ইয়াকুব আলি সকাল আটটা থেকে
ইয়াকুব আলি সকাল আটটা থেকে মৃন্ময়ীদের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তাঁর চেহারায় দিশাহারা ভাব। বাড়িতে ঢুকে তিনি বেশ হকচকিয়ে গেছেন। মৃন্ময়ী মেয়েটা বড়লোকের মেয়ে এটা তিনি জানেন কিন্তু সে যে এমন একটা
বিশাল ড্রয়িং রুমের এক কোনায় তিনি হতাশ হয়ে বসে আছেন। ম্যানেজার জাতীয় একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ছেলেটা বলেছে, মৃন্ময়ী আপা তার ঘরেই আছেন। হাঁটাহাটি করছেন, গান শুনছেন। তবে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, কাজেই এখন দরজায় টোকা দেয়া যাবে না।
ইয়াকুব বললেন, দরজা বন্ধ থাকলেই না লোকজন বাইরে থেকে টোকা দেবে। দরজা খোলা থাকলে দিবে কেন?
এই বাড়ির এ-রকমই নিয়ম। আপনি বলুন আপা দরজা খুললেই তাকে খবর দেয়া হবে। আপা কি আপনাকে চেনেন?
আমার মেয়ে তার সঙ্গে পড়ে। আমার নাম ইয়াকুব আলি।
ইয়াকুব একবার ভাবলেন বলবেন আমার মেয়ের নাম ছন্দা। শেষপর্যন্ত বললেন না। এমনও হতে পারে ছন্দা পালিয়ে এ-বাড়িতেই বসে আছে। এখন হয়ত গল্প করছে মৃন্ময়ীর সঙ্গে।
গতকাল সকালে তিনি ছন্দাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কঠিন গলায় বলেছেন, বাকি জীবন আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।
ছন্দা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, বাবা আমি যাব কোথায়?
তিনি বলেছেন, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবি। আমার এখানে না। আমি চোর-মেয়ে ঘরে রাখব না।
ঘটনা ঘটেছে সকাল নয়টায়। বারো ঘণ্টা পর রাত নয়টার দিকে তিনি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবখানে। মৃন্ময়ীকে টেলিফোন করেছেন কিছুক্ষণ পর পর। যতবারই টেলিফোন করেন ততবারই শোনা যায়—এখন সংযোগ দেয়া সম্ভব না। আবার ডায়াল করুন।
মৃন্ময়ীর বাসার ঠিকানা বের করতেও তাঁর খুব ঝামেলা হয়েছে। কেউ ঠিকানা বলতে পারে না।
আপনি কি চা খাবেন? চা দিতে বলি?
ম্যানেজার ছেলেটা আবার এসেছে। ইয়াকুব আলি বললেন, দরজা কি খুলেছে?
জি-না এখনও না। আপনাকে চা দিতে বলি?
না। এক গ্লাস পানি দিতে পারেন।
টেবিলের নিচে খবরের কাগজ আছে। ইচ্ছা করলে খবরের কাগজ পড়তে পারেন।
আমার কিছু লাগবে না। একটু তাড়াতাড়ি যদি খবরটা দেয়া যায়। বিশেষ ঝামেলায় আছি।
দরজা খুললেই খবর দেব।
ইয়াকুব বুঝতে পারছেন না ঝামেলার ব্যাপারটা মৃন্ময়ীকে খোলাখুলি বলবেন কি-না। বলা অবশ্যই উচিত কিন্তু বলবেন কীভাবে? সবকিছু কি বলা যায়?
ঘটনাটা এ রকম— সকালে নাশতা খেয়ে তিনি চায়ের কাপ নিয়ে ইজিচেয়ারে বসেছেন, হুড়মুড় করে তিনটা মেয়ে ঢুকে পড়ল। তিনি যে বসে আছেন সে-দিকে ফিরেও তাকালো না। ঢুকে গেল ছন্দার ঘরে। বিছানা বালিশ উল্টাচ্ছে, ড্রয়ার খুলছে, আলমিরা খুলছে। তিনি বললেন, এইসব কী? মেয়ে তিনটার একটা বলল, ছন্দা তার গয়না চুরি করেছে। দুই ভরি ওজনের একটা গলার চেইন।
ইয়াকুব বললেন, তোমরা কি পাগল হয়ে গেলে? আমার মেয়ে করবে চুরি? আমার মেয়ে?
আর তখনই অন্য একটা মেয়ে বলল, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। মেয়েটার হাতে চেইন। তারা যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল, সে-রকম ঝড়ের মতো চলে গেল। তিনি দেখলেন, ছন্দা ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। তিনি বললেন, ছন্দা তুই কি চেইনটা চুরি করে এনেছিলি?
ছন্দা জবাব দিল না।
মৃন্ময়ী এসেছে। ইয়াকুব আলিকে দেখে সে মোটেই চমকালো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, চাচা স্লমালিকুম। আপনি এসেছেন? কেমন আছেন চাচা।
ইয়াকুব আলি বললেন, মাগো! আমি ভালো নাই। আমি খুব খারাপ আছি।
ছন্দা কি তোমার এখানে?
না তো।
তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে?
জি না। চেষ্টা করলেও টেলিফোনে আমাকে ধরতে পারত না। আমি সব সময় টেলিফোন বন্ধ করে রাখি। শুধু আমার যখন কথা বলার দরকার হয় তখন অন করি। চাচা ব্যাপারটা কী বলুন তো?
ইয়াকুব মাথা নিচু করে ঘটনা বর্ণনা করলেন। কয়েকবার তার গলা বন্ধ হয়ে গেল। মৃন্ময়ী বসেছে তার পাশে। সে শান্ত ভঙ্গিতে পুরো ব্যাপারটা শুনলো। ইয়াকুব বললেন, মা দেখ তো এই জিনিসটা কি তোমার?
তিনি শার্টের পকেট থেকে কাগজে মোড়া হীরের নাকফুল বের করলেন। ব্ৰিত গলায় বললেন, ছন্দা বলেছে তোমার বাড়ি থেকে তোমাকে না বলে নিয়েছে।
মৃন্ময়ী বলল, চাচা এই জিনিস আমার না। আমি নাকফুল ব্যবহার করি না।
ইয়াকুব বলেলেন, তা হলে মনে হয় অন্য কারো কাছে থেকে চুরি করেছে। মার খেয়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে বোধ হয়। তোমার নাম মনে এসেছে বলেছে।
মেরেছেন?
হ্যাঁ। রাগ সামলাতে পারলাম না। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, তার সুটকেসে সিগারেট লাইটার পর্যন্ত আছে। তিনটা লাইটার! যা পেয়েছে চুরি করেছে।
চাচা আপনি কি নাশতা করেছেন?
মাগো নাশতা করার মতো মনের অবস্থা নাই। মেয়েটা রাতে কোথায় ছিল, কার কাছে ছিল, কিছুই তো জানি না।
ইয়াকুব কেঁদে ফেললেন। মৃন্ময়ী বলল, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। নাশতা করবেন। আমি চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করি সে কোথায় থাকতে পারে।
মা আমি নাশতা খাব না। আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না। তুমি চিন্তা করে বল, সে কোথায় যেতে পারে। মেয়েটার জন্য আমি শাহজালাল সাহেবের দরগায় সিন্নি মানত করেছি।
মৃন্ময়ী বলল, আপনি অবশ্যই আমার সঙ্গে নাশতা খাবেন। রাতে কি কিছু খেয়েছেন? না কি রাতেও কিছু খান নি?
ইয়াকুব জবাব দিলেন না।
মৃন্ময়ী হাত ধরে তাকে টেনে তুলল। আবারও ইয়াকুবের চোখে পানি এসে গেল। তার নিজের মেয়ে কোনোদিন হাত ধরে তাকে টেনে তুলে খেতে নিয়ে যায় নি, আর এ অন্যের মেয়ে।
নাশতার টেবিলে বসতে বসতে মৃন্ময়ী বলল, চাচা আমি প্রসেস অব এলিমিনেশনের মাধ্যমে ছন্দা কোথায় থাকতে পারে বের করে ফেলেছি।
ইয়াকুব তাকিয়ে আছেন। মৃন্ময়ী বলল, আমি চিন্তা করছি আমি ছন্দা হলে কী করতাম? আমি আমার কোনো আত্মীয়ের বাড়ি যেতাম না। সেটা হতো আমার জন্যে লজ্জার ব্যাপার।
ইয়াকুব বললেন, ঠিক বলেছ। আমি সবার বাসায় খোঁজ নিয়েছি সে নাই।
মৃন্ময়ী বলল, আমি কোনো বান্ধবীর বাড়িতে বা ক্লাসফ্রেন্ডের বাড়িতে যেতাম। সেটা হতে আরও লজ্জার। এই জাতীয় ঘটনা অতি দ্রুত সবাই জেনে যায়।
ঠিক বলেছ।
আমি দূরে কোথাও যেতাম না। দূরে যেতে সাহস লাগে। ছন্দার এত সাহস নেই। সঙ্গে টাকাও নেই।
ইয়াকুব বললেন, সে এক বস্ত্রে বের হয়েছে। সঙ্গে টাকাপয়সা দূরের কথা রিকশা ভাড়ার টাকাও নেই।
মৃন্ময়ী বলল, ছন্দার জন্যে একটা জায়গাই শুধু আছে যে ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে সে আছে সেখানে। আপনি ঐ বাড়িতে গেলেই তাকে পাবেন।
ইয়াকুব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মৃন্ময়ীর কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। বাচ্চা একটা মেয়ের এত বুদ্ধি দেখে তিনি চমৎকৃত।
মৃন্ময়ী বলল, চাচা আপনি শান্তিমতো নাশতা খান, চা খান। আমি আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি। গাড়ি নিয়ে যান।
গাড়ি দিতে হবে না মা।
আমি যা বলছি শুনুন তো। আপনিই তো বলেছিলেন মেয়ে বাবাকে অনুরোধ করবে না, বাবাকে করবে আদেশ। আমি আপনার মেয়ের মতো না?
অবশ্যই। অবশ্যই।
আমি পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে দিচ্ছি। আপনি খাবেন আমি দেখব। পাউরুটিতে মাখন লাগাতে আমার খুব ভালো লাগে।
ইয়াকুব ঠিক করে ফেললেন মৃন্ময়ী নামের মেয়েটার বিয়েতে যেভাবেই হোক সোনার কিছু দেবেন। গলার হার কিংবা হাতের চুড়ি। এতে যদি তার গ্রামের বসতবাড়ি বিক্রি করতে হয় তাতেও তিনি রাজি আছেন।
মৃন্ময়ী যা বলেছিল তা-ই। ছন্দা সেই বাড়িতেই আছে। গতকাল রাত এগারোটায় কাজী ডেকে পাঁচ লক্ষ এক টাকা দেন মোহরানায় বিয়েও হয়ে গেছে। বরের ছোট মামা বললেন, আপনাকে খবর দিতাম কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন! মেয়েকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। ছিঃ ছিঃ! একবার চিন্তাও করলেন না। এই বয়সের একটা মেয়ে কোথায় যাবে? যাই হোক আপনি এসেছেন আমরা খুশি। মেয়ে জামাইকে দোয়া করে যান।
জামাই এসে সালাম করল। ছন্দা বাবার সামনে বের হলো না। সে কিছুতেই আসবে না।
বরের মামা বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে। এত তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নাই। ধীরে ধীরে মিলমিশ হবে। বাবা-মেয়ের রাগারাগি ললিপপ আইসক্রিম। সামান্য গরমেই গলে পানি।
ইয়াকুবকে ঐ বাড়িতে দই-মিষ্টি খেতে হলো। বরের মামা গলা নামিয়ে বললেন, বেয়াই সাহেব! বৌমাকে আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে। অসাধারণ মেয়ে। প্রথম রাতেই সে তার স্বামীকে বলেছে, তোমার মেয়ে অন্যবাড়িতে কেন থাকবে? এখন আমি তার মা। সে তার মার বাড়িতে থাকবে।
রাতেই মেয়েকে নানীর বাড়ি থেকে আনা হয়েছে। সেই মেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে হয়েছে মায়ের ভক্ত
সারক্ষণ মায়ের পিছনে পিছনে ঘুরছে।
ইয়াকুব বললেন, ভালো তো। বেশ ভালো।
চুপেচাপে বিয়ে হওয়াতে আপনার জন্যও তো ভালো হয়েছে। খরচের হাত থেকে বেঁচে গেলেন। হা হা হা। ঠাট্টা করলাম। বেয়াই সাহেব কিছু মনে করবেন না।
ইয়াকুব বললেন, কিছু মনে করি নি। ছন্দার এক বান্ধবী তাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠিটা কি ছন্দার হাতে দেয়া যাবে?
অবশ্যই দেয়া যাবে। আমার হাতে দিন। আমি দিয়ে আসছি। মৃন্ময়ী চিঠিতে লিখেছে–
ছন্দা,
আমার হিসাব যদি ঠিক হয়, তা হলে তুই সুখে আছিস। তুই অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। অতি বুদ্ধিমতীরা সুখ বের করে নিতে জানে। বোকা মেয়েগুলিই বেছে বেছে দুঃখ কুড়ায়। আমি তোকে খুব পছন্দ করি আবার তোর বাবাকেও খুব পছন্দ করি। অথচ দুইজন দুই মেরুর।
ভালো থাকিস।
ইতি
মৃন্ময়ী
পুনশ্চ # ১ : তোর একটা পেট্রেটা করার বলেছিলাম, মনে আছে? আর্টিস্ট ভদ্রলোক আগামীকাল থেকে ফ্রী। দাদার ছবি তিনি একে শেষ করেছেন। আজ হ্যান্ডওভার করবেন। আমি ছবি হ্যান্ডওভারের দৃশ্য দেখতে যাচ্ছি। দাদাজানের ছবি যদি পছন্দ হয় তবেই তোর ছবি আঁকানো হবে। তৈরি হয়ে থাক।
পুনশ্চ # ২ : তোর যে একটা মানসিক রোগ আছে, শুনেছি বিয়ের পর এই রোগ সেরে যায়। স্বামীর ভালোবাসা এই রোগের একমাত্র ওষুধ। মনে রাখিস।