ভাইয়া
গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে, যেখানে দারোয়ান এবং মালীরা সাধারণত বসে থাকে। ভাইয়া সেখানে বসে আছে। তার মুখ বিষণ্ণ। দেখেই মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। শরীর কি খারাপ করেছে? ভাইয়া এমন মানুষ যে শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করলেও কাউকে কিছু জানাবে না। হয়তো তার কাছে শারীরিক কষ্ট অরুচিকর ব্যাপার। যা অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়।
ভাইয়া এ বাড়িতে থাকতে আসার দিন পনের পরের কথা— বাবা এক সকালবেলা গাড়ি বের করে আমাকে বললেন টগরকে ডেকে নিয়ে আয়তে। ওকে কিছু জামাকাপড় কিনে দেব। ওতো ফকির মিসকিনের কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী, তুইও চল আমাদের সঙ্গে। আমি ভাইয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভার ঘটাং করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল। ভাইয়া গাড়ির দরজায়। হাত রেখেছিল, তার হাতের তিনটা আঙ্গুল থেতলে গেল। সে অস্পষ্ট গলায় শুধু বলল, উফ।
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
ভাইয়া বলল, কিছু হয় নাই।
বাবা বললেন, দরজায় হাত রেখে বসেছিলে কেন? গাড়িতে চড়ারও কিছু নিয়ম কানুন আছে। লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেই হয় না। ব্যথা পেয়েছ।
ভাইয়া চাপা গলায় বলল, না।
বাবা বললেন, ড্রাইভার চালাও, বনানী মার্কেটের দিকে যাও।
আমি বললাম, না। আগে কোনো ডাক্তারের কাছে চলে। ভাইয়া খুবই ব্যথা পেয়েছে, রক্ত পড়ছে। রক্তে তার সার্ট মাখামাখি হয়ে গেছে।
আমরা একটা ক্লিনিকে গেলাম। ক্লিনিকের ডাক্তার সাহেব বললেন, কী সর্বনাশ! এই ছেলের তো একটা আঙ্গুল ভেঙে গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান, কিংবা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান।
বাবা বিরক্ত মুখে বললেন, একটা আঙ্গুল ভেঙে গেছে তারপরেও কোনো শব্দ করে নাই। এ তো ডেনজারাস ছেলে। একে তো সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা দরকার।
টগর নামের অতি শান্ত অতি নম্র কিশোরটি একটি ডেনজারাস ছেলে এই চিন্তাটা বাবা মাথা থেকে কখনো দূর করতে পারেন নি। দূর কোনোদিন হবে বলেও আমার মনে হয় না। মানুষের প্রথম ধারণা সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। ভাইয়াকে এ রকম অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে আমার খুবই মায়া লাগল। এইখানে একটা ভুল কথা বললাম— ভাইয়াকে দেখলেই আমার মায়া লাগে। তাকে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলেও মায়া লাগে, আবার সহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলেও মায়া লাগে। আমি বললাম, শরীর খারাপ না-কি?
না। মৃ তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
এইখানে বলবে না ঘরে যেতে হবে?
ঘরে আয়।
কথা যা বলার এক মিনিটের মধ্যে বলে শেষ করতে হবে। আমার আজও ক্লাসে দেরি হয়ে গেছে।
তাহলে এখানেই বলি।
বলো।
ভাইয়া ইতস্তত করতে লাগল। আমি খুবই অবাক। এমন কী কথা যা আমাকে বলতে ভাইয়ার ইতস্তত করতে হচ্ছে। আমি ধমকের মতো বললাম, বলো তো কী বলবে।
আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি?
আমি হ্যান্ডব্যাগ খুলতে খুলতে বললাম, অবশ্যই পারব। বলো কত লাগবে পাঁচ শ টাকায় হবে?
পাঁচ শ টাকায় হবে না। অনেক বেশি টাকা লাগবে। কারো কাছ থেকে জোগাড় করে দিতে পারবি?
অবশ্যই পারব। বাবার কাছ থেকে এনে দেব।
টাকাটা যে আমার দরকার এটা জানলে বাবা দেবেন না।
বাবাকে বলব না। এখন দয়া করে বলে কত টাকা?
ষাট হাজার টাকা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ষাট হাজার টাকা! এত টাকা?
ভাইয়া নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ। বিকাল চারটার আগে টাকাটা লাগবে। মৃ পারবি?
না পারার তো কোনো কারণ দেখি না।
বিকাল চারটার আগে টাকাটা দরকার।
আমার মনে আছে। আমি কি জানতে পারি বিকাল চারটার আগে এতগুলি টাকা কেন দরকার।
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল— পরে বলি? এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।
বলতে ইচ্ছা না করলে তোমাকে কখনো বলতে হবে না।
থ্যাংকু য়।
আমি গাড়িতে উঠেই মোবাইল ফোনে বাবাকে টেলিফোন করলাম। ষাট হাজার টাকা বাবার জন্যে কোনো ঘটনাই না। বাবা টেলিফোন ধরলেন। কিছুটা অবাক হয়েই বললেন, মা ব্যাপার কী?
কোনো ব্যাপার না বাবা, আমার কিছু টাকা দরকার।
কখন দরকার?
আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরব একটার সময়। তখনই দরকার। তুমি কাউকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিও।
তেমন প্রয়োজন মনে করলে আমি রহমতকে দিয়ে তোর ইউনিভার্সিটিতেও পাঠাতে পারি।
ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে হবে না। বাড়িতে পাঠাও।
এমাউন্ট বল। এমাউন্টটা বেশি। আমার দরকার ষাট হাজার টাকা। Sixty thousand.
হঠাৎ এত টাকা। কী জন্যে দরকার বল তো?
সেটা এখন বলতে পারব না। ষাট হাজার টাকা তোমার জন্যে দেয়া কি কোনো সমস্যা?
না, সমস্যা না।
বাবা টাকাটা অবশ্যই দেড়টার মধ্যেই পাঠাবে। আমার দরকার চারটার আগে। তারপরেও কিছু সময় হাতে থাকা ভালো।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মৃ টাকাটা তোর দরকার না। অন্য কারোর দরকার। আমার ধারণা তোর কাছে টাকাটা চেয়েছে টগর। ধারণা কি ঠিক?
আমি বললাম, টাকাটা আমি তোমার কাছে চাচ্ছি। এটাই মূল বিষয়।
বাবা শান্ত গলায় বললেন, এটা অবশ্যই মূল বিষয় না। তুই আমাকে খোলাখুলি বল – টাকাটা কি টগরের দরকার?
হ্যাঁ।
কী জন্যে দরকার?
বাবা আমি জানি না। আমাকে ভাইয়া বলে নি।
ঠিক আছে আমি টেলিফোন করে টগরের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি।
তুমি অবশ্যই ভাইয়াকে টেলিফোন করবে না। ব্যাপারটা সে তোমাকে জানাতে চাচ্ছে না।
কেন জানাতে চাচ্ছে না? সে তোমাকে ভয় পায়।
পুরো ব্যাপারটায় ফিসি কিছু আছে। ফিসি কোনো ব্যাপারই আমার পছন্দ না। মৃন্ময়ী মা শোন, এই টাকাটা আমি দেব না।
আমি খুবই বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি দেবে না!
বাবা শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, না। টগরকে আমার কাছে আসতে হবে। ওকে এক্সপ্লেইন করতে হবে।
না দিলে দিও না, কিন্তু ভাইয়াকে এ বিষয়ে দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
আচ্ছা। জিজ্ঞেস করব না।
বাবা টেলিফোন রেখে দিলেন।
আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। বাবা অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষ। বুদ্ধিমান মানুষ কখনো তার প্রিয়জনদের সঙ্গে এমন রূঢ় আচরণ করে না। আমি একটা ছোট্ট ভুল করেছি। আমার বলা উচিত ছিল— টাকাটা আমার নিজের ব্যক্তিগত কোনো কারণে দরকার। কারণটা এখন ব্যাখ্যা করতে পারছি না। পরে ব্যাখ্যা করব। মিথ্যা বলা হতো। আমি নিজে মিথ্যা বলার জন্যে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকতাম। কিন্তু বেচারা ভাইয়া উদ্ধার পেত। সে নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়েছে।
মোবাইল ফোন বাজছে। বাবা টেলিফোন করেছেন। ফোন সেটে তাঁর নাম্বার ভাসছে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। এই অভদ্রতাটা করা কি ঠিক হবে? হয়তো বাবা টেলিফোন করেছেন সরি বলার জন্যে। হয়তো তিনি মত বদলেছেন। রহমত চাচাকে টাকা দিয়ে পাঠাচ্ছেন। মানুষের ভেতর সব সময় জোয়ার ভাটার খেলা চলে। এই রাগ এই ভালোবাসা। এই মেঘ এই রৌদ্র।
মৃন্ময়ী।
হ্যাঁ বাবা।
তুই কি এখনো পথে।
হ্যাঁ জামে আটকে পড়েছি।
ক্লাসের দেরি হয়ে গেল না?
রোজই হচ্ছে। তুমি কী বলার জন্যে টেলিফোন করেছ সেটা বলে ফেল।
মৃন্ময়ী শোন, তুই মনে হয় আমার ওপর রাগ করেছি। পুরো ব্যাপারটা তোকে ঠাণ্ডা মাথায় দেখতে হবে।
বাবা আমার মাথা এখন মোটেই ঠাণ্ডা না, কাজেই ঠাণ্ডা মাথায় আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। পরে তোমার সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করি।
আলোচনার কিছু নেই। আমার যা বলার আমি এখনি বলে শেষ করব। আমার ধারণা আমার কথা শোনার পর কথার পেছনের লজিক তুই ধরতে পারবি। জগতটা আবেগের না মা। জগতটা লজিকের। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে কোনো আবেগে ঘুরছে না। লজিকে ঘুরছে।
এই লজিক সৃষ্টির পেছনে কিন্তু কাজ করেছে আবেগ।
সেটা তো আমরা জানি না। লজিকটা আমরা জানি। যা জানি কথা হবে তার ভিত্তিতে।
বেশ বলো তোমার লজিক।
বাবা শান্ত গলায় বললেন, টগর হলো এমন এক ছেলে যার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। ডিগ্রি পরীক্ষা দুবার দিয়েছে। এই তার যোগ্যতা। প্রতি মাসে আমার কাছ থেকে যে টাকাটা হাত খরচ হিসেবে পায় এটাই তার বর্তমানের রোজগার এবং হয়তোবা ভবিষ্যতের রোজগার। এই পর্যন্ত যা বলেছি ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তার কিছু বন্ধু বান্ধব আছে যারা ছায়া জগতের বাসিন্দা। দু একজনের পেছনে পুলিশ ঘুরছে। যা বলছি ঠিক আছে মা?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
এখন টগর নামের অপদার্থ ছেলেটার হঠাৎ ষাট হাজার টাকার দরকার পড়ে গেল। বাবা হিসেবে আমি প্রথম যে চিন্তাটা করব তা হলো সে বড় কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে। টাকা দিয়ে ঝামেলা মেটানো যায় না। টাকায় ঝামেলা বাড়ে। টাকাটা না দিয়ে আমার উচিত খোঁজখবর করা ঘটনা কী?
তোমার টাকা দিতে হবে না। তোমার প্রতি আমার একটাই অনুরোধ তুমি এই নিয়ে কোনো খোঁজখবর করবে না। ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
তোর অনুরোধ রাখব। এবং আশা করব তুইও আমার কথা রাখবি।
তোমার কী কথা?
টগরের টাকাটা অন্য কোনো সোর্স থেকে জোগাড় করার চেষ্টা করবি না।
আমার আর কোনো সোর্স নেই।
তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে। সোর্স বের করা তোর জন্যে কোনো সমস্যা না।
থ্যাংক য়ু ফর দি কমপ্লিমেন্ট। বাবা টেলিফোন রাখি?
টেলিফোন রাখার আগে তুই কি স্বীকার করৰ্বি আমি যে কথাগুলি বলছি তার পেছনে যুক্তি আছে?
হ্যাঁ স্বীকার করছি।
বাবা টেলিফোন রেখে দিলেন।
পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস। আমি উপস্থিত হলাম চল্লিশ মিনিট পর। ক্লাসে ঢুকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। টিচার নেই। কাওসার স্যার ক্লাস নিতে আসেন নি। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। কেউ কেউ ডিজাইন টেবিলে বসে কাজ করছে। তবে বেশির ভাগই গল্প করছে। ফরিদা বলল-ইউনিভার্সিটির কারেন্ট গুজব শুনেছি? আমাদের বিখ্যাত গরু স্যার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়েছেন।
আজ ক্লাসে আসেন নি এই কারণেই এমন গুজব?
তিনি গত তিনদিন কোনো ক্লাসে আসছেন না। তিনদিন আগে থেকেই বাজারে গুজব ভাসছে। দুই রকমের গুজব। একটা হলে তিনি চাকরি করবেন না রেজিগনেশন লেটার দিয়েছেন। দ্বিতীয়টা হলো ইউনিভার্সিটি তার চাকরি নট করে দিয়েছে। দুটা গুজব যখন বাজারে চালু থাকে তখন দুটা গুজবের একটা সত্যি হয়। কোনটা সত্যি কে জানে!
যেটাই সত্যি হোক ফলাফল তো একই।
তা ঠিক। আমরা গুজব অনুসন্ধান কমিটি করেছি। আমি সেই কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আজ বিকাল চারটার মধ্যে রিপোর্ট দেয়া। তুই আমার সঙ্গে কাজ করবি?
না।
আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্যারের নাম্বারে টেলিফোন করেছি। সেই নাম্বারে কেউ ধরছে না। ইউনিভার্সিটি থেকে ঠিকানা নিয়ে তার বাসায় গিয়েছি। সেখানেও কেউ নেই। তবে বিভিন্ন জায়গায় স্পট লাগানো আছে। খোজ বের হয়ে পড়বে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে হয় তোর প্রচণ্ড মন খারাপ নয় তোর খুব ক্ষিধে লেগেছে। কোনটা সত্যি?
দুটাই সত্যি। আমি সকালে নাশতা করি নি। এবং আমার মনও খারাপ।
ক্যান্টিনে নাশতা করে নে। ভেজিটেবল রোল আছে, গরম গরম ভাজছে। নাশতা খেয়ে আয় তোর সঙ্গে গোপন কথা আছে। খুবই গোপন। সিক্রেট টু দা হাইয়েস্ট ওয়ার্ভার।
মুখ প্যাঁচার মতো করে রাখলে–গোপন কথা বলা যাবে না। মনের দুঃখ এক পাশে সরিয়ে–আমার কাছে আয়। গোপন কথা শুনে যা।
আমি ফরিদার দিকে তাকালাম। যত দিন যাচ্ছে এই মেয়ে তত মোটা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে তার বিশাল শরীর নিয়ে মোটেই চিন্তিত না। মনের সুখে খাওয়া দাওয়া করছে। ক্লাসের শেষে বাড়ি যাবার আগে অবশ্যই সে আইসক্রিম খাবে। সে একা খাবে না। সঙ্গে যারা থাকবে তাদের সবাইকে খেতে হবে। মানুষকে নানান ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। ফরিদী এমন মেয়ে যাকে কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবে না।
ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম সেমিস্টার শুরুর দিনে ফরিদা সবাইকে একটা কাগজ পাঠাল। কাগজের ওপর লেখা জন্মদিন–জানিয়ে দিন।
তার নিচে গুটি গুটি করে লেখা–
সহযাত্রী বন্ধুদের অনুরোধ করা যাচ্ছে–তাঁরা যেন তাদের জন্মদিন এই কাগজে লিখে দেন। যাতে ক্লাসের পক্ষ থেকে এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে আমরা জন্মদিন পালন করতে পারি।
ফরিদা তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। জন্মদিন পার্টি হচ্ছে। ফরিদা একাই একশ। কথায় কথায় ‘খুবই গোপন। সিক্রেট টু দি হাইয়েস্ট ওয়ার্ডার’ বলা তার মুদ্রাদোষ।
ভেজিটেবল রোল খেতে খেতে মাকে টেলিফোন করলাম। মা তাঁর স্বভাব মতো উল্লসিত গলা বের করলেন, মৃ তুই বিশ্বাস করবি না এক মিনিট আগে। মনে হলো তোর টেলিফোন আসছে। আমার মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে আসছে। মোবাইল অফ ছিল। এক মিনিট আগে অন করেছি। কারণ আমি নিশ্চিত তুই টেলিফোন কবি। টেলিপ্যাথির কথা অনেক শুনেছি এই প্রথম নিজের চোখে দেখলাম। কী যে অবাক হয়েছি। এখনো গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে আছে। তোর সঙ্গে গাড়ি আছে না? তুই এক কাজ কর গাড়ি নিয়ে হুট করে চলে আয়–আমার গায়ের নোম যে খাড়া হয়ে আছেনিজের চোখে দেখে যা। আসতে পারবি?
না আসতে পারব না। তোমার মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাচ্ছে আমি কাজের কথা সেরে নেই।
বল তোর কাজের কথা দাঁড়া এক সেকেন্ড তোর কাজের কথার আগে আমি আমার নিজের কথা বলে নেই, পরে ভুলে যাব। আমার বেলায় এটা খুব বেশি হয়। সময় মতো কথা বলা হয় না বলে কখনোই বলা হয় না। কথাটা হলো– আমি মোজা বানাতে পারে এমন একজনের সন্ধান পেয়েছি, তিনি আমাকে মোজা বানানো শিখিয়ে দেবেন। তিনি পায়ের মোজা বানাতে পারেন আবার হাত মোজাও বানাতে পারেন।
ভালো তো।
কোন মোজাটা বানাব সেটা বুঝতে পারছি না। স্ক্রীপ্টে কিছু লেখা নেই। তোর কী মনে হয়?
ডিরেক্টর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।
প্রতি দশ মিনিট পরপর তাঁকে টেলিফোন করছি। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না।
মা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমি কি আমার কথাটা বলতে পারি?
তোর ষাট হাজার টাকা দরকার এই তো কথা?
জাননা কীভাবে?
তোর বাবা টেলিফোন করে আমাকে জানিয়েছে যেন আমি টাকাটা না দেই।
ও আচ্ছা।
মৃ শোন উলের মোজা সাধারণত কোন কালারের হয় বল তো?
মা আমি জানি না কোন কালারের হয়। আমি নিজে কখনো উলের মোজা পরি না।
তুইও পরেছিস। জানুয়ারির সাত তারিখ তোর জন্ম। প্রচণ্ড শীত। তোর হাতে পায়ে উলের মোজা পরিয়ে রাখতাম। ছবিও তোলা আছে।
মা এখন রাখি।
রাখতে হবে না। আমার মোবাইলের ব্যাটারি একদম শেষ পর্যায়ে। এক্ষুণি বন্ধ হয়ে যাবে। পিক পিক শব্দ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি না?
পাচ্ছি।
আয় আমরা কথা বলতে থাকি। ব্যাটারিও শেষ। আমাদের কথাও শেষ।
বেশ কথা বলে।
তুই এমন রাগী রাগী গলা করে রাখলে কথা বলব কী? খেয়াল রাখবি একে তো আমি মা, তার ওপর বয়সে বড়। হি হি হি।
শুধু শুধু হাসছ কেন?
এত সুন্দর একটা ডায়ালগ বলেছি এই আনন্দে হাসছি। একে তো আমি মা, তার ওপর বয়সে বড়। আমার নিজের কথা না। এত গুছিয়ে কথা বলব এমন বুদ্ধি আমার নেই। পরশুরামের ডায়ালগ। আমি কী করি জানিস নানান জায়গা থেকে ইন্টারেস্টিং ডায়ালগ মুখস্ত করে রাখি সময় বুঝে ব্যবহার করি।
ভালো। মৃ, এক্ষুণি ব্যাটারি চলে যাবে। টা টা বাই বাই বলে দে।
মা শোনো, আহ্লাদী করতে একটুও ইচ্ছা হচ্ছে না। আমার প্রচণ্ড মন খারাপ, শরীরও খারাপ সব মিলিয়ে কেমন এলোমেলো লাগছে।
মন ভালো করে দেই?
কোনো প্রয়োজন নেই মা। তোমার কথা শুনে মাথাও ধরে গেছে। মানসিক যন্ত্রণাটা শারীরিক যন্ত্রণায় টার্ন নিচ্ছে।
আমি তোর মাথা ধরা সারিয়ে দেব, মন খারাপ ভাব সারিয়ে দেব, শরীরও দেখবি ভাল হয়ে গেছে। কি দেব? আচ্ছা ঠিক আছে দিচ্ছি। শোন মূ, টগরকে টাকাটা আমি দিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণ অকারণেই তোর সঙ্গে খটখট করলাম।
টাকা দিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ। ব্যাংক থেকে তুলে এনে দিয়েছি। তোর বাবা জানতে পারলে কেঁচা দেবে।
থ্যাংক য়ু মা বলে একটা চিৎকার দিতে ইচ্ছা করছে। চিৎকার দিতে পারলাম না কারণ মার মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে যোবাইল অফ হয়ে গেছে।
আমার মাথা ধরা নেই, মন খারাপ ভাব পুরোপুরি দূর হয়েছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। মা যেমন ছেলেমানুষি করে আমারও সে রকম কিছু করতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টিতে ভেজা টাইপ কিছু। এখন নভেম্বর মাস। আকাশে শীতের ঝলমলে রোদ। বৃষ্টির কোনোই সম্ভাবনা নেই। এমন কোনো দিন সত্যি কি আসবে যখন প্রকৃতি পুরোপুরি মানুষের মুঠোর মধ্যে চলে আসবে? আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। আমি ছাদে উঠে দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললাম, বৃষ্টি! ওমি ছাদে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি শুধুই আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। আর কাউকে কিছু করল না।
বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। সন্ধ্যার অনেক আগেই ফিরতে পারতাম। শেষ ক্লাসটা হয় নি। তিনটার পর থেকেই ছুটি। মাঝে মাঝে ঘরে ফিরতে ইচ্ছা। করে না। ইচ্ছা করে শুধুই ঘুরে বেড়াই। প্রাণীজগতের ভেতর একমাত্র মানুষই হয়তো এমন প্রাণী যার হঠাৎ হঠাৎ ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না। কিংবা কে জানে প্রাণী জগতের অনেকেরই হয়তো ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না। পাখিদের সম্বন্ধে পুরোপুরি না জেনেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন।
সব পাখি ঘরে ফেরে…
পাখিদের কেউ কেউ হয়তো কখনোই ফিরে না। ঢাকা শহর এমন একটা শহর যে ঘরে না ফিরে কোথাও যাবার জায়গা নেই। একজন মেয়ের পক্ষে একাকী কোথাও যাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। একটি সাধারণ কফি শপে কফি খেতে যাওয়া যাবে না। কফি শপের মালিক, কর্মচারী এবং কাস্টমাররা বারবার তীক্ষু চোখে দেখবে। তাদের চোখে প্রশ্ন এই মেয়ে একা কেন? আমার এমন অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে। মেয়েদের একা ঘোরার জায়গা একটাই শাড়ি গয়নার দোকান। যেন তাদের জীবনটাই শাড়ি এবং গয়নার গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। মেয়েরা অন্য কোনো গোলকধাঁধায় ঘুরতে পারবে না। এই গোলকধাঁধায় ঘুরতে পারবে।
আমার যখন একা ঘুরতে ইচ্ছা করে গাড়ি নিয়ে শালবনের দিকে চলে যাই। শালবন শব্দটা মনে হলেই আমাদের চোখে ভাসে নিবিড় বন। মাঝখান দিয়ে রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অতি নিৰ্জন রাস্তা। বাতাসে শালবনের পাতা কেঁপে মোটামুটি ভয় ধরে যায় এমন শব্দ হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। যে শব্দের সঙ্গে সমুদ্ৰ গৰ্জনের কিছু মিল আছে।
বাংলাদেশের শালবন সে রকম না। বেশির ভাগ গাছ কাটা হয়ে গেছে। বনের ফাঁক ফোকড়ে ধনী জমি। বাড়ি ঘর। হাঁস মুরগি পালা হচ্ছে। এমনকি ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত হয়ে গেছে। মশা মারা কয়েলের ইন্ডাস্ট্রি, জাপানি সহযোগিতায় মাছের খাদ্য প্রস্তুতের ইন্ডাস্ট্রি। এলাম তৈরির কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। শালবনের ভেতর দিয়ে যে হাইওয়ে গিয়েছে সেখানে হেন যানবাহন নেই যা চলছে না। মহিষের গাড়ি থেকে শুরু করে কন্টেইনার আনা-নেওয়া করে দৈত্য-ট্রাক সবই আছে। এক মুহূর্তের জন্যও রাস্তা ফাঁকা না।
তারপরেও বনের ভেতর যেতে আমার ভালো লাগে। হাইওয়ের এক পাশে গাড়ি রেখে হুট করে বনে ঢুকে পড়া। খুব ভেতরে ঢুকতে সাহস হয় না। তারপরেও অনেকখানি ভেতরে চলে যাই। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচলের শব্দ শোনা না যাওয়া পর্যন্ত এগুতে থাকি। এক সময় ভয় লাগতে শুরু করে। অচেনা জায়গার ভয়। বনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ডাকাতের ভয়। নির্জনতার ভয়। তখন সামান্য সময়ের জন্য হলেও নিজের মধ্যে এক ধরনের ঘোর তৈরি হয়। সেই সময় অদ্ভুত সব কাও করতে ইচ্ছা করে।
ড্রাইভার রহমত আমার এই স্বভাবের কথা জানে। তাকে যখনই বলি শালবনের কাছে নিয়ে চলল, সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মুখ শুকিয়ে কেমন ছাতা-মারা হয়ে যায়। আমার ধারণা রাতে সে যে সব দুঃস্বপ্ন দেখে তার বেশির ভাগই শালবন সম্পর্কিত। সে গাড়ি নিয়ে শালবনের ভেতর ঢুকছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে বনের ভেতর চলে যাচ্ছি। হঠাৎ আর্তনাদ। কয়েকজন মুখোশ পরা ডাকাত আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বাঁচাও বাঁচাও করে চিকার করছি। ঘুমের এই পর্যায়ে রহমতের ঘুম ভেঙে যায়। সে বিড়বিড় করে তার স্ত্রীকে বলে পানি খাওয়াও। আজ আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
সন্ধ্যাবেলা ভাইয়ার ঘরে বাতি জ্বলছে। এটা খুবই অদ্ভুত ঘটনা। সন্ধ্যাবেলা সে ঘরেই থাকে না। আর যদি থাকে তার ঘরে বাতি জ্বলে না।
ভাইয়া বিছানায় শুয়ে ছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, টাকা এনেছিস।
আমি অবাক হয়ে বললাম, টাকা পাও নি?
ভাইয়া বলল, তুই না দিলে পাব কোথায়? আর কাউকে তো টাকার কথা বলি নি। টাকা জোগাড় হয় নি?
আমি বললাম, না।
ভাইয়া বিড়বিড় করে বলল, বিরাট ঝামেলায় পড়ে গেলামরে।
কী ঝামেলা?
ভাইয়া জবাব দিল না। আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্ষীণ গলায় বলল, মৃ বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যা।
মার সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছে।
হ্যাঁ হয়েছে।
মা কিছু বলেছে?
তিনি উলের মোজা নিয়ে কী যেন বললেন। আসলে আমি মন দিয়ে তাঁর কথা শুনি নি।
আমি দোতলায় উঠে এলাম। দোতলার বারান্দায় গামলা ভর্তি গরম পানিতে পা ডুবিয়ে মা বসে আছেন। তাঁর পায়ে সমস্যা আছে। সামান্য হাঁটাহাটি করলেই পা ফুলে যায়। তখন জল চিকিৎসা চলে। তাঁর হাতে উলের কাটা। তিনি মোজা বুনা শুরু করেছেন।
মা আমাকে দেখে হাসিমুখে তাকালেন। আমি কঠিন গলায় বললাম, ভাইয়াকে তুমি টাকাটা দাও নি মা?
না।
তাহলে আমাকে কেন বললে দিয়েছ?
তুই খুবই মন খারাপ করে ছিলি। তোর মন ভালো করার জন্যে মিথ্যা করে। বলেছি। মানুষের মন ভালো করার জন্যে দু একটা ছোটখাট মিথ্যা বলা যায়। এতে কোনো পাপ হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে পুণ্য হয়।
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মোজা বুনে। যাচ্ছেন। কাজটায় অতি অল্প সময়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছেন এটা বোঝা যাচ্ছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন ভালো হচ্ছে না? মোজা বানানোর আসল রহস্য খুব সোজা। ঘর তোলা আর হিসেব করে ঘর বন্ধ করা। এই দুটা জিনিস জানলেই হলো। তুই যদি চাস তোকে আমি মোজা বানানো শিখিয়ে দিতে পারি। তোর বুদ্ধি বেশি তো। তুই খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলবি। শিখবি?
তোমার কাছ থেকে কিছুই শিখব না মা।
কার কাছে থেকে শিখবি তোর বাবার কাছ থেকে? দাড়িয়ে আছিস কেন, বোস। এতে আমার খুব লাভ হবে।
কী লাভ হবে?
নাটকে আমার সিকোয়েন্সটা হচ্ছে আমি শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে উল বুনব। তুই যদি আমার সামনে বসিস তাহলে আমি তোর দিকে তাকিয়ে উল বুনব। এতে প্র্যাকটিসটা হবে।
আমি মার সামনের মোড়ায় বসলাম। মা মাথা নিচু করে অস্পষ্টভাবে হাসলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। অত্যন্ত রূপবতী একজন মহিলা বয়সের কোনো ছাপ যার চেহারায় নেই। শুধু বয়স কেন, কোনো কিছুর ছাপই তার চেহারায় নেই। দুঃখের ছাপ নেই, শোকের ছাপ নেই, আনন্দের ছাপ। নেই।
মৃন্ময়ী, তোর বাবার সঙ্গে কি তোর দেখা হয়েছে?
না।
সে ঘরে আছে। মেজাজ খুবই খারাপ।
কেন?
তোর বাবা তো বলবে না কেন তার মেজাজ খারাপ। তবে আমি অনুমান করতে পারি। দড়ি টানাটানি খেলা হঠাৎ শুরু হয়েছে। তার বাবা সবসময় ভেবেছে তার শক্তি ভালো। দড়ি টানাটানি শুরু হলে সে অনায়াসে জিতবে। এখন বুঝতে পারছে জেতা দূরের কথা, তার ফেল নিয়েই টানাটানি।
কী বলতে চাচ্ছি পরিষ্কার করে বলো তো মা।
ফেল নিয়ে টানাটানির ব্যাপারটা আগে বলি। এক ছেলে ক্লাস ফোরের ছাত্র। পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে। রেজাল্ট এতই খারাপ হয়েছে যে হেডমাস্টার সাহেব বলেছেন এই ছেলেকে ক্লাস ফোরে রাখার দরকার নেই। এক ক্লাস নিচে নামিয়ে দিন। ছেলের বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন, কী-রে বাবা পাশ করেছিস? ছেলে বিরক্ত হয়ে বলল, রাখো তোমার পাশ– আমার ফেল নিয়েই টানাটানি।
মা তুমি কী বলতে চাচ্ছ পরিষ্কার করে বলে। গল্পগুলি বাদ দাও। দড়ি টানাটানির ব্যাপারটা কী?
তোর বাবা এবং আজহার সাহেব এই দুজনের মধ্যে দড়ি টানাটানি হচ্ছে। অনেকদিন থেকেই হালকাভাবে হচ্ছিল, এখন প্রবল টানাটানি আরম্ভ হয়েছে। তোর বাবার অবস্থা কাহিল আজহার সাহেব বলতে গেলে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তোর বাবা মাটিতে পা রাখতেই পারছে না, দড়ি কী টানবে। হি হি হি।
হাসি বন্ধ করে মা।
তুই না বললেও হাসি বন্ধ করতাম। হাসতে গিয়ে আমার উল বোনায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে। দুইটা ঘর ফেলে দিয়েছি। কী সর্বনাশ!
দুটা ঘর ফেলে দিয়েছ, তোমার বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাই না মা! জগৎ সংসার আউলে গেছে! ছোট মানুষের ছোট জগৎ ছোট ব্যাপারেই আউলে যায়। মোজার দুটা ঘর ফেললে কারোর জগৎ আউলায়। আবার কেউ কেউ আছে কোনো কিছুতেই জগৎ আউলায় না।
মার বকবকানি শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি উঠতে যাচ্ছি মা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেললেন। চাপা গলায় বললেন, তোর বাবা শেষ পর্যন্ত কবরের জায়গা কিনেছে। আজহার সাহেবের হাত থেকে তোর বাবা বের হয়ে যাবে এটা অসম্ভব। তোর বাবা জানে না। আমি জানি।
বাবা কবরের জায়গা কিনেছেন?
হ্যাঁ।
সত্যি কথা বলছ মা?
মা জবাব দিলেন না— তিনি মোজার ফেলে যাওয়া দুটা ঘর খুঁজে পেয়েছেন। তিনি ঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মা যে সত্যি কথা বলছেন তা বোঝা যাচ্ছে। সত্যি বলে তিনি থেমে গেছেন, কিন্তু আমাকে একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন। মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন আজহার নামের বোকা টাইপের মানুষটা আমার অতি বুদ্ধিমান বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাবা বুঝতেও পারছেন না। তিনি নিজেকে রেলের ডিজেল ইঞ্জিন ভাবছেন— অতি দ্রুত এগুচ্ছেন কিন্তু যে রেল লাইনের ওপর দিয়ে তিনি যাচ্ছেন সে রেল লাইন যে অন্য একজন পেতে দিচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না।
রাতে খেতে বসে খুব সহজ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কবরের জন্যে জায়গা কিনেছ না-কি?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, কে বলেছে?
তার মানে তুমি কিনেছ?
হ্যাঁ কিনেছি। প্রতিদিন এসে ঘ্যানর ঘ্যানর–ভালো লাগে না।
মা হাসি মুখে বললেন, তোমার তো সব ব্যবস্থাই হয়ে গেল। কাফনের কাপড় আছে, কবরের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।
বাবা খাওয়া বন্ধ করে বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না।
মা অবাক ভাব করে বললেন, কী ফাজলামি করলাম? যেটা সত্যি সেটা বলেছি। না-কি এ বাড়িতে সত্য বলা নিষেধ?
বাবা বললেন, তুমি কবে থেকে সত্যবাদী হয়ে গেলে?
তোমার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে সত্যবাদী হয়েছি। তুমি সব সময় সত্যি বলো তো। তোমাকে দেখে দেখে সত্যি বলা শিখেছি।
তুমি কী বোঝাতে চেষ্টা করছ?
আমি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি না। শুধু বলেছি তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে আমি সত্যি কথা বলা শিখেছি। এর আগে প্রচুর মিথ্যা বলতাম। ক্লাস টেনে বান্ধবীরা নববর্ষে সবাইকে উপাধি দেয়— আমার উপাধি কী ছিল জানো– মিথ্যারাণী!
বাবা আগুন চোখে তাকিয়ে রইলেন। মা বললেন, মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। ক্লাস টেনে সাফিয়া নামের একটা মেয়ে পড়ত। ওর টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি। ওকে জিজ্ঞেস করো।
বাবা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতের এক ঝটকায়। টেবিলে রাখা ডালের বাটি মেঝেতে ফেলে দিলেন। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে মা বললেন, করেছ কী? ডালের বাটিটাই ফেলে দিলে। ডালটাই সবচে ভালো হয়েছিল। মুরগির মাংসের বাটিটা ফেলতে। খেতে জঘন্য হয়েছে।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা দয়া করে নিজেকে সামলাও। এবং খাওয়া শেষ করো।
বাবা বসে পড়লেন। মা বললেন, আমাকে সরি বলার কোনো দরকার নেই।
বাবা শীতল গলায় বললেন, সরি।
আমি তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। বাবা নিজের ওপর কন্ট্রোল পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন। ভাত মুখে দিচ্ছেন, কিন্তু তার হাত কাঁপছে। বাবা নিচু গলায় বললেন, নানান টেনশানে থাকি। নিজের ওপর কনট্রোল কমে যাচ্ছে। আমি আসলেই দুঃখিত। এরকম আর কখনো হবে না।
সংবাদপত্রের ভাষায় এ ধরনের বক্তব্য হলো নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। ক্ষমা প্রার্থনার পর আর কিছু থাকে না। মার মুখে বিজয়ীর হাসির পরিবর্তে বোকা বোকা হাসি দেখা যাচ্ছে। তিনি কিছু বলবেন এটা বুঝতে পারছি অনেকক্ষণ ধরেই। তিনি মনে মনে কিছু গোছাচ্ছেন। মা বাবাকে আবারো আক্রমণ করবেন এরকম মনে হচ্ছে না। টম এন্ড জেরী খেলার এইখানেই ইতি হবার কথা। কিন্তু মাকে বিশ্বাস নেই। মা বাবার দিকে তরকারির বাটি বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার পায়ের মাপটা দিও তো।
বাবা বললেন, কেন?
মা বললেন, আমি মোজা বানানো শিখেছি। তোমার জন্যে উলের মোজা বানিয়ে দেব। চা বাগান কিনেছ। শীতের সময় ঐ সব অঞ্চলে খুব শীত পড়ে। উলের মোজা পায়ে থাকলে শীতের হাত থেকে বাঁচবে।
বাবা মার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, থ্যাংক য় ফর দ্যা কাইন্ড থট।
আমি মোজা বানানো কার কাছ থেকে শিখেছি জানলে তুমি খুবই অবাক হবে।
বাবা খাওয়া বন্ধ করে মার দিকে তীক্ষ চোখে তাকালেন। আমিও তাকলাম। টম এন্ড জেরী খেলা এখনো শেষ হয় নি। মার মুখে আনন্দময় হাসি। মা হাসি হাসি মুখে বললেন, মোজা বানানো শিখেছি টগরের মার কাছে। টগরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে উনাকে খুঁজে বের করলাম। খুব গুণী মহিলা। অনেক কিছু জানেন। ছোট মাছ আর জলপাই দিয়ে একটা টক করেন। তুমি না-কি সেই টক খুব শখ করে খেতে।
বাবা তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। পরিস্থিতি বিচার করছেন। মা বললেন, এখন শিখে এসেছি তোমার যখন খেতে ইচ্ছা করে বলবে বেঁধে খাওয়াব।
বাবা বললেন, থ্যাংক যা এগেইন।
মা বললেন, আরেকজনের কাছে মুরগি রান্নার একটা রেসিপি জোগাড় করেছি। এটাও না-কি তোমার খুব প্রিয়।
বাবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। মার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি এখন আর বাবার দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
মৃ শুনে রাখ। তোর যা বুদ্ধি একবার শুনলেই মনে থাকবে। তখন তুই তোর প্রিয়জনকে বেঁধে খাওয়াবি। তোর গরু স্যারকে বেঁধে খাওয়াতে পারিস। রেসিপিটা হচ্ছে একটা মাঝারি সাইজের মুরগি নিবি। আস্ত মুরগিটার চামড়া খুলে ফেলবি। তারপর মুরগিটার গায়ে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটার মতো ফুটা করবি। প্রতিটা ফুটায় একটা করে রসুনের কোয়া ঢুকিয়ে দিবি। তারপর টক দই দিয়ে মুরগিটা মাখিয়ে একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবি। মুরগি ফ্রিজে থাকবে বার ঘণ্টা…
বাবা কঠিন গলায় বললেন, স্টপ ইট।
মা চুপ করে গেলেন।