মুরারিবাবুর দেখা লোকটা
শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যায় তুলকালাম বৃষ্টি। সেই সময় আড্ডাটা জমেছিল ভালো। ইতিমধ্যে গোপালবাবুর কাজের লোক কানুহরি ছাতার আড়ালে মুড়ি আর তেলেভাজা এনেছিল। বৃষ্টিতে বেচারার একেবারে কাকভেজা অবস্থা। ভিজে কাপড় বদলে নিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে সে এবার ট্রে-ভর্তি চা আনবে। ঠিক এই সময়ে মুরারিবাবু আর জিতেনবাবুর মধ্যে কী সুত্রে তর্কটা বেধে গেল অন্যেরা খেয়াল করেননি।
জিতেনবাবু বললেন,–বোগাস! আমি বলছি নেই!
মুরারিবাবু বললেন, আমি বলছি আছে!
-সায়েন্সকে তুমি অস্বীকার করতে পারো?
–রাখো তোমার সায়েন্স! আমি স্বচক্ষে দেখেছি! আর তুমি বলছ নেই!
–তুমি ভুল দেখেছ! সাইকোলজিতে হ্যাঁলুসিনেশন বলে একটা কথা আছে জানো? দৃষ্টিবিভ্রম।
–রাখো তোমার সাইকোলজি।
গোপালবাবু গৃহকর্তা। বন্ধুদের মধ্যে কী নিয়ে তর্ক হচ্ছে, তা না জানলে কেমন করে মিটিয়ে দেবেন? তাই তিনি বললেন, আহা! ব্যাপারটা কী?
জিতেনবাবু বাঁকা হেসে বললেন, ভূত! যে যুগে মানুষ চাঁদে পাড়ি দিয়েছে, মঙ্গলগ্রহে স্পেসশিপ পাঠিয়েছে, সেই যুগে মুরারি বলছে কিনা…যত্তসব উদ্ভট কথাবার্তা!
মুরারিবাবুও আরও বাঁকা হেসে বললেন, তুমি তো কলকাতায় সারাটা জীবন কাটাচ্ছ! কখনও আমার মতো গ্রামেগঞ্জে থেকেছ? আমার মতো একলা রাত-বিরেতে নিরিবিলি জায়গায় কখনও ঘুরেছ?
নাড়ুবাবু টিপ্পনী কাটলে,–ঠিক বলেছ ভায়া। কলকাতা একটা মহানগর। সবসময় আলো, ভিড়ভাট্টা। এখানে ভূত আসবে কোন সাহসে?
কানুহরি চায়ের কাপপ্লেট ভর্তি ট্রে রেখে গেল। চা খেতে-খেতে তর্কটা ধামাচাপা পড়েছিল। কিন্তু নাড়ুবাবুই সেটা আবার খুঁচিয়ে দিলেন–জিতেন বলছে ভূত নেই। আর মুরারি বলছে আছে। বেশ তো! মুরারিই বলুক, সে কোথায় ভূত দেখেছে!
গোপালবাবু সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। বৃষ্টিটা বেশ জমে উঠেছে। মুরারি! তুমি গল্পটা বলল।
মুরারিবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন,–গল্প নয়। একেবারে সত্যিকার ঘটনা। বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ইচ্ছে।
নাডুবাবু বললেন কী বলছ ভায়া? আজ অবধি তোমার মুখে একটা মিথ্যা কথা শুনিনি। তুমি বলো। শোনা যাক।
তারপর তিনি জিতেনবাবুকে বললেন,–জিতেন! তুমি কিন্তু স্পিকটি নট। চুপচাপ বসে থাকবে।
মুরারিবাবু চা শেষ করার পর বললেন,–সে প্রায় বছর পনেরো-ষোলো আগের কথা। তখন আমি সরকারি চাকরি করি। নদিয়া জেলার বাবুগঞ্জে আমার অফিস। আমার কাজ ছিল ওই অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে ঘুরে সরকারি সাক্ষরতা প্রকল্পে কতটা কাজ হচ্ছে, তার হিসেব নেওয়া। বাবুগঞ্জ অফিসে একটামাত্র জিপগাড়ি ছিল। সেটা ব্যবহার করতেন আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার। আমি কখনও সাইকেলে, কখনও বাসে, আবার কখনও ট্রেনে চেপে বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াত করতুম।
নাড়ুবাবু বললেন, আহা! ভূত দেখার ব্যাপারটা বলো!
মুরারিবাবু একটু চটে গিয়ে বললেন, আগে ব্যাকগ্রাউন্ড না বললে তো বুঝবে
–ঠিক আছে। ব্যাকগ্রাউন্ড বোঝা গেল। এবার ভূতের ব্যাপারটা শোনা যাক।
মুরারিবাবু দরজার বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন,–মে মাসের মাঝামাঝি হবে। হ্যাঁ–সেদিন ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা। বাবুগঞ্জ থেকে ট্রেনে চেপে ঝাঁপুইহাটি নামে একটা গ্রামে গিয়েছিলুম। স্টেশনটা মাঠের মধ্যে। সেখান থেকে সাইকেলরিকশোয় গ্রামে পৌঁছলুম। তখন বেলা প্রায় বারোটা বাজে। মোটে চারটে স্টেশন দূরত্ব। ট্রেনের স্পিড কেমন তা বোঝো তাহলে! আসলে আগের বছর প্রচণ্ড বন্যা হয়েছিল। রেললাইন তখনও ঠিকমতো সারানো হয়নি।
গোপালবাবু বলে উঠলেন, কী কাণ্ড! তোমার ভূত আসতে বড্ড দেরি হচ্ছে মুরারি!
নাড়ুবাবু টিপ্পনী কাটলেন–সেই ট্রেনের স্পিডের মতো!
মুরারিবাবু বললেন, ঝাঁপুইহাটির পঞ্চায়েত-কর্তার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রাম করলুম। বিকেলে সাক্ষরতা প্রকল্পের কাজকর্ম খাতাকলমে দেখলুম। দু একজনকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডে নাম লিখতেও বললুম। কিন্তু বুঝতে পারলুম, খাতাকলমের সঙ্গে আসল কাজের মিল নেই। কী আর করা যাবে? মুখে উপদেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল। বাবুগঞ্জ ফেরার ট্রেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। পঞ্চায়েত কর্তা খাতির করে আমাকে তার মোটরসাইকেলে চাপিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। সাহস পেলুম না। রাস্তার যা অবস্থা!
নাডুবাবু গম্ভীরগলায় বললেন, ভূত!
–এবার সেই ঘটনায় আসছি। স্টেশনে পৌঁছে খোঁজ নিলুম। ডাউন ট্রেন সময়মতো আসার গ্যারান্টি নেই। স্টেশনে কয়েকজনমাত্র যাত্রী অপেক্ষা করছিল। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। খোলা জায়গা বলে উত্তল বাতাস বইছে। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে খালি বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরালুম।
গোপালবাবু বললেন, তুমি সিগারেট খেতে নাকি? কী করে ছাড়লে বলে তো মুরারি?
নাড়ুবাবু গম্ভীর গলায় ফের বললেন,–ভূত!
মুরারিবাবু বললেন,-বসে আছি তো আছি। সাতটা দশ বেজে গেল। ট্রেনের পাত্তা নেই। এমন সময় একটা লোক এসে বলল,-বেঞ্চিতে একটু বসতে পারি সার? লোকটার চেহারা আবছা দেখা যাচ্ছিল। পরনে খাটো ধুতি আর হাফশার্ট। পায়ে যেমন তেমন একটা স্যান্ডেল।
বললুম,–নিশ্চয় বসতে পারো। বেঞ্চটা তো খালি আছে। লোকটা বেঞ্চের শেষপ্রান্তে বসল। তারপর বলল, এখন যদি আমি একটা বিড়ি খাই, কিছু মনে করবেন না তো সার! এ তো দেখছি বিনয়ের অবতার। বললুম,–তুমি বিড়ি খাবে, তাতে আমার মনে করার কী আছে?
লোকটা পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন জ্বেলে বিড়ি ধরাল। ওই একটুখানি আলোয় দেখলুম, লোকটার মুখে খোঁচা-খোঁচা গোঁফদাড়ি আর বাঁদিকের গাল থেকে গলা অবধি ক্ষতচিহ্ন। তার মুখটা দেখে কেন যেন একটু অস্বস্তি জাগল। তার গায়ের রঙও কুচকুচে কালো। কেউ নিশ্চয় লোকটার গাল ও গলায় চপারের কোপ মেরেছিল।
গোপালবাবু বললেন, তাহলে লোকটা খুনখারাপিতে মরে যাওয়ার পর ভূত হয়েছিল?
মুরারিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,–আহা, পুরোটা বলতে দাও!
নাডুবাবু বললেন, হ্যাঁ, বলো।
মুরারিবাবু বললেন,–লোকটা বিড়ি টানতে-টানতে বলল,–সারের যাওয়া হবে কোথা? বিরক্ত হয়ে বললুম,-বাবুগঞ্জ। লোকটা কেমন অদ্ভুত শব্দ করে হাসল। তারপর বলল,-বাবুগঞ্জ? এ লাইনে এই এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। বাবুগঞ্জ থেকে আসবার ট্রেন পাওয়া যত সোজা, ফিরে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া তত কঠিন। দেখুন
ট্রেন কখন আসে। এমন হতে পারে এ রাত্তিরে ট্রেন আর এলই না। অবাক হয়ে বললুম,–সে কী! সে আবার সেইরকম বিদঘুঁটে হেসে বলল,–এই যে আমাকে দেখছেন। রোজ ঠিক সন্ধেবেলা বাবুগঞ্জ যাব বলে স্টেশনে এসে বসে থাকি। ট্রেন আর আসে না। রেলের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে সার! এতক্ষণে সন্দেহ হল, লোকটা নিশ্চয় পাগল। তাই চুপচাপ বসে রইলুম। লোকটা বকবক করে যাচ্ছিল। ইচ্ছে হল, তাকে ধমক দিয়ে উঠে যেতে বলি। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। বলা যায় না, কোনও গুণ্ডাবদমাশ হতে পারে। আমার হাতে একটা অ্যাটাচি কে। টাকা আছে ভেবে হয়তো সে এটা কেড়ে নিয়ে পালানোর ফিকিরে এখানে এসেছে। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে বসা আমার উচিত হয়নি। এই ভেবে উঠে যাব ভাবছি, স্টেশনে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজল। অমনি লোকটা বলল,–দেখছেন তো? বাবুগঞ্জের দিক থেকে ট্রেন আসছে। ওই দেখুন সিগন্যালবাতি নীল হল। লক্ষ করে দেখলুম, সত্যি তাই। লোকটা বলল,–এইজন্যে জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে সার! বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এ কী অবস্থা হয়েছে দেখুন। একটু পরে স্টেশনের কাছে কজন যাত্রীকে প্ল্যাটফর্মের সামনে যেতে দেখলুম। তারপর সত্যিই ডাউনের দিক থেকে ট্রেনের আলো দেখা গেল। তারপর ট্রেনটা হুইসল দিতে-দিতে স্টেশনে ঢুকছিল। এই সময় দেখলুম, বেঞ্চ থেকে লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। তারপরই ঘটে গেল ভয়ংকর ঘটনা। ট্রেনটা এসে আমার সামনে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে থামবার আগেই লোকটা ইঞ্জিনের সামনে লাইনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুরারিবাবু চুপ করলে নাডুবাবু বললেন,–এ তো সুইসাইড কেস। তোমার ভূত কোথায়?
জিতেনবাবু এতক্ষণে সকৌতুকে বলে উঠলেন, সবে তো লোকটা মারা পড়ল। ভূত হতে একটু সময় লাগবে না?
মুরারিবাবু তার কথা গ্রাহ্য করলেন না। তাকে এবার কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছিল। আবার একটা শাস ছেড়ে তিনি বললেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! অমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। ড্রাইভারের তো চোখে পড়ার কথা। কিন্তু কোনও হইহল্লা শুনলুম না। ট্রেনটা হুইসল দিয়ে দিব্যি চলে গেল। তখন আমি আতঙ্কে, উত্তেজনায় বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। লোকটার রক্তাক্ত হাড়গোড়ভাঙা লাশ নিশ্চয় নিচে লাইনে পড়ে আছে। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখতেও ভয় করছে। এমন সময় রেলের একচোখো লণ্ঠন হাতে একজন খালাসিকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলুম। সে ভেবেছিল আমি বিনা টিকিটের যাত্রী। আমার কাছে এসে সে টিকিট দাবি করতেই বললুম,–আমি যাব বাবুগঞ্জ। আমার টিকিট আছে। কিন্তু এক্ষুনি একটা লোক ওইখানে ইঞ্জিনের সামনে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছে।
সে অবাক হয়ে বলল,–সে কী? কখন?
বললুম, গিয়ে দেখো। লাইনে তার লাশ পড়ে আছে।
খালাসিটি লণ্ঠন হাতে প্ল্যাটফর্মের নিচে লাইনে আলো ফেলে এদিক-ওদিক দেখার পর বলল,–কোথায় লাশ? আপনি টিকিট কাটেননি। তাই আজেবাজে কথা বলে কেটে পড়ার তালে আছেন! খাপ্পা হয়ে তাকে আমার টিকিট দেখালুম।
তখন সে হাসতে-হাসতে বলল, আপনি ভুল দেখেছেন সার। মাথায় জেদ চেপে গেছে আমার। তাকে বললুম, লাশটা ইঞ্জিনের চাকার ধাক্কায় হয়তো দূরে ছিটকে গেছে। চলো। খুঁজে তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
গোপালবাবু বললেন, লাশ দেখতে পেলে?
–নাঃ! অনেক খোঁজাখুঁজি করে লাশ তো দূরের কথা রেললাইনে রক্তের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পেলুম না। আতঙ্ক আর অস্বস্তিতে আমার শরীর তখন অবশ। খালাসি বলল, ডাউন ট্রেন আসতে আজ একটু দেরি হবে সার। আপের স্টেশনে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এবার মালগাড়ি পাস হবে। তারপর ডাউন ট্রেন আসবে।
যাই হোক, সে স্টেশনের দিকে চলে যাওয়ার পর সেখানে দাঁড়াতে আর সাহস হল না। স্টেশনের কাছাকাছি একটা বেঞ্চের উপর গাছের ছায়া পড়েছিল। সেই বেঞ্চে গিয়ে বসলুম। তারপর দেখলুম, বেঞ্চের অন্য প্রান্তে কেউ বসে আছে।
নাড়ুবাবু বলে উঠলেন,–সেই লোকটা নয় তো?
মুরারিবাবু বললেন, তাঁঃ! সেই ব্যাটাচ্ছেলে! আমি যেই বসেছি, অমনি সে সেইরকম বিদঘুঁটে হেসে বলল, খালাসির সঙ্গে রেললাইনে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন সার? তখন আর ভয়-টয় নেই আমার। রাগে মাথায় আগুন ধরে গেছে। বললুম, তুমি দেখছি এক্কেবারে ম্যাজিশিয়ান! আমাকে ম্যাজিক দেখিয়ে ছাড়লে!
লোকটা বলল, না সার! ম্যাজিক জানলে তো কত টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়ে যেতুম। আসলে কী জানেন সার? বাঁচতে আমার আর একটুও ইচ্ছে নেই। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম,–তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়?
লোকটা বলল, কিছু মনে নেই। সব ভুলে গেছি। এবার মনে হল, লোকটা সত্যিই পাগল। আর তাকে যে আপ ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছিলাম, সেটা নিশ্চয় আমার চোখের ভুল। প্রচণ্ড শব্দ করে ট্রেনটা আসছিল। এ সময় ট্রেনের দিকেই আমার মনোযোগ থাকা স্বাভাবিক। লোকটার কথা শুনে আর হঠাৎ উঠে যাওয়া দেখে ব্যাপারটা আমি কল্পনাই করেছিলুম।
জিতেনবাবু হোহো করে হেসে উঠলেন। তাহলে কী দাঁড়াল? বলছিলুম না ভূতের ব্যাপারটা সাইকোলজিকাল। হ্যাঁলুসিনেশন!
মুরারিবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, আমার কথা এখনও শেষ হয়নি।
নাড়ুবাবু বললেন, তাহলে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলল। বৃষ্টি থেমে গেছে মনে হচ্ছে। বাড়ি ফিরতে হবে।
মুরারিবাবু বললেন, লোকটা আবার বকবক করতে থাকল। কান দিলুম না। একটু পরে দেখলুম, আপের সিগন্যাল নীল হল। স্টেশনমাস্টার বেরিয়ে এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একচোখো লণ্ঠনে নীল রঙের আলোটা নাড়তে থাকলেন। তারপর মালগাড়ির ইঞ্জিনের আলো দেখা গেল। আলোর দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর ইঞ্জিনটা যেই কাছাকাছি এসেছে, অমনই বেঞ্চ থেকে লোকটা আগের মতো উঠে দৌড়ে গিয়ে রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
গোপালবাবু বললেন, তারপর? তারপর?
–নাঃ! আমার চোখের ভুল নয়। মালগাড়িটা ধীরে-সুস্থে স্টেশন পেরিয়ে গেল। আমি তার আগেই বেঞ্চ থেকে উঠে স্টেশনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। স্টেশনের বারান্দায় কয়েকজন যাত্রী বিরক্ত হয়ে স্টেশনমাস্টারকে ঘিরে ধরে ডাউন ট্রেনের কথা জিগ্যেস করছে আর রেলদফতরের মুন্ডুপাত করছে।
নাড়ুবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন,–এই তোমার ভূত?
মুরারিবাবু বললেন, না। শেষটুকু শোনো। তবে না বুঝবে?
–বেশ। বলো।
বাবুগঞ্জ ফেরার ডাউন ট্রেন এল রাত প্রায় সাড়ে আটটায়। ট্রেনে ভিড় ছিল। তবে যে কম্পার্টমেন্টে উঠেছিলুম, একটা সিট পেয়ে গেলুম। ট্রেন ছাড়ল। একটা করে স্টেশন আসছে আর ভিড় একটু করে কঁকা হচ্ছে। বাবুগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছনোর আগে হঠাৎ দৃষ্টি গেল আমার বাঁ-দিকে একটু তফাতে। বেঞ্চের কোণে হেলান দিয়ে বসে আছে সেই লোকটা! হাসে-ই বটে। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ। গায়ে ছাইরঙা হাফশার্ট। পরনে খাটো ধুতি। বাঁদিকের গাল থেকে গলা পর্যন্ত দাগড়া-দাগড়া ক্ষতচিহ্ন। সে আমার দিকে এবার তাকাল। হিংস্র দৃষ্টি। চোখদুটো নিষ্পলক। আতঙ্কে আমার শরীর তখন প্রায় অবশ। দৃষ্টি সরিয়ে নিলুম। একটু পরে বাবুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোমাত্র আমার পিছনের দিকের দরজা দিয়ে নেমে গেলুম।
গোপালবাবু বললেন,–হ্যাঁ। তাহলে লোকটাকে ভূতই বলতে হবে।
নাড়ুবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, ভূত! হান্ড্রেড পারসেন্ট ভূত!
জিতেনবাবু বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,–ওহে গোপাল! আমি একবার বাথরুমে যাব।
গোপালবাবুর বাড়িটা পুরোনো আমলের। এই বসার ঘরের সংলগ্ন বাথরুম নেই। পিছনের দিকে এক টুকরো কঁকা জায়গায় ফল-ফুলের গাছ আর ঝোঁপঝাড় আছে। বাউন্ডারি পাঁচিল ঘেঁষে একটা বাথরুম আছে। সেদিকের দরজা খুলে বেরুলেন জিতেনবাবু। গোপালবাবু বললেন,–ওই সুইচ টিপে আলো জ্বেলে নাও জিতেন।
জিতেনবাবু বললেন, আমার আলোর দরকার নেই। তবে বৃষ্টিতে জায়গাটা পিছল হয়ে আছে। বলে তিনি ঘুরে এসে সুইচ টিপে দিলেন। তারপরই তার চিৎকার শোনা গেল। কে রে? কে ওখানে? কানুহরি? আঁ! এ কী! এ আবার কে? ওরে বাবা! কী সাংঘাতিক! গোপাল! গোপাল! গো-গো-গো-ও-ও!
সবাই সেই দরজা দিয়ে ছুটে গেলেন। জিতেনবাবু সিঁড়ির নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি জলে-কাদায় নোংরা। ধরাধরি করে তাকে ঘরে এনে চোখেমুখে জল ছেটানোর পর তার জ্ঞান ফিরে এল। তিনি অতিকষ্টে বললেন, হ্যাঁলুসিনেশন। মানে–মুরারির দেখা অবিকল সেই লোকটা ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।