Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃত্যুক্ষুধা || Kazi Nazrul Islam » Page 8

মৃত্যুক্ষুধা || Kazi Nazrul Islam

মৃত্যুক্ষুধা – ০৮

সেদিন ঘিয়াসুদ্দিন শ্বশুরবাড়ি এসেছে। মেজোবউও বোনাইকে দেখলতে এসেছে। ও-ই এসেছে কিংবা ওর বোনাই-ই আনিয়েছে – এই দুটোর একটা-কিছু হবে।

আগুন আর সাপ নিয়ে খেলা করতেই যেন ওর সাধ। ঘিয়াসুদ্দিন ওকে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না বলেই এত ঘন ঘন আসে। মেজোবউ তা বোঝে, তাই তাকে ঘন ঘন আসায় অর্থাৎ আসতে বাধ্য করে।

সে বলে, “দুলাভাই, তুমি তোমার গাড়িতে চড়ালে না আমায়?”

ঘিয়াসুদ্দিন যেন হাতে চাঁদ পেয়ে বলে, “এ নসিবে কি তা আর হবে বিবি? আমার গাড়ি তো তৈরিই, তুমি চড়লে না বলেই তো তা রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইল!”

মেজোবউ মুচকি হাসে। হাসি তো নয়, যেন দুফলা চাকু। বুকে আর চোখে দুই জায়গায় গিয়ে বেঁধে। বলে, “অর্থাৎ আমি গাড়িতে উঠলেই গাড়ি তুলবে আস্তাবলে! বুবুকে যেমন তুলেছ!”

ঘিয়াসুদ্দিন হঠাৎ থ বনে যায়। বে-বাগ ঘোড়া হঠাৎ মুখের উপর চাবুক খেয়ে যেমন থতমত খেয়ে যায় তেমনই!

একটু সামলে নিয়ে সে বলে, “আরে তৌবা, তৌবা! ও কী বদরসিকের মতো কথা বল ভাই! আস্তাবলে কেন, গাড়িসুদ্ধ মাথার ওপরে তুলব তোমায়। তোমার বুবু তো বুকে আছেনই।”

মেজোবউ বোনাই-এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “আমায় রাখবে একেবারে মাথায়! এই তো? কিন্তু দুলাভাই, তোমাদের মাথা কি সব সময় ঠিক থাকে যে, ওখানে চিরদিন থাকব? আরো দু-দুজনকে তো মাথায় তুলে শেষে পায়ের তলায় নামিয়ে রেখেছ!”

ঘিয়াসুদ্দিনও হটবার পাত্র নয়। সে মরিয়া হয়ে বলে উঠল, “কিন্তু ভাই, ওরা হল নুনের বস্তা, বেশিদিন কি মাথায় রাখা যায়? তুমি হলে মাথার তাজ, তোমাকে কি তাই বলে মাথার থেকে নামানো যাবে?”

মেজোবউ একটু তেরছা হাসি হেসে কণ্ঠস্বরে মধু-বিষ দু-ই মিশিয়ে বলে উঠল, “জি হাঁ, যা বলেছেন! কিন্তু ও পাকা চুলে আর তাজ মানাবে না দুলাবাই! বরং সাদা নয়ানসুকের কিশতি-নামা টুপি পরো, খাসা মানাবে!” বলেই হি হি করে হাসে।

ঘিয়াসুদ্দিন ঘেমে উঠতে থাকে। কীসের যেন অসহ্য উত্তাপ অনুভব করে সারা দেহে-মনে।

মেজোবউ তখনও বাণ ছুঁড়তে থাকে। শিকারী যেমন করে আহত শিকার না-মরা পর্যন্ত বাণ ছুঁড়তে বিরত হয় না।

সে বলে, “পুরুষগুলো যেন আমাদের হাতের গালার চুড়ি। ভাঙতেও যতক্ষণ, গড়তেও ততক্ষণ!”

ঘিয়াসুদ্দিন কী বলতে কী বলে ফেলে। খেই হারিয়ে যায় কথার। বলে, “আচ্ছা ভাই, তুমি মাথায় না-ই চড়লে, পিঠে চড়তে রাজি তো?”

মেজোবউ এইবার হেসে লুটিয়ে পড়ে। বলে, “হাঁ, তাতে রাজি আছি। যদি চাবুক পাই হাতে!” বলেই বলে, “সেদিন বাবুদের বাড়িতে কলের গানে একটা গান শুনেছিলাম দুলাভাই, “বলেই সুর করে গায় –

“আমার বুকে পিঠে সেঁটে ধরেছে রে!”

তারপর গান থামিয়ে বলে, “বুবু আছেন বুকে, এরপর আমি চড়ব পিঠে, তাহলে তোমার অবস্থা ওই সেঁটে ধরার মতোই হবে যে! তাছাড়া, জান তো একজন বুকে বসে থাকলে আর একজন পিঠে চড়তে পারে না!”

গান শুনে মেজোবউয়ের বড়ো ভাবি এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে এইবার বলে উঠল, “কী লো, বোনাই-এর সাথে যে হাবুডুবু খাচ্ছিস রসে?”

ঘিয়াসুদ্দিন এতক্ষণে যেন কূলের দেখা পেলে বড়ো শালাজকে পেয়ে। এইবার সে অনেক সপ্রতিভ হয়ে বললে, “বাবা, নদের মেয়ে ডাক-সাইটে মেয়ে, এদেশে রসিকতা করে পার পাওয়ার জো আছে? ভাগ্যিস এসে পড়েছে ভাবি, নইলে, এখুনি ডুবে মরেছিলাম আর কী!”

মেজোবউ তার ভাবির দিকে একটু চেয়ে নিয়ে বললে, “কোথায় ডুবেছিলে, খানায় না সার-কুঁড়ে? – কিন্তু অত ভরসা কোরো না দুলা-ভাই, ও কলার ভেলা। ডুবোতে বেশি দেরি লাগবে না।”

ঘিয়াসুদ্দিন হতাশ হয়ে তক্তাপোশে চিতপাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, “না ভাবি, কোনো আশা নেই!”

ভাবি হাসতে হাসতে বলে চলে গেল, “অত অল্পে হতাশ হতে নেই ভাই পুরুষ মানুষের। যেখানে শক্ত মাটি, সেখানে একটু বেশি না খুঁড়লে পানি পাওয়া যায় না।

মেজোবউ কিছু না বলে তামাক সেজে ঘিয়াসুদ্দিনের হাতে হুঁকো দিয়ে বললে, “এইবার বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দাও দেখি একটুকু, সব পরিষ্কার দেখতে পাবে।”

ঘিয়াসুদ্দিন হুঁকোটা হাতে নিয়ে একবার করুণ নয়নে মেজোবউয়ের পানে চেয়ে বলল, “যথেষ্ট পরিষ্কার দেখতে পেয়েছি ভাই। ধোঁয়া হয়ে রইলে কিন্তু তুমিই।”

বলেই জোরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হুঁকোয় মন দিলে।

মেজোবউ কৌতুক-ভরা চোখে একবার বোনাই-এর পানে চেয়ে উঠবার উপক্রম করতেই ঘিয়াসুদ্দিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বললে, “একটু দাঁড়াও ভাই, একটা কাজ আছে।” বলেই তার হাতের কাজের বাক্সটা হতে একখানি সুন্দর ঢাকাই শাড়ি বের করে বললে, “এইটে তোমায় নিতে হবে ভাই!”

মেজোবউ শাড়িটার দিকে কটাক্ষে চেয়ে হেসে বললে, “আগে থেকেই কাপড়ের পর্দা ফেলে দিলে বুঝি? কিন্তু এ যে ঢাকাই কাপড় দুলাভাই, বড্ড পাতলা। আমি যে বিধবা, সে ঘা তো এ পাতলা কাপড়ে ঢাকা পড়বে না।”

বলেই মুখ ফিরিয়ে চোখের জল মুছে চলে গেল। ঘিয়াসুদ্দিনের হাতের কাপড় হাতেই রয়ে গেল।

একটু পরেই মেজোবউ হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে বললে, “ওকীদুলাভাই, তুমি এখনও কাপড় হাতে করে বসে আছ? দাও দাও, মন খারাপ করতে হবে না।” বলেই কাপড়খানি হাতে নিয়ে গুন গুন করে গান করতে করতে বেরিয়ে গেল, – “তোর হাতের ফাঁসি রইল হাতে, আমায় ধরতে পারলি না!”

একটু পরেই উঠানে মেজোবউয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “না ভাবি, আজ আসি! শাশুড়ি বোধ হয় এতক্ষণ তাঁর মরা ছেলেকে নালিশ করছেন আমার নামে? ও কাপড়টা তোমায় দিলাম। এ পোড়া গায়ে কি অত রং চড়াতে আছে? চটে যাবে। – বিনি রঙেই কত বুড়োর চোখ গেল ঝলসে, রং চড়ালে না জানি কী হবে!” বলেই বোনাই¬-এর পানে তাকায়। তারপর ছেলেমেয়ে দুটির হাত ধরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।

সারা পথ তার পায়ের তলায় কাঁদতে থাকে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *