বিনী।
নীতা পিছন ফিরে দেখে মা কেমন যেন বিশ্রীভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এই বেড়াতে বেরোনোটা ঠিক যেন পছন্দ করে না মা।
কি ভেবে দৃঢ়পদে এগিয়ে চলে নীতা। তার মনে একটা ঝড় উঠেছে। একটা বাধার অস্তিত্ব জেগে উঠেছে নীতার মনে। হু হু ঝড় ওঠে তাই।
এককালে ছিল পরিত্যক্ত মাঠ। এখন গড়ে উঠেছে উপনিবেশ। মাঝে মাঝে তৈরি হয়েছে কোঠাবাড়ি, টিনের চাল দেওয়া দরমার বাড়ি। মূলিবাঁশের বেড়ায় উঠেছে কুমড়োলতা; কোথাও বা মস্ত জলা। দু’একটা আম নারিকেল গাছ ছিটিয়ে রয়েছে, গড়ে উঠেছে কলাবাগানের সবুজ আবরণ। এঁকেবেঁকে খালটা চলে গেছে লাইনের দিকে; আবছা অন্ধকার ঢাকা আকাশ—গাছগাছালি পাখির ডাকে ভরে ওঠে চারিদিক। নিকানো আকাশের আঙিনায় দু-একটা করে তারা ফুল ফুটে ওঠে।
একটা শান্ত-নিথর পরিবেশ। ওরা বসে আছে দু’জনে। সনৎ আর নীতা। কাছাকাছি দুটি সত্তা যেন চিন্তায় একাত্ম হয়ে গেছে।
সনতের সামনে একটা সমস্যা। এতদিন অভাব-অভিযোগের মধ্যে পরের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আজ তার সামনে একটু স্বস্তির সন্ধান। একটা চাকরি-বাকরি, একটু ছোট্ট বাসার আভাস তার মনে ফুটে ওঠে।
নীতা বলে ওঠে—ভাববার এত কিছু নেই। এখনই চাকরি করবে না, আরও পড়বে, রিসার্চ করবে। যদি পি-এইচ. ডি হতে পারো তখন চাকরির অভাব হবে না। আর দু’একটা বছর কষ্ট করো।
—কিন্তু সে তো অনেক খরচাও।
নীতার মনে দৃঢ়তার ছায়া; সামান্য পাওয়াতে সে তৃপ্ত নয়। জীবনের সব কঠিন বাধা উত্তীর্ণ হয়ে সে মহত্তর জীবনের স্বপ্ন দেখে, সাধনা করে। বলে ওঠে—কিছু টাকা স্টাইপেন্ড পাবে, বাকি যদি আমি চাকরি নিই তার থেকে যাহোক করে হোক manage করা যাবে।
নিঃসঙ্কোচে বলে নীতা। সনতের বাধ বাধ ঠেকে।
—তোমার টাকা? কত নেব বলতে পারো?
নীতা ওর দিকে তাকাল; গোধূলির শেষ আলোয় কালো আকাশের বুকে তখনও গাঢ় লাল আবিরের আলপনা; কালো মেয়েটিকেও সুন্দর দেখায়। ওর দু’চোখের চাহনিতে নিবিড় একটি আমন্ত্রণ। ওর হাতখানা তুলে নিতে নীতা বলে ওঠে—নেবার মতো একটা পরিচয় পাকাপাকি গড়ে তুলো তখন
সনৎ কি ভাবছে কোথায় রাতের প্রথম আঁধারে ডাকছে পাখি; জোনাকির আলো আশমানে ঘুরে বেড়ায়।
অবাক হয়ে গেছে সে ওর দ্বিধাহীন আত্মনিবেদনের সুরে। দীর্ঘ দশ বছর দেখে এসেছে নীতাকে; মেয়েরা বোধহয় এমনিই। প্রথমে দ্বিধা-সংকোচ থাকে, কিন্তু যাকে আপন করে নেয় তারা, সেখানে কোনো ফাঁক আর ফাঁকি থাকে না। নীতা আজ নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে আসতে পেরেছে।
—কেন, ভয় পাচ্ছো নাকি? নীতার দু’চোখে হাসির আভা।
মিষ্টি এক ঝিলিক হাসি। ওই শীর্ণ-পরিশ্রান্ত মেয়েটিও আজ সুন্দর আকর্ষণীয় করে তুলেছে নিজেকে, মনের অতলের আনন্দ আর সুরের পরশে।
রাতের আঁধারে জাগে বকুলগন্ধ; সনৎ যে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
নীতার মনে প্রথম যৌবনের সাড়া; বলে চলেছে—পরে না হয় শোধ দিও। কোথাও বেড়িয়ে আনবে।
—কোথায়?
—দুরে! অনেক দূরে! ধরো কোনও পাহাড়ের রাজ্যে। উঁচু মেঘছোঁয়া পাহাড়, পাহাড়ের পর পাহাড় আর ঘন সবুজ পাইন বন। পাইন বনে ঝড় উঠবে। মাতাল ঝড়। …হঠাৎ হেসে ফেলে নীতা; হাসছে! নিজের আকাশছোঁয়া কল্পনায় নিজেই হাসছে। সনৎ হঠাৎ ওর হাসি দেখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। গলার সুর হালকা করে বলে ওঠে—নীতা।
—মাঝে মাঝে কি যে আজে-বাজে স্বপ্ন দেখি। মাথা-ও নেই মুণ্ডু-ও নেই! মাগো।
-–কেন? সেখানে যাওয়া কি সম্ভব নয়? তুমি আর আমি। আমি তোমায় নিয়ে যাব নীতা।
সনতের মনে একটা বাস্তব স্বপ্ন, নীতা কি যেন ভাবছে।
শন শন জাগে রাতের বাতাস; তারার প্রতিবিম্ব দুলছে খালের জলে।
—নীতা!
সনৎ ওকে কাছে টেনে নেয়, সব বাধা আজ দূর করে দিতে চায়। চমকে উঠেছে নীতা। …ওর হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ওর ঠোঁটে লাগে উত্তপ্ত স্পর্শ; উষ্ণ নিশ্বাস ছোঁওয়া দেয় ওর গালে। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে নীতা।
দু’চোখ বুজে আসে। প্রতিবাদ করতে চায় না যেন, এটুকু নিঃশেষে পেতে চায় সে।
—ওঠো! রাত হয়ে এলো।
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে আসে তারা; সিগন্যালের নীল আলোটা মিটিমিট জ্বলছে।
মাধববাবু হ্যারিকেনের আলোয় বসে একগাদা কাগজ-পত্র নিয়ে বই লিখে চলেছেন একমনে। তামাক সেজে নিয়ে কাদম্বিনীকে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হন। কাদম্বিনী আজ কাজকর্ম সেরে একটু কথা বলবার জন্য এসেছে!
—তুমি! ও!
কলকেটা হুঁকোসমেত ওঁর হাতে তুলে দিয়ে কাদম্বিনী বসল। মাধববাবু ঠিক বুঝতে পারেন না ব্যাপারটা।
বলে চলেছে কাদম্বিনী—সনৎ ছেলেটি বেশ! ক’বছরেই মানুষ হয়ে উঠেছে। শুনছিলাম চাকরি-বাকরির খোঁজও আসছে। আসবে না? এম.এ পাশ। লুফে নেবে ওকে কত অফিস থেকে।
মাধববাবু মাথা নাড়েন—উহুঁ! কেরানিগিরি কি করবে? জুয়েল একটা, থিসিস সাবমিট করুক ও। পি-এইচ. ডি হবে। আমি বলে দিয়েছি চাকরি-বাকরির মোহে পড়ো না বাবু, পড়াশোনা করো।
কাদম্বিনী হঠাৎ ফোঁস করে ওঠে—হ্যাঁ, আর তোমার মতো পচে মরুক। ওই স্বভাব কি কোনদিনই বদলাবে না? নিজে ভুগছো সেই ভালো, আর পাঁচজনকে ওই জাহান্নামে টানা কেন?
মাধববাবু চুপ করে কাদম্বিনীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আর কথা বলা নিরাপদ নয়, এখুনিই শুরু হবে নানা কথা। মাধববাবু এসব ক্ষেত্রে চুপ করেই থাকেন শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে হয়।
কাদম্বিনী বলে চলেছে—গীতার সঙ্গে ওকে মানাবে বেশ। আর দুটিতে ভাব-সাবও খুব মনে
মাধববাবু কোনো কথাই বলেন না। কাদম্বিনীর শীর্ণ দারিদ্র্যপীড়িত চেহারায় ক্ষণিকের জন্য একটা দীপ্তি ফুটে ওঠে। একটু হেসে বলে চলে—এমন সোনার চাঁদ ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা।। আর দেখতে শুনতে গীতাই বা মন্দ কি। তুমি বাপু বাগড়া দিও না। সনৎ চাকরি-বাকরি যদি ভালো পায় নিক। মেয়েকে বিদেয় করে আমরাও স্বস্তি পাই।
মাধববাবু মনে মনে শিউরে ওঠেন, মুখে-চোখে একটা বিবর্ণতা ফুটে ওঠে। কি যেন বলতে গিয়ে হঠাৎ দরজার কাছে নীতাকে দেখে থামলেন।
নীতা ঘরে ঢুকছিল, অজানতেই সামনে একটা সাপ দেখে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। মায়ের কথাগুলো শুনেছে সে, পায়ের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। সারা মনে কেমন হাহাকার ভরা শূন্যতা। নিজের কালো কুৎসিত রূপের কথা ভেবে মন গুমরে কেঁদে ওঠে। একটা নিষ্ঠুর কালো দৈত্য তার কাছ থেকে সব যেন ছিনিয়ে নিতে চায়, তার সব সঞ্চয়।
কাদম্বিনী তীক্ষ্ণ-সন্ধানী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর তীব্র নগ্ন দৃষ্টির সামনে নীতার মনের সব হতাশাই প্রকাশ পায়। কাদম্বিনী বৈকালে ওর সনতের সঙ্গে বের হয়ে যাওয়াটা পছন্দ করেনি। মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিল, ওর দৃষ্টিতে এখনও ফুটে ওঠে সেই রাগের জ্বালা।
নীতা চোরের মতো সরে গেল ওর কঠিন দৃষ্টিপথ থেকে, নিজের বিক্ষত মনের দৈন্য অপরের সামনে প্রকাশ করার দুর্বলতা সহ্য করতে পারবে না সে। সরে গেল তাই।
মাধববাবু অবাক হয়ে যান নীতার ব্যবহারে। হুঁকোটা নামিয়ে কি ভাবছেন। সনৎ আর নীতা!
দু’জনকে যেন বারবার একই সত্তার পৃথক অস্তিত্ব বলে মনে হয়। মাধববাবু বলেন—এ ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখো বড়বউ।
—ভাববার কিছুই নেই। এমন ছেলে মিলবে না আর। বুঝলে!
মাধববাবু স্ত্রীর দিকে নির্বাক বেদনাহত ভাবে তাকিয়ে থাকেন।
নীতা চুপ করে ঘরে বসে আছে। একজনকে ঘিরে তার সব আশা-ভরসা-স্বপ্ন যেন ব্যর্থ হয়ে যেতে বসেছে। ওর গালে তখনও সনতের উষ্ণ চুম্বনরেখার স্পর্শ মিলিয়ে যায়নি।
মনে কোথায় একটা সুর বাজে! আঁধারতল থেকে জেগে ওঠে একটা সুর, মনের সঙ্গোপনে মধুর স্পর্শের সুর। দুঃখের মধ্যেও আশা জাগে—সান্ত্বনা জাগে।
ওদিকে গীতা আর মন্টুর মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে চুলোচুলি হবার উপক্রম। পিঠোপিঠি ভাইবোন। গীতা অকারণেই বলে ওঠে—ফোথ্ ক্লাস! ফোথ্ ক্লাস বারো আনা।
ওই ব্যাপারটা গীতা নিজে দেখেছে শহরতলির কোন সিনেমা হাউসের পাশে এবং সে দলে মন্টুও নাকি ছিল।
মন্টু লাফ দিয়ে ওঠে—মারব এক রদ্দা, মুখের জিয়োগ্রাফি বদলে দোব। চোর কোথাকার! কেন আমার পয়সা নিবি তুই?
—ইস্! গীতা বঙ্কিম ভঙ্গিতে রুখে দাঁড়িয়েছে বইপত্র ফেলে।
কাদম্বিনী আজ গীতার ব্যবহারে বেশ চটে রয়েছে। সনতের সঙ্গে ভালো করে কথাই কয়নি মেয়ে। অন্য কিসের মোহে যেন বেভুল হয়ে আছে গীতা। ধমকে ওঠে কাদম্বিনী।
—হাঁদা মেয়ে কোথাকার! যেমন পড়াশোনায় গবেট তেমনি সব দিকেই। ওর পয়সা নিয়েছিস কেন? আর তুইবা পয়সা পেলি কোথায় মন্টু।
গীতা বলে ওঠে—পয়সা? ওমা, জানো না বুঝি? কলোনির মাধু-অসীমের সঙ্গে গিয়ে জয়শ্রী সিনেমায় টিকিট ব্ল্যাক-মার্কেটে বেচে ওরা। ফোখ্ কেলাস ফোথ্ কেলাস। মন্টু রাগে ফুলে উঠেছে। হঠাৎ ফেটে পড়ে গীতার কথায়। আর তুই? বলব? সেদিন মিত্তিরদের গুপিদার সঙ্গে লক্কা পায়রার মতো-
—থাম মন্টু! মা বকে ওঠে।
তবু কাদম্বিনী মনে মনে চমকে ওঠে; মিত্তিরবাড়ির ছেলে-মেয়েদের নানান বদনাম। নানা কারবার থেকে শুরু করে নানা ভাবে জীবিকা অর্জন আর দিনাতিপাত করে তারা। কলোনির মধ্যে ওদের চালচলন সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিগ্ধ। নিজের মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে তাদের কথা উঠতেই শিউরে ওঠে সে। গীতার দিকে তাকাল। গীতা লাফ দিয়ে উঠে মন্টুকে ধরতে যায় চিৎকার করে। –মিথ্যুক, –মিথ্যাবাদী কোথাকার! গীতা কি লুকোতে চাইছে মায়ের কাছ থেকে।
—কোথা গিয়েছিলি মুখপুড়ি?
আজ বৈকালে তার সব আশায় ছাই দিয়ে ও মেয়ে কোন চুলোয় গিয়েছিল তা বেশ বুঝতে পারে। আজবাদ কাল মেয়ের বিয়ে দেবে, সেই মেয়ে কিনা ঢলিয়ে বেড়াচ্ছে আজও। মা ধমকায়—বেশরম মেয়ে, যাবি আর কোনদিন? তাই বুঝি এত সাজগোজ। আজবাদ কাল কিনা বিয়ে দিতে যাচ্ছি ওই মুখপুড়ির!
গীতা বলবার চেষ্টা করে—গান শিখতে গিয়েছিলাম।
—গান! একজন গান গেয়ে সংসারকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলে, আবার সেই গান! খবরদার যাবি না।
খপ্ করে মা তার চুলের মুঠিটাই ধরেছে।
—মা! নীতা গোলমাল শুনে বের হয়ে এসেছে। বলে ওঠে—এতবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলবে?
—তবে কি দুধকলা খাওয়াব? ছিঃ ছিঃ। সবই আমার বরাত। এক-এক জন এক-এক পদের! জানলে আঁতুড়ে নুন খাইয়ে শেষ করে দিতাম। হবে না-ই বা কেন? যা দেখবে তাই তো শিখবে।
চমকে ওঠে নীতা। মা যেন তাকে শোনাবার জন্যই কথাগুলো বলছে। কাদম্বিনী আপন মনেই বলে ওঠে—লোকে কি কিছু দেখতে পায় না? এত রাত অবধি বাইরে ছিলি কোথায়? এক ভাবি—হয় এক!
মন্টু গীতা চুপ করে গেছে। ওরা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিদিকে নিয়ে পড়েছে মা। কাদম্বিনী বকে চলেছে—এ বাড়িতে আর লক্ষ্মী থাকবেন না কোনদিন। সব শান্তি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ছিঃ ছিঃ এত অনাচার!
নীতা সরে এল ঘরের ভিতর।
মায়ের উপর রাগ হয়। এই হীন মন্তব্যের জবাব সে দিতে পারে এখনই। সনৎকে নিয়ে এই ঘৃণ্য ইঙ্গিতের জবাব
কলোনির অনেক মেয়েই কীভাবে জীবিকা অর্জন করে তা সে জানে। দত্তদের বাড়ির লতিকা, রেলপারের মল্লিকা আরও কতজন শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরে। তাদের জীবিকার পথ কত অন্ধকারে ঢাকা তা তার জানতে বাকি নেই।
আর সে! স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই পরিচিত হতে পারে ইচ্ছে করলে। এ তার ভুলই যদি .হয়—সামান্য এই ভুলটুকুও ক্ষমার চোখে দেখেনি মা!
মনের সব শ্রী আজ কুশ্রী হয়ে উঠেছে। জীবনের সব আনন্দের ভোজ থেকে সে বাতিল একটি প্রাণী, সংসার আর অপরের জন্যই তার এই উদয়াস্ত পরিশ্রম। জীবনের কোনো সৌন্দর্য, কোনো ভবিষ্যৎ স্বপ্নে তার অধিকার নেই। মা যেন বিকটাকার দানবের মতো তার চাওয়া-পাওয়ার সব পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। নইলে তাকে প্রশ্ন না করেই সনৎকে নিয়ে গীতার জন্য ভাবতে পারত না। মা হয়তো সব কিছু জেনেশুনেই এড়িয়ে গেছে—নীতাকে তাদের প্রয়োজন বলেই ছাড়তে নারাজ।
একটা সুর উঠেছে রাত্রির আকাশে। তারাজ্বলা আকাশকোলে কেঁপে কেঁপে স্নিগ্ধ প্রদীপশিখার মতো উঠছে ওই সুরের রেশ। জ্বালাভরা মনে একটা শান্তির ক্ষীণ আভাস আনে। ঊষর প্রান্তরে যেন নেমেছে বৃষ্টির ধারাপাত। তৃপ্ত হয়ে উঠেছে শুষ্ক সবুজ স্বপ্ন ব্যর্থ বন্ধ্যা মৃত্তিকায়।
গান গাইছে শঙ্কর। স্তব্ধ রাত্রির রাগ। নীতার দু’চোখে জল নেমেছে।
নামুক! ধুয়ে-মুছে যাক সব চিহ্ন, অভিসারিকার চোখের কাজলরেখা! একাই চলবে সে সারা পথ, জীবনের দীর্ঘ বন্ধুবিহীন বন্ধুর পথ!
গুপি মিত্তির মাধু সেন আরও কজন ছেলের উৎসাহে আর মাস্টারদের সহযোগিতায় মাধববাবুকে বিদায়-অভিনন্দন জানাবার আয়োজন করা হয়েছে স্কুলের মাঠে। চিত্র-বিচিত্র জামাপরা গুপি তদারক করছে সব কিছু। দেবদারু পাতা, কলাগাছ, মঙ্গলঘট সহ ঘটা করে বিদায় দেবার কোনো আয়োজন তারা বাকি রাখেনি। সব কিছুই রয়েছে। গুপি আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
কে বলে ওঠে—অ্যাই হেডমাস্টার মশায় আসছে।
গুপি সিগারেট কসে টানতে থাকে, বলে ওঠে—এখন আর ছাত্র নই বাবা, ওর ইজ্জতের দাম স্রেফ দু’পয়সা। ফেলে দিলে সিগ্রেটটাই যাবে—এখনও কোম্পানি পোড়েনি যে রে?
সদ্যধরানো সিগ্রেটের অর্ধেকটা শেষ হয়েছে মাত্র। কোম্পানির নাম লেখা জায়গাটা অবধিও এখনও পোড়েনি। মাস্টার মশায় ভাগ্যক্রমেই এগোলেন না ততদূর। বোধহয় ভূতপূর্ব ছাত্রদের গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে নিজেই সরে গেছেন।
ওদিকে ফাংশন শুরু হয়েছে! ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় পরেশকেও। গুপি বলে ওঠে—কিরে, আজ ডিউটিতে যাবি না? হাতকাটা তেল—আশ্চর্য মলম?
বেশ একটা ব্যঙ্গই ফুটে ওঠে ওর কণ্ঠস্বরে।
হাসে পরেশ—না। মাস্টার মশাইকে প্রণাম করতে এলাম।
—খুব যে ভক্তি, যা চাট্টি বেশি ধুলো নে। বলি মতলবটা কি খুলে বল দিকি?
—এমনিই। পরেশ গুপির এই সন্ধানী দৃষ্টির সামনে যেন কেঁচো হয়ে রায়।
হাসছে গুপি। এইবার চুড়িওয়ালার ব্যবসা ধর; ফেরিওয়ালা থেকে চুড়িওয়ালার ব্যবসা ঢের লাভের। বুঝলি?
সরে গেল পরেশ।
গুপির চেলা মদন এসে খবর দেয়—না; এলো না গীতা।
একটা হতাশার খবর! গুপি চমকে ওঠে—কেন?
—বাড়িতে ওর মা নাকি নিষেধ করেছে। বিয়ে-থা হবে, এ সময় বেরোতে দেবে না। একেবারে নজরবন্দি করে রেখেছে।
গুপির চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। সিগারেটের স্বাদও পানসে ঠেকে। গজগজ করে—ধ্যুত্তোর! শালা খামোকাই তালে এত খাটাখাটনি করে মালা দিলাম ওই বুড়ো ঘাটের মরাকে? ঘুঘু মেয়ে দেখছি! কাজ সারা হল আর ওমনিই ফুঃ।
মদনা বলে ওঠে—আগেই জানতাম ইসের খবর। সনৎ না কে ওই যে আসে ওদের বাড়ি, এম-এ পাশ—
ধমকে উঠে গুপি–রাখ তোর এম-এ পাশ। ঢের দেখছি। আচ্ছা আমিও গুপি মিত্তির। বরিশালের লোক বাবা, আইতে শাল যাইতে শাল তবে জানবা বরিশাল। দেইখা লমু।
গুপি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে হনহন করে চলে গেল।
মাধবমাস্টার আজ ছেলেদের সামনে শেষ অভিভাষণ দিতে উঠেছেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীত জীবনের দিনগুলো। কত মুখ, কত স্মৃতি একটার পর একটা জেগে ওঠে, সব যেন গুলিয়ে যায়।
কাল থেকে আর স্কুলে আসবেন না তিনি। চল্লিশ বছরের মাস্টারি জীবনে যবনিকা নামল। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে, শীর্ণ কোটরাগত চোখ দিয়ে জল নামে। আবেগকম্পিত স্বরে তিনি বলে চলেছেন—সত্য আর জ্ঞানের আলোয় তোমাদের মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক, এই দুর্দিনের মাঝেও আমাদের বাঁচতে হবে। সেই বাঁচবার পথ দেখাবে প্রকৃত শিক্ষা আর জ্ঞান। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমরা জয়ী হও, সার্থক হও।
চোখ-মুদে বসলেন বৃদ্ধ মাধবমাস্টার।
একদিনেই তাঁর বয়স যেন বেশ কয়েক বৎসর বেড়ে গেছে। চলমান জীবনের ভিড় থেকে তিনি সরে যাবেন। কোনো ঠাঁই আর তাঁর নেই এই নিজের হাতে গড়া স্কুলে। প্রথম জলাভূমি আর জঙ্গল কেটে স্কুলপত্তন যাঁরা করেছিল তিনিও তাদের একজন।
সন্ধ্যা নামছে। কলরব-কোলাহল করে ছেলের দল চলে গেল। আকাশে দু-একটা তারা ফুটে উঠেছে। পথে নামলেন মাধববাবু।
—মাঝে মাঝে আসবেন মাস্টারমশায়! আপনাদের হাতে গড়া স্কুল।
ছোকরা হেডমাস্টার আমন্ত্রণ জানায় তাঁকে। মাধববাবুকে যেন সান্ত্বনা দিচ্ছেন তিনি।
হাসেন মাধবমাস্টার—না, না আসব বৈ কি বাবা। পরামর্শও দরকার। তোমরা তো ছেলেমানুষ, চল্লিশটা বছর এই কর্ম করলাম। ধর তোমার বয়েসিই মাস্টারি হবে আমার।
—তা বটে। একা যেতে পারবেন তো? অন্ধকার হলো।
চমকে ওঠেন মাধববাবু; বৃদ্ধ হয়েছেন—পথ চলতেও যেন অক্ষম তিনি, এই কথাটা আজ ওদের মনে গেঁথে রয়েছে। একান্ত অসহায় মনে করে তাঁকে। বলে ওঠেন তিনি—না না। চেনা-পথ। ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে।
অন্ধকারেই এগিয়ে গেলেন তিনি। জীবনের অন্ধকার ঢাকা বন্ধুর পথে হাতড়ে চলেছে একটি বাতিল মানুষ। চলতে যেন পারে না।
রাত্রির আঁধার নেমেছে বাড়িতে। নীতা গুম হয়ে পড়েছে। সামনে তার পরীক্ষা। পড়ার চাপ পড়েছে; এত পরিশ্রমের পর পড়তে শরীর বয় না—তবু পড়তে হয়। গীতা গান গাইছে—গুপি মিত্তিরের শেখানো আধুনিক গান। হালকা সুর উঠেছে, জানলাটা বন্ধ করে নীতা ধমকে ওঠে—চুপ কর গীতা।
কাদম্বিনী সাড়া দেয়—শঙ্কর হ্যা-হ্যা করলে তখন কানে বাজে না, বাজে এখনই! একটু গান গাইলে তোর এত কি অসুবিধা হয় বাপু? কেবল ওর পিছনেই লাগা।
নীতা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে পড়তে বসে।
হঠাৎ একটা আর্তনাদ কানে আসে। আঁধার রাতের বাতাস ওঠে শিউরে; কাঁপছে তারার রোশনি। গীতার গান থেমে গেছে। কাদম্বিনী চিৎকার করে কাঁদছে। ধড়মড় করে উঠে বাইরে এল নীতা।
হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় দেখে পরেশ, আরও কজন লোক ধরাধরি করে মাধব মাস্টারের অচেতন দেহটাকে তুলে এনেছে।
অন্ধকারে আসছিলেন—রেল লাইনের ধারেপাশে সিগন্যালের তারে পা-লেগে পড়ে যান মাধববাবু লাইনের উপর। শক্ত পাথরে ছেঁচে গেছে জায়গা জায়গা, মাথায় চোট লেগেছে— জামাকাপড়ে রক্তের দাগ। জ্ঞান তখনও ফেরেনি।
কাদম্বিনীকে থামাবার চেষ্টা করে নীতা—চুপ করো মা। এখন চ্যাঁচামেচি না করে স্থির হও।
পরেশ জল এনে মাথায় দিচ্ছে। কে পাখা করতে শুরু করেছে।
নীতাই স্থির মস্তিষ্কে এগিয়ে আসে, সমস্ত দায়িত্ব তুলে নেয়। বলে ওঠে—মন্টু ডাক্তারবাবুকে একবার ডেকে আন এখুনি।
ক্রন্দনরতা কাদম্বিনীকে ধমকে ওঠে নীতা – মা!
মাধববাবু চোখ বুজে পড়ে আছেন। রাতের অন্ধকারে মুখ বুজে সকলেই কী এক নিমোঘ বিধানের প্রতীক্ষায় বসে রয়েছে।
সংসারের রূপ এক মুহূর্তেই বদলে গেছে কাদম্বিনীর কাছে। নীতার চোখের সামনে অন্তহীন অন্ধকার, যেন ঢেউ-এর মাথায় ভেসে চলেছে হালভাঙা পালছেঁড়া এক নৌকা, কোথাও পারের নিশানা নেই। চারিদিকে তার উদ্দাম ফেনাভরা ঢেউ-এর মতো গর্জন। ছোট সংসারের জীর্ণ নৌকাখানাকে বানচাল করে দেবার উন্মত্ততা ওর চারিদিক ঘিরে।
ডাক্তারবাবু এসে গেছেন। নিবিষ্ট মনে নাড়ীটা দেখে চলেছেন তিনি। চোখ-মুখে তাঁর উৎকণ্ঠা।
ব্যাকুল কণ্ঠে পরেশ প্রশ্ন করে—ডাক্তারবাবু।
—দেখি কি করা যায়। তবে এত বেশি বয়সে স্ট্রোক একটু বিপদের কথাই।
নীতার চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে আসে। তবু নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে।
সনতের মনে আজ একটা দ্বন্দ্ব জাগে। একদিকে পরিশ্রম, দুঃখভোগ। মহত্তর জীবনের সাধনায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, সে পথের প্রান্তে কি আছে তাও জানা যায় না। নীতার মুখখানা আবছা মনে পড়ে। অনিশ্চিতের মধ্যে ওই একটু পথ
অন্যদিকে ছোট একটা চাকরি, একটু মনোমতো বাসা আর?…
একজনকে অকারণেই মনে পড়ে বারবার। কলেজ স্কোয়ারের আলো-আঁধারির মাঝে দেখা একটি নতুন মুখ,—দুটি চোখের নীরব আমন্ত্রণ। মরু-তীর হতে কোন্ সুধাশ্যামল জগতের আহ্বান। একটি মুহূর্তে তার অবচেতন মনে এমনি গভীর অতর্কিত একটি রেখাপাত করে রেখেছে ভাবতে পারেনি সে। ক্রমশ সেই উজ্জ্বল স্মৃতির স্পর্শ মনকে তার ছেয়ে ফেলেছে।
মন থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সনৎ। নীতার মুখখানা মনে জেগে ওঠে আবার।
—এই যে আছেন দেখছি।
এ মেসের ম্যানেজার শীতল নায়েক ঘরে ঢুকল। কোন কোম্পানির টাইপিস্ট, ঢলঢলে চেহারা, একটু নেওয়াপাতি ভুঁড়িও গজিয়েছে। হাতে রেমিংটন কোম্পানির রিবনের খালি কৌটো ভর্তি বিড়ি আর দেশলাই। যেন দয়া করে নিচেতলার চাকরদের এঁদো ঘরখানায় ঢুকছে শীতলবাবু।
স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে শতরঞ্চি পাতা–ও কোণে চালের বস্তার উপর কয়েকটা আরশোলা ঘুরছে, উড়ছে ফরফর করে। এই সনতের রাজ্য। ওকে দেখে অভ্যর্থনা জানায় সনৎ—আসুন, আসুন!
—না এসে আর কি করি বলুন দিকি? হপ্তার ছদিন ঘানি গাছে ঘুরি, সাতদিনের দিন বাড়ি যেতে হয় বটে। ঘরবাড়ি তো রইছে মশায়, রিফুজি লই তো। সাত ঝামেলা মালি মোকদ্দমা জমি-জারাত নিয়েই লবেজান হইছি। তা আপনার ডিউসটা? আজ্ঞে গতমাস থেকেই পড়ে রইছে। আপনারা লেখাপড়া-জানা লোক, আমাদের মতো ঘোড়ার পাতা বিদ্যে নিয়ে হ্যামারম্যানগিরি তো করেন না। দিয়ে দেন কেন্নে। ফেলাই দ্যান, লিয়ে যাই।
—শিগগির মিটিয়ে দোব এইবার। সনৎ আমতা আমতা করে। নিজেরই বিশ্রী ঠেকে ওই কথাগুলো। শীতল নায়েক জবাব দেয় তখুনিই।
—সে তো ঢের দিন থেকেই শুনছি; পড়াশোনা করছিলেন। এতদিন চুপ দিয়েছিলাম। ইবার এম-এ পাশ দিয়েও ঠায় বসে থাকবেন—আর আমরা বইবো খাই-খরচা ইটা কেমন কথা? লেগে যান কেন্নে চাকরিতে।
কথাটা চুপ করে শোনে সনৎ। পাশ করার পরই চাকরি, এই তাদের কাছে সোজা পথ। এর মধ্যে আবার অন্য কি করণীয় কাজ থাকতে পারে ছাপোষা শীতল নায়েক জানবে কি করে!
—তালে কালই দিছেন? সোজা কথা বলুন মশায়। নাহলে অন্য মেম্বার দেখতে হবেক। মেম্বারের কি ভাবনা? এত টাকা বকেয়া ফেলে দু’বেলা খেয়ে যাবেন?
সনৎ কি ভাবছে। নীতার কথা; কিছু টাকা আপাতত যদি পায় পরে টিউশানি নিয়েও শোধ করবে। তবু কষ্ট করেই দেখবে সে আরও দু-বছর।
জবাব দেয়—দু’এক দিনের মধ্যেই মিটিয়ে দোব।
—হ্যাঁ, তাই দেন নালে—
শীতল নায়েক বাকি কথা শেষ করল না, খড়মের শব্দ তুলে উপরে উঠে গেল। বাইরে আরও ক’জন মেসের লোক অপেক্ষা করছিল, তারা কি বলাবলি করে চাপা-স্বরে। সনতের ধৈর্য যেন ফুরিয়ে আসছে।
কি একটা দুঃসহ-জ্বালা তার মনে। একটা পথ তার চাই, নিজেকে আজ অত্যন্ত দুর্বল অসহায় মনে হয়। চাকরির সন্ধানও পেয়েছে। তবু শেষ চেষ্টা করবে সে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সনৎ।